মন ভালো মন খারাপ



মিনিবাসের জানালা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। খোলা থাকলে বৃষ্টির ছাঁট ঢোকে, ধুলো ঢোকে, ধোঁয়া ঢোকে, কনুই বেরিয়ে থাকলে পাশ থেকে কম্পিটিশন দেওয়া মিনিবাস এসে গুঁড়িয়ে দেয়, খালি হাওয়া ঢোকে না। মামাবাড়ির খাওয়া খেয়ে, সেই মিনিতে বসে হাওড়া পর্যন্ত আসা, সোজা কথা নয়।

ওই শক্ত কাজটাই আমরা করতাম, আমি আর মা, তিনমাসে ন্যূনতম একবার। রিষড়া থেকে দুপুর দুপুর বেরিয়ে কসবা পৌঁছে সন্ধে ছ’টার সময় গলা পর্যন্ত গিলে রথতলা মিনিতে সেদ্ধ হতে হতে হাওড়া পর্যন্ত আসা। একটাই রক্ষা, ডিপো থেকে উঠতাম বলে সিট পাওয়া যেত। জানালার পাশে, কিন্তু তাতে সুবিধে কিছু হত না। হাওড়ায় নেমে, আমি আর মা, মা আর আমি, নিজেদের একটা প্রাইজ দিতাম। যত রাতই হোক না কেন, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিক দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে সারি সারি উজ্জ্বল দোকানগুলো থেকে দুজনে দুটো লিমকা খেতাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এক নম্বর থেকে ব্যান্ডেল লোকাল ছেড়ে যাচ্ছে নাকি তারকেশ্বর ঢুকছে পাঁচ নম্বরে, কেয়ার করতাম না। যদিও সবাই বলত থামস আপ হজমের পক্ষে বেটার, আমি আর মা দুজনেই লিমকা প্রেফার করতাম। লিমকা এখনও আমার প্রিয়তম কোল্ডড্রিঙ্ক। তারপর থামস আপ। তারপর কোকা কোলা। পেপসিটা মাথায় বন্দুক ধরলে খেতে পারি। অর্চিষ্মানের এ বাবদে বয়স পাঁচে আটকে আছে, তার পছন্দ মাজা, গোল্ড স্পট, নিদেনপক্ষে মিরিন্ডা। বেসিক্যালি, কমলা রং।

আবার একমাস হতে না হতেই উসখুস শুরু হত। মামা ফোন করে বলতেন, কীরে মণি, সম্পর্কটা রাখবি না ঠিক করেছিস নাকি? মামি বলতেন, কতদিন দেখিনি মণি, একবার এসো না।

আবার গোটা যুদ্ধটা শুরু হত।

তখন অবশ্য যুদ্ধ মনে হয়নি। মামাবাড়ি যাওয়ার আনন্দটাই শুধু টের পেতাম। শিউরানিটা এখন হয়। অনেক কিছু মনে পড়লেই হয়। যদি কেউ গ্র্যাজুয়েশনের তিন বছর এম জি রোডের জ্যামে (এবং জ্যামবিহনেও, স্রেফ কন্ডাক্টরের বাস চালাতে ইচ্ছে করছে না বলে বা সিগন্যাল খেতে ইচ্ছে করছে বলে) আটকে থাকার দিনগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসেন, কেঁদে বলব, চাই না যৌবন। এই নিন, এক মাসের মাইনে।

এখনও কি এমন কিছু করি যা পঁচিশ বছর পর যুদ্ধ মনে হবে? মনে হবে কী করে পারতাম? ভাবার চেষ্টা করলাম, চিহ্নিত করতে পারলাম না। দিব্যিই আছি তো।

এখন বিনাযুদ্ধে যাই মামাবাড়ি। সময় খুব যে কম লাগে তা না, পথ তো ডেফিনিটলি ঘুর হয়। তবে গায়ে ঝাঁকুনি লাগে না। জি টি রোডের ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় দিল্লি রোড ধরা হয়। আমাদের বাড়ি থেকে দিল্লি রোড পৌঁছতে পুকুর ঘেরা পুঁচকে একটা বাঁশবন পড়ে। একসময় আমাদের পাশের পাড়াতেও বাঁশবন ছিল, আমিই দেখেছি। মা নাকি আমাদের পাড়াতেও বাঁশবন দেখেছেন। আর পঁচিশ বছর পর আমি থাকলেও, মামাবাড়ি থাকলেও এই বনটুকু থাকবে না, গ্যারান্টি। কাজেই আমি সর্বদা দিল্লি রোড ধরায় ভোট দিই।

