সামবডি'জ আউট


আমার আর অর্চিষ্মানের একটা ঐকমত্যের জায়গা হচ্ছে মানুষ লাফেবলি, পিটিফুলি ট্রান্সপারেন্ট। একটা লোকের সঙ্গে পনেরো মিনিট কথা বললে তার পনেরোটা ইনসিকিউরিটি ধরে ফেলা সম্ভব। আমরা ভাবছি চমৎকার ঢাকাঢুকি দিয়ে রেখেছি নিজেকে, আসলে উদোম ঘুরছি।

তেমনি দুটো লোককে - যদি না তারা একেবারে অচেনা হয়, যদি দূরতম সম্পর্কের সুতো দিয়েও একে অপরের সঙ্গে গাঁথা থাকে - নিজেদের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকট করতে বা পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকতে দেখলেও প্রায় পুরো গল্পটা পড়ে ফেলা সম্ভব।

আড়চোখে তাকাতে দেখলে তো হয়েই গেল।

সবথেকে সহজপাঠ্য স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক। কারণ এই একটা সম্পর্কে নাতিশীতোষ্ণ বলে কিছু হয় না। হয় তুন্দ্রা, নয় থর। আঁচ গায়ে লাগবেই।

অর্চিষ্মান বলবে, ভ্যাট। সব স্বামীস্ত্রীর মধ্যে অত আঁচটাচ থাকে না। প্লেন অভ্যেস।

অ্যাপাথি? অনাগ্রহ? উদাসীনতা?

রাইট।

সেটা ধরা তো আরও সহজ। উদাসীনতা, প্রেম ও ঘৃণা দুইয়ের থেকেই তীব্র কাজেই প্রকটতর।

*

আমরা একটা বাংলা ভ্লগিং চ্যানেল দেখি মাঝে মাঝে। এই সব চ্যানেলে যা দেখায় - চিকেনমটন খাওয়া, শপিং মলে গিয়ে মশলার কৌটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পছন্দ করা আর জরিদার বেসবল ক্যাপ উল্টো করে পরে ভি দেখিয়ে ডাকফেস। একটা পোষা পাগ আছে, ভীষণ মজার।

এ সব বেশিদিন দেখা যায় না। কিন্তু না দেখে করব কী? কাজেই আমরা বিলা বিলা করি - মশলার কৌটোর থেকে যা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং - চ্যানেলের হোতা এবং হোতার বউয়ের সম্পর্ক। সম্পর্কের সাবটেক্সট, অবভিয়াসলি। ওপর ওপর তো সব হাংকি ডোরি।

বা নয়। আমরা ভাবছি মেক আপ-এ ব্রণ ঢেকেছি, কিন্তু ব্রণর কাজ তো শুধু গালের ওপর গণ্যমান্য গ্যাঁট হয়ে থাকায় নয়। মানুষের মতোই ব্রণর বেলাতেও অদর্শন ইজ নট অনুপস্থিতি। একবার ভুলে হাত লেগে যাক। আগাপাশতলা শিহরণ, চোখের ভেজন, শ্বাসের সশব্দ টানন। পরিপক্কতার ডিগ্রি বুঝে চোদ্দপুরুষকে সাশ্রু স্মরণ।

স্বামীস্ত্রীর ডায়নামিক্স ব্রণর মতো। মেকআপ ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে। স্পষ্ট দেখা যায় কার বাক্যের মাঝপথে প্রতিবার কে নিজের বক্তব্য গুঁজে দেয়। কার এককুচি প্রশংসা হলেই কার শরীর শক্ত। ক্যাজুয়াল রসিকতার ছুতোয় কার তূণ থেকে কোন তীর বারংবার ছুটে আসে।

প্রসেনজিতের দিয়ে যাওয়া মুড়িভাজা খেতে খেতে আমরা সে সব দেখি। কনুই মেরে অন্যকে দেখাই। 

দেখলে দেখলে?

সেদিনের ভ্লগের কনটেন্ট ছিল জন্মদিন। অতিথিসমাগম। বিরিয়ানিভোজন। গিটারসহকারে ব্যান্ডসংগীত। এইসব অ্যাড্রিনালিনপূর্ণ পরিস্থিতিতে অনেক সময় একে অপরের প্রতি সৌজন্য বোধ এবং প্রকাশ সহজ হয়। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম মেবি সত্যিই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সম্পর্কের হাওয়া তো ঘোরে।

তক্ষুনি একটা ক্যাজুয়াল রসিকতা। একজনের অট্টহাসি, অন্যজনের দপদপ রগ।

দেখলে দেখলে বলে অর্চিষ্মানকে খোঁচা মারতে গেলাম, অর্চিষ্মানও আমাকে সেই মুহূর্তে দেখলে দেখলে বলে খোঁচা মারল। কনুইয়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, সবে তো তিন, নেক্সট তিরিশ বছর একসঙ্গে থাকবে কী করে গো?

অর্চিষ্মান বলল, বুদ্ধি থাকলে থাকবে না। ছেড়ে দিয়ে বেটার সুটেড কাউকে খুঁজবে। বোকা হলে নরকযন্ত্রণা দীর্ঘায়িত করবে।

তারপর বলল, চেহারা দেখে যে গাধারা বিয়ে করে তারা কাইন্ড অফ ডিজার্ভ দিস।

*

সেদিন দেরিতে পৌঁছেছিলাম, ব্লু টোকাইয়ের সব সিট ভর্তি ছিল। মানে আমার পছন্দের প্রথম দুটো সিট। আমার তৃতীয় ফেভারিট সিট একটা টু-সিটার কাউচ যার এক পাশে হেবি মাঞ্জা দিয়ে কেউ বসে আছে। রেগুলার না। রেগুলাররা হেবি মাঞ্জা দিয়ে আসে না (ব্যতিক্রম আছে, সে ব্যতিক্রমই)। ভাবছি চতুর্থ ফেভারিট কিছু ফাঁকা পেলে বসব। না পেলে মাঞ্জা দেওয়া ব্লাডি টুরিস্টের পাশের সিট।

সিট খুঁজছি আর পেরিফেরাল ভিশনে টের পাচ্ছি মাঞ্জা দেওয়া ব্লাডি টুরিস্ট আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকেও তাকাতে হল। র‍্যান্ডম স্ট্রেঞ্জারের সঙ্গে চোখাচোখি আমার পঁয়তাল্লিশের অ্যাড্রিনালিন রাশ।

ধুস, লারিব। মানে লারিবের র‍্যান্ডম স্ট্রেঞ্জার না হওয়াটা ধুস, লারিব ধুস না। লারিব ভয়ানক লক্ষ্মী ছেলে। ইন্টারেস্টিংও। মানুষের ইন্টারেস্টিংনেসের একটা লক্ষণ হচ্ছে কনট্রাস্ট। যাকে দেখে যে রকম মনে হচ্ছে, আচমকা অন্যরকম কিছু ঝিকিয়ে ওঠা। লারিব এমনিতে ভদ্রসভ্যতার এপিটোম, বিনয়ের পরাকাষ্ঠা। একদিন লারিবের এক বন্ধু এসে লারিবকে জিজ্ঞাসা করছে, হাউ আর ইউ ডুয়িং? লারিব শুনি বলছে, বেটার দ্যান ইউ।

ক্যান্ডি ক্রাশের নখকামড়ানো ক্লাইম্যাক্স থেকে বেরিয়ে হাই ফাইভ দিতে হয়েছিল। নেক্সট দশ মিনিট ধরে আমরা এই ধরণের হাবিজাবি প্রশ্নের সম্ভাব্য মুহ্‌ তোড় জবাব নিয়ে ব্রেনস্টর্মিং করেছিলাম। দুজনেই একমত হয়েছিলাম হাবিজাবির মধ্যেও হাবিজাবিতম হচ্ছে হোয়াট ডু ইউ ডু। কারণ এটা প্রশ্ন নয়। এটা হচ্ছে ক্যাপিটালিস্ট কাস্ট সিস্টেমে মানুষকে প্লেস করার নির্লজ্জ ফিতে।

লারিবের খুব শখ, যখন র‍্যান্ডম কেউ জিজ্ঞাসা করবে, সো, হোয়াট ডু ইউ ডু? ও বলবে, নান অফ ইয়োর বিজনেস। 

লারিবের মুখ আঁধার হল। জানি সত্যি সত্যি বলতে পারব না। অত সাহস নেই।

বললাম, ওর থেকে বেটার উত্তর একটা ইন্টারনেটে দেখেছি। ট্রাই করে দেখতে পার। সাহসও কম লাগবে মনে হয়। বলবে, আই ডু মাই বেস্ট।

এবার লারিব আমাকে হাই ফাইভ দিল।

*

চোখাচোখি হতে লারিব পাশের খালি সিটের দিকে ভুরু নাচাল। ব্যাগ নামাতে নামাতে বললাম, তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে - এই পর্যন্ত গিয়েই বুঝেছি ইনটেনশন এক্সিকিউশনে ফাঁক থেকে যাচ্ছে কিন্তু ততক্ষণে বেইমান ব্রেন বাক্যরচনা সম্পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে - যে চিনতেই পারিনি।

*

অর্চিষ্মান যখন চেহারা দেখে বিয়ে করাকে গাধামোয় পর্যবসিত করল, ওরও কি বাক্যের মাঝপথে পৌঁছে দ্বিধা জেগেছিল? মনে হয়েছিল, বাক্য সম্পূর্ণ করলে কুন্তলার মাথায় নিম্নলিখিত চিন্তার পারম্পর্য শুরু হতে পারে?

