মুরথল



রাত আড়াইটেয় ঘুম ভেঙে করণীয় কাজের লিস্ট বিশেষ লম্বা নয়। জলপান। বাথরুম ভিজিট। অন্ধকারে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকা। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবা, বা উপলব্ধি করা, ভাবার মতো বিষয়ও আর বাকি নেই, সব ভাবনা ছিবড়ে হয়ে গেছে।

মগজ হাই তুলে বলে, মুরথল গেলে হয়।

যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন, মুরথল যাওয়ার জায়গা নয়। মুরথল কেউ যায় না। যেমন হাওড়া কেউ যায় না। কলকাতা যেতে হলে হাওড়া ছুঁয়ে যায়। যেমন এম ফিল। খামোকা কেউ করে না, যদি না পি এইচ ডি-র উচ্চাশা থাকে। যেমন বিয়ে। এমনি এমনি কোনও পাগলে করে না, আসল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য সন্তানসন্ততি উৎপাদন যা পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতির এন্ড গোল। আর আপাতত আমাদের সমাজের যা ভাবগতিক তাতে বাচ্চা উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের আদর্শ আবহাওয়া এখনও বিয়েই দিতে পারে, কাজেই।

তবু কিছু কিছু লোক এমনিই বিয়ে করে। জিনটিন ছড়ানোর এন্ড গোল নেই, তবু। কারও কারও কলকাতা যাওয়ার কোনও দরকার না থাকলেও হাওড়া যায়। গিয়ে ফিরে আসে।

মুরথল যাইনি, কিন্তু মুরথলের পাশ কিংবা ওপর দিয়ে অনেকবার গেছি। পাহাড়ে, যেখানে একসময় ঘনঘন যেতাম, যেতে গেলে মুরথল এড়ানো যায় না। মুরথল বিখ্যাত ধাবার জন্য। ধাবা বলতেই যে দড়ির খাটিয়া আর সরসো দা সাগের সোঁদা ঘ্রাণ, দশাসই সর্দারজীর অমায়িক হাঁকাহাঁকি, আপনার কল্পনার এই সব স্টিরিওটাইপে টিক দিতে মুরথলের ধাবাদের বয়ে গেছে। শুধু সাইজ ম্যাটার করে বলেই তারা প্রকাণ্ড অবয়ব ধারণ করেছে। সর্বাঙ্গে টুনি বাল্ব সেঁটে চকমক চকমক করছে স্রেফ চোখে পড়ার জন্যই। চব্বিশঘণ্টা কাকচিল তাড়িয়ে 'জয় মাতাদি' কিংবা ‘মুহ্‌ বন্ধ রখ্‌খেগি, মেরা সাথ চলেগি’ র‍্যাপ চালিয়ে রেখেছে কেবল লোকের কানে অন্য কিছু ঢুকতে অ্যালাউ করবে না বলেই।

মুরথল মিস করার ভুল সংশোধনের ইচ্ছে আগেও জেগেছে। অফিস যাওয়ার পথে, লাঞ্চ সেরে উঠে, সন্ধেবেলা জ্যামে আটকে। মগজে ঘাই মেরে মিলিয়েও গেছে। রাত আড়াইটের মহিমাই হবে, ইচ্ছেটা এল এবং গেল না।

উল্টে কৌতূহল প্রকাশ করল। কীভাবে যেতে হয়?

সোজা উত্তরটা হচ্ছে অন্য কোথাও যাও, পথে মুরথল পেয়ে যাবে। কিন্তু এ উত্তর কাজের না। ওই মুহূর্তে অন্য কোথাও যাওয়ার আমার দরকার নেই। গেলে মুরথলই যাব। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম, ব্রেন যদি বোর হয়ে অন্য ভাবনায় মুভ অন করে যায়। গেল না। উল্টে 'গেলেও হয়' থেকে 'গেলেই হয়' হয়ে 'যাওয়া যাক'-এর দিকে রওনা দিল। কালীবাড়ির পাশের রেঙ্গুন ট্যাক্সি সার্ভিস? নাকি উবার রেন্টাল? ক'ঘন্টার বুকিং? কত কিলোমিটার ইনক্লুডেড? কত মিনিট কত সেকেন্ড পার হলে বাড়তি চার্জ শুরু? শুরু হলে সেটা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে ইত্যাদি হিসেবনিকেশ।

ঘুম ততক্ষণে সম্পূর্ণ ছুটে গেছে। ভাবছি রেন্টাল শেডিউল করেই ফেলি। উইকেন্ড?