এবার পাঁচ পাঁচটা ওয়ার্কিং ডে হাতে নিয়ে রিষড়া গেছিলাম। দুটো কাজের প্রায়োরিটি ছিল। সে কাজের গল্প বলব পরের পোস্টগুলোতে। কিন্তু কাজের কাজ ছাড়াও বাড়ি গেলে আরও কিছু অকাজের কাজ থাকে, যেমন আত্মীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করা। যতজনের সঙ্গে করব ভেবে যাই, সে উচ্চাশা কখনওই পূর্ণ হয় না। তবে মামাবাড়িটা যাওয়া হয়। মিথ্যে বলব না, যাওয়ার আগে ব্যাপারটা কর্তব্য ঠেলার মতোই লাগে। কথাও তো তেমন করে বলার কিছু নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, বিনোদন - যে সব বিষয়ের অবস্থানের একটা গোড়ার মিল না বেরোলে দুটো প্রাপ্তবয়স্কের মিল হয় না বলেই বিশ্বাস করি, সেগুলো মামাবাড়ি কেন, কাছেদূরের কোনও আত্মীয়দের কারও সঙ্গে এ যাবত হয়েছে (বা মিল ধরা পড়ার সুযোগ হয়েছে) বলে তো মনে পড়ে না।

এইখানে চয়েসের প্রসঙ্গ আসে। বিজয়টিজয়ায় তত না, থ্যাংকসগিভিংটিভিং-এ যত, তবে বিজয়াটিজয়াতেও হবে অচিরেই, একধরণের পোস্টের বাজার তেজী থাকে দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য প্ল্যাটফর্মেও, যে আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে ওই বাধ্যতামূলক কয়েকঘণ্টা কাটাতে কার কত বুক ফাটছে। আমাদের আত্মীয়দের আমরা বাছিনি, গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, বা তাঁদের গলায় আমরা ঝুলেছি। অন্য দিকে বন্ধু জুটিয়েছি আমরা নিজেরা, টিপে টুপে, বেছে বুছে। কাজেই বন্ধুরা আত্মীয়দের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।

তেজী মতের বিরুদ্ধে যাচ্ছি যেহেতু ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি, আমার আত্মীয়দের মধ্যেও এমন অনেক লোক আছেন, যারা আত্মীয় না হলে তাদের দেখে আমি গলি পালটাতাম কিংবা দৌড়ে গিয়ে পথের পাশে ঝোপের আড়ালে লুকোতাম। কাজেই আমি পোস্টদাতাদের বেদনা বুঝি না এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু চয়েস ব্যাপারটা গোলমেলে। যা আমরা আমাদের চয়েস বলে ভাবছি তা আদৌ আমাদের চয়েস কিনা, যদি না হয় তাহলে কে সেই চয়েস তৈরি করল, কী উদ্দেশ্যে তৈরি করল, চয়েসই আমাদের স্বাধীনতার লক্ষক কি না, চয়েসকে মানবাধিকারের র‍্যাংকিংয়ে গণ্য করা উচিত কি না। অতসব জটিলতায় না গিয়ে আমি শুধু এটা বলতে পারি, আমার তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যক্তিগত জীবনের নিরিখে চয়েস যেমন ভীষণ কাজে দিয়েছে, বিপদেও কিছু কম ফেলেনি। পরীক্ষার আগে পড়তে বসাটা চয়েসে পরিবর্তিত না হলেই হয়তো, হয়তো না, নিশ্চিতভাবেই ভালো হত।

