আভরণহীনতার শিবিরে



অর্চিষ্মান তিতিবিরক্ত। ছ’খানা মোমোর সঙ্গে ছ’রকমের সস। ছ’বছর আগে তো কান দিয়ে ধোঁয়া বার করানো লাল লংকার সস ছাড়া কল্পনাতেও কুলোতো না কারও। ছ’মাস আগে পর্যন্তও দুটো পুঁটলি। লাল লংকা আর সাদা মেয়োনিজ। এখন ছশো মোমোওয়ালা গুঁতোগুঁতি করছে বাজারে। একে অপরের থেকে এগিয়ে থাকার তাড়নায় এ মোমোয় চিজ পুরছে তো ও দিচ্ছে ছ’রকম সস।

কর্নফ্লেক্স চিবোতে চিবোতে বললাম, কী কী সস দিয়েছে গো?

অর্চিষ্মান বলল, হুস। দেখিওনি। টান মেরে ফেলে দিয়েছি। ছ’টা মোমো ছ’রকম সস দিয়ে খাব? তাছাড়া ছ’ ছ’টা বাটি নামাব নাকি? মাজবে কে?

পয়েন্ট। বাসন মাজার ফ্যান্টাসি থাকলে অর্চিষ্মান মাংসভাত খেত কবজি ডুবিয়ে। নেই বলেই তো মোমো।

দু’নম্বরের দাদুর চপের দোকানে, যা কি না দিল্লির বেংগলি ফুড হেরিটেজ ওয়াকের অংশ, পরিস্থিতি এতটা না হলেও, খারাপ। প্রতিবার সিঙাড়া প্যাক করানোর সময় হৃদপিণ্ড জিভে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ছান্তায় চড়ে সিঙাড়া ঝুড়িতে পড়া এবং ঝুড়ি থেকে ঠোঙায় ভরা আর ঠোঙার মুখ মোড়ার মধ্যের কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডে সবুজ চাটনির দু'দুখানা পুঁচকে থলে ঠোঙাতে চালান হবে, আর আমাকে ওই মাইক্রোসেকেন্ডের মধে চেঁচিয়ে উঠতে হবে, লাগবে না লাগবে না, শুধু সিঙাড়াই যথেষ্ট।

এত প্যানিকের কী আছে, অর্চিষ্মান বলে। দিতে দাও, নিয়ে ফেলে দেবে।

পরামর্শটা এতরকম স্তরে প্রবলেম্যাটিক যে প্রাণ থাকতে এ ব্যবস্থায় রাজি হতে পারি না। পরেরবার আবারও হৃদপিণ্ড জিভে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রতিবার সিঙাড়া কিনতে গিয়ে মিনি প্যানিক অ্যাটাক পেরোই।

অর্চিষ্মান বলে, সঅঅব দিল্লির কুপ্রভাব। সামোসা-ছোলের যে ধ্যাষ্টামোটা এরা করে, পারফেক্ট মচমচে সিঙাড়াগুলোকে ছোলের ঝোলে চুবোয়, গার্নিশের নামে গুচ্ছের হাবিজাবি, সে সব দেখে নিষ্পাপ বাঙালিরা গোল্লায় যাচ্ছে। চপের সঙ্গে কেচাপ পরিবেশন করছে আজকাল। কলকাতায় দেখেছ এসব নষ্টামো?

