গোশৈণী থেকে সোঝা/ ২




সকালবেলা আকাশ পরিষ্কার দেখে সময় নষ্ট করলাম না। চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 

কোথাও যে বাঁধাধরা যাওয়ার আছে তেমন নয়। এই আশেপাশে বিচরণ। নদী পেরিয়ে বড় রাস্তায় যাব না, জঙ্গলের দিকেই হাঁটব। ডাইনিং হলের ওপাশে একটা কাঁচা পথ ওপরের দিকে গেছে, অন্যটা নিচে নদীর দিকে। ওপরের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম।


রাস্তা মানে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ। বৃষ্টিতে ভিজে প্যাচপেচে, দু’পাশে ঝাঁপিয়ে আসা ডালপালায় খোঁচা লাগার সম্ভাবনা ব্যতিরেকে নির্বিঘ্ন। কদাচিৎ কয়েকটা আপেলের গাছে ফুল ঝেঁপে এসেছে, মৌমাছিরা বোঁ বোঁ ঘুরছে। ফুলের মধুর কি না জানি না, হাওয়ায় মিষ্টি গন্ধ ছড়ানো। কাল রাতে জানালার একটা ছোট পাল্লা অল্প খুলে শুয়েছিলাম, নেটের ভেতর দিয়ে এই গন্ধটাই ঢুকছিল ঘরে সম্ভবতঃ। রাস্তা উঠে নেমে চলল। মাঝে মাঝে বাঁক নিয়েই চোখের সামনে এই রকম সব দৃশ্য বেরিয়ে পড়ছিল। 


প্রকৃতির শোভা অবলোকন করে, ছবি তুলে, ধীরেসুস্থে আধঘণ্টা চলার পর জঙ্গল পাতলা হল। চোখের সামনে ভেসে উঠল গোশৈণী বরিষ্ঠ উচ্চ বিদ্যালয়-এর নীল বোর্ডওয়ালা গেট। সুন্দর স্কুলে পড়েছি বলে আমার গোপন জাঁক আছে। রানীরং মাধবীলতা জড়ানো আমাদের হলুদ স্কুলবাড়ির সামনে ছিল সবুজ মাঠ, মাঠ ঘিরে রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়া। গোশৈণী বরিষ্ঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যের কাছে হাঁটু গেড়ে টুপি খুলে রাখতে কোনও দ্বিধাই হল না। পাহাড়ের কোলে স্কুল, স্কুলের কোলে নদী, নদীর কোলে আবার একখানা কাঠের দুলন্ত সাঁকো! ছেলেমেয়েরা ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড়ে সে সাঁকো পার হয়, আমার আর অর্চিষ্মানের প্রাণ বেরোনোর জোগাড় হল।

সাঁকো পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়লাম। মুদির দোকান, পাকা বাড়ি, একখানা চৌমাথা কাম বাসস্ট্যান্ড। গোশৈণী শহর। একখানা ক্যাফেও আছে, মুনলাইট। ভাইসাব বারান্দা ঝাঁট দিয়ে তকতকে করছিলেন, দু’কাপ চায়ের অনুরোধ জানিয়ে ভিউওয়ালা টেবিলটায় বসলাম।।

ভিউ বলতে দুয়েকটা গরু ব্রেকফাস্ট করছে পথের পাশের কচি ঘাসে। কিছু ছেলেপুলে একে অপরের কাঁধে হাত রেখে স্কুলের দিকে যাচ্ছে। চা খেতে খেতে ভাইসাবের সঙ্গে আলাপ করলাম। আপনারা কোথা থেকে জিজ্ঞাসা করলে আমরা বলি কাজ করি দিল্লিতে, কিন্তু আসলে পশ্চিমবঙ্গের লোক। ভাইসাবের জন্মকর্ম গোশৈণীতেই। ওই মুনলাইট ক্যাফের লাগোয়া বাড়িটাই ওঁর বাড়ি। উনি আমাদের কুল্লুর সংস্কৃতির খোঁজখবর দিচ্ছিলেন। ওঁর ফোনে ট্র্যাডিশনাল নাচগান দেখলাম, শালের দাম জানলাম। পরশুর পোস্টে সে সব কথা লিখেছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গল্প সংক্ষেপ করতে হল, কটেজে ব্রেকফাস্টের সময় শেষ হয়ে যাবে দশটায়। বড় রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফেরা যেত তারপর ফোন করে কটেজের লোকদের বলা যেত, রিভার ক্যারেজ দিয়ে আমাদের পার করে দিন। কিন্তু ওঁরা যদি রেগে যান? বলেন ইয়ার্কি হচ্ছে? আমাদের কাজ নেই, আপনাদের খেলা দেওয়া ছাড়া? তাই জঙ্গলের রাস্তা ধরেই ফেরা সাব্যস্ত হল।

