চোর
আজ থেকে বছর কুড়ি আগে এক কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে আমাদের
পাড়ায় চোর এসেছিল।
শিবু গরানের ধানজমি প্লট করে বিক্রি করে যে বাড়িগুলো উঠেছে,
সেগুলোরই মধ্যে কোনও একটা নতুন বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর ভোগ খাওয়ানো হচ্ছিল। সাধারণত
এসব অনুষ্ঠানে পাড়াপ্রতিবেশীরা এমনিই সকলে আসে-টাসে। তার ওপর এঁরা পাড়ায় নতুন
এসেছিলেন, বাকিদের সাথে তখনও ভালো করে আলাপ করার সুযোগও হয়ে ওঠেনি। কাজেই কৌতূহলের
চোটে পাড়াশুদ্ধু লোক ঝেঁটিয়ে ভোগ খেতে গিয়েছিল। যাদের নেমন্তন্ন করা হয়েছিল তারা
তো গিয়েছিলই, বাকিরাও, “আহা পুজো করেছে, না গেলে খারাপ দেখায়...” এই যুক্তি দেখিয়ে
হাজির হয়েছিল।
আমাদের বাড়ির পুজো সাঙ্গ করে মাবাবা বাগকাকুদের বাড়ির পুজো
দেখতে গিয়েছিলেন, পিসি বুচিদিদিদের বাড়িতে গল্প করতে গিয়েছিল। আমি আর ঠাকুমা
লোডশেডিং-এর মধ্যে বারান্দায় বসে মশা মারার কম্পিটিশন করছিলাম।
ঠিক ওই সময়েই হবে, আমার বা ঠাকুমার চোখে পড়ল, বুবুনদের
ফাঁকা বাড়ির ভেতর যেন একটা আলো জ্বলে উঠেই নিবে গেল। প্রথমটা আমরা দুজনেই
ভেবেছিলাম চোখের ভুল। কিন্তু মিনিট পাঁচেক বাদেই যখন আবার একবার আলোটা জ্বলে উঠে
নিবে গেল তখন বুঝলাম চোখের ভুল নয়।
মশাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে আমরা দম বন্ধ করে বুবুনদের বাড়ির
দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিরিশ সেকেন্ড সব অন্ধকার।
আবার!
আমি তো “মা গো” বলে এক লাফে ঠাকুমার গায়ের সাথে সেঁটে
গেলাম। ঠাকুমাও ঘাবড়ে ছিলেন নির্ঘাত, তবে তিনি কি না বাংলাদেশের মেয়ে, গাছে চড়ে
পুকুরে ঝাঁপিয়ে বড় হয়েছেন, তাই আমাদের থেকে তাঁর অনেক বেশি সাহস।
অন্ধকার রাত্তিরে ফাঁকা বাড়িতে আলো জ্বলতে নিভতে দেখে আমি
যখন কোত্থাও না থেমে সোজা ভূতে গিয়ে ল্যান্ড করি, ঠাকুমার মাথায় তখন চোরের কথাটাই
সবথেকে আগে আসে।
আমাকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে ঠাকুমা ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবতে
লাগলেন। বুবুন আর কাকিমা সেজেগুজে সেটা আমরা বারান্দায় বসেই দেখেছি। কাকু যে অফিস
থেকে সোজা নেমন্তন্নবাড়ি যাবেন এবং নেমন্তন্ন খেয়ে একসঙ্গে তিনজন বাড়ি ফিরবেন, এ
সমস্ত প্ল্যান আজ সকালে অফিস যাওয়ার সময় কাকু গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আর কাকিমা
রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আলোচনা করেছেন। পাড়াশুদ্ধু সবাই শুনেছে।
চোরও শুনেছে নির্ঘাত।
আমি দুয়েকবার মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম যে চোর নয়, ভূতও
তো হতে পারে, ঠাকুমা পাত্তাই দিলেন না। উত্তেজিত হয়ে পরবর্তী কর্মপদ্ধতি নিয়ে
ভাবতে লাগলেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ঠাকুমাকে মেনে নিতে হল যে একার পক্ষে এখন তাঁর
পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। লোক ডাকতেই হবে।
বয়সটা যদি আর দশটা বছর কম হত...
