Trier



হোস্টেলের প্রায় সবার ঘরে ছিল সরু কঞ্চি দিয়ে তৈরি আঁকাবাঁকা বুককেসগুলো। ঘরের দেওয়ালে টানা শেলফ দেওয়া ছিল, কিন্তু সেখানে সব বই আঁটত না। এক্সট্রা জায়গা লাগত। কঞ্চির বুককেসগুলো মুনিরকায় ঢেলে বিক্রি হত। একে সস্তা, তাছাড়া সেগুলোর চেহারার মধ্যে বেশ একটা হ্যান্ডমেড, আঁতেল ছাপ থাকত। ও ছাপ অবশ্য শুধু বুককেসে নয়, আমাদের ইউনিভার্সিটির সর্বাঙ্গে ছিল। বিশেষ করে সোশ্যাল সায়েন্স পড়ুয়াদের মধ্যে।  

অফ কোর্স, তা বলে সবাই আঁতেল ছিল না। মুখভর্তি দাড়ি রাখলে আর চোখে ধ্যাবড়া করে কাজল টানলেই তো আর আঁতেল হওয়া যায় না, তাই সবাইকে অন্যান্য রাস্তার খোঁজখবরও রাখতে হত। ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার তিননম্বর সেরা রাস্তা ছিল বই। বা বুককেস। কতরকম বুককেস যে দেখেছি। দেখে দেখে এমন প্র্যাকটিস হয়ে গিয়েছিল যে শুধু বুককেস দেখে বলে দিতে পারতাম বুককেসের মালিক প্রেসিডেন্সি না স্টিফেনস্‌, রামসেবক না মাওবাদী, ননভেজ না শাকাহারী।

সে রকম একটা বুককেসে প্রথম দেখেছিলাম বইটা। মুহূর্তটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। রাজমা আর টিন্ডার তরকারি দিয়ে কোনওমতে দেড়খানা রুটি গলাধঃকরণ করে গুটিগুটি পাশের হোস্টেলের দিকে হাঁটছি। ক্যাম্পাসে তখন আমার সবে দুই, বা তিন নম্বর সপ্তাহ। তখনও রাতে মাকে "গুডনাইট" বলে ফোন রেখে হোস্টেলের বাইরে বেরোলে মনে হত পাপ করছি নির্ঘাত। ছেলেদের হোস্টেলের গেট পেরিয়ে ঢুকতে গেলে ঠাকুরকে ডাকতাম, পাঁচ মিনিটের জন্য যদি আমাকে অদৃশ্য করে দেন। চুপিসাড়ে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে ডানদিকের করিডরের একদম শেষ মাথার ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা মারলাম। আজ সারারাত আড্ডার প্রোগ্রাম এ ঘরে। ক্যাম্পাসের বাঘাবাঘা বাঙালির আসার কথা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবে ভাবছি, কোন সাহসে এখানে এসেছি, এখনও ফিরে যাওয়ার সময় আছে কি না...

এমন সময় দরজা খুলে গেল। কালো চশমার আড়ালে ভীষণ চকচকে দুটো চোখ। খাড়া নাক। একমুখ দাড়ির ভিড়ে তামাকে পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়া ঠোঁট। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। দুটো অদৃশ্য পেরেক আমার পায়ের পাতাজোড়া মেঝের সঙ্গে গেঁথে রেখেছে।

পোড়া ঠোঁট নড়ে উঠল।

“তুই বুঝি কুন্তলা?”

“হ্যাঁ।”

“হুম্‌ম্‌। ভেতরে আয়। ব সিগারেট কিনতে নিচে গেছে, এক্ষুনি চলে আসবে।”

ব-দাদার বন্ধু চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর থেকে একটা খোলা বই হাতে তুলে নিলেন, আমি দরজা দিয়ে ঢুকে মেঝেতে পাতা গদির ওপর দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, কুঁকড়েমুকড়ে বসলাম। এত নোংরা ঘর জীবনে দেখিনি। ইন ফ্যাক্ট, মানুষের ঘর যে এত নোংরা হতে পারে সেটা আগে কখনও কল্পনাও করিনি। কাবার্ডের দরজা হাট করে খোলা, জামাকাপড় ছত্রাকার, বইপত্র ছত্রাকার, স্টেপলার খোলা প্রিন্টআউটের পাতা ছত্রাকার, মুখ থুবড়ে পড়া অ্যাশট্রের ছাই ছত্রাকার, গোটাবিশেক ফাঁকা বোতল ঘরময় ছত্রাকার।