রাত আড়াইটের, ততক্ষণে তিনটে বাজতে পাঁচের, মগজ ভুরু তোলে। আবার উইকেন্ড কেন? মঙ্গলবারের শেষরাত দোষ করল কীসে? ঘূম তো আর আসবে না। চুল আঁচড়ে বেরিয়ে পড়লেই হয়।

আর অমনি জগতের সবকিছু ভালো লেগে গেল।

অবাক হলাম, কারণ আজকাল আর কিছুই ভালোলাগে না। লাগলেও নাতিশীতোষ্ণ ভালোলাগে, সতর্ক ভালোলাগা, মাপাজোকা ভালোলাগা। যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রাজেশ খান্না। সবথেকে খারাপ, কংক্রিট কারণ লাগে ভালোলাগতে। খিদের মুখে খাবার লাগে, তেষ্টার মুখে জল, মনখারাপের মুহূর্তে ইগোর সর্বাঙ্গে হাততালির মালিশ। ইন্দ্রিয়, ইগো অতিক্রম করা ভালোলাগাদের আর খবর পাই না। যেমন ইচ্ছে হল আর করে ফেললাম-এর ভালোলাগা। চল যাবি? বললাম আর বেরিয়ে পড়লাম-এর ভালোলাগা। যেমন বাইশ বছর বয়সে পারতাম। রাতভর বব ডিলানের পিণ্ডি চটকে ভোরবেলা আর টি ডি সি-র বাসে করে চলে গেলাম জয়পুর। হাওয়াই চটি বদলে ঠিকঠাক জুতোও পরলাম না।

শেষরাতের শহরের বৃষ্টিধোয়া ফাঁকা রাস্তা সঙ্গে সঙ্গে চলল। সিগন্যালের আলো গলে গলে জানালার কাচ বেয়ে নামতে লাগল। রেডিও মিরচি-তে বাজতে লাগল ওল্ডিস গোল্ডিসরা - যারা, অ্যামিউজমেন্ট মিশ্রিত আতংকের সঙ্গে উপলব্ধি করলাম, আমার কিশোরবেলার। শহর ফুরোল। মাঠ শুরু হল। এই সব মাঠেই আক্ষরিক কুরুক্ষেত্র বেধেছিল, যতবার ভাবি গায়ে কাঁটা দেয়। তারপর অন্ধকারের মধ্যে আচমকা লাল নীল সবুজ আলো একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে এমন ঝিংচ্যাক লাগাল যে বুঝলাম মুরথল এসে গেছে।

অম্রিক সুখদেব, মুরথলের ধাবাদের মাফিয়াসর্দার, সেখানেই যাওয়া হল। সুখদেব দুটো, বলা উচিত দুজন আছেন, একজন পানিপথের এদিকে আরেকজন ওদিকে। এদিকের জনের কাছেই গেলাম। আশেপাশের সব ধাবার থেকে বেশি উঁচু, সামনে সবথেকে বেশি সংখ্যক এস ইউ ভি অপেক্ষারত। কান ফাটিয়ে 'জয় মাতা দি' বাজছে।

