পনেরো


কথাটা আমার মাথাতে এসেছিল। রাদার কথাটা যে উঠতে পারে সেই কথাটা।

কসোল পোস্ট অত ডিটেলে লিখলাম কী করে? যে রকম ক্লেম করলাম সে রকম নেশা হলে তো এত খুঁটিনাটি মাথায় থাকার কথা নয়।

রইল কারণ খুঁটিনাটিগুলো যখন ঘটছিল সবগুলোতে আমি আঙুল দিয়ে দিয়ে রাখছিলাম যাতে লেখার সময় মনে থাকে।

অবান্তরে লিখব বলে দিবারাত্রের যাবতীয় অভিজ্ঞতা পাহারা দিচ্ছি ধরা পড়ে গেলে এখনও লজ্জা হয়। যে লজ্জার ইংরিজি শেম, সেই লজ্জা। কবিতা না, উপন্যাস না, প্রবন্ধ না, ফেসবুক না, ওয়র্দি গেটকিপারের পাহারা পেরোনো ওয়র্দি সাহিত্যসৃষ্টি করব বলে না । অবান্তরে লিখব বলে।

অর্চিষ্মানের কাছে হয় না। 'এখানে চল' 'ওখানে যাবে?' দুয়ের বেশি তিনবার বললে ও বলে কেন গো? ব্লগ লিখবে? পাত্তা দিই না। বাড়ি থেকে দরজা এক ইঞ্চি ফাঁক রেখে 'চাবি তোমার কাছে তো?' জিজ্ঞাসা করতে করতেই পোস্টের প্রথম লাইনটা অলরেডি মাথায় এসে গেছে লজ্জা না পেয়ে ওর কাছে স্বীকার করতে পারি। বাকিদের কাছে লজ্জা পাই।

এই লজ্জা পাওয়া আমাকে আরেক প্রস্থ লজ্জা পাওয়ায়। লজ্জার অনন্ত আয়নাঘরের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি। সকালে চোখ খোলার আগে ছি ছি ছি ছি ছি শুরু হয়, রাতে চোখ বোজার আধঘণ্টা পর পর্যন্ত মাথানাড়া চলতে থাকে। মনে করাতে হয় একা নই, অনেকেই আমার মতো। সেদিন চলচ্চিত্র পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী বললেন, আই অ্যাম পারপেচুয়ালি অ্যাশেমড। যাক, কিন্ড্রেড স্পিরিট। ইন্দ্রনীল জানালেন গ্রামশি নাকি বলেছেন শেম ইজ আ রেভলিউশনারি সেন্টিমেন্ট।

খোঁজ নিতে গেলাম। গ্রামশির নাম পেলাম না। বরং খোদ মার্ক্স আত্মপ্রকাশ করলেন। আঠেরোশো তেতাল্লিশ সালে হল্যান্ডে এক বজরায় ভাসতে ভাসতে আর্নল্ড রুজকে চিঠতে লিখেছিলেন মার্ক্স।

"From both the French papers and the local ones I see that Germany has ridden deeply into the mire and will sink into it even further. I assure you that even if one can feel no national pride one does feel national shame . . . And the opinions of foreigners about the Prussian government! There is a frightening agreement, no one is deceived any longer about the system and its simple nature. So the new school has been of some use after all. The glorious robes of liberalism have fallen away and the most repulsive despotism stands revealed for all the world to see.

This, too, is a revelation, albeit a negative one. It is a truth which at the very least teaches us to see the hollowness of our patriotism, the perverted nature of our state and to hide our faces in shame. I can see you smile and say: what good will that do? Revolutions are not made by shame. And my answer is that shame is a revolution in itself . . .Shame is a kind of anger turned in on itself. And if a whole nation were to feel ashamed it would be like a lion recoiling in order to spring."

একটা গোটা লজ্জিত জাতি কুঁকড়ে যাওয়া সিংহ হলে পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চির লজ্জিত কুন্তলা অন্ততঃ একটা কুঁকড়ে যাওয়া আরশোলা হবে। লজ্জার ভার বইতে না পেরে একদিন ঘরময় উড়তে শুরু করবে, টিউবলাইটে গোঁত্তা খাবে, সুইসাইডাল হয়ে ফ্যানের বিপজ্জনক রকম কাছ ঘেঁষে ছুটে যাবে, বাড়ির লোকজনের নাকে কানে চশমায় ফরফরিয়ে ধাক্কা খাবে। অর্চিষ্মানকে সাবধান করে রাখতে হবে এইবেলা।

মার্ক্সই হোন বা গ্রামশি, আমার আর আমার চেনা অধিকাংশ লোকের থেকে বুদ্ধিমান মানুষ শেমকে বৈপ্লবিক শিরোপা দিয়েছেন। কাজেই আজকাল লজ্জা বা শেমকে অন্য চোখে দেখার চেষ্টা করছি। অরিজিন্যাল শেম না কমলেও শেমজনিত শেম কমার দিকে। যার মধ্যে অবান্তরসংক্রান্ত শেমও পড়ে।

