দ্য হাউস অফ সিল্ক



উৎস গুগল ইমেজেস

আমার এ বছরের গল্পের বই পড়াকে গ্রাফে ফেলল দেখা যাবে দীর্ঘ কোমাটোজ, মাঝে মাঝে প্রাণের সাড়া। কপাকপ তিন চারটে বই গিলে আবার ঝিমুনি। জাগরণের সময়টুকুতে ইন্টারেস্টিং বই যে পড়া হয় না তেমন নয়। রুথ রেন্ডেলের গল্প অবলম্বনে গল্প লিখতে গিয়ে ওঁর দু'খানা ছোটগল্প সংকলন পড়া হয়েছে। রুথ ওয়্যার বলে আমার কাছে নতুন এক লেখকের 'ইন আ ডার্ক, ডার্ক উড' নামের একটা উপন্যাস পড়লাম। অ্যান ক্লিভস-এর ভেরা স্ট্যানহোপ সিরিজ টিভিতে দেখা ছিল, শুরুর দুটো বই পড়লাম। আমার দেখা 'বইয়ের থেকে বেটার' টিভি রূপান্তরের হাতে গোনা লিস্টে আর একটা নাম যোগ হল সম্ভবতঃ। তবে আরও দু'চারটে বই না পড়ে মন্তব্য করা উচিত নয়। 

বইগুলো পড়ার পর অনেক কথা মাথায় এসেছিল, তক্ষুনি লিখে রাখা হয়নি, এখন ভুলে গেছি। কোটেশন-মোটেশনও কিছু জমিয়ে রাখা হয়নি কোথাও। এখন পোস্ট লিখতে গেলে খাটনির মধ্যে পড়তে হবে। সত্যি বলতে কি অবান্তরে পোস্ট লেখা নিয়ে আমার অত উদ্বেগ নেই, যত আছে বই পড়া নিয়ে। বছরের শুরুতে পঞ্চাশটা বই পড়ার ঢ্যাঁড়া পিটিয়েছিলাম, দিল্লি বইমেলার সৌজন্যে খানিকটা পিক-আপও নেওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তারপরই কোমা ধরেছে। এখন যা পরিস্থিতি, একত্রিশে ডিসেম্বর পঞ্চাশের বদলে সাঁইত্রিশে গিয়ে দৌড় না শেষ হয়। 

সেটা হতে দেওয়া যায় না। কাজেই আমার এমন বই চাই যা আমি শেষ করতে পারব। অথচ যা চটি নয়। নিজের পরীক্ষায় নিজেই চিটিং করার থেকে প্যাথেটিক আর কিছু নেই। এবং অফ কোর্স, বই এমন হতে হবে, পঞ্চাশটা বই শেষ করার হাস্যকর মুলো নাকের সামনে না ঝুললেও যেটা আমি পড়তাম। পড়তে চাইতাম। আমার পড়তে ভালো লাগত। 

বইয়ের আগে লেখকের নাম মনে এল। 

অ্যান্থনি হরোউইটজ। 

বইও বেশি ভাবতে হল না। ওঁর 'দ্য হাউস অফ সিল্ক' পড়ার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। তাছাড়া অরিজিত আশ্বাস দিয়েছেন বইখানা তাঁর ভালো লেগেছে। 

দ্য হাউস অফ সিল্ক, অ্যান্থনি হরোউইটজের লেখা প্রথম শার্লক হোমস প্যাস্টিশ। কোনান ডয়েল এস্টেটের তরফ থেকে বরাত দেওয়া অফিশিয়াল প্যাস্টিশ। দ্য হাউস অফ সিল্ক লেখার পর আর একটি সিকোয়েলও লেখা হয়েছে মরিয়ার্টি নামে। 

