রানী ২/২




মূল গল্পঃ The Queen of the Mystery
লেখকঃ Ann Cleeves



*****

খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ে লিখলে আমার ডানহাতের কনুইটা যেখানে ছুঁয়ে থাকে, এই টেবিলটার ঠিক সেই জায়গাটাতে একটা ছোপ। চেয়ারটাও আমার মাপে মাপে ফিট করে গেছে। কাজেই এগুলো আমারই। কিন্তু লেখার ঘরের বাইরে ধু ধু মাঠের মধ্যে এগুলোকে আনল কে? আমি তো আনিনি। সুষমা? নাকি রঞ্জন? রঞ্জন আমার পাশেই একটা খাটে শুয়ে আছে। খাটটা অবশ্য আমাদের না। কয়েকটা কাঠের তক্তা জুড়ে জুড়ে বানানো একটা সরু লিকপিকে ব্যাপার। পালিশটালিশ কিছু নেই। এদিকে চার পায়ায় বাঁধা রজনীগন্ধার ডাঁটি, ধূপ থেকে জুঁইয়ের গন্ধ সাদা সুতোর মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। ধপধপে সাদা চাদর গলা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে রঞ্জন। ভীষণ রোগা লাগছে ওকে। গালদুটো ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। ভুরুর হাড়দুটো উঁচু। নাকটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। রঞ্জন ঘুমোচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। দু’চোখের ওপর দুটো তুলসি পাতা ঢাকা দেওয়া। আচমকা একটা জোর হাওয়া শুরু হল। টেবিলের ওপর রাখা কাগজের তাড়া এলোমেলো। মাঠের মাঝখানে লিখতে বসেছি অথচ পেপারওয়েট আনিনি? পাতা উড়ে উড়ে ছত্রাকার হয়ে যাচ্ছে সারা মাঠ। আমার এত যত্ন করে তৈরি আউটলাইন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে, আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। হাওয়ায় তুলসি পাতার ঢাকনি উড়ে গেছে, কিন্তু রঞ্জনের চোখ কোথায়? চোখের জায়গায় দুটো গর্ত, নাকের জায়গায় দুটো গর্ত, যেখানে ঠোঁট থাকার কথা সেখানটাতেও একটা গর্ত ফুটে উঠছে। গর্তটা ক্রমে গুহার মত বড় হয়ে উঠছে, হাওয়ার দাপটে সব শব্দ ভেসে যাচ্ছে, অনেক কষ্টে কান পেতে শুনছি, গুহার ভেতর থেকে একটা গম্ভীর যান্ত্রিক শব্দ বলে চলেছে, যে সেরা সে জিতবে, যে জিতবে সে সেরা।  

শেষরাতে মোটে ঘণ্টাদুয়েকের ঘুম, তাও দুঃস্বপ্নে ভর্তি, ছেঁড়া ছেঁড়া। সকাল ন’টা থেকে প্রশ্নোত্তর পর্ব। একটুও ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার, কিন্তু গোটা ইভেন্টের এই একটামাত্র পর্বেই পাঠকপাঠিকার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ, কাজেই যাওয়াটা জরুরি। ঘুরিয়েফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন বছর বছর। আইডিয়া কোত্থেকে পান, মধুমাধবী আপনার নিজের ছায়ায় গড়া কি না, নতুন লেখকদের প্রতি আপনার টিপস। উত্তরে বছর বছর ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলা। কারণ সত্যিগুলো, বেশিরভাগ সত্যির মতোই, স্বীকার করা যায় না। আইডিয়া পাই অন্যের লেখা থেকে। আইডিয়া মানে আইডিয়ার বীজ। লোকাল ট্রেন থেকে শোনা সংলাপের সুতো ধরে গল্প লিখলে যদি চুরি না হয় তা হলে বইয়ের পাতায় পড়া সংলাপ বা পরিস্থিতি নিয়ে গল্প লেখা চুরি নয়। তাছাড়া গল্প প্লটে থাকে না, থাকে বলার মুনশিয়ানায়। মধুমাধবী যে আমি, এ বিশ্বাসটা গোড়া থেকেই ছিল। কোনও একটা গল্পে মধুমাধবীর বেগুনি রঙের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ হয়ে পড়ার পর থেকে পুজোতে আমার গোটা তিনেক বেগুনি শাড়ি বাঁধা। প্রথমটা অপমানজনক লাগত, মেয়েরা লিখলেই সেটা আত্মজৈবনিক হতে হবে কেন এ নিয়ে  ছায়ার সঙ্গে অনেক লড়াই লড়তাম মাথার মধ্যে, তারপর দেখলাম বিশ্বাসটা অ্যাকচুয়ালি আমার পক্ষে সুবিধের। লোকে মধুমাধবীকে অনেক চট করে ‘রিয়েল’ ভেবে নিতে পারে। তাছাড়া মধুমাধবীর কৃতিত্ব যে আমার নয়, যজ্ঞের আগুন থেকে বেরোনো সালংকারা দ্রৌপদীর মতো নিজের পছন্দঅপছন্দ, আচারবিচার, ধ্যানধারণা সমেত স্বয়ংসম্পূর্ণ সে ইউক্যালিপটাসের বনে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল স্বীকার করে নিলে লেখক হিসেবে আমার গৌরব কিছু বাড়বে না। আর নতুন লেখকদের প্রতি আমার টিপস? বিশ্বাসী হলে তাগাতাবিজ ধারণ, মন্দিরে মাথা ঠোকা, আর আমার মতো অবিশ্বাসীদের জন্য কোন টিপস কাজে লাগবে আমার জানা নেই।  