এই সব ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে আমি গুরুগম্ভীর ইস্যুর তুচ্ছীকরণ করতে চাই না। আমার যেটা বলার, সেটা হচ্ছে যে আত্মীয়স্বজন যে আমার চয়েসের নাগালে নন এটা আমার কাছে ইদানিং একটা আশ্বাসের ব্যাপার। এঁরা ক্যাপ্টিভ। এদের ইম্প্রেস করার জন্য আমাকে কিছু সাজতে হবে না। আমি লোক বুঝে কথা কম বলতে পারি, বা কিছু ইস্যু প্লেগের মতো পরিহার করতে পারি, কিন্তু তা সত্ত্বেও এঁরা আমার দাদা মামা কাকাই থাকবেন। আমি প্রগতিশীল হলেও আমার ছোটমামা আমার ছোটমামাই থাকবেন, না হলেও তাঁর পালানোর রাস্তা নেই। ঠিক যেমন মামা বিজেপি না মাওবাদী, ভ্যাকসিনে বিশ্বাস করেন না করেন না, গোয়েন্দা পড়েন না দেরিদা কপচান, এগুলোর ওপর তিনি যে আমার মামা, সেই সত্যিটা নির্ভর করে না। হোয়াটসঅ্যাপে নিষ্করুণ হয়েছি বলে মাসতুতো দাদা ঘোষণা করে দিতে পারে না যে আজ থেকে ছোটবোন পদে সোনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট টার্মিনেটেড।

এর আরামটা তারা বুঝতে পারবে না, যাদের বয়স অল্প এবং যাদের তুড়ি মারলে নতুন বন্ধু হয়। বন্ধু হওয়ার সঙ্গে বয়সের একটা ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক আছে। সে লোকে যতই মনের বয়স, শরীরের বয়স ইত্যাদি চুল চিরুক না কেন। কারণ শরীর ও মনের বয়সের মধ্যে আবার একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে, একটা বাড়লে অন্যটা সামান্য হলেও বাড়ে (বাড়াই উচিত। আমি পঞ্চান্ন বছরের লোককে পঁচিশের মতো আচরণ করতে দেখেছি। শুধু যে দৃষ্টিকটু তাই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক।) গত পাঁচ বছরে আমার একজনও বন্ধু হয়নি, গত দশ বছরে খুব উদার হয়ে গুনলেও দু’জন। বাধ্যবাধকতা না থাকায়, দেখা না হতে হতে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কগুলোতেও হয়তো জং ধরে যাচ্ছে, কে জানে।

আত্মীয়দের সঙ্গে সেটা হওয়ার জো নেই। নেহাত মুখ দেখাদেখি বন্ধ না হয়ে গেলে, নিয়মিত ইন্টারভ্যালে দেখাসাক্ষাৎ হয়। কারণ ওটা চয়েস নয়, কর্তব্য। কর্তব্য করতে যাওয়ার আগে কান্না পায় যে কী বলব, কিন্তু গিয়ে উপস্থিত হওয়ার পর প্রত্যেকবারই বেরোয় যে কথা অ্যাকচুয়ালি থামানো যাচ্ছে না। কারণ যেটা আছে সেটা হচ্ছে একটা কমন অতীত। কমন শিকড়। কমন স্মৃতি। অ্যালবাম ভর্তি সাদাকালো ছবি। আমার স্মৃতি তৈরি হওয়ারও আগে থেকে। যখন আমাদের মায়েদের কাজল কোম্পানির সঙ্গে গোপন আঁতাত ছিল। সেই স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতেই সময়সীমা কাবার।

স্মৃতিচারণ বোরিং হতে পারত, যদি একই লোকেরা বছরের পর বছর একই জাবর কাটত। সেটা যে ঘটেনি তার কৃতিত্ব সেইসব আইনত আত্মীয়দের, যারা নিয়মিত ইন্টারভ্যালে বংশলতিকায় ঢুকে পড়েছে। সেই সব জামাইদের, যারা অফিস থেকে ফিরে শ্বশুরবাড়ির গুরুজনের জন্য হাসপাতালে রাত জাগতে এক সেকেন্ড না ভেবে হাত তুলেছে। এমন ভাইবউরা, যারা আড়াই ঘণ্টা আগে খবর দিয়ে বেড়াতে আসা চরম ইনকনসিডারেট ননদের জন্য চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয় রেঁধে হাসপাতালে হাড়ভাঙা ডিউটি দিতে গেছে। নিরামিষ হয়ে লোকের যা কাজ বাড়িয়েছি, নিজেরই লজ্জা করে। অর্চিষ্মানের জন্য মাছ মাংস করলেই হয়ে যায়, আমার জন্য লাগে কাঁকরোল ভাজা, পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি, পটলের দোরমা, ভাজা মুগ ডাল, দই পনীর, আমড়ার চাটনি। মামাতো বোনের বাড়িতেও একই ব্যাপার। তবে সেখানে পদের বৈচিত্র্য ও সম্ভারের থেকেও ইন্টারেস্টিং ছিল অন্য একটা ব্যাপার। খেতে বসে জানলাম, তুলতুলে নানপুরী ভেজেছেন বোনের শ্বশুরমশাই, উমদা পনীর রেঁধেছে বোনের বর, স্বর্গসম সিমুইয়ের পায়েস বানিয়েছেন বোনের শাশুড়ি, রগরগে আলুর দমের কৃতিত্ব বাড়ির রান্নার লোকের। ফিরে আসার সময় হুমকি দিয়ে এসেছি, যতবার বাড়ি আসব ততবার আসব আপনাদের বাড়ি। আশা করি ওঁরা হুমকিটা ফাঁকা ধরে নেননি। ধরলে পস্তাবেন।