ঠোঁট সরু করতেই অর্চিষ্মান থামিয়ে দেয়। ফুচকা, রাইট। কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা দোকানে ফুচকা নিয়ে একটা ফাজলামো শুরু হয়েছে বটে। দই ফুচকা, কিমা ফুচকা, চকোলেট ফুচকা। কিন্তু সে কয়েকটা দোকানে, বেশিরভাগ ফুচকাওয়ালাই স্বাভাবিক ফুচকা বিক্রি করে।

হবে। কলকাতার কতটুকুই বা দেখেছি। সেলেব্রিটিসম্বলিত ইউটিউবের ফুড চ্যানেলে কলকাতার সেরা ফুচকার এপিসোডে দেখলাম, বাইশ না কতরকম ফুচকার ভ্যারাইটিওয়ালা একজন বিক্রেতা জায়গা পেয়েছেন। বাইশটার একটাও ফুচকা মুখে দেওয়ার মতো কি না সে সব প্রশ্ন ইমমেটেরিয়াল (নয়। মুখে না দিয়েই জানি।) স্লো মোশনে চোখ বুজে চকোলেট সস দেওয়া ফুচকা মুখে পুরছে লোকজন। এখানে বাইশ না হলেও, রকমারি ফুচকার আয়োজন থাকে। ফুচকার ভ্যারাইটি প্লেট ব্যালেন্স করে পা টিপে টিপে প্লাস্টিকের টেবিলের দিকে এগোতে দেখলে, স্বীকার করছি, ভায়োলেন্ট ইমোশনেরা ঠেলাঠেলি করে মাথার ভেতর। চট করে পজিটিভ ভাবনা দিয়ে মগজ বোঝাই করতে হয়।

তেলেভাজার সঙ্গে কেচাপের নষ্টামোটা এখনও শুরু হয়নি। অ্যাট লিস্ট আমাদের ওদিকে। অর্চিষ্মান তেলেভাজার পৃষ্ঠপোষক শুনে ঝপ করে গেঞ্জির ওপর শার্ট চড়িয়ে স্কুটার চেপে পাড়ার চপের দোকান থেকে  আলু, পেঁয়াজ, বেগুন, মোচা মায় ধনেপাতার চপ (ধনেপাতার বড়ার সঙ্গে গোলাবেন না, যেটা বাড়িতে হয়। এখানে গোটা গোটা ধনেপাতার ঝাড় বেসনে ডুবিয়ে ভেজে তুলেছে। থালার ওপর তারা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে শুয়ে ছিল যখন সে অসামান্য আর্টওয়ার্ক) নিয়ে এসেছিলেন সেজকাকু। যে দোকান ইনোভেশনে এত এগিয়েছে, তারাও কেচাপ পর্যন্ত নামেনি। 

ওপরের প্যারাটা পড়ে অর্চিষ্মান মাথা নাড়ার আগেই ডিসক্লেমার দিই, চপের দোকানটা আমার পাড়ায় ঠিক না, পাশের পাড়ায়। নাকতলায় কামধেনু দোকানের চমচম খেয়ে স্বীকার করেছিলাম, হ্যাঁ, উমদা বটে। প্রায় আমাদের পাড়ার অমরের লেভেলের। তারপর একদিন জি টি রোডে অমরের সামনে  গাড়ি থামিয়ে চমচম আর রাবড়ি আর সরভাজা কিনতে নেমেছি, অর্চিষ্মান বলল, এটা তোমাদের পাড়া কোথায়, এ তো উত্তরপাড়া! অ্যাকচুয়ালি উত্তরপাড়া আর বালির মাঝামাঝি। সেই থেকে অর্চিষ্মানের ব্যঙ্গাত্মক দাবি, লিলুয়া থেকে ব্যান্ডেল পর্যন্ত যা কিছু ভালো সব নাকি আমি আমার পাড়ার জিনিস বলে চালিয়ে দিই।

তাছাড়া এদের সর্বত্র পনীর দেওয়ার অসভ্যতাটা? অর্চিষ্মানের রাগ তখনও কমেনি। ছোলেভাটুরা খেতে  গেছিল কোথায়,  কানের ভেতর আটরংগি রে-র গানের সঙ্গে সঙ্গে সানমাইকার টেবিলে টোকা মারছিল ফুর্তিতে, যতক্ষণ না ছোলেভাটুরের থালার পাশে এক্সট্রা বাটিতে সবুজ কাদায় প্রোথিত একপিস ফ্যাটফেটে পনীর এসে হাজির।