অর্চিষ্মান গাধা নয়। কাজেই অর্চিষ্মান চেহারা দেখে বিয়ে করেনি। অর্থাৎ অর্চিষ্মান চেহারা অগ্রাহ্য করে বিয়ে করেছে। অর্চিষ্মান কুন্তলাকে বিয়ে করেছে। তার মানে কুন্তলার চেহারা গ্রাহ্য করার যোগ্য না।

অর্চিষ্মানের কি চিন্তা হয়েছিল, এই পারম্পর্যের শেষে পৌঁছে কুন্তলার অতিকষ্টে চাপাচুপি দেওয়া চেহারাসংক্রান্ত ইনসিকিওরিটি আবারও দপ করে উঠবে?

আমি শিওর হয়নি। কারণ এই সব সুপারফিশিয়াল ইনসিকিওরিটিকে আতুপুতু করা অর্চিষ্মান মন থেকে অপছন্দ করে। এ সব সেলফ পিটি পনেরো বছর বয়সে যদি বা অ্যালাউ করা যায়, পঁয়তাল্লিশে জাস্ট আনঅ্যাকসেপ্টেবল।

আই কাইন্ড অফ এগ্রি।

*

কথাটা হচ্ছে অর্চিষ্মানের মতে চেহারা দেখে বিয়ে করা যদি গাধামো হয় তাহলে কী দেখে বিয়ে করা মনুষ্যোচিত।

জানি না। সম্ভবতঃ বোধবুদ্ধির মিল। কমন রেঞ্জের ওয়ার্ল্ডভিউ। কাটা ঘুড়ি থেকে ভেজা গামছা - জীবনদর্শনের বর্ণচ্ছটায় কাছাকাছি বিন্দুতে অবস্থান।

অধিকাংশ লোকেই (চেহারা প্রায়োরিটাইজ করা গাধারা ছাড়া) এই সব দেখেই বিয়েশাদি করে। তফাৎ হয় এ সব ধোঁয়াধোঁয়া ভাসাভাসা অ্যাট্রিবিউটগুলোর প্রক্সির পছন্দে। কেউ জন্মমুহূর্তে গ্রহতারার অবস্থান প্রক্সি নেয়, কেউ পদবী, কেউ বাড়িগাড়ি, কেউ ভোটের রং, সিনেমার পছন্দ, বইয়ের রুচি।

অর্চিষ্মানের প্রক্সি নিয়ে অনেক আগে যখন কথা হয়েছিল বলেছিল, ওর চিরকাল মনে হয়েছে বাংলা গল্পের বই পড়েছে এমন কারও সঙ্গে থাকতে হয়তো ওর সুবিধে হবে। ভালোও লাগতে পারে।

*

আমার প্রক্সি? সিরিয়াসলি বলব? আমি অত কিছু ভাবিটাবি না। ভাবার প্র্যাকটিস আমার নেই। তলিয়ে ভাবা, চুলচেরা বিশ্লেষণ, তুল্যমূল্য বিচার - শুনলেই আমার হাই ওঠে। বোর হয়ে যাই। মুড খারাপ হয়ে যায়। ইন্টারনেটে মহাপুরুষরা যে রিলের পর রিল ধরে মুখে ফেনা তুলে চলেছেন, জীবনের সবথেকে ক্রুশিয়াল সিদ্ধান্ত হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্গী নির্বাচন, সে সিদ্ধান্তও আমি হুট বলতে নিয়েছি।

লম্বা, রোগা, ভদ্রসভ্য, জাতধর্মলিঙ্গবর্ণের পরিচয়কে পাত্তা দেয় না, লাজুক কিন্তু আত্মবিশ্বাসী, কথা প্রায় বলেই না, বললে ভেবে ও নিচু ভলিউমে বলে, নিজের প্রিভিলেজ ভোলে না, এনটাইটলমেন্টে ভোগে না, বঞ্চনার আগুনে পোড়ে না, প্রতিবাদে ফাটে না, স্পেশাল হওয়ার ঠেলা নেই, নিজের ভ্যালিডেশন নিজেই জোগাতে পারে, হাসায় না অথচ হাসির কথায় হো হো হাসে।

অর্চিষ্মানের এই ক'টা বৈশিষ্ট্য দেখেই আমি এমন উল্টে পড়েছিলাম যে বাঙালি হয়ে জন্মে একলাইনও কবিতা না লেখা, লেখার কথা মাথাতেও না আনার রেড ফ্ল্যাগটা চোখ বুজে পেরিয়ে গেছিলাম।

তবে অত চোখ খুলেই বা কী হবে। আনপপুলার ওপিনিয়ন, কিন্তু চোখ বুজে ঝাঁপানো জীবনের পথে চলার জন্য এমন কিছু বাজে স্ট্র্যাটেজি নয়। হ্যাঁ, অধিকাংশ সময়েই হয়তো কাদায় পড়বেন, কিন্তু সর্বক্ষণ কাদা বাঁচিয়ে চলা ইজ ওভাররেটেড।

জীবনে যা যা ভুল সাহস করে করে উঠতে পারলাম না তাদের অনুতাপ, অন্যকে না চটানোর ভয়ে যা যা মেপেজুপে ঠিক করে করতে হল তাদের সান্ত্বনার থেকে তীব্র হবে। ইন্টারনেটে পড়া/শোনা যে দু'টো কথা বিশ্বাস করি তার মধ্যে এটা একটা। আর একটা হচ্ছে - নোবডি ইজ কামিং টু সেভ ইউ।

কাজেই অত মাপামাপি করবেন না। যা ইচ্ছে করছে করে ফেলুন। কনসিকোয়েন্স পরে হ্যান্ডল করা যাবে। হ্যান্ডল না করা গেলেই বা কী? মনে রা্‌খবেন, সব কনসিকোইয়েন্সোঁ কা কনসিকোয়েন্স গঙ্গার ধারে গাঁদার মালা হাতে অপেক্ষা করছে। ঘড়ি দেখছে, হাঁটু নাচাচ্ছে, বাদামভাজা খাচ্ছে আর চতুর্দিকে খোসা ছড়াচ্ছে।

*

অর্চিষ্মান সিলেবাসের বাইরের বাংলা পড়ার কমপ্যাটিবিলিটি চেয়েছিল, প্যারাডক্সিক্যালি, ওর দুটো চিরকালের প্রিয় হয়ে ওঠা বই, যা আমি ওকে পড়িয়েছি, দুটোই ইংরিজি। একটা বেল জার। অন্যটা ঠিক বই নয়, কমিক্স।

অর্চিষ্মান কমিক্স পছন্দ করে। আমি করি না। অর্চিষ্মান পরপর টিনটিন পড়ে যেতে পারে, টিনটিন শেষ  হলে অরণ্যদেব, অরণ্যদেবের পর অ্যাসটেরিক্স। আমি বোর হয়ে যাব। গল্পের মধ্যে অত ছবিছাবার ডিসট্র্যাকশন আমার পছন্দ নয়। সকলেই দাবি করেন তাঁরা ভিশুয়াল, আই গেস আমি নন-ভিশুয়াল। ভাবুন তো, পথের পাঁচালী কেউ পুরোটা এঁকে এনে পড়তে দিলে? বা প্রথম প্রতিশ্রুতি? হাঁদাভোঁদা নন্টেফন্টে পড়েছি সে শুকতারাতে ছিল বলে। ম্যানড্রেক পড়েছি আনন্দবাজারের কোণায় থাকত বলে। ফেলুদা কমিক্স, রাপ্পা রায় - সবই ওই ভাবেই, ওই জন্যই পড়েছি। আমি মনে করি ছবি আমার পাঠের অভিজ্ঞতা খাটো করে।

বা এত গভীর কিছু না। নাকতলার মাবাবা অর্চিষ্মানকে কমিক্স কিনে দিয়েছিলেন, আমার মাবাবা দেননি। অভিভাবক হিসেবে তাঁদের এই গ্রস নেগলিজেন্স অতিক্রম করতে বড় হয়ে নিজ দায়িত্বে একটাদুটো কমিক্স পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। করে বুঝেছিলাম কমিক্স জিনিসটা পান্তাভাতের মতো। শাহরুখ খানের মতোও হতে পারে। ছোটবেলায় ভালো না লাগিয়ে ফেললে বড়বেলায় ভালো লাগানো অসম্ভব।

কিন্তু সেই একটাদুটো কমিক্সের একটাই আমাকে তাঝ্বিম মাঝ্বিম করে দিয়েছিল। প্রেক্ষাপট চরম অকমিক্সসুলভ। নো সুপারহিরো। নো সেভিং দা ওয়ার্ল্ড। নো দুষ্টের দমন শত্রুর পালন। হবেই বা কী করে কারণ কমিক্সের হিরো এক ছ’বছরের বালক। বাড়িতে নিঃসঙ্গ। স্কুলে নির্বন্ধু। সে ছেলের যা আছে, দরকারের থেকে কোটিগুণ বেশিই, তা হল কল্পনা। সেই কল্পনা দিয়ে সে নিজের তুলোপোরা বাঘকে জ্যান্ত করে তুলে তার সঙ্গে বিশ্বের অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ায়। যে বাঘ বলে, I don’t know which is worse: that everyone has his price, or that the price is always so low.

