নতুন পোয়্যারো



*কোনও স্পয়লার নেই।

উৎস গুগল ইমেজেস

নতুন হারক্যুল পোয়্যারোর বই বেরোতে শুরু করেছে দু’হাজার চোদ্দ থেকে। আমি কেন এতদিন পড়িনি তার মুখ্য উত্তর, ভয়। কিন্তু বছরের শুরুতে হঠাৎ একদিন চ্যাটবাক্সের ওপার থেকে প্রশ্ন এল, পড়েছ? আমি বললাম, না। চ্যাটবাক্স বলল, পড়বে নাকি? কিন্ডলে দারুণ সস্তা। বল তো অর্ডার করে দিই। সাহসী হওয়া আমার এ বছরের রেজলিউশন, লিখে দিলাম, দাও দাও। 

নতুন পোয়্যারো লিখেছেন সোফি হানা, একজন ইংরেজ লেখক ও কবি। নতুন পোয়্যারো লেখার আগে তাঁর নিজের আটখানা ক্রাইম নভেল ছাপা হয়ে গিয়েছিল। আগাথা ক্রিস্টি এস্টেট-এর বরাতে পোয়্যারোর ‘কনটিনিউয়েশন’ উপন্যাস লিখতে শুরু করেন সোফি হানা। পূর্ববর্তী লেখকের তৈরি চরিত্র বা ঘটনাপ্রবাহ অবলম্বন করে যখন পরবর্তী লেখক নতুন করে লেখেন তখন সেটা হয় কনটিনিউয়েশন লেখা। আমার পড়া বাংলায় যে কনটিনিউয়েশন লেখার উদাহরণ এই মুহূর্তে মনে আসছে তা হল তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাজল’। গোয়েন্দা গল্পে এ ধরণের কনটিনিউয়েশনের উদাহরণ প্রচুর। জেমস বন্ড, শার্লক হোমস সবাইকে নিয়েই বিস্তর গল্প এখনও লেখা হয়ে চলেছে। কনটিনিউয়েশন রচনার প্রতি সকলের মনোভাব সমান নয়। কেউ বলেন, হোক না। এই করে যদি নতুন যুগের ছেলেমেয়েরা হোমস, অপুকে চিনতে পারে, ক্ষতি কী? কেউ একে পরের ধনে পোদ্দারি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। আমার নিজের মত এ বিষয়ে, অন্য বেশিরভাগ বিষয়েরই মতো। অর্থাৎ, জোরালো কোনও মত নেই। আমি মনে করি না পোয়্যারো কিংবা শার্লক কিংবা অপু কিংবা ব্যোমকেশ বা ফেলুদাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার জন্য তাদের নিয়ে গল্প লিখে যাওয়ার প্রয়োজন আছে, আবার যদি কারও ইচ্ছে করে লিখতে তাহলে তিনি যে লিখতেই পারেন সে নিয়েও আমার কোনও সন্দেহ নেই। এতে আসল চরিত্র বা আসল চরিত্রদের সম্মানহানির কোনও সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই না। 

যাকগে। এবার সোফি হানা-র পোয়্যারোর কথায় আসি। এখনও পর্যন্ত পোয়্যারোকে নিয়ে দু’খানা উপন্যাস লিখেছেন সোফি। দ্য মোনোগ্রাম মার্ডারস আর ক্লোজড কাসকেট। আগে গল্পদুটোর ধরতাই দিয়ে নিই, তারপর আমার কেমন লেগেছে বলছি। 

