কাঠমান্ডু ৪ঃ ফেরা


আজ কাঠমান্ডু ফিরব। অর্চিষ্মান সোমবার দিল্লি ফিরবে। আমি মঙ্গলবার। কাঠমান্ডুর হোটেল বুক করা নেই। আমার মাথাব্যথাও নেই। ওয়েপনাইজড ইনকমপিটেন্স এতদিন তত্ত্বে জানতাম, এবার সত্যে পরিণত করেছি। হোটেল বুকিং বিষয়ে নিজেকে সাকসেসফুলি অপদার্থ প্রমাণ করে ফেলেছি। এবার থেকে হোটেল বুকিং অর্চিষ্মানই করবে। কিন্তু তার আগে আমরা আরেক দফা নাগরকোটে হেঁটে ঘুরব।

ডাইনিং রুমে এক দম্পতি ঘেঁষাঘিষি বসে খাচ্ছে। গলার আওয়াজ আমাদের দেখে দু অক্টেভ নেমে গিয়ে ফিসফিস হয়ে গেল। অর্চিষ্মান অচেনা লোকের সঙ্গে স্মল টক করে না আর আমি মুড ভালো থাকলে বিরিয়ানিওয়ালাকেও জিজ্ঞাসা করি শরীর ভালো ? নেপালেরই ছেলেমেয়ে কিন্তু ফ্লুয়েন্ট হিন্দি বলতে পারে। আমাকে বলল আপ কলকাত্তা সে হো? অর্চিষ্মান দেখছে জেনেও ঘাড় নেড়ে দিলাম।

ওরা বুদ্ধি করে জানালার পাশের টেবিল ছেড়ে বসেছিল। ট্রেনলাইনের ট্রমা, জানালার পাশ আমি ছাড়তে পারি না। অন্ধকারে কিছু দেখা না যাক, বাথরুম যেতে অসুবিধে হোক আই ডোন্ট কেয়ার। ওয়েব চেক ইনে অন্য সিট গছালে 'দেখুন না স্যার দেখুন না ম্যাডাম' করে কাউন্টারে লাইন দিই। আপগ্রেড চাই না, জানালা চাই।

জানালার রোদ্দুর শুরুতে মিষ্টি লাগছিল ক্রমে কড়া হয়ে উঠেছে। দেওয়ালের সঙ্গে যথাসম্ভব সেঁটে ইউ ভি রে এড়ানোর চেষ্টা করছি আর "ওরে বাবা রে গরমে মরে গেলাম রে" কোঁকাচ্ছি। অর্চিষ্মান পাঁউরুটি চিবোচ্ছে।

জিজ্ঞাসা করলাম অর্চিষ্মান থালাবাটি নিয়ে অন্য টেবিলে শিফট করতে চায় কি না। অর্চিষ্মান বলল কুন্তলা এত তাড়াতাড়ি অসহ্য হলে জীবনের পথে চলবে কী করে? ও আবারও ভুল বুঝল। আমি উঃ আঃ করছিলাম ওর অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য। ও যদি বলে সত্যি রোদটা ভীষণ কড়া তাহলেই আমি চুপ করে যাই। দল বাড়ানোর সাধ ছাড়া আমার আর কোনও বদুদ্দেশ্য নেই। ওইটুকু রোদ আমাকে টসকাবে না সে আমিও জানি।

মেনুতে জুস কফি দুধ কেলগস্‌ পাউরুটি জ্যাম মাখন সসেজ ডিমসেদ্ধ স্ক্র্যাম্বলড অমলেট ফল আর গোল গোল মিনিয়েচার প্যানকেক। এত মিনি যে প্রথমটা বুঝিনি প্যানকেক। জিজ্ঞাসা করাতে ছেলেটা বলল প্যানকেক। মুখে দিয়ে বুঝলাম প্যানকেকও না। গোলারুটি।

গোলারুটি খেয়েছি কেজি ক্লাসের বন্ধু তনুশ্রীর বাড়িতে। জীবনে যে একটিমাত্র আইচ পদবীর মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে সে তনুশ্রী। তনুশ্রীজনিত দুটো স্মৃতি টাটকা। একদিন রাস্তায় তনুশ্রী ওর মায়ের সঙ্গে হাঁটছিল, পেছন পেছন আমি আমার মায়ের সঙ্গে। ওরা আমাদের দেখতে পায়নি। আমি তনুশ্রীকে “ওই ওই” করে ডাকছিলাম। মা বলেছিলেন, 'ওই' বলে ডেকো না সোনা। নাম ধরে ডাকো। নামের আগে ‘এই’ বা ‘অ্যাই’ বসাতে পার.‘ওই’ কখনও না।

দ্বিতীয় স্মৃতিটায় গোলারুটি আছে। তনুশ্রীর বাড়িতে বিকেলে খেলতে যেতাম। কাকিমা গোলারুটি বানাতেন। রান্নাঘরের সামনে বারান্দায় বাবু হয়ে বসে আমি আর তনুশ্রী গোলারুটি খেতাম। নাগরকোটে প্যানকেকের নামে গোলারুটি পেয়ে তনুশ্রীর পাশে বারান্দায় বসে গোলারুটি খাওয়ার দৃশ্য শব্দ গন্ধ স্পর্শ স্বাদ সব ফিরে এল। অর্চিষ্মানকে বললাম, গোলারুটি খেয়েছ?

আমি এ সব গরিব বাঙাল খাবার খাই না।

গল্পের এই জায়গাটায় এসে তিন্নি বলেছিল, এইজন্য বলেছিলাম কাঠমান্ডু থেকে ভালো দেখে একটা কুকরি কিনে আনতে। এই সব মুহূর্তে বার করে আনমনে ঘোরাতি।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোলাম। গ্র্যাভিটি-ডিফাইং ঝুঁটিবাঁধা শিশু থেকে কলাবিনুনি কিশোরী, নীলসাদা ইউনিফর্ম পর মিছিল করে শ্রী মহাকালী সেকেন্ডারি স্কুলের দিকে চলেছে। তাদের মুখভঙ্গি, হাঁটার স্পিড দেখে গেস করার খেলা খেলছিলাম - কার হোমওয়ার্ক হয়েছে কার হয়নি। মোড়ে নাগরকোটের ম্যাপ। ম্যাপে বড়রাস্তা গলিরাস্তা দোকান স্কুল হোটেল পুলিস স্টেশন। ম্যাপ জুড়ে অনেকগুলো নেচার ট্রেল এঁকেবেঁকে জালের মতো ছড়িয়ে। একটা মহাকালী স্কুলের কান ঘেঁষে।

হাতে সময় বেশি নেই। এমন কোনও ট্রেলে ঢোকা যাবে না যেখান থেকে তিন ঘণ্টার ভেতর বেরোনো যাবে না। ম্যাপে দূরত্ব লেখা নেই। জয় মহাকালী বলে ট্রেলে ঢুকে পড়লাম।

জঙ্গলের গন্ধ, শব্দ, সব আলাদা। যেন একটা আলাদা গ্রহ, যেখান থেকে আমরা ঘাড়ধাক্কা খেয়েছি অনেকদিন, এখন ঢুকতে গেলে সবাই সন্দেহের চোখে দেখছে। ট্রেলের ঢাল মৃদু, রোদের তেজ মোলায়েম, এনার্জি তুঙ্গে। ঝকঝকে সকালে ঝিঁঝিঁর ডাকের তেজ যেন গ্রামের অন্ধকার পুকুরধার। ট্রেলের শাখাপ্রশাখা একটা ডানদিকে নামছে, একটা বাঁদিকে উঠছে। প্রায় টস করে একটা শাখা ধরে চলে যাচ্ছি, ঝিঁঝিঁপোকারা উত্তেজিত হয়ে উঠছে, চিৎকার ঘনীভূত হচ্ছে, দশ মিনিট হেঁটে মাইন্ড চেঞ্জ করে ফিরে আবার অন্য প্রশাখায় ঢুকছি। কখনও অর্চিষ্মান সামনে হাঁটছে কখনও আমি। সরু পথের মাঝে রোদজলবৃষ্টির ঘষা খাওয়া, খাটো গুঁড়ির মসৃণ মাথা টপকাচ্ছি। আমরা নেচার দেখব বলে গাছ কেটে নেচার ট্রেল বানানো হয়েছে। এ পথের যেন আরও কোনও উপযোগিতা থাকে ঠাকুর, স্রেফ টুরিস্টদের প্রকৃতিদর্শনের সুবিধার্থে যেন না হয়।

নরম রোদ্দুর পাতার ফাঁক দিয়ে গায়ে পড়ছিল। আমরা 'দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলি' করতে করতে হাঁটছিলাম। ঘণ্টা দেড়েক পর দূরে বাসস্ট্যান্ড মতো দেখা গেল। অবভিয়াসলি বাসস্ট্যান্ড নয়, ধরণটা বাসস্ট্যান্ডের মতো। বললাম এবার মনে হয় ফিরলে ভালো। অর্চিষ্মান গুগল ম্যাপ খুলল। ফোনের রিসেপশন ভালো। দেখো আমরা সিক্সটি (আসলে ফিফটি টু) পারসেন্ট এসে গেছি, এখন ফেরার থেকে এগোনোই ভালো না?