ভাবুন, এই সব বউ জামাইরা চাইলেই পৃথিবীর যে কোনও বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক পাতাতে পারত, অথচ সব ফেলে, সবাইকে ফেলে আমাদের বাড়িতে এসে উঠেছে। কাজেই এই লোকগুলোকে বেঁধে বেঁধে রাখতে হবে। আর গল্প যেমন বাঁধে তেমন আর কিছু বাঁধে না। তাই বারবার আমাদের কমন অতীতের গল্পগুলো শোনাই। যাতে শোনাতে শোনাতে একসময় ওরা অজান্তে নিজেদের ওই গল্পগুলোর অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। নিজের দিকেও এই স্ট্র্যাটেজিটা কাজ করতে দেখেছি। আমার বিয়ের প্রায় তিন বছর পর মামাতো ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল। তার আগে আমাদের রাবণের গুষ্টির খতিয়ান অন্তত এককোটি বার দিয়েছি অর্চিষ্মানকে, মনে রাখতে পারেনি। দুয়েকবার লোকজনের বাড়িতে গিয়ে কবজি ডুবিয়ে খেয়েও এসেছে, কিন্তু তাও সম্পর্কের মানচিত্রে সবার অবস্থান ঠিকঠিক বলতে পারত না।

তারপর মামাতো ভাইয়ের বিয়ে বাধল। বেহালা, সোনারপুর, কসবা, ম্যান্টন, উত্তরপাড়া, রিষড়া থেকে কারপুল করে লোকজন অকথ্য মজা করতে করতে লংড্রাইভে বরযাত্রী গেল রাঁচি। আমি আর অর্চিষ্মান দিল্লি থেকে দোকাবোকা পৌঁছলাম বিয়ের দিন দুপুরে। হোটেলের সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে অর্চিষ্মান গলা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বলেছিল, এটাই তো গো? এটাই, কনফিডেন্টলি বলেছিলাম। কারণ হোটেলের ভেতর থেকে অলরেডি কিছু পাড়াকাঁপানো, ছাদফাটানো হাসির আভাস আসছিল। পরের দু'দিন, হোটেলের ঘরে বা রিসেপশনের সোফায়্, বিয়ের মণ্ডপে যাওয়ার বাসে, যজ্ঞের আগুন ঘিরে পাতা বাহারি চেয়ারে বসে, মালাবদলের ছাদনা ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে আমাদের গলা খুলে গেল, পেট ব্যথা হয়ে গেল, চোখ ভিজে গেল। আর ওই দুদিনে, অর্চিষ্মান আমাদের রাবণের গুষ্টির সবাইকে চিনে ফেলল। যারা ওখানে ছিল, যারা ছিল না, যারা মরে গেছে, যাদের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছে, সবাইকে। এখন কারও প্রসঙ্গ উঠলে বলে, ও আচ্ছা ওই যিনি অমুক কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন, বা তমুক কেসটি খেয়েছিলেন?