বইয়ের শুরুতেই দেওয়া আছে কাজেই স্পয়লার নয়। শার্লক হোমস সত্যি সত্যি মৃত। ওয়াটসন বৃদ্ধ। অতি বৃদ্ধ। নার্সিং হোম-জাতীয় কোনও এক জায়গায় আছেন। সারাদিন লেখেন। লিখলে ভালো থাকেন। 

গল্প শুরু হয়, হোমসের বেশিরভাগ গল্পই যেভাবে শুরু হয় সেভাবে। এক ভদ্রলোক এসেছেন একটি সমস্যার ব্যাপারে হোমসের কাছে সাহায্য চাইতে। রহস্যটিও এর থেকে বেশি হোমসোচিত হওয়া সম্ভব নয়। ভদ্রলোক আর্টের কারবারি। কয়েকটি পেন্টিং চুরি এবং সে চুরি-পরবর্তী মারামারি কাটাকাটির ফলে এক অ্যামেরিকান মাফিয়া তাঁর পিছু ধাওয়া করে ইংল্যান্ডে এসেছে এবং প্রাণে মারার হুমকি দিচ্ছে। শাখাপ্রশাখা বেরিয়ে কেস ক্রমে জটিলতর হয়। সে সব বলতে গেলে স্পয়লার হয়ে যাবে, তাই এড়িয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এটুকু বলাই যায়, দ্য হাউস অফ সিল্ক-এ রহস্যের অভাব নেই। প্রথম দেখায় যে রকম লাগে গল্পটা অত সরল নয়। পেঁয়াজকলির থেকে পেঁয়াজের সঙ্গেই হাউস অফ সিল্কের প্লটের সাদৃশ্য বেশি। গল্পে লেস্ট্রাড আছেন, মাইক্রফট আছেন, শার্লকের রাস্তার ছেলে বাহিনী আছে, ছোট্ট রোলে ওয়াটসনের স্ত্রী মেরি আছেন। ঘোড়ার গাড়ি আছে, আফিমের ঠেক আছে। যা কিছু বা যাঁদের অপেক্ষায় শার্লক হোমসের পাঠকরা থাকবেন, তাঁরা সকলেই আছেন। 

প্লট সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছু বলতে না পারার জন্য দুঃখিত। আমার গল্পটা খুবই ভালো লেগেছে। রহস্য, রহস্যের গতি, উত্থানপতন, সবই ভালো। ফোর স্টার দেওয়ার মতো ভালো।

কিন্তু দ্য হাউস অফ সিল্ক মৌলিক উপন্যাস হিসেবে কেমন সেটা জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে শার্লক হোমসের প্যাস্টিশ হিসেবে বইটা কতটা সফল সেটা।

ভাষা, ভয়েস, চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিক বিচারে হরোউইটজের 'হাউস অফ সিল্ক' অরিজিন্যাল শার্লক হোমসের গল্পের সফল অনুকরণ বলেই আমার মত। আমার মতে শার্লক হোমসের গল্পের মুল আকর্ষণও ওইগুলোই। শার্লক হোমসের মতো একখানা যুগনির্ণায়ক চরিত্র আর লন্ডনের ছায়াছায়া অলিগলিতে খটাখট ঘোড়াগাড়ি। অরিজিন্যাল হোমসের ওয়াটসনের গল্প বলার ধরণে বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহার করার প্রবণতা, বন্ধুর প্রতি অন্ধ গুণগ্রাহিতা, চ্যাপ্টারের শুরুতে টেমস বা কান্ট্রিসাইড নিয়ে প্যারাদুয়েক ভাষাবিস্তার, হাউস অফ সিল্কে একেবারে নির্ভুল টোকা। 

তাহলে কোন জায়গাটায় হাউস অফ সিল্ক অরিজিন্যাল শার্লক হোমসের গল্পের মতো নয়?

