The Shortest Route



গঙ্গা পেরোতে হবে শুনেই সতর্ক, ট্রেন ধরতে হবে শুনে ভিরমি। হাওড়া স্টেশন তো নয়, যেন নন্দাদেবীর বেসক্যাম্পে যেতে বলা হয়েছে। এরপরেই কোমরে দড়ি বেঁধে, তুষারকুঠার হাতে নিয়ে অগস্ত্যযাত্রা। বেরোতে গিয়েও থমকে গিয়ে, ফিরে এসে মায়ের পা ছুঁয়ে কিংবা পার্টনারের গালে চুমু খেয়ে কানে কানে ‘আই লাভ ইউ’ বলে যাওয়া। যদি আর দেখা না হয়, অন্তত এই মুহূর্তটুকু রইল সারাজীবন আঁকড়ে থাকার জন্য।

এইবার শুরু হবে প্রশ্ন।

কতক্ষণ বাদে বাদে ট্রেন ছাড়ে? ডিমসেদ্ধ বিক্রি হয় শুনেছিলাম, লাল শালু মোড়া ঝুড়িতে করে? আর শশা পাওয়া যায় কি? ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে?

প্রথম প্রশ্নটার উত্তর, অনেক। অফিস(ফেরতা)টাইমে প্রায় বাসের মতোই ঘনঘন। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, উঁহু। শশা চাইলে পাওয়া যেতে পারে, ডিমসেদ্ধ মুশকিল। তবে এত কিছু খাওয়ার দরকার কি? মোটে আধঘণ্টার তো রাস্তা। অনেকে অবশ্য টানা আধঘণ্টা মুখ না চালিয়ে থাকতে পারে না, আপনি যদি তাদের মতো হন তবে আপনার পক্ষে বাদামভাজা তাক করাটাই উচিত হবে। নোনতা, মিষ্টি, গুড়মাখানো চাক। আপনার যেমন রুচি। কপাল যদি খুব ভালো হয় গাঁটের পয়সাও খরচ করতে হবে না, কোনও স্থানীয় এম পি–র সঙ্গে ট্রেনে দেখা হয়ে গেল হয়তো। এ সব দিকের লোক পার্লামেন্টেই যাক আর যেখানেই যাক, মফস্বলী দেওয়াথোওয়ার অভ্যেসটা গায়ে লেগে থাকে। বলা যায় না, হয়তো গোটা কামরার লোককে বাদামভাজা কিনে খাওয়াল। বানিয়ে বলছি না, সত্যি সত্যি হয়েছে এ’রকম।

রেল কোম্পানির বইতে লিখে রেখেছে কুড়ি মিনিট, কিন্তু আসলে পৌঁছতে লাগে তিরিশ। হাওড়া থেকে ঘটাং ঘটাং করে রেললাইনের জট ছাড়িয়ে লিলুয়া পৌঁছতেই দশ মিনিট কাবার, বাকি রাস্তা পক্ষীরাজের মতো উড়ে কুড়ি মিনিটে।

উঁহু, গুড নয়। ভিড়ের কথাটা মাথায় রাখতে হবে। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটার ভিড় নিয়ে কালজয়ী উপন্যাস লেখা যায়। কেন যে কেউ লেখে না কে জানে। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সমস্যা যখন আছে তখন সমাধান থাকবে না এমনটা তো হতে পারে না। কয়েকটা টিপ্‌স্‌ দিয়ে রাখছি। কাজে লাগবে। নিজেকে ভিড়ের ঠিক মাঝখানটায় প্লেস করবেন। মানিব্যাগ হাত দিয়ে চেপে ধরে সামনের লোকের ওপর বডি ছেড়ে দেবেন। পেছনের লোক ঠেলে তুলে দেবে। একবার সেট হয়ে গেলে ব্যস। অনেকটা মুড়ির বয়ামের মতো ব্যাপার। যতক্ষণ ঝাঁকানো হচ্ছে ততক্ষণই যা কষ্ট। তারপর সেট হয়ে গেলেই হয়ে গেল।

