স্ত্রী




উৎস গুগল ইমেজেস

পাড়ার হলে চলছিল, শুক্রবার রাত ছিল, কাজেই আমরা স্ত্রী দেখতে গেলাম। অর্চিষ্মানেরই উৎসাহ বেশি ছিল, ও নাকি ভালো রিভিউ শুনেছে। আমি অফিসে যখন বললাম স্ত্রী দেখতে যাচ্ছি, একজন বললেন তিনি নাকি শুনেছেন, ওকে মুভি। শুক্রবার রাত, বাড়িতে বসে থাকার থেকে ‘ওকে’ সিনেমাই না হয় দেখে আসি, ভেবেটেবে চলে গেলাম হলে। 

ভাগ্যিস গেলাম। স্ত্রী আমার দারুণ লেগেছে। দুর্দান্ত লেগেছে। একঘর লেগেছে।

স্পয়লার বাদ দিয়ে গল্পটা আগে বলি। মধ্যপ্রদেশের চান্দেরি শহরের বার্ষিক পূজার সময় প্রতি বছর এক পেত্নীর আবির্ভাব হয়। সে কেবল শহরের পুরুষদেরই আক্রমণ করে। প্রথমে ফিসফিস করে নাম ধরে ডাকে, যেই না পুরুষটি পেছন ফিরে তাকায়, তাকে গাপ করে পালায়। পুরুষটি যে কখনও পৃথিবীতে হেঁটেচলে বেড়াত তার প্রমাণ হিসেবে পড়ে থাকে শুধু পরনের পোশাক। পেত্নীর প্রতিষেধক হিসেবে শহরের লোকেরা দেওয়ালে রক্তাক্ষরে ‘ও স্ত্রী কাল আনা’ লিখে রাখে, তাতে কাজও দেয় বেশ। কিন্তু লেখা না থাকলে আর রক্ষা নেই। 

ভিকি (রাজকুমার রাও) ‘বিক্কি’ হচ্ছে চান্দেরির স্টার দরজি। বাবার (অতুল শ্রীবাস্তব) নয়নের মণি। বিট্টু (অপারশক্তি খুরানা) আর জনা (অভিষেক ব্যানার্জি) ভিকির দুই বন্ধু। ভিকি বাবার দোকানে বসে কাপড় বানাতে বানাতে ভাবে নিশ্চয় আরও বড় কিছু করার জন্য ওর জন্ম হয়েছে। রুদ্র (পঙ্কজ ত্রিপাঠী) বলে আরেকজন আছেন লোকাল পুস্তক ভাণ্ডারের মালিক, তিনি নিজের দোকানের পুস্তক পড়েটড়ে স্ত্রী-কে প্রতিহত করার রাস্তা বার করেছেন। নিজ উদ্যোগে রিকশা চড়ে সে প্রতিষেধকের লিফলেট বিলি করে বেড়ান। শহরে পুজো শুরু হয়। ভিকির কাছে পুজোর লেহেঙ্গা সেলাই করানোর জন্য আসেন এক রহস্যময় মহিলা (শ্রদ্ধা কাপুর)। আরও একজন আসে শহরে। অলিগলির ছায়ায় ছায়ায়, ঘন জঙ্গলের শুকনো পাতায় খসখস করে কে চলেফিরে বেড়ায় সে আর বলে দেওয়ার দরকার নেই। পরপর দু’রাতে দুই নওজওয়ান হাপিস।

স্ত্রী হচ্ছে যাকে বলে জনর-বেন্ডিং সিনেমা। বেশিরভাগটাই হাসির, কিন্তু আবার পেত্নীও আছে, বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ঠাট্টাতামাশাও। সিনেমায় চান্দেরিকে অপূর্ব দেখতে লেগেছে। স্মার্ট ফোনে লুডো খেলা থেকে শুরু করে পুজোর প্রস্তুতি, গলির দেওয়ালে কাঁপা হাতে লেখা বিজ্ঞাপন, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ‘ভাসান’ নাচের ফুর্তিটুর্তি মিলিয়ে ছোট শহরের চার্ম পর্দা থেকে সোজা হৃদয়ে লাফ মারে। দেখলেই মনে হয় জায়গাটায় ঘুরে আসি। 