এগারোটা নাগাদ ছুটি মিলল। ঘরে গিয়ে ঘুমোনোই উচিত ছিল হয়তো, কিন্তু জেগে থাকার জরুরি একটা কারণ আছে। সেটা হোটেলের সামনের রাস্তা পেরিয়ে বাঁ দিকে খানিকটা হেঁটে গিয়ে তিননম্বর গলি দিয়ে ঢুকে আরও হাফ কিলোমিটার মতো গিয়ে। 

একটা বইয়ের দোকান। গত পঁচিশ বছরে আমরা অনেককে দোকানটার ডিরেকশন দেওয়ার চেষ্টা করেছি, হাতে গোনা ক’জন ছাড়া কেউ খুঁজে পায়নি। এখন আমার বিশ্বাস হয়েছে যে দোকানটা দেখতে পাওয়া না পাওয়া আসলে অন্যের হাতে নেই। দোকানটা যাদের পছন্দ করে তাদের দেখা দেয়। আমাকে আর রঞ্জনকে খুবই পছন্দ করত দোকানটা বলতে হবে। গত পঁচিশ বছরে আমরা যতবার ওকে দেখতে চেয়েছি, পেয়েছি। 

আমরা দোকানটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম নিজেরাই। তখন ব্যোমকেশ হোটেলের বদলে এই পাড়ারই একটা বাড়িতে হত। কর্মকর্তাদের কারও বাড়ি নিশ্চয়। পুরোনো আমলের কড়িকাঠ আর কুলুঙ্গিওয়ালা প্রকাণ্ড বৈঠকখানায় বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্ররা যে যাঁর অনুরাগীসমেত দিব্যি এঁটে যেতেন। সে আমলেও প্রশ্নোত্তর পর্বের ব্যাপার ছিল। আমি তখন ছিলাম প্রশ্ন করিয়েদের দলে। আজ প্রশ্ন করতে আসা ছেলেমেয়েদের যা উদ্দেশ্য আমার উদ্দেশ্যও তা-ই থাকত। নিজেকে এই জগৎটাকে সঙ্গে পরিচিত করানো। এই জগৎটাকে নিজের সঙ্গে পরিচিত করানো। সে সব দায়িত্বকর্তব্য ফুরোলে আমরা কলকাতা ঘুরতে বেরোতাম। ঘুগনি, আলুকাবলি, ফুচকা খেতাম। ঘুরতে ঘুরতেই একদিন আচমকা চোখে পড়েছিল। দু’পাশের বড় বড় পুরোনো বাড়ির মাঝখানে প্রায় চেপ্টে যাওয়া, ফুটপাথের বড় বড় দেবদারুর আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট দোকান। সবুজ কাঠের দরজার গায়ে কাচের আরশির ওপাশে অন্ধকারে কী আছে কিছুই বুঝতে পারিনি প্রথমে। যতক্ষণ না মাথার ওপর প্রায় মুছে যাওয়া, সামনে ঝুঁকে পড়া পেঁচানো ইংরিজি অক্ষরে লেখাটা ঠাহর হয়েছিল। ‘দ্য পয়জন পেন”। 

গলির ভেতর ঢুকে বড় রাস্তার কোলাহল এমনিই লবেজান হয়ে পড়ে, বাকিটুকু পয়জন পেন-এর উঁচু সিলিংছোঁয়া কালো কাঠের শেলফগুলো শুষে নেয়। মানুষের মনের অন্ধকার দিক নিয়ে যা যা গল্প ফাঁদা হয়েছে পৃথিবীর যেখানে যেখানে সব যেন জোগাড় করে রাখা হয়েছে দোকানটায়। গোয়েন্দা, ভূত, থ্রিলার। প্রাচীন চিনা রহস্য/অতিলৌকিক সাহিত্যের অনুবাদ থেকে শুরু করে আধুনিক নর্ডিক নোয়ার, প্রিয়নাথ মুখার্জি থেকে শুরু করে শর্মিষ্ঠা গুপ্ত। বছর সাতেক আগে আইডিয়ার একটা বাড়াবাড়ি রকম খরার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে, এই দোকানে পাওয়া একটা আফ্রিকান উপজাতির লোককথা সংকলন থেকে একটা গল্প ধার নিয়েছিলাম। প্লট অবিকল এক, খালি কুইডাডুর বদলে কোচবিহার, শিকারি উপজাতির ভস্মমাখা সদস্যদের বদলে বর্ধিষ্ণু পরিবারের শ্বশুরশাশুড়ি ছেলে বউ উচ্ছন্নে যাওয়া নাতি। পাবলিশ হওয়ার পর বেশ কিছুদিন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত। প্রকাশকের দপ্তরে চিঠির পর চিঠি আসছে, তাতে রক্ত দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ‘অনসূয়া মিত্র চোর’। 

