অমৃতসর ১ঃ শুরু



দশ বছর ধরে ব্লগ লিখতে লিখতে এমন হয়েছে, অন্যরকম কোনও একটা ঘটনা ঘটলে, খুব বেশি অন্যরকম হওয়ারও দরকার নেই, কোনও অটো ভাইসাব মিটারে যেতে রাজি হয়ে গেলে, বস পিঠ চাপড়ে হেসে উঠলে বা যাতায়াতের পথের সিগন্যালগুলো সব সবুজ থাকলেই, ব্লগে তাই নিয়ে পোস্ট লিখে ফেলতে হাত নিশপিশ করে।  

আর ঘটনাটা বেড়াতে যাওয়া হলে তো কথাই নেই। টিকিট কাটা হয়ে গেলেই স্ক্রিভনারে ফাইল খুলে রেডি। যখন যা ঘটবে, কাব্যিক লাইন আসবে মাথায়, ভালো ভালো ভাব জাগবে লিখে ফেলব।

অমৃতসর নামের ফাইলটা ডকুমেন্টে বসে ছিল প্রায় মাসতিনেক। এটা আমার পক্ষেও বাড়াবাড়ি। ফাইল খুলেছিলাম যাওয়ার ঘনাঘনই, কোথায় যাব, কোথায় খাব, কোন ছবিটা কোন অ্যাংগল থেকে তুলব সব স্থির এমন সময় দুর্ঘটনার ঘনঘটায় টিকিট ক্যানসেল করতে হল। কনফার্ম টিকিট। ভাবুন। সে মনঃকষ্ট, কী বলব। টিকিট ক্যানসেল করলাম, হোটেল বুকিং গচ্চা গেল, কিন্তু স্ক্রিভনার ফাইলটা ডিলিট করলাম না। রেখে দিলাম। যাতে আগুনটা বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকে। যাতে যতবার চোখ পড়ে বুক মুচড়ে ওঠে। যাতে জল মাথার নিচে নামলেই দৌড় দেওয়া যায়। 

দিল্লি থেকে অমৃতসর ভ্রমণের সুবিধে হল, লংটং লাগে না, নর্মাল উইকএন্ডেই সেরে দেওয়া যায়। এক বৃহস্পতিবার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে কথা হল, আরেকবার ট্রাই নেওয়া যাক? কাল শুক্রবারটা একটু বাড়াবাড়ি হবে, নেক্সট শুক্রবার যাই চল। অফিস থেকে সাড়ে পাঁচটার বদলে তিনটেয় বেরোব। অমৃতসর শতাব্দীর চেয়ারকার চড়ব বিকেল সাড়ে চারটেয়, রাত দশটায় নামব অমৃতসর। স্বর্ণশতাব্দী ছাড়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে, কাজেই আজমেরী গেটের বদলে ওলায় ডেসটিনেশন দেব পাহাড়গঞ্জ গেট। 

গেটের পাঁচশো মিটার দূরে পৌঁছে ভাইসাব জানতে চাইলেন, লাগেজ জ্যাদা হ্যায় ম্যাডাম? এবং একই সঙ্গে আমার দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করলেন। মিথ্যে কথা বলার সুযোগ নেই। স্রেফ ব্যাকপ্যাক নিয়ে বসে আছি। ভাইসাব বললেন, এখানকার লাইটে নাকি পন্ধরা মিনিট হেসেখেলে দাঁড়াতে হয়, কাজেই… ওঁর মনের ইচ্ছে বুঝে নেমে পড়লাম। অন্য সময় হলেও হয়তো নামতাম, কিন্তু মনের মধ্যে ক্ষোভ গরগর করত। বোকা পেয়ে ঠকিয়ে দিল। কেন সবাই আমাকেই ঠকায় ঠাকুর? এখন বেড়াতে যাচ্ছি তাই ফুর্তিতে মন টইটম্বুর। ক্ষোভ জায়গা পাচ্ছে না।

সিকিউরিটি চেকের কনভেয়ার বেল্টে ব্যাগ চাপিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দাঁড়ালাম। হ্যালো হ্যালো, আমি ঢুকে গেছি। তুমি কোথায়? দশ মিনিট এখনও? পনেরোও হতে পারে? না না, মাইন্ড করার কিছু নেই, একটা ভয়ানক মজার কুকুর বসে আছে সামনে, তার দিকে তাকিয়ে দশ মিনিট কেটে যাবে। বাকি পাঁচ মিনিট লোক দেখে।

