অফিস পলিটিক্স



জানুয়ারি এখনও যায়নি, কিন্তু দিল্লির তাপমাত্রা ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শীত, বৃষ্টি, অ্যানার্কিস্ট মুখ্যমন্ত্রী, আসন্ন প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড। মেট্রো স্টেশনে অজানা জিনিসে হাত না দেওয়ার ঘনঘন সতর্কবাণী। বাসস্ট্যান্ডে, গাছের ডালে, কুতুবমিনারের গায়ে লটকানো হেল্পলাইন নম্বর। কেউ ঘুষ চাইছে? কাউকে সন্দেহজনকভাবে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে? ফোন বার করে অবিলম্বে উপরোক্ত নম্বর টিপুন।

সাধারণত আমি এসব ব্যাপারে দিব্যি চোখ উল্টে থাকতে পারি। ব্রেকিং নিউজের হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে আকাশবাতাস দেখতে দেখতে, বাদামভাজা খেতে খেতে, গুনগুন গান ভাঁজতে ভাঁজতে উদাসীন হেঁটে যেতে পারি। কিন্তু ইদানীং না চাইতেও কিছু কিছু ব্রেকিং নিউজ কানে এসেই যায়।

ছ’মাস বনবাস থেকে ফিরে এসে দেখি আমার পুরনো সিট বেহাত। এটা অবশ্য আশা করাই গিয়েছিল, আমার অফিসে বসার জায়গা আর জায়গায় বসার মানুষের চাহিদাযোগানের ভারসাম্য চিরকালই নড়বড়ে। তার ওপর আমার বসার সিটটা ছিল একেবারে প্রাইম লোকেশনে। একটি নিরিবিলি ঘরের নিরিবিলিতম কোণ। পেছনে সিলিংজোড়া জানালা, জানালার ফ্রেমে যতদূর চোখ যায় সবুজ, সবুজ, সবুজ আর সবুজের সমুদ্রে অনেকদূরে লাইটহাউসের মতো টিমটিম করা লে মেরিডিয়ান। কিন্তু সবথেকে চোখটাটানোর ব্যাপারটা ছিল আমার কম্পিউটারের অবস্থান। যে বসবে তার মুখ থাকবে দরজার দিকে, আর কম্পিউটারের মুখ থাকবে দরজার দিকে পেছন করে। কেউ ঢুকলে সে শুধু আমাকেই দেখবে, আমার স্ক্রিনে সলিটেয়ার নাকি শার্লক হোমস (উঁহু, বেনেডিক্ট কাম্‌বারব্য্যাচ নন, জেরেমি ব্রেট। শার্লকের ব্যাপারে আমি নিতান্ত পুরনোপন্থী, আর তাছাড়া শার্লক হোমস কাঁপাকাঁপা চোখে আর বুজে আসা গলায় ওয়াটসনকে নিজের হবু সন্তানের নাম নিজের নামে রাখার বায়না করছে---সে দৃশ্য হজম করাও আমার পক্ষে কঠিন) সে সব কিছুই দেখতে পাবে না।

আমি কল্পনা করতে পারি আমি যাওয়ার পরদিনই এইচ আরের (আমাদের নন-কর্পো অফিসে অবশ্য এইচ আর বলে কোনও বস্তু নেই, আছেন শুধু সুরজিৎ নামের একজন অমনিপোটেন্ট, অমনিসায়েন্ট, অমনিপ্রেসেন্ট অস্তিত্ব) দরজায় কেমন লাইন পড়েছিল।

-আরে ভাই, হাউ ক্যান আই গিভ ইউ হার সিট? শি ইস কামিং ব্যাক আফটার সিক্স মান্থস, নো?

-ও মাই গড সুরজিৎ, ডু ইউ রিয়েলি বিলিভ দ্যাট? হোয়াই উড শি কাম ব্যাক? শি ইস গন ফর গুড। হোয়েন ক্যান আই মুভ মাই স্টাফ?