সিনেমার আর কিছুর বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু গল্প বলার ভালোমন্দের বিচার করা সম্ভব। এমনকি আমার চেনা কিছু লোক যারা সিনেমার পর্দার উল্টোদিকের যন্ত্রপাতির দিকগুলো সারাদিন নাড়েনঘাঁটেন তাঁরাও স্ত্রী-র লেখার কথাই প্রথম বলেছেন। রাজ নিদিমোরু আর কৃষ্ণা ডি কে-র চিত্রনাট্য, জাস্ট মচৎকার। গল্প বলা, গতি, সংলাপ সব। শুনলে হাসি তো পায়ই, সঙ্গে সঙ্গে লেখকদের সংযম মন ভালো করে দেয়। কারণ রসিকতা করে আন্ডারলাইন টানার অভ্যেস আমাকে যেমন পীড়া দেয় তেমন আর কিছুই দেয় না। আর যখন সিনেমার চরিত্ররা সিনেমার পরিচালক বা অন্যান্য হর্তাকর্তাদের মুখের কথা, তাঁদেরই ভাষায় আবৃত্তি করতে থাকেন।

স্ত্রী-তেও প্রচুর বক্তব্য আছে। সেগুলো শুনলে আপনার সিনেমাটার স্ট্যান্ড বূঝতেও অসুবিধে হবে না। নয়ী ভারত কি চুঢ়ৈল। ইয়েস মানে ইয়েস। কে ছোটবেলায় মগরমচ্ছের সঙ্গে খেলা করে বড় হয়েছে। কুছ ভি বনো জ্যায়াদা ভক্ত মত বনো গোত্রের ওয়ান লাইনারে ঠাসা দু’ঘণ্টার স্ত্রী। কিন্তু কোথাও ওয়ানটাকে টেনে দেড়লাইন করার করার চেষ্টা হয়নি। ‘পাছে আমার মারাত্মক উইট দর্শক মিস করে যায়’ ভয়ে স্ত্রী-র লেখকরা সদাকম্পমান নন। আর এত নিচু তারে এই সব বক্তব্য মুখের কথার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই লোকটা ওই কথাটা বলতে পারে কি না এ সন্দেহ জাগে না।

আমার মতো নন-ফোটোজেনিক দর্শকদের নন-ফোটোজেনিক অভিনেতাদের প্রতি দুর্বলতা থাকেই। আপনার কথা জানি না, আমীর খানের থেকে পঙ্কজ ত্রিপাঠী বা নওয়াজউদ্দিন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলে আমার বুক বেশি ধড়ফড় করবে, কাজেই আমি নন-ফোটোজেনিক বলতে অনাকর্ষণীয় বোঝাচ্ছি না। এই ইন্টারভিউতে ত্রিপাঠী যাকে বলছেন ‘সামান্য চেহরা’, সেই চেহারার কথা বলছি। এর পেছনে নিজের চেহারা যৎসামান্য হওয়ার ফ্যাক্টর তো আছেই। দ্বিতীয়ত, এটা বিশ্বাস করতে সুবিধে হয় যে এঁরা অভিনয়ের জোরেই অভিনয় করতে এসেছেন। ফর্সা রং কিংবা আরও চারটে আবোলতাবোল অ্যাডভানটেজ খাটিয়ে লাইন ভেঙে ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকেননি। স্ত্রী গিজগিজ করছে সামান্য চেহারার অভিনয়কুশল শিল্পীদের ভিড়ে। ওঁরাই স্ত্রী-র হিরো। ওঁরাই হিরোসুলভ এন্ট্রি পান, ওঁদের জন্য বেস্ট সংলাপ তোলা থাকে। অন্ধকার রাতে লম্বা পিচরাস্তায় যখন বাইক এসে ঘ্যাঁচ করে থামে আর বোরখার (স্ত্রী-কে বোকা বানানোর জন্য বোরখা পরে ঘুরছেন) পর্দা তুলে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর খোঁচাখোঁচা দাড়িসম্বলিত মুখ উদ্ভাসিত হয়, (জঙ্গল ঘেরা ল্যাম্পপোস্টহীন রাস্তায় যতখানি উদ্ভাসিত হওয়া সম্ভব,) আর হল হাততালিতে ভেসে যায়, আপনা থেকেই সিনেমার প্রতি পক্ষপাত জন্মায়। রাজকুমার রাও তাঁর সামান্য চেহারা নিয়েও কী করে হিরো হয়ে উঠেছেন, স্ত্রী দেখলে সে রহস্যটা আরও ফিকে হয়। ভিকির বাবার ভূমিকায় সাড়ে পাঁচ ফুটের কম অতুল শ্রীবাস্তবকে আমার অনেকদিন মনে থাকবে। বিট্টুর ভূমিকায় অপারশক্তি খুরানা তো ভালোই, অভিষেক ব্যানার্জির জনাও অবিস্মরণীয়। সিনেমাতে রাজকুমার রাওয়ের পাশে আরেকজন স্টার ছিলেন শ্রদ্ধা কাপুর। সত্যি বলতে তাঁর তেমন কিছু করার ছিল না। যেটুকু ছিল সেটুকুর দায়িত্ব তিনি যথাযথ পালন করেছেন। 

