গুজরাট ভবন



লাঞ্চে যাওয়ার আগে কাজ তুলে রেখে এদিকওদিক করছি, ফোনে আলো জ্বলে উঠল। একদিকে সবুজ ফোন, একদিকে লাল কাটাচিহ্নর মাঝখানে অর্চিষ্মানের নাম। আমি ফোনের ওপরদিকে ডানকোণে তাকালাম। ১২ টা ২৫।

এখন অর্চিষ্মানের ফোন করার কথা নয়। ওর ফোন করার কথা ১ টা ২৫-এ। ফোন করে জিজ্ঞাসা করার কথা, কী খেলে? তখন আমার বলার কথা, রুটি আর ভিন্ডি/সীতাফল/লাউকি/সয়াবিন। তারপর উল্টে জিজ্ঞাসা করার কথা, তুমি? তখন ওরও বলার কথা, রুটি আর ভিন্ডি/সীতাফল/লাউকি/সয়াবিন। তারপর আমাদের দুজনেরই বিতৃষ্ণায় খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার কথা, তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, ঠিক আছে? ঠিক আছে। বলে ফোন ছেড়ে দেওয়ার কথা।

আমি ওর নামটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম কোনও খারাপ খবরের জন্য আমার তৈরি হওয়া উচিত নাকি। যা হওয়ার কথা তার বদলে অন্য কিছু হলে নির্ঘাত কিছু খারাপই ঘটেছে এইটা আঁচ করে নেওয়ার অভ্যেস অনেকের থাকে। আমার মায়ের আছে। মায়ের সঙ্গে আমার দৈনিক কথাবার্তার একটা রুটিন এইরকম। সকালে উঠেই, মানে ঠিক উঠেই না, মাকে ঘুম থেকে ওঠার সময় দিয়ে, এই ছ’টা নাগাদ, আমি মাকে ফোন করি। গুড মর্নিং বলি, আগের দিন কিছু ইন্টারেস্টিং ঘটেছে কি না, আজ কিছু ইন্টারেস্টিং ঘটার আশা আছে কি না খোঁজখবর নিই। সাড়ে আটটা নাগাদ অফিসে পৌঁছে একবার চট করে পৌঁছসংবাদটা জানিয়ে দিই। মা যদি সে সময় বাই চান্স ফোনের সামনে না থাকেন, বাবা ফোন তুলে গম্ভীর গলায় বলেন, ‘অ্যারাইভাল নোটেড’। বেলা এগারোটা নাগাদ ভদ্রতারক্ষার্থে মা একবার আমাকে ফোন করেন। দুটো থেকে চারটের মধ্যে, যে সময়টা চোখ আর খোলা রাখা যাচ্ছে না, কখন কে কোনদিক থেকে এসে মুচকি হেসে, ‘হ্যাভ আ কাপ অফ টি, কুন্তলা’ বলে চলে যায় সেই ভয়ে আরেকবার মাকে ফোন করতে হয়। এর বাইরে খবরের কাগজে বা টিভিতে হাস্যকর কোনও খবর পড়লে বা দেখলে, আলমারি গোছাতে গিয়ে পুরোনো খাতা, বউটুপি বেরিয়ে পড়লে, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে ফোনাফুনি হয়। ব্যস। 

এরও বাইরে কখনওসখনও বসের বকা খেলে বা অবান্তরে কমেন্ট না পড়লে আমার মায়ের গলা শুনতে ইচ্ছে করে। তখন ফোন তুলে মা এমন গলায় 'কী হয়েছে, সোনা?' বলেন যেন মনে হয় উনি একটা অগ্নুৎপাত কিংবা জলোচ্ছ্বাস অনুমান করছেন। তাতে সুবিধেই হয় অবশ্য। পারস্পেক্টিভ পরিষ্কার হয়ে যায়। অগ্নুৎপাত কিংবা জলোচ্ছ্বাসের পাশে আমার হৃদয়ভঙ্গের অকিঞ্চিৎকরতাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আমার মায়ের থেকেও খারাপ একজন ছিলেন আমাদের চেনাশোনার মধ্যেই। তাঁর তিন ছেলের একজন বাড়ির নিচের তলার মনিহারি দোকান চালাত, অন্যজনের ডেকোরেটরের অফিস ছিল পাশের পাড়ায় আর তৃতীয়জন যেতেন রেললাইন পেরিয়ে শাড়ির দোকানে। সাড়ে সাতটার পর এঁদের একজনও তাঁর ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে না ঢুকলে তিনি বুক চাপড়ে শুরু করতেন, ওরে আমার তিনটের একটা গেল রে।