-আরে ক্যায়সে নহি লওটেগি? শাদি করকে গয়ি হ্যায়।

-(ঠোঁটে আক্ষেপের ছিক ছিক শব্দ করে) ইউ আর সাচ এ বাচ্চা, সুরজিৎ। আজকাল শাদি-ওয়াদি ইস নট ইম্পরট্যান্ট। উইমেনস্‌-লিব কা জমানা হ্যায়। শি উইল টেক হার হাজব্যান্ড দেয়ার। ওকে দেন, আই উইল স্টার্ট সিটিং দেয়ার ফ্রম টুমরো? ইস দ্যাট অলরাইট?

অলরাইট না হয়ে আর উপায় কী। আমি এসে ব্যাপার দেখে দীর্ঘশ্বাস চেপে সুরজিৎকে ফোন করলাম। সুরজিৎবাবু গলায় অসম্ভব বেশি উৎসাহ ফুটিয়ে বললেন, ‘আরে কুন্তলা, ডোন্ট ওয়রি। আই হ্যাভ সেভড আ বেটার সিট ফর ইউ। রাইট নেক্সট টু মি।’

সেই থেকে আমার সিট এইচ আর পাড়ায়। আমার চারপাশে এখন চুলে হাইলাইট করা ব্যস্ত সেক্রেটারি আর কাঁচাপাকা জুলপির প্রৌঢ়, প্রশান্ত অ্যাকাউনটেন্ট। আর্টিকেল, পাবলিকেশন, প্রোজেক্ট ইত্যাদির বদলে ব্যাংক, প্যান নাম্বার আর ভাউচার জাতীয় শব্দের ছড়াছড়ি। প্রথমদিকে নিজেকে ভীষণ হংস মধ্যে বক যথা লাগত। সেটা বুঝে হংসেরা আমাকে তাঁদের ডানার তলায় টেনে নিলেন। কুন্তলা খানা লায়ে হো? কুন্তলা কফি চাহিয়ে? কুন্তলা তুমহারা হাসব্যান্ড কাঁহা কাম করতা হ্যায়? প্রশ্নোত্তরের পথ বেয়ে হাঁস আর বকের পরিচয় ক্রমে গাঢ় হল।

আর যেটা গাঢ় হল সেটা হচ্ছে বকের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের জ্ঞান। আমাদের এখানে প্রশান্তবাবু বলে একজন অ্যাকাউন্টের ভদ্রলোক আছেন, তিনি অফিসে এসে কোনওমতে নিজের ঘরে ব্যাগটি রেখেই বেরিয়ে পড়েন। আমার প্রৌঢ় প্রতিবেশীর সঙ্গে আজ কা মুখ্য সমাচার নিয়ে আলোচনা করতে। প্রতিবেশী বিশ্বাস করেন কেজরিওয়ালের ঝাঁটায় সত্যি সত্যি দিল্লির দুঃখদুর্দশা বিদেয় হবে, উনি করেন না। মত না মিললে মন মেলে বেশি। আগেও দেখেছি, এঁদের দুজনকে দেখে বিশ্বাস বাড়ল।

‘আরে সুপালজী, এক বাত সমঝ লিজিয়ে। ঝাড়ু কিতনা ভি আচ্ছা হো, ছে মাহিনে সে জিয়াদা নহি চলতি। বদলনা পড়তা হ্যায়।’

আলোচনা চলাকালীন আমি সাধারণত কথা বলি না, মিষ্টি হেসে অংশগ্রহণের ভাব প্রকাশ করেই ক্ষান্ত দিই। একদিনই সে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছিল, তার কারণ আমার ভুল ধরার স্বভাব। মুখ্য সমাচারের ডালে ডালে ঘুরতে ঘুরতে সেদিন প্রশান্তবাবু কী করে যেন কেজরিওয়াল থেকে কমিউনিজমে গিয়ে পড়েছেন, আর কমিউনিজম আসতেই কানের সঙ্গে মাথার মতো পশ্চিমবঙ্গ এসে পড়েছে। আমার অমনি কান খাড়া।

‘পচ্চিস সাল। পচ্চিস সাল বংগালমে কমিউনিস্টরাজ চলা হ্যায়।’

‘চৌতিস্‌।’ নিজেই নিজের গলা শুনে চমকে যাই। বন্দুকের গুলির মতো ঠিক উত্তরটা ছিটকে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, আমি ট্রিগার না টিপতেই।

‘চৌতিস্‌?!’ 

