The Girl On The Train




উৎস গুগল ইমেজেস

কেমন আছেন? আমি এতদিন অবান্তরের খোঁজ নিতে পারছিলাম না বলে একটু মন্দ ছিলাম, এখন আবার চাঙ্গা বোধ করছি।

কে বলেছিল ভুলে গেছি, হয় কুহেলি নয় অন্বেষা, অবান্তরের সাইডবারে যে ঢাক পিটিয়ে সবাইকে নিজের বই পড়ার কথা জানাই, সেই বইগুলো নিয়ে পোস্ট লিখতে। খুবই ভালো পরামর্শ। তাছাড়া অবান্তরে বিষয়ের লেবেলের সারিতে বইপত্র বলে একটা লেবেল আছে যেটা বহুদিন ধরে অবহেলিত পড়ে আছে। সব মিলিয়ে আমি স্থির করেছি এবার থেকে সব বই না হলেও আমার পড়া কিছু কিছু বই নিয়ে আবার নিয়মিত হাজারদুয়েক শব্দ লেখার চেষ্টা করব।

প্রথমেই আমার ফেভারিট ঘরানার বই দিয়ে শুরু করা যাক। দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন। বইটা আপনারা অনেকেই পড়ে ফেলেছেন, না পড়লেও বইটা নিয়ে চেঁচামেচি নির্ঘাত কানে এসেছে। আমার কানেও বহুদিন ধরে আসছিল কিন্তু পড়া হয়ে উঠছিল না। মাসখানেক আগে সুযোগ হল। এই রইল বইটা পড়ে আমার মনে যা যা ভাবের উদয় হয়েছে তার ফিরিস্তি। ফিরিস্তির ফাঁকে ফাঁকে বোনাস কুইজ হিসেবে তিনটে প্রশ্নও রইল, দেখুন তো উত্তর দিতে পারেন কি না।

(নিচের লেখায় কোনও স্পয়লার নেই।)

*****

কৈলাস কলোনি মেট্রো স্টেশন পেরিয়ে নেহরু প্লেসের দিকে এগিয়ে আসার পথে বাঁ দিকে পড়ে বাড়িটা। হলুদ দেওয়ালে লাল বর্ডার দেওয়া বেশ বড় দোতলা বাড়ি। সামনে এল অক্ষরের মতো কংক্রিটের বাঁধানো চাতাল, এল-এর লম্বা অংশটা বাড়ির ডান দিক দিয়ে পেছন দিকে চলে গেছে। গেটের বাইরে দারোয়ানজীর খুপরি ঘর, ঘরের বাইরে চেয়ার নিয়ে দারোয়ানজী বসে থাকেন। মাঝেসাঝে দারোয়ানজীর পায়ের কাছে একটা হোঁৎকা গোল্ডেন রিট্রিভারকেও ঘোরাঘুরি করতে দেখি।

কিন্তু যেটা সবথেকে বেশি করে দেখি সেটা হচ্ছে দোতলার বারান্দাখানা। লম্বায় চওড়ায় প্রায় আমাদের বাইরের ঘরটার সমান। বারান্দারও দেওয়াল হলুদ, রেলিং লাল। আধুনিক বাড়ির বারান্দায় অনেক সময়েই গাছপালা, বনসাই ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হয়, এ বাড়িতে সে সবের পাট নেই ঝকঝকে তকতকে ফাঁকা মেঝে (এটা মেট্রো থেকে দেখেছি), সিলিং থেকে সাবেকি তিন ব্লেডের ফ্যান ঝুলছে। বারান্দা শেষ হয়ে যেখানে ঘরের দেওয়ালে মিশেছে সে দেওয়ালে দুটো বড় বড় জানালা। তাদের অবশ্য আমি কোনওদিন দেখিনি, কিন্তু তারা সর্বক্ষণ লাল প্লাস্টিকে মোড়া যে দুখানা চিকের পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, তাদের দেখলেই জানালার আয়তন আন্দাজ করা যায়।