*

অর্চিষ্মান কমিকস কনোসিওর জেনে যতটা দমেছিলাম, ক্যালভিন অ্যান্ড হবস পড়েনি শুনে ততটাই চেগেছিলাম। কারণ এই একটা ব্যাপার দিয়ে ইমপ্রেস করা প্রায় শিওর শট। অর্চিষ্মানের প্রথম জন্মদিন ছিল আমাদের পরিচয়ের পঁচিশ দিন পর। যত ডেসপারেটই হই না কেন তখন উপহার দেওয়া যায় না। হাতের ওপর বসে দুলতে দুলতে এক বছর পঁচিশ দিন কাটল। লাফিয়ে অর্চিষ্মানকে জন্মদিনে ক্যালভিন অ্যান্ড হবস উপহার দিলাম। অর্চিষ্মান পড়ল এবং মুগ্ধ হল। মুগ্ধতা মূলতঃ বিল ওয়াটারসনের প্রতিই কিন্তু আমার দিকেও কি দু'এক ছিটে আসেনি?

কোনও শিল্পকর্মের দ্বারা দু'ভাবে ইমপ্রেসড হওয়া যেতে পারে। এক, এটা এরা ভেবে ফেলল কী করে, আমি তো ভাবিনি, যদিও ভাবা উচিত ছিল। দুই, এরা আমার ভাবনাটা পড়ে ফেলল কী করে, আমি তো কাউকে বলিনি।

ক্যালভিন অ্যান্ড হবস-এর ক্ষেত্রে অর্চিষ্মানের দ্বিতীয়টা হয়েছিল। পাটুলি থেকে শুরু করে পঁচিশ বছর জীবনের পথে হেঁটে যে নির্যাস অর্চিষ্মান ছেনে তুলেছিল, একটি মিডওয়েস্টার্ন অ্যামেরিকান ছ'বছরের কিডের সঙ্গে তা বর্ণে বর্ণে মিলে গেল কী ভাবে?

That's one of the remarkable things about life. It's never so bad that it can't get worse.

There's never enough time to do all the nothing you want.

এবং লাস্ট বাট দা মোস্ট ইমপরট্যান্টঃ I find my life easier the lower I keep everyone's expectations.

*

অর্চিষ্মান চব্বিশে বুঝেছিল, আমার পঁয়তাল্লিশ লেগেছে। অন্যের নয়, আমাকে ভোগাচ্ছে নিজের এক্সপেক্টেশন। ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে একাই গণপেটাচ্ছে।  

পঁয়তাল্লিশে কনফার্ম হলাম, আঁচ পেয়েছিলাম চল্লিশেই। তখন থেকেই এক এক করে প্রত্যাশার দেউটি নেভাতে শুরু করেছি। মাসছয়েক আগে মুরথলেরটা নেভালাম। দুজনে মিলে মাঝরাতে মুরথল গেছিলাম আমার ধারণা তিন বছর হয়েছে, আড়াই তো হয়েছেই। অবান্তরে পোস্ট দিয়েছিলাম কি না শিওর হতে পারছিলাম না। হাঁচলেও অবান্তরে লিখতাম তখন, সেই লজিকে ধরে নিচ্ছিলাম লিখেছি। এই পোস্টে কীভাবে মুরথল যাওয়ার বর্ণনা দেব ভাবতে গিয়ে ভাবলাম লিখি সবাই অন্য কোথাও যাওয়ার পথে মুরথলে যায়, কেউই শুধু মুরথলে যায় না। ঠিক যেমন সবাই কলকাতা যেতে গেলেই হাওড়া যায়, হাওড়া যেতে চেয়ে হাওড়া যায় না।

মনে পড়ে গেল। এক্স্যাক্ট এই তুলনাটা আগের পোস্টে টেনেছিলাম। তিন বছরে আমার মাথা বেটার তুলনা টানতে পারছে না সেটা দুঃখের নাকি তিন বছর আগেই পারফেকশন হিট করে ফেলেছি সেটা আনন্দের?

মুরথল এমন কিছু হাতিঘোড়া ব্যাপার নয়, দিল্লি হরিয়ানার বর্ডারে একটা খাঁ খাঁ জায়গা যেখানে পাহাড়ের মতো বড় বড় সব ধাবায় গাড়িওয়ালারা থেমে পরান্ঠা খায়। মুরথলের স্পেশালিটি হচ্ছে পরোটার সঙ্গে হোমমেড সাদা মাখন কিন্তু ব্যাপারটা মাখনের থেকে এককোটিগুণ কম তেলতেলে আর হালকা। আমার আর অর্চিষ্মানের ধারণা এটাকেই ননী বলে। জানি না, ভুল হতে পারি।

ননীফনিতে আমার ইন্টারেস্ট নেই, কমার্শিয়ালাইজড মাস-প্রোডিউসড পরান্ঠাও ওভাররেটেড লাগে। ওভাররেটেড নয় যেটা সেটা হল অর্চিষ্মানের সঙ্গে গভীর রাতে ট্যাক্সি চড়ে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার যাওয়া, টেবিলে পাশাপাশি বসে খাওয়া, হাহাহিহি পিএনপিসি, আবার ফিরতি পথে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। আগের বার ফিরতে ফিরতে দিল্লির আকাশ আলো হতে দেখেছিলাম কিন্তু সে বোধহয় গরমকাল ছিল। এখন ঘুটঘুটেতে বেরিয়ে ঘুটঘুটেতেই ফিরতে হবে।

দু'বছর ধরে ঠেলছি, আবার একবার মুরথল যাই চল। অর্চিষ্মান আদৌ শুনতে পাচ্ছে কি না সেটাই বুঝতে পারছি না। ছ'মাস আগে একদিন রাত তিনটের সময় বেল বাজল। দরজা খুলে দেখি অর্চিষ্মান। এ হাতে লাল সুটকেস, ও হাতে আলপনা আঁকা টবে রঙিন পাতার দোমড়ানো গাছ। গাড়িতে আনতে আনতে নাকি দুমড়ে গেছে। গাছ আমার হাতে চালান করে অর্চিষ্মান বলল, রাস্তায় যা একটা হল যদি জানতে।

হোল্ড ইয়োর থট! বলে গাছ নিয়ে বারান্দায় গেলাম। জল দিয়ে, কঞ্চি গুঁজে সোজা করে, বাকি গাছদের ঘুম ভাঙিয়ে, নতুন ক্লাসমেটকে মর‍্যাল সাপোর্ট ও আরও যা যা লাগবে সেই দিয়ে চাঙ্গা করতে বলে, ঘরে এসে দু'কাপ চা নিয়ে অর্চিষ্মানকে গিয়ে বললাম, নাও, এবার বল।

অর্চিষ্মান হিসার না কোথায় গেছিল, ঠিক হিসারও না, হিসার থেকে ডানদিকে বেঁকে একটা গ্রামে। পঞ্চায়েতপ্রধানের বাড়ির চৌকিতে বসে হোমমেড পরোটা আর গৃহপালিত ভঁইসের দুধের লস্যি খেয়ে ফিরেছে। শত দামি হোটেলে শত টাকা দিলেও ও জিনিস পাওয়া যাবে না কুন্তলা। আর হরিয়ানভি হসপিট্যালিটি? আনম্যাচড। অত আদরযত্ন খাওয়াদাওয়ার পর আবার এমন সুন্দর গাছের গিফট। যাই হোক, খেয়েদেয়ে গাছ নিয়ে অর্চিষ্মানরা চুয়াল্লিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ফিরছিল। ফিরতে ফিরতে মাঝরাতে মুরথলের কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি স্লো হল। ফোন থেকে চোখ তুলে অর্চিষ্মান দেখে ডিভাইডারের ওপাশে পুলিসের জিপের জটলা। তাদের হেডলাইটের হলুদ আলোর বিমের সঙ্গমে কাত হয়ে শুয়ে আছে একটা কাটা মুণ্ডু।

ধড়ের চিহ্নমাত্র নেই।

*

হোয়াট!

সিরিয়াসলি।

তুমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলে?

না দেখার অপশন ছিল না কুন্তলা। চোখ সরানোর আগেই বুঝে গেছি জিনিসটা কী।

অন্যান্য জানালা দিয়ে সহকর্মীরাও দেখেছে যে রক্ষা। ওই পরোটা আর লস্যির পর মাঝরাতে যা দেখছে ঠিক দেখছে কি না সে নিয়ে সংশয় করতে হয়নি। অর্চিষ্মান প্রথমটা ভাবছিল অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে, সহকর্মীরা বলেছে, পাগল হো কেয়া? কিতনা ক্লিন কাট দেখ রহে হো? হান্ড্রেড পারসেন্ট মার্ডার। মার্ডার করে কেটেকুটে এস ইউ ভি-তে তুলে এক এক করে বডি পার্টস ছড়াতে ছড়াতে গেছে।

*

কাটা মুণ্ডুর গল্প শেষ করে, সকাল আটটায় দরকার হলে গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলেও ডেকে দিয়ো কুন্তলা, ভীষণ কাজ, বলে অর্চিষ্মান ঘুমিয়ে পড়ল। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, মুরথলের আশাও গেল। পাহাড়ে গেলে এন এইচ চুয়াল্লিশ এড়ানো প্রায় অসম্ভব, কাজেই কাটা মুণ্ডু দেখে ফেলার সম্ভাবনা থেকেই যায়। দেখে ফেললেও, হিমালয় ভুলিয়ে দেবে হোপফুলি। কিন্তু এ রিস্ক নিয়ে মুরথলে পরোটা খেতে যাওয়া যায় না।

তার পর থেকে একা থাকলে মাঝে মাঝে মুরথলের কথা মনে পড়ত। আগেরবার গভীর রাতে ট্যাক্সি চড়ে যেতে কেমন মজা হয়েছিল, রাত দুটোর সময় আলুপরোটা খেয়ে কেমন চোঁয়া ঢেকুর উঠেছিল, চারটের সময় ফিরতে ফিরতে কেমন দিল্লির আকাশ আলো হতে দেখেছিলাম। মন কেমন কেমন হত। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ বছরে বুঝেছি দুঃখই স্বাভাবিক আর ডক্টর সুস-ই সত্যি।

Don't cry because it's over, smile because it happened.