ঘরের যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে আমার চোখ দেওয়ালের গায়ে বুককেসে এসে থামল। একটা না, দুটো না, তিনটে বুককেস পাশাপাশি দাঁড় করানো। সরু কঞ্চির তৈরি পলকা বুককেস অত বইয়ের ভার সইছে কী করে সেটা রহস্যজনক। ওপচানো ভ্যাটের মতো বুককেসগুলোর চারদিক থেকে বই ঝুলে আছে। ছেঁড়া বই, আস্ত বই, নতুন বই, ধুলোমাখা জীর্ণ বই। আর সে সব বইয়ের মধ্যে গম্ভীর মুখে শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়িয়ে আছে একটা মোটা ষণ্ডামার্কা বই। লাল বাঁধানো মলাটের ওপর সোনালি অলংকৃত ইংরিজি অক্ষরে লেখা ‘দাস ক্যাপিটাল’।

চোখ ফেরাতেই ব-দাদার বন্ধুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দাদা এতক্ষণ আমার চোখ ফলো করছিলেন বোধহয়। জিজ্ঞাসা করলেন, “পড়েছিস?”

“দাস ক্যাপিটাল?” অত টেনশনের মধ্যেও আমার হাসি পেল, “না।”

“পড়ে দেখতে পারিস। আর কিছু না হলেও ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজে দেবে। বাই দ্য ওয়ে, ব ক্লাস ইলেভেনে গোটা বইটা পড়ে ফেলেছিল।”

আমি চোখ গোল গোল করলাম।

“তবেই বোঝ। কঠিন ব্যাপার।”

দাস ক্যাপিটালের লেখকের জন্মস্থান দেখতে যাওয়া হয়েছিল গত শনিবার। শহরটার ইংরেজি বানান Trier, স্থানীয় উচ্চারণে বলতে গেলে বলতে হবে ‘ঠিয়াহ্‌’। কানাঘুষো শুনে থেকে মনে মনে উত্তেজনার আঁচ পোয়াচ্ছিলাম, শেষে ইনবক্সে অ্যালফন্‌সের মেল এসে জানাল, সব প্ল্যান হয়ে গেছে। আমরা সত্যি সত্যি কার্ল মার্ক্সের জন্মস্থান দেখতে যাচ্ছি।



অবশ্য Trier-কে শুধু মার্ক্সের জন্মস্থান বললে শহরটার প্রতি চরম অবিচার করা হবে। Trier হচ্ছে জার্মানির সব থেকে পুরোনো শহর, যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও ষোল বছর আগে থেকে ইতিহাসে এর চিহ্ন পাওয়া যায়। মোসেল নদীর ধারে, আঙুরবাগানের ছায়ায় Trier দাঁড়িয়ে আছে দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। জার্মানির অন্যান্য পুরোনো শহরের সঙ্গে Trier-এর উল্লেখযোগ্য পার্থক্যটা হচ্ছে যে এত পুরোনো শহর হওয়া সত্ত্বেও Trier কখনওই মিলিটারি বেস হিসেবে ব্যবহার হয়নি। গোড়া থেকেই কেবলমাত্র শাসনতান্ত্রিক অফিসকাছারি বসানোর জন্য Trier-এর পত্তন করেছিল রোমানরা।
         
রোমান আমলের অ্যাম্‌ফিথিয়েটারের ধংসস্তুপের ওপর বানানো আধুনিক বাগান।


ওপরের ছবি পোর্টা নিগ্রা-র। ১৮৬ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বানানো সিংহদুয়ার। রোমানদের কায়দা ছিল শহর গড়ে তার চারদিকে চার তোরণ বসানো। Trier-এর চার তোরণের এক তোরণ হচ্ছে এই পোর্টা নিগ্রা। শুরুতে অবশ্য এর নাম পোর্টা নিগ্রা ছিল না। মধ্যযুগ আসতে আসতে তোরণের পাথরের রং সময় আর দূষণের খপ্পরে পড়ে ধূসর থেকে কালো হয়ে গেল, আর তখন সবাই এর নাম দিল পোর্টা নিগ্রা, অর্থাৎ কি না কালো দরজা।