মোনোগ্র্যাম মার্ডারস: হারক্যুল পোয়্যারো রেস্টোর‍্যান্টে বসে খাবার খাচ্ছিলেন, এমন সময় এক বছর চল্লিশের মহিলা, দৃশ্যতই আতংকিত, সেই রেস্টোর‍্যান্টে এসে ঢুকলেন এবং পোয়্যারোর বন্ধুত্বপূর্ণ জেরার উত্তরে জানালেন যে তাঁকে অচিরেই কেউ খুন করতে চলেছে। এই কথা শুনে স্বভাবতই পোয়্যারোও আতংকিত হয়ে পড়লেন এবং মহিলাকে সাহায্য করতে চাইলেন কিন্তু মহিলা সাহায্যগ্রহণে অস্বীকৃত হয়ে যেমন দৌড়ে ঢুকেছিলেন তেমনই দৌড়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেই রাতেই লন্ডনের এক অভিজাত হোটেলের তিনটি ঘরে তিনটি মৃতদেহ আবিষ্কার হল, প্রতিটি দেহের মুখের ভেতর একটি করে কাফলিংক, সবকটি কাফলিংক-এ একই মোনোগ্রাম খোদাই করা, পি আই জে। 

 ক্লোজড কাসকেটঃ এ গল্পের চলন একেবারে স্বর্ণযুগের গোয়েন্দাগল্পের চলনে ঢালা। লেডি প্লেফোর্ড তাঁর মস্ত ম্যানসনে ছেলেমেয়ে, উকিল, গোয়েন্দা, পুলিশ সবাইকে জোগাড় করেছেন। তারপর ডিনার টেবিলে ঘোষণা করেছেন যে তিনি তাঁর উইলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে চলেছেন। ঘোষণা শুনে সবার চোখ কপালে ওঠে এবং সেই রাতেই একখানা খুন হয়।  (আপনি যাকে ভাবছেন, সে নয়, খুন হয় অন্য একজন। ইন ফ্যাক্ট, এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, যেটা কিছুদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরছিল। অনেক সময় গল্প একেবারে খুন দিয়েই শুরু হয়, আবার অনেক গল্প চরিত্রদের সঙ্গে পরিচিতি দিয়ে। একদল লোক, যাদের মধ্যে একজন খুন হবে, আর একজন হবে খুনি। ইদানীং একটা গোয়েন্দা সিরিজ দেখছি, যেটা এই দ্বিতীয় গোত্রের। গল্প শুরু হওয়ার তিন মিনিটের মধ্যে বোঝা যায় কে খুন হবে। কারণ সে বাকিদের এমন চটিয়ে রেখেছে যে তাদের কেউ একজন আর রাগ সামলাতে না পেরে স্ট্রিকনিন কিংবা পিস্তলের দ্বারস্থ হবে। কে খুন করবে সেটার সম্পর্কেই লেখকরা সব সাসপেন্স জমিয়ে রাখেন, কিন্তু কে খুন হয়েছে বা হবে সে বাবদেও যদি কিছু চমক দেওয়া যায়, মন্দ হয় না। ক্লোজড কাসকেট-এ হানা এটা দারুণ সফলভাবে করেছেন।) 

 এবার বইদুটো সম্পর্কে আমার মতামতে আসি। পড়া শুরু করার আগে দুটো জিনিস সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এক, বইগুলো আগাথা ক্রিস্টির বইয়ের মতো ভালো হবে না। আর দু’নম্বর হচ্ছে, আমি চেষ্টা করেও বইগুলোকে একেবারে দূরছাই করতে পারব না। সোফি হানা লেখক হিসেবে কাঁচা হতে পারেন কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি যে ভয়ানক সাহসী সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। না হলে কেউ যেচে পোয়্যারো নিয়ে গল্প লিখতে বসে না। কাজেই স্রেফ সাহসিকতার খাতেই তাঁর কিছু নম্বর বাঁধা।
  