সবাই যা খায়, তাই অর্ডার দিলাম। পরোটা। একটা মিক্স, একটা আলু। ওর থেকে ভালো পরোটা বাড়িতেও অনেকসময় হয়। সঙ্গের ডাল মাখনি, সেটা অবশ্য বাড়িতে হয় না, হলেও অত ভালো হত না। বুঁদির রায়তা চলনসই, দু’রকম আচারের মিক্সডটাও যেমন হওয়ার কথা তেমনই। লেবুর আচারটি বলার মতো ভালো। বাড়ির জন্য এক শিশি কিনে আনার মতো ভালো। আর যে বিষয়টা নিয়ে সকলেই হুটোপাটি করে, পরোটার ওপর খাবলা সাদা মাখন, নন-ইন্ডাস্ট্রিয়াল উপায়ে তৈরি, ক্যালেন্ডারে নীল রঙের শিশু কৃষ্ণের থাবায় মাখানো বস্তুটির মতো দেখতে, সেটাও আমার হইচই বাধানোর মতো কিছু মনে হয়নি। আমাদের বেড়ে ওঠার মাখনের সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে, ব্যস এইটুকুই। শেষমেশ চা, দরকারের থেকে বেশি দুধ দিয়ে। দিব্যি।

অর্ডার করছিলাম যখন অন্ধকার, পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরছিলাম যখন অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে, চায়ের কাপ হাতে নিতে না নিতে বাইরে ধপধপে আলো হয়ে গেল আর সাবানজলের বালতি আর মপের লগা দিয়ে ভাইসাবরা কাচের দেওয়াল ধোয়াতে শুরু করলেন। সূর্য ওঠা আর ডোবার সময়টা বোঝা যায় পৃথিবীটা আসলে কী বাঁইবাঁই ঘুরছে, কে বলবে সারাদিন এর কেমন পি পু ফি শু চলন ছিল।

বাড়ি ফেরার পথে ভাইসাবেরও তাড়া দেখার মতো। যাওয়ার সময়ের প'নে দুঘণ্টা কমে দাঁড়াল এক ঘণ্টায়। দশটার মধ্যে আটটা সিগন্যাল ভাঙলেন, গোটা রাস্তাটা সামনের সিট আঁকড়ে বসে থাকলাম।

নেমে বুকধড়ফড় কমাতে চা খেতে হল। মানে বাড়িতে ঢুকে তো খাবই, কিন্তু যতক্ষণ না ঢুকছি ততক্ষণের ঠ্যাকনা আরকি। মেলাগ্রাউন্ডের বাইরের ভদ্রলোকের চায়ের প্রশংসা অনেকদিন শুনছিলাম, চিনি ছাড়া হবে কি না বলতে যে রকম মুখ করলেন তাড়াতাড়ি 'চিনিশুদ্ধুই চলবে' বলতে হল। চিনিশুদ্ধু চাও দিব্যি চলনসই। কাজেই প্রশংসা মিথ্যে নয়।

ওই সময়টা পাড়ার কুকুরদের এক্সারসাইজের সময়। বিভিন্ন সাইজের, রঙের, দামের কুকুরেরা বকলস পরে মেলাগ্রাউন্ডে জড়ো হয়েছে। অড ওয়ান আউট এক নেড়ি, যে নিজেই নিজের মালিক, কিন্তু একেবারে বেওয়ারিশ বোধহয় নয় কারণ গলায় একটি ফিতে বাঁধা। তীরবেগে এসে দামি বেরাদরদের জটলায় ঢুকে পড়ে হল্লা বাধিয়ে দিল। বাকিরা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ল, বন্ধুত্বপূর্ণ হাতাহাতি এবং বকলস খুলে দেওয়ার পর মাঠ জুড়ে দৌড়োদৌড়ি চলল। প্রবল ল্যাজ নাড়ানাড়ি। এ বন্ডিং একদিনে হওয়ার নয়। অর্থাৎ এ জিনিস রোজই ঘটে।

সেই থেকে মাঝে মাঝেই নেড়িটার কথা মনে পড়ছে। এই যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ফারাক সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংকোচ না বোধ করে অবলীলায় যারতার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর কনফিডেন্স, যদি আমার থাকত।

Comments

  1. Murthal-er bishoy jabotiyo boktobyer shonge shompurno ek mot. Jemon murthal keu jaye na. Onno kothao gele tobe murthal jawa jete para jaye...emon ki murthal ke mashoor paratheo amaar murthal er theke onno jaigae beshi bhalo legechhe...
    Kintu oi...karon chharai kichhu jinish kore phela jaye...May masher bhot belae Murthal giye alu kr parathaeo khawai jaye