খারাপ লাগার করার মতো কি কিছুই ছিল না সিনেমাটাতে? অফ কোর্স ছিল। কিন্তু  ভালোলাগার তুলনায় খারাপলাগাগুলো এতই অকিঞ্চিৎকর যে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়েছি। এই রকম সিনেমায় সার্থকভাবে নাচগান ঢোকানো প্রায় অসম্ভব, স্ত্রী-র কর্তৃপক্ষ সে চেষ্টা না করলেই পারতেন। গানগুলো ভুলে যাওয়ার মতো, ভুলেও গিয়েছি, কিন্তু স্ত্রী-র বাকিটুকু মনে জ্বলজ্বল করছে। 


Comments

  1. tomar dewa poster ta besh ga chomchome.hawa te bhasche body,aar chayar lomba lomba haat,nokh..ore baba..enzoy enzoy,parar hall e cinema dekhar mojai alada..

    promise karo chatbe na....জনর...uruscharon ta jnor..chandrobindu,rnestorar moto..

    prosenjit

    ReplyDelete
  2. রাজকুমার রাও আর পঙ্কজ ত্রিপাঠী আছে বলে সিনেমা টা এমনিই দেখতাম, আপনার লেখা পড়ে আর একটু নিশ্চিত বোধ করছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, এই সিনেমাটা দেখলে মনে হয় পস্তাবেন না।

      Delete
  3. আজ রাতের শো-তে সপরিবারে যাইতে আসি! আর বিলম্ব নয়।

    ReplyDelete
  4. Ei weekend ei dekhlam. Khubi bhalolegechhe.

    Apni "Searching" dekhechhen? Apnader khub bhalolagbe. Dekhe asun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক, আমি এতক্ষণ একাই ভালো ভালো বলে চেঁচাচ্ছিলাম আর এদিকে ভেতরে ভেতরে কনফিডেন্সে টান পড়ে যাচ্ছিল। বাকিদের হয়তো খারাপ লেগেছে বা লাগবে। আপনি ভরসা দিলেন, সায়ন, থ্যাংক ইউ।

      সার্চিং তো দেখিনি। দেখব সুযোগ পেলেই।

      Delete
  5. Amar khub bhalo legeche Stree. High five.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাই ফাইভ, কুহেলি।

      Delete
  6. রাজ নিধিমুরু আর কৃষ্ণ ডি কে অসাধারণ লেখেন। ওঁঁদের প্রথম সিনেমা নাইন্টি নাইন (99), দেখতে পারেন। ক্রিকেট বেটিং, সদ্য উদার অর্থনীতির হাওয়া এসে পড়া ভারতকে অদ্ভুত সুন্দর ভাবে ধরেছেন ওঁঁরা। সেকেন্ড ছবি শোর ইন দ্য সিটি -ও ভাল