আমার প্রথম বিশ্বাসটা মিলে গেছে। সোফি হানা আগাথা ক্রিস্টি নন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বাসটা খানিকটা মিলেছে, খানিকটা মেলেনি। এবং না মেলায় আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। হানাকে আমি নম্বর দিয়েছি, কিন্তু সেটা শুধু সাহসিকতার জন্য নয়। সোফি হানা ক্রিস্টি নন, কিন্তু তিনি অন্য অনেকের থেকে ভালো। প্রচুর খেটে প্লট বানিয়েছেন হানা। সে প্লটে যথাসম্ভব গেরো পাকিয়েছেন এবং যথাসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে সে গেরো খুলেছেন। গল্পের গতি চমৎকার। প্রথম গল্পে শুরুতে একটু ঢিলেমি চলছিল, অচিরেই সমস্ত মনোযোগ গ্রাস করে ফেলেছে।

কিন্তু শুধু প্রশংসা করলে মজা নেই। ক্রিস্টির থেকে কোনখানটায় হানা কম পড়লেন, সে চুল না চিরলে মনে আনন্দ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, হানার খামতি নিয়ে কথা বলা আসলে ক্রিস্টির উৎকর্ষ নতুন ভাবে উপলব্ধি করা এবং নতুন করে চমৎকৃত হওয়াও। কাজেই এ পোস্টে যত কথা সোফি হানাকে নিয়ে বলব, তার সমান কথাই আমাকে ক্রিস্টিকে নিয়েও বলতে হবে।

আমার মতে হানা প্রথম হোঁচট খেয়েছেন ভাষায়। তাঁর একটি ইন্টারভিউতে সেই পুরোনো প্রসঙ্গটা আবার উঠেছে। যে আগাথা ক্রিস্টি বেসিক্যালি ভালো ধাঁধা বানাতে পারতেন, সাহিত্যসৃষ্টির কোনও ক্ষমতা তাঁর ছিল না। সোফি হানা এ মতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে একজন লেখকের “স্টাইলিস্টিক” খামতি থাকতেই পারে, তা বলে তাঁকে বাজে লেখক বলা যায় না। 

সোফি হানার উদ্দেশ্য মহৎ, আমার এবং তাঁর প্রিয় লেখককে ডিফেন্ড করা, কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে একমত নই। কারণ আমার মতে আগাথা ক্রিস্টির স্টাইল অতি উচ্চমানের। লেখা যেখানে ‘লেখা’ বলে বোঝা না যায়, আমার মনে হয় সেখানেই লেখকের আসল কেরামতি। বলাই বাহুল্য, ভাষার পছন্দঅপছন্দ বেজায় ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনকি পরিস্থিতিভেদে একই ব্যক্তির পছন্দঅপছন্দ পালটে যেতে পারে। আমার নিজেরই আলংকারিক ভাষাওয়ালা বহু লেখা দারুণ লাগে। কিন্তু মোটের ওপর আমি ন্যাড়াবোঁচা লেখার দলে। 

সোফি হানা পোয়্যারোর গল্পে খুব সাহিত্য ফলিয়েছেন বলব না। তবে তিনি যে ‘লেখক’ গল্পের ভাষায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আর তিনি যে কবি, কিছু কিছু জায়গায়, বিশেষ করে বর্ণনামূলক অংশে তা লুকোতে পারেননি। তুলনাটা যেখানে আগাথা ক্রিস্টির মুখের কথার মতো তরল এবং সপাট ভাষার সঙ্গে, সে অংশগুলো আমার একটু কেমন কেমন লেগেছে। তাছাড়া ক্রিস্টির লেখায় একটা ফুরফুরে রসের স্রোত অহরহ বয়, সেটাও হানার লেখায় অনুপস্থিত।