এতক্ষণ যা যা বললাম, বাড়ি, বারান্দা, চাতাল, দারোয়ান, বিলিতি কুকুর – কোনওটাই সাউথ দিল্লির বড়লোক পাড়ায় খুব অমিল দৃশ্য কিছু নয়। তবু এই বাড়িটাই আমার চোখ টানল কেন সেটার একটা কারণ আছে। আমি যখন প্রথম সাউথ এক্সটেনশন ছেড়ে চিত্তররঞ্জন পার্কে উঠে আসি, অর্থাৎ কি না যখন থেকে ওই পথটাই আমার অফিসে যাতায়াতের প্রধান পথ হয়ে দাঁড়ায়, তখন ওই বারান্দাটা ফাঁকা থাকত না। ওখানে বসে থাকতেন এক বৃদ্ধ মহিলা। গোল মুখে খাড়া নাক, স্পষ্ট চিবুক, অনেকটা আমার ঠাকুমার মতো। তবে আমার ঠাকুমার মতো জীবনের অর্ধেকটা উনুনের সামনে খরচ করতে হয়নি বলেই বোধহয় এঁর রংটা এখনও টকটকে আছে। ভদ্রমহিলার বাকি শরীরটুকু কখনও দেখতে পাইনি, কিন্তু কেন যেন কল্পনা করে নিয়েছিলাম, কেউ ওঁকে বারান্দায় এনে বসিয়ে দিয়ে গেছে, আবার উঠে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও কাউকে এসে তুলে নিয়ে যেতে হবে। উনি নিজে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে পারবেন না।

তারপর একদিন আর দেখলাম না। একদিন দেখলাম না, দুদিন দেখলাম না, একমাস দুমাস তিনমাস করে করে এখন প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেছে আমি ভদ্রমহিলাকে আর দেখিনি। এমন নয় যে ও বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের পাট উঠেছে ও পাড়ায় এ ঘটনা আকছার ঘটে, বাড়ি ফেলে সবাই চলে যায়, কিছুদিন বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে, তারপর ভেঙে সেখানে দোতলার জায়গায় চারপাঁচতলা বাড়ি ওঠে। এক এক তলায় এক একটা করে ফ্ল্যাট, সে সব ফ্ল্যাটে চিলতে বারান্দা, বারান্দা ভর্তি গাছ। মেঝেতে, গ্রিলে, সিলিং থেকে ঝুলন্ত বাহারি টবে। লোক বসার জায়গা নেই, সময়ও নেই।

এ বাড়িতে তেমন কিছু হয়নি। বাড়ি যেমনকার তেমন আছে, গেটের সামনে দারোয়ানজী যেমনকে তেমন পাহারা দিচ্ছেন, গোল্ডেন রিট্রিভার আরও মুটিয়েছে, এখন ঘোরাঘুরির বদলে বেশিরভাগ সময়টাই দারোয়ানজীর পায়ের কাছে বসে ঝিমোয়।

অর্থাৎ ভদ্রমহিলার অন্তর্ধানের পেছনে দুটো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বাকি রয়ে গেল। হয় তিনি চলচ্ছক্তিরহিত হয়েছেন আগে তাঁকে ধরে ধরে বারান্দায় এসে বসান যেত, এখন আর যায় না, এখন তিনি বাড়ির ভেতর কোনও ঘরে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকেন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নল গুঁজে। খুব সম্ভবত ওই রক্তবর্ণ চিকঢাকা জানালার ওপারের ঘরে।

আমার অবশ্য মনে মনে ভোট তিন নম্বর সম্ভাবনাটার দিকে। যদিও আমার পক্ষে সেটা যাচাই করার কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করেছে, এখনও মাঝে মাঝে করে, একদিন কৈলাস কলোনি স্টেশনে বা গোল্ডেন রিট্রিভারের নাকের ডগায় অটো থামিয়ে নামি। গিয়ে দারোয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করি, “আপনাদের বারান্দায় যে ঠাকুমা বসে থাকতেন তাঁর কী হল? শেষটা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন কি?”