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি শোর ইন দ্য সিটি দেখেছি, ঋতম, নাইনটি নাইন দেখিনি। দেখব হাতের কাছে পেলে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  7. dekhbo ki dekhbo na bhabchhilum. Raj-DK (ora nijeder erokom i bolen) shor in the city ar 99 dutoi bhalo legechhilo, Go Goa Gone poshayni. etay Shradhha achhe bole shradhha hochhilo na dekhar jonyoi. tobe rajkumar-pankajtripathi juti toh tukhor. opekkhay thaki kobe ashbe Prime ba Netflix ey.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমার তো খুবই ভালো লেগেছে, প্রিয়াঙ্কা।

      Delete
  8. Trailer ta dekhechilam .. Bhhoootni k naachte dekhe ektu kemon jeno legechchhilo .. tor review pore .. Netflix/Prime e asar appekhhay thaaklam ..

    And belated Happy birthday Abantor !!

    ReplyDelete
  9. Completely agree with your assessment that Stree is a genre defining film.
    Horror is full blooded horror. There is nothing comic about the horror-chills.
    Comedy is full blooded comedy. One of the best comedies I can think of. As you said, the actors and their dialogues are the asset.
    The social message is very subtle but cannot be missed. I hope it can indeed change people's behavior.

    One question though. Why did you not like the Kamariya dance by Norah Fatehi? She danced like a charm. Didn't she?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সম্বরণ।

      মুশকিল হল আইটেম সং-এ গান এবং নাচ দুটোর যথাযোগ্য সঙ্গত না হলে জমে না। আপনি আইটেম সং-এর হল অফ ফেম-এর আইটেমদের উদাহরণ নিন। তু চিজ বড়ি হ্যায়, ছইয়া ছইয়া, দিলবর দিলবর - সবার নাচ যেমন রোমহর্ষক, গানও ততোধিক। নোরার দুর্ভাগ্য যে ওঁর এমন নাজুক নৃত্যের নেপথ্যের গানটি খেলোস্য খেলো। যতক্ষণ পর্দায় হচ্ছিল, হচ্ছিল। এখন আধলাইনেরও সুর মনে করতে পারছি না।

      স্ত্রী-র মেসেজ হৃদয়ঙ্গম করে মানুষের আচরণ বদলানোর আপনার আশাতেও আশা রাখতে পারলাম না। ও ব্যাপারে মানুষের প্রতিরোধ কুকুরের ল্যাজের থেকেও সাংঘাতিক।

      Delete
    2. Hmm.. বুঝলাম |
      I want to share some more random feelings about Stree
      1. Watching it in an almost houseful theater was very enjoyable. The whole hall was screaming in terror, laughing out together, exhaling in combined relief. I recommended my NRI friends to watch the movie together with at least 5-6 families. The fun will be amplified.

      2. Looked up Chanderi in internet. Chedi-raaj Shishupaal (of Mahabharat) ruled over present day Chanderi. That is the mythology. Chanderi is definitely up for a trip now.

      3. There were carefully crafted plot holes, which were left deliberately. Who was 'Shama' referred to repeatedly by Rudra (Pankaj Tripathi's character)? Shama calls him on his mobile but we never get to see Shama. How does Rudra know so much about Stree (most of it correct)? A sequel is in the works. Hopefully that lives up to the first one.

      4. Me and my wife, being brave-hearts, spent about 50% of the time looking at each other rather than the screen. Most people in the hall were doing the same. So we went for a second show. Now that we knew the scare-points, we could spend more time looking at screen.

      Delete
    3. আপনার সবক'টি পয়েন্টের সঙ্গেই একমত (৪ নম্বরটা ছাড়া, আমি স্রেফ চোখ বন্ধ করে ছিলাম কিছু সময় কাজেই অর্চিষ্মান কী করছিল দেখিনি)। চান্দেরির শাড়ি খুব বিখ্যাত কিন্তু।

      Delete
  10. ‘পাছে আমার মারাত্মক উইট দর্শক মিস করে যায়’- ottyuttom...

    ReplyDelete
    Replies
    1. দর্শক/পাঠক/শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেওয়ার লোভ সংবরণ করা অবশ্য দারুণ শক্ত।

      Delete

Post a Comment