কাঠমান্ডু ৩ঃ নাগরকোট


নাগরকোট জনপ্রিয় কিন্তু ছোট্ট জায়গা। একটা চৌমাথামতো জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারজি বললেন, অব কিস তরফ?

হোটেলের নাম বললেই যে সবাই ফস করে সব চিনে যাবে সে রকম আশা করবেন না। কারণ নেপালে হোটেল থেকে ওষুধের দোকান থেকে রেস্টোর‍্যান্ট থেকে জুয়ার আড্ডা থেকে বইয়ের দোকান - সবেরই নাম হয় এভারেস্ট নয় হিমালয় বা হিমালয়ান। নাগরকোটের বিখ্যাততম হোটেল হিমালয়ান ক্লাব। ড্রাইভারজি তার সামনেই গাড়ি থামিয়েছেন। আমরা যাব হিমালয়ান গ্লেসিয়ার-এ। অর্চিষ্মান নেমে এদিকওদিক তাকাল। ওই তো।

হিমালয়ান গ্লেসিয়ার-এর একতলার ডাইনিং রুমের একদিকের দেওয়াল পুরো কাচ, কাচের ওপারে ভিউ। কিন্তু আমরা কাচ দিয়ে ভিউ দেখতে চাই না, ভিউ-র ভেতর সশরীরে গিয়ে পড়তে চাই।

ভাইসাব বললেন, ভালো ঘর বেছেছেন, ভিউ পাবেন। অর্চিষ্মান আরও দু’ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেল, আমি আরও দু’ইঞ্চি কুঁকড়ে গেলাম।

ঘর আরামদায়ক্‌, পরিচ্ছন্ন, মাপমতো সাজানো। বারান্দার চেয়ারটেবিলে বসে তাকালে জঙ্গল, খাদ আর দিগন্তে হিমালয়।

যদি অবশ্য হাওয়া পরিষ্কার থাকে। এখন হাওয়া পরিষ্কার নয়। ভিউ বলতে কুয়াশাবৃত শূন্যতা। মন খারাপ করতে চাইলে করাই যায়। এভারেস্ট যদি ছেড়েও দিই, অন্নপুর্ণার পিক না দেখতে পেলে, মচ্ছাপুছরের ল্যাজ, এত পয়সা খরচ করে এত দূর আসার মানে কী?

আমার রোজকার ভিউ হইচইতে একেনবাবুর মুখ। আমার এই ভিউতেই পয়সা উশুল।

ঘরে ফিরে রিমোট টিপে টিভি চালালাম। জি মুভি এইচ ডি। সোনি নেই? যাহ। ভিউ না হলেও চলবে, হোটেলের টিভিতে সি আই ডি না হলে আই ফিল চিটেড।

টানা দশমিনিট আমার সাড়া না পেয়ে টুইটার থেকে মনোযোগ তুলে অর্চিষ্মান খোঁচাল, কী গো ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? আমি হাঁ-মুখ ওর দিকে ফিরিয়ে টিভির দিকে আঙুল তুলে দেখালাম। টিভিতে দাবাং টু চলছিল। সলমান খান সি জি আই-তে নাচছিলেন। সি জি আই-তে। অন্য সিনেমায় বাঘ সিংহ বুনিপ দেখাতে সি জি আই ব্যবহার হয়, সলমান খানের সিনেমায় সলমান খানের নাচের ভঙ্গি দেখাতে সি জি আই ব্যবহার হয়।

এ জিনিস ছেড়ে ভিউ দেখতে বেরোনোর ইচ্ছে ছিল না, অর্চিষ্মান ঠেলে তুলে দিল। নাগরকোটে আজ দুপুর থেকে কাল দুপুর পর্যন্ত থাকব। সময় কমই পড়বে। পিলেচমকানো বানানে বিভিন্ন পয়েন্টের পারমুটেশন কম্বিনেশনের প্যাকেজের তথ্যসম্বলিত প্রিন্ট আউট রুমে অলরেডি রাখা ছিল। মনে হয় না অত উদ্যোগ করে প্যাকেজ ধরে বেড়ানো হবে।

হয়ওনি। নাগরকোটের দু’বেলার উদ্দেশ্যহীন দুই হাঁটা আমার জীবনের হাঁটাসমূহের হল অফ ফেম-এ ঢুকে গেছে।