এবার তিরিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকুন। কী? সিট? হাহা, না পাবেন না। হুম্‌, তা একরকম শিওরই বলতে পারেন। আপনার দ্বারা হবে না। সিট পেতে গেলে প্রথমেই দরকার ‘সিট আমি পাবই, কোনও ব্যাটার সাধ্য নেই রোখে’ কনফিডেনস্‌। কারশেড থেকে আসা ফাঁকা ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়নো, রানিং-এ ওঠা, শিশুবৃদ্ধ নির্বিচারে কনুই চালানো – ও সব তারপর আপসে আসবে। একদিনে হবে না। তবে বেশিদিনও লাগবে না। এক সপ্তাহ, ম্যাক্সিমাম। যারা ট্রেনলাইনে জন্মায় তাদের অবশ্য জন্মগত প্রতিভা থাকে। বাচ্চা জন্মানোর ছ’দিনের দিন বিধাতা এসে কী করেন বলে আপনার ধারণা? জন্মের অক্ষাংশদ্রাঘিমাংশ বুঝে প্রতিভার প্যাকেজ বিতরণ করে যান। দিল্লিতে থাকলে গালি দেওয়ার প্রতিভা, প্যারিসে থাকলে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন তিনশো ছেষট্টি রকম করে গলায় স্কার্ফ পেঁচানোর প্রতিভা, ট্রেনলাইনের আশেপাশে জন্মালে অফিসটাইমে সিট জোগাড়ের প্রতিভা। এবার সে প্রতিভায় শান দেওয়া শিশুর আর তার বাবামায়ের ব্যাপার। আপনার সঙ্গে সিট নিয়ে যাদের কমপিটিশন তারা এ জিনিস গত পঁচিশ বছর ধরে প্র্যাকটিস করছে। সেই যখন জামাইষষ্ঠীতে মায়ের কোলে চেপে কপালের টিপের ওপর পাউডার মেখে মামাবাড়ি যেত তখন থেকে। দু’ইঞ্চি ব্যাসের রুপোর চুড়ি টাইট হয়ে বসা টার্কির টেংরির মতো মোটা মোটা হাত দিয়ে সামনের লোককে এন্তার কিল মেরেছে চুল টেনেছে। আজ এ সিট পাবে না তো কি আপনি পাবেন?

হ্যাঁ, সে তো বটেই। দুঃখ পেয়ে লাভ নেই। গীতার মূল শিক্ষাটা মনে রাখবেন, ট্রেনে চড়বে কিন্তু সিটের আশা করবে না। তাহলেই সব পিসফুল।

উঠে পড়েছেন অথচ ট্রেন ছাড়ছে না? টাইম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও? টাইম গুলি মারুন। জানালার বাইরে তাকান, অবশ্য যদি সে পরিস্থিতি থাকে। আরে না না থাকবে, শান্ত হোন . . . সিট পাননি তো কী হয়েছে, জানালার একেবারে ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে যেতে পারবেন। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই মা সরস্বতীর পা ছুঁয়ে প্রমিস।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। জানালার বাইরে জনস্রোতের দিকে তাকান। যতক্ষণ দেখবেন সে স্রোত হেলেদুলে চলেছে ততক্ষণ ট্রেন ছাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। যেই দেখবেন লোকজন ছুটতে শুরু করেছে বুঝবেন আর দেরি নেই।

ছুটছে কেন? কোনও কোনও সময় টেকনিক্যাল কারণ থাকে ছোটার। ধরুন যদি আপনি পুরুষ হন আর ধরুন যদি ট্রেন ছাড়ার সময়ে যদি আপনার হাতের কাছে লেডিস কামরা পড়ে যায়। তখন প্রাণপণে দৌড়ে সে কামরাটা পেরিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। তবে বেশিরভাগ সময়ে অত জটিল কারণ থাকে না। লোকে এমনিই শখ করে দৌড়য়। সেই যে চিরকালীন মরীচিকা – আরেকটু এগিয়ে যেতে পারলেই বোধহয় বেটার লাইফ, ফাঁকা সিটওয়ালা কম্পার্টমেন্ট – সেই ব্যাপার আরকি।