কটেজের কাছাকাছি আসতে দেখি কালকের কুকুরদুটো, এখন আর কালকের মতো ঝিমন্ত না, কান খাড়া, গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে ঘ্যাঁক করে অসন্তোষ প্রকাশ করল, কেন ওদের না জানিয়েই বেড়াতে বেরিয়েছি। বললাম, ভারি ভুল হয়ে গেছে। দাঁড়াও, খেয়ে আসি, আবার বেরোব না হয়।

গোশৈণীর রাজু ভাইয়ার কটেজের ডাইনিং রুম একটি ইন্টারেস্টিং জায়গা। বেশিরভাগই দিল্লি চণ্ডীগড় থেকে দীর্ঘ উইকএন্ডে বেড়াতে আসা লোক, মাঝে মাঝে আরও দক্ষিণ থেকেও ভ্রমণার্থীরা আসেন। তবে কোথা থেকে আসেন তার থেকে ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং হচ্ছে ভ্রমণার্থীদের কমপোজিশন। কর্পোরেটকর্মী থেকে শিল্পী থেকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পাশ করা স্পিরিচুয়াল হিলার, আপাতত চণ্ডীগড়ে চেম্বার খুলে দেশের লোকদের দিশা দেখাচ্ছেন। আর কেউ কেউ থাকেন যারা দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত আসেন। রাজুর কটেজে তাদের জানাচেনা আছে। ফ্যামিলি নিয়ে মাঝেমাঝেই শহর থেকে পালাতে আসেন।

সত্যি বলতে ওখানে আমরাই একটু প্রোলেতারিয়েত গোছের। সেই নিয়ে সামান্য গর্ব অনুভব করছিলাম, তারপর মনে পড়ল এক রাতের রাজু ভারতীর কটেজের ভাড়া, গীতাদিকে আমরা এক মাসের যা মাইনে দিই তার সমান। এক চড়ে বুর্জোয়া বাস্তবে ফিরে এলাম, যেখানে আমাদের সত্যিকারের বাস। 

আপনি যদি মুখ বন্ধ রেখে খেয়ে যান কিংবা নিজেদের নিয়ে মত্ত না থাকেন, তাহলে নানারকম ইন্টারেস্টিং আলোচনা কানে আসবে। অবশ্যই আড়িপাতায় রুচি থাকলে তবেই। আমরা দু’বেলা খেতে খেতে জি এস টি নিয়ে ঝগড়া শুনলাম, 'রাজুর কটেজ আগে কত নিরিবিলি ছিল এখন তো সকলেই আসছে' অভিযোগ শুনলাম, স্পিরিচুয়াল হিলারের কার্ড বিলি করা মার্কেটিং দেখলাম, কিন্তু এই সব শুনতে শুনতে একমুহূর্তের অসতর্কতায় যেই না, উপমাটা বেশ ভালো করেছে বল? বলে ফেলেছি অমনি পেছনের টেবিল থেকে মন্তব্য এল, আর ইউ ফ্রম সি আর পার্ক?

স্বীকার করলাম। ভদ্রমহিলার বোন গ্রেটার কৈলাসে থাকেন। ওঁরা গোশৈণীতেই পাঁচদিন থাকবেন, আর কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না। আমাদের প্ল্যান জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম। আমাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াতের বর্ণনা শুনে ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক দুজনেই মারাত্মক ইম্প্রেসড।

হাউ অ্যাডভেঞ্চারাস!