কিছুই হয়নি। পরের বছর শারদীয়ার জন্য তিন সপ্তাহে লিখে দেওয়া আমার একটা বড় গল্পের বিরুদ্ধে গোটা কয়েক চুরির অভিযোগ সম্পাদকের কাছে জমা পড়েছিল। ওই গল্পের জন্য চুরি করতে হলে লেখা ছেড়ে দেওয়া উচিত। 

দরজা ঠেলে ভেতরে পা দেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর থেকে ধীরে ধীরে দৃশ্যটা ফুটে উঠতে শুরু করে। মাটি থেকে সিলিং পর্যন্ত, ডানদিক থেকে বাঁদিক পর্যন্ত, দৃষ্টি জুড়ে, দৃষ্টি পেরিয়ে, ছত্রাকার বই। চলতে চলতে পায়ে ঠোক্কর দেওয়া বই, শেলফ থেকে সারি ভেঙে এগিয়ে এসে চুলে কোণা আটকে দেওয়া বই, অসামান্য অনাদরে ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে রাখা বই। শুরুতে একটা নিয়ম মানার চেষ্টা হয়েছিল বোঝা যায়। এদিকে ইংরিজি, ওদিকে বাংলা। বাঁ থেকে ডানে প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক যুগ। কিন্তু সেটা পরে মেন্টেন করা হয়নি। অমনোযোগী খদ্দের বা পাঠকের হাতে এ শেলফের বই ও শেলফে চলে গেছে। মেঝেতে নেমে এসেছে। দোকানের পেছনদিকে শেলফের আড়ালে ছোট একটা জায়গা খালি করে বসার জায়গার ব্যবস্থা - গোটা দুই পিঠ উঁচু মান্ধাতা আমলের চেয়ার, ফুলের ছাপওয়ালা ঢাকনা দেওয়া আপহোলস্টরি থেকে ভকভক করে ন্যাপথলিনের গন্ধ বেরোয়, কিন্তু বসলে অদ্ভুত আরাম - সেখানে প্রচুর বই ডাঁই হয়ে রয়েছে। 

শেলফগুলোর গা ঘেঁষে, বইগুলোর গায়ে আলতো হাত বুলোতে বুলোতে ধীরে ধীরে আমি হাঁটতে থাকলাম। আবার কবে এদের দেখব জানি না। কালি, পাতা, অক্ষর, গল্প মিলেমিশে অনেকদিন পর খুঁজে পাওয়া ভ্যানিলার বোতল খোলার মতো হালকা, উষ্ণ একটা গন্ধ। বুক ভরে নিজের ভাগের গন্ধটা নিলাম। রঞ্জনের ভাগেরটাও। শেলফের সারি শেষ হয়ে বসার জায়গাটা চোখের ওপর ফুটে উঠল। দুটো চেয়ারের একটা অলরেডি দখল। কেদারায় শরীর সম্পূর্ণ ন্যস্ত করে বসে আছে পাঠক। আরাম আর মনোযোগের প্রতিচ্ছবি। হাতলে কনুই, তেলোয় গাল। এক হাঁটুর ওপর তুলে রাখা অন্য হাঁটুর গা বেয়ে এলিয়ে নেমেছে হ্যান্ডলুমের শাড়ি। সবুজ জমির ওপর সরু গেরুয়া পাড়ের আড়াল থেকে উঁকি মারছে পায়ের আঙুল। কোলের ওপর বই খোলা। এক হাতে বইটা আলতো করে ধরা, তাতে ব্যাককভারের সবুজ রঙের একটুখানি দেখা যাচ্ছে। আমাদের উত্তরের ব্যালকনিটার ওপারের সবুজটা ঠিক এই শেডের। মলাটটা আরেকটু তুলে ধরলে দেখা যাবে একটা কাঠের রেলিং-এ একটা কনুই। কনুই বেয়ে ইঞ্চি চারেক ওপরে উঠলেই আমার মুখ। আমাকে ব্যালকনিতে দাঁড় করিয়ে ছবিটা তুলেছিল সমকাল-এর প্রতীক দাস। 

প্রশ্নোত্তর থেকে পালিয়ে, কেয়ার থেকে পালিয়ে, সবার থেকে পালিয়ে, পৃথিবীর এই অজ্ঞাত কোণে বসে মধুমাধবীর গল্পে ডুবে গেছে শর্মিষ্ঠা গুপ্ত। 