এইও। সেনসিটিভ জায়গায় ঢুকছি। পনীর নিয়ে কথোপকথন ডেসিবেল ছাড়িয়েছে বেশ কয়েকবার। হতে পারে ভেজিটারিয়ান হয়ে আমার গায়ের চামড়া এক্সট্রা পাতলা হয়ে গেছে - পনীর নিয়ে প্রগতিশীল বাঙালির হাসাহাসি জাস্ট নিতে পারি না। পনীর খেতে ব্যক্তিগতভাবে খারাপ বেসেও (ছানার ডালনাও আন্তরিক অপছন্দ করি) লড়ে যাই। লড়ি বেচারা অর্চিষ্মানের সঙ্গেই। বাকিদের নীরবে জাজ করে বেরিয়ে আসি। আমি এটা খাই বলে আমি বুদ্ধিমান, তুই ওটা খাস না বলে আমার যোগ্য নস, এই লাইনে নিজেদের ঔৎকর্ষ প্রমাণের ফাঁকিবাজি জাস্ট নিতে পারি না।

অথবা নতুন নিরিমিষ হয়েছি বলেই লড়ি। হিঁদুর পোলা মুসলমান হলে বেশি গরু খায়, ঠাকুমা বলতেন।

আলোচনাটা তর্কের দিকে না নিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছেতেই বোধহয় অর্চিষ্মান বলল, পনীর ইজ ফাইন। পনীরের বিরুদ্ধে ওর মূল অভিযোগ যে কোনও নিরামিষ খাবারকে মহার্ঘ প্রতিপন্ন করতে গেলেই পনীর এনে জোটানোর এদের প্র্যাকটিসটা। কথাটা ঠিকই। নিরামিষ ভালো খাবার ইকুয়ালস টু পনীর আর পনীর ইকুয়ালস টু নিরামিষ ভালো খাবারের সরলীকরণ, সত্যি অতিসরলীকরণ। এটা আজকাল বাংলাতেও ঘটছে। আত্মীয়প্রতিবেশীর নেমন্তন্ন বাড়িতে গেলেও হরদম পনীরের মুখোমুখি পড়তে হয়। পনীর আর ধোঁকা। দুটোর থেকেই এককোটিগুণ সুখাদ্য হচ্ছে তেতোচচ্চড়ি, আলুরদম, আলুভাজা, নিমবেগুন, হিং বেগুন, বেগুন ভাজা, যাবতীয় শাক, আলুপোস্ত, আলুভাজা, পটলভাজা, পটলপোস্ত, মোচার ঘণ্ট, থোড়ের ছেঁচকি, আলুপটল, আলুফুলকপি, কুমড়োর ছক্কা, কুমড়োফুল ভাজা, উচ্ছেকুমড়ো, শিমচচ্চড়ি . . .

অর্চিষ্মানের সঙ্গে এ বাবদে এক শিবিরে আমি। পৃথিবীতে যে ক'টা কর গোনা রাজযোটক বিয়ে দেখেছি, একটা নিশ্চিতভাবেই ছোলে আর ভাটুরের। ফাটোফাটো, গমরঙা, ভালোমানুষ ভাটুরের পাশে গাঢ় শ্যামবর্ণ, হাই-ভোলটেজ ছোলে। এদের মধ্যে পনীরের পরকীয়া গোঁজার ধ্যাষ্টামোটা, সিরিয়াস ধ্যাষ্টামো। 

আরেকটা এই রকম অবান্তরতা হচ্ছে চিজ। ইউটিউবে স্ট্রিটফুডের ভিডিওতে স্যান্ডউইচের ওপর  চিজের থানইট ঘষে শেষ করছেন বিক্রেতা। ভিউজ মিলিয়ন ছাড়াচ্ছে।

যে যাই বলে বলুক, আমি জানি, হ্যাঁ, ট্রাই না করেই জানি, ও জিনিস মুখে তোলার অযোগ্য হবে। অখাদ্য হবে এক কেজি আমূল বাটারে ভাজা পাওভাজিও।

চিজ। রাইট। অর্চিষ্মান সায় দেয়। আবার আমরা সেম শিবিরে। চিজ পোরা পান বেরিয়েছে, শুনেছ?