হানার দ্বিতীয় হোঁচট, কারিগরিতে। এবং সেটাও হানার খামতির থেকেও ক্রিস্টির নৈপুণ্যই বেশি মনে করায়। গোয়েন্দাগল্পের ‘ক্রাফট’ যে আগাথা ক্রিস্টি কী অসামান্য বুঝেছিলেন এবং তাতে কী অভূতপূর্ব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, সেটাই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। গোয়েন্দাগল্প লেখা একই সঙ্গে যেমন সততার পরীক্ষা তেমনি আবার পাঠককে ভুল পথে চালিত করারও। একগাদা ক্লু আছে, লেখক জানেন কোন ক্লু-এ কত ধক, সেই বুঝে তিনি তাদের এগিয়েপিছিয়ে রাখেন। এই এগোনোপেছোনোর মধ্যেও একটা খেলা থাকে। যে ক্লু একেবারে চোখের সামনে থাকে, তার ওপর ভরসা কোনও পোড়খাওয়া পাঠকই করে না। যে বেচারার মোটিভ স্ট্রং আর অ্যালিবাই খোঁড়া, সে খুনি নয়। আবার কোনও কোনও ক্লু হালকা হাওয়ায় ভাসিয়ে লেখক এগিয়ে যান (ভাঙা ঘড়ি কিংবা সেলাইর ফোঁড়), অতি চালাক পাঠক ভাবেন সেই দিয়ে তিনি বাজিমাত করবেন, শেষে গিয়ে দেখা যায় ওগুলো নেহাত অপ্রয়োজনীয় তথ্য ছাড়া কিছু নয়। বেশি বুদ্ধি খাটাতে গিয়ে চোখের সামনের ক্লুটাই চোখ এড়িয়ে গেছে।

আমার মনে হয়েছে, সোফি হানা এই খেলাটায় খুব একটা দড় হতে পারেননি এখনও। কে কখন চা খেয়েছে, এ নিয়ে হানা যখন পাতার পর পাতা আলোচনা করে চলেন, ঘাগু পাঠক সাবধান হয়ে যান যে এটা খুব একটা ক্রুশিয়াল পয়েন্ট হতে পারে না। সোফি হানার  যেমন ধরুন যখন চানাচুরের শিশি ফাঁকা হয়েছিল আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম এই যদি আমার অ্যালিবাই হয় আর সাক্ষী যদি হয় অর্চিষ্মান, আর ও যদি খুব মাথা ঝাঁকিয়ে বলে যে হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো জেগেই ছিলাম, কই কুন্তলা তো একটি বারও ঘুম থেকে ওঠেনি, আর তারপর লাস্ট সিনে যদি বলে, ইয়ে মানে আমি মিছে কথা বলেছিলাম, আর অমনি যদি সব সমস্যা সমাধান হয়ে যায়, তখন একটু হাঁ করে থাকতে হয় বইকি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ঘটনাবলীর অবস্থান। মোনোগ্রাম মার্ডারস-এ সমাধান হয়ে যাওয়ার পর অন্তত আরও চারটে চ্যাপ্টার ধরে গল্প চলতে থাকে, এবং আমার মতে, তেমন কোনও উন্মোচন ছাড়াই। 

তবে এ সমস্ত কাঠামোগত অসুবিধে সোফি হানা প্রভূত পরিমাণে কাটিয়ে উঠেছেন ক্লোজড কাসকেট-এ।  তাছাড়া এগুলোর কোনওটাই আমার মতে সোফি হানার পোয়্যারো উপন্যাসের প্রধান দুর্বলতা আমার মতে হানার অ্যাকিলিস’ হিল হচ্ছে তাঁর সৃষ্ট একটি চরিত্র, যে সে চরিত্র নয়, গল্পের বক্তা, এডওয়ার্ড ক্যাচপুল। 