*****

ওপরের কথাগুলো বলা এই কারণেই যে দৈনন্দিন যাতায়াতের পথে কোনও বিশেষ জিনিসের - গাছ, বাড়ি বা বাড়ির বাসিন্দা - প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং তাদের ওপর নিয়মিত কৌতূহলী নজরদারি চালানো বেশ আকছার ব্যাপার। আর আকছার বলেই সে নিয়ে গল্প ফাঁদা যায় না। অন্তত রহস্যরোমাঞ্চ গল্প না। সে রকম গল্প ফাঁদতে গেলে দৃশ্যে চলচ্ছক্তিহীন ঠাকুমার থেকে ইন্টারেস্টিং চরিত্রের দরকার হয়, কিন্তু তার থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং হতে হয় যে এই দৃশ্যের যে দর্শক, তাকে।

র‍্যাচেল ওয়াটসনের মতো ইন্টারেস্টিং। দৃশ্যের বাইরে নির্বিকার দর্শক হয়ে বসে থাকায় যার রুচি নেই, যে দৃশ্যের ভেতর ঢুকে অংশগ্রহণ করতে চায়।

র‍্যাচেল রোজ সকালে ট্রেনে চেপে অফিস যায় অ্যাশবেরি থেকে ইউস্টন বেশিরভাগ দিনই র‍্যাচেল জানালার সিট পায়। বেশিরভাগ দিনই লাইনের একটি জায়গায় পৌঁছে সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেনটা ঢিকোতে শুরু করে। আর ঠিক সেইখানেই, রেললাইনের একেবারে পাশে র‍্যাচেলের নিজের বাড়ি। ছিল, এখন আর নেই। এখন সে বাড়িতে থাকে টম আর টমের স্ত্রী অ্যানা ওয়াটসন। র‍্যাচেলকে ডিভোর্স দিয়ে টম অ্যানাকে বিয়ে করেছে। ট্রেনে করে চাকরি করতে যেতে যেতে র‍্যাচেল দেখে ওর পুরোন বাড়ির গায়ে নতুন রং, জানালায় নতুন পর্দা। দেখলেই বোঝা যায় এবাড়ির লোকেরা খুব সুখে আছে। র‍্যাচেল প্রাণপণে সে সুখের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে চায়, আর সেটা করতে গিয়েই র‍্যাচেলের চোখ পড়ে যায় অন্য একটি বাড়ির দিকে। এ বাড়িটাও লাইনের একেবারে ধারে, এ বাড়িতেও আছে একটা ছোট্ট বাগান আর একট খোলা ছাদ, ঠিক যেমন টম আর র‍্যাচেলের বাড়িতে ছিল। সে ছাদে সকালসন্ধ্যেয় পাশাপাশি বসে থাকে এক দম্পতি। সুদর্শন, সুখী, ঠিক যেমন টম আর র‍্যাচেল ছিল। র‍্যাচেল তাদের দেখে আর ভাবে। কী হতে পারত, কী হল না। ভাবে আর ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া জিন অ্যান্ড টনিকের বোতল গলায় উপুড় করে ধরে।

দিন যায়। র‍্যাচেলের মনের অসুখ ক্রমে গভীর থেকে গভীরে শিকড় ছড়ায়। ক্রমে র‍্যাচেল নিজেকে ছাদের দম্পতির সঙ্গে একাত্ম করে ফেলে। যেন ওদের জীবনটা শুধু ওদের (র‍্যাচেল ওদের নাম দিয়েছে জেস আর জেসন) নয়, তাতে র‍্যাচেলেরও অংশ আছে। ঠিক এই সময় একদিন জানালা দিয়ে জেস আর জেসনের বাড়ির ছাদে এমন একটা ঘটনা ঘটতে দেখে র‍্যাচেল, যেটা যেটা ওর এতদিনের কল্পনা, যা এখন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে, তাকে চুরমার করে দিয়ে যায়। র‍্যাচেলের জায়গায় আমি আপনি হলে হয়তো আঘাতটা হজম করে নিতাম, পরদিন থেকে আর ওই জানালার পাশে বসতাম না, বসলেও ওই ছাদটার কাছাকাছি পৌঁছে জোর করে চোখদুটো হাতে ধরা ম্যাগাজিনের পাতায় সেঁটে রাখতাম।

কিন্তু র‍্যাচেল আমি আপনি নয়, র‍্যাচেল এই মুহূর্তে বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত রহস্যরোমাঞ্চ গল্পের মুখ্য চরিত্র। কাজেই গোলমাল দেখে, ক্যানের অবশিষ্ট জিন অ্যান্ড টনিক এক চুমুকে শেষ করে, ট্রেন থেকে নেমে র‍্যাচেল চলল ব্যবস্থা নিতে। পরিণতি, বলাই বাহুল্য, ভালো হল না।

সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তার নতুন নতুন নজির কায়েম করেছে ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’। জে কে রোলিং-এর ‘ক্যাজুয়াল ভেকেন্সি’ আর ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য লস্ট সিম্বল’কে হারিয়ে টানা কুড়ি সপ্তাহ ইংল্যান্ডের বেস্ট সেলার হয়ে থেকেছে প্রথম প্রকাশের সাত মাস এবং সাতাশটি মুদ্রণের পরেও এ বইয়ের বাজার তুঙ্গে। ‘গুডরিডস’ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুখ্য এক্সিকিউটিভ ওটিস চ্যান্ডলার আগস্ট মাসে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁদের ওয়েবসাইটে ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ রেটেড হয়েছে ২৭৫,০০০ বার, এ বছর প্রকাশিত হওয়া অন্যান্য বইয়ের তুলনায় পাঁচগুণ। সিনেমা বানানোর জন্য ড্রিমওয়ার্কস অলরেডি বরাত নিয়ে বসে আছে।

অথচ ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ পলা হকিন্সের লেখা প্রথম থ্রিলার। এর আগে হকিন্স বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় টাকাকড়িসংক্রান্ত প্রতিবেদন লিখেছেন, মহিলাদের জন্য আর্থিক উপদেশ নিয়ে ‘দ্য মানি গডেস’ নামে একটি ননফিকশন বই লিখেছেন আর এমি সিলভার ছদ্মনামে চারটি উপন্যাস লিখেছেন, চারটিই রোম্যান্টিক কমেডি।

কোন জাদুতে একজন আনকোরা থ্রিলার লেখকের কপালে এইরকম শিকে ছেঁড়ে সে নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞেরই মত পলা হকিন্সের সঙ্গ দিয়েছে সময়। টাইমিং। ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ এমন সময় প্রকাশ পেয়েছে যে সময়টা ডোমেস্টিক নোয়ার ঘরানার স্বর্ণযুগ। দু’হাজার বারো সালে প্রকাশিত দুনিয়া কাঁপানো ‘গন গার্ল’-ও এই ঘরানার প্রতিনিধি। সাধারণ গোয়েন্দা গল্পের সঙ্গে এই ঘরানার গল্পের প্রধান তফাৎ হচ্ছে গোয়েন্দার অনুপস্থিতি। একটা রহস্য থাকে, সেটা খুনও হতে পারে বা কিডন্যাপ, ভালো জাতের গল্প হলে (যেমন গন গার্ল) তাতে খুন কিডন্যাপ দুই-ই থাকে। কিন্তু সে রহস্য সমাধানের জন্য কোনও গোয়েন্দা থাকে না। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনও একটি চরিত্রর হাতেই তালেগোলে সমাধানের চাবি এসে পড়ে, কিন্তু সেটাও কোনও অর্থেই সাবেকি গোয়েন্দাগিরি নয়।

সাবেকি গোয়েন্দা বা হু ডান ইট গল্পের সঙ্গে সঙ্গে ডোমেস্টিক নোয়ার ঘরানার আরেকটা তফাৎ হচ্ছে এর চরিত্রমণ্ডলীতে। কোনও এক সমুদ্রসৈকতে একগাদা অবসরপ্রাপ্ত মেজর, ফিল্মস্টার, শিল্পী, প্রাক্তন প্রেমিক, হিংসুটে স্বামী, মৌলবাদী ধর্মগুরু, অকৃতদার বুড়োবুড়ির দল জমা হলে এবং তারপর সেখানে কোনও একটা খুনখারাপি হলে, তাকে ডোমেস্টিক নোয়ার বলা হবে না। ডোমেস্টিক নোয়ার-এর প্রেক্ষাপট হতে হবে একেবারে ঘরোয়া, সেখানে টানাপোড়েন হবে চারদেওয়ালের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীস্ত্রীর মধ্যে। তাদের অন্তর্বর্তী ড্রামায় ইন্ধন জোগানোর জন্য একটি দুটি বাইরের চরিত্র থাকতে পারে, তবে তার বেশি নয়। (যদিও এই ধরণের গল্পের পালের হাওয়াটা নতুন, এ জিনিস বাজারে আছে বহুদিন। ডাফনে ডু মোরিয়ে-র ‘রেবেকা’ আমরা সবাই পড়েছি, ‘রেবেকা’ একশো ভাগ খাঁটি ডোমেস্টিক নোয়ার।)