মামাবাড়িতে গিয়ে চিৎকারচেঁচামেচি করা আর খাওয়া ছাড়া আরও একটা কাজ থাকে, সেটা হচ্ছে মামার কাছে শরীরসংক্রান্ত কিছু একটা সমস্যার সমাধান চাওয়া। মামাবাড়ি গেছি অথচ মামাকে কিছু একটা শারীরিক যাতনার কথা জানাইনি এমনটা হয়নি এ জন্মে। এমনও হয়েছে, কোথাও কিচ্ছু নেই, দিব্যি ফিটফাট স্বাস্থ্য নিয়ে রিষড়া থেকে বেরিয়েছি, কসবার বাড়ির দরজায় বেল দিতে দিতে হেঁচে, কেশে, নাক টেনে একশা।

এটা নিয়ে ভয়ানক মজার মজার গল্প করা যায়। বিয়ের সদ্য সদ্য পর দিল্লি ফিরেছি। তখন সংসদ মার্গে অফিস ছিল। গেলাম। লাঞ্চের আগে দুই, পরে দুই, চারবার বমি হয়ে গেল। অর্চিষ্মান বলল, দাঁড়াও, মামাকে ফোন করি। একমুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে গেছিলাম, ও এরই মধ্যে জানল কী করে যে এ সব হলে মামাকে ফোন করতে হয়? তারপর খোলসা হল যে আমার না, অর্চিষ্মান ওর তরফের মামার কথা বলছে। তিনিও ডাক্তার, তিনিও বাড়ি এবং এক্সটেন্ডেড বাড়ির সবার কান কটকট, মাথা ঝনঝনের আজীবনের দায়িত্ব নেওয়ার বন্ড সই করেছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মামারা এমনি সৌজন্যের ফোনের আশাও ত্যাগ দিয়েছেন। ফোন তুলেই বলেছিলেন, বল কী বাধিয়েছিস। অর্চিষ্মান বলেছিল, আমি না, কুন্তলা বাধিয়েছে। ব্যস, খুলে ফেললাম খাতা। ওই মামার মামিও ডাক্তার। ও বাড়ির যে কোনও অনুষ্ঠানে আমাকে দেখলে দেখবেন আমি মামির পাশে বসে ফিসফিস করছি আর মামি টিস্যু পেপারে ফসফস করে ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছেন।

এতদিনের রেকর্ড ভাঙার মানে হয় না। মামাবাড়ি পৌঁছে, মামির রেডি করে রাখা ঘোলের শরবত আর নারকেল নাড়ু সাঁটিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখে (গত তিন মাসে ফোন করিনি, একটাও হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের প্রাপ্তিস্বীকার করিনি), মামাকে বললাম, মামা, তোমার বাড়ি এসে তোমাকে দিয়ে চিকিৎসা না করিয়ে গেলে অস্বস্তি হবে না বল? মামা হাঁপ ছেড়ে বললেন, আরে আমারও হচ্ছিল তো অস্বস্তি মারাত্মক। কই দেখি কী পাকিয়েছিস। মামা আমার সমস্যার সমাধান করতে লাগলেন, দরজা দিয়ে আমার নাম ধরে চেঁচাতে চেঁচাতে ভাই ভাইয়ের বউ ফিরল হাসপাতালের ডিউটি সেরে, খাওয়াদাওয়া হল খুব। কাঁকরোল ভাজা, পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি, পটলের দোরমা, ভাজা মুগ ডাল, দই পনীর, আমড়ার চাটনি। খেয়ে উঠে ভাই বলল, কী গো, ব্রণগুলো সারাও এবার। আমি বললাম, ও ব্রণ চিতা পর্যন্ত সঙ্গে যাবে। বলল, বাজে না বকে এটা লাগাও সকালবিকেল। ওষুধ বার করে দিল আলমারি থেকে। দেজা ভিউ। যেমন মামা দিত। চিন্তা ঘুচল। আমাদের মামা ছিল, আমাদের পরের প্রজন্মের গেঁড়িগুগলিগুলোর ওরা থাকবে।