আমি একসময় পর্যন্ত ভাবতাম, ইনি, আমার মা এঁরা সব ভিতুর ডিম। আর আমার মতো লোক, যারা খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনাকে মনের কোণেও স্থান দেয় না কখনও, তারা আসলে সাহসী। ইদানীং মনে হয় ব্যাপারটা আসলে ঠিক উল্টো। আমি আসলে এতই ভিতু যে ভয়ের সামনে দাঁড়ানোর সাহস আমার নেই। এঁদের আছে।

আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম আমার ভয় পাওয়া উচিত কি না। অদ্ভুত কিছু কি ঘটেছে? তারপর সে সাহস জোগাড় করতে পারলাম না। নিজেকে বোঝালাম এই ঘণ্টা চারেক আগেই আমাদের দেখা হয়েছে, আধঘণ্টা আগে চ্যাট হয়েছে আবার আধঘণ্টা বাদে চ্যাট হবে এবং ঘণ্টা চারেক বাদে দেখা, এর মধ্যে খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা শূন্য। 

সবুজ ফোন চিহ্নে হাত ছোঁয়ালাম। হ্যালো?

কুন্তলা!

জলোচ্ছ্বাস না হোক, একটা মিনি কালবৈশাখী তো বটেই।

আমার মনে ছিল না, আজ আমাদের লাঞ্চে কঢ়ি পকোড়া! ভয়াবহ। 

মনে পড়ে গেল। আমাদেরও আজ লাঞ্চে কঢ়ি পকোড়া। আমার ফেভারিট খাবার। তাছাড়া এরা বানায়ও চমৎকার বানায়। 

অর্চিষ্মান জানাল যে পুজোর মুখে এমন সুন্দর রোদ্দুর আর হাওয়া আর গরমহীনতায় কঢ়ি পকোড়া খেতে ওর মারাত্মক খারাপ লাগবে। 

গুজরাট ভবন যাবে?

আমার বরং সেই দিন গুজরাট ভবন গেলে সুবিধে হত যে দিন মেনুতে সীতাফল। কিন্তু বিয়ে মানে কম্প্রোমাইজ। রাজি হয়ে গেলাম। 

তাহলে বেরিয়ে পড়। কুইক। 

*****


স্টেট ভবনের ক্যান্টিনের বেশ কয়েকটা ক্যাটেগরি হয়। কোনওটার ভেতরবাহির দুটোই জমকালো (গোয়া, আসাম, বিহার), কোনওটার বাইরে ভেতর দুটোই ন্যাড়া (কেরালা, ওডিশা, অন্ধ্র, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড), কোনওটার বাইরে ন্যাড়া ভেতর ঝকঝকে (বঙ্গ, মহারাষ্ট্র)। গুজরাট ভবন পড়বে এই তিননম্বর দলে। চার বা ছ’জনের বসার টেবিল সাজানো পরিষ্কার, বড় হল। সপ্তাহের মাঝখানে যার বেশিরভাগই ভর্তি।

প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, তারপর মনে পড়ল নবরাত্রি চলছে, স্ট্রিক্টলি শাকাহারী ভোজনালয়ে ভিড় হওয়াই স্বাভাবিক। গুজরাট ভবনের লাঞ্চে বৈচিত্র্যের বিড়ম্বনা নেই। থালি আর স্পেশাল থালি। থালিতে আসে ফারসান (অর্থাৎ অ্যাপেটাইজার) ঘি মাখানো রুটি, গাজর কড়াইশুঁটি দেওয়া ভাত, দু’রকম ডাল, দু’রকম তরকারি (একটা শুকনো একটা ঝোলঝোল)। স্পেশাল থালিতে ফারসান আইটেম একটার জায়গায় দুটো আর একটা মিষ্টি।  