*

শুক্রবার সকালে উঠে অর্চিষ্মান শূন্যদৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। একটা অনন্ত দিন খাঁড়া উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মা গো।

অফিসের পর অর্চিষ্মানের মাঝরাত পর্যন্ত মিটিং। সূর্যাস্তের পর বাড়িতে থাকাই পছন্দ করি, কিন্তু অর্চিষ্মানের কাজের বান ডাকলে নয়। নিজে সারাদিন ক্যান্ডি ক্রাশ খেলি বলে অন্যকে কাজ করতে দেখলে আমার প্যালপিটেশন হয়। সন্ধে ছ’টা বাজতে পাঁচে বাড়ি ঢুকলাম, ছ’টায় প্রসেনজিৎ ঢুকল, ছ’টা পনেরোয় অর্চিষ্মান। ছ’টা কুড়িতে আদা চা নিয়ে এল প্রসেনজিৎ। ছ’টা পঁয়তাল্লিশে বিছানায় পেপার পেতে আলুপরোটার থাক রেখে গেল। দু’হাজার পঁচিশের বাঙালির পারস্পেক্টিভ থেকে উনিশশো পঁচাত্তরের ফেলুদার মনোজ্ঞ মূল্যায়ন শুনতে শুনতে দু'জনে সে থাক থালায় মিশিয়ে ফেললাম। অর্চিষ্মান বাঘের মতো লাফিয়ে ল্যাপটপ বার করল, আমি প্রসেনজিতের ঘর মোছার বালতির হার্ডল পিটি ঊষার মতো টপকিয়ে ব্লু টোকাইতে চলে এলাম।

সাড়ে দশটা নাগাদ ভয় ও শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ঢুকে দেখি মিটিং শেষ, হিটার চালিয়ে, কম্বল থেকে মুণ্ডু বার করে অর্চিষ্মান টানটান শুয়ে আছে। জুতো, ব্যাগ, সোয়েটার ঘরের বিভিন্ন কোণায় ছুঁড়ে অর্চিষ্মানের পাশে মুণ্ডু বার করে সেঁধিয়ে গেলাম। অর্চিষ্মান বলল, রেডি? আমি বললাম, স্টেডি। অমনি অর্চিষ্মান কম্বলের তলা থেকে একটা আঙুল বার করে বুকের ওপর রাখা রিমোটের বাটন টিপে স্ক্রিন আনপজ করল।

নেটফ্লিক্সে নাইভস আউট সিনেমা সিরিজের তৃতীয় সিনেমা, ওয়েক আপ ডেড ম্যান। এ সিরিজের সমস্যা হচ্ছে বড় বেশি রাইট উইং-এর দমন, প্রগতিশীলের পালন। নাইভস আউট ভালো লেগেছিল, সিরিজের সেকেন্ড সিনেমা গ্লাস ওনিয়ন রীতিমত বাজে, ওয়েক আপ ডেড ম্যান অনেকটা সামলালো। ডিটেকটিভ সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা ফাস্টেস্ট ফিংগার ফাস্ট খেলি। কে আগে বলতে পারে কে ভিকটিম কে খুনী। অর্চিষ্মান খেলাটাকে রিডিকিউলাস জায়গায় নিয়ে গেছে, ফার্স্ট সিন থেকে শুরু করে। কোনদিন মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের লোগো দেখে বলবে সিংহ খুনী। 

ফার্স্ট সিন না হলেও, সিনেমা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা ভিকটিম ধরে ফেললাম এবং ধরলাম কাঁটায় কাঁটায় একসঙ্গে। লোকটা সিনে ঢুকেছে কি ঢোকেনি, দুজনে চেঁচিয়ে উঠেছি, এ মরবে! কম্বল থেকে হাত বার করে হাই ফাইভ দিতে হল।

খুনী কে সেটা অর্চিষ্মানের অনেএএএক আগে আমি ধরে ফেললাম এবং পারফেক্ট ধরলাম। ড্যানিয়েল ক্রেগ যখন লাস্ট সিনে সেই খুনীকেই সবার সামনে ধরে দিচ্ছেন আর আমি অর্চিষ্মানের নাকের ঠিক ডগায় কাঁচকলা দেখাচ্ছি, অর্চিষ্মান বলল, আগেও খেয়াল করেছি কুন্তলা, বাজে মিস্ট্রির সমাধানে তোমার মাথা আশ্চর্য দ্রুত খেলে।

এই সব খেলাধুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে উল্টোপক্ষের ঘুমিয়ে পড়া প্রতিহত করা। একা জেগে নাইট শো-তে সিনেমা দেখে কোন সাইকোপ্যাথ? অর্চিষ্মান ছাড়া কেউ না। একা একা দিল্লির এই ঠাণ্ডায় এগারোটার শো-য়ে ধুরন্ধর দেখে এসেছে। সিনেমাহলে ব্যাং নাচলেও 'যাই কুন্তলা দেখে আসি, তুমি নিশ্চয় যাবে না,' বলে কোনদিন হাঁটা দেবে। অন্ধকার হল, পপকর্নের গন্ধ, বিরাট পর্দায় দৈত্যাকৃতি রূপবান রূপবতীরা কান ফাটিয় হাসছেন কাঁদছেন নাচছেন গাইছেন কুরুক্ষেত্র বাধাচ্ছেন - অর্চিষ্মানের কোর কমফর্ট।

আমার হল ভালো লাগে না। বই টানা পড়তে পারি কিন্তু সিনেমা যত ভালোই হোক দু'ঘণ্টার বেশি অন্ধকারে মুখে বড়া দিয়ে বসে থাকতে হাঁসফাঁস হয়ে যাই। ভিশুয়াল নন-ভিশুয়ালেরই কিছু সমস্যা হয়ে থাকবে। তাছাড়া হলের পরিবেশও তো চমৎকার। সবাই মিনিটে মিনিটে ফোন তুলে বলছে, আই অ্যাম ইন দা মুভিজ, কান্ট টক নাউ। এনিথিং ইমপরট্যান্ট? নাথিং? আর ইউ শিওর? সোচ লো, জলদি নেহি হ্যায়। নাচোস স্যান্ডউইচের ননস্টপ সিট ডেলিভারি। সিটের পিঠে লাথি যদি ছেড়েই দিই।

তার থেকে অনেক ভালো বাড়িতে সিনেমা দেখা। ন্যাতাকানি পরে, অর্চিষ্মানের পাশে শুয়ে বসে সিনেমা দেখা। মাঝপথে থামিয়ে উঠে চা নেওয়া যায়, চানাচুর নিতে গিয়ে ইনভেরিয়েবলি খালি বয়াম আবিষ্কার করে ব্লিংকিট থেকে আনানো যায়।

সবথেকে লোভের, কন্টিনিউয়াস কথা বলে যাওয়া যায়। ফুটবল ম্যাচের কমেন্টারির মতো সিনেমারও ধারাবিবরণী। ধারাবিবরণী মুলতঃ আমিই দিই। তাৎক্ষণিক রিভিউ। অর্চিষ্মান এমন ভঙ্গি করে যেন ওর ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। ফিল্মের ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিশিয়েশনে টান পড়ে যাচ্ছে। রিমোট বাগিয়ে সিনেমা পেছোয়। উফ, কুন্তলা তোমার টিপ্পনী শুনব না সিনেমা শুনব? আমার মোনোসিলেবিক টিপ্পনীতে নাকি ওর পনেরো মিনিটের সিনেমা মিস হয়ে গেছে।

এদিকে আমি দেড় মিনিট চুপ করে থাকলে, কী গো ঘুমোচ্ছ নাকি? বলে ধাক্কানি। আমি বলি, না রে বাবা না। সোয়া মিনিট ওর সাড়া না পেলে আমি ঠেলা মরি। জেগে আছ? অর্চিষ্মান বলে, হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ।

সিনেমা শেষ। ক্রেডিটস দেখাচ্ছে। সিনেমাটা সম্পর্কে একটা শেষ কথা বলে পাশ ফিরে ঘুমোনোর উপক্রম করছি, আমার শেষ কথার উত্তরে অর্চিষ্মানের কোনও কথা নেই।

কী গো?

ক্রিকেটস্‌।

অর্চিষ্মান? অর্চিষ্মান! 

কতক্ষণ একা একা জেগে সিনেমা দেখছি? অর্চিষ্মান!!!!

হ্যাঁ হ্যাঁ। অত চেঁচিয়ো না।

ঘাপটি মেরে আছ কেন?

ভাবছি।

কী ভাবছ?

ভাবছি এখন মুরথল গেলে কেমন হয়। যাবে?