ঠাকুমা ম্যাজিকট্যাজিক কিছু করেছিলেন নিশ্চয়। কারণ একটুও
চেঁচামেচি হল না, আমাদের বাড়ির বারান্দা থেকে অশোককাকুদের জানালা দিয়ে গলে, গলির
মুখে এক মিনিট থেমে, মাধুরীপিসিদের গোলবারান্দা টপকে, খোকনদাদাদের বাগান পেরিয়ে
মাঠের নতুন বাড়ির পুজোর আসরে চোর আসার খবরটা পৌঁছে গেল। সব মিলিয়ে পাঁচ মিনিটও
লাগল না।
চাঁদের আলোয় একটা একটা করে লোক পা টিপে টিপে বুবুনদের বাড়ির
সামনে জড়ো হচ্ছে, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে একে অপরকে ইশারা করে আওয়াজ করতে বারণ করছে।
রাজু, মিঠু, অভিজিৎ, তক্ষুনি দরজা ভেঙে ঢুকে চোরের কলার চেপে হিড়হিড় করে টেনে বার
করে আনতে চায়, জেঠুকাকুরা তাদের ঠেলে পেছনে পাঠাচ্ছেন। চাপা গলার মৃদু বকুনি, “আহ্,
মাথা ঠাণ্ডা রাখো। তোমাদের যে কবে বুদ্ধি হবে...” দুয়েকজন মাথা খাটিয়ে টর্চ নিয়ে
এসেছেন, যদিও সেগুলো ওই মুহূর্তে জ্বালানোর প্রশ্নই নেই। চোর সাবধান হয়ে যাবে।
ক্লাবঘর থেকে বোটনদাদা একছুটে ডিফেন্স পার্টির একটা ভোঁতা বর্শাও নিয়ে এসেছে। বলা
তো যায় না, চোর সশস্ত্রও তো হতে পারে?
ছোটবেলার অনেক কিছু আমার ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু ওই রাতটা
এখনও কালকের রাতের থেকেও বেশি স্পষ্ট। টেম্পো চেপে হিন্দি গান বাজাতে বাজাতে
পিকনিক করতে না যেতে পাড়ার দুঃখ সেই এক রাতে আমার ঘুচে গিয়েছিল। চোর ধরার উত্তেজনার
কাছে পিকনিক যে স্রেফ দাঁড়াতে পারবে না, সেটা আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি।
আমাদের বাড়ির বারান্দায় ততক্ষণে গিজগিজ করছে নিঃশব্দ ভিড়।
ওখান থেকেই ‘ভিউ’টা সবথেকে ভালো কি না।
প্রথমেই বুবুনদের বাড়ি থেকে বেরোনোর রাস্তাগুলো সব ব্লক করে
ফেলা হল। জেঠুরা সামনের দরজায় দাঁড়ালেন, দাদারা গলির মুখে বেরোনো পেছনের দরজায়
গিয়ে বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়াল। আর অভিজিৎদার মায়ের নেতৃত্বে পাড়ার জেঠিমারা বললেন,
-আমরা রান্নাঘরের দিকটা দেখছি।
জেঠুরা হাঁহাঁ করে উঠেছিলেন, জেঠিমারা শুধু বললেন,
“যত্তসব।”
বাড়ির ভেতর আলো তখন মাঝেমাঝেই জ্বলছিল আর নিভছিল। কিন্তু
এতসব ছোটাছুটি তো একেবারে চুপিচুপি হয় না, এতগুলো মানুষের নড়াচড়া, একে অপরকে হাত
দিয়ে টেনে সরানো---উৎসাহের চোটে কে বেশি কাছে চলে যাচ্ছে---চোখের ইশারা, এতগুলো
উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনির শব্দটাও তো কম নয়।
আলোটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে আর জ্বলছিল না।
সবাই পজিশন নিয়ে নিলে, শ্যামলকাকু গলার কাঁপুনি যথাসম্ভব
সংযত করে কড়া স্বরে বললেন,
-ভেতরে কে আছ? বেরিয়ে এস শিগগিরি।
আলো একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
-বেরোও বলছি! নইলে আমরা দরজা ভাঙব।
আলো নেই। উত্তেজনা আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ করে বুবুনদের বাড়ির সামনের ঘরের
জানালাটা একটু ফাঁক হল।
আমি আর নেই, মরেই গেছি।
বুবুনের বাবা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বললেন,
-কী হয়েছে
শ্যামলদা? এত ভিড় কীসের?
থতমত খেয়ে গিয়েই সামলে নিয়ে জেঠুরা চেঁচিয়ে উঠলেন,
-বেরিয়ে
এস, বেরিয়ে এস, ঘরের ভেতর চোর রয়েছে!
বুবুনের বাবা ভয়ানক অবাক হয়ে বললেন,
-চোর? কই আমি তো এতক্ষণ
আছি, কিছু টের পাইনি তো?
ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে সবাই যে যার ঘাঁটি ছেড়ে সামনের দরজায়
এসেছে। ব্যাপারটা কী হল, এত কথাবার্তা কীসের, দরজা এখনও কেন ভেঙে ফেলা হচ্ছে না
দেখার জন্য। আমাদের বারান্দার ভিড়ও বিপদ নেই বুঝে অকুস্থলের দিকে গুটিগুটি এগোতে
শুরু করেছে। আমিও এগোচ্ছি ঠাকুমার আঁচল চেপে ধরে।
-তুমি ঘুরছিলে নিজের বাড়ির মধ্যে টর্চ জ্বেলে! আলো
জ্বালাওনি কেন?!
শ্যামলকাকু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না।
-সত্যি কাকু, আপনার কিন্তু একটা হ্যারিকেন জ্বালানো উচিত
ছিল।
কাকু তাঁর বাড়ির সামনে সারাপাড়ার লোককে জড়ো হতে দেখে ভয়ানক
ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, এতক্ষণে খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
-আরে দেশলাইটা
খুঁজে পাচ্ছিলাম না তো। একটা জিনিস যদি জায়গায় থাকে।
অফিস থেকে ফেরার পথে কাকুর হঠাৎ মনে হয় যে ভয়ানক ক্লান্ত
লাগছে, বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে, জামাকাপড় বদলে ভোগ খেতে যাওয়াটাই ভালো আইডিয়া। বাড়ি
ফিরে দেখেন লোডশেডিং এবং দেশলাই দেশলাইয়ের জায়গায় নেই। তাই তিনি টর্চ জ্বালিয়ে হাত
পা ধুচ্ছিলেন, আলমারির মাথা থেকে হাতপাখা পেড়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন মশা তাড়াচ্ছিলেন,
আলনা থেকে পায়জামা পাঞ্জাবি নামাচ্ছিলেন।
আর পাড়াশুদ্ধু লোক তাঁর বাড়ির চারদিকে অতি উৎসাহে চোর ধরার
জন্য চক্রব্যূহ রচনা করছিল।
অসম্ভব অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স, বুঝতেই পারছেন। সত্যি সত্যি
চোর আসলে আরও কত বেশি মজা হত আমাদের সবার। আপনাদের আরও কত বেশি ভালো একটা গল্প
শোনানো যেত। কিন্তু কী আর করা যাবে। গল্পের খাতিরে তো আর সত্যের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ
করা যায় না, যায় কি?
ei byaparta je ami chotobyalar theke kottobaar dekhechi, tar kono simana nei...
ReplyDeleteprotibar ek i kando hoto...ami poRe poRe ghumotam, baba maa kaku kakima pishi dadu sobbai baranday e chor dhora dekhto, aar uttejonar chote bhule jeto amader i bathroom er diker dorja ta haa kore khola. ami khub i sahoshi kina, ami ei dekhe, leper tolaye aro besh kore sedhiye jetam :)
beshirbhag chor guloi shiit kale ashto. shiit er chuti ta ekta duto chor na ashle thik jomto na. kono chor i bola bahulyo, dhora poReni.
hehe...ei dhoroner mojar golpo amar o achhe onek...pore akdin bolbo....
ReplyDeleteUfff...ki bhalo lekhona tumi..eita Lila Majumdar cum Tarapado Ray, kintu shobar upore tomar moton hoyeche. Darun !
ReplyDeleteAr tomay boli, tomar lekhe amar bari'r onyo praptoboyoshko ke poriyechi, se o swikar koreche tumi ghyama lekho
ReplyDeleteOsadharon... eta ni:sandehe apnar onyotamo sreshtho lekha. Shirshendu ar Lila Majumdar ar Nabanita Debsen er mixture. Aro erakom lekha chai! poRte poRte akkebare uttejonay iye hoye giyechhilam... mane sei andhokar ghore pidim er aaloy "Tibboti Guhar Bhoyonkor" poRte poRte je chheleta boi er paatar kona kuchi kuchi kore felechhilo taar moton ar ki.
ReplyDeleteSumana, bolar moto ekta chorer golpo nei emon hotobhagyo ami e jiibone dekhini.
ReplyDeleteKamalika, tomar golpota shonar jonyo bose roilam.
Bongmom, thank you thank you thank you.
are Sugata, amio Jurasic Park dekhte giye uttejonay 'iye' hoye giye rumal-er chardiker selai khule phelechhilam!!
ha ha ha...chomotkar hoyeche
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, প্রদীপ্তা।
Deleteআরে এটা তো দারুন একটা গল্প! সত্যিকারের চোর এলেই বরং মারামারি - পুলিশ টুলিশ থাকত । অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সটাই দারুন । এতদিন চোখেই পরেনি লেখাটা।
ReplyDelete