আমি আরেকটা জরুরি কারণ পয়েন্ট আউট চেষ্টা করলাম।

অ্যান্ড চিপ।

কিন্তু সেটা বিশেষ দাগ কাটল না। গোটা ব্যাপারটার অর্থকরিতার থেকে অ্যাডভেঞ্চারটাই ওঁদের মনে ধরেছে বেশি। হাউ নাইস, ট্র্যাভেলিং লাইক কিডজ। তাড়াতাড়ি ফোন বার করে রুটটুট লিখে নিলেন। ওঁদের সন্তানরা নাকি অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে হন্যে হয়ে আছে। বলে হিমালয়াস দেখতে হলে ব্যাকপ্যাকিং ওনলি ওয়ে। এস ইউ ভি নিয়ে যেতে হয় তোমরা যাও।

অর্চিষ্মান বলছে, ট্র্যাভেলিং লাইক পুওর পিপল বলতে গিয়ে বদলে কিডস বলেছে নির্ঘাত দেখ গিয়ে। আমি অত সিনিক হতে রাজি নই। আমার কি না যৌবন একেবারেই গেছে তাই কেউ তারুণ্যের প্রশংসা করলে (মিথ্যে করেও) লাফিয়ে সে প্রশংসার দখল নিই।  

ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা ভারি ভদ্র। আমাদের সোঝা যাওয়ার প্ল্যান শুনে নিচু গলায় আলোচনা সেরে প্রস্তাব দিলেন, ওঁদের গাড়ি করে আমাদের সোঝা ছেড়ে দিয়ে আসার। আমাদেরও পৌঁছনো হবে, ওঁদেরও একটা নতুন জায়গা দেখা হবে। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। ওঁরা হয়তো ভাবলেন আমরা বাসের অ্যাডভেঞ্চার বাদ দিতে চাই না বলে গেলাম না, আসল কথাটা হচ্ছে গোটা রাস্তা স্মল টক করতে চাই না।

খাওয়া শেষ করে হাঁটতে বেরোলাম। কালো আর কালোর বন্ধু হাইলাইটওয়ালা বন্ধুর গাইডেন্সে। নিয়মটা হচ্ছে ওরা আগে আগে যাবে। মাঝে মাঝে থেমে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখবে, তারপর আমরা ফলো করব। আমরা যদি থেমে বোকা বোকা কাজ করে সময় নষ্ট করি, যেমন কিনা ছবি তোলা, ফুল দেখা, তখন ওরা পেছন ফিরে দেখবে, এদিকওদিক শুঁকবে, তাড়া দেবে তারপর তাতে কাজ না দিলে, ঠিক আছে, আমারও তো কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই বলে বলে ফিরে আসবে। রাস্তায় যদি কোনও সরু অংশ থাকে, বা সিঁড়ি, যেখান দিয়ে একজনই যাওয়া যায়, ঠিক ‘দেখি দেখি সাইড দিন দিদি,’ আগে যাই,’ বলে ঠেলাঠেলি করে ওভারটেক করবে।

সকালে ওপরের রাস্তা নিয়েছিলাম। পাহাড়ের দিকে গিয়েছিলাম। এখন নিচের রাস্তা নিয়ে নদীর ধারে পৌঁছলাম। একটা ভীষণ সরু সিঁড়ির দুপাশে মধুগন্ধওয়ালা ফুলেরা ছেয়ে এসেছে। বড় বড় পাথরে পা ফেলে ফেলে জলের যত কাছে যাওয়া যায় গেলাম, তারপর নিচু হয়ে জল ছোঁয়া। আপনার কথা জানি না, এই পরিস্থিতিতে আশেপাশে উপযুক্ত কেউ থাকলে তার গায়ে জল না ছুঁড়ে আমি থাকতে পারি না। সে সব সেরে দুজনে দুটো পাশাপাশি পাথরে বসলাম। গাইডও এসে গায়ে ঘেঁষে এলিয়ে বসল। 