ফায়ার পান বেরিয়েছে দেখেছ? মুখে পুরলে নেক্সট পাঁচ মিনিট দমবন্ধ সাসপেন্স। দিওয়ালির পরের সকালের চিরাগদিল্লির মোড়ের থেকেও গাঢ়তর গলগল ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন থাকবে খাইয়ের বদন।

দু’নম্বরেও হচ্ছে। কূলহড় মোমোর নাম দিয়ে খুরিতে মোমো পুরে একগাদা চিজ দিয়ে . . .  অর্চিষ্মান ম্রিয়মাণ হয়। দশহাতের মধ্যে দাদুর দোকান। বদসঙ্গে পড়ে যদি সিঙাড়ায় চিজ পুরে ভাজতে শুরু করেন . . . অর্চিষ্মান শিহরিত হয়।

সে অ্যাপোক্যালিপস এখনও আসতে দেরি আছে। অর্চিষ্মানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও আশ্বাস দিই।

কিছু বলা যায় না। রোলে অলরেডি এসে গেছে। ওকে ওর স্বভাবত নৈঃশব্দ্য ভেঙে রোল বানানোর সময় অ্যাকটিভলি মাঠে নামতে হয় আজকাল। না হলে চিত্তির। বিশ্বের সস, বিশ্বের মাংস, বিশ্বের পেঁয়াজ ঠাসাঠাসি হয়ে যে বস্তুটি হাতে আসবে, অর্চিষ্মানের কল্পনার রোলের সঙ্গে কোনও মিল নেই তার। ধরে ধরে বেচারাকে বলতে হয়, ব্যস ব্যস আর পেঁয়াজ না, আর কেচাপ না, মাংসও বরং আরেকটু তুলে রাখুন, চিজের দিকে তো তাকাবেনই না। আড়ালে বলে, পরোটা আর ডিমের স্বাদও তো পেতে হবে। 

সে তো হবেই। রোলের অন্যতম কি-কমপোনেন্ট হচ্ছে পরোটাটা। এ কী বারিটো পেয়েছ যে কাঁচা রুটির মধ্যে ভাত পুরে বিশ্বজয় করে ফেলবে? এগরোলকে আপ দেখাতে গিয়ে বারিটোকে ডাউন করার আমার এ উদ্যোগে সঙ্গ দেয় না অর্চিষ্মান। বারিটো ওর পেয়ারের। আজকাল যে অর্চিষ্মান অধিকাংশ সময়েই এগরোল অর্ডার করে, যা কি না পূর্বাশ্রমে আমার বেস্টেস্ট রোল ছিল, সেটাও দায়ে পড়ে। চিকেনমটন রোলের প্রতি ওর পক্ষপাত চিরকাল, এ বাবদেও কখনও আমরা শিবির শেয়ার করিনি।

বলি, আসল সমস্যাটা হচ্ছে অশ্রদ্ধা, বুঝলে না। এই প্রজন্মটার মধ্যে কোনও রেসপেক্ট নেই। না সিঙাড়ার প্রতি, না চিজের প্রতি, না ম্যাগির প্রতি। না হলে একটাকে আরেকটায় পুরে ভেজে দিত না। আর মায়াদয়ার অভাব। কতখানি হিংস্র হলে ফুচকায় চকোলেট সস ঢালে মানুষে?