খেয়েদেয়ে ছাদে গেলাম। ভাইবউকে বললাম, জানো এই ছাদে পিকনিক হত নববর্ষে নিউ ইয়ারে? আর পারিবারিক স্পোর্টস? সে স্পোর্টসে আমি চোখ বেঁধে সোজা হেঁটে হাঁড়িতে হোঁচট খেয়ে ডিসকোয়ালিফাই হয়েছিলাম, ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল যে পনেরো হাত দূরে জলের ট্যাংকে লাঠির বাড়ি মেরেছিল, সে। সেই থেকে শিক্ষা হয়েছে যে পারফেকশন আসলে প্রাইজের পথে বাধা। আরেকটা শিক্ষাও হতে পারত যে সোজা পথে হাঁটলে প্রাইজ নেই, কিন্তু সবে চল্লিশে অতখানি সিনিক হতে রাজি নই। স্পোর্টস অন্তে খাওয়াদাওয়া শুরু হল। ছোটমামি ভাবলেন দাঁও মারবেন, বললেন স্পোর্টস এখনও শেষ হয়নি, খাওয়াশেষে পরিষ্কার পাতের ক্রমানুসারে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড প্রাইজ দেওয়া হবে। লোকজন পত্রপাঠ মাছের চোষা কাঁটা, মুরগির চেবানো ঠ্যাং নিজের পাতের বদলে পাশের পাতে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। মামিকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় স্পোর্টসের ইভেন্টটির অন্ত ঘোষণা করতে হয়েছিল। বিজয়ায় প্যান্ডেল খাটিয়ে সম্মিলনী হত। মামা পেশাদার গায়কবাদক জোগাড় করে আনতেন। একবারের বিজয়ায় এক গায়ক মাদুর্গার একটা গান ধরেছিলেন সেখানে লাইনে লাইনে শঙ্খধ্বনি শব্দটা ঘুরে ঘুরে আসছিল। সবাই মারাত্মক ভক্তিপূর্ণ মুখে গান শুনছে এমন সময় অন্তরা আভোগীর ইন্টারল্যুডে টুপি থেকে পায়রা বার করার সমান কাপ্তেনিতে বাদক ঝোলা থেকে একখানা আস্ত শঙ্খ বার করে পোঁ পোঁ পোঁ বাজাতে লাগলেন। বড়দের ক্ষুরে ক্ষুরে, তাঁরা মুখের একটি পেশিও না নড়িয়ে গম্ভীর মুখে গান শুনতে লাগলেন। আমরা কোনওমতে প্যান্ডেলের পেছনে পালিয়ে গিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে লাগলাম। হাসির আওয়াজ শোনা যাওয়ার পরিণত গুরুতর হতে পারত, নিঃশব্দে হাসতেে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। পরের দুদিন পেটের মাসল টনটনিয়েছিল।

চোখ মুছে, দম নিয়ে ভাইবউ বলল, সোনাদি, পরের বার একটা কিছু প্ল্যান করবে? পিকনিক? বা স্পোর্টস? বা সম্মিলনী?

নিচ থেকে মামির হাঁক এল। পঁয়ত্রিশ, তিরিশ, পঁচিশ বছর আগে যেমন আসত। মামা বেরোচ্ছে চেম্বারে। ছাদের রেলিং ধরে ডিঙি মেরে টা টা করে দিতে পারতাম। ছোটাছুটি থামিয়ে অজস্রবার করেছি। কিন্তু নামলাম। প্রণাম করা যায় না ওভাবে। নামতে নামতে সিঁড়িঘর জুড়ে চটির ফটফটানি প্রতিধ্বনিত হল। এ প্রতিধ্বনি কত হাজার বার শুনেছি। যদিও এর সঙ্গে তার মিল সামান্যই। কারণ এখনকার সিঁড়ি বাওয়ার সঙ্গে তখনকার সিঁড়ি বাওয়াও আকাশপাতাল ছিল। তখন নামতাম দুদ্দাড়িয়ে, একে অপরের সঙ্গে রেস করে, তিনটে সিঁড়ি একসঙ্গে টপকে, "ওরে আস্তে নাম!" আর্তনাদ উল্লাসে ডুবিয়ে দিয়ে।

এখন চটিজোড়ারা, সুস্থির, গম্ভীর প্রতিধ্বনি তুলল। আর সেই যে মনখারাপ হল ওই দুদ্দাড়, অস্থির প্রতিধ্বনির জন্য, এখনও, দিল্লি ফিরে আসার পরও সে মনখারাপ কাটছে না। অর্চিষ্মান বলবে মেলোড্রামা, কিন্তু চোখে জলও আসছে অল্প অল্প। তারপর দৃষ্টি ঘোরালাম। নিজেকে বোঝালাম, মনখারাপ হওয়ার তো কিছু নেই, উল্টে এই ভেবে শুধু কৃতজ্ঞই হওয়ার আছে যে চেনা চটিগুলো এখনও আমার সঙ্গে নামছে। আমার চটির ঢিলে হয়ে আসা প্রতিধ্বনিতে তাল মেলাচ্ছে।