আমি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ি। প্রশান্তবাবু প্রথমটা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কিন্তু যতই হোক, খোদ ঘোড়ার মুখের খবর, বিশ্বাস করতেই হয়। ‘তবেই বুঝুন’ মুখের ভাব করে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে ফেরেন। যে হাইপোথেসিসটা প্রমাণ করতে চাইছিলেন সেটাই প্রমাণ হয়ে যাওয়ায় বিজয়ের গর্ব তাঁর চোখমুখে উপচে পড়ে।

যদিও সেই প্রথম আর সেই শেষ। মুখ্য সমাচার অধিবেশনে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ। এখন আবার কান খোলা, মুখে মৃদু হাসি, চোখে চোখ পড়লে সম্মতিসূচক ঘাড়সঞ্চালন। যতদিন না আবার বংগাল নিয়ে কথা হচ্ছে, আর কেউ বলে বসছেন, ‘পাতা হ্যায়, কলকাত্তামে তো সংস্‌কৃতি প্রচার কে লিয়ে, হর রোড পে মাইক লাগাকে হানি সিংগকা র‍্যাপ সং ফুল ভলিউম মে বাজায়া যাতা হ্যায়’ ততদিন আমার আর মুখ খোলার সম্ভাবনা নেই।


Comments

  1. Jharuponthi colleagues are way better than...erm...'gujarat mukhyomontri ponthi' colleagues. Gotokaal sei niye office cafetaria tey emon haat paa chhure jhogra korechhi, je cup theke cha cholke pore ekakkar kando.

    p.s. Cumberbatch DAROON. TOPPEST. DURDANTO. Dhulu dhulu chokh-i howk, ba dhora gola. Bas. :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার বক্তব্যের প্রথম অংশের সঙ্গে হাই ফাইভ, শেষের অংশের সঙ্গে স্যাডলি, লো ফাইভ বিম্ববতী। তবে শার্লকে মত না মিললে কী হবে, ফেলুদাকে আমাদের দুজনেরই পছন্দ, সেটাই যথেষ্ট।

      Delete
  2. :) খুব মজা পেলাম পড়ে :) 'চৌতিস্‌' আর 'হানি সিং' টা ব্যাপক :)

    ReplyDelete
  3. Hehe..Sherlock er janyo hi5! Ami o vison praachinponthi e byapare!

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক একজনের সঙ্গে মিলেছে। হায়েস্ট ফাইভ কোয়েল।

      Delete
  4. khub bhalo laglo pore ..:) ..tabe Benedict Cumberbatch ke amaro durdanto lage .dekhar katha cherei dilam ,ki durdanto galar swar..ar making khub adhunik mone hayeche amar .kono tv show ato jatno kore banano ami toh besh kam dekhechi..last episodeta ta chere de.ota ektu kemon jeno chilo..kintu thik tar agerta mane Mary ar Watson er bier episode ta durbanto ,specially Sherlocker best man speech er sequence ta jake bole too good ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা বেনেডিক্টবাবুকে খারাপ লাগতে যাবে কেন। দারুণই লাগে আমার। দেখতেশুনতে সব দিক থেকেই জব্বর। আমি বলছি, নতুন শার্লক ব্যাপারটাই আমার পছন্দ না। বড় বেশি কায়দা। আর আমি নিজে কায়দায় অপটু বলে যে কোনও ধরণের কায়দা দেখলেই আমার গা-জ্বালা করে। তবে তোর্ সঙ্গে একটা জায়গায় একমত তিন্নি, কায়দা হলেও, কায়দাটা যে খুব যত্ন করে করা হয়েছে সে নিয়ে সত্যিই তর্ক নেই।