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ হিট করার আরও একটা কারণ হচ্ছে পাঠকরা র‍্যাচেলের সঙ্গে একাত্মবোধ করাতে পেরেছে। যে ব্যাপারটা র‍্যাচেলের ক্ষেত্রে পাগলামোর পর্যায়ে গেছে, সেটা আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর আছে। এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য কারও জীবনকে চোখে চোখে রাখার আনন্দ, ভয়্যারিজম, এত প্রবলভাবে আগে কখনও পৃথিবীতে গ্রাস করতে পারেনি, এখন যেমন করেছে। আমরা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকের ননস্টপ নিজের কথা, নিজের ছবি, নিজের মত প্রচার করা দেখে আতংকিত হই, কিন্তু সারাদিন ধরে সেসব শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকাটাও যে একইরকম, কিংবা আরও বেশি আতংকের, সেটা ভুলে যাই।

ডোমেস্টিক বলেই হয়তো, এই জাতের গল্পের কেন্দ্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলা চরিত্র থাকে। রেবেকায় রেবেকা, গন গার্ল-এ এমি, দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন-এ র‍্যাচেল। ডোমেস্টিক নোয়ার গল্পে মেয়েদের এ রকম বোলবোলাও দেখে কেউ কেউ আজকাল একে ‘চিক’ নোয়ার বলেও ডাকছেন।

দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন লেখা হয়েছে তিনজন নারীর বয়ানে। র‍্যাচেল ওয়াটসন, অ্যানা ওয়াটসন, মেগান হিপওয়েল। তবে র‍্যাচেলই যেহেতু 'দ্য গার্ল', কাজেই তাকেই প্রধান বা প্রিন্সিপল ন্যারেটর বলা যেতে পারে। প্রিন্সিপল এবং আনরিলায়েবল। আনরিলায়েবল ন্যারেটর হচ্ছেন “…a narrator, whether in literature, film, or theatre, whose credibility has been seriously compromised.” নাটকনভেলে আনরিলায়েবল ন্যারেটরের গুচ্ছ গুচ্ছ উদাহরণ আছেরশোমনের কথা মনে করে দেখুন। একই ঘটনা চারজন চার রকম করে বলছে, কার ওপর রিলাই করবেন আপনি? আবার ‘ইউজুয়াল সাসপেকট’-এর কেভিন স্পেসির ‘ভার্বাল’ চরিত্রটির কথা মনে করুন, গোটা সিনেমা জুড়ে যার প্রতিটি কথা আপনি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেছেন, কিন্তু সিনেমার শেষে বুঝেছেন যে সেটা করা বোকামি হয়েছে, কারণ ভার্বাল চরম আনরিলায়েবল।

উপন্যাসেও এরকম আনরিলায়েবল বক্তার অজস্র উদাহরণ আছে। যেমন লোলিটা-র হামবার্ট হামবার্ট, দ্য ক্যাচার ইন রাই-এর হোল্ডেন কলফিল্ড । এঁরা সকলেই বিখ্যাত। কিন্তু বিশ্বের বিখ্যাততম আনরিলায়েবল ন্যারেটরের মুকুট চিরকালের মতো মাথায় পরে বসে আছেন ডক্টর জেমস শেফার্ড।

বোনাস কুইজ : ডক্টর জেমস শেফার্ড কে?

র‍্যাচেল ওয়াটসনও আনরিলায়েবল ন্যারেটর, কিন্তু ওপরের ন্যারেটরদের থেকে আলাদা কারণে। র‍্যাচেল মানসিক অবসাদে টইটম্বুর, র‍্যাচেল নেশার ঘূর্ণিতে টালমাটাল, র‍্যাচেল মিথ্যেবাদী, র‍্যাচেল নিজের এবং অন্যের ভালোমন্দ সম্পর্কে আগাপাশতলা চেতনাহীন। এসবের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জুটেছে ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়ার রোগ। যত্রতত্র, যখনতখন র‍্যাচেলের ব্ল্যাকআউট হয় এবং সেই সংক্ষিপ্ত সময়ের সমস্ত স্মৃতি র‍্যাচেলের মগজ থেকে মুছে যায়।

