গেটাফিক্স, গ্রেটার কৈলাশ ১



আমার গেটাফিক্স-এর খাবার ভালো লেগেছে, সজ্জা ভালো লেগেছে, জানালা ভালো লেগেছে, জানালার ব্লাইন্ডের ফাঁক দিয়ে গায়ে এসে পড়া ডোরাকাটা রোদ্দুর ভালো লেগেছে, কর্তৃপক্ষের ব্যবহার ভালো লেগেছে, আমাদের আশেপাশে বসে খাওয়া বাবামাবাচ্চা, প্রেমিকপ্রেমিকা, বন্ধুবান্ধবদের ভালো লেগেছে, ওপেন কিচেনের ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া শেফ আর সু-শেফদের ধপধপে সাদা জামা আর টুকটুকে লাল টুপি ভালো লেগেছে। আমার গেটাফিক্সের সব কিছু এত এত ভালো লেগেছে যে অদূর ভবিষ্যতে যে ক’দিনের জন্য আমার টেম্পোরারি প্রোষিতভর্তৃকা হওয়ার চান্স আছে, সে ক’দিন সময় পেলে এসে গেটাফিক্সের জানালার ধারের টেবিলটায় বসে কফি আর স্যালাড খেতে খেতে অবান্তর লেখার ইচ্ছে আছে। অবশ্য লেখা কত হবে কে জানে কারণ ওয়াই ফাই ফ্রি। 


আমার উত্তেজিত প্ল্যান শুনে অর্চিষ্মান চোখ ঘোরাল। ও জানে যে আমার ভালো লাগার কোনও মাত্রা নেই। খারাপ লাগারও না। ইন ফ্যাক্ট, গেটাফিক্সের দুর্দান্ত রিভিউ মারকাটারি রেটিং-এর কথা আমি অনেকদিনই জানতাম, কিন্তু কখনও যাওয়ার কথা ভাবিনি। কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম গেটাফিক্স আমার খারাপ লাগবে। ভীষণ খারাপ লাগবে। প্রথম খারাপ লাগবে লোকেশন। জি কে ওয়ান এন ব্লক মার্কেটে আমি যতবার গেছি, বাড়ি ফিরতে প্রাণান্ত হয়েছে। সে ওলা উবারের আগের জমানা। কোনও অটো পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় খারাপ লাগবে খাবার। গেটাফিক্সের ট্যাগলাইনের প্রথম শব্দ হচ্ছে ‘হেলদি’। অর্থাৎ ময়দার বদলে ভুষিওয়ালা আটা দিয়ে বানানো খসখসে বার্গার-বান, চোয়াল ব্যথা করা গ্লুটেন-ফ্রি পাস্তা আর ডিমের সাদার বিস্বাদ অমলেট। তিন নম্বর এবং সবথেকে বেশি খারাপ লাগবে ক্রাউড। পয়সা দিয়ে যাঁরা চিয়াসিড ছড়ানো পালংশাকের জুস আর ভেগান কেক খেতে যান তাঁদের টাইপ সম্পর্কে আমার একটা মতামত আছে এবং সেটা হচ্ছে . . . ওয়েল, তাঁরা আমার টাইপ নন এটুকু বলাই যথেষ্ট।

তবু গেলাম কেন? গেলাম শনিবার দুপুর বলে। বেয়াল্লিশ ঘণ্টা ছুটি হাতে থাকলে কোনওকিছুই খারাপ লাগে না, হতাশ হওয়ার সম্ভাবনায় ভয় লাগে না, লাগলেও সেটাকে ‘অ্যাডভেঞ্চার’ বলে চালিয়ে নেওয়া যায়। সাবিত্রী ফ্লাইওভার সারানো হচ্ছে কে জানে কদ্দিন ধরে, রোজ ফেরার সময় বাড়ির নাকের ডগায় এসে আধঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে কান্না পায়, শনিবার দুপুরবেলা মনে হয় দেশের উন্নতির জন্য এটুকু কষ্ট করা আমার কর্তব্য। তার ওপর ওইরকম রোদ্দুর। তবু গেটাফিক্স আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল না। কিন্তু প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পছন্দের কোনওটাই যখন আমাদের ট্যাঁক এবং পছন্দসই দূরত্বের সীমার মধ্যে পড়ল না তখন স্থির হল গেটাফিক্সই সই।

জি কে ওয়ান মার্কেটের ভেতরের গলিতে গেটাফিক্স। ঢোকার সিঁড়িটা সরু, কিন্তু ঢুকে পড়লে চৌকো ছড়ানো বসার জায়গা, দেওয়ালে বিদেশী ক্যাফের ছবি, লাইটের ফিক্সচার যেন সে ক্যাফের সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট।