উঁহু, ইস্যুটা রেস্পেক্টের না। অর্চিষ্মান পয়েন্ট ব্ল্যাংক রিফিউজ করে আমার শিবিরে আসতে। রাস্তার খাবার আমরা কেন খাই ভাবো তো? স্বাস্থ্যরক্ষার খাতিরে খাই না তো অবভিয়াস। খিদের খাতিরেও না। স্বাদও অতটা ম্যাটার করে না, যতটা নিজেদের বোঝাই। যেটা করে সেটা হচ্ছে খোলা হাওয়া, আকাশ, একহাতের মধ্যে রান্না হওয়ার সম্পূর্ণ প্রসেসটা প্রত্যক্ষ করা, ভিড়ের গমগম, আগুনের গনগন, পোড়া তেলের ঝাঁজ। এতরকম অলংকারের আয়োজন অলরেডি আছে রাস্তার খাবারের চারপাশে যে খাবারটাকে নিজেকে অকারণ সাজ পরতে হয়নি। সে থাকতে পেরেছে সোজাসাপটা, গিমিকশূন্য, অলংকরণহীন। এবং সেটাই এর স্ট্রেংথ। আঙুলে তুলে খেয়ে নেওয়ার। শালপাতা ছুঁড়ে হাত ঝাড়ার। তোবড়ানো স্টিলের জগ তুলে আলগোছে গলায় উপুড় করার। ছ'রকম সসের প্যাকেট জুটিয়ে যে স্ট্রেংথটা এরা মাটি করার মতলব ফেঁদেছে।

জীবনের মোচড়টোচড় হয় না বাবদে কী সব বাজে বকলাম জন্মদিনের পোস্টে, আলবাত হয়। পাপড়ি চাটের সঙ্গে প্রথম আলাপের দুপুরটা কুন্তলা বন্দ্যোর জীবনে একটা মোক্ষম মোচড়। একুশে পা পড়েছিল, সোনারোদ উঠেছিল, বেস্ট ফ্রেন্ডের কনুই জড়িয়ে অভিভাবকহীন শপিং করতে বেরিয়েছিলাম জীবনে প্রথমবার, শপিং সেরে আলুটিক্কি চাটের তপ্ত তাওয়া আর গোলগাপ্পার কাচের বাক্স পেরিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে লিনোলিয়াম মোড়া দোতলায় স্টিলের চেয়ার আর সানমাইকার টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলাম। জীবনে কখনও খাইনি শুনে বেস্ট ফ্রেন্ড বলেছিল, তাহলে পাপড়ি চাট নিই চল। স্টিলের প্লেটে করে সে চাট এসেছিল, চামচে করে মুখে দিয়ে দশ সেকেন্ড পর মুখ তুলে দেখি, মেয়ে খাওয়া স্থগিত রেখে বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে।

কিছু বলতে হয়নি, গম্ভীর মাথা নড়ে উঠেছিল। বলেছিলাম?

যে দোকানেই খেতে যাই না কেন মেনুতে পাপড়ি চাট দেখলে যে অর্ডার করে বসি, বাকি অর্ডারের সঙ্গে মানানসই হোক না হোক, তা যতটা চাটের প্রেমে ততটাই ওই সহজসরল দুপুর আর সোজাসাপটা বন্ধুত্বে ফিরে যাওয়ার প্রার্থনায়। কয়েকমুহূর্তের জন্য হলেও। 

এ অভিজ্ঞতা অর্চিষ্মানের সঙ্গেও তো কতবার ভাগ করে নিয়েছি। মান্ডি হাউসের মেট্রোর উল্টোদিকে কুলচাছোলের ঠেলায় পেতলের হাঁড়ি কাত হয়ে ছিল, ভদ্রস্থ পরিমাণ তেলে পেঁয়াজ ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে চেপে চেপে বাড়ি থেকে আনা আধসেঁকা কুলচায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হচ্ছিল, পাশের শকরকন্দ চাটের ঠেলা থেকে ধূপের গন্ধ আসছিল, ডিসেম্বরের বেলা তিনটের রোদে ভিড় জমছিল, গণ-হুসহাসের শব্দে নার্ভাস হয়ে একজন কানের কাছে ফিসফিস করে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, বহোত তিখা হ্যায় কেয়া ম্যাডামজি? অর্চিষ্মানের আই কন্ট্যাক্ট এড়িয়ে নিঃসংশয় ঘোষণা করছিলাম, পারফেক্ট হ্যায়, করে যুবক বিক্রেতার চকিত কৃতজ্ঞ দৃষ্টিপাত উপহার পাচ্ছিলাম।