লজ্জা পেয়ে, না পেয়ে অবান্তর লিখে গেছি পনেরো বছর ধরে। অদ্ভুত কিছু না ঘটলে - অবশ্য যথেষ্ট অদ্ভুত জিনিসপত্র ঘটেছে এই পনেরো বছরে, অবান্তর থামেনি - কাজেই অদ্ভুত কিছু না ঘটলে বা ঘটলে, লজ্জা নির্লজ্জতার দোলনায় দুলতে দুলতে অবান্তর টিঁকে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। মাও টের পেয়েছিলেন ব্লগ লেখাটা শখ ছেড়ে অবসেশনের দিকে যাচ্ছে, হয়তো কাজের কাজ ছেড়েও লিখতে পারি বা কোনও কাজ থেকে পালাতে। টের পেয়ে সাবধান করেছিলেন। একবার ছাড়ার চেষ্টা করেই দেখ না সোনা। ছ’মাস না লিখলেই ছেড়ে যাবে। মনেই পড়বে না

ছ’বছর হতে না হতে মায়ের না থাকাটাই জলভাত হয়ে গেল, অবান্তরকে ভুলতে ছ’মাসের বেশি লাগত না। হয়তো ভুললে ভালোই হত, আরও লাভজনক জিনিসপত্রে সে ফাঁক ভরাট হত। মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ হতে তো দেখলাম না।

তবু, এ ব্যাপারে মায়ের কথা না শুনে ভালোই করেছি। ভালোই হয়েছে অবান্তরকে ভুলতে ছ’মাস খরচ না করে। করলে নিজের এই আশ্চর্যরকম অর্ডিনারি জীবনটার প্রতি মনোযোগে ঢিলে পড়ত। আমি তো বাঞ্জি জাম্পিং করতাম না, জাস্টিস চেয়ে মিছিলে হাঁটতাম না, পৃথিবীর আধখানা মানুষের জীবন বদলাতে পারতাম না। নিজেরটাই পারছি না। যত দিন যাচ্ছে টের পাচ্ছি অটো চড়ে দিল্লি শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ানোই আমার জীবনের একটিমাত্র সুর হয়ে উঠছে। অবান্তর না থাকলে সেই সুরটা অত কান পেতে শুনতাম না। সেদিন সফদরজং মার্গ দিয়ে যাওয়ার সময় পথিপার্শ্বে তাজা সবুজ ঘন উঁচু নিমগাছের সারি জীবনে প্রথমবার নোটিস করার বিস্ময় ফোন করে জানানোর মতো আর কেউ নেই। হোয়াটসঅ্যাপে লেখা যায়, কিন্তু সারাদিনের অবান্তর কথোপকথনের ভিড় একার দায়িত্বে বাড়িয়ে যেতে কুণ্ঠা হয়। ফোর এস থেকে ফেরার পথে চলন্ত অটোর ফোঁকর দিয়ে হাত বাড়িয়ে মাঝরাত-পেরোনো চাঁদের ছবি নেওয়ার চেষ্টা করলে অটো ভাইসাব যখন বলেন হাথ অন্দর কিজিয়ে ম্যাডাম, বুঝতে না পেরে পাঁচবার কেয়া? কেয়া?-র পরেও ধৈর্য না হারিয়ে ছ'বারের বার থেমে থেমে বলেন, হাথ অন্দর কিজিয়ে, পিছে সে বাইক লেকে আয়েগা, ফোন উঠাকে নিকল যায়েগা, তখন ওওও সমঝা-র ভুল লিঙ্গপ্রয়োগ মনে করে রাখি। যদি কোনওদিন অবান্তরে লেখার প্রসঙ্গ ওঠে।

নোমাডে বসে বারিটো বোল খাওয়ার সময় দূরে ইলেকট্রিকের তারে পাঁচটা পায়রা বসে থাকে সারি দিয়ে, একটা উড়ে গেলে বাকিরা দুলে দুলে সরে সরে জায়গা ভরাট করে। পনেরোই অগস্ট ব্রেকফাস্টে গিয়ে দোকান বন্ধ পেয়ে নতুন দোকানে যাই, মোড়ে মোড়ে দীর্ঘদেহী, ভুঁড়িহীন পুলিস যাঁদের অনেকেই মডেলিং ট্রাই করতে পারতেন, মোটরবাইকে হেলান দিয়ে সেলফি তোলেন। অবান্তর না থাকলে এই অবান্তর দেখাগুলো কাউকে বলার থাকত না।

লজ্জা কমছে। কমতে কমতে একদিন হয়তো শূন্য ছোঁবে। তারপর কে বলতে পারে হয়তো গর্বের স্কেল চড়তে শুরু করবে। জীবনটা নিয়ে কী করলে জানতে চাইলে অবান্তরকে বার করে দেখাব। এই যে। এটা করেছি। সারাদিন ধরে করেছি, সবটুকু দিয়ে করেছি। আমার দ্বারা যতখানি সিরিয়াসনেস, যতখানি সততা, যতখানি এনার্জি, যতখানি উদ্যম, যতখানি নিষ্ঠা জোগাড় সম্ভব হয়েছে, সব দিয়ে শুধু এটাই করেছি। উন্মাদের মতো শুনতে লাগলেও এটাই সত্যি।

শুভ জন্মদিন, অবান্তর। তুমি না থাকলেও অনেক কিছু থাকত নিশ্চয়। কিন্তু তারা কেউ না থেকে যে শুধু তুমি আছো তাতে আমার একবিন্দু দুঃখ নেই। শুধু ভালোলাগা আর ভাগ্যিস আছে।