আমার থাই প্রন স্যালাড। লেটুস, হলুদ সবুজ লাল ক্যাপসিকাম, গ্রিলড পেঁয়াজ, মিষ্টি নোনতা আঠালো ড্রেসিং। যতটুকু দরকার ততটুকু। অন্য সবকিছুকে ডুবিয়ে মারছে না। তরিতরকারি সতেজ, লেটুস সজীব, মোটা মোটা চিংড়ির পরিমাণ ভদ্রলোকের মতো। প্রথমে ভেবেছিলাম ছুরি কাঁটাই তো যথেষ্ট আবার চামচ দিয়েছে কী করতে। তারপর যখন স্যালাডের শেষ লেটুসের পাতাটা মুখে পোরার পর গভীর প্লেটের নিচে খানিকটা ড্রেসিং পড়ে থাকতে দেখলাম, তখন বুঝলাম কেন। ভাগ্যিস চামচ দিয়েছিল, প্লেট কাত করে সেটুকু খেয়ে নেওয়া গেল। 


অর্চিষ্মানের বারিটো চিকেন বোল। ভাত, লাল (রাজমা) কালো বিনস, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম, মিষ্টি ভুট্টার দানা, টমেটোকুচি, চিপোটলে মশলা মাখিয়ে গ্রিল করা মুরগির লেগপিস হাড় ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো করা। পাতিলেবুর রস। উনুনগরম। পাশে সাওয়ার ক্রিম আর সালসা। 

অন্তে দার্জিলিং উলং চা আর গাজরের কেক। ডিমহীন। চিনির বদলে গুড় আর মাখনের বদলে তিসির তেল দিয়ে বানানো। তাতে স্বাদ টসকেছে কেউ বলতে পারবে না। কেকের পাশে সম্ভবত বেরিজাতীয় কোনও ফলের রস। চিনিহীন।

খুঁত ধরতেই হবে? তবে বলি জলের জাগে কমলালেবুর টুকরো ভাসিয়ে রাখার আইডিয়াটা আমার ভালো লাগেনি। আমি যখন জল খেতে চাই তখন বিস্বাদ, বোরিং জলই খেতে চাই। কমলালেবু খেতে চাইলে সফলের দোকান থেকে কমলালেবু কিনে খাব। 

জীবনে দু’রকম হেলদি খাবার দেখেছি। একরকম হচ্ছে গাঁদাল পাতার ঝোল আর বার্লি। স্বাস্থ্যে টইটম্বুর, স্বাদে অকথ্য। দ্বিতীয়রকম হেলদির উদাহরণ হল গরম ভাত, মুসুর ডালের সঙ্গে পটলভাজা আর কাঁচালংকা কালোজিরে দেওয়া রুইমাছের ঝোল। ভালো খেতে কিন্তু স্বাদটা পয়েন্ট নয়, পয়েন্ট হল আরামটা। কুলকুচি করে জিভ থেকে স্বাদ মুছে ফেলার পরও যেটা অনেকক্ষণ বুক ভরিয়ে রাখবে। 

ভুল প্রমাণিত হয়ে এত খুশি জীবনে কমই হয়েছি। 

গেটাফিক্সের হেলদি খাবার এই দ্বিতীয় রকমের হেলদি। পেট তো ভরেই, মন ভরে তার থেকেও বেশি। কাছাকাছি থাকলে অবশ্য যাবেন।


Comments

  1. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিন্নি।

      Delete
  2. Amio tomar motoei poisa diye "healthy" khete jai na! Lekhata khub bhalo hoyechhe! Archismaan koddin er joneey jacchhhen?

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ অ্যান্ড হাই ফাইভ, রুণা। অর্চিষ্মান ভীষণই কম দিনের জন্য যাচ্ছে কিন্তু তার মধ্যেই আমি একবার গেটাফিক্স যাওয়ার প্ল্যান করছি। ওই যে জানালার ধারে বসে একজন স্যালাড খেতে খেতে টাইপ করছে, এই ছবিটায় নিজেকে না বসাতে পারলে ভাত হজম হচ্ছে না।

      Delete
  3. oi salad ta ekhuni khete ichhe korchhe. tomar chhobi darun...nirbhejal hasi- Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্যালাডটার কথা মনে পড়লে আমারও খেতে ইচ্ছে করছে, ব্রততী।

      Delete
  4. Jol e lebu ba komola lebu r slice chubiye rakha ekta fad hoyeche ekhon mone hocche.
    Chobigulo dekhe ar description pore khide peye gelo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, সব দোকানেই এরকম করে রাখে বুঝি, শর্মিলা? বিতিকিচ্ছিরি।

      Delete
  5. Lekhata darun tobe khaoyar byapare ami Archismaner dole. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে আমার স্যালাডখানা খেলে আমার দলে হয়ে যেতে, চুপকথা।

      Delete
  6. টেম্পোরারি প্রোষিতভর্তৃকা আবার কেন? আহা রে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, টেম্পোরারিটা কি-ওয়ার্ড, অন্বেষা। টেম্পোরারি মানে ভয়ানক টেম্পোরারি। এক আঙুলে গোনা যায়। কিন্তু আমার মতে অল্প ডোজে একলা থাকা (আমার পক্ষে) দুঃখের তো নয়ই, বেশ থ্রিলিং।

      Delete
  7. শেষ লাইনের জন্যে হাই ফাইভ| অল্প একলা থাকার অভ্যেস সকলের জন্যেই থ্রিলিং এবং দরকারী|

    ReplyDelete

Post a Comment