এক, বইয়ের আয়তনে। অরিজিন্যাল শার্লক হোমসের ছাপান্নটাই ছিল ছোটগল্প আর উপন্যাস মোটে চারটে। দ্য হাউস অফ সিল্ক, অরিজিন্যাল শার্লক হোমসের দীর্ঘতম উপন্যাস হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস-এর থেকেও দীর্ঘ। শুরুর দিকের ঘটনাগুলো, ক্লায়েন্টের দেখা করতে আসা, ক্লায়েন্টকে দেখে বা দেখার আগেই তার সম্পর্কে হোমসের অনেককিছু বলে দেওয়া, মিসেস হাডসনের প্রবেশ ও প্রস্থান ইত্যাদি ঘটনাগুলো স্লো মোশনে ঘটছে মনে হয়। অবশ্য যতক্ষণ না আপনি ওই লয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন ততক্ষণই মনে হয়, তারপর সয়ে যায়।  (আমি কিন্তু অ্যান্থনি হরোউইটজের লেখাকে স্লো মোশন বলছি না। আমি বলছি শার্লক হোমসের সাপেক্ষে ধীরগতি।) 

দ্বিতীয় তফাৎ হল রহস্যের চরিত্রে। শার্লক হোমসের গল্পে সাধারণতঃ যে ধরণের রহস্য থাকে, তার থেকে ঢের ঢের ঢের বেশি আতংকউদ্রেককারী। অরিজিন্যাল শার্লক হোমসের ক্লায়েন্টরা জানালার বাইরে 'স্যাভেজ' ইন্ডিয়ান 'মাংকি' ফেস দেখলেই স্মেলিং সল্টের বোতলের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়তেন, দু'হাজার এগারোর পাঠকদের ও জিনিস দেখিয়ে সহানুভূতি আদায় করা কঠিন হত। কাজেই এ যুগের পাঠকরা যা যা পড়ে আঁতকে উঠতে পারেন, বেছে বেছে সেই রকম রহস্যই ফেঁদেছেন লেখক। এবং প্রাচীন চরিত্ররা তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে সে সব রহস্যের পিছু ধাওয়া করছেন একেবারে আধুনিক ভাবনাচিন্তা, সংবেদনশীলতা এবং নীতিবোধের সূত্র মেনে। অরিজিন্যাল বইয়ে চরিত্রগুলোর মধ্যে যার ছিটেফোঁটা নমুনাও দেখা যায়নি।  

আর এখানেই প্যাস্টিশের মূল টানাপোড়েন। গলির ছায়া, ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ, মিসেস হাডসনের লং স্কার্টের কুঁচির গুনতি যত বেশি আসলের কাছাকাছি তত হাততালি। কিন্তু সাজ পোশাকের আড়ালে চরিত্রগুলোর মূল্যবোধ হতে হবে একেবারে আপ টু ডেট। বেশ কিছু জায়গায় রীতিমত ক্ষমা চেয়েছেন ওয়াটসন, লেস্ট্রেডকে গালি দিয়েছিলেন বলে। শার্লক হোমসকে দিয়ে বলিয়েছেন, সত্যি আমি অনেক কাজ ভেবেচিন্তে করিনি। আরেকটু সেন্সিটিভিটি দেখানো উচিত ছিল।

চরিত্রদের গোলমেলে আচরণ সংশোধন করার দায়িত্ব প্যাস্টিশ লেখকের কি না সেটা ভাবার বিষয়। চরিত্রের অথেন্টিসিটির মধ্যে তার খারাপ দিকগুলোও তো পড়ে। না হয় থাকলই। 

যাই হোক, আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। বইখানা একদিনে পড়ে ফেলা গেছে। সামনের ক'দিনের গল্পের বই পড়ার যে খরাটা আসতে চলেছে, আসবেই, সে নিয়ে এক্ষুনি দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।



Comments

  1. bah bah..chaliye jao
    btw tumi tintin er kono pastiche porecho,
    TINTIN IN BANGKOK..internet e pawa jay,tobe tomar khub kharap o lagte pare..motamuti mojar.