*

ঘরের ভেতরে হিটার, বাড়ির বিছানা, লেপ, লেপের নিচে ন্যাতাকানি পরে আমরা। বাইরে ডিসেম্বর মাসের রাত বারোটা বেজে পাঁচ, তাপমাত্রা দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফিলস লাইক আট, কাঠবেকারেরা এ কিউ আই-এর আতংকে দিল্লিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসছে না, হাইওয়েতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ক্লিন-কাট মুণ্ডু।

তবু অর্চিষ্মান কেন মুরথল যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে? দু'বছর ধরে আমার শত অনুনয়বিনয়ে কান না দেওয়া সত্ত্বেও?

কারণ আমি মন থেকে মেনে নিয়েছি আমার আর কোনও দিন মাঝরাতে ট্যাক্সি চড়ে মুরথল যাওয়া হবে না, তেলতেলে পরোটা খাওয়া হবে না, চোঁয়া ঢেকুর তুলে ফিরতে ফিরতে সূর্যোদয়ে আকাশ আলো হতে দেখা হবে না। অর্চিষ্মানের আকাশ থেকে প্রত্যাশার মেঘ কেটে গেছে। এখন অর্চিষ্মান ইজ রেডি টু ডেলিভার।

*

আরও দু’বার কনফার্ম করলাম। সত্যি বলছ? মন থেকে যেতে চাও? নাকি আমি ঝুলোঝুলি করেছি বলে? আমার কিন্তু সত্যিই না গেলেও হবে। অন গড ফাদার মাদার।

তিনবারের বার অর্চিষ্মান উঠে প্যান্ট পরতে শুরু করল।

আমিও ঘরের বিভিন্ন কোণ থেকে জামাকাপড় কুড়িয়ে অঙ্গে তুললাম। চুল আঁচড়ালাম। টিপ দুল ঘড়ি। পার্স, ডেটলের হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ট্র্যাভেল প্যাক - ব্যাকপ্যাক থেকে বার করে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাগে পুরলাম। আর জোয়ানের শিশি। মনে করে জোয়ানের শিশি।

বারোটা বাইশে রোহিত কুমার সিংজি ইন্টারসিটি উবার নিয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। সি আর পার্কের সব গেট বন্ধ হয়ে গেছে, এঁকেবেঁকে ঘুরপথে অবশেষে রিং রোড। সিটবেল্টের অ্যালার্ম ফুল ফোর্সে পিঁ পিঁ করছে। শুধু ড্রাইভার বেল্ট পরলে হবে না, পেছনের সিটের লোকদেরও পরতে হবে। উবার খুবই অ্যাডভান্সড হয়ে গেছে, একদিন অটোতেও এক মহিলা কম্যান্ডিং কণ্ঠে আমাকে বেল্ট পরার নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

আমি পাত্তা দিচ্ছিলাম না, রোহিতজিও বলছিলেন অভি বন্ধ হো যায়েগা, অর্চিষ্মান হঠাৎ বিচলিত হয়ে পড়ল। কুন্তলা, বেল্ট পরো বেল্ট পরো। বলে খটাস করে নিজের বেল্ট আঁটলো। বুঝলাম, ওর মাথায় রাতের এন এইচ চুয়াল্লিশ ভেসে উঠেছে। এন এইচ চুয়াল্লিশ, পুলিসের জিপ, জিপের হেডলাইট। আমার বেল্ট লাগছে না। আমি চেষ্টা করলাম, অর্চিষ্মান চেষ্টা করল। তারপর বলল, কুন্তলা তুমি এদিকে এসো। আমি ওদিকে যাচ্ছি।

কোনও দরকার নেই। নিজের মুণ্ডুর বদলে অর্চিষ্মানের মুণ্ডু গড়াগড়ি খেলে ইউটিলিটি যে নগণ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, চলন্ত গাড়িতে সিট বদলাবদলি পোষাবে না।

অর্চিষ্মান আরও দু'বার ঠেলাঠেলি করে আমার বেল্ট লাগিয়ে ফেলল।

*

দুজনেই কানে ইয়ারফোন গুঁজলাম। অর্চিষ্মানের স্ক্রিনে লরির জানালা থেকে একটা হাত ঢেউ তুলতে তুলতে বেরিয়ে আসছে। দেখেই চিনেছি, আলিয়া ভাটের হাত। আমার প্রিয় গান শুনছে অর্চিষ্মান।

তু তো পাক রব কা বান্কা‌ বাচ্চা রাজ দুলারা তুহি/ পাক রব কা বান্কা বাচ্চা উসকা পেয়ারা তু হি/ মালিক নে যো চিন্তা দি ওয়হ্‌/ দূর করেগা ওয়হি।

প'নে একটার সময় রাস্তায় কত গাড়ি দেখেছ? এই লেনে রক্তচক্ষুর লাইন, ওই লেনে হলুদ বাঘচোখের বান। ফ্রাইডে নাইট বলে বোধহয়। একটা আটমাথার সিগন্যাল ছেড়েছে, আমাদের দিক থেকে ছিটকে বেরিয়েছে গাড়ির ঝাঁক, ওই দিক থেকে একটা স্কুটি সিগন্যাল ভেঙে, স্বাভাবিকের থেকে অত্যন্ত বেশি রকম স্পিডে বাঁক নিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে স্কিড করে প্রায় টম ক্রুজের ভঙ্গিতে স্লো মোশনে মাধ্যাকর্ষণের কাছে হার মানল। লাফিয়ে উঠে মুখে হাত চাপা দিচ্ছি, পেছন ফিরে দেখছি হেডলাইট জ্বেলে এস ইউ ভি-রা অর্ধচক্রব্যূহ গড়েছে, স্কুটির চালক উঠে স্কুটি টেনে তুলছে। হেলমেটের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে কোমর পর্যন্ত লম্বা হাইলাইট করা চুল।

Feel the city breakin' and everybody shakin'
And we're stayin' alive, stayin' alive.

শহর ক্ষীণ হয়ে এল। ফাঁকা রাস্তার দুপাশের অন্ধকারে বিরাট বিরাট ফার্ম। সিডনি ফার্মের গেটের সামনে কিং সাইজ ক্যাঙারুর আভাস। আমি শিওর দিনের আলোয় দেখলে বেশি ভয়ের লাগবে। আমরা চুপ করে যে যার জানালার দিকে তাকিয়ে নিজের নিজের ফোনে গান শুনছি। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে অন্যের হাঁটুতে নিজের গানের তালে তবলা বাজাচ্ছি।

সি এন জি নিতে হবে। এখানে গাড়ির ভেতরে বসে থাকলে নাকি সি এন জি দেবে না। নেমে দাঁড়ালাম। বাপরে বাপ কী ঠাণ্ডা। এর মধ্যে রোহিত সিংজি জাস্ট শার্ট পরে ঘুরছেন। মন্তব্য করতে হল। উনি বললেন, নেহি ম্যাম, ইনার হ্যায় না।

অর্চিষ্মান বলবে, এই গোটা কথোপকথনটার কোনও দরকার ছিল না। তার উত্তরে আমি বলব, এই মনুষ্যজন্মেরই তো দরকার ছিল না। এত বড় বাহুল্যটা ঘটেছে যখন ড্রাইভারজির গরম পোশাকের খবর নেওয়ার অবান্তরতাটা না হয় ঘটুক।

রোহতাকের রাস্তা সোজা বেরিয়ে গেল, আমরা বাঁদিকে বেঁকে কার্নালের রাস্তা ধরলাম। ম্যাজিকের মতো কংক্রিট ফুঁড়ে দু'পাশে পাঞ্জাব লরির পাঁচিল উঠে এল। লরির পর লরি, মাঝখানে ছ'ইঞ্চি ফাঁকও নেই। প্রতি লরি মাথায় আর একটা লরির সমান উঁচু বস্তার পাহাড় নিয়ে চলেছে। হর্ন দিচ্ছে না, লাইন ভাঙছে না, স্পিড বাড়াচ্ছে না, কমাচ্ছে না। সেই সব মৌন গলিয়াথদের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে প্রবল হর্ন দিতে দিতে আমাদের ইন্টারসিটি উবারের সুইফট ডিজায়ার ডেভিডের মতো অকুতোভয় ছুটল।

আমার শরীরটাই শুধ ডিজায়ারের ভেতর, বাকিটা জানালার বাইরে। We are all prisoners here of our own device. লরির ওপর বস্তার আউটলাইন টপকে কৃষ্ণনীল আকাশের ফালি থেকে চোখ নামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্চিষ্মানের দিকে তাকালাম। ওরও দৃষ্টি, সম্ভবতঃ মনও, জানালার বাইরে। চোখের কোণে একবার আঙুল ছোঁয়াল কি? চোখ সরিয়ে আবার বস্তার আউটলাইনের ওপরে প্লেস করলাম।

লরির প্রাকার যেমন অতর্কিতে গজিয়েছিল, তেমন মিলিয়ে গেল। জেগে উঠল খাটু শ্যামজির পবিত্র ধামের সিংদরজা। শ্যামের নাম যে খাটু হতে পারে কল্পনাতেও আসার আগে মেলাগ্রাউন্ডের সামনে এক পুরিভাজির ঠেলার সঙ্গে পরিচয়। ঠেলার সর্বাঙ্গে খাটু শ্যামজির ছবি ও নামের আলপনা। অনেক ঠেলাগাড়ির কচুরি খেয়েছি দিল্লিতে, খাটু শ্যামজির নামাঙ্কিত সে ঠেলার মতো আর খাইনি। ঠেলা একদিন আর এল না। আগের গ্রীষ্মে এক্স্যাক্ট ওই স্পটে একটা মিনি আইসক্রিম ট্রাক এসে দাঁড়াল। ট্রাকের মাথায় কার নাম ও ছবির আলপনা বলুন দেখি?