অমৃতসরে যাওয়ার সুবিধে হল, সকলেই আগে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের যা পুরী, দিল্লির তাই হল অমৃতসর। বাড়িওয়ালি গেছেন, সহকর্মীরা গেছেন। নিজেরা গেছেন, বাবামাকে নিয়ে গেছেন। অনেক সহকর্মী আবার ওখান থেকেই এসেছেন। কাজেই টিপস অ্যান্ড ট্রিকসের অভাব হয় না। হোয়াট টু ডু, হোয়াট টু ইট তো ইন্টারনেটেই পাওয়া যায় কিন্তু থাকার ব্যাপারটায় ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা থাকলে সুবিধে। বিশেষ করে পাঞ্জাব টুরিজমের কিছু যখন পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমবার যখন যাওয়ার কথা উঠেছিল, একজন আমাদের গোল্ডেন টেম্পলের গেস্টহাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে মারাত্মক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সাইটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন-টেশন করে একাকার। নিরুৎসাহ তো করা যায় না, কিন্তু আমরা খুব একটা উৎসাহও বোধ করছিলাম না। গেস্টহাউসে যাঁরা থাকবেন ধরে নেওয়া যায় তাঁরা ভক্তমানুষ; আমরা অজান্তে কিছু বেচাল করে ফেললেই হয়েছে। গেস্টহাউসে জায়গা পাওয়া গেল না যখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ভদ্রলোক বললেন, ওঁরা যখন যান অত বুকিংটুকিং-এর ধার ধারেন না, গুরুদ্বারার চাতালে শুয়েই রাত কাটিয়ে দেন। (গুরুদ্বারায় পরিচ্ছন্নতা এবং সুব্যবস্থার যে রকম নমুনা দেখলাম, হেসেখেলে করা যায়) আমরা অত অ্যাডভেঞ্চারাস না হয়ে অন্যান্য খোঁজখবর নিতে লাগলাম। ওয়ো রুমের কথা অনেকেই বলছিল। শেষটা শ বলল ‘ওয়ো ৮৫১০ ওয়েলকাম ইন’-এ যাও, প্রিমিয়াম রুম, রেলস্টেশনের পাঁচশো মিটারের মধ্যে, আমরা দু’হাজার সতেরোতে গিয়ে চমৎকার সাফসুতরো পেয়েছি।

দু’হাজার আঠেরোতেও ওয়ো ৮৫১০ ওয়েলকাম ইন ঝকমকে সাফসুতরো আছে। আপনারা গেলে চোখ বুজে থাকতে পারেন। 

দশ মিনিট দূরস্থান, দু’মিনিট যেতে না যেতেই কুকুরটা কুণ্ডলী ভেঙে উঠে হাই তুলে একবার ডাউনওয়ার্ড ডগ হয়ে হেলেদুলে হাঁটা দিল। ভাবছি এবার কী দেখা যায়, অমনি স্টেশনে চাঞ্চল্য, গাড়ি ঢুকছে।

প্যানিক কাকে বলে। অর্চিষ্মানের দেখা নেই। এদিকে গাড়ি ঢুকে যাবে অথচ আমি তাতে না চড়ে দাঁড়িয়ে থাকব, যারপরনাই শারীরিক এবং মানসিক অস্বস্তির ব্যাপার। ভাবছি উঠেই পড়ি, ফোন করে দেব, দেখি গাড়ি থামার নাম না করে স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওটা চণ্ডীগড় শতাব্দী। আমাদেরটা অমৃতসর। এর পর ঢুকবে। 

অমৃতসর শতাব্দী ঢোকার আগে অর্চিষ্মান ঢুকে গেল। ট্রেনও এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ওদিকের ভিড় এদিকে এল, এদিকের ভিড় ওদিকে, পেছনের ভিড় এগোল, সামনের ভিড় আরও এগোল। ধাক্কা না দিয়ে, না খেয়ে এঁকেবেঁকে যেতে যেতে কানে এল নার্ভাস গলায় নালিশের সুর।  

ডাব্বাডুব্বা পতা ভি হ্যায়?

ভিড়ের মধ্যে কে বলছে কে জানে। চিনি না, জানি না। যে-ই বলে থাকুক তার সঙ্গে প্রিয় সিনেমা, প্রিয় বই, প্রিয় হিরো, প্রিয় খাবার না মেলার প্রব্যাবিলিটি হাই। কিন্তু আমরাও এই রকম টেনশনের সিচুয়েশনে বলি, এই জন্য বলি নম্বরটম্বরগুলো মুখস্থ করে রাখলে সুবিধে। ওরাও তেমনি বলে ডাব্বাডুব্বা পতা করে রাখনি? গুচ্ছ অমিলের মধ্যে এই যে নম্বরটম্বর আর ডাব্বাডুব্বা-র মিল, কেমন একটা আত্মীয়তার সেতু গড়ে দিল। 

সিটের কাছে পৌঁছে দেখি দুজন বসার উপক্রম করছেন। ওঁদেরও নাকি আটচল্লিশ ঊনপঞ্চাশ। বগিও নাকি এক, যাত্রার ডেটও গোলায়নি।  ট্রেনে আমার কনফিডেন্স ডবল হয়ে যায়, নিজের টিকিটখানা হাতছাড়া না করে বললাম, কই দেখি আপনাদের টিকিট। যা ভেবেছি তাই। আটকে আটচল্লিশ পড়েছে।

অবশেষে সব ঝামেলা মিটল। ব্যাকপ্যাক তাকে তুলে আরাম করে বসলাম। মাকে ফোন করে বললাম, গাড়ি ছাড়বে ছাড়বে। মা বললেন, অমৃতসরে ভয়ানক ঠাণ্ডা, মাফলারখানা…হ্যাঁ হ্যাঁ বলে ফোন রাখামাত্র ট্রেন ছেড়ে দিল। অর্চিষ্মান আর আমি প্রায় একইসঙ্গে বললাম, এবার খাবার দিলে পারে, বল?

(চলবে)



Comments

  1. Eta just barabari.. koyek ghonta agei bhebechi kuntala di onekdin por ekdiner puri gechilo.. mone hocche kachakachi abar kothao jabe..

    ReplyDelete
    Replies
    1. Telepathy word tai likhte bhule gechi.. :D

      Delete
    2. আছে আছে! ঊর্মির টেলিপ্যাথির জোর আছে!

      Delete
    3. Haha...Khub bhalo laglo..

      Delete
  2. Dabbadubba r Nombortomborer aatiyota .... aha ebhabe jodi shobai bhabte pare ... Bhalo thakben ...

    ReplyDelete

Post a Comment