*****


ড্রেসিংটেবিলটা ঘরের একটা বিতিকিচ্ছিরি জায়গায়। জানালার মুখোমুখি। পর্দার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে আয়নায় ঠিকরোচ্ছে। মুখ দেখতে পাচ্ছি না। পর্দা টেনে দিতে পারি। আয়নার ওপর একটা আলো আছে, যেটা আমার মুখে পড়ার কথা, সেটা যথেষ্ট জোরালো নয়। বাথরুমের আয়নায় সাজা যায়। কিন্তু তাহলে দাঁড়িয়ে সাজতে হবে। আজকাল অতক্ষণ টানা দাঁড়াতে কষ্ট হয়। 

রঞ্জন থাকলে তাড়া দিত। বলত, হল তোমার যুদ্ধসাজ? যেন যুদ্ধটা আমি সেধে করছি, না করলেও চলে। যেটা ও কোনওদিন বোঝেনি, কেউই বোঝে না, রানী হওয়াটাই একটা আজীবনের যুদ্ধ। সিংহাসনে আরোহণ করার পর সেই যে শুরু হয়, আর থামে না। আর কয়েকঘণ্টা পর যখন আমি আবার রানীর মুকুট পরার জন্য স্টেজের দিকে হাঁটতে শুরু করব সে হাঁটাটা শুরু হয়েছে আসলে তিরিশ কিংবা তারও বেশি বছর আগে থেকে, প্রথমবার যখন গল্প এসে আমার মগজের জানালায় ছায়া ফেলে দাঁড়িয়েছিল। এই তিরিশ বছর ধরে ছায়া বদলেছে, কিন্তু যুদ্ধটা রয়ে গেছে এক। সেই ছায়াকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা, তার হাড় শক্ত কি না, মজ্জা টাটকা কি না, একটা গোটা প্লটের, চরিত্রদের, চরিত্রদের টানাপোড়েনের ভার, শেষ পরিচ্ছেদের চমক এবং মোড়ে মোড়ে কোণে কোণে ক্লু লুকিয়ে রাখার যোগ্যতা তার আছে কি না। সে সব শেষ হলে তার ওপর অভেদ্য দুর্গের মতো প্লট বোনা, প্রকাশকের তাগাদা সামলে, তারপর নির্বোধ নিন্দুককে অগ্রাহ্য করা, ফিল্মের লোকজনদের ঝাড়াইবাছাই, গল্প বিক্রি, রয়্যালটির খেয়াল রাখা, রয়্যালটির খেয়াল যে রাখে তার খেয়াল রাখা, এবং এই সব কিছুর মধ্যে মধ্যে কান খাড়া চোখ টান রাখা কখন আবার একটা ছায়া এসে খাতার ওপর উঁকি মারে। এ যুদ্ধ ছাড়া আর কী?

এই যে আমি এখন আয়নার সামনে বসে রং মাখব, সেটাও যুদ্ধের একটা অঙ্গ। আলোর অপ্রতুলতা, হাঁটুর ব্যথা এ সব বিঘ্নের বিরুদ্ধে আমার একমাত্র অস্ত্র সময়। তা আমি অনেক নিয়ে বসেছি। যাতে তুলির টান প্রথমবার বেঁকে গেলে সেটা মুছে আবার টানা যায়, ভুল হয়ে গেলে মুছে আবার, আবার আবার আবার, যতক্ষণ না তা আমার সংজ্ঞায় নিখুঁত হচ্ছে। যত্ন করে ভুরু আঁকলাম। বিজয়ী হিসেবে আমার নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আমি তাদের উত্থিত করব যাতে আমার কপট বিস্ময় নিখুঁত ফোটে। ঠোঁটের খাঁজে খাঁজে গাঢ় রং দিয়ে ভরাট করলাম। পুরস্কার নেওয়ার আগে এবং পরে যখন আমি ঘুরে ঘুরে, হেসে হেসে নেটওয়ার্কিং করব, অটোগ্রাফ বিলোব, ব্যাংকোয়েট হলের আলোর চড়া ওয়াটের সঙ্গে যাতে আমার হাসি পাল্লা দিতে পারে। 

সবথেকে বেশি সময় দিলাম চোখে। মহার্ঘ রঙে রাতের ঘুমহীনতার চিহ্ন মুছে দিলাম। আমার চোখ দেখে কেউ যেন আঁচ না পায় একমুহূর্তের জন্যও আমি হারার সম্ভাবনাকে চিন্তায় স্থান দিয়েছি, একমুহূর্তের জন্যও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আমার মনে কোনও দ্বিধা ঠাঁই পেয়েছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রানী হিসেবে অন্য কারও নাম উচ্চারণ করার স্পর্ধা যেন কারও না হয়। 

ফোন এল। ওরা রেডি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কে জিতবে? রঞ্জন নিজের দশ আঙুল আমার দশ আঙুলে শক্ত করে জড়ালো। শান্ত, দীঘল, মায়াবী, উজ্জ্বল চোখদুটো আমার দু’চোখে ঢেলে দিয়ে বলল, তুমি। কারণ তুমি সেরা।  