এত সমাপতন অর্থহীন হতে পারে না। ভবিষ্যতে অর্চিষ্মান ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে হলে খাটু শ্যামজিকেই করব। ডিসাইডেড।

গ্রীষ্ম গেছে, আইসক্রিম ট্রাকও আর নেই। গ্রীষ্ম আবার আসবে জানি, ট্রাক আসবে? খাটু শ্যামজির কচুরির ঠেলা তো আর আসেনি। যদি আসেও, ঠিক আগের বারের মতোই কি থাকবে?

কান থেকে গান টেনে নামালাম। অর্চিষ্মানের মুখের সামনে হাত নাড়তে ও-ও কান থেকে গান টেনে নামাল।

এই রাতটা আজকের পর অতীত হয়ে যাবে। বললাম আমি।

এই রাতটাও আজকের পর অতীত হয়ে যাবে। অর্চিষ্মান বলল।

*

অতীতের আফসোসদের যদি আলভিদা করি, ভবিষ্যৎই যখন নেই ভেবে কী হবে যদি ধরে নিই, অর্চিষ্মানের হাঁটুতে তবলা বাজাতে বাজাতে ট্যাক্সিতে চড়ে মাঝরাতে বর্ডার পেরিয়ে ভিনরজ্যের ভিড়গিজগিজ ধাবায় আলুপরোটা খেতে যাওয়া কৃষ্ণরাতের ফালিতেই নিজেকে কষে বেঁধে রাখি - এই বা কতক্ষণের। পঁয়তাল্লিশে পৌঁছে জানি যা আছে থাকবে না। যা শুরু হয়েছে তা ফুরোবে। যতই আবছা করে ছাপা হোক না কেন, এক্সপায়ারি ডেট একদিন ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে।

Look at everything that's come and gone
Sometimes, when I play that old six-string
I think about you, wonder what went wrong.

*

ধাবাল্যান্ড ঢুকে গেল। কালো রাতের ব্যাকগ্রাউন্ডে টুনিতে টুনিতে টিমটিমাটিম।

রোহিতজি জিজ্ঞাসা করলেন, সুখদেব যায়েঙ্গে তো সার?

মুরথলে কোটি কোটি ধাবা কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি কাউকে অমৃক সুখদেব ধাবা ছাড়া আর কোনও ধাবায় যেতে শুনিনি। কোটি কোটি ফ্লেভারের সিরাপের শিশি সাজানো থাকলেও যেমন কালা খাট্টা ছাড়া কেউ কোনও চুসকি খায় না, এক্স্যাক্ট সেই কেস।

ধাবার সামনে পার্কিং ফুল. রোহিতজি পিছিয়ে পাশের পার্কিং-এ গাড়ি ঢোকালেন। কালো সোয়েটার, কালো প্যান্ট, কালো স্কালক্যাপ, কালো মাফলারে নাকমুখ পেঁচিয়ে কিছু লোক পার্কিং জুড়ে পায়চারি করছেন। নাকের ডগাতেই পুলিসচৌকি, কাজেই ধরে নিলাম ওঁরা পার্কিং লট তত্ত্বাবধায়কই হবেন।

অর্চিষ্মান রোহিত সিংজিকে বলল, আপনিও কিছু খেয়ে নিন। রোহিতজি বললেন, নিশ্চয়, হামারা তো ফ্রি হ্যায়।

পাঞ্জাবীদের একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি - সিংহহৃদয়।

গাড়ি থেকে নেমে অর্চিষ্মান দেখি ধাবার মূল প্রবেশপথের উল্টোদিকে হাঁটছে।

কী গো কোথায় যাচ্ছ ?

একজন ব্ল্যাক প্যান্থার বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় বলে উঠলেন, ওদিক দিয়েও রাস্তা আছে বউদি, চলে যান।

অপ্রত্যাশিত বাংলা আমাকে এত ফুর্তি কেন দেয় কোথা থেকে দেয় পঁয়তাল্লিশেও বুঝিনি যখন নেক্সট পঁয়তাল্লিশেও আশা নেই।

*

মেলা বসে গেছে। বিকট স্যান্টামূর্তি, রুডি দা রেনডিয়ারের নাগরদোলা। দুলন্ত নৌকো রাইডের দু’দিকে দুই মহিলা বসে উচ্চকণ্ঠে হুপ হাপ আনন্দপ্রকাশ করছেন।

বাবা, এদের ঠাণ্ডা লাগছে না?

লাগার কথাও না, কুন্তলা।

বলামাত্র আকাশবাতাস ফাটিয়ে - হাসিও হতে পারে, মার্ডার হওয়ার মুহূর্তের আর্তনাদও হতে পারে। মহিলাদ্বয় যে যার সিট থেকে গড়িয়ে পড়েছেন, আপাতত নৌকোর মেঝেতে আক্ষরিক গড়াগড়ি।

রাইট।

ধাবার শুরুতে একটা ঢাকা বারান্দা মতো, পেরিয়ে একটা হল, সে হল পেরিয়ে আর একটা হল। সবই যতটা বড় কল্পনা করছেন তার থেকেও অল্প বাড়িয়ে নিন তবে কাছাকাছি হবে। সিট পেতে তিন নম্বর হলে ঢুকতে হল।

রোহিতজি আলতো তাড়া দিয়ে রেখেছেন, আমাদের সি আর পার্ক পৌঁছে ওঁকে আবার সি আর পার্ক থেকে কাস্টমার তুলে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। কাজেই আমরা চটপট মেনু খুললাম। প্রথম পাতাতেই পরান্ঠার লিস্ট। পরের পাতাগুলোয় প্রত্যাশিত আলু পালংশাক মাশরুম ফুলগোবির গ্রেভি মাখনি কাবাব। তারও পরের পাতাগুলোতে অপ্রত্যাশিত কিন্তু আবার প্রত্যাশিতও - পিৎজা পাস্তা চাইনিজ। গোবি মাঞ্চুরিয়ান, হট অ্যান্ড সাওয়ার, লেমন করিয়েন্ডার, সুইট কর্ন, তালুমিয়েন সুপ।

দু'হাজার ছাব্বিশ ঢুকে যাচ্ছে এদিকে পাঞ্জাবী ধাবার মেনুতে ফালাফেল এন্ট্রি পাচ্ছে না কেন মর্মে ছিকছাক করে অর্চিষ্মানকে বললাম, বেশি খিদে তো নেই, তাছাড়া এই ঠাণ্ডায় মনে হয় আরাম লাগবে। বলে আমি আমার পছন্দের খাবারের নাম বললাম। অর্চিষ্মান নিজের বাছাবাছি থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাকানোর কনটেক্সট আছে। সাড়ে বারো বছর বিয়ের পর কনটেক্সটহীন তাকানো হয় না।

*

আমার একটা ব্যাপার আছে। ভীমেশ্বরা নামের দোকানে, জাস্ট মেনুর লাস্ট পাতায় লিখে রেখেছে বলেই আমার মাঞ্চুরিয়ান সুপ অর্ডার করার ঠেলা আসে। রয়্যাল ড্র্যাগন কিচেনের মেনুর শেষে স্টার দিয়ে খুদি খুদি 'আলু জিরা অ্যাভেলেবল আপঅন রিকোয়েস্ট' দেখলেই আমার আলু জিরার ক্রেভিং তুঙ্গ ছোঁয়। অর্চিষ্মান এমনিতে 'তোমার জীবন তুমি আড়ে কাটবে না বহরে কাটবে তোমার ডিসিশন কুন্তলা' নীতিতে চলে , কিন্তু এই একটা ব্যাপারে ও বাউন্ডারি রক্ষা করতে পারেনি।

কুন্তলা, তুমি কি পাগল? মুরথলে এসে লেমন করিয়েন্ডার সুপ খাবে? পরোটা খাও। যত্তসব।

ভাইসাব অর্ডার নিতে এলেন। আমি আলুপেঁয়াজ পরোটার অনুরোধ জানালাম। তন্দুরি অথবা তাওয়া অপশনে পাওয়া যাবে। তাওয়া পরোটার আবার দুই শ্রেণীবিভাগ - ফ্রাই অ্যান্ড ড্রাই। আমি ড্রাই বাছলাম। বেছে অর্চিষ্মানের কোন পরোটা অর্ডার করছে জানতে কৌতূহলী হলাম।

আমাকে পরোটার দিকে ঠেলে অর্চিষ্মান অম্লানবদনে অমৃতসরি কুলচার থালি অর্ডার করল। ভাইসাব বললেন, এখন কুলচা হবে না। পরান্ঠা মিল যায়েগি যো চাহিয়ে।

বেশ হয়েছে।

অর্চিষ্মান একটুও না টসকে আমার টুকে আলুপেঁয়াজ পরোটা অর্ডার করল। টুকলি ঢাকতে আমার তাওয়া ড্রাইয়ের বদলে তন্দুরির অপশন নিল। ভাইসাব বহোৎ বঢিয়া বলে চলে গেলেন। আমরা টেবিলের ওপরের সম্ভারে মনোনিবেশ করলাম।