আর কি, এবার স্টেশন আসবে, ট্রেন থামবে, নেমে পড়বেন। কায়দা একই। সামনের ভিড়ের ওপর ভর করে পেছনের ভিড়ের ঠেলায় গন্তব্যে পৌঁছনো। তবে এবার দু’একটা বাড়তি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সবথেকে জরুরি বিষয়টা হচ্ছে, ভিড় দেখে ঘাবড়ে গিয়ে নিজের স্টেশন আসার তিনটে স্টেশন আগে থেকে দরজার সামনে গিয়ে গুঁতো খাবেন না। কোনও আত্মসম্মানওয়ালা ডেলিপ্যাসেঞ্জার ও জিনিস করে না। ওটা করলেই সবাই বুঝে যাবে আপনি আনাড়ির চরম। কোন্নগর ছাড়ার পর ধীরেসুস্থে সিট ছেড়ে . . . আই মিন, প্যাসেজ থেকে বেরোবেন। খুব টেনশন হলে সামনের লোককে জিজ্ঞাসা করবেন তিনি নামবেন কি না, নয়তো নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের দুঃখদুর্দশার কথা ভাববেন। একটুও টেনশন করবেন না, ট্রেন আপনাকে না নামিয়ে যাবে না।

নেমেছেন? বলেছিলাম। না না, এখন দম নিতে দাঁড়ালে চলবে না। চলুন চলুন। ভিড়ের সঙ্গে স্পিড মিলিয়ে হাঁটুন। ও দিকে আবার কী দেখছেন? এ কী, মুখ এত বড় হাঁ করেছেন কেন? ওহ্‌, না না, এটা বাজার নয়, প্ল্যাটফর্মই। সে যতই জোরকদমে আলুপটল মাশরুম চিচিঙ্গা বিক্রি হোক না কেন। হ্যাঁ হ্যাঁ ইলিশ মাছও আছে। সে কী, এখন মাছ কিনতে দাঁড়াবেন নাকি? আপনি দেখছি আমার মায়ের মতো। বাজার দেখলে বাজার করার কথা মনে পড়ে। গোটা রাস্তা মনে ছিল না, হঠাৎ ফলের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে ‘কাল স্যালাডের জন্য শশা লাগত যে রে সোনা!’ শশার পর টমেটো, টমেটোর পর কাঁচালংকা। এই করতে করতে যখন শেষমেশ প্ল্যাটফর্ম থেকে নামলাম ততক্ষণে স্ট্যান্ড খালি করে সব রিকশা চলে গেছে, আমরা হাতে ফাটোফাটো বাজারের প্লাস্টিক নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি।

হ্যাঁ, রিকশা চাইলে ইলিশ ছেড়ে এখন চলুন। গুড। ওরে বাবা, অত জোরে না হাঁটলেও চলবে। থাকবে রিকশা।

উঁহু, ওদিকে তাকাবেন না। জানি টেবিল পাতা আছে, জানি টেবিলের ওপর ক্যারামের গুটির মতো গোল গোল কী সব ঘুরছে, জানি যারা ঘোরাচ্ছে তাদের চোখেমুখে চোরচোর ভাব। টেবিলটা ফোল্ডিং। পুলিশ আসছে বুঝলেই যাতে গুটিয়ে নিয়ে বগলে করে পালাতে পারে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক পালাতে পারবে। জুয়াচোর আর পুলিশে কখনও দেখা হওয়ার নিয়ম নেই জানেন না? হয় পুলিশ ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে আসবে, নয়তো এঁরা দারুণ জোরে দৌড়বেন।

প্ল্যাটফর্ম শেষ, এবার কোন দিকে? আচ্ছা আপনি বলুন দেখি। আপনি এতক্ষণ আমাকে প্রশ্ন করছেন, এবার আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। এই যে দুটো রাস্তা দেখছেন, একটা বুক ফুলিয়ে আলোঝলমল ভিড়ভিড়াক্কার বাজারের মধ্য দিয়ে গটগটিয়ে চলে গেছে আর অন্যটি ব্যাপারস্যাপার দেখে টুক করে বাঁয়ে বেঁকে বুড়ো অশ্বত্থগাছটার তলার অন্ধকার দিয়ে সটকেছে।

কোনটা আমার রাস্তা হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? আহা, গেসই করুন না।

জানতাম পারবেন। ঠিক ধরেছেন, ওই আনস্মার্ট মেনিমুখো রাস্তাটাই আমার রাস্তা। চলুন, এবার রিকশা . . . বিজয়কাকু? কেমন আছ? আমি ভালো। আরে বেশিদিন না, এই পরশুই চলে যাব। পুজোয়? জানি না গো আসা হবে কি না, ইচ্ছে তো আছে।

চলুন চলুন, উঠে পড়ুন। সে কী, আপনি রোজ যে বাসে আসাযাওয়া করেন তার কনডাক্টরের নাম জানেন না? অবশ্য শহরের ব্যাপারস্যাপার আলাদা। সত্যি বলতে কি আমারও ফার্স্ট নেম বেসিসে চেনা রিকশাকাকুর সংখ্যা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এখন যারা জোয়ান, তারা আমাকে চেনে না, আমিও তাদের চিনি না।

নাঃ, মনখারাপ করছি না। সময়ের নিয়ম, কে খণ্ডাবে। ওটা? ওটা শনিমন্দির। ভাগ্যিস শনিবার নয়, নয়তো দেখতেন ভিড় কাকে বলে। রাস্তা জ্যাম হয়ে যেত। এর পর আসবে হনুমান মন্দির, এর চাতালে প্রতি সন্ধ্যেয় ঢোলকরতাল নিয়ে হনুমানচালিসা গান হয়। এখন হচ্ছে না কেন কে জানে। হয়তো শেষ হয়ে গেছে। কিংবা টিভিতে ভালো সিনেমা দিয়েছে। জানেন, এই সাইকেলের দোকানটায় আমি সাইকেল রাখতাম রোজ স্কুলে যাওয়ার আগে। ঝুপড়ি? কোন ঝুপড়ি? ওহ্‌, যেটার সামনে ভিড় করে লোক দাঁড়িয়ে আছে? আহা ঝুপড়ি কোথায়, দিব্যি বোর্ডে বড় বড় করে ‘মালা রুটি সেন্টার’ লিখে রেখেছে তো। জানেন এটা যখন খুলেছিল, ওই যে ভদ্রলোক রুটি সেঁকছেন গোমড়ামুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তিনি এই এইটুকু ছিলেন। সিরিয়াসলি। এঁরা তিন ভাই। একজন আমার থেকে একটু বড় ছিল, একজন ঠিক আমার সমান, আর ছোটজন এই ইনি। মাবাবাকে দেখছি না, রিটায়ার করেছেন বোধহয়। ছেলেরাই দেখছে এখন ব্যবসা। শুরুতে এটা সত্যিসত্যিই একটা রোগা ঝুপড়ি ছিল। একটা উনুন, একটা বেলুনচাকি, একটা চিমটে, একজোড়া রোগা বাবামা, তিনটে লিকপিকে বাচ্চা। যখন ওদের একটাও রুটি বিক্রি হত না, তখনও মালার মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল। তকতকে পরিষ্কার দোকানঘরের সামনে উনুনে আঁচ দিয়ে, আটা মেখে বসে ধৈর্য ধরে বসে থাকত পাঁচটা লোক। তারপর একদিন সন্ধ্যেবেলা অফিসফেরৎ এক ভদ্রমহিলা থামলেন। তাঁর দেখাদিখি আরেক জনের সাহস হল। তারপর আরেকজন। তারপর আরেকজন। মাসখানেক পর প্রথম রিকশার বদলে একটা সাইকেল এসে থামল। বারোটা রুটি প্যাক করে দাও তো, বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে বলেছে। ব্যস। মালার ব্যবসা পাখনা লাগিয়ে সেই যে উড়ল আর কখনও পড়তে দেখিনি তাকে। তারপর তো ভেতরে বসে খাওয়ার জায়গাও হল। মাঝে মাঝে গানের স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার আর মায়ের খুব ইচ্ছে হত রিকশা থামিয়ে একদিন বসে গরমগরম রুটি তরকারি খেয়ে যাই, কিন্তু রাস্তায় সর্বক্ষণ পাড়ার লোকের এত ভিড় থাকত যে মায়ের সাহস হয়নি। দেখলে সবাই নিশ্চয় ভাবত বৌদির মাথাটা গেছে।

হ্যাঁ, স্টেশন ছেড়ে এগিয়ে এলে আর তেমন আলো নেই এই রাস্তাটায়। ভালো তো। আকাশের তারাগুলো কত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেখুন। দূরে ওই যে তিনটে ছায়াছায়া তালগাছ, একটুও না বেঁকে সোজা উঠে গেছে, দেখতে পাচ্ছেন? মা বলেছিলেন, ‘দেখেছিস সোনা, ঠিক যেন ভূতের স্কেল।’ তারপর থেকে সোজা ঠ্যাংঠেঙে তালগাছ দেখলেই আমি তাকে ভূতের স্কেল ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনি।

এই তো, চলেই এসেছি প্রায়। অধৈর্য হচ্ছেন কেন। এবার বাঁয়ে বেকব, তারপর ডায়ে, তারপর আবার বাঁয়ে, আবার ডায়ে, আবার বাঁয়ে বেঁকে সোজা নাকবরাবর। আর অন্ধকার পাবেন না রাস্তায়। এবার রাস্তাঘাট সব পাড়ার মধ্য দিয়ে। এই রাস্তার বেশিরভাগ বাড়ির লোককে আমি চিনি। নাম জানি না, অফ কোর্স, কিন্তু মুখ চিনি। এই যে মোড়টা . . . সামলে. . . হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে বসুন, এই জায়গাটা একটু উঁচুনিচু আছে। এই মোড়টা দিয়ে একবার আমি আর বুচিদিদি সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলাম আর উল্টোদিক থেকে দুটো লোক আরেকটা সাইকেল চেপে আসছিল। আমার তখনও হাত স্টেডি হয়নি। আমি সাইকেলটাকে আসতে দেখে কেমন ভেবলে গিয়ে হাতটাত কাঁপিয়ে ফেললাম, ওদিকের লোকদুটো সংঘর্ষ এড়াতে ‘আরে আরে এ কী এ কী!’ বলে খচমচিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। আমি তো একমুহূর্ত না থেমে অকুস্থল থেকে যত দ্রুত সম্ভব পালানোর চেষ্টা করছি, বুচিদিদিও আমার পেছন পেছনই আসছে, এদিকে ওই লোকগুলো সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে, ‘চালাতে পারে না, এদিকে রাস্তায় বেরোনো চাই’ এইসব তড়পে চলেছে। আমি বুচিদিদিকে সবে বলছি, ‘বুচিদিদি, পালাও পালাও’, এমন সময় বুচিদিদি মোটা গলায়, ‘তুই থাম তো’ বলে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে পেছন ফিরে যেই না চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘আপনারা যখন এতই ভালো চালাতে পারেন তখন কাটিয়ে গেলেই পারতেন দাদা’ অমনি লোকদুটো সুড়সুড় করে সাইকেলে উঠে পড়ে চম্পট। বুচিদিদি থমথমে মুখে সিট ঝেড়ে আবার সাইকেলে উঠতে উঠতে বলছে, ‘কিছু বলা হয় না বলে বেশি পেয়ে বসেছে’, এই ছবিটা এখনও আমার চোখে লেগে রয়েছে।