ফোন এল। ওরা রেডি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কে জিতবে? ফাঁকা ঘরের আনাচেকানাচে ঠোক্কর খেয়ে প্রশ্ন ফিরে এল আয়নার ওপারের লোকটার  কাছে। আমি অপেক্ষা করলাম। সে আমার দিকে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল রং করা চোখ মেলে তাকিয়ে রইল।


*****


হয়তো আসবে না। কিন্তু যদি পরে কোনওদিন এ সন্ধ্যের স্মৃতিচারণ করার সুযোগ আসে তাহলে আমার মনে পড়বে শুধু একটা বিরাট ঘোলাটে কুয়াশার তাল। ফুল আর পারফিউমের গন্ধে ভারি, ভেজা, স্যাঁতসেঁতে। তার মধ্যে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। কানের কাছে কতগুলো দুর্বোধ্য শব্দ ঘাই মেরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফ্যান, পুরস্কার, ভোট, শর্মিষ্ঠা গুপ্ত, কোজি মিস্ট্রি, ইয়ং ব্লাড, নতুন মুখ। কুয়াশার মধ্যে ভেসে উঠছে কতগুলো অশরীরী মুখ, ধড়, মুণ্ডু, বাড়ানো হাতে ধরা অটোগ্রাফের খাতা। আমি সই দিচ্ছি, হাসছি, ঘুরছি, ঘাড় নাড়ছি। সবটাই নিখুঁত অভ্যেসে। 

অবশেষে কথাবার্তা ফুরোলো, সৌজন্যবিনিময় থামল। এখন সবাই যে যার নির্দিষ্ট স্থানে এসে বসেছে। হল জুড়ে টেবিল, টেবিল ঘিরে আধখানা চাঁদের মতো চেয়ার। সাদা কভারে তাদের পায়া ঢাকা। সকলের নিজস্ব গুরুত্ব অনুসারে টেবিল আছে। পেছন দিকের টেবিলে কোনও উপায়ে পাস জোগাড় করা সাধারণ দর্শক। তারপর প্রকাশক, সমালোচক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী। তারপর মনোনীত বিভাগের লেখক। অনুবাদক, প্রতিবেদক, সিরিয়াল লেখক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার। আর একেবারে সামনের টেবিলের অধিকারী সাহিত্যের মাথার মণি, উপন্যাস। টেবিল ঘিরে আমি। আমার পাশে শর্মিষ্ঠা, সৌরীশ, অনুপমা চাকি আর মৌসুমী পাল। 

আলো মৃদু হয়ে এল। গুনগুন স্তিমিত হয়ে এল। চোখের সামনে মঞ্চ এখন উদ্ভাসিত। ব্যাকড্রপে হাই রেজলিউশন রক্তাক্ত ছোরাখানা জ্বলজ্বল করছে।

সামান্য উত্তেজনা স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। সেটা না থাকলে বুঝতে হবে বিষয়টা সম্পর্কে সিরিয়াসনেসের অভাব আছে। কিন্তু আমার এখন যেটা হচ্ছে সেটা প্যানিক। বুকের ভেতরটা ফাঁকা, শ্বাস নিতে কষ্ট। রঞ্জন, রঞ্জন, রঞ্জন। কোথায় তুমি। একমনে আমার জমে বরফ হয়ে যাওয়া হাতের তেলোয় আমি ওর হাতের তেলো কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম আমার কাঁপতে থাকা শরীর ঘিরে ওর চির আশ্বাসদায়ী উপস্থিতি বেড় দিয়ে আছে। বার বার মনঃসংযোগ টলে যেতে লাগল।

একে একে সব পুরস্কার শেষ। মঞ্চে উঠে এল কেয়া, টালিগঞ্জের জনপ্রিয় অভিনেত্রী - মধুমাধবীর আগের সিনেমাটায় ও নামভূমিকায় ছিল, আর সুটবুট পরা এক বেঁটেমোটা ভদ্রলোক। হলের দেওয়াল ছয়লাপ হয়ে থাকা ক্রিম আর চুলের কলপের কোম্পানির অধীশ্বর। কেয়ার হাতে নমিনেশনের তালিকা। এ বছরের সেরা রহস্য উপন্যাসের দৌড়ে পাঁচটি উপন্যাস। সৌরীশ রায়চৌধুরীর কর্ণসুবর্ণ, মৌসুমী পালের অতলের তলে, অনুপমা চাকির নিতাই গুহ যেদিন মারা গেলেন, অনসূয়া মিত্রের সপ্তম স্বর্গ আর শর্মিষ্ঠা গুপ্তর বিকেলের আলো। শেষ বইটা এখন পড়ে আছে এই হোটেলের সাতশো ছত্রিশ নম্বর রুমের, আমার রুমের, বিছানার পাশের টেবিলে। প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি না মেপে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হওয়া কাঁচা যোদ্ধার লক্ষণ। বইটা ব্যাগেই ছিল। অবশেষে ভয় জয় করে কাল রাতে পড়তে শুরু করেছিলাম। তিনশো সাতাশ পাতার বই। আমি জানতাম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না। বড়জোর একশো পাতা। 