ক্যাচ কোম্পানির পাঁচরকম সাদা স্প্রিংকলার কৌটো। নুন গোলমরিচ চাটমসালা রায়তা মসালা, সর্বনাশ, আবার পেরি পেরি। তিনটে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত আচারের বাটিতে - খুদি খুদি কটোরি না, প্রপার বাটি - একটায় লেবুর মিষ্টি আচার, একটায় আমের ঝাল আচার আর একটায় গাজর আর লংকার মিক্সড স্পাইসি আচার। স্ট্যান্ড অ্যালোন বাটিতে ভিনিগারে ভেজানো সিরকা পেঁয়াজ। এই রঙের জামা আমার আছে একটা। কম কম পরি যাতে বেশিদিন থাকে।

আমাদের চারপাশে পরিবেশকরা বিরাট বিরাট ট্রে-তে পরোটার থালায়, থালার ওপর মাখনের বাটি নিয়ে দ্রুতবেগে হাঁটছেন। হলময় সেঁকা পরোটার ঘ্রাণে, থালাবাটির শব্দে, লোকজনের হাসি গল্প উল্লাসে এমন এক খাই খাই বাতাবরণ জন্ম নিয়েছে যে খালি প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকা অসম্ভব। অর্চিষ্মান লেবুর মিষ্টি আচার প্লেটে নিল। আগেরবার এই আচারটা খেয়ে অর্চিষ্মানের এত ভালো লেগেছিল যে একটা এক কেজির শিশি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি মিক্সড আচারের বাটির গাজরগুলো চামচ দিয়ে সন্তর্পণে সরিয়ে চাপা পড়া দুটো কাঁচালংকা তুললাম। দুজনেই একটা করে সিরকা পেঁয়াজ। তারপর দুজনেই পেরি পেরি ছড়িয়ে সে সব খেতে খেতে ধোঁয়া ছড়িয়ে পরোটা এসে গেল। সঙ্গে দু'বাটি ঠাণ্ডা ধপধপে ননী, এক নৌকোবাটি ভর্তি ছোলে। পাছে অম্বল কম পড়ে, অর্চিষ্মান রিস্ক নেয়নি। সে ছোলেতে যে পরিমাণ মশলা, প্রসেনজিৎ দেখলে ঠিক বলত বাইরে পয়সা দিয়ে এসব খাওয়ার সময় তো কোনও কথা নেই,খালি আমাকেই রান্নায় মশলা কম মশলা কম বলে পাগল করা।

দুজনে দুটো পরোটা নিলাম। সে একেবারে সদ্য তন্দুর আর তাওয়া থেকে নেমেছে। লোভে পড়ে টেবিলে নামিয়ে রাখা মাত্র ছিঁড়ে ধরে থাকা যায় না, প্লেটে ছুঁড়ে ফেলে আঙুলে ফুঁ দিতে হয়। আমারটা কী ভালো তোমারটা ভালো? ইত্যাদি বলাবলি করতে করতে আমরা পরোটা খেতে লাগলাম। অর্চিষ্মান আমাকে, একী ননী খাচ্ছ না কেন? খাও খাও, বলে নিজের বাটির ননী শেষ করে ফেলল, আমি আমার বাটি থেকে দুএক চামচ করে নিয়ে পরোটায় মাখালাম, কিন্তু আমার প্লেনই ভালো লাগে। 

অর্চিষ্মান আমার থেকে জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে ঢিলে, এক খাওয়া ছাড়া। আমি লোক্যাল ট্রেনের ডেলি প্যাসেঞ্জারি দিয়ে জীবন শুরু করেও খাওয়ার স্পিড সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম কী করে কে জানে। অর্চিষ্মান চাটনিতে পৌঁছে যায়, আমি তখনও ধোঁকাই শুরু করতে পারি না।

ওই মারাত্মক গরম পরোটাও অর্চিষ্মান শেষ করে ফেলল, আমি তখনও দুয়ের পাঁচ নামিয়েছি সবে। অর্চিষ্মান বলল, আর একটা নিয়ে হাফ হাফ খাবে? পরোটা চিবোতে চিবোতে ঘাড় নাড়লাম, অর্চিষ্মান ভাইসাবকে আর একটা পরোটা আনতে বলে দিল। এই এক্সট্রা পরোটাটা অর্চিষ্মান নিজের পছন্দেরও বলতে পারত, অর্থাৎ তন্দুরি, কিন্তু জানতাম ও আমার পছন্দটাই বলবে। তাই বলল। তাওয়া ড্রাই এক লানা ভাইসাব।

নতুন পরোটা আসতে আসতে আমার পুরোনোটা শেষ হয়ে গেল। নতুন পরোটা যেন আরও গরম, আরও সুস্বাদু। অর্চিষ্মান লেবুর আচারের বাটি অর্ধেক করে ফেলল, আমি নির্লজ্জের মতো গাজরের নিচ থেকে চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে যত কাঁচালংকা সব বার করে খেয়ে ফেললাম। আর সিরকা পেঁয়াজও বিপজ্জনক রকম কমে এল। শেষ করা গেল না শুধু ছোলে। ও জিনিস শেষ করা সম্ভবও না।

আমরা খেয়ে চললাম, আমাদের চারপাশে পিলপিল করে লোক ঢুকল,  পিলপিল করে বেরোল। প্রেমিক প্রেমিকা, সিংগল ডেট, ডবল ডেট, বরবউ,  বর বউ বাচ্চা, বর বউ ভাসুর দেওর ননদ ভাজ শ্বশুর শাশুড়ি বেয়াই বেয়ান, যুবকের দল, যুবতীর দল, যুবকযুবতীর মিশ্র দল, ভারতবর্ষে যত রকমের বয়স লিঙ্গ ধর্মের যত রকম পারমুটেশন কম্বিনেশন হওয়া সম্ভব, সব শুক্রবার রাত আড়াইটেয় পরোটা খেতে এসেছে।

আর বাচ্চা। বাবাগো, কত যে বাচ্চা,  তোয়ালেমোড়া অচেতন থেকে দুই হাত মাথায় তুলে দৌড়নো টডলার থেকে গম্ভীরমুখো বালকবালিকা। এরা ঘুমোচ্ছেনা কেন? এদের ঘুম পাচ্ছেই না বা কেন? কেন পরোটা থেকে চোখ তুলে যে দিকেই তাকাচ্ছি, তারা নিজ নিজ বাবার কাঁধের ওপর থেকে ছোট্ট মুণ্ডু বার করে আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? তাকিয়ে আমার পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরোনো হৃদপিণ্ডে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে?

*

ইয়েস, আগের রবিবারের আগের রবিবার, চোদ্দ তারিখ, আমার পঁয়তাল্লিশতম জন্মদিন ছিল। সবাই জিজ্ঞাসা করল স্পেশাল কী করলাম।

স্পেশাল করতে গেলে শনিবার রাতে আট ঘণ্টা ঘুমিয়ে রবিবার সকালে উঠে ঠিক সময়ে উঠে, তিনবেলা বাড়ির খাবার খেয়ে, আগের মাসে কাচা জামার ঢিপি ভাঁজ করে তুলে, মন দিয়ে কাজ করে, ঠিক সময়ে ঘুমোতে যেতে হত।

কাজেই যা অর্ডিনারি তাই করেছি।

সকাল হওয়ামাত্র ছিলা ছিঁড়ে ব্লু টোকাইতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। চার ঘণ্টা পর ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে অর্চিষ্মান পৌঁছেছে। তারপর আমরা এক ঘণ্টা শিল্পসাহিত্য এবং পাশের টেবিলের প্রেমের লঞ্জিভিটি নিয়ে ফিসফিসিয়ে, মার্কেটেই কোথায় একটা খেতে গেলাম। খেয়ে অর্চিষ্মান 'বাড়ি যাই বুঝলে' বলে চলে গেল, আমি আরও চার ঘণ্টা বসে থেকে মোমোফোমো নিয়ে বাড়ি এসে প্রসেনজিতের রান্না বাঁধাকপি না রাজমা খেয়ে টিভিতে পডকাস্ট না সিনেমা - মোদ্দা কথা বাংলা এবং বাজে - চালিয়ে অর্চিষ্মানের সঙ্গে লেপের তলায় শুয়ে শুয়ে দেখলাম। বারোটা বাজতে পাঁচে অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা মিথ্যে বোলো না, আমি জানি তোমারও ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। বলে কে এফ সি থেকে দুটো লার্জ আলুভাজা আর একটা মসালা পেপসি অর্ডার করল। চব্বিশ মিনিট পর জোম্যাটোর 'অ্যাট ইয়োর ডোরস্টেপ' নোটিফিকেশন দেখে ডেলিভার নিতে নিচে গিয়ে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে গেল। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভাইসাব যে ডেলিভারি দিতে এসেছেন সেটা যদি প্রাপ্য বলে কাটিয়েও দিই, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকাটা উল্লেখ করতেই হবে।

অর্চিষ্মান আবার একটা বাংলা এবং বাজে বেছে কিছু একটা চালাল টিভিতে, দেখতে দেখতে সারা বিছানায় নুনের গুঁড়ো ছড়িয়ে আমরা আলুভাজা খেলাম। অর্চিষ্মান এক্সট্রা চিকেন স্ট্রিপ খেল বলে সমানাধিকার বজায় রাখতে ওর ভাগের আলুভাজা থেকে আমাকে আলুভাজা দিল।