এডওয়ার্ড ক্যাচপুল হচ্ছেন নতুন পোয়্যারোর হেস্টিংস। এবং একইসঙ্গে জ্যাপও। কারণ ক্যাচপুল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বত্রিশ বছর বয়সী একজন পুলিশ গোয়েন্দা। কিন্তু ক্যাচপুলকে এ দুটোর একটাও মনে হয় না। বত্রিশ বছরের একজনের যুবকের তাঁর হাবভাব বুড়ো হেস্টিংস-এর সঙ্গে অনেক বেশি মেলে। আমি বলছি না বত্রিশ বছরের যুবক হলেই তাকে প্রাণবন্ত হতে হবে, আমি নিজেই বত্রিশে তা ছিলাম না, বাইশেও না, কিন্তু ক্যাচপুল বড্ড বেশি ঝিমোনো। মোনোগ্রাম মার্ডারস-এর প্রথম যে দৃশ্যে ক্যাচপুলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হচ্ছে সেখানে দেখা যাচ্ছে ডেডবডি দেখে এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে হোটেল থেকে বাড়ি (গেস্টহাউস) চলে এসে চুপ করে বসে আছেন। আমি জানি না ঘটনাটা আমার যতখানি অদ্ভুত লেগেছিল ততখানি আমি প্রকাশ করতে পারলাম কি না। ক্যাচপুলের ট্রমার কারণ পরে (খুব সম্ভব চতুর্থ চ্যাপ্টারে) উদ্ঘাটিত হয়, কিন্তু সত্যি বলছি, ক্যাচপুলের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।

 তার থেকেও বেশি অদ্ভুত হচ্ছে ক্যাচপুলের পুলিশ পরিচয়। ভদ্রলোকের যে অফিস বলে কোনও বস্তু আছে, গল্প পড়ে তার কোনও আভাস পাওয়া যায় না। পোয়্যারোর পেছন পেছন ঘুরছেন, পোয়্যারো যে মুহূর্তে বলছেন, চল একটু বাসে করে ঘুরে আসি, মাথা পরিষ্কার হবে, ক্যাচপুল বিনা বাক্যব্যয়ে বাসে চেপে চলেছেন। একবার ফাঁকতালে বলা হয়েছে যে পোয়্যারোর খ্যাতির কথা জানা আছে বলে ক্যাচপুলের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা তাঁকে সম্পূর্ণরূপে পোয়্যারোর কাছে ছেড়ে রেখেছেন কিন্তু এটা ফ্র্যাংকলি বিশ্বাসযোগ্য নয়। 

এডওয়ার্ড ক্যাচপুলকে পুলিশ করার আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল কি না, দেখেশুনে সেটাই আমার প্রশ্ন জেগেছিল। এমনি একজন রিটায়ার্ড বুড়োকে দেখালেই হত। প্রধান গোয়েন্দা পুলিশ হলে তাও না হয় বুঝি, সহকারী পুলিশ হওয়ার সুবিধে কী? তারপর মনে পড়ল এতে বোধহয় তদন্তের তথ্য ইত্যাদি পেতে সুবিধে হয়। যাই হোক, পুলিশে আমার আপত্তি নেই কিন্তু তাহলে সে পেশাসংক্রান্ত আরও কিছু ডিটেলস আমি আশা করেছিলাম।  

কিন্তু প্লট নয়, কাঠামো নয়, ক্যাচপুল তো নয়ই, যাঁর জন্য সোফি হানার উপন্যাস পঞ্চাশটির মতো ভাষায় অনুবাদ হয়েছে আর লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে তিনি হলেন বেঁটেখাটো, গোঁফসর্বস্ব, হামবাগ সেই বেলজিয়ান ডিটেকটিভ। তাঁকে কেমন এঁকেছেন হানা? এই পোয়্যারো সেই পোয়্যারোর থেকে ফরাসিটা একটু বেশি বলেন। আরেকটা অসুবিধে হচ্ছিল আমার গোড়ার দিকে, তবে সেটা মানসিক বলেই আমার ধারণা। মানে পুরোনো পোয়্যারো রেস্টোর‍্যান্টের কাঁটাচামচ সোজা করে রাখলে আমার কিছুই মনে হত না, কিন্তু যেই না নতুন পোয়্যারো কাঁটাচামচ সোজা করে রাখছেন আমার মনে হচ্ছে, দেখেছ, খালি অথেনটিসিটি প্রমাণ করার চেষ্টা। এ সব বাদ দিলে সব ঠিকই আছে। সেই দেমাক, সেই সমাধানের গন্ধ পেলে চোখে সবুজ আলো জ্বলে ওঠা, সবই আছে যেখানে যা থাকার। সোফি হানার পোয়্যারো প্রায় আমাদের চেনা পোয়্যারোর মতোই এবং সবথেকে আশ্বাসের কথা, একটুও ক্যারিকেচারিশ নন। 