অতদূর অপেক্ষা করতে হয়নি। খানতিরিশ পাতা পড়েই চোখ খুলে গিয়েছিল, তিনশো সাতাশ নম্বর শেষ করে যখন বইটা মুড়ে রাখলাম তখন সমস্ত সন্দেহ অন্তর্হিত হয়েছে। 

আমি বিশ্বাস করি, অ্যাকচুয়ালি, আমি জানি, লেখা শেখা যায়। গলায় সুর না নিয়ে জন্মালে গান করা যায় না, মাথা নিয়ে না জন্মালে অংক কষা যায় না, কিন্তু অক্ষরজ্ঞান থাকলে, যা সকলেরই থাকে, লেখা শেখা যায়। আমি নিজে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আমি নিজে নিজে লিখতে শিখেছি। অক্লান্ত পরিশ্রমে তাকে নিখুঁত করেছি। 

একই সঙ্গে আমি এও জানি, শেখা লেখা দিয়ে শুধুমাত্র একটা উচ্চতা পর্যন্ত যাওয়া যায়। খারাপ লেখা অভ্যেসে ভালো হয়। ভালো লেখা অভ্যেসে মহৎ হয় না। সে’রকম লেখা কেউ কেউ লিখতে পারে। এবং তাদের লেখা পড়েই বলে দেওয়া যায়, তারা লেখা শেখেনি। শিখেই জন্মেছে। 

শর্মিষ্ঠা গুপ্ত সেই সব লেখকদের একজন। 

শুধু লেখা নয়, মহৎ লেখা লিখতে গেলে দৃষ্টিও লাগে। কাটোয়ার বি এড পড়া মেয়েদের হোস্টেলের প্রেক্ষাপটে মানুষের গভীর গোপন কামনাবাসনা, লোভ, পাপ, ঈর্ষা, যৌনতা যে দৃষ্টি দিয়ে ছেনে গল্প লিখেছে এই সাতাশ বছরের মেয়ে, আরও তিরিশ বছর লিখলেও আমি সে দৃষ্টি অর্জন করতে পারব না।  


*****


কেয়ার হাতে একটা খাম। বাঁ হাতে তুলে ধরে ডান হাতের এক টানে মুখটা ছিঁড়ে ফেলল কেয়া। 

আমার কানের পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে। সেন্টের বদলে সে হাওয়ায় সমুদ্রের নোনা গন্ধ। আমার খালি পায়ের তলায় শ্যাওলাপড়া এবড়োখেবড়ো পাথর। পাথরের দেওয়ালের গায়ে, যে দেওয়ালের কিনারে আমি দাঁড়িয়ে আছি, অনেক নিচে ধাক্কা মারছে সাদা ফেনা। যা কিছু আন্দোলন সব ওই দেওয়ালের কাছটুকুতে, বাকি আদিগন্ত জুড়ে গাঢ় নীল শান্তি।

অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ… 

আমি দু’পা এগিয়ে গিয়ে দু’হাত মেলে দিলাম। আমার পায়ের তলায় আর পাথর নেই। এখন আমার সারা শরীরটা মুড়ে রেখেছে লবণাক্ত হাওয়া। এখন শুধু অপেক্ষা কয়েকটা মুহূর্তের। হয় অতল, নয় অমরত্ব।  

সারা আকাশ জুড়ে আবার শুরু হয়েছে সেই যান্ত্রিক দৈববাণী, যে সেরা সে জিতবে। যে জিতবে সে সেরা। 

অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ… উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল কেয়া। 

কে সেরা? গর্জে উঠল চরাচর।

শ-র-মি-শ-ঠা  গু-প-তো . . . মাথার ভেতর নামটা বিস্ফোরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর ঠাণ্ডা জল ছুঁল। 


*****


এও আরেকরকমের ভাসা। হাওয়ার বদলে জল। এও আরেকরকমের আলো। সবুজ। মেদুর। শ্যাওলা আর গুল্ম ভেসে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে, ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার চোখের পাতা, চিবুক, অল্প অল্প দোলা দিয়ে যাচ্ছে আমাকে। অনেক ওপরে জলে বিলি কাটছে সূর্যের সোনালি আলো। কী আরাম, কী শান্তি। যুদ্ধ শেষ। আমি চোখ বুজলাম। আমার যুদ্ধসাজ মুছে নিচ্ছে জল। আমার বর্ম একে একে খুলে নিয়ে যাচ্ছে ঢেউ। 

এমন সময় আমার বাহু ছুঁয়ে গেল,না উদ্ভিদ নয়, উষ্ণশোণিত!

চোখ খুললাম। ভেসে উঠল একটা মানুষের মুখ। এই মুখটা আমি খবরের কাগজে দেখেছি। ম্যাগাজিনে দেখেছি। শর্মিষ্ঠা গুপ্ত। ওর ঝকঝকে চোখদুটো আমার চোখে নিবদ্ধ। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।

কনগ্র্যাচুলেশনস, দিদি। 

ঘোর কেটে গেল। সমুদ্রের সবুজ মায়া কেটে গিয়ে ফ্ল্যাশের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল চোখে, কান বিদ্ধ করল হাততালি আর উল্লাস। ঘরশুদ্ধু লোক উঠে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে আসছে আমার দিকে, আমাকে জড়িয়ে ধরেছে মৌসুমী, “হোয়াট আ সারপ্রাইজ!” হা হা করে হাসছে সৌরীশ। স্টেজের ওপর থেকে কলরব ছাপিয়ে কেয়ার গলা শোনা যাচ্ছে, পাঠকের বিচারে এ বছরের ব্যোমকেশ সেরা রহস্য সম্মানের দাবিদার নির্বাচিত হয়েছে অনসূয়া মিত্র, আমাদের সবার প্রিয় অনুদির মধুমাধবী সিরিজের তেইশ নম্বর উপন্যাস সপ্তম স্বর্গ। 

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি জলের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলাম। কেউ আমার হাত ধরে স্টেজের দিকে নিয়ে চলেছে। নায়িকা আমাকে আলিঙ্গন করল। ক্রিম কোম্পানির অধীশ্বর আমার হাতে তুলে দিলেন মানপত্র, ছুরির মডেল আর চেক। 


*****


এই যে উঁচু, আলোকিত মঞ্চ থেকে আমি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর নিচ থেকে মানুষ, চিবুক তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এটা আমার ফেভারিট পয়েন্ট অফ ভিউ। এই দৃশ্যে আর কোনও সংশয়ের জায়গাই থাকে না যে আমি রানী। আমিই। ওরা সমস্ত মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখছে, অপেক্ষা করছে আমার কথা শোনার জন্য। আমি ওই দৃষ্টিগুলোকে, এই অপেক্ষাটাকে, বুকের ভেতর নিলাম।

ব্যোমকেশের ছুরি আর জলের গ্লাস নামিয়ে রেখেছি পোডিয়ামের ওপর, উত্তরীয় আর মানপত্র নিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নম্র মডেল।

আমার বেশি বলার নেই, কিন্তু যা বলার আছে তা জরুরি। আমি সময় নিই। নিজেকে সুস্থিত করি। নিজের শপথ নিজেকে মনে করাই। আজ যা বলব সত্যি বলব। সত্যি বই মিথ্যে বলব না। 

আমি বাংলা রহস্য সাহিত্যের পাঠকদের আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। সহলেখকদের। ব্যোমকেশ কর্তৃপক্ষকে। কেয়াকে। বলি, আমি যা পেয়েছি তা কল্পনা করা সম্ভব নয় কোনও নশ্বর সাহিত্যিকের পক্ষে, আমিও করিনি। পুরোটাই আমার পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। 

আমি স্বীকার করি, এ বছরের ব্যোমকেশ জেতা আর সব বছরের ব্যোমকেশ জেতার থেকে জরুরি ছিল আমার কাছে। কারণ এটাই মধুমাধবীর শেষ বছর। সপ্তম স্বর্গই মধুমাধবী সিরিজের শেষ উপন্যাস। 

সশব্দ বিস্ময় হল জুড়ে। কেউ কেউ মুখে হাত চাপা দিয়েছে। কারও কারও চোখ বিস্ফারিত। 

আমি চুপ করলাম। আমার কথা শেষ। আমার যাওয়ার সময় এসে গেছে। স্তম্ভিত নীরবতা ভেঙে একটা দুটো করে হাততালির শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে হলের এ কোণা থেকে ও কোণা। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। ভিড়ের মধ্যে চেনাঅচেনা মিলেমিশে একাকার। একবার খুঁজে বার করে শর্মিষ্ঠার মুখটা দেখলাম। পরের বছর ও মুখ থাকবে আমার জায়গায়। নতুন রানী নিজের সাম্রাজ্য বুঝে নেবে। 

আর তখনই চোখে পড়ল। কখন এসেছে টেরই পাইনি। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। সেই প্রথম দেখার মুহূর্তের রঞ্জন, স্বাস্থ্যে উজ্জ্বল। আনন্দে উচ্ছল। জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে। প্রত্যয়ে টইটম্বুর হাসি। আমি এত কষ্ট পেলাম, ওর যেন কোনও সন্দেহই ছিল না এ জয় নিয়ে। 

একঝলক বুনো গন্ধ ঝাপটা দিয়ে গেল। ইউক্যালিপটাসের ছায়া নিয়ে মধুমাধবী, তুমিও এসেছ? আমার বন্ধু। আমার সখা। আমার জীবনের সোনার কাঠি।  