এই শেষের ব্যাপারটা পলা হকিন্সের 'ডেয়াস এক্স মাকিনা' হতে পারত। 'ডেয়াস এক্স মাকিনা'-র মানে জানতে চাইলে উইকিপিডিয়া বলবে, “a character or thing that suddenly enters the story in a novel, play, movie, etc., and solves a problem that had previously seemed impossible to solve.” উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা নির্ভুল তবে আক্ষরিক অর্থটা, যে অর্থে গ্রিক থিয়েটারে কথাটা ব্যবহার হত, সেটা অনেক বেশি মজার। গ্রিক ভাষায় 'মাকিনা' হল মেশিন, 'ডেয়াস' হলেন গড। 'ডেয়াস এক্স মাকিনা' হল 'গড ফ্রম দ্য মেশিন'। কল্পনা করুন, থিয়েটার জমে উঠেছে, দেড় ঘন্টা লেগেছে জট পাকাতে, দেড় ঘণ্টা ধরে ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়ছে না। পরিচালক তৈরি ছিলেন, তিনি চেঁচালেন, “আগুন দে!” উইংসের পাশে একগাদা ভেজা খড় ডাঁই করা ছিল, দৌড়ে গিয়ে কেউ তাতে আগুন দিল। ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার চতুর্দিক, দর্শকরা কেশে অস্থির, অভিনেতারা কাশি চাপতে গিয়ে অস্থির, এমন সময় সেই ধোঁয়ার মধ্যে মঞ্চের ছাদ থেকে একটা দড়িতে ঝোলানো রথে করে নেমে এলেন গড। বাঙালি ঠাকুমাদের শাড়ির মতো করে পরা জামা, কাঁধের কাছে কুঁচি করে সেফটিপিন দিয়ে সাঁটা। মাথায় মুকুট, হাতে বজ্রাস্ত্র। গড রথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বদমাশদের শাস্তি দিয়ে দিলেন, ভালোদের ধরে ধরে রাজারানী করে দিলেন, সব জট খুলে গেল। পরিচালক আবার চেঁচালেন, “আগুন দে!” আবার খড়ে আগুন পড়ল, মঞ্চের পেছনে কেউ একটা কপিকলের দড়ি ধরে হেঁইও টান দিল, মাথার ওপর বজ্রাস্ত্র উঁচু করে ধরে রথের ওপর দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গড আবার আকাশে উড়ে গেলেন।

বোনাস কুইজ: “...গল্প অন্যভাবে ফাঁদতে হবে। দেড় ঘণ্টা লাগবে জট পাকাতে, দেড় ঘণ্টা ছাড়াতে।” সিনেমার গল্প ফাঁদার এই চমৎকার পরামর্শটি কোন গল্পে, কে, কাকে দিয়েছিলেন?

বোনাস কুইজ :
কোন বাংলা গল্পে ভেজা খড়ে আগুন দিয়ে এক নকল গড এবং সে গডের ভণ্ড গুরুকে তাড়ানো হয়েছিল? এই ভেজা খড়ের আইডিয়াটা বেরিয়েছিল কার মাথা থেকে?

পলা হকিন্সের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগটা তোলা যেতে পারত। র‍্যাচেলের ব্ল্যাকআউটের ফাঁকে সব কাজের ক্লু চাপা পড়ে আছে, সময়মতো তারা রথে চড়ে সিলিং ফুঁড়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে রহস্যের সমাধান বাতলে দেবে, যখন পাঠকের পক্ষে রহস্য সমাধানের কোনও আশাই থাকবে না।