কুলচার ভেতর চিজ পুরে দিলে আর গণ্ডায় গণ্ডায় সসের প্যাকেট সাপ্লাই করে ওই অভিজ্ঞতা রেপ্লিকেট করা যেত? পাঁচ বছরের বাচ্চাও উত্তর জানে।

আমরা তো বিহার ভবনের সাজানো ঘরে শহুরে লিট্টি খেয়েই আহাবাহা, অর্চিষ্মান বিহারে গিয়ে লিট্টি চোখা খেয়ে এসেছে, একেবারে রাস্তার, লিট্টি হাতে করে ভেঙে ছড়িয়ে ডালের মধ্যে দিয়ে খেয়ে অফিসকাছারি যায় লোকজন। ও জিনিস না খেলে বুঝবে না লিট্টি খেতে আসলে কেমন। সে ইস্তক আমার বাকেট লিস্ট, বিহারের ধুলোমাখা বাসস্ট্যান্ডের লিট্টিচোখা না খেয়ে মাঠ ছাড়ছি না। আমাদের নিজের রাজ্যও তো আছে। বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়ার ফিল্ড থেকে রোজ ছবি পাঠাত অর্চিষ্মান। পুকুরের, গাছের, মুরগিছানার। এত সুন্দর জায়গা আমাদের ঘরের কাছে, ঘাড়ের ওপর? ফোনে অর্চিষ্মানের গলায় উচ্ছ্বাসের সঙ্গে শোকও টের পেতাম, এখানে লোকে ব্রেকফাস্টে তেলেভাজা খায়, জানো? বাসস্ট্যান্ডে, অটোস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে ধামাধামা মুড়ি আর তেলেভাজার ঝুড়ি নিয়ে ভোরভোর বসেন বিক্রেতারা। ইয়াব্বড় ঠোঙাভর্তি মুড়ি আর ছোট দুটো চপ প্যাক করিয়ে জগতের আনন্দযজ্ঞে নেমে পড়ে জীবনের স্রোত। অর্চিষ্মানের সহকর্মী ফ, শহরের মহার্ঘ রেস্টোর‍্যান্টে কিংবা হোল ইন দ্য ওয়ালে, কাবাব খেয়ে আহাবাহা বলে উঠে বাকিদের প্রত্যাশা মিটিয়েছিল, তারপর ভিড়ের অল্প পেছনে হাঁটতে হাঁটতে অর্চিষ্মানকে বলেছিল, একবার আমাদের দেশের বাড়ি চল। সন্ধে নামলে রাস্তার ধারে তন্দুর নিয়ে বসে চাচাভাতিজার দল, কাবাব ভেজে শালপাতার প্লেটে করে দেয়। মাথার ওপর ছাউনি নেই, চিলড কোকের আশা রেখো না। সেই থেকে হেমন্তসন্ধের হিমে, পোড়া মাংসের ওমে, ধুলোপথে দাঁড়িয়ে বা পায়াভাঙা বেঞ্চিতে বসে গরম কাবাব মুখের ভেতর পুরে ফ-এর সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠা অর্চিষ্মানের বাকেট লিস্টে। আমারও। আমিও যাব ল্যাংবোট হয়ে। কাবাব না খাই, ওই হিম আর ওম আর হেসে ওঠাটুকুর ভাগ ছাড়ছি না।

অনলংকৃত অখাদ্যকুখাদ্য, নিরাভরণ বাঁচা আর ভণিতাহীন বন্ধুত্ব - জীবনের এই তিনটে জায়গায় আমি আর অর্চিষ্মান এক শিবিরে। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন বাকি কোন শিবিরে আলাদা হলাম, হু কেয়ারস?