এক প্যারা প্রশংসা করে পাঁচ প্যারা খুঁত ধরলাম বটে, কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে যে কোনও ভালো গল্পের, গোয়েন্দাগল্পের তো বটেই, যেটা প্রধান গুণ, পাঠককে গ্রাস করে ফেলা,  সোফি হানার পোয়্যারোর গল্পে সে গুণ ষোলো আনার আঠেরো আনা আছে। দ্য মোনোগ্রাম মার্ডারস আর ক্লোজড কাসকেট পড়ার দু’দিন আমি অন্য কথা ভাবতে পারিনি। মানে ভাবতে তো হয়েছেই, না হলে আর মাইনে দেবে কেন, কিন্তু যখনই সে সব আবোলতাবোল জিনিস মাথা থেকে সরেছে, পোয়্যারোর গল্প ফিরে এসে মগজ জুড়ে বসেছে। আধপড়া গোয়েন্দাগল্পের কাছে ফিরে আসার যে কী অসামান্য আনন্দ, সেটা যে না পেয়েছে তাকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া অবাস্তব। সোফি হানা (নাকি পোয়্যারো?) আমাকে বহুদিন পর সেই সুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর পরের পোয়্যারোর গল্পগুলো আমি অবশ্যই পড়ব। একটুও ভয় না পেয়েই।



Comments

  1. Besh bhalo laglo lekhata. Udbuddho holam Sophie Hannah'r golpo porate.
    Tobe ekta kotha, mane eta amar ekantoi byaktigoto mot: Agatha Christie r Sophie Hannah er modhyekar tulonata onekta oi Sachin Tendulkar er batting er songe Venkatesh Prasad er batting er tulona tanar moton hoye gyalo.
    Bakita niye kichhu bolar nei :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি আপনার সঙ্গে একমত, অরিজিত। কিন্তু পোয়্যারো লিখছেন যখন, (তাও শখে নয়, রীতিমত অফিশিয়াল ছাপ নিয়ে) তখন তো তুলনা না করে পারাও যায় না।

      Delete
  2. ekta apato oprasongkik....keu ba kara,,jakhan bole poyrott...mathata bhok kore garam hoy kina...ebong besh shikkhito lokera..

    ki..

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার রাগটা স্বাভাবিক, প্রসেনজিৎ, কিন্তু আমি বেশি রাগ করছি না, কারণ আমি নিজে প্রচুর উচ্চারণ ভুল করি। ইন ফ্যাক্ট, পোয়্যারোর নামের উচ্চারণ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নই বলে গোটা লেখায় সেটা পরিহার করার চেষ্টা করেছি।

      Delete
    2. are..tumi to serious hoe gele..mosti to..

      Delete
  3. darun laglo lekhata... ebar Sophie hannah pore phelbo... gorimosi katiye... bhalo laglo tulona.. mushkil hocche aamaar jani na kyano emnite miss marple ke beshi bhalo lage.. :) tai aami bodh hoy poirot r unish bishe khub dukkho pabo na..

    bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. মিস মার্পল আমারও বেশি পছন্দ, ইন্দ্রাণী, তবে পোয়্যারোও ভালো লাগে। সোফি হানা পোয়্যারোতে খুব একটা উনিশবিশ করেননি। অন্য চরিত্রগুলো, বিশেষ করে ক্যাচপুল, আমার মতে একটু দুর্বল। তবে এটা তো ঠিক, ক্রিস্টির থেকে যদি হানা বেটারও লিখতেন, আমার মতো ফ্যানেদের মনে হত ক্রিস্টির মতো হয়নি। এই হচ্ছে কনটিনিউয়েশন লেখার ঝামেলা।