তিনটে টাকনার একটা আচার তো বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু বাকি দুটোতে এগুলো কি, গাঢ় কমলা, ঢিবি ঢিবি? একটা তুলে জিভে ঠেকিয়ে বুঝলাম যা সন্দেহ করেছি জিনিসটা ঠিক তাই, গুড়।

খাবারেরও আগে এল ঘোল। ঠাণ্ডা, জিরের গুঁড়ো ভাসানো। দিল্লিতে এখন যা টেম্পারেচার চলছে তাতে ঘোলটা দরকারি। তারপর এসে গেল থালি। 


গুজরাট ভবনের খাবারের বর্ণনা যদি দিতে হয় তাহলে বলতে হবে খুব ভালো, পাকা হাতে রাঁধা বাড়ির রান্না। খেলে রসনা, মন এবং পেট তিনজনেই শান্তি পায়। ফারসানের ছোট্ট সামোসা আর ধোকলা, দুটোই এ ক্লাস। দুটো ডালের একটা রীতিমত মিষ্টি, সেটা আমি শেষ করতে পারিনি, কিন্তু এটাও বুঝেছি যে যাদের মিষ্টি ডাল খেতে আপত্তি নেই তাদের ও জিনিস ভালো লাগবে। অন্য ডালটি রাজমা এবং আরও কিছু ডালের সমাহার। রাজমা আমাদের দুজনেরই প্রিয়। আলু পনীরের ঝোলের কড়া হিং-এর গন্ধও দুজনেরই মনে ধরেছে। কুন্দরির শুকনো শুকনো তরকারিটা আমাদের বাড়িতে হয়, বহুদিন পর খেয়ে ভালো লাগল। আর মিষ্টির সবুজ রং দেখে চমকে গিয়েছিলাম। মুখে দিয়ে আরও চমক। একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম জিনিসটা কীসের। 

জিনিসটা দুধি, অর্থাৎ লাউয়ের ক্ষীর। 

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? আচ্ছা নহি হ্যায়? 

আচ্ছা বললে কম বলা হবে। বহোৎ আচ্ছা। গুজরাত ভবনের পরিবেশকদের ব্যবহারও ভালো। দুজনের পেটভরা খাবারের দাম হল আড়াইশো টাকা। বেরিয়ে ওলা ডেকে অফিসে ফিরে এলাম। গোটা ঘটনাটা ঘটাতে সময় লাগল দেড় ঘণ্টারও কম। 

*****

সামনের এক সপ্তাহের মতো সম্ভবত এটাই অবান্তরে শেষ পোস্ট। একটা কাজ সেরে রবিবার ফেরার কথা। তখন দেখা হবে। টা টা বাই বাই, আবার যেন দেখা পাই।



Comments

  1. Replies
    1. হ্যাঁ, গুজরাট ভবন দিলখুশ করে দিয়েছে, তিন্নি।

      Delete
  2. Ami probol mangshashi. Gujarat Bhavan amar jonney noi. Aar Archisamaaner songey amat Kadi obhokti mele!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি খুব কম বাঙালিকে কঢ়ি পছন্দ করতে দেখেছি, রুণা।

      Delete
  3. amar kori bhaloi lage.. ami borong sitafol opochhonder dole.. r ekdin for a change gujrat bhobone apotti nei tobe roj eoj khete bolle kanna pabe.

    btw, tomar sei sada til ra sodgoti prapto holo?

    ReplyDelete
    Replies
    1. সীতাফলটা জাস্ট নেওয়া যায় না, চুপকথা। সাদা তিলের কথা তুলে আর লজ্জা দিয়ো না। তবে অজুহাত হিসেবে একটা কথা বলতে পারি, আমি নিজেই এখন প্রায় সদগতি পাওয়ার অবস্থায় আছি। সামনের সপ্তাহে খানিকটা হাঁফ ছাড়ার পর একটা অনেস্ট অ্যাটেম্পট নেবই নেব।

      Delete
    2. কি হলো? পুজোর রেশ কাটাচ্ছ নাকি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছো?নাকি সব থেকে বাজে ব্যাপার, অফিসের হাতে পড়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছ? এবারের বইমেলায় তোমার আর কোনো বই বেরোবে কি?

      Delete
    3. সবথেকে বাজে ব্যাপারটাই চলছে, চুপকথা। বই বেরোনোর খবরটা দিতে পারলে নিজেই খুশি হতাম, কিন্তু স্যাডলি সে খুশি কপালে নেই।

      Delete
  4. Shubho Bijoya Kuntala! Onekta deri hoye gelo ... tobuo janayi Bijoyar antorik shubheccha o bhalobasha.

    Ekhane praaye e Gujarati thali khai ... kintu adaisho takaye?! Shey sudin ar ashbe na Pune te.

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভেচ্ছার কোনও দেরি নেই, শর্মিলা। তোমরাও আমার অনেক ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা জেনো।

      আড়াইশো টাকার বিলটা স্রেফ স্টেট ক্যান্টিন বলে। সাধে কি আমার সরকারি জিনিস এত পছন্দ।

      Delete
  5. রুটি আর ভিন্ডি/সীতাফল/লাউকি/সয়াবিন।

    ...total frustration...bujhi..bujhi..amio somo batyathi

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাই ফাইভ, প্রসেনজিৎ।

      Delete
    2. kauke aghat na korei bolte chai..banglar baire...LAUKI CHANA DAAL..khabar ta aristrocrat level somman pay..ar ki utsaho o anando Jodi ei jinis ta menu te thake...se na dekhle petyo jabe na..ami amar bhager ta kauke die dei..khub e anonder sathe..amar dekhei bibomisha lagte shuru kore..kemon jeno lage ekta unchanunchan..

      prosenjit

      Delete
    3. হাহাহা, লাউয়ের ডাল অবশ্য বাঙালিরাও করে, তবে সেটা ছোলার ডাল দিয়ে নয় মোস্ট প্রব্যাবলি। আমারও লাউকি চানা পোষায় না। ইন ফ্যাক্ট আমার ওই বাঙালি লাউয়ের ডালও খুব একটা পোষায় না। মা জোর করে খাওয়াত।

      Delete
  6. aamio kadi khub bhalobasi.. kintu sitafal ki?...

    dilli berate ele bodh hoy sob bela state canteen ei khabo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. এরা কুমড়োকে সীতাফল বলে, ইন্দ্রাণী। আবার আতাকেও হিন্দিতে সীতাফল বলে। আমার দু'রকমের সীতাফলই সমান খারাপ লাগে। তবে থ্যাংক গড আতার তরকারি বানিয়ে খাওয়ায়নি কখনও।

      Delete
  7. "তবে থ্যাংক গড আতার তরকারি বানিয়ে খাওয়ায়নি কখনও। " - e line ta porei bejay haslam . accha kari ki hoy? tobe ei ekbar tomar khabarer post e lobh dilam na

    ReplyDelete
    Replies
    1. কঢ়ি একরকমের দই + বেসন -এর ঝোল, প্রদীপ্ত। (বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন রকম কঢ়ি হয়। সিন্ধি কঢ়িতে দই থাকে না, শুধু বেসন।)

      Delete
  8. Shubho Bijaya r Subho Dipabolir o agam subhechha. Abantor porchhi kintu comments lekhai phnakibaji cholchhe. sahor e chhilam na besh kichhudin. prothomta beranor jog e ditiota kajer... bujhtei parchho phnaki marar onek ojuhat ... darun post .. r amar dirghosash delhi basi na hobar

    ReplyDelete
    Replies
    1. কোথায় বেড়াতে গেলেন, ইচ্ছাডানা?

      Delete

Post a Comment