ব্যস, হয়ে গেল আমার অর্ডিনারি জন্মদিন পালন।

*

একটা ঘটনা স্পেশাল ঘটেছিল বটে। ঘটেছিল ওপরের বর্ণিত যাবতীয় ঘটনাবলীর আগে। রবিবার ভোরে চোখ খোলার পরপরই। অর্চিষ্মানের তখনও মাঝরাত। কাজেই ও কিছু টের পায়নি।

ওই সময় গলিতে একটা সাদা আলো জ্বলার কথা, জ্বলছিল না। জানালার বাইরে পিচ ব্ল্যাক। একবার হুলো ফ্যাঁস করল। এ সময় রোজ আমাদের কমলা হুলো আর কে জানে কাদের একটা কালো হুলোর মধ্যে মিনি কুরুক্ষেত্র হয়। যে দিন সূর্য উঠবে না সেদিনও এ কুরুক্ষেত্র হবে। ঘরে কোথাও একটা নীল নাইটলাইট জ্বলছে, তার আভাসে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। আমি সিলিং ফ্যানের স্তব্ধ ছায়ার দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকলাম।

পঁয়তাল্লিশ কি এইরকমই দেখতে হয়? পঁয়তাল্লিশের কি এই রকমই দেখতে হওয়ার কথা ছিল? পঁয়তাল্লিশের কাছ থেকে যা যা পাওয়ার কথা ছিল পেলাম কি? নাকি পঁয়তাল্লিশ আমাকে কী দিল-র থেকে দরকারি প্রশ্ন পঁয়তাল্লিশকে আমি কী দিলাম। কতটা পরিশ্রম, নিষ্ঠা, অভ্যেস, মনোযোগ নিয়ে আমি পঁয়তাল্লিশের দরজায় এসে কড়া নেড়েছি যে পঁয়তাল্লিশকে আমার মনের মতো পেখম মেলে রেডি হয়ে দরজা খুলতে হবে?

জানি না। সব গুলিয়ে গেছে।

*

একটা ব্যাপার ছাড়া।

পঁয়তাল্লিশ বছর পর যদি থাকি, আমি এই আমি থাকব না। অর্চিষ্মান এই অর্চিষ্মান থাকবে না। তবলা বাজানোর জন্য অর্চিষ্মানের হাঁটু থাকলেও সে সম্ভবতঃ রিপ্লেসড হাঁটু।

বাই দা ওয়ে, অর্চিষ্মানকে পাওয়া গেছে। রাদার, গেছিল। তরশু রাতে বিছানায় টান টান শুয়ে বুকের ওপর রাখা বয়াম থেকে চামচ করে চানাচুর তুলে, মাথা বালিশ থেকে মিনিমাম উত্থিত করে, মুখে পুরছিলাম। এমন সময় ফোন।

বল তো আমি কোথায়? চমকে যাবে। বললাম, চমকাও শুনি কেমন চমকাবে। অর্চিষ্মান বলল, মুকুটমণিপুর। দারুণ জায়গা। দুজনে একবার আসব একসঙ্গে। তোমার লার্জ বডি অফ শান্ত ভালো লাগে বল না, কুন্তলা? এখানে একটা ওই রকম শান্ত বিরাট লেক আছে, দেখবে ভালো লাগবে।

গলায় জগতের উদাসীনতা জুটিয়ে বললাম, অমুক হোটেলে আছ?

অর্চিষ্মান বলল, হোয়াট দা?

মাধ্যমিকের পর দিদিভাইরা নিয়ে গেছিলেন । তোমরা আছ ড্যামের ওপারে, আমরা ছিলাম এপারের ইউথ হোস্টেলে। বাই দা ওয়ে, ওটা লেক নয়, ড্যাম ইট। ওটা ড্যাম। ওই ড্যামের ওপর দাঁড়িয়ে আমি আমার এই পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনের সুন্দরতম কালবৈশাখী...

বুঝেছি কুন্তলা, তোমার গ্যাদগেদে নস্ট্যালজিয়া শোনার সময় নেই আমার, অনেক কাজ, বলে অর্চিষ্মান ফোন কেটে দিল। সে বাহাত্তর ঘণ্টা হল।

যাকগে। যুগলে যদি মুকুটমণিপুর যাওয়া হয়ও, পঁয়তাল্লিশ বছর পর দরকার নেই, এখন গেলেও নতুন লাগবে শিওর। আমার ক্লাস এইটের পৃথিবীটাই নেই, মুকুটমণিপুর কোত্থেকে থাকবে। পঁয়তাল্লিশ বছর পর আমার এই মুহূর্তের পৃথিবীটাও থাকবে না, আমাকে ঘিরে ব্লু টোকাইয়ের গমগম থাকবে না, ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কোর্টাডোর কাপ থাকবে না, এই ল্যাপটপে এই অনন্ত অবান্তরতা টাইপ করে যাওয়ার আনন্দ থাকবে না।

অহর্নিশি দুমড়ে দেওয়া দুঃখগুলোও চলে যাবে। যে ভয়গুলো রাতে ঘুম ভাঙিয়ে ঘাম ছোটাচ্ছে, ভোল পালটাবে। হেরে যাওয়ার হাহাকার, ব্যর্থতার বিষাদ, সর্বদা সবেতে কম পড়ে যাওয়ার কনস্ট্যান্ট কামড়ানি - মিলিয়ে যাবে। অর্চিষ্মান বলবে, কুন্তলা ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাও শিগগিরি, কিন্তু আনন্দের থেকেও আমার দুঃখগুলোর জন্য দুঃখ আমি সামলাতে পারি না। যে সব কথা অর্চিষ্মানকেও বলতে পারছি না (হান্ড্রেড পার সেন্ট শিওর অর্চিষ্মানও বলতে পারছে না কারণ কেউই কাউকে মনের কথা বলতে পারছে না, পারার কথাও না), যে অনুভূতিগুলো আক্ষরিক আমার একার, আমার সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিগুলোর আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে চোখে জল এসে যায়। হাত বাড়িয়ে টিস্যু নিতে গিয়ে দেখি আগের কাপ নিয়ে যাওয়ার সময় অনু টিস্যুও নিয়ে চলে গেছে। এবং নতুন কফির সঙ্গে দেয়নি।

আমি, ব্লু টোকাইতে বসে বিনা টিস্যুতে বুরবকের মতো কাঁদছি। আনবিলিভেবল। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এই রকম অকওয়ার্ডনেসে পড়ে কী করে লোকে?

তারপরেই মনে পড়ে এই অকওয়ার্ডনেসও অতীত হল বলে।

*

কিন্তু আজকের দিনটা অতীত নয়। জ্বলজ্বল করে আছে। যেমন অর্চিষ্মান আছে। আছে মানে কফিশপে নেই, বাড়িতেও নেই, থাকবে কী করে দিল্লিতেই নেই, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ থেকেও হাওয়া। কিন্তু অদর্শন ইজ নট অনুপস্থিতি। কানে শুভা মুদগল আছেন। রাহ দেখে কালে মেঘা নদিয়া কা পানি, ও রে তেরে লিয়ে রাহ দেখে বলমা সারি জিন্দগানি। কাফকা আরাম করছেন ল্যাপটপের পাশেই, বাগদত্তা ফিলিস বাওয়ারকে লেখা চিঠির গুচ্ছ 'লেটারস টু ফিলিস' নিয়ে।

I have gradually lost sight of all other human beings, can see only you.

লাইনটা পড়ার পর বইটা আর সামহাউ পড়তে ইচ্ছে করছে না, আস্তে করে সরিয়ে রেখেছি। এয়ার কার্টেন গর্জে উঠেছে, দরজা ঠেলে ঢুকছে র‍্যান্ডম স্ট্রেঞ্জার।

এই মুহূর্তে গিবসভাইরা যতই কানের পর্দা ফাটিয়ে 'লাইফ গোয়িন' নোহোয়্যার, সামবডি হেল্প মি' চেঁচিয়ে রিলেটেবলের চূড়ান্ত হোন না কেন, পঁয়তাল্লিশ বছর (অত লাগবে না, পাঁচই যথেষ্ট) পর আজকের বা কালকের বা পরশুর, বা দশদিন পুরোনো জন্মদিনের কথা মনে পড়লে, ব্রায়ান অ্যাডামসই জিতবেন। মা আমাকে ভালোবাসেন যতখানি নিশ্চয়তায় জানতাম, ততখানি নিশ্চয়তায় জানি এই দিনগুলো উইল বি দা বেস্ট ডেজ অফ মাই লাইফ।

*

পোস্ট লিখতে লিখতে নেটে ক্যালভিন অ্যান্ড হবস-এর স্ট্রিপগুলো পড়তে পড়তে একা একা হাসলাম গত কয়েকদিন। না হলে আরও আগেই পোস্ট পাবলিশ করা যেত। যেটা সমস্যার সেটা হচ্ছে সব স্ট্রিপই কাউকে না কাউকে পড়াতে ইচ্ছে করে। অর্চিষ্মানকে চারটে পাঠিয়েছিলাম। প্রথমটায় হাসির ইমোজি দিয়েছিল। পরের তিনটেয় ক্রিকেটস্‌। আর পাঠানো যায় না। কিন্তু একটা পেয়েছি, যেটা একা পড়া ফিজিক্যালি অসম্ভব। অর্চিষ্মান গত বাহাত্তরঘণ্টা সাড়া দেয়নি কাজেই প্রতিশোধ হিসেবে আপনাদের পড়াচ্ছি।




Comments