কিছু অনুতাপ কি রয়ে গেল? কিছু মনোবাঞ্ছা অপূর্ণ? ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল বিমলের সাহিত্য ক্লাবের পাঠকরা। ঠিক সময় ঠিক প্রশ্নটা কে আমার কাছে পাঠায় কে জানে। হেসে বলেছিলাম, রয়ে গেল তো। অন্তত এক ডজনকে ও জিনিস দিয়ে মেরেছি, অথচ নিজে কোনওদিন চোখে দেখলাম না। সবাই হেসে উঠল, যেন সায়ানাইড চোখে দেখাটা জলভাত। আমি বিমলকে দেখছিলাম। বিমল হাসছে, কিন্তু একই সঙ্গে সংকল্পও নিচ্ছে রানীর ইচ্ছে পূরণ করার। আর ক’দিন পর বিজয়ার প্রণাম করতে আসবে ও বউছেলে নিয়ে। আমাকে প্রণাম করে, মুড়িমুড়কি নিমকি নাড়ু লুচি মাংস খেয়ে, চলে যাওয়ার আগে, বউছেলেকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলবে, আপনি একটা কথা বললেন সেদিন লঞ্চে . . . আমি ভাব করব যেন আমার মনেই নেই কিছু . . . তারপর পকেটের ভেতর থেকে ওর হাতে উঠে আসবে একটা ছোট কাচের শিশি, এই মাত্র দু’কর লম্বা, নিচে নুনের মতো সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব . . . প্রথমেই মনে হবে এইটুকু যথেষ্ট কি, তারপর নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই মনে মনে হেসে উঠব অথচ মুখে কিছুই ফুটে উঠবে না।

সেই সাদা গুঁড়ো এখন এই গ্লাসের জলে, সম্পূর্ণ দ্রবীভূত।

রঞ্জন অস্থির হয়ে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে ডাকছে, আর কীসের দেরি? মধুমাধবীও অপেক্ষা করছে। তিরিশ বছর ধরে।  এই আমার সুযোগ, রানীর খোলস ছেড়ে ফেলে, যুদ্ধসাজ ছেড়ে ফেলে ওদের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়ার। 

কিন্তু আর কয়েকটা মুহূর্ত দাও আমাকে। শেষবারের মতো এ সিংহাসনের শৈত্য গায়ে মেখে নিতে দাও। কানে ভরে নিতে দাও প্রজাদের উল্লাস। চরাচর কানায় কানায় ভরে দেওয়া মুগ্ধতা আর ঈর্ষার সমুদ্রে শেষবারের মতো গা ডুবিয়ে নিতে দাও। বড় অদ্ভুত এ সমুদ্র। আকণ্ঠ জলে দাঁড়িয়েও তেষ্টা মেটে না। আমি হাত বাড়াই জলের গ্লাসের দিকে।
                                                                                                                           (শেষ)


Comments

  1. যেকোন কথাই বাহুল্য মনে হবে। তাই চুপ থাকি, আর আবেশটা জিইয়ে রাখি ...

    ReplyDelete
  2. অসম্ভব ভালো। তোমার অনুবাদ গুলো এত ভালো লাগে মূল লেখাটা না পড়ার আপশোষ থাকেনা। একটা দাবী করব? অনুবাদ থ্রিলার আরও বেশী করে হতে পারে কি? প্লিজ? - প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত। থ্রিলার অনুবাদ বেশি হতেই পারে, মুশকিল হচ্ছে আমার হাস্যকর রকম বেশি সময় লাগে অনুবাদগুলো করতে। আসলে আমার প্রোডাক্টিভিটি ভয়ানক কম। অনেকক্ষণে ঘেঁতিয়ে এক প্যারা বেরোয়। যদি সেটা বদলাতে পারি, তবে নিশ্চয় পরিমাণ বাড়বে।

      Delete
    2. হবে হবে আমাদের দাবির জোর আছে :)

      Delete
  3. কোনো শব্দ, কোনো বাক্য যথেষ্ট নয় এই গল্প পড়ে হওয়া অনুভূতি প্রকাশের জন্য। যা লিখব, মনে হবে অপর্যাপ্ত, নয়তো অতিকথনে খেলো।
    আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি স্ক্রিনের সামনে নতশির।
    সেলাম!

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ঋজু। কী আনন্দ যে হল আপনার মন্তব্য পেয়ে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. অসম্ভব ভাল লাগল। এর বেশি কিছু বলাই বাহুল্য হবে। এরকম লেখা আরও চাই।

    ReplyDelete
  5. Oshadharon!!
    r beshi kicchu bolar nei. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, অরিজিত।

      Delete
  6. Ek kothay darun.. du kotha nei ar :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা,থ্যাংক ইউ, চুপকথা।

      Delete
  7. "আর তখনই চোখে পড়ল। কখন এসেছে টেরই পাইনি। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। সেই প্রথম দেখার মুহূর্তের রঞ্জন, স্বাস্থ্যে উজ্জ্বল। আনন্দে উচ্ছল। জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে। প্রত্যয়ে টইটম্বুর হাসি। আমি এত কষ্ট পেলাম, ওর যেন কোনও সন্দেহই ছিল না এ জয় নিয়ে।"

    চোখ ভিজিয়ে দিলেন | অপূর্ব |

    ReplyDelete
  8. asadharon.-Bratati

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ব্রততী।

      Delete

Post a Comment