      Delete
    2. thik bolechen. Continuation khub e golmele byapar.. sherlock holmes erokom ek continuation, jekhane ekti meye holmes er protege, jodio premise ta khubi interesting, kintu kichutei boita 20 patar beshi porte paarini.. ei boitar naam mone porche na, tai search korte ei page ta dekhe bhirmo khelam - https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_authors_of_new_Sherlock_Holmes_stories

      Delete
    3. Anthony Horowitz er The House of Silk golpota amar kharap laageni Sherlock er continuation hishebe.
      Kintu Ami Sherlock er theke Christie er beshi fan, kaajei Sophie Hanna porte giye Christie k ekebare matha theke bar kore diye porte hobe. :)

      Delete
    4. ইন্দ্রাণী, যে গোয়েন্দার বাজার যত তেজী তার কনটিনিউয়েশনের বাজারও তত তেজী আরকি।

      হাউস অফ সিল্ক পড়েছেন, অরিজিত? আমি একেবারে হন্যে হয়ে আছি বইটা পড়ার জন্য।

      Delete
    5. House of Silk porechhi, Kuntala. Amar kharap laageni. Pore felun jogar kore.

      Delete
  4. Replies
    1. আমি তো বলি পড়েই ফেল। দুটো না হলেও, একটা। অখাদ্য লাগলে আমার ওপর রেগো না, এইটি শুধু অনুরোধ।

      Delete
  5. অবশেষে নতুন পোয়্যারো-র প্রথম বইখানি হাতে এল, আর গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম।
    প্রথমেই বলি, গল্পটা আমার বেশ ভাল লেগেছে। কিছু কিছু জিনিসের অনর্থক পুনরাবৃত্তি এবং শেষের দিকটা 'টেনে বাড়ানো' মনে হলেও, সামগ্রিকভাবে বেশ টানটান একটা ব্যাপার। প্লটটার মধ্যে অভিনবত্ব এবং খাটুনি - দুটোই পেলাম। চরিত্রচিত্রণও যথাযথ।
    দুই, পোয়্যারোকেও আমার খারাপ লাগেনি, বরং এরকম অতি-জনপ্রিয় একজনকে পুনরায় গল্পের পাতায় নামানো খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার, আর সেই কঠিন ব্যাপারটায় সোফি হানা ভালই উৎরেছেন।
    কিন্ত ক্যাচপুলই হলেন এই গল্পের সবচেয়ে আপত্তিকর অধ্যায়। কুন্তলা, আপনার কথা ধরেই বলি, একে না আনলেও চলত, এবং কে জানে, হয়তো এর থেকে আরো ভালই চলত।

    পরের বইটা পড়ার উৎসাহ প্রচন্ড বেড়ে গেল, এবং আমার সঙ্গে এই সিরিজের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

    ওঃ, নেট-এ দেখলাম, এই বছর তিন নম্বর বইটা বেরোচ্ছে :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. রেকোমেন্ড করা বই কারও পছন্দ হলে আর সে এমন সুন্দর করে প্রতিক্রিয়া জানালে কত ভালো লাগে সেটা আপনি জানেন নিশ্চয়, অরিজিত। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। মহিলা যে খেটেছেন গল্পগুলোর পেছনে সে নিয়ে সন্দেহ নেই। শেষের দিকের টেনে বাড়ানোর কথায় বলি, যদিও অনেকদিন আগে পড়েছি, তবু মনে আছে, Denouement-এর জায়গাটা মহিলা সামলাতে পারেন না, বা বাকি জায়গাগুলোর থেকে কম পারেন। অত ব্যাখ্যা না দিলেও চলে। তাছাড়া পুনরাবৃত্তি দোষও আছে, ঠিকই বলেছেন আপনি। কিন্তু সব মিলিয়ে পোয়্যারোর আশীর্বাদে উৎরে যায়।

      তৃতীয় বইটার খবর দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment