ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁই শাকের চচ্চড়ি





মা তোমার কি মনে আছে আজ থেকে প্রায় লক্ষাধিক বছর আগে তোমার একটা মেয়ে হয়েছিল?

লক্ষাধিক কোথায়! এই তো মোটে তেত্রিশ বছর . . . আচ্ছা চৌত্রিশই না হয় হল। এরই মধ্যে ভুলে যাব?

রকমসকম দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। ফোনটা ভালো করে চোখ মেলে দেখ একবার। অন্তত সাতটা কল করেছি সকাল থেকে।

সাআআআত? কই আমি তো একটাও দেখলাম না? সরি সোনামা, সরি সরি . . .

জঘন্য। ফেলে দাও তোমার ফোন। মা, তোমাকে একটা স্মার্ট ফোন দেব গো পুজোয়? বেশ টাচ স্ক্রিন?

খবরদার না সোনা। এই বোতামটেপা ফোনই আগে সামলে নিই। কী করছিস মা ছুটির দিন বসে বসে?

কিসুই না। করার মতো একটা ভদ্রস্থ কাজই নেই। খালি টিভি দেখছি আর বোর হচ্ছি। তুমি এত কাজ পাও কোত্থেকে ভগবানই জানেন।

আমার আবার কাজ কোথায় দেখলি? সকাল থেকে উঠে খালি খাচ্ছি আর খাওয়ার পর আবার কী খাব ভাবছি। ব্যস। এই তো কাজ।

কী খাবে গো মা?

ওরে বাবা, কত কিছু যে খাব। বলতেও লজ্জা করে। এই তো সাড়ে ছ’টার সময় চা বিস্কুট খেলাম। তারপর ন’টা বাজতে না বাজতেই এমন খিদে পেয়ে গেল যে দুধরুটি খেতে হল। এখন মীরামাসি উচ্ছে ভাজা, টমেটো দিয়ে ডাল, আলুপটলের তরকারি আর বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ রাঁধছে, একটা বাজতে না বাজতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেগুলো আবার খাব।

মা! মিল মিল! আমরাও আজ ইলিশ খাব। শোনো না মা, আমাদের না ভেজে খেতে খেতে মাছের পিসগুলো সব খাওয়া হয়ে যায়, খালি মাথাটা পড়ে থাকে। আমি বুদ্ধি খাটিয়ে কাল পুঁইশাক কিনে এসেছি। তুমি একটা সেই চচ্চড়ি মতো করতে না মাথাটাথা শাকটাক দিয়ে?

করতাম তো।

একটু রেসিপিটা বল না মা।

ধুর, অত সোজা রান্নার আবার রেসিপি কীসের। বলে দিচ্ছি, শোন। কিন্তু চচ্চড়িতে তো আরও কিছু তরকারি লাগে, আলু বেগুন কুমড়ো . . . কিনেছিস সে সব?

আলু কুমড়ো কিনেছি। বেগুন কেনার জো নেই। সবার নাকি অ্যালার্জি।

আহা, সে অনেকেরই অ্যালার্জি হয় বেগুনে। বেগুন ছাড়াই দিব্যি হবে। প্রথমেই মাছের মাথাটা ধুয়ে নুনহলুদ মেখে রেখে দেবে। ইলিশমাছ অবশ্য বেশি ধুতে নেই, গন্ধ চলে যায়। তবে মাথা তো, তুমি ভালো করেই ধুও।

হ্যাঁ হ্যাঁ, পাগল নাকি। গন্ধের মায়ায় শেষে কলেরা হয়ে মরি আরকি।

আঃ সোনা, এ সব কী পচা কথা!

আচ্ছা আচ্ছা, তারপর বল।

মাছ রেখে দিয়ে পুঁই শাকটা ধোবে শাকে কিন্তু ভীষণ মাটিঝাটি লেগে থাকে সোনা, তোমার ওই যে ঝাঁঝরি মতো জিনিসটা আছে সেটায় রেখে একেবারে কলের তলায় ধরে খচরমচর করে ধোবে। তারপর জল ঝেড়ে টুকরো টুকরো করে কাটবে। সাবধান, হাত যেন না কাটে।

তারপর?

ডাঁটাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিস না কিন্তু সোনা। পুঁইয়ের আসল মহিমা ওই ডাঁটাতেই। একেবারে গোড়ার দিকের শক্ত জায়গাগুলো বাদ দিবি, তাছাড়া সব যাবে। আলু, কুমড়োও মাপমতো কেটে নিবি। মুলো দিলেও বেশ হয়। কিনেছ নাকি?

পাগল নাকি? আমার রান্নাঘরে মুলো ব্যান। বেগুনের বদলা।

আঃ সোনা, বদলা আবার কী? একসঙ্গে থাকতে গেলে একে অপরের পছন্দঅপছন্দ মানিয়েগুছিয়ে চলতে হয়। দুজনেই একটুআধটু অ্যাডজাস্ট করবে। এর মধ্যে বদলার তো কিছু নেই।

ওরে বাবা মা, ওটা রসিকতা করেছিলাম। ঘাট হয়েছে। তারপর বল।

তারপর আবার কী, হয়েই তো গেল। মাছের মাথাটা ভালো করে ভেজে তুলে নিয়ে হাতা দিয়ে অল্প ভেঙে নিস। একেবারে গুঁড়ো করে ফেলিস না, আবার বিরাট বড় বড় টুকরোও রাখিস না। 

বুঝেছি। বাইট সাইজ।

ঠিক। এবার একই তেলেই পাঁচফোড়ন, শুকনো লংকা ফোড়ন দিবি। তেজপাতা আছে? না থাকলেও ক্ষতি নেই।

আছে আছে। শুকনো লংকা, তেজপাতা, ম্যাগি টেস্ট মেকার, আজিনামোটো সব আছে। আমার রান্নাঘরকে আন্ডারএস্টিমেট কোরো না মা, হুঁহুঁ।

না না, পাগল নাকি। ফোড়ন হয়ে গেলে এইবার তরকারি ছাড়বে। সব একসঙ্গে ছেড়ো না কিন্তু। কোনটার পর কোনটা ছাড়বে বল দেখি?

এটা আমি জানি। শক্ত থেকে শুরু করে নরম। প্রথমে যাবে আলু, পাঁচ মিনিট পর কুমড়ো, বেগুন থাকলে সেটা তারও পরে যেত। কিন্তু স্যাডলি বেগুন নেই। আর লাস্টে শাক দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে।

ভেরি গুড। এই তো আমার সোনা ক্রমশ রন্ধনে সৈরিন্ধ্রী হয়ে উঠছে। তরকারিগুলো ভাজার সময় মাপমতো নুন হলুদ দিস মনে করে। একটা কাঁচালংকা চিরে দিস। এক চিমটি চিনিও।

অ্যাঁ! চিনি! ছি ছি মা, তুমি না ঢাকাই বাঙাল?! তুমি কি না রান্নায় চিনি দিতে বলছ? ছি ছি ছি।

আহা, আমি কি গাদাগাদা দিতে বলছি নাকি। চচ্চড়িটচ্চড়িতে একটু মিষ্টি লাগে। চামচের একদম ডগায় করে এএএকটুখানি দিস। নিয়মরক্ষা।

নাঃ, আই অ্যাম ডিস্যাপয়েন্টেড। যাকগে, বলছ যখন দেব এক চিমটে। তারপর কী করব?

তারপর শাক ছেড়ে কড়াই ঢাকা দিয়ে এসে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে এসে ফ্যানের তলায় বসে থাকবি। মাঝে মাঝে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবি কদ্দূর হল। তলা ধরে যাচ্ছে দেখলে জলের ছিটে দিতে পারিস। তবে মনে হয় না লাগবে, শাক থেকেই যথেষ্ট জল বেরোবে।

বুঝেছি, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করব।

এক্স্যাক্টলি। যখন দেখবি গোটা ব্যাপারটা মিলেমিশে বেশ চচ্চড়িচচ্চড়ি দেখতে হয়েছে তখন বুঝবি রান্না শেষ। তখন ভেজে রাখা মাছের মাথাটা দিয়ে নেড়েচেড়ে গ্যাস বন্ধ করে দিবি। ব্যস। বাকি থাকল শুধু আরাম করে খাওয়া।