Comments

  1. Asamanyo likhechhen Kuntala : Apnar kolom thuri keyboard Nabaneeta Debsener moto :) Ar e niye ami ar Raka ontoto ekmot :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ মা, সায়ন, আমার কলম আমার মতো বললেন না কেনওওওওওও 😭😭😭😭😭 এ বিষয়ে আপনি আর রাকা একমত হলে আরও কত্ত খুশি হতাম 😭😭😭😭😭

      রসিকতা করছি, বলা বাহুল্য। যাঁর মতোই হোক, আপনাদের যে আমার লেখা মনে ধরে সেটাই আমার ভয়ানক, ভয়ানক ভালোলাগা আর প্রাপ্তি আর সৌভাগ্য আর কৃতজ্ঞতার জায়গা। থ্যাংক ইউ। আপনি আর রাকা এ শিবির ও শিবির করে ভীষণ ভালো থাকুন এই কামনা করি।

      Delete
  2. Lekha ta porte giye koto rokom je gondho pelam, ar jibher dogay koto swader smriti khele gelo, ki bolbo.
    Pochhonder khabare eshob amalgamation r adulteration just newa jayna. Mone achhe amader chhotobelay chocolate flavour er Maggie namok ek bhoyaboho bostu hoechhilo. sheta dokane pawa jeto kina mone ei, tobe school e sample taste koriechhilo. Chocolate momo, chocolate fuchka shunlei amar shei bibhishika mone pore.
    Beche thak shekele form e shobar shob priyo khabar.

    ReplyDelete
    Replies
    1. চকোলেট ম্যাগি!! মাগো এ জিনিসের সঙ্গে মোলাকাত তো হয়নি, ঈপ্সিতা। এ তো সিরিয়াসলি কল্কি অবতার। এই বিষয়ে একদম একমত, যে কিছু জিনিসের ফর্ম বদলানোর কোনও দরকার নেই। তারা অলরেডি পারফেকশনের শিখরে আছে। ফুচকা ও ম্যাগি, তাদের মধ্যে দুটি।

      Delete
    2. ekta mishti maggi'o chhilo - bhishon kharap khete!

      Delete
    3. হোয়াট!!!! এ সবের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়নি কেন!!! অবশ্য যে ভালোই হয়েছে কারণ হলে কী হত ভেবে শিউরে উঠছি। সামনে যাকে পেতাম তার প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠা এড়ানো গেছে।

      Delete
  3. ওহ এই সবেতে চীজ দেওয়া, আর যার সঙ্গে নয় তাই খাওয়ার একটা আশ্চর্য সমস্যা তৈরী হয়েছে। বিরিয়ানিতে চকলেট সস, মোমো স্যান্ডউইচ!!! ভাই কি খাচ্ছিস কেন খাচ্ছিস দেখ একবার! ওরিও পকোড়া! কি না ওরিওকে ভেজে নেওয়া একবার তেলে।
    আমার মনে হয় আমাদের জীবনে এত বেশী ইন্সট্যান্ট গ্যাজেটস আসছে, সুবিধে আসছে, স্বাচ্ছন্দ্য আসছে আরো চমক, আরো অভিনবত্ব চাইছে সবাই। এক মুহূর্ত স্বস্তি নেই, সরলতা নেই।
    লেখাটা মচৎকার হয়েছে বলাই বাহুল্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. 😀😀😀 কমেন্ট পড়তে পড়তেই তোমার হতাশ মাথানাড়াটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, প্রদীপ্ত। ভালো ও লাগছে। একা ঘরে হাসিমুখে বসে আছি। তোমার রোগনির্ণয় একেবারে অকাট্য। একমুহূর্ত শান্ত হয়ে বসতে পারছে না লোকে। সর্বক্ষণ স্টিমুলেশন চাই। সেটা যদি বিরিয়ানিতে চকলেট সস মাখিয়েই পাওয়া যায়, সেও ভি আচ্ছা। ভালো থেকো। বড়দিনে খুব আনন্দ কোর।