      Delete
  5. Office e seat nia amar dukhher kotha r ki bolbo apnake...amar 4 joner cubicle e 7 jon manush bose..tar modhhe 5 jon mohila...ami bade rekjon purush bekti ordhek din work from home koren...so ami only purush...sometimes I feel I am sitting in a 'Kitty Party' :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা রে, আপনি একেবারে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন সৌমেশ। বুঝতে পারছি। কী আর করবেন, এই সুযোগে নারীচরিত্র পর্যবেক্ষণ করে নিন, কাজে দেবে।

      Delete
  6. শার্লকটা মিললনা। আমার জেরেমি ব্রেটের থেকেও বেশি সাবলীল লাগে কাম্বারব্যাচকে। গল্পগুলো নতুন হলেও আসল গল্পের এত রেফারেন্স আছে যে এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয়না যে কোনান ডয়েলকে অসম্মান করা হয়েছে। আর কাম্বারব্যাচের গলার স্বরটা আমার কার মতন লাগে বলুন তো? অ্যালান রিকম্যান অর্থাৎ সেভেরাস স্নেপ। তবে কাম্বারব্যাচের শার্লক ভালো লাগার পেছনে রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের অবদান কম নয়!

    ঝাড়ু আর রাজনীতির কথায় যেতে চাইনা। তবে ওই আশে পাশে কেউ আমার জানা কোনও বিষয়ে ভুল কথা বললে আগ বাড়িয়ে ঠিক করে দেওয়ার বদ অভ্যেসটা আমারও আছে। আপনার তো তাও চেনা লোক, আমি তো ট্রেনে-বাসে অচেনা লোকেদেরও ভুল ধরে দিই মাঝে মধ্যে। আর জানালার সামনে বসতে আমিও পেয়েছি, দেশের অফিসেও, আর এখানেও। মনিটর উল্টোমুখো হওয়ার ব্যাপারটায় আপনাকে হিংসে করলাম। ওটা আমার কোনদিন হলনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে, এই বোধহয় প্রথম অমিল বেরোলো, নাকি? অবশ্য বেরিয়েছে ভালোই হয়েছে, সব মিললে বড় বোরিং। জেরেমি ব্রেটের প্রচুর ম্যানারিজম আছে, মানছি। কিন্তু ওই সময়ের লন্ডন দেখতে খুব ভালো লাগে, সেটা পক্ষপাতিত্বের একটা কারণ হতে পারে। শার্লক সিনেমাগুলো শিউরে ওঠার মতোই, এটা হক কথা বলেছেন।

      কমপিউটারের মনিটরের লোকের চোখের আড়ালে হওয়াটা আমার একটা ফান্ডামেন্টাল রাইটসের মধ্যে পড়ে।

      Delete
    2. এটা যদ্দুর মনে পড়ছে দ্বিতীয় অমিল। প্রথমটা ছিল কাঁঠাল। :-)

      Delete
    3. তাও তো বটে।

      Delete
  7. 'Joy Forever' er sathe akebare ekmot, Rober Downey Jr's portrayal was so outlandish that Cumberbatch looked infinitely better. Also in most episodes they get the basic plot/names from the original writings, like in 'Study in Pink' the killer's idea of offering two pills or names like 'Major Sholto','Jonathan Small' are all taken from Conan Doyle. Sherlock aficionados will also pick up Easter eggs like 'Five orange peeps' turned into 'Five iPhone beeps' and 'The Greek Interpreter' becomes 'The Geek Interpreter' :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. রণদীপ, একমত। নতুন শার্লক আমি বেশি দেখিনি, কিন্তু যেটুকু দেখেছি তাতে আসল গল্পগুলোর প্রতি একটা হ্যাট-টিপ-এর ব্যাপার আছে, যেটা খুব ভালোলাগার।

      Delete
  8. Tumi "Elementary" dekho. Johnny Lee Miller ke bhalo lagbe. Tar thekeo bhalo lagbe Lucy Liu ke as Watson.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এলিমেন্টারি আমি একবার দেখতে শুরু করে আর দেখিনি। তুমি যখন বলছ তখন দেখব চান্দ্রেয়ী।

      Delete

Post a Comment