পোর্টা নিগ্রার মতো ঐতিহাসিক গুরুত্ব না থাকলে কী হবে, এই বাড়ির দরজাটিরও বৈশিষ্ট্য আছে। ওই যে দেড়তলা উচ্চতায় একটা দরজা দেখছেন, ওটাই এককালে ছিল বাড়ির মূল প্রবেশপথ। যে রকম যুদ্ধের বাজার, কখন কোন দিক থেকে কোন রাজার সৈন্যদল হা রে রে রে করে ঘাড়ের ওপর পড়বে, সেই ভয়ে দরজা ও রকম টঙে বানানো হয়েছিল। মই বেয়ে উঠে, মই সরিয়ে নিলেই ব্যস্‌, কোনও ব্যাটার সাধ্য নেই দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠে আসার।


এই গেট দিয়ে ঢুকলেই ছিল ইহুদিপাড়া। তখন ক্যাথলিকদের ধর্মে মুনাফা অর্জন নিষিদ্ধ ছিল। সকল অর্গ্যানাইজেশনই বাধ্যতামূলকভাবে নো-প্রফিট। ইহুদিদের এ সব হাস্যকর বাধানিষেধ ছিল না, তারা দু’হাতে ব্যবসায় লাভ করতে আর ফুলেফেঁপে টাকার কুমির হত। খ্রিস্টান পড়শির চোখ টাটাবে না কেন? খ্রিস্টান পড়শিরা ছিল সংখ্যায় ভারি। তারা আর কিছু করতে না পারুক, নিয়ম জারি করল যে সব ইহুদিদের পাঁচিলঘেরা নির্দিষ্ট পাড়ায় থাকতে হবে। সব পাড়ার একটা করে গেট থাকত, যেটা রোজ রাতে বন্ধ করে দেওয়া হত। গেট বন্ধ হওয়ার আগে প্রত্যেক ইহুদির পাঁচিলের এপাশে চলে আসা ছিল বাধ্যতামূলক।


সেন্ট পিটার’স ক্যাথিড্র্যাল জার্মানির সবথেকে পুরোনো ক্যাথিড্র্যাল। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় যিশু যে পোশাক পরে ছিলেন, সবাই বলে সে পোশাক এই ক্যাথিড্র্যালে রক্ষিত আছে। সে জামা তো আর চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার একটা ছবি ক্যাথিড্র্যালের ভেতরের দেওয়ালে টাঙানো ছিল। ছবি তুলে আনতে ভুলে গেছি, দেখতে অনেকটা শ্যাওলা রঙের ফুলহাতা ঢিলা কুর্তার মতো।

এই হচ্ছে ক্যাথিড্র্যালের অর্গ্যান। পাইপ অর্গ্যান।

আর এই হচ্ছে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট কনস্ট্যানটিনের ব্যাসিলিকা। চতুর্থ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বানানো।

  
যত ইতিহাসসমৃদ্ধ শহরই হোক না কেন, যত পুরোনো ক্যাথিড্র্যালই থাকুক না কেন আর যত বিখ্যাত সম্রাটদের চারণভূমিই হোক না কেন, এদের সবার কীর্তিকে ম্লান করে Trier-এর নাম ইতিহাসে নতুন করে লিখে দিয়েছেন যিনি, তাঁর নাম কার্ল মার্ক্স। ১৮১৮ সালের ৫ই মে, নিচের ছবির বাড়িটায় উচ্চমধ্যবিত্ত জার্মান পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। মার্ক্সবাদের ইতিহাসে অবশ্য Trier-এর নাম পাওয়া যায় না। ১৮৩৫ সালে কার্ল Trier ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন। প্রথমে ইউনিভার্সিটি অফ বন, তারপর ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিন। সবাই বলে এই বার্লিনে গিয়েই মার্ক্সের হেগেলিয়ান দর্শনের প্রতি টান জন্মায়, আর সেইখানেই মানবসভ্যতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে বস্তুবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করার আইডিয়ার বীজ বপন হয় তাঁর মাথার ভেতর।