      Delete
  4. Khub bhalo hoyechhe ei lekhata. Oi makhon ar cheese er adhikyo-r fole amader street food er oitijhyo khatre me hai!!! Keema phuchka oboshyo ami badite prochur kheyechhi, ebong amar khub priyo. Kajei, oita baad diye, bakitar shathe ekmot. Merry Christmas.
    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই দেখুন, সুতীর্থ, আপনার কমেন্ট পড়ে দুটো তীব্র অনুভূতি ঠেলাঠেলি করছে। প্রথমটা, আমোদ। খতরেঁ মে হ্যায় পড়ে খুব হাসছি। খতরেঁ মে-ই বটে। ইদানীং লোকজন ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে খাঁড়া উঁচিয়ে আছে বিশ্বের যাবতীয় বিষয়ে, এদিকে বড়াপাও বার্গার দিব্যি মুখ বুজে খেয়ে নিচ্ছে! সে বেলা কারও হেলদোল নেই।

      সেকেন্ড অনুভূতিটা হচ্ছে মাথাচাপড়ানি। কিমা-ফুচকার জায়গায় পনীর ফুচকা লিখেছিলাম, অন গড ফাদার মাদার। সেই পনীর ফুচকা লেখা পোস্ট বেশ কয়েক ঘণ্টা পাবলিশড অবস্থায় ছিলও। তারপর ভাবলাম যে নিজেই অত কথা লিখে আবার নিজেই পনীর ব্যাশিং করাটা ভালো দেখাচ্ছে না, তাই পনীর কেটে কিমাকে ক্রুশকাঠে চড়ালাম। তাতে আপনার মতো একজন বন্ধুর খাদ্যাখাদ্যের পছন্দঅপছন্দ নিয়ে নিজেকে কেমন জাজমেন্টাল প্রমাণ করে ফেললাম সেই ভেবে আফসোস হচ্ছে।

      আপনি প্রেমসে কিমা ফুচকা খাওয়া চালিয়ে যান। আমি পারলে আমিও খেতাম। আপনার অনারে আমি সয়া-কিমা ফুচকা ট্রাই করে দেখব একদিন। নির্ঘাত পাওয়া যাবে কোথাও না কোথাও। দাঁড়ান সার্চ মেরে দেখি।

      Delete
    2. Are duur. Abantor er taan tai to eikhane je prem se, kono kichhur toakka na kore, moner kotha ta shona jai. Honesty is the best fresh air available. Apni jodi political correctness, judgmentalism, wokeness, ityadi niye byasto hoye poden, to amra, orthaat apnar guno-mugdho pathhok-pathhika ra, kothay jai bolun to? Besh korechhen kima fuchka ke na posond-er list e dhukiye. Apnar blog, apnar list, apnar morji!!! Have fun!

      iti
      Shuteertho

      Delete
    3. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, সুতীর্থ।

      Delete
  5. Tu cheesem bari hain mast mast :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. 😂😂😂😂ইস, কতদিন শুনি না গানটা। যাই শুনে আসি। মনে পড়ানোর জন্য থ্যাংক ইউ, রণিতা।

      Delete
  6. ki darun lekha!
    teerashi nombor tomo boring call er majhkhane pore phellam - ajke lunch skip hoyechhe tai fridge theke frozen pork momo niye gorom kore khachhi! :-D No cheese! No mayo!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, ভাগ্যিস ধরাবাঁধা লাঞ্চ স্কিপ হয়েছিল, তাই কেমন সুন্দর অ্যাড হক লাঞ্চ খেলে, কেকা।

      Delete

Post a Comment