আমরা বসে রইলাম। নদী বয়ে চলল। ওপারের উঁচু রাস্তা দিয়ে দুয়েকজন পথচারী পাঁচ সাত মিনিট বাদে বাদে যেতে লাগলেন, তাঁদের লক্ষ করে আমাদের গাইড চেঁচাতে লাগল। মিনিট দশেক পর আরেক নবদম্পতি, এঁদের কাল ডিনারে দেখেছি, নদী এক্সপ্লোর করতে উপস্থিত হলেন। ছবিটবি তুলতে লাগলেন। মিনিট দশ পর আমরা উঠে চলে আসার সময় বিনীত অনুরোধ করলেন যদি তাঁদের একটা যুগল ছবি তুলে দিই। তুলে দিলাম। অন্য ছবিগুলো ওঁরা যথেষ্ট ঘনিষ্ঠভাবেই তুলছিলেন। আমাদের দেখে সংকুচিত হয়েই বোধহয় একে অপরের কোমরে আলতো হাত রেখে পাঁচ ইঞ্চি ফাঁক রেখে দাঁড়ালেন। ছবি তুলে ফিরে আসছি অর্চিষ্মান বলল, কী গো, গেল কোথায়? পেছন ফিরে দেখি, গাইড হাওয়া। বললাম, ওদের সঙ্গে ছবি তুলছে দেখ গে। বলতে গিয়ে আমার চোখেমুখে “কসমে ওয়াদে পেয়ার ওয়াফা সব বাতেঁ হ্যায় বাতোঁ কা কেয়া” ছাপ ফুটল, অর্চিষ্মানও দেখি ভুরু কুঁচকেছে। নিজেদের পজেসিভনেসে নিজেরাই চমৎকৃত। এক সকালেই এই, পুষলে কী হবে বুঝতে পেরেছ? যেটা হবে সেটা ভালো না খারাপ চিহ্নিত করার চেষ্টায় মুখ বুজে চললাম। যেই না সরু সিঁড়িটা বেয়ে উঠতে যাব, ঠ্যাঙে গুঁতো। গাইড আবার ওভারটেক করছেন। যা আনন্দ হল, কী বলব।

*****

বানজারের বাস আসার কথা ছিল বারোটায়, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে এসে পৌঁছল সাড়ে বারোটায়। আমরা সিট পাওয়ার আশায় নদী পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে গোশৈণীর চৌমাথায় এসে পৌঁছেছি। দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। আশেপাশে আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি যথারীতি সংযম না রাখতে পেরে অলরেডি বারদুয়েক জিজ্ঞাসা করে ফেলেছি, দাদা, বাস এখানেই আসবে তো, ফাঁকি দিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে পালাবে না তো? ক্রমে ভিড় জমে উঠল। এঁরা সকলেই লোকাল, ডেলি প্যাসেঞ্জার। এঁরা নিশ্চয় সকলেই ভুল জায়গায় এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করেছেন না ভেবে স্বস্তিতে থাকার চেষ্টা করলাম। একটা একটা করে ট্রেকার টাইপের গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে যেতে লাগল, আর ভিড় থেকে একেকজন 'হেই হুই' হাঁকডাক করে ট্রেলারের পেছনে দৌড়ে, হাতের ব্যাগ ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে, নিজে হেঁইও বলে ট্রেলারে উঠে বাঁকের ওপারে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলেন। অর্চিষ্মানকে সবে বলতে যাব যে নেক্সট ট্রেলারটা এলে এই পদ্ধতির অ্যাটেম্পট নেওয়া যেতে পারে, বাস এসে গেল।

সবাই আমাদের আগে উঠে পড়লেন। বাপরে কী ভিড়। ওই ভিড়ের মধ্যে একটি বৃহদাকার ভেড়া বাসের মেঝেতে এলিয়ে শুয়ে রয়েছে। গাড়ি চলল। স্বাভাবিকভাবেই, গোশৈণী থেকে বানজার রুটে সকলেই ওঠে, কেউই নামে না। পেছনের দরজা দিয়ে যারা উঠছেন তারা এগিয়ে যাওয়ার তাড়না দিচ্ছেন আর ঠিক উল্টো চাপ আসছে সামনের দরজা দিয়ে ওঠা যাত্রীদের থেকে। এর ওপর যোগ করুন উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ি, ক্রেন, খাদের ধারে বিপজ্জনক রকম সাইড দেওয়া, পাথরে চাকা উঠে গিয়ে বিপজ্জনক দুলুনি। অ্যাডভেঞ্চারের হদ্দমুদ্দ, সন্দেহ নেই। 

ভিড় আর দুলুনির ঠেলায় একবার প্রায় ষাট ডিগ্রি কাত হয়ে আবার কোনওমতে খাড়া হতেই হাতে টোকা পড়ল। পেছনের সিটে বসে থাকা মহিলা তাঁর সিট ভাগাভাগি করে বসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। বললাম, আমার না বসলেও চলবে, আপনি বরং আমার ব্যাগটা ধরুন। 

