ভূগোল ক্লাসের গল্প


অনেক ভেবেও সলস্টিস্‌-এর বাংলা প্রতিশব্দ মনে করতে পারলাম না।

বছর তিনেক আগে সিনেমা দেখে ফেরার পথে হাইপোটেনিউসের বাংলা বলতে পারেনি বলে বান্টিকে খুব দুয়ো দিয়েছিলাম, নেমেসিস অবশেষে আমাকে ধরে ফেলেছে।

আজ নর্দার্ন সলস্টিস, বিষুবরেখার ওপরের মানুষদের জন্য বছরের সবথেকে লম্বা দিন। উত্তরায়ণ শেষ, এবার সূর্যঠাকুর মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণে যাত্রা করবেন। এক দুদিনের মধ্যেই অম্বুবাচীও শুরু হবে। বিধবাদের এ সময় আগুন ছোঁয়া বারণ। আগুনের রান্না খাওয়া বারণ। ঠাকুমার হাঁটুতে যখন জোর অবশিষ্ট ছিল তখন একবছর তিনি ছাদের চাঁদিফাটা রোদে জল গরম করে তাতে চা বানানো যায় কি না তার এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। বলা বাহুল্য কিছুই হয়নি, তবু আমি আর ঠাকুমা মহোৎসাহে সেই ঘোলাটে জলে আহ্‌ উহ্‌ করে চুমুক দিয়েছিলাম।

বিষুবরেখা বললাম আর ভূগোল মনে পড়ে গেল। ভূগোল কোনওদিন ভালো লাগত না আমার। বই ভর্তি ছবি কিন্তু একটা ছবির দিকেও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। যে পাহাড় এত সুন্দর, তাকেও পৃথিবীর গায়ে বড় বড় ঘামাচির মত করে এঁকে রেখেছে। আর দু’খানা রোগা রোগা তীরচিহ্ন দিয়ে মৌসুমি বায়ু।

জঘন্য।

ভূগোলের অকূল পাথারে একমাত্র খড়কুটো ছিলেন ছোড়দি’ভাই। কক্ষনও গলা তোলেননি, কক্ষনও বকেননি, মারতে গেলে নিজেই কেঁদে ফেলতেন নিশ্চয়। অথচ তাঁর ক্লাসেই মেয়েরা সবথেকে লক্ষ্মী হয়ে থাকত। সকলেই তাঁর গুণমুগ্ধ। রাঙাদি’ভাই এক ধমকে স্কুলশুদ্ধু মেয়ের হাড় কাঁপাতে পারেন, আর মেজদি’ভাইয়ের গায়ের রঙ ফটফটে ফর্সা হতে পারে, কিন্তু আমাদের চোখে কালো বেঁটে এলোমেলো খোঁপার ছোড়দি’ভাইয়ের নখের যুগ্যি কেউ ছিলেন না।

বোর্ডে অবলীলায় হাত ঘুরিয়ে ছোড়দি’ভাই মস্ত এক পৃথিবী আঁকতেন আর ক্লাসশুদ্ধু মেয়ে এমন নিখুঁত গোল দেখে তাজ্জব হয়ে যেত। একদিন পৃথিবীর গায়ে জেলখানার মত গোল গোল দাগ আঁকলেন দি’ভাই, ওপর নিচ আর পাশাপাশি। বললেন কোনগুলোকে অক্ষাংশ বলা হয় আর কোনগুলোকে দ্রাঘিমাংষ। পৃথিবীর পেটের ওপর দিয়ে যে দাগটা গেছে, সেটা হচ্ছে...

বলতে না বলতে ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে শুভলক্ষ্মী চেঁচিয়ে বলে উঠল,

-বিষুবরেখা!

পৃথিবীর সব দেশের সব স্কুলের সব ক্লাসেই একজন না একজন হারমায়োনি গ্রেঞ্জার থাকে, আমাদের ছিল শুভলক্ষ্মী চক্রবর্তী। অন্যদিন হলে শুভলক্ষ্মীর এই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ক্লাস পার্টিসিপেশন দেখে বাকিরা হয় চোখ ঘোরাত নয় দিদিভাইয়ের নজর বাঁচিয়ে জিভ ভেংচাত, কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল কে জানে, শুভলক্ষ্মীর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিষুবরেখার দখল নেওয়া দেখে সকলের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। দিদিভাইয়ের আঙুল পৃথিবীর গা বেয়ে একটু উঠে আরেকটা লাইনে থামতেই গোটা দশেক ভালো মেয়ে, যারা যেদিন যেটা স্কুলে পড়ানো হয় সেটা আগেই পড়ে আসে, চেঁচিয়ে বলে উঠল,

-কর্কটক্রান্তি!

দিদিভাই খুব খুশি হয়ে আঙুল নিচে নামালেন। বিষুবরেখা যেই না পেরিয়েছেন, ক্লাসশুদ্ধু মেয়ে প্যাটার্নটা আন্দাজ করে গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাল,

-মর্কটক্রান্তি!

হাসি থামলে চোখ মুছে ছোড়দি’ভাই বললেন, ওটা মর্কট নয়। মকরক্রান্তি। মকর থাকে জলে আর মর্কট থাকে গাছে। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন অবশ্য কখনও কখনও তাদের কাউকে কাউকে আমাদের ফাইভের ক্লাসরুমের বেঞ্চিতেও বইখাতা খুলে বসে থাকতে দেখেছেন তিনি, নিজের চোখে।

শুনে আমরা ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম।

Comments

  1. morkotkranti !!!! hahahah :) erokom koyekta naam thakle tobu bhuugol ta poRa jeto, bolo? aar amar mone hoy, ei bangali Granger gulo-r naam e "parna" thake...amader class e chilo Parnalekha. bhable ekhono matha gorom hoye jaye. hNuh.

    ReplyDelete
  2. Google Translate bollo solstice er bangla "অয়তান্ত - বিন্দু" kintu ami thik bhorsa korte parchhina. Jaai hok, apnar galpo ta anobadyo hoyechhe taate sandeho nei.

    Amader chhotobelay Hermione Granger ra aboshyo subject anujayi vary korto... ebong amar ghor sandeho kono kono class-e amay class shuddho chhele keno dekhte partona seta ami ekhon ektu ektu bujhte pari.

    ReplyDelete
  3. Sumana, hNya 'Parna' bejay golmele dekha jachhe. khobordar konyer naamer dhare kachhe 'parna' ghNeshte diyo na.

    Sugata, babah google to asadhyosadhon korechhe moshai. ar apnar class-er jhamelate apnar kono haat nei, ota puropuri bakider shoytani.

    ReplyDelete

Post a Comment