সে অভিযোগ যে কারণে তোলা যায়নি আমার মতে সেটাই ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’-এর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার আসল কারণ। পলা হকিন্সের লেখা। ঝরঝরে, টানটান, সংযত। কলমের জোর প্রমাণের ব্যস্ততা নেই, প্রকৃতি বা মানুষের অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা নেই, গল্পের জন্য যতখানি দরকার ঠিক ততটুকুই আছে। পাতার পর পাতা উল্টে যাওয়া যায় অক্লেশে, সবথেকে ভালো ব্যাপার হচ্ছে পড়তে গিয়ে মনে হয় লেখকেরও লিখতে বিশেষ কষ্ট হয়নি, কিবোর্ডের সামনে বসতে না বসতেই আঙুল থেকে লাগসই শব্দরা সারি সারি বেরিয়ে এসেছে। রহস্যরোমাঞ্চের উপযোগী মুনশিয়ানাও আছে বিস্তর, শেষ পাতায় পৌঁছে যখন গোটা নকশাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন বোঝা যায় যে এ যাবৎ একটি দৃশ্য বা একটি সংলাপও লেখক বাজে খরচ করেননি, তারা প্রত্যেকেই নকশার একেকটা টুকরো।

শুধু আমি বলছি না, স্টিফেন কিং-ও বলছেন। পলা হকিন্সের জীবনের প্রথম থ্রিলার উপন্যাসের সম্পর্কে তিনি টুইট করেছেন, “Really great suspense novel. Kept me up most of the night. The alcoholic narrator is dead perfect.”

*****

প্রথম থ্রিলারের এই অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার ঢেউ পেরিয়ে পলা হকিন্স আবার কাজে ফিরে গেছেন। চলছে তাঁর জীবনের ষষ্ঠ প্রকাশিতব্য উপন্যাস লেখা। উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিয়ে হকিন্স বেশি মুখ খুলছেন না, কিন্তু জানা গেছে এটিও থ্রিলার, এটিরও কথক এক নারী। আর ঘটনা ঘটছে ইংল্যান্ডের উত্তরে যেখানে সারাবছর টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ে, কুয়াশা আর মেঘে ঘিরে থাকে চরাচর, আর যেখানে এই সেদিন পর্যন্ত, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেও, ডাইনি অপবাদে মেয়েদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে।

আমি অলরেডি হাঁ করে বসে আছি।


Comments

  1. বইটার কথা আমিও শুনেছি, কিন্তু পড়া হয়নি এখনও। আপনার লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে এবারে বইটা পড়তেই হবে। :)
    কুইজের উত্তরের প্রথমটা 'দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড্‌ এর সেই বিখ্যাত 'আন্‌রিলায়েব্ল ন্যারেটার' , দ্বিতীয়টি লালমোহনবাবুর উদ্দেশ্যে ফেলুদার পরামর্শ আর তৃতীয়টা বিরিঞ্চিবাবা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সবক'টা উত্তরই ঠিক, অরিজিত। বইটা পড়ে ফেলুন, মনে হয় ভালোই লাগবে।

      Delete
  2. Boita porechhi. Besh bhaalo..
    Uttor gulo:
    1> Narrator in Murder of Roger Ackroyd
    2> Feluda to Lal Mohan Babu in Bombaiyer Bombete
    3> Birinchi Baba. Idea eshechhilo Nirupmar theke, Prof Noni's wife / Buchki'r didi

    By the way, Ruth Rendell-e amaake addicted korar jonno thanks!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংকস-এর আবার কী। আমি কিন্তু ভাবছিলাম মনে মনে যে অর্পণের রুথ রেন্ডেল কেমন লাগল ইত্যাদি। ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম।

      উত্তর তো সব ঠিকই হয়েছে। শেষের নিরুপমা দেবীর স্থানাংক যেভাবে বিশদে বুঝিয়েছ, ননী বুঁচকি ইত্যাদি বিন্দুর সাপেক্ষে, তাতে তোমাকে এক্সট্রা নম্বর দিলাম।

      Delete
  3. Ei re. Ei prothom tomar ar amar mot millo na. Amar Girl on the Train besh average legechhe. Gone Girl er songe bheeshon beshi similarity khuje peyechhi. Ar ekta point er porey main choritro tir songe empathize kora etotai kothin hoye porchhilo je besh biroktoi lagchhilo.