বানজার এসে গেল। ভেড়া নামল। পিছু পিছু আমরাও নামলাম। এবার সোঝার বাস খোঁজার পালা। 

গোশৈণী থেকে সোঝা, সোজা রাস্তা।  গাড়ি থাকলে তো ল্যাঠা চুকে গেল। না থাকলে বাস ধরে বানজার চলে যান, বানজার থেকে সোঝার বাস নিয়ে নিন। আসলে বাসগুলো যায় নারকাণ্ডা সিমলা রুটে, মাঝপথে আপনাকে সোঝায় নামিয়ে দিয়ে যাবে। রুটটা খুব ইন্টারেস্টিং। অর্চিষ্মানের টু ডু লিস্টে আছে। ও নাকি বানজার থেকে বাসে চড়ে সিমলা যাবে সামনের বছর। আমাকে বলল, যাবে? আমি বললাম, নাঃ, তুমি একাই যাবে আর আমি দরজাজানালা বন্ধ করে ফাঁকাবাড়িতে বসে নাপতোল দেখব। আশা করা যায় আমার মতামত আর স্পষ্ট করার দরকার নেই। একটাই কথা মনে রাখার, সোঝার বাস খুব ঘনঘন নেই। বানজারে গিয়ে অপেক্ষা করতে হতে পারে, যদি না আপনারা আগেভাগে বাসের সময় জেনে নিয়ে থাকেন। 


যেভাবেই যান না কেন, রাস্তাটি মনোরম হবে। পথে পড়বে জিভি। অপূর্ব একটি উপত্যকা। তীর্থনের ধারে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের চরিত্রের থেকে জিভি উপত্যকার জঙ্গলের চরিত্র একেবারে আলাদা। ওখানে দেখেছিলাম মেলামেশা গাছের জঙ্গল, আর এখানে দীর্ঘ পাইন দেবদারু ছাওয়া বন। এই বসন্তে তাদের পাতায় যে কী অপূর্ব রং ধরেছে। হলদেবাদামী সোনালি পাতায় বিকেলের রোদ ঝিকমিক করছে। একটা পাহাড় ফুরোতে না ফুরোতেই আরেকটা পাহাড়ের গায়ে ফুটে উঠছে রঙের দেওয়াল। ওই রাস্তাটার জন্য আরেকবার সোঝা যাওয়া যায় (আরও অনেককিছুর জন্যও যাওয়া যায়, তবে রাস্তাটা সে সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দেবে।)

জিভি ছাড়াতে পথ খাড়া হল, হাওয়া ঠাণ্ডা হল। সোঝা এসে গেল। আমাদের দু'রাতের বুকিং আছে সোঝা হলিডে ইন-এ। এই ইন একসময় রাজা গেস্ট হাউস নামে পরিচিত ছিল, এখনও বেশিরভাগ লোক, সোঝা হলিডে ইনকে রাজা গেস্ট হাউসের নামেই চেনেন। সোঝা ইন আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। এর ব্যবস্থাপত্র হিলস্টেশনের বাজেট হোটেলের যেমন হয় তেমনই, প্রয়োজনের সবই আছে, গরমজলের গিজার শুদ্ধু, ঘরগুলো সামান্য ছোটর দিকে এবং ঝকঝকে পরিষ্কার। আমাদের ফুল রেকোমেন্ডেশন রয়েছে। ইনের মালিক শ্রী এলু রাম ভারতীর সঙ্গে কাল সকালে আমাদের পরিচয় হওয়ার পর রেকো আরও স্ট্রং হবে, কিন্তু কালকের কথা কালকে। 

সোঝা গোশৈণীর থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। তাই ঠাণ্ডাও অনেকটা বেশি। ঘরে ব্যাগ রেখে কাঁপতে কাঁপতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আর চোখ মন মগজ একসঙ্গে ধাঁধিয়ে গেল। 

সামনে জঙ্গল, বাঁদিকে জালৌরি পিক, ডানদিকে ধৌলাধার শৃঙ্গরাজি।


পথশ্রমের ক্লান্তি উবে গেল। ফোরকাস্টে বলেছে জলযোগের সম্ভাবনা হাই। ছাতাটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