তা বলে কি Trier কার্ল মার্ক্সের বেড়ে ওঠায় কোনও ছাপ রাখেনি? আমার বিশ্বাস হয় না। সতেরো বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত এই বুড়ো থুত্থুড়ে শহরেই ঘোরাফেরা করেছেন কার্ল, Trier হাই স্কুলে পড়েছেন, মাঠেঘাটে খেলে বেড়িয়েছেন, এই শহরের কন্যাকে বিয়ে করেছেন। রাতারাতি তো কিছু হয় না, তখন থেকেই নিশ্চয় তিনি সমাজকে আর পাঁচটা লোকে যে ভাবে দেখে তার থেকে অন্যভাবে দেখতে শিখেছিলেন। তখন থেকেই নিশ্চয় শ্রম, মুনাফা, পুঁজির অঙ্গাঙ্গী কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের আভাস ধরা পড়তে শুরু করেছিল তাঁর চিন্তায়, দৃষ্টিতে।


বলা যেতে পারে, বার্লিনের ফিলজফি ক্লাস সে চিন্তাকে আরও শাণিত করেছিল, প্রসারিত করেছিল। ভাগ্যিস করেছিল, না হলে হয়ত সে চিন্তা, সে দৃষ্টি, চিরকালের মতো Trier-এর পোর্টা নিগ্রার কালো দেওয়ালের ভেতর বন্দী থেকে যেত, দেশকালের সীমা পেরিয়ে কোনওদিনই ব-দাদার সেই ঘুপচি ঘরের পলকা বুককেসে গিয়ে হাজির হত না।


  

Comments

  1. Last chhobita ki sundor, ki symbolic! :)

    Tomar ei Germanyr bibhinno jaygar bhromon rochona gulor ekta collection boi hisebe chhapiye falo. Bhalo kaTti hobe. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ বিম্ববতী। তোমার কমেন্টে একটা যা মজার ব্যাপার আছে না... ব-দাদার সেই যে বন্ধুর কথা লিখেছি, তার একটা পেটেন্ট নেওয়া ডায়লগ ছিল...কেউ ভারি গোছের, সিম্বলিক কিছু কথা বললেই তিনি বলতেন, "সিম্বল দেখাচ্ছিস?" আমার ছবিটা দেখলেও নির্ঘাত সিগারেটের ছাই ঝেড়ে নিরুত্তাপ গলায় দাদা বলে উঠতেন, "সিম্বল দেখাচ্ছিস?" তোমার কমেন্টে হুড়মুড় করে কত কথা মনে পড়ে গেল দেখলে? এ জন্য এক্সট্রা থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. সুন্দর, ঝরঝরে, পরিচ্ছন্ন। অনেক কিছু জানতে পারলাম, দেখলামও। আর শেষ ছবিটা নিয়ে কোনও কথা হবে না। এ একদম ভুড়িভোজের পর বাটারস্কচ্‌ আইসক্রিম।।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ আবির। আর বাটারস্কচ আমার ফেএএএভারিট আইসক্রিম ফ্লেভার। হায়েস্ট ফাইভ।

      Delete
  3. Kothay bole teerthojaatri-ke dorshon korleo teerthojatra-r ordhek punyo orjon kora jay....tai tomar ekta nijer chhobi post korle shetai dekhe nitam aar ki....:)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এঃহে, এই দিকটা একেবারে খেয়াল ছিল না শ্রমণ, তাহলে সত্যি আমার একটা ছবি তুলে দিতে বলতাম কাউকে।

      Delete
  4. Lekha ar chhobi dutoi 'darun' bolle kom bola hobe. bhaggis tumi bhalo camera ta kinechhile tai chhobi dekhe ekebare oikhantitei jeno pochhe jachhi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।

      Delete
  5. Replies
    1. থ্যাংক ইউ তিন্নি।

      Delete

Post a Comment