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. আচ্ছা। পেলে পড়ব।

      Delete
  2. Ei boiTa amar khub bhalo legechhilo. Rahosyota jemon jomati temon climax! Apni porlen bole bhalolagchhe...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, ক্লাইম্যাক্সটা জব্বর, সায়ন।

      Delete
  3. Replies
    1. আপনি বললেন বলে বইটা আরও উদ্যোগ নিয়ে পড়লাম, অরিজিত। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. অ্যান্থনি হরোউৎজের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় 'ট্রিগার মর্টিস'-এর মাধ্যমে। অবাক হয়ে গেছিলাম লেখাটা পড়ে। ফ্লেমিং-এর সহজ, অনাড়ম্বর, গতিময় গদ্যকে অনুসরণ করেও প্যাস্টিশটি ব্রিটিশ উন্নাসিকতা এবং নারীবিদ্বেষ তথা মেয়েদের বন্ডের খেলার পুতুল বানানো জাতীয় স্টিরিওটাইপ থেকে মুক্ত ছিল। আলোচ্য বইটি পড়তে গিয়েও একই জিনিস আমাকে চমকে দিয়েছিল। তবে বইটা আমারও বড়ো বেশি অন্ধকার ঠেকেছিল। ক্যালেব কার-এর 'দ্য এলিয়েনিস্ট' নিউ ইয়র্কের পটভূমিতে ট্রু ক্রাইমের সেনসেশন আর রহস্যভেদের উত্তেজনা মিশিয়ে এই অপরাধকেই আরও চরম আকারে দেখিয়েছিল। সেটা পড়তে সমস্যা না হলেও হোমসকে এই অপরাধ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখা একটা ধাক্কাই ছিল।
    তবে এও স্বীকার্য যে এখনকার টপ নচ প্যাস্টিশগুলো এমন অপরাধই তুলে আনছে, যাদের সামনে পড়লে হয়তো ডার্টমুরের হাউন্ডটিও পালাতে পথ পেত না। লিন্ডসে ফে-র 'ডাস্ট অ্যান্ড শ্যাডো'-তে রিপার, মাইকেল শাবন-এর 'দ্য ফাইনাল সলিউশন'-এ হলোকস্টের বীভৎসতা... আজকের পাঠনের জন্য প্যাস্টিশ লিখতে গেলে বোধহয় লেখকদের সামনে আর কোনো রাস্তা নেই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখেশুনে তো সে রকমই মনে হচ্ছে, ঋজু। তবে ক্যালেব কার-এর সঙ্গে শার্লক হোমসের একটা তফাৎ আছে। ক্যালেব কার ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও আমাদের কাছে অচেনা। সে লোকটার ভ্যালু সিস্টেম সম্পর্কে আমাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। লেখক যা বানাবেন, বিশ্বাস করব। তাছাড়া ক্যালেব কার ওই সময়ের তুলনায় চিন্তাভাবনায় অনেক অগ্রগণ্য ছিলেন বলেই দেখানো হয়েছে বইতে। শার্লক 'উইয়ার্ড' এবং সমাজছাড়া ছিলেন, কিন্তু তাঁকে ভাবনাচিন্তায় প্রগতিশীল সন্দেহ করার কোনও কারণ ডয়েল দেননি। তাছাড়াও শার্লকের মূল্যবোধটোধ পাঠকদের অনেকদিন ধরে চেনাজানা। সেগুলো যুগের চাহিদার সঙ্গে মাথায় রেখে বদলে দিলে চরিত্রটাও বদলে যায় না কি?

      অবশ্য এটাও মানি, এই যুগে দাঁড়িয়ে ইন্ডিয়ান চাকরেওয়ালা গল্প লেখাও বিবিধ কষ্টিপাথরে ফেল করতে পারে। কোনটা যে বেশি ঠিক কে জানে। ভেবেচিন্তে মনে হচ্ছে, আধুনিক লেখকরা যা করছেন সেটাই সম্ভবতঃ।

      Delete

Post a Comment