বুচিদিদির বয়স? তখন? মেরেকেটে চোদ্দ। আমার থেকে মোটে চারবছরের বড় বুচিদিদি, কিন্তু সাহস অন্তত চারকোটিগুণ বেশি। চিরদিনই।

এই তো এসে গেছি এবার। এটা তনুশ্রী আইচের বাড়ি, আমার সঙ্গে কেজিতে পড়ত, ওটা তুলতুলিদি’দের, এটা অমিত কাকুদের, এটা মাখনদাদুর, এটা টুকাইদার, এটা বুচিদিদিদের আর ওওইটা অবশেষে আমাদের বাড়ি। অ্যাঁ? কলাগাছ? বাবা আপনার তো দারুণ চোখ। এই অন্ধকারেও দেখে ফেলেছেন। মা ফোনে বলছিলেন খুব কাঁদি ধরেছে নাকি। তবে ও দিকে নজর দেবেন না, বাগানের পেছনের জানালায় বসে একজন নির্ঘাত সে কাঁদির দিকে তাকিয়ে ঠায় পাহারা দিচ্ছেন, আপনি হাত ছোঁয়াতে গেলেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবেন।

যাই হোক, বাড়ির কথা জানতে চাননি আপনি। রুট জানতে চেয়েছিলেন। বলে দিলাম। এই সেই রুট। কী বলছেন? যথেষ্ট শর্ট নয়? আরে লং-শর্ট তো আপেক্ষিক। তাছাড়া মোটে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগেছে পৌঁছতে, আর কত কম চাই আপনার? যাই হোক, আমার আর আপনাকে দেওয়ার মতো সময় নেই। আপনার পছন্দ হলে আমার রুটের কথা আপনার সমীক্ষা রিপোর্টে লিখবেন, না হলে লিখবেন না। আপনার হিসেবে শর্টেস্ট হোক না হোক, এটাই আমার শিওরেস্ট রুট টু হ্যাপিনেস।


Comments

  1. thiki to etai to "শিওরেস্ট রুট টু হ্যাপিনেস।" :-) ... ei rasta amar khub chena.... :-)
    ei rasta r kachhei ek somoi onek jatayat chhilo. jara thakten tara Rishra chherechhen. kintu amader khusi khusi chhotobelar onekta roe gachhe eikhanei.... tai aro beshi bhalolaglo.
    chhotobelai soni robi holei ma ke dhore jhule portam jodi odikpane jaoa jai. takhon bujhtam na keno ma soni robi eto gorimosi koren. ekhon hare hare bujhi ... ar amar meye bujhte chaina :-D

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওওও, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে তো রিষড়ার একটা সম্পর্ক আছে ইচ্ছাডানা। সত্যি, শনিরবি কত কাজ করতেন মাবাবা। তখন কল্পনাও করতে পারতাম না যে ওঁদের কষ্ট হতে পারে। আমাকে উইকএন্ডে তার সিকি পরিমাণ কাজ করতে বললে অজ্ঞান হয়ে যাব।

      Delete
  2. bah darun laglo...amar khub bari jete icche korche :) - tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. পুজোয় চলে যা, তিন্নি।

      Delete
  3. আপনার তো পোয়া বারো, অ্যাঁ? এই দিল্লি, এই রামগড়, এই বাড়ি। ক'দিনের জন্য গেছেন? একাই গেছেন না অর্চিষ্মানকে নিয়ে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই সেরেছে, আমি তো সি আর পার্কে গ্যাঁট হয়ে বসে আছি দেবাশিস। লেখার বিষয় পাওয়া যাচ্ছিল না বলে ঝুলি ঝেড়ে নস্ট্যালজিয়ার রুগ্ন বেড়াল আবার বার করেছি

      Delete
  4. আবার মনটা খারাপ করে দিলে তো? দেড় বছর হয়ে গেল বাড়ির মুখ দেখিনি|
    ভালো খবরের মধ্যে এই যে কাল বাবা-মা আসছেন| ট্রেন টা সাত ঘন্টা লেট করে হলেও শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলছে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ বাঃ, দারুণ খবর অপরাজিতা। এতক্ষণে নিশ্চয় কাকু কাকিমা পৌঁছে গেছেন? খুব আনন্দ কর। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছ নাকি সবাই মিলে?

      Delete
    2. যখন কমেন্ট টা দেখলাম তখনও ট্রেন স্টেশনে আসতে পাক্কা ১ ঘন্টা| তাই আর উত্তর দিইনি তখন| কাঁহাতক আর আসছে না কেন আসছে না কেন বলে কান্নাকাটি করব?
      তবে পরের বাপার টা ঠিক ধরেছ| বেড়াতে গেছিলাম| মহাবালেশ্বর - পঞ্চগনি - প্রতাপগড়| ছবি পাঠাব| আর ছোট্ট একটা থ্যাংক ইউ বলে রাখি| বৃষ্টিতে ভিজে ভুট্টা খাওয়ার আইডিয়া দেওয়ার জন্য|

      Delete
    3. আমি তোমার ব্লগ পড়া শুরু করেছি ১ বছর হয়ে গেল তো!

      Delete
    4. কে যেন বলেছিলেন, দিন যত আস্তে কাটে বছর কাটে ততই দ্রুত। আবারও প্রমাণ হয়ে গেল অপরাজিতা। পঞ্চগনির বোর্ডিং স্কুলে সব ফিল্মস্টারদের ছেলেমেয়েরা পড়তে যায় শুনেছিলাম। কেমন জায়গাটা? পড়ায় মন বসার মতো?

      Delete
  5. offff..apnar lekha pore hajar smriti gulo bhitor theke nariye diye gelo..ei idli dosar rajye bose theke birati,nijer para,parar manush jon,barir library room,barir samner pukur...sob kichuke natun kore miss korlam..jai ektu coffee kheye asi..nahole apni to dekhchi aj kaje mon bosate deben na.. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দূর থেকেই ভালো ঋতম। যখন রোজ সাইকেল করে দৌড়তাম তখন কি এত ভালো লাগৎ নাকি? যেমন কেঁদেককিঁয়ে লিখেছি?

      Delete
  6. আমি আর হাওড়া থেকে ট্রেন এ উঠি না.
    আমি উঠি বালি থেকে, ভিড়ে ঠাসা ট্রেন এ কোনও মতে শরীর টা গলিয়ে দাড়িয়ে পড়ি দরজার সামনে, শুধু অপেক্ষা থাকে কখন রিশরা আসবে|
    এক দমকে ট্রেনটা ফাঁকা হয়ে যায় অনেকটা | আর একটা স্টেশন ব্যাস ... তারপর আমি ও পৌছে যাই আমার root এর কাছে... ওই একটা স্টেশন এর না ফুরোতে চাওয়া রুট পেরিয়ে |

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা, আমি এই ব্যাপারটা লিখব ভাবছিলাম জানেন আত্মদীপ। এই রিষড়াতেই অর্ধেক ট্রেন ফাঁকা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। আপনি বলে দিলেন, থ্যাংক ইউ। শ্রীরামপুরে আমি গান শিখতে যেতাম। রবিবারের কত সন্ধ্যে যে ওই এক/দুই নম্বর ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছি।