    Se jai howk. Ami apatoto Galbraith er porer boitar opekkhay.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার তো ওই ব্যাপারটাই বেশি ইন্টারেস্টিং আর ইমপ্রেসিভ লেগেছে, বিম্ববতী। র‍্যাচেলের মতো এ রকম একজন 'আনলাইকেব্‌ল' প্রধান চরিত্র নিয়ে উপন্যাসের পাথার পাড়ি দেওয়ার প্ল্যানটা। তুমি ঠিকই বলেছ, একটা সীমার পর র‍্যাচেলের প্রতি মায়াও হয় না আর, রাগ হতে থাকে। সেটা আমার বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে।

      Delete
  4. Amar oi baranday bosa thakuma r akhyan e bhalo laglo. Chhilo, nei, matro ei. Amar Dida r moto :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. দিদাঠাকুমাদের এই চলে যাওয়াগুলো ভীষণ কষ্টের। জীবনের নিয়ম বলে মেনে নিন, কী আর করবেন।

      Delete
  5. Thakumar golpota besh interesting laglo.. Sotyi rasta ghate cholte firte erom kotojonkei dekhe nije mone mone bhebe nei..
    Girl on the train porini tobe tomar review dekhe mone hochehy porte hobe.

    1. Prothom ta khub chena laglo kintu mone porlo na
    2. Bombai er bombete feluda jotayu ke golpo ta lekhar age suggestion diyechhilo.
    3. Birinchi baba prof. Noni r bou Nirupama debi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. পড়ে দেখো, চুপকথা, ভালোই লাগবে মনে হয়। মাস্টারপিস নয়, তবে একবার পড়াই যায়।

      জেমস শেফার্ড হচ্ছেন, আগাথা ক্রিস্টির লেখা দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড গল্পের অন্যতম চরিত্র।

      Delete
  6. Bah. Pore dekhte hobe. Quiz 1 er uttor partam na. Othocho oi golpo amar pora. Quiz 2 ta Feluda'r kono golpo ki? Quiz 3 ta Birinchi baba hopefully. Etao bhul hole lojjaye amar mukh dekhano uchit noy.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভুল হয়নি, কুহেলি। দু'নম্বরের আন্দাজটাও ঠিক হয়েছে। কাজেই তোমার লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণই নেই।

      Delete
  7. আমি অবান্তর-এর নিয়মিত পাঠক। একটাও পোস্ট মিস করি না, যদিও মন্তব্য বিশেষ করা হয় না। আজকের এই পোস্ট থেকে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল।

    আমি জন্মের পর থেকে ২৬ বছর একটা কোয়ার্টারে থাকতাম। একদম রেললাইনের পাশে। এখন আর থাকি না। এখন সেখানে অন্য লোক থাকে। যাওয়া-আসার পথে নজর যায়। সেই বারান্দা সেই জানালা। ট্রেনে যাতায়াতের সময় অনেকে জিগ্যেস করেছে “তোমরা আর ওই বাড়িতে থাকো না?” কিংবা এরকমও শুনেছি, “তোমাকে তো চিনি, ছোটবেলা থেকে দেখেছি, তোমরা ওইখানে থাকতে!” এটা একদম ঠিক আমি কাউকে না চিনলেও, কেউ কেউ সেই ছোটবেলা থেকে আমাকে চেনে।

    কুইজের উত্তর সবাই দিয়ে দিয়েছে বলে আর দিলাম না।

    পুনশ্চ: এবারের বর্ষামঙ্গল গোয়েন্দামেলা মানে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা পড়েছেন নাকি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ, দেখেছেন, আপনার জীবনের কত কাছাকাছি একটা ব্যাপার নিয়ে একটা বেস্টসেলার লেখা হয়েছে, সৌগত। পূজাবার্ষিকী বেরিয়ে গেছে বুঝি? অনেক গোয়েন্দাগল্প আছে? নেক্সট দেশটার সঙ্গে কিনে আনব।

      Delete
  8. পড়তে হবে এটা।প্রথম প্যারাটা পড়েই দারুন লাগল কনসেপ্ট টা। ছাড়া যাবে না, আমি নিশ্চিত ।
    গন গার্ল টাও পড়া হয়নি এখনো। দুটো একসাথেই কিনবো উইকেন্ডে ।
    আর পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা শেষ করলাম আজই। কি আর বলি? মা কি ছিলেন, আর কি হইয়াছেন !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. কনসেপ্টটা আমারও ভারি ভালো লেগেছে, ঋতম। এত রোজকার একটা ঘটনার মধ্যে একটা ক্রাইম ঢুকিয়ে দেওয়া . . . পড়ে জানিও কেমন লাগল।

      Delete

Post a Comment