রাস্তায় একটিও লোক নেই, মিনিট দশেক বাদে বাদে একেকটা গাড়ি এদিক থেকে ওদিক কিংবা ওদিক থেকে এদিক আসে। ডুবন্ত সূর্যের আলোয় পাইন বনের আচমকা একটা একটা খণ্ড ঝলসে উঠতে লাগল। কেউ আগুন জ্বেলেছে, সাদা ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে সবুজ বনের ব্যাকড্রপে। একটা অতি সরু ঝরনা ঝরছে। ঝরনাটা প্রথম দেখতে পেয়েছিল অর্চিষ্মান, আমার কনুই টেনে দেখাল। বলল দেখ কেমন একা একা ঝরছে, কেউ ছবিও তুলছে না। শুনে আমি দুয়েকখানা তোলার চেষ্টা করলাম, উঠল না। 


রাস্তাটা খাড়া। থেমে থেমে উঠছি তাই কষ্ট হচ্ছে না। এই রাস্তাই পাঁচ কিলোমিটার চলে পৌঁছচ্ছে জালৌরি পাস। আমরা কাল যাব। জালৌরি থেকে আরও পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক করে সেরওলসর লেক, বেগতিক কিছু না ঘটলে সেখানেও যাওয়ার ইচ্ছে আছে। এই সব ভাবতে ভাবতে আর প্ল্যান করতে করতে এগোচ্ছি। এগোতে এগোতে একটা বাঁকের মুখে থামলাম। সামনে বিস্তীর্ণ আকাশ, পাহাড়। পাহাড়ের ওপর ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। মেঘ করেছে না সন্ধে নামছে ঠিক মালুম হচ্ছে না, যাই হোক না কেন, ফিরে যাওয়াই ভালো।


অচিরেই সন্দেহ নিরসন হল। খটাস খটাস বৃষ্টি পড়তে লাগল মাথার ওপর। আঘাতের প্রাবল্যে প্রথমটা চমৎকৃত হয়েছিলাম, তারপর বুঝলাম শিলা। শত শত নকুলদানা সাইজের শিলা আমাদের মাথায়, ঘাড়ে, নাকে, গালে, চশমার কাঁচে কামানের গোলার মতো নেমে আসছে। পাহাড়ের মেটে সবজেটে গা বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রচণ্ড বেগে নেমে আসছে, সে গতি এবং লাফের উত্তেজনা দেখলে জ্যান্ত বলে ভুল হয়। ফাঁকা রাস্তা, আবছায়া, হাড়কাঁপানো শীত সব মিলিয়ে সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা একটা অতিপ্রাকৃতিক আকার ধারণ করল। শিলাগুলো যেন অজানা উড়ন্ত প্রাণী, জঙ্গলের ভেতর স্পেসশিপ লুকিয়ে রেখে দলে দলে পৃথিবী আক্রমণ করেছে। 

তাড়াতাড়ি ছাতা খুললাম। ওইরকম তীব্র, তির্যক শিলাপাত থেকে বাঁচানো মহেন্দ্র দত্তেরও কর্ম নয়। জ্যাকেটম্যাকেট সব ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। ঠাণ্ডা বাতাসে নাকের ডগা অবশ, ঠোঁট জমে গেছে, কথাবার্তাগুলো বেঁকেচুরে বেরোচ্ছে।

বুকে বল আনতেই বোধহয় অর্চিষ্মান গান ধরল, ‘অ্যা-অ্যা-কদিন ব্-বৃষ্টিতে দুজনেএ-এ…’ ধুয়ো ধরার আশায় অতি কষ্টে ঠোঁট নাড়ালাম। ‘ভ্‌-ভেজ প্‌-পকোড়া’ ছাড়া আর কিছু বেরোল না।


Comments

  1. Khub shundr bornona! Apnar emnitei strong kolom-er utkorshota aro badchhe!!

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুতীর্থ। ভালো লাগল মন্তব্য পেয়ে।

      Delete
  2. Ami abar pahar bhalobasleo pahare bus er duluni ke bhoy pai..shila brishtita darun experience...
    Ota Madhabilata na bougainvillea ��

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ হ্যাঁ, বোগেনভিলিয়াই বটে।

      Delete

Post a Comment