      Delete
  7. রিশরা বানান টা কিছুতেই ঠিক করে টাইপ করতে পারলাম না :(
    তবে আপনার বাড়ির ঠিকানা টা যে জন্যই রাখলেন ভালই হলো ... এক্কেবারে গিয়ে অবান্তর এ অটোগ্রাফ নিয়ে আসবো.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে আত্মদীপ, একটুও খারাপ পাবেন না। গত কয়েক বছরের দৈনিক দু'ঘণ্টা বাংলা টাইপ করার অভিজ্ঞতায় আমি জানি, 'রিষড়া' টাইপ করার থেকে বেশি শক্ত কাজ পৃথিবীতে মেরেকেটে আর পাঁচটা আছে। তিনটে ব্যঞ্জনবর্ণের ওই পুঁচকে শব্দ লিখতে গিয়ে ক্যাপস লক, অলট, কন্ট্রোল, শিফট, শীর্ষাসন - কত কিছু যে করতে হয় বাপরে।

      আমার বাড়িতে আসার সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। আমাদের পাড়ায় একটা ভালো চপের দোকান আছে, অটোগ্রাফ দিতেনিতে সে দোকানের বেগুনিফুলুরি সাঁটানো যাবে বেশ। তারপর আমরা ট্রেনে করে আবার শ্রীরামপুর যাব, গিয়ে সম্রাটের মোগলাই খাব। এককোটি বছর আগে পিসির সঙ্গে একবার খেয়েছিলাম।

      Delete
  8. bari jabooooo
    mithu

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে কী, সবাই একসঙ্গে দিল্লিকে ফেলে রেখে চলে গেলে কী করে হবে মিঠু? আগে আমি ঘুরে আসি, তারপর তুমি যেও।

      Delete
  9. এই লেখাটা আমার খুব ভালো লেগেছে, কুন্তলাদি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ, অনির্বাণ।

      Delete
  10. Durdanto likhecho.. khub bhalo laglo... thank you..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধন্যবাদটা তোমারই প্রাপ্য ইনিয়া। ভালো লাগল তোমার কমেন্ট পেয়ে।

      Delete
  11. Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, কোয়েল।

      Delete
  12. tomar route ta porte porte na amio Barrackpur chole giyechilam jano...Barrackpur local...station...riksha-te bari...prochur mil tomar r amar route-r moddhe...monta abar kharap hoye gelo....ki je karo na......

    ReplyDelete
    Replies
    1. ট্রেনলাইনের ধারের সব জায়গাই এক রকম দেবশ্রী। তোমার সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা মেলে জেনে খুশি হলাম।

      Delete
  13. কয়েকদিন ছিলামনা তাই মন্তব্য করা হয়নি। দারুন হয়েছে লেখা - পরেরবার আপনার বাড়ি যেতে চাইলে একটুও অসুবিধে হবেনা, গুগল ম্যাপস ছাড়াই সোজা পৌঁছে যেতে পারব। :-)

    ReplyDelete
  14. Jara bari theke duure...aar bari ferar monkemoner sathe deerghobaas....tader torof theke onek onek dhonyobad. Firlam barite. Tor lekhar sathe.

    ReplyDelete
  15. Apni ekhono amader baRi chailei aste paren. bhoyanok soja rasta. Rishra station-e neme poschimdike ese oi rikshastand-e bolben, “Rabi je baRite jan roj sokale sei baRita kothay bhai?”, je keu chokh buje niye asbe.

    এটার থেকেও যে Shortest Route বলা যায় তা দেখালে তুমি।
    দারুণ হয়েছে।
    আর সুগত দাদার কথাই গুগল ম্যাপস্ ছাড়াই সোজা পোঁছে যাব।
    :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অনুজিত।

      Delete
  16. বাঁড়ি যাবও (একঘেয়ে নাকিকান্না সুরে) :( :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা স্বাগতা। এই তো বাড়ি থেকে গেলে, আর একটু সবুর কর, আবার আসবে।

      Delete

Post a Comment