গুড। খেয়ে তোমাকে বলব কেমন হল। তোমার মতো হবে না, স্টিল।

ভ্যাট্‌, আমার থেকে ভালো হবে দেখিস।

সান্ত্বনা দিও না মা, তুমিও জান তোমার মতো হবে না। তুমিও তো বল তোমার রান্না কিছুতেই দিদিমার মতো হয় না। যাই হোক। শোন না মা, এখন রাখি। অনেক কথা বলে ফেলেছি। পরে আবার ফোন করব। অবশ্য যদি তুমি শুনতে পাও।

শুনতে পাব না মানে? এই আমি ফোন আঁচলে বেঁধে রাখলাম। এবার দেখবি একটা রিং হতে না হতেই খপ করে তুলে হ্যালো বলব।

বোঝা গেছে। ঠাকুমার সঙ্গে এখন আর কথা বললাম না, কাল বলব।

ঠিক আছে, আমি বলে দেব’খন।

রাখছি মা। টা টা।

টা টা সোনামা।
  

  

Comments

  1. ufff ! baddo bhalo dekhte tarkarita..dilli theke bombayte gandho pacchi- tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুই এলে এটা রেঁধে খাওয়াব। লজ্জাজনক রকম সোজা বানানো।

      Delete
  2. Pui shaak! aha ... kotodin khaini. Ekhane Ilish payi kintu pui paina.
    Khub bhalo dekhte hoyeche chochchori ta.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে তোমার ব্লগেও দেখলাম তো এই রেসিপিটাই শর্মিলা। পুঁই বিহনে তুমি অন্য কিছু একটা শাক দিয়ে বানিয়েছিলে সেটাও দেখলাম।

      Delete
    2. Palong. Dudh er shaad ghole metai. :-)
      Ami ektu ada bata dei ar muro ta ektu agey dei jaate ilish er sugondho ta puropuri bhabe torkari ta te mishe jaye.

      Delete
    3. হ্যাঁ হ্যাঁ শর্মিলা, পালংশাক, মনে পড়েছে। আদা একটু দিলে হত, না? আমার ছিল, কিন্তু মা বলল না বলে দিই নি।

      Delete
  3. mil mil mil! amra o aajke eitai khelam je! Mashi Kolkata theke puishak anlo :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাই ফাইভ, সুমনা। সব ঠিকঠাক চলছে আশা করি?

      Delete
  4. Replies
    1. খেতেও ভালো হয়েছিল ইচ্ছাডানা (এটা অবশ্য নিজের মুখে বলা উচিত নয়, তবু লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম)।

      Delete
  5. মনটা উদাস হয়ে গেল। কতদিন যে এসব খাইনি। :-(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে সুগত, আর তো তিন মাস পরেই বাড়ি আসছেন, তখন অবশ্য ইলিশ সিজন থাকবে না বোধহয়, কিন্ত আরও ভালো কিছুর সিজন নিশ্চয় পড়বে। কাজেই মন উদাস করবেন না একদম।

      Delete
  6. এইটা একেবারে উল্লাস উল্লাস! আমার প্রিয়তর পদ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা সৌরাংশু, গুড। প্রিয়তম পদটা জানার ইচ্ছেয় থাকলাম।

      Delete
  7. :( আহ কদ্দিন হয়ে গেল এইসব ফোটোক ছাড়া দেখিই না ।আমার মেনু আজ waltmart এর প্রাচীন তেলাপিয়া :/

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, ষাট ষাট। দুঃখ করবেন না। বরং ভাবুন ভাগ্যিস গ্লোবালাইজেশন হয়েছিল, ভাগ্যিস তেলাপিয়াগুলো ভিসা পেয়েছিল, না হলে তো স্রেফ ক্যাটফিশ খেয়ে থাকতে হত, তখন?

      Delete
  8. দূরদূর ওই চিনা না কোরিয়ান ওদের একটা দোকান আছে সেখানে দেখলাম ব্যাটারা শুঁড় দেখেই অমনি আজে বাজে নাম দিয়ে দিয়েছে কি ভাগ্যিস ইঁদুর ফিশ বলেনি ।

    ReplyDelete

Post a Comment