লাভ হল না কিছুই, উল্টে আরও জোরে কান্না পেয়ে গেল।

Comments

  1. Boro bhalo laglo lekhata pore. Anekdin por Comment korlam. Goto koekmaas Abantor e khub kom aasa hoyechhe. Tabe abar regular hoye gechhi. Ashakori apnara bhalo aachhen ei somoye.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে সুস্মিতা, থ্যাংক ইউ। গত কয়েকমাসে কম এসেছেন যে তাতে কোনও অসুবিধে নেই, সব ঠিক আছে আশা করি? আবার যে বেশি বেশি আসছেন অবান্তরে সেটা অবশ্য খুবই খুশির খবর। সুস্বাগতম।

      Delete
  2. বড় ভালো লাগলো আগের বিক্রমাদিত্যেত বারান্দা আর এটাও। আমার ছোটবেলাতেই ওই সব আত্মীয় স্বজন মিলে হুড়োহুড়ি শেষ মনে হয়। বড় হয়েছি যত তত নিজের কোনে ঢুকেছি, আত্মীয়দের বাড়ি গেলেও পালিয়ে বেরিয়েছি। অথচ এইবার, আমার বিয়ের সময়েই মাসতুতো, মামাতো দিদিরা, ছোট ছোট ভাগ্নেরা ভাগ্নীরা,খুড়তুতোর খুড়তুতোতো দিদিরা এসে সে পুরো জমজমাট হয়ে গেল। আমি তো ভাবতেও পারিনি! এমনকি একটু আড্ডার বিরাম হবে বলে কেউ দুটো পাড়ি পরে যে বাড়িটা ভাড়া নেওয়া ছিল সেখানেও গেল না, ঠাসাঠাসি করে, মেঝেতে বিছানা পেতে সব এক বাড়িতেই রয়ে গেল। অথচ ওই যা বললে সব সত্যি, এদের কারোর সাথে বই, বেড়ানো, রাজনৈতিক বা অন্যকোনোরকম মতের মিল বা আলোচনা হয়না। তাও হাসির তো অভাব হয়ও না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিকই বলেছ, প্রদীপ্ত। আমিও প্রত্যেকবার অবাক হয়ে যাই যে এত আনন্দ হয় কী করে এই লোকগুলোর সঙ্গে। অথচ হয়। প্রত্যেকবার হয়। আত্মীয়স্বজনের বিয়েবাড়ি এক অদ্ভুত ব্যাপার। অতি রামগরুড়ের ছানারও বাঁধ ভাঙতে দেখেছি। ভাড়াবাড়ি ফেলে রেখে একবাড়িতে গাদাগাদি করে থেকে যাওয়ার ঘটনাটা ভালো লাগল খুব শুনে। ওটাই কষ্টিপাথরের প্রমাণ যে তোমার বিয়েতে আসলেই মজা হয়েছিল।

      Delete
  3. ish amar o je mon kharap hoye gelo..jader emon elebaorate mamar bari tahke tader sobbar eta hobe...tao tomar jaoa holo etai boro bapar..ekhon to sob chole jaoar por khobor pai..se arek dombondho koshto..aj emon meghla dine khuub bhalo laglo pore..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, হ্যাঁ, ওই খবরগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ছে রে, পারমিতা। শক্তিশেলের মতো বেঁধে একেকটা সব। ভয়াবহ।

      Delete
  4. "গিয়ে উপস্থিত হওয়ার পর প্রত্যেকবারই বেরোয় যে কথা অ্যাকচুয়ালি থামানো যাচ্ছে না। কারণ যেটা আছে সেটা হচ্ছে একটা কমন অতীত। কমন শিকড়। কমন স্মৃতি। অ্যালবাম ভর্তি সাদাকালো ছবি। আমার স্মৃতি তৈরি হওয়ারও আগে থেকে। " <3

    ReplyDelete
  5. Apurbo! erokom lekha upohar deoar janyo anek dhnyobad o bhalobasha!

    ReplyDelete

Post a Comment