ফিফটি টু সিক্সটি টু কিছু না অর্চিষ্মানের বেসিক্যালি ট্রেল কমপ্লিট করার ইচ্ছে। অর্চিষ্মান ইজ আ ফিনিশার। আমি বিরক্ত লাগামাত্র উঠে পড়ি, অর্চিষ্মান শুরু করলে শেষ না করে ছাড়ে না। এগোলাম। পথ নামতে শুরু করল। নামা মানে একেবারে পাতালপ্রবেশ। জঙ্গল দু'পাশে চেপে এল, তীব্র উতরাই, মাঝেমধ্যে শ্যাওলায় ঢাকা সিঁড়ি। হড়কাতে হড়কাতে, একে অপরকে সাবধান করতে করতে আমরা নামতে থাকলাম। মাথার ওপর রোদ অদৃশ্য, টেম্পারেচার মিনিমাম তিন ডিগ্রি নেমে গেছে, ঝিঁঝিঁপোকাগুলোও চুপ। চারদিক ভয় ভয় ছায়া ছায়া। মুখ বুজে হাঁটছি, ছবিটবি তোলা মাথায় উঠেছে, ঘড়ি ঘোড়ার মতো ছুটছে। একটাই সান্ত্বনা, পথ একটাই কাজেই হারানোর চান্স নেই।

জামায় যখন ঘামের ছোপ, সময় নিয়ে চিন্তা হচ্ছে, পথ উঠতে শুরু করল। উঠতে উঠতে গাছেদের মাথা আবার দেখতে পেলাম, পাতা গলে রোদ্দুর গায়ে পড়ল, তারপর মাথার ওপর থেকে গাছটাছ সরে ন্যাড়া, নীল আকাশ বেরিয়ে পড়ল। নেচার ট্রেল শেষ, জঙ্গল ফুরিয়েছে।

চাইছিলাম ফুরোক। তবু মন খারাপ হল।

টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছি, পেছনে জঙ্গল ছড়িয়ে আছে। রাস্তা, রোদ্দুর, বাসস্ট্যান্ড সব আছে ওই সবুজের পেটে, কিন্তু এখান থেকে মনে হচ্ছে একবিন্দু ফাঁকফোকর নেই। ঠাসা সবুজ। বিভিন্ন শেডের।  ভাবছি লেখার সময় ব্যাপারটাকে ব্রকোলির সঙ্গে তুলনা করলে কেমন হয়। রাজুর ভ্যানে বস্তার আড়াল থেকে উঁকি মারছে হাফ ব্রকোলির মাথা, একটা দুটো ফ্লোরেট পেকে সবুজ থেকে হলুদের দিকে হাঁটা দিয়েছে। তারপর উনিশশো বাহান্ন সালে বার্নার্ড বেনরসনকে লেখা হেমিংওয়ের চিঠি মনে পড়ল। Then there is the other secret. There isn’t any symbolysm (sic). The sea is the sea. The old man is an old man. The boy is a boy and the fish is a fish. The shark are all sharks no better and no worse. All the symbolism that people say is shit. What goes beyond is what you see beyond when you know.

জঙ্গলের কিনারায় কুৎসিত খাদ। কেটে বালিফালি কিছু বার করা হচ্ছে। গোডাউনের নীল শেড। সবুজ ট্রাক। হলুদ ট্রলি। খাদের বাউন্ডারি ঘেঁষে রাস্তা। কিন্তু সে রাস্তায় পড়ব কী করে? অর্চিষ্মান কোমরে হাত দিয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। এমন সময় গুড়গুড়। অর্চিষ্মানের মাথার একহাত ওপর একটা ঝোপের পাশ দিয়ে একটা গাড়ির চাকা ঘুরতে ঘুরতে চলে গেল।

অদ্ভুত পরিস্থিতি। অর্চিষ্মানের মাথার একহাত ওপর মেজ রাস্তা যেটা ডেফিনিটলি বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছে কারণ গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু সে মেজ রাস্তায় ওঠার কোনও ছোট রাস্তা নেই। যদি না বিন্দু বিন্দু জল গড়ানো নালার পাশের পাইপটাকে রাস্তা বলে গণ্য করি। পাইপ না, পাইপের অংশ। পাহাড়ের গা দিয়ে বেরিয়ে আছে। পাইপে পা রেখে অর্চিষ্মান উঠল। তারপর আমি মনের জোর, অর্চিষ্মানের হ্যাঁচকা টান আর টেকনিক্যালি অসম্ভব আমার কিছু বৈবাহিক সম্পর্ককে স্মরণ করতে করতে প্রায় আমার হাইটের সমান উচ্চতা অতিক্রম করে মেজ এবং অচিরেই বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। রাস্তার পাশে মাইলস্টোনে লেখা সাংখু।

ওহ হো, কাঠমান্ডু থেকে নাগরকোট হেঁটে এলে এই রাস্তাটাই নিতে হত। 

এই রাস্তা ধরে নাগরকোট প'নে তিন কিলোমিটার। এখন বাজে এগারোটা কুড়ি। বারোটায় চেক আউট। ডিসট্যান্স ম্যানেজেবল্‌। কিন্তু চড়াই প্রবলেম্যাটিক। জঙ্গলের ছায়াঘন মায়া অন্তর্হিত, ঠা ঠা রোদ্দুর গ্লুকন ডি-র অ্যাডের মতো স্ট্র দিয়ে মাথার ভেতর এনার্জি শুষে নিচ্ছে। পাহাড়ের গা থেকে ঝুলে পড়া ফার্নের ছায়ায় জিরোনোর সময় নেই।

হৃদপিণ্ড মুখে নিয়ে হাঁটছিলাম। দশ বছর পর মাথায় বন্দুক ধরলেও এ জিনিস আমার দ্বারা হবে না। নাটক্র্যাকারের ফ্যামিলি প্যাকের সঙ্গে ইমিডিয়েটলি মুখদেখাদিখি বন্ধ না করলে দশটা পাঁচ হয়ে যাবে। তাড়াটা হেল্পই করেছিল। না হলে কষ্ট দীর্ঘায়িত হত। মাঝপথে একটাই ঝুপড়ি দোকান পেয়েছিলাম, একটা প্রায় বরফ হয়ে যাওয়া জলের বোতল কিনে, অর্ধেকটা খেয়ে অর্ধেকটা মাথায় ঢালতে ঢালতে ডট বারোটায় রিসেপশনে বডি ফেলেছিলাম। অর্চিষ্মান আবারও বিচক্ষণতা দেখিয়ে ফোন করে রেখেছিল। যদিও গাড়ি প’নে বারোটায় আসতে বলা হয়েছে, আমাদের পৌঁছতে বারোটা বেজে যাবে। বেরোতে অ্যাট লিস্ট বারোটা দশ।

যেহেতু আমরা পনেরো মিনিট লেট করেছি, ট্যাক্সি পনেরো মিনিট আগে এসে গেছে। আধে ঘন্টে সে খড়ে হ্যাঁয়। অ্যাপোলজেটিক দৌড়চ্ছি রুমের দিকে। টানটান বিছানার প্রতি দৃকপাত করছি না পাছে সংযম হারাই। অলরেডি প্যাক করে রাখা ব্যাগ তুলে নিয়ে নেমে ট্যাক্সিতে উঠছি। ওঠার আগে রিসেপশনের আলোকিত ফ্রিজ থেকে এক বোতল লিমকা কিনে খেয়েছিলাম শুধু, অর্চিষ্মান সেটুকু বিলাসিতাও নিজেকে অ্যালাউ করেনি।

নাগরকোট টু কাঠমান্ডু রাস্তার দৃশ্য, ড্রাইভারজির নাম কী, বাড়ি কোথায়, চা খাওয়ার জন্য কোথায় ক'বার থামলাম, আমি ক'বার রসিকতার চেষ্টা করলাম, অর্চিষ্মান ক'বার চোখ ঘোরালো কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে আছে ঘণ্টাখানেক পর জানালার বাইরে রোদের চণ্ডমূর্তি, কাঠমান্ডুর ট্র্যাফিক, কানফাটানো হর্ন, নামভোলানো জ্যাম, চৌমাথায় অচেনা প্রাতঃস্মরণীয়দের মূর্তি, মোড় ঘুরেই শান্ত বুলেভার্ড, মোড় ঘুরেই জ্যাম। ঘেমো শহরের ফুটপাথে ইস্তিরি করা সাদা অট্টালিকা। থামের ওপর নাম দেখে দুজনেই চমকাই। এ জিনিসটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। আসবে আসবে? রাতে খাওয়াদাওয়ার পর? মগজের ভেতর মধ্যবিত্ত মর‍্যালিটি, দরকারের সময় যার টিকি দেখা যায় না, এক চোখ খুলে ভুরু তোলে। তাড়াতাড়ি অর্চিষ্মানকে বলি বাজেট করে ঢুকব কিন্তু। স্ট্রিক্ট বাজেট। বড়রাস্তা ছেড়ে ট্যাক্সি থামেলের গলিতে ঢোকে। গুগল ম্যাপ অন করে ডানেবাঁয়ে মুড়ে ‘হিমালয়ান সুইট’ হোটেলের গেটের সামনে থামে। পাঁচিলে সাঁটা বোর্ডে কানে কাঁঠালচাঁপা গুঁজে মাস্কারাদীর্ঘ পলক বুজে শুয়ে থাকা মডেলের পিঠ গড়িয়ে তেলের ফোঁটা নামে।

ঢোঁক গিলে চশমা অ্যাডজাস্ট করি। ফুল বডি প্যাম্পারিং অ্যান্ড মাইন্ড রিল্যাক্সেশন সেশন অ্যাট ফিফটিং পার সেন্ট ডিসকাউন্ট। নিচের লাইনে দুটি তারার মাঝখানে *ইউনিসেক্স স্পা*।

যাক এতদিনের স্বপ্ন পূর্ণ হবে।

অর্চিষ্মান বলল, কী স্বপ্ন?

পাশাপাশি দুটো ধপধপে বিছানা, মাথার জায়গাটায় ফুটো, যে ফুটোতে মুখ গলিয়ে আর তুমি হাত ধরে উল্টো হয়ে শুয়ে আছি, আমাদের বডি এবং মাইন্ডের রিল্যাক্সেশন হচ্ছে।

এই গোত্রের স্বপ্ন আমার আগেও হয়েছে। ইউনিসেক্স সেলুন দেখলেই আমার মনে হয় আমি আর অর্চিষ্মান পাশাপাশি চেয়ারে হাত ধরে বসে আছি আর লোকজন আমাদের চুল কেটে দিচ্ছে।

কুন্তলা, তোমার গোলমেলে স্বপ্ন তুমি পূর্ণ করো আমাকে এর মধ্যে টেনো না। সিকিউরিটি ভাইসাবের পেছন পেছন রিসেপশনে ঢুকে গেল অর্চিষ্মান। রিসেপশনে স্বচ্ছ গ্লাসে কমলা ওয়েলকাম ড্রিংক। আমি আজীবন বিশ্বাস করেছি সিগমা গার্লস অ্যান্ড বয়েজরা কেবলমাত্র সেই সব নন-কমলা কোল্ড ড্রিংকস খায় যেগুলো খেতে শুরু করেই চোখ বুজে কাঁটা হয়ে অপেক্ষা করতে হয় কখন ঝাঁজ ব্রহ্মতালুতে ধাক্কা মারবে। 

ভদ্রতার চুমুক দিয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম। নিজেরটা শেষ করে এদিকওদিক তাকিয়ে আমার গ্লাস শেষ করল অর্চিষ্মান। ঘরে এলাম। স্নান করে খানিকটা মানুষের মতো লাগছে। বিছানায় বডি ফেলছি। ঘুমিয়ো না কিন্তু। খেতে বেরোব।

থাকালি খাওয়ার লক্ষ লক্ষ জায়গা কাঠমান্ডুতে, গুগলে চারপাঁচটা দোকানের নাম ঘুরে ঘুরে আসছে। একটা জিম্বু থাকালি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় জিম্বু থাকালির শাখা। ক্যাপিটাল গ্রিল সংলগ্ন শাখাটি নাকি বেস্ট।

অর্চিষ্মান বলল, দাঁড়াও পাঠাও ডাকি।

সেটা কী?

এদের উবার।

বললাম, নাগরকোটের ছেলেটা ফ্যান্টার বোতল না বলে শিশি বলল, এরা ভেজো না বলে পাঠাও নাম দিয়েছে। বাংলা নেপালিতে এত মিল জানতে?

মিল থাকতে পারে কিন্তু এই পাঠাও নেপালি না। বিশুদ্ধ বাংলা। এটা বাংলাদেশী কোম্পানি।

Baader-Mainhof সিনড্রোম সত্যি। কাঠমান্ডুতে এর আগেও কয়েক বেলা ঘুরেছি চোখে পড়েনি, যেই না পাঠাও সম্পর্কে জেনেছি, চারদিকে পাঠাও ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। শহর জুড়ে পাঠাও -এর পুঁচকে সাদা গাড়ি ছুটছে। বাঙালি পাঠাও চড়ে নেপালি থাকালিতে গিয়ে নামলাম। বোর্ডে ক্যাপিটাল গ্রিল, জিম্বু থাকালি দুটো নামই ঝলসাচ্ছে। অর্থাৎ ঠিক জায়গায় এসেছি। তবু কয়েকটা সংশয় জেগে উঠল।

সংশয়ের প্রথম কারণ জিম্বু থাকালির চেহারা। ভালো দেখতে বটে। বারান্দা, গাছ, দোলনা - সবই ইন্সট্যাগ্র্যামেবল্‌। এত ইন্সট্যাগ্র্যামেবল্‌ যে সন্দেহ হয় অথেনটিক তো? নিজের চেহারা নিয়ে আজীবন কাঁদুনি গেয়েছি, প্রিভিলেজটাও অগ্রাহ্য করিনি। প্রিটি প্রিভিলেজের মতো আগলি প্রিভিলেজ ইজ আ থিং। আমার অনেক প্রিটি ফ্রেন্ড (উভয় লিঙ্গের) বলেছেন ভালো দেখতে হয়ে তাঁরা মারাত্মক বিপদে আছেন। রাত প'নে বারোটায় মেসেঞ্জারে “জেগে?”এর বিপদ ছাড়াও অন্য বিপদ। প্রচলিত ধারণায় বুদ্ধি আর রূপের সহবাস সুলভ না, কাজেই তাঁদের বুদ্ধির ওপর লোকে অনেক ক্ষেত্রেই ভরসা রাখতে পারে না।

তা বলে কি আমার বুদ্ধির ওপরেই পারে? আমার চেহারা এ এরকম বলেই বুদ্ধিমান ভেবে নেওয়ার মতো অন্ধ কেউ না, কিন্তু চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক পরি না বলে লোকে যে লাফ দিয়ে ধরে নেয় আমার মনটা সাদা আর মগজটা সরল, বারবার দেখেছি। বন্ধুদের মাবাবা থেকে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা রেগুলার বলে থাকেন, কুন্তলা? ভীষণ সিম্পল মেয়ে।

দ্বিতীয় সন্দেহের কারণ স্পেশালাইজেশন। পাড়ার যে সব দোকানে মোগলাই চাইনিজ সাউথ ইন্ডিয়ান সব একসঙ্গে পাওয়া যায় আমরা তাদের নিচু চোখে দেখি। জিম্বু থাকালি ও ক্যাপিটাল গ্রিল একই ছাদের তলায় (কর্তৃপক্ষও এক হতে পারে); মেনুতে বার্গার উইথ চিমিচুরি সস থেকে আলু সদেকো, তুলসী ভাসানো মার্গারিটা থেকে বেলের পানা সবই অ্যাভেলেবল।

কিন্তু আমরা সন্দেহের মুডে ছিলাম না। সকালে ওই অত্যাচার আর জার্নির পর ঘেমো দোকানে বসে অথেনটিসিটি উদযাপনের থেকে চকচকে দোকানের এসিতে আরাম করাই আমাদের পছন্দ ছিল। দোলনার পাশে ছাতার তলার টেবিল খালি ছিল। বললাম আজকের জন্য আমাদের প্রকৃতির ডোজ পূর্ণ হয়েছে, এসিতেই বসব। স্মার্ট স্কার্ট পরা হোস্টেস পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। দোকানের প্রথম অংশটা “থাকালি থাকালি” দেখতে। মজনু কা টিলায় নেপালি থাকালি খেতে আমরা এ রকম দোকানেই যাই। খোপ খোপ বসার জায়গা। প্রতি খোপে কাঠের নিচু টেবিল ঘিরে গদি।

জিম্বু থাকালির সব খোপ ভর্তি। ফিটফাট মেয়ে গটমট চললেন। পেছন পেছন আমরা। থাকালির অংশ পেরিয়ে করিডর, করিডরে বাহারি আয়না, সোনালি কল, গামলা আকৃতির সোনালি বেসিন পাশাপাশি তিনটে। একটায় একজন ভদ্রমহিলা ন্যাতা ধুচ্ছেন।

করিডরের ওপারের অংশটা আমার ধারণা ক্যাপিটাল গ্রিল। কায়দার লাইটিং, বারের বোতলের সারিতে ঠিকরোচ্ছে। আমাদের টু সিটার টেবিলে বসানো হল। অদূরে লম্বা টেবিলে ছ’সাত জন বসে খাচ্ছেন। চার পাঁচজন পুরুষ, দু'জন মহিলা, একটা বাচ্চা। লম্বাচওড়া পুরুষদের আঙুলে রত্ন, কবজিতে ধাগা। অর্ডার দেওয়া বা কথাবার্তার সময় কেউই পরিবেশকের দিকে তাকাচ্ছেন না। দুই মহিলা নিঃসন্দেহে উপস্থিত দুজন পুরুষের স্ত্রী। এক কালে অ্যামেরিকা’স নেক্সট টপ মডেল দেখার নেশা হয়েছিল। সেখানে জেনেছিলাম সুন্দর, কুচ্ছিতের মতো আরেকরকম লুক হয়ঃ “এক্সপেনসিভ”। সুন্দর কুচ্ছিতের সঙ্গে এই লুকের সম্পর্ক নেই। একজন সুন্দর লোক সস্তা সেজে থাকতে পারেন, একজন কুচ্ছিত লোক নিজেকে দামি লুকিং করে তুলতে পারেন। আবার একজন সুন্দর লোক দামি দেখতে হতে পারেন, কুচ্ছিত সস্তা। বর্ণময় জাজেরা বলতেন, ইউ মাস্ট লুক এক্সপেনসিভ। সুন্দর কুচ্ছিত জিসাসের হাতে কিন্তু সস্তা দামি মানুষের।

দুই ভদ্রমহিলাই এক্সপেনসিভ লুকিং। সুন্দরীও, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের পেছনে নিয়মিত বিস্তর পয়সা খরচ করে সুন্দরের থেকে দামির অংশটা প্রকট করে তোলা হয়েছে।

প্রায় দু’ঘণ্টা জিম্বুতে ছিলাম যার মধ্যে এক ঘণ্টা ওঁরাও ছিলেন। এক ঘণ্টায় মহিলা দু’জন একে অপরের প্রতি আধখানা অব্যয়ও উচ্চারণ করেননি, সিকিখানা দৃষ্টিপাত না। একজন যতক্ষণ নিজের বছরছয়েকের বাচ্চাকে খাওয়ালেন, অন্যজন আতংকিত তাকিয়ে রইলেন।

দুটো সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির মানুষ, বরেদের পেশার খাতিরে একে অপরকে সহ্য করতে করতে ক্লান্ত? খোলাখুলি ঝগড়া হয়েছে কখনও? নাকি (এই অপশনটা বেশি সম্ভাব্য ঠেকছে আমার) ‘ও যদি আমার সঙ্গে যেচে কথা না বলে আমিও বলব না’ লজিকে দিন কাটছে?

কারণ যা-ই হোক, দু'জনের গোটা অস্তিত্ব থেকে একে অপরের প্রতি অপছন্দ বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

আমার মনের জটিলকুটিলতাও কি এই তীব্রতায় ধরা পড়ে?

এর থেকে অনেক বেশি তীব্রতায় ধরা পড়ে, কুন্তলা। এরা তোমার কাছে শিশু।

কাচের দেওয়ালের ওপারে ইন্সট্যাগ্র্যামেবল দোলনায় ইন্সট্যাগ্র্যামেবল মানুষজন দোল খাচ্ছে, ভিডিও তুলছে। বড় দলটা উঠে চলে গেছে। লাঞ্চ আওয়ার শেষ। দোকানের এই অংশে এখন শুধু আমরা আর কোণার টেবিলে রানা দগগুবাটির মতো দেখতে একটা ছেলে একা বসে খাচ্ছে। আমাদের খাওয়া শেষ। প্লেট উঠিয়ে নিয়ে গেছে কিন্তু আমাদের উঠতে ইচ্ছে করছে না। অর্চিষ্মানের ক্যাপুচিনো আমার এসপ্রেসোর কাপ নামিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন, ‘কী ডেজার্ট পাওয়া যায় দেখি’ বলে হার্ডবাউন্ড মেনুর ধাক্কায় অর্চিষ্মান কাপভর্তি ক্যাপুচিনো উল্টে ফেলল। মেঝেময় কফি, চূর্ণবিচূর্ণ সেরামিক।

কিচ্ছু হয়নি, নো ওয়রিস, হতেই পারে চেঁচিয়ে উঠে আমি হাতপা নেড়ে পরিবেশককে ডাকলাম, পরিবেশক একজন দিদিকে ডাকলেন। দিদি মপবালতি হাতে এসে পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন। পরিবেশক আমাদের তুলে নিয়ে পাশের টেবিলে বসালেন। বললাম আরেকটা ক্যাপুচিনো যদি আনেন। “অফ কোর্স” বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন এবং ক্যাপুচিনো নিয়ে ফিরে এলেন। দিস ইজ অন আস। আমাদের অনেক আপত্তি শুনলেন না। আমরা নুয়ে পড়ে থ্যাংক ইউ বললাম। অর্চিষ্মান স্বাভাবিকের থেকে কম কথা বলছিল। মুখে বললাম ছাড়ো তো, এদের এ রকম দিনে পাঁচটা করে হয়, মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস আমারটা উল্টোয়নি।

কফি খেয়ে ভক্তপুরের দরবার স্কোয়্যার যাব। তার আগে অর্চিষ্মানের হোটেলে যেতে হবে, যে হোটেলে ওয়ার্কশপ চলাকালীন ও ছিল। ওর বস্‌ ওর জন্য চকোলেট এনেছিলেন, গোটা ওয়ার্কশপ মনে পড়েনি, যতক্ষণে মনে পড়েছে অর্চিষ্মান নাগরকোটের রাস্তায়। বস্ চকোলেট রিসেপশনে জমা রেখে বাড়ি ফিরে গেছেন।

রিসেপশনের মহিলা চকোলেটের প্যাকেট বার করে, তিনবার নাম মিলিয়ে অর্চিষ্মানের দিকে ভুরু কুঁচকে তেরো সেকেন্ড তাকিয়ে, দু'প্যাকেট চকোলেটের জন্য পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া বাড়াবাড়ি হবে কি না তুল্যমূল্য করতে করতে প্যাকেট হস্তান্তর করলেন। প্যাকেট হাতে নিয়ে অর্চিষ্মান দ্বিধান্বিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। "নট ইয়োরস?" বলে মহিলা লাফিয়ে হাত বাড়িয়েছেন, অর্চিষ্মান হাত সরিয়ে মহিলাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে, আমি বিরক্ত হয়ে ব্যাপারটা কী? বলে গলা বাড়ালাম।

চকোলেট রেখে গেছে মারি কিন্তু প্যাকেজিং-এর হরফ আর যাই হোক ফরাসি নয়। অর্চিষ্মান বলল, ওওওও, মারি এখানে আসার আগে মালয়েশিয়া গেছিল বটে।

ওকে থ্যাংকস বাই বলে হোটেল থেকে বেরিয়েছি, পাঠাও-এর ট্যাক্সি হোটেলে ঢুকে গেছে, সিকিউরিটি ভাইসাব সেদিকে আমাদের ধাবিত করছেন এমন সময় "সার সার!" পার্কিং-এ গাড়ির ভিড়ের মধ্য থেকে এক ভদ্রলোক হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে ছুটে আসছেন।

এঁকে চিনি। ইনি আমাদের নাগরকোটে নিয়ে গেছিলেন। আমরাও উল্টে হাত নাড়লাম, কেমন আছেন? 

ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে খালি খেজুর করতে আসেননি। আমাকে নমস্কার ঠুকে অর্চিষ্মানকে ডেকে নিয়ে পার্কিং লটে নিজের গাড়ির দিকে নিয়ে চললেন। দু'মিনিট পর অর্চিষ্মান বেরিয়ে এল। হাতে ফোনের সাদা রঙের ইউ এস বি কেবল। যে কেবল্‌টা গাড়ির ইউ এস বি পোর্টে গুঁজে অর্চিষ্মান গম্ভীর মুখে নাগরকোটের হোটেল খুঁজছিল। ওটা গাড়িতেই রয়ে গেছে। অর্চিষ্মান টেরও পায়নি ওটা গাড়িতে রয়ে গেছে।

এর পরেও তুমি বলবে লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিষয়ে তোমার লাক কাজ করে না?

অর্চিষ্মান শুক্রবার সন্ধেয় শপিং মলের ফুড কোর্টে হলদিরামের কাউন্টারে ক্রেডিট কার্ড ফেলে রেখে পনেরো মিনিট পর গিয়ে পেয়ে গেছে। এ রকম অগুন্তি উদাহরণ আছে। নবতম সংযোজন কাঠমান্ডুর কেবল্‌। লোকে ওকে ডেকে ডেকে হারানো জিনিস ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আর আমি এদিকে চশমা খুলে রেখে দু'সেকেন্ড ওদিকে তাকালে পরের দশ মিনিট চশমা খুঁজে বেড়াচ্ছি। দিনে পাঁচবার করে এ ঘটনা ঘটছে।

ভক্তপুরের দরবার স্কোয়্যারে অর্চিষ্মান নাকি আগেও এসেছে।

আগের বছর?

বৃহস্পতিবার। তুমি আসার আগের দিন। অফিসের একজনকে নিয়ে।

গল্পটা বলল অর্চিষ্মান। কনফারেন্স বা ওয়ার্কশপজনিত অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে নিশ্চয় জানবেন নতুন শহরে কনফারেন্স হলে - নতুন দেশ হলে তো কথাই নেই - বেড়ানো আর শপিং করার জন্য লোকে হাফ পাগল হয়ে যায়। রীতিমত সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে, প্যানেলের বিষয় কী, পার্টিসিপেন্টস কারা, কে তাঁদের কাজের কোন জায়গাটায় আলো ফেলতে চান (কোনও কোনও এক্সপার্ট আবার কানে কানে বলেন তাঁকে কী প্রশ্ন করা হবে যদি বলে দেওয়া হয় তাহলে তিনি ভালো করে প্রিপেয়ার করে আসতে পারেন) এর মধ্যে কেউ না কেউ বলবেনই আচ্ছা একদিন সরোজিনী নগর মার্কেটের ফিল্ড অর্গানাইজ করা যায় না? একদিন হাফ ডে নিয়ে হপ অন হপ অফ বাসে করে লোটাস টেম্পলটা কভার করে এলে কেমন হয়?

কাঠমান্ডুর কনফারেন্স শুক্রবার শেষ হয়েছে, বৃহস্পতিবার লাস্ট সেশনের কিউ অ্যান্ড এ শেষ হতে না হতে ল্যাজে আগুন দিয়ে লাফ মেরে সবাই বেড়াতে বেরিয়ে গেছে। অর্চিষ্মান ঘরে গিয়ে দমটম ছেড়ে নিচে নেমে দেখছে এক ভদ্রমহিলা, কনফারেন্সের পার্টিসিপেন্ট, রিসেপশনে চুপ করে বসে আছেন।

ভদ্রমহিলা বর্ষীয়ান রিসার্চার, ডক্টরেট। সত্তর ছুঁইছুঁই। ওঁর টিমমেটরা পঁচিশ টু পঁয়ত্রিশের পুরুষ। দল বেঁধে কাঠমান্ডু ঘোরার প্রসঙ্গটাই ওঠেনি।

ভদ্রমহিলা এ কথা সে কথার পর অর্চিষ্মানকে বললেন আমার বাজারটাজার কিছু করার নেই। শহরটা যদি একটু দেখতে পেতাম, এতদূর এসেছি।

তখন অর্চিষ্মান একটা পাঠাও ডেকে ভদ্রমহিলার সঙ্গে ভক্তপুর দরবার স্কোয়্যার একঘন্টার জন্য ঘুরে গেছে। ভদ্রমহিলার স্বামী বেঁচে থাকতে দুজনে নাকি বিকেলবেলা রিকশা করে ছেলেমেয়েসহকারে হাওয়া খেতে বেরোতেন। অর্চিষ্মান বলেছে আমার আর আমার ওয়াইফও ঘনঘন হাওয়া খেতে বেরোই। পাঠাও-এর ড্রাইভার বা অন্য কাউকে দিয়ে অর্চিষ্মানের ফোনে একটা ছবিও তোলা হয়েছে। ভদ্রমহিলার ঘোমটাদেওয়া নিরীহ মুখ। অর্চিষ্মানের ঘোমটাছাড়া নিরীহ মুখ। এক হাত দূরে দূরে আড়ষ্ট হেসে দুজনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্চিষ্মান জিনস্‌ পরে অফিসে যায়, কাজেই ওর ফর্ম্যালস পরা চেহারাটা আমি প্রায় দেখিই না। মনে হয় অচেনা কেউ।

মল্লরাজাদের রাজপ্রাসাদ, রাজপ্রাসাদসংলগ্ন অফিস কাছারি স্কুল চিকিৎসালয় হোমরাচোমরা লোকদের বাড়ি ইত্যাদি নিয়ে তৈরি হত একেকটা দরবার স্কোয়্যার। নেপালের কাঠমান্ডু, পাটান ও ভক্তপুরের তিনটি দরবার স্কোয়্যারের মধ্যে ভক্তপুরেরটা ছিল গ্র্যান্ডতম। হাজার বছর আগে থেকে শুরু হয়ে চারশো বছর আগে পর্যন্ত এই দরবার স্কোয়্যারে নতুন কাঠামো জোড়া হয়েছে। তুঙ্গে প্রায় একশোর মতো কোর্টইয়ার্ড ছিল, এখন পনেরোরও কম। সময় আর ভূমিকম্প বাকিগুলোকে খেয়েছে। যেটুকু দাঁড়িয়ে আছে আমাদের চোখ টেরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

পরে ইন্টারনেটে দেখেছি দরবার স্কোয়্যারের মন্দির ও বাড়িগুলোর সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, লিজেন্ড আছে, মিথ আছে। স্থাপত্যের কেরামতি আছে, মূর্তির ভঙ্গিমার বিজ্ঞান আছে। গাইড নিয়ে যাইনি কাজেই এ সব কিছুই জানতে পারিনি। আমরা প্লেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমাদের মতো আরও অনেকেই প্লেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। দরবার স্কোয়্যারের ভেতরে, আশেপাশে গমগম বসতি। মেন চত্বরে টুরিস্ট, গাইড, হকার, সিকিউরিটি ছাড়াও স্থানীয় লোকও হাওয়া খেতে এসেছেন। দেখলেই বোঝা যায় রেগুলার আসেন। মন্দিরের সিঁড়িতে বসে মহিলারা গল্প করছেন। সাইকেল স্কুটার চালিয়ে লোকে যাতায়াত করছে। স্যান্ডোগেঞ্জি পরা সাহেবমেমেরা গণ্ডাগণ্ডা বিডের মালা গলায় জড়িয়ে ঘুরছে।

আমরা খাড়া সিঁড়ি বেয়ে এই মন্দিরের টঙে গিয়ে দশ মিনিট বসছিলাম, আবার নেমে ওই বাড়ির প্রাচীন বারান্দায় বসে পা দোলাচ্ছিলাম। লাফ দিয়ে নেমে জিন্স ঝেড়ে পরের মন্দিরের মাথায় চড়ছিলাম। সূর্য বাড়ি ও মন্দিরের অটুট এবং তুবড়ে যাওয়া ছাদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে আমরা একটা মন্দিরের চুড়োর কাছাকাছি  উঠে উত্তরদিকে মুখ করে বসলাম। সামনের বাড়ির ছাদে দুই মেম, মানুষ সমান ট্রাইপডে প্রায় দু'হাত লম্বা লেন্স সূর্যের দিকে তাক করে অপেক্ষায়। বাঁপাশে অর্চিষ্মান, ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তাকিয়ে আছি। সূর্যটা একটা মন্দিরের চোখা মাথায় গিঁথে আছে। দরবার স্কোয়্যারের গুঞ্জনের মধ্যে একেকটা নৈঃশব্দ্যের পকেট তৈরি হচ্ছে, একেক করে দৃষ্টি পশ্চিমদিকে ঘুরছে। মেমসাহেবরা ক্যামেরায় শেষবারের মতো চোখ রেখে দেখে নিচ্ছেন সব ঠিক আছে কি না। সূর্য মন্দিরের চুড়ো ছেড়ে নেমে পড়েছে, ঢাল বেয়ে গড়াচ্ছে, গুঞ্জন আরও কমে এসেছে, এমন সময়, পাঁচশো বছর আগের মহিমান্বিত দরবার স্কোয়্যারকে যেমন ভাসাতো, আজকের ভগ্নস্তুপকেও সমান উজ্জ্বলতায় ভাসিয়ে অর্চিষ্মানের গাল ছুঁয়ে সূর্য ডুবে গেল। আমার চোখে চোখ রেখে বলে গেল, ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে বলছিলি না? এই নে, একদিন কমিয়ে দিলাম।

কয়েক মুহূর্তে কারফিউ শেষ, সকলে এইবার ওঠা যাক ভঙ্গি করে জামাকাপড় ঝাড়ছে, ফোন দেখছে, ব্যাগ বোতল মানুষ মিলিয়ে নিচ্ছে। আমরা টং থেকে নেমে এলাম। সূর্য ডুবে গেলেও আলো আছে। দরবার স্কোয়্যারের বাড়ির একতলা জুড়ে দোকান। ফ্রিজ ম্যাগনেট, বিডের মালা, মহার্ঘ আর্টিফ্যাক্টস। একটা বাড়ির তিনতলায় আমার আর অর্চিষ্মান দুজনেরই একসঙ্গে চোখ গেছে।

ঘুপচি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই কফির গন্ধ। আহ্‌। জাস্ট একবছরের মধ্যে আমরা দুজন যে কী স্মুদলি চা-কে ল্যাং মেরে কফির দলে ভিড়েছি, সে নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক পোস্ট লেখা দরকার অবান্তরে। সরু বারান্দার কোণার টেবিলটা ভাগ্যিস খালি, না হলে ভেতরে বসতে হত, রেলিং-এ কনুই, কনুইয়ে চিবুক রেখে চত্বরের ভিউ পাওয়া যেত না। জিম্বু থাকালিতে কফি উল্টে অর্চিষ্মানের ডেজার্ট খাওয়া কেঁচে গেছে; কফির সঙ্গে চিজকেক বলা হল।

ওপর থেকে নিচের মানুষজনের দিকে তাকালে নিজেকে ভগবান ভগবান মনে হয়। এত কিছু ঘটছে, আমাদের চোখ একেকটা খণ্ডদৃশ্যে সেঁটে যায়। একটা লাল ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়ে, কত হবে, ছয় সাত, সম্ভবতঃ মা এবং অন্যান্য মহিলা আত্মীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে বিকেলের হাওয়া খেতে এসেছে। মা গল্প করছেন, মেয়েটি ঘুরে ঘুরে নিজের মনে খেলছে। একটু পরে ভিড়ের মধ্য দিয়ে দৌড়ল। মা দেখলেন তো? মেয়েটা দৌড়ে একটা বাইকের কাছে গিয়ে থামল। বাইক কাত করে পা মাটিতে রেখে এক ভদ্রলোক। বাবা? তাই হবে। মেয়েটা দৌড়ে আবার মায়ের কাছে ফেরত এল। এইরকম দৌড়োদৌড়ি চলল কিছুক্ষণ। তারপর বাবা বাইকে স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। মাও সখীসহকারে রওনা দিলেন। মেয়েটি মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট লাফ মারতে মারতে বাড়ি চলে গেল।

অর্চিষ্মান একটা কাককে ফলো করছিল। কাকটা আমাদের বারান্দার রেলিং থেকে উড়ে গিয়ে একটা মন্দিরের মাথায় বসল কিছুক্ষণ, আবার ফিরে এসে পাশের বাড়ির বারান্দায় বসল। ভাবলাম চিজকেক দিই। তারপর দিলাম না। কর্তৃপক্ষ যদি ওঁদের সুসজ্জিত দোকানে কাককে নেমন্তন্ন খাওয়ানোতে অফেন্স নেন। নিজেরাই গোটাটা খেয়ে নিলাম।

অর্চিষ্মান বলল, আজকের বিকেলটা মনে থাকবে।

আমারও।

আলো অন্তর্হিত। অর্চিষ্মানের কাল সকালে প্লেন। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। পাঠাও বুক করা হয়েছে। পিক আপ পয়েন্ট স্কোয়্যার থেকে পাঁচ মিনিট দূর। জমজমাট স্কোয়্যারের পাশের গলিতেই অন্য জগত। কম পাওয়ারের বাল্বের নিচে ছায়াছায়া কিছু লোক বসে আছে। নিজেদের মধ্যেও কথা বলছে না। বাড়ির ওপর দিয়ে ক্রমাগত উটকো লোকজনের যাতায়াত দেখছে মুখ বুজে।

পাঠাও-এর ভদ্রলোক পঁচিশ বছর আগে দিল্লিতে ছিলেন। রিয়েলাইজ করলাম ওই সময় নাগাদ আমিও দিল্লিতেই ছিলাম। বিশপঁচিশ বছর ধুলোবালি হয়ে গেছে, যখনতখন হাত ঝেড়ে দেখিয়ে দিতে পারি।

দিল্লি নিশ্চয় অনেক বদলে গেছে?

একটা শহরের বদল অনেক রকম ভাবে মাপা যায়। ফ্লাইওভারের সংখ্যা দিয়ে, গাছ কাটা পড়া দিয়ে, চেনা দোকান বন্ধ হওয়া দিয়ে। ভদ্রলোকের মাপকাঠি হচ্ছে অটোমোবাইলের দাম। বলুন তো তখন দিল্লিতে একটা টেম্পোর দাম কত ছিল? কোনও আইডিয়া নেই স্যার। আরে, কিছু তো একটা আইডিয়া থাকবে। সত্যিই নেই, অন গড ফাদার মাদার। ভদ্রলোক প্রশ্নপত্র সহজ করে দিলেন। তখন একটা টেম্পো তিন লাখে কেনা যেত। এখন যাবে? বললাম, মনে হয় না। ভদ্রলোক রিয়ার ভিউ মিররে কড়া চোখ রেখে বললেন, মনে হয় না? তাড়াতাড়ি বললাম, না না শিওর পাওয়া যাবে না। কী করে যাবে? তিন লাখে আজকাল জল গরম হয় না তো টেম্পো কী করে পাওয়া যাবে?

রাস্তা সারাই হচ্ছে। ট্র্যাফিক স্তব্ধ। প্রবল জ্যাম। চিৎকার, গালাগালি, গরম। আমাদের ভদ্রলোকও গাড়ি থেকে নেমে রোড রেজ প্র্যাকটিস করছেন। আধঘণ্টা আগের বিকেলটার রেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস না হতে দিতে চাইলে এই মুহূর্তে এমন কিছু চাই, এমন কাউকে চাই যিনি আমাকে এই চেল্লামিল্লির ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারবেন।

আঙুলে গোনা কয়েকজনই পারেন। ছায়া গাঙ্গুলি কানের ভেতর নেমে এলেন। ইয়াদ কি চাঁদ দিল মে উতরতে রহে, চাঁদনি জগমগাতি রহি রাত ভর। কোই দিওয়ানা গলিয়োঁ মে ফিরতা রহা, কোই আওয়াজ আতি রহি রাত ভর।

*****

সোমবার ঘুম থেকে উঠে ফোন চোখের কাছে ধরে অর্চিষ্মানের মুখের রং বদলাল। কী ব্যাপার? দিল্লির বদলে ঢাকা যেতে হবে। এখন? এখন। দিল্লি নেমে তিনঘণ্টা পর ফ্লাইট। বাড়ির চাবি আমার হাতে দিল অর্চিষ্মান; তিনঘণ্টার জন্য বাড়ি গিয়ে লাভ নেই, এয়ারপোর্টেই বসে থাকব।

শার্ট ভাঁজ করে ঢোকাতে গিয়ে সুটকেসের কোণায় লালের ঝলক। অর্চিষ্মানের ওয়ার্ডরোবে লাল রেয়ার। যে লাল টি শার্টটা বাড়িতে পরে ঘোরে সেটা আমার কনফারেন্স থেকে আনা। আমার ঢলঢলে হচ্ছিল, ওকে পারফেক্ট ফিট করেছে। এ ছাড়া প্রকাশ্যে লাল পরে ওকে ঘুরতে দেখিনি।

টেনে বার করলাম। সিল্কের উত্তরীয়। কী সুন্দর গো। কোথায় পেলে। কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দিয়েছে। উল্টেপাল্টে দেখলাম। কর্তৃপক্ষ ভদ্রলোক, চাদর জুড়ে নিজেদের নামঠিকানা ছেপে রাখেননি।

এমনি ভাঁজ করে দিল নাকি তুমি স্মিত হেসে ঘাড় ঝোঁকালে আর তোমার গলায় পরিয়ে দিল? ছবি উঠেছে নিশ্চয়? ওদের সাইটে সে ছবি ছাপবে? অর্চিষ্মান বলল, হয়েছে কুন্তলা। ওটা আমি তোমাকে দিয়ে দিলাম। থ্যাংক ইউ বলে উত্তরীয় ভাঁজ করে নিজের ব্যাগে ঢোকালাম।

আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো শোনাবে, তবে অর্চিষ্মান ও উত্তরীয় পরত না। স্কার্ফ, সানগ্লাস, টুপি ইত্যাদি অ্যাকসেসরিজের বিরোধী অর্চিষ্মান।  গগলস্‌ পরলে নাকি মনে হয় এইবার ও গায়ে তেল মেখে সিঁধ নিয়ে বেরোবে। টুপি জিনিসটা অর্চিষ্মান মনে করে ব্যান করে দেওয়া উচিত। বা ফরমান দেওয়া উচিত যে একটা নির্দিষ্ট লেভেলের সুন্দর দেখতে না হলে টুপি পরা যাবে না। জিজ্ঞাসা করেছিলাম লেভেলটা কী? ভেবে বলেছিল, যৌবনের ব্র্যাড পিট। বা জনি ডেপ।

স্কার্ফও তাই। আমি একবার এক ফ্যাশন ফরওয়ার্ড শহরে গিয়েছিলাম। মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালে জামাকাপড়ের বিজ্ঞাপনে এক সুন্দর পুরুষ মডেল দাঁড়িয়ে থাকতেন। বিরাট বোর্ড, লার্জার দ্যান লাইফ মডেল। অ্যামেরিকান ঘরানার মডেলদের গুলিপাকানো টেরিবাগানো চোখধাঁধানো সুন্দর না, আরেকটু-হলেই-মিস-করে-যাচ্ছিলে-তো সুন্দর। অনায়াস সুন্দর। উদাসীন সুন্দর। এমন সুন্দর যে সে ছবির দিকে সোজা তাকাতে পারতাম না, আড়চোখে তাকাতাম।

সে মডেলের বাকি জামাকাপড়ের সঙ্গে গলায় একটা নীল স্কার্ফ পেঁচানো থাকত। বাড়ি ফেরার আগের শনিরবিবারে দোকানে গেছি। কোনও দরকার নেই, স্রেফ কনফর্মিস্ট চকোলেট কিনব বাড়ির জন্য। কেনা হয়ে গেছে। কাউন্টারের পথে পুরুষদের জামাকাপড়ের র‍্যাকের পাশ দিয়ে আসছি। আচমকা নীলের ঝলক। ঠিক ওই ছেলেটার মতো একটা স্কার্ফ। অফ কোর্স ছেলেটার স্কার্ফের মতো না, না হলে আর আমার নাগালে হবে কী করে। কয়েকবাক্স চকোলেট শেলফে রেখে এসে স্কার্ফটা নিয়ে নিলাম।

সে স্কার্ফ নিয়ে দশ বছর ধরে তিনটে বাড়ি ঘুরে ফেলেছি, তিরিশ সেকেন্ডের জন্য অর্চিষ্মান ও স্কার্ফ ছুঁয়ে দেখেনি। ব্যাগ থেকে বার করার পর তিন সেকেন্ড গলায় পেঁচিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে খাটে গড়াগড়ি খেয়ে হেঁচকি তুলে ফেলেছিল। কাজেই উত্তরীয় গাপ করে আমার গিল্ট নেই।

ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিচে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম। ছোট্ট লনে ছাতার নিচে চেয়ারটেবিল। অর্চিষ্মানের ফোনে মেসেজ আর কলের বন্যা শুরু হয়েছে।

ভালো লাগে না।

লাগার কথাও না।

অর্চিষ্মানের গাড়ি এসে গেছে। কফি শেষ করে বাইরে গেলাম। আবার তরশু দেখা হবে। দিল্লিতে। অর্চিষ্মান ঢাকা থেকে ফিরলে। জানালা নামিয়ে অর্চিষ্মান বলল কুন্তলা, থামেলে গিয়ে মদগাঁজা খেয়ো, জুয়াসাট্টা খেলো, কিন্তু দোহাই তোমার সারাদিন হোটেলে বসে থেকো না।

ছাতার নিচে ফিরে এলাম। আরেক কাপ কফি নিলাম। রোল্যান্ড টোপরের দা টেন্যান্ট, একশো চুয়াত্তর পাতার হরর, সাঁইত্রিশ পাতা পর্যন্ত পৌঁছে আর এগোতেই পারছি না। এমনও না যে টেন্যান্ট-ই পড়তে বসেছি। বসেছিলাম স্টিফেন গ্রেগরির 'করমোর‍্যান্ট' পড়তে, যেটা নাকি 'টেন্যান্ট'-এর সার্থক উত্তরসূরী। ভাবলাম তাহলে আগে টেন্যান্ট পড়ি তারপর করমোর‍্যান্ট পড়ব।

গোবলয়ের চেনা উচ্চারণে “অথেনটিক” “অথেনটিক” উচ্চারণ। পাশের টেবিল থেকে অথেনটিক থাকালির খোঁজ চলছে। চেনা লোকদের সঙ্গে কথা বলার যত অনীহা আমার, অচেনা লোকদের সঙ্গে আগ্রহ তত বেশি। স্কুলকলেজের পুনর্মিলনী উৎসবের খবর পেলে যে আমি রামনাম শুরু করি, সে আমিই লিফটে, প্ল্যাটফর্মে, কফিশপে আমি বন্ধুতার এপিটোম, ভদ্রতার প্রতিমূর্তি, উদারতার চ্যাম্পিয়ন।

একটা ঘটনা বলি। সাড়ে এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে যতবার শ্বশুরবাড়ির কোনও অনুষ্ঠানে গেছি - বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন - কারও না কারও সঙ্গে প্রথমবার আলাপ হয়েছে। কেউ কেউ তো আছেন যাঁদের সঙ্গে প্রত্যেকবারই প্রথম আলাপ হয়। দূর থেকে দেখে মনে পড়ে আগেরবার তিন্নিকে কনুই মেরে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল ইনি যেন কিনি? এবারেও তাই করতে হবে। সবাই তেমন হন না। কেউ কেউ থাকেন যাঁদের সঙ্গে জেনুইনলি প্রথমবার আলাপ হয়। বারো বছর পরে তাঁরা এই প্রথমবার জিষ্ণুর বউকে দেখছেন। সংখ্যায় নগণ্য কিন্তু এমন লোকও বেরিয়েছেন যিনি জানতেনই না অর্চিষ্মানের বিয়ে হয়েছে। জানতে পেরে অবাক মুখ করেছেন। অর্চিষ্মান পরে মাথা নেড়েছে। কী রেপুটেশন বুঝতে পারছ?

সেদিন কান থেকে ইয়ারফোন টেনে বার করে বলল, বাই দা ওয়ে, মামার জন্মদিনের পার্টিতে কারও সঙ্গে গল্প করেছিলে? প্রশ্নটা বুঝতেই পাঁচমিনিট লাগল। তারপর মনে পড়ল। গত বছর মামার পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনের পার্টিতে একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বটে যিনি আমাকে আগে দেখেননি কখনও। উনি সারাদিন মোটামুটি একাই বসে ছিলেন, আমি মাঝেমাঝে ঘুরে ঘুরে হাইহ্যালো করছিলাম, তারপর একসঙ্গে বসে খাওয়া ইত্যাদি হয়েছিল। কখনওই অর্চিষ্মান উপস্থিত ছিল বলে মনে পড়ল না।

কী করে জানলে?

তোমার প্রশংসা করছিল। বলতে ভুলে গেছি।

সাঁতার না জানা লোক পুরী গিয়ে যেমন নুলিয়াকে ধরে, অর্চিষ্মানকে ধরলাম। কী বলছিল বল বল। ওরে বাবা কুন্তলা কী আবার বলবে বলল তোমার তো বেড়ে বউ হয়েছে। ঠিক এই ভাষায় বলেনি, অর্চিষ্মান প্যারাফ্রেজ করেছে।

তুমি কী বললে? অর্চিষ্মান কানে ইয়ারফোন গুঁজল। কী আর বলব। বললাম হ্যাঁ, অল্পসময়ের জন্য ভালোই।

এটা প্যারাফ্রেজ নয়।

কিছু মনে করিনি। আমরা সবাই অল্পসময়ের জন্যই ভালো। এভরিওয়ান ইজ ডিজ্যাপয়েন্টিং আপঅন ক্লোজার ইন্সপেকশন। অল্পের বেশি সময় কাটাতে গেলে অন্য কারণ বা স্বার্থ লাগে যা দিয়ে খারাপটুকু অগ্রাহ্য করা যায়। সে রকম কিছু জোগাড় না হলে অল্পের ওপর সারাই ভালো।

মোদ্দা কথা, অল্পের ওপর আমি ভালোই কাজেই লাফিয়ে পড়ে প্রতিবেশী টেবিলের লোকজনকে জিম্বু থাকালি-র অথেনটিক থাকালির খোঁজ দিলাম। নাগপুর থেকে এসেছেন। গায়ে পড়ে বললাম, পাঠাও অ্যাপ আছে? না হলে ডাউনলোড করে নিন। ওঁরা অলরেডি ও সব সেরে রেখেছেন। তারপর আরেক কাপ কফি রুমে পাঠাতে বলে, বইপত্র গুছিয়ে ঘরের দিকে রওনা দিলাম। ওঁদের বলে এলাম, অল দা বেস্ট।

ঘরে ঢুকে স্লটে কার্ড গুঁজে, দরজার নব একবার, দু’বার, শিওর হতে তিনবার ঘোরালাম। সাড়ে ন'টা বাজছে। চেক আউট কাল সকাল আটটায়। অর্চিষ্মান আজ যে প্লেনটায় দিল্লি গেল, আমার সেটা কাল। অর্থাৎ হাতে আর সাড়ে বাইশ ঘণ্টা।

অচেনা শহরের গলির প্রায় শব্দহীন, গন্ধহীন, বন্ধুহীন এক ঘরে, যে ঘরের পর্দার রং পছন্দের কৃতিত্ব আমার নয়, ঝুল না ঝাড়ার গ্লানি আমার নয়, দেওয়ালের একটি ফোটো ফ্রেমের সঙ্গেও আমার স্মৃতির কোনও সংযোগ নেই, আমার হাতে সাড়ে বাইশ ঘণ্টা।

সাড়ে বাইশ ঘণ্টা আমি আমার স্মৃতির নাগাল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। স্মৃতি কি আসবে না? আসবে। মগজে গিজগিজ করবে। কিন্তু স্ট্রিক্টলি আমার আমন্ত্রণে। এই শহর, এই শহরের মানুষ, রাস্তা, গাছ, গলি, এই ঘরের দেওয়াল, বাতাস, জানালার গ্রিল, বিছানার চাদর আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র দৃশ্যের জন্ম দিতে পারবে না। হেডবোর্ডের রং চটা বিন্দুগুলো ঘরভর্তি হাহাহিহির মাঝখানে আমাকে ফাঁকা করে দিতে পারবে না, ইলেকট্রিক কেটলির ওপর অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবিটার ফ্রেম, কালকাজীর কাদায় পেছল খেতে খেতে অপ্রতুল ছাতার নিচে দুজনে ভিজতে ভিজতে বেসমেন্টের ছবিবাঁধাইয়ের দোকানে পৌঁছনোর সন্ধেটা মনে পড়িয়ে মুচকি হাসি এনে দিতে পারবে না। দেওয়ালের নেপালি ট্র্যাডিশনাল মুখোশের দিকে একবার কেন একশোবার তাকালেও ওই মোড়টা মনে পড়বে না যেখান থেকে ডানদিকে বেঁকে ট্যাক্সি রঘুনাথপুরের রাস্তা নিল। ধুলো রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে শিল্পীদের গ্রাম। আমরা বাড়িতে ঢুকছি, গোটিপুয়া নাচের পোশাকে বালিকারা দৌড়ে বেরোচ্ছে, ডোনারদের লোক্যাল ফ্লেভার দেওয়ার আয়োজন হয়েছে নির্ঘাত, আক্ষরিক 'ডান্সিং ফর ডেভেলপমেন্ট'। দোতলায় ঢালু ডেস্কের ওপর ছাত্রছাত্রীর মনোযোগী মাথা, শিক্ষক উঠে আসছেন, ওঁর সময় নষ্ট হবে কিন্তু উনি ইনসিস্ট করছেন সেটা কোনও অসুবিধেই নয়, অসামান্য সব শিল্পকর্ম আমাদের সামনে মেলে ধরছেন, সমুদ্রের ঢেউ, জগন্নাথের চোখ, আমাদের শিক্ষাই নেই এই শিল্প, চর্চা, এক্সেলেন্স অ্যাপ্রিশিয়েট করার, পৃষ্ঠপোষকতার তো ছেড়েই দিলাম। শেষমেশ দুটো নারকেলের মালায় আঁকা জগন্নাথের মুখ নিলাম। আমাদের দেখে কি শিল্পী বোঝেননি যে আমরা ফাইন্যালি এগুলোই কিনব? তাহলে তিনি অন্য জিনিসগুলো দেখালেন কেন? হয়তো নিজের বলেই দেখাতে ইচ্ছে করে। নারকেলের জগন্নাথ মিষ্টি হেসে খাটের পাশের দেওয়ালে টেঙে আছেন। ফুলজল তো দূর, ঝাড়িও না। ভগবানের নিটোল কাঁধে ধুলো অথচ গোলগোল চোখ একইরকম ক্ষমাশীল। সে চোখের দিকে যতবার চোখ পড়ে, আমার মাথার ভেতর ট্যাক্সি ততবার জনবহুল মোড় থেকে ডানদিকে রঘুনাথপুরের দিকে বাঁক নেয়।

হোটেলের দেওয়ালের মুখোশ আমার দিকে কটমট তাকিয়ে থাকে, আমি মুখোশের তাকিয়ে থাকি। নাথিং। জিরো। নাডা।

এই স্মৃতিহীনতার স্বর্গ, নেক্সট সাড়ে বাইশ ঘণ্টার জন্য আমার। অর্চিষ্মান যদি মনে করে এই স্বর্গ ছেড়ে থামেলের গলিতে মাতালের ধাক্কা খেয়ে বেড়াব, তাহলে অর্চিষ্মান আমাকে চেনে না।

এসি মাপমতো করে ধপধপে লেপ টেনে আধশোয়া হলাম। টিভিতে মিউটে সলমান খান নাচছেন। বুকের ওপর ল্যাপটপ মেলে গুগল ডক খুলে নাম দিলাম কাঠমান্ডুঃ১। শুনেছি সুনীল রোজ চারঘণ্টা করে লিখতেন। শুনেছি মায়া এঞ্জেলো বাড়ির বদলে হোটেলে গিয়ে লিখতেন। আজ এ দুজনকে নিজের ভেতর চ্যানেল করব।

সৎ কাজে শত বাধা। দু'ঘণ্টা হয়নি ব্রেকফাস্টে গাণ্ডেপিণ্ডে গিললাম, অলরেডি খিদে খিদে পাচ্ছে। ফোন তুলে আলু সদেকো পাঠানোর অনুরোধ জানালাম। বেল বাজল। চটপটে মেয়ে চটপটে গলায় বলল হ্যালো ম্যাম। মানুষের এনার্জি যে কী আকর্ষণীয়। মানুষের এনার্জিই আসলে আকর্ষণীয়। নাম জিজ্ঞাসা করতেই হল।

মেয়েটি নাম বলল আর মাথার ভেতর উনিশশো নিরানব্বই দৌড়ে এল। ফার্স্ট ইয়ার। অংক পাসের ক্লাস। মেয়েটির অনার্স সম্ভবতঃ ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি। আমার জীবনে একমাত্র দেখা মানুষ যে নিজের নামের সঙ্গে সঙ্গে মানেও বলত। বাংলা ভাষায় পাপিতা মানে দিঘি সেটা আমি সে মেয়ের কাছ থেকে প্রথম জেনেছিলাম।

এ পাপিতা অবশ্য নেপালি ভাষায় নামের মানে কি জানায়নি। হতে পারে এ হিন্দি মানেটা জানে না। বা জানলেও ডাজন’ট কেয়ার।

আলু সদেকোর প্লেটটা ডেফিনিটলি একজনের জন্য নয়। সিকি বাটি শেষ করেই আমার কার্ব কোমা এসে গেল। প্রবৃত্তির নিবৃত্তি করে নিই এই বেলা, লেখার সময় তো পড়েই আছে।

ঘুমোলাম। উঠলাম। পাশ ফিরে মাথা তুলে দু’চামচ আলু সদেকো মুখে পুরলাম। দু’চুমুক জল। টিভিতে রজনীকান্তের রোবট বদমাশদের মেরে পাট করছেন। লেপের তলা থেকে বেরিয়ে ঘরের কোণা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কফি বানিয়ে খেলাম। যাঁরা বলেন চা কফি তাঁদের স্লিপ শেডিউল ঘেঁটে দেয় তাঁদের আমি বুঝি না। অর্চিষ্মানও বোঝে না। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক কাপ কফি খেয়ে এসেছি।<

ফোনের পিং-এ ঘুম ভাঙল। আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার মানে। অর্চিষ্মান ঢাকা পৌঁছে গেছে। সারাদিন বেরোওনিতো? এখন বেরোও। বেশি রাত কোরো না।

হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। ঘুমের ঘোর কেটে গেছে। উঠে পড়লাম। আলু সদেকোর বাটি খালি। এবার ঝোল মোমো খাওয়া যায়। যদি পাপিতাই দিতে আসে তাহলে এই ইমপার্সোন্যাল সমুদ্রে একটুখানি চেনার ছোঁয়া পাই।

পাপিতাই এল। আলু সদেকোর খালি বাটি ট্রে-তে তুলে চকিত চোখ সারা ঘরে বোলাল কি?

আই এট দা হোল থিং বাই মাইসেলফ। আই অ্যাম ইটিং টু মাচ।

নো ইউ আর নট। অকেলে রহনে সে ভুখ জোর লাগতা হ্যায়।

পার্সোন্যাল বাউন্ডারি ক্রস হয়ে যেতে পারে তাছাড়া পাপিতার হাতও জোড়া। হাই ফাইভ গিলে নিলাম। আর কিছু লাগবে? জিজ্ঞাসা করল পাপিতা।

টি ব্যাগ ফুরিয়ে গেছে।

দশ মিনিট যেতে না যেতে বেল। পাপিতা নয় কিন্তু আরেকটি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিমুখ। হাতে চা ব্যাগ, কফি স্যাশে এবং চায়ের কাপ। জানি পাপিতা বুদ্ধি খাটিয়ে সব পাঠিয়েছে। পাপিতা অনেক দূর যাবে। পাপিতা অনেক দূর যাক।

লেখা হবে না বুঝে গেছি ততক্ষণে। বই খুলে বসলাম। পড়াও তো একরকমের লেখাই। পড়তে পড়তে ঢুললাম, ঢুলতে ঢুলতে মোমো খেলাম। খেয়ে ঘুমোলাম। ঘুম ভেঙে দেখলাম টিভিতে সলমান খানের সিনেমা চলছে যাতে পার্শ্বচরিত্রদের অভিনয়ক্ষমতা এক্স্যাক্টলি আমার সমান। সলমান খান আমাকে আশ্চর্য করেন। একজন শিল্পী, গোটা কেরিয়ার, গোটা বডি অফ ওয়ার্ক শুধু ফ্যানেদের জন্য উৎসর্গ করে দিলেন। নিজস্ব ক্রিয়েটিভ খিদের কেয়ার না করে। বা সে খিদে ছিলই না হয়তো। সেটা আরও আশ্চর্যের।

এগারোটা বেজে গেল। এগারোশো শব্দও হয়নি। ঝোল মোমোও শেষ হয়নি। গোটা বারো মোমো ছিল বোধহয়। চারটে বাকি। ছোটবেলায় অ্যাফ্রিকার ক্ষুধার্ত শিশু নিয়ে কেউ ইমোশন্যাল ব্ল্যাকমেল না করা সত্ত্বেও খাবার ফেলতে অস্বস্তি হয়। ফেলে রাখা খাবার আমাকে ইমোশন্যালি নয়, এসথেটিক্যালি আহত করে। তবু মোমোগুলো খেলাম না। বিপদ হতে পারে। তাছাড়া ঝোলটাও আর ঠিক তরল নেই। ঢাকা দিয়ে ঘরের বাইরে বারান্দায় বাটি নামিয়ে রেখে এলাম। আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। অর্চিষ্মান থাকলে তবু সহানুভূতির আশা থাকত, একা ঘরে পেটব্যথার সে বেনিফিটও নেই।

টিভি বন্ধ করে এসি বাড়িয়ে লেপমুড়ি দিলাম। শিব্রাম চক্রবর্তী স্মরণে এলেন। কেউ ওঁর দিনের রুটিন জানতে চেয়েছিল। শিব্রাম বলেছিলেন এই তো সকালে উঠি, কাগজ পড়ি, বাজার যাই, স্নান করি, খাই, বিকেলে প্রকাশকদের তাগাদা দিতে যাই, রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমোই।

তাহলে লেখেন কখন? শিবরাম বলেছিলেন, কেন পরের দিন?

সকালে রেডি হয়ে নিচে গেলাম। নেপালি টাকা আর ডলার মিলিয়ে বিল মেটাব, কিন্তু আমার টার্গেট হচ্ছে, ন্যাচারেলি, যত পারা যায় নেপালি টাকা মুক্ত হয়ে ডলার যথাসম্ভব কম হাতছাড়া করা। একটা জটিল কনভারশনের মধ্য দিয়ে অন্ততঃ পাঁচ বার রিসেপশনের ছেলেটাকে ঘুরিয়ে, অবশেষে পার্সের শেষ নেপালি নোট (এয়ারপোর্টে খরচ হাতে রেখে) মুক্ত হয়ে এবং মোটে আট ডলার হাতছাড়া করে গুনগুন করতে করতে ব্রেকফাস্টে গেলাম। সিকিউরিটি ভাইসাব এসে জানালেন গাড়ি এসে গেছে। উঠে রিসেপশনে রাখা ব্যাগ নিতে গেলাম।

ছেলেটি উঠে এল। আ স্মল ফেয়ারওয়েল গিফট। একটা তসর রঙের উত্তরীয় গলায় পরিয়ে দিল। আড়চোখে দেখলাম কোণায় হোটেলের নামঠিকানা গর্বিত ফন্টে ঝলমল করছে। পনেরো পারসেন্ট অফে স্পা-এর ব্যাপারটাও লিখেছে নাকি?

আবার আসবেন।

আসব।

যথারীতি ওয়েব চেক ইন-এ মিডল সিট অ্যাসাইন করেছিল। অত ডানবাঁ জানতামও না, জিজ্ঞাসাও করিনি। "জানালার সিট খালি থাকলে যদি দেন" বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভদ্রলোক যে শুধু জানালা না, ডানদিকের জানালার সিট আমাকে দিলেন, আগে জানা থাকলে সে জন্য এক্সট্রা থ্যাংক ইউ দিয়ে আসা যেত।



                                                                                                                                                        (শেষ)


Comments

  1. ছবিটা অন্নপূর্ণা-২ এর, তাই না? "দেখেই চিনেছি" একদমই নয় - গুগলে খুঁজে বলছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি তো তবু গুগল পর্যন্ত গেছেন। আমি অতও বুঝিনি। মনে হয়েছে বাঃ কী সুন্দর পাহাড়, তাই ছবি তুলে নিয়েছি।

      Delete

Post a Comment