    ReplyDelete
    Replies
    1. পরোটাটাই সবথেকে আন্ডারহোয়েল্মিং, ঠিকই বলেছ, অর্পণ। তাতে অসুবিধে নেই, কারণ পরোটাটা পয়েন্ট ছিল না। আসল ছিল উঠল বাই তো মুরথল যাই-এর ব্যাপারটা। সেটা সফলভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে।

      Delete
  2. Murthal er paratha anekbar kheyechi. Tobe sob bar i kothao jabar somoy - Shimla/Manali/Chandigarh/Chhail. Amrik Sukhdev e akbar kheyechhi kintu amra jabar somoy borabor 'Garam Dharam Dhaba' (Dharmendra theme) te khai ar asbar somoy 'Mannat' e - always.
    Jabar somoy monta khushi khushi thake ar asbar somoy onnorokom :/

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাহ, তোমাদের ধাবার রুটিন আছে জেনে ভালো লাগল, রণদীপ। এটা ঠিকই বলেছ, যাওয়া আসার সময় মুড আলাদা থাকে কাজেই খাওয়ার জায়গাও আলাদা হওয়াই উচিত। যদি কোথাও যাওয়ার পথে মুরথলে নামি, বা মুরথলেই যাই এবারের মতো, তোমাদের ধাবা দুটো ট্রাই করব।

      বাই দা ওয়ে, চৈল কেমন গো? ভাবছি গেলে হয়।

      Delete
    2. Onek ta Kashauli r motoi. Khub shanto ar bhir ta ektu kom.. akta Kali tibba temple ar akta palace (3 idiots). Relaxing trip..

      Delete
    3. বুঝলাম। থ্যাংক ইউ 🙂

      Delete
  3. এই যে ইচ্ছে হল যেতে পেরেছ ব্যস আর কী চাই! চমৎকার লাগলো। আরো এরকম হুটহাট বেহিসাবী ভালোলাগার মুহূর্ত তৈরী হোক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও সেইরকমটাই চাওয়া, প্রদীপ্ত।

      Delete
  4. বাহ...অনেকদিন বললাম আর বেরিয়ে পড়লাম এরকম টা করা হয়নি... উৎসাহ নিচ্ছি :)

    ReplyDelete
  5. ভালো লাগলো পরে। সত্যি, একটা সময়ে কত সহজে এরম বেরিয়ে পড়া যেত।

    তবে দেড় বছর বাড়িতে আটকে থাকার এফেক্টে, এই জানুয়ারীতে প্রত্যেকটা উইকএন্ডে বেরিয়ে পড়ছিলাম এরম, কোলকাতার হটাৎ লকডাউনটা জারি হবার দুটো উইকএন্ড বাদ দিয়ে। অবশ্য "সবাই যায়" এরম জায়গাগুলোতেই যাচ্ছিলাম। সব দেখার পর মনে হল যে এর থেকে "যাওয়ার জায়গা নয়" তে যাওয়াই হয়ত ভালো - কারণ সব জায়গায় কলকাতার পূজো প্যান্ডেলের মতো উপচে পড়া ভিড় পাচ্ছিলাম !

    "পি পু ফি শু" দেখে মনে হল এই গল্প কি নতুন প্রজন্মরা আর জানবে ? কে জানে... তবে ওদের নতুন গল্প থাকবে নিশ্চই...

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয় থাকবে, রাজর্ষি। এ রকম বেরিয়ে পড়া বিরল থেকে বিরলতর হয়ে উঠেছে আমাদেরও। তাই এত ব্যাখ্যান করে লিখলাম।

      Delete
  6. কি সুন্দর মেজাজি ভাবে লিখেছেন। খোশগল্প আবার খাবার এর ও গল্প। সাইয়েদ মুজতবা আলি সাহেবের লেখার কথা মনে পড়ে গেল। ভাল থাকবেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, শর্বরী। ভালোলাগা জানালেন, মন ভালো হয়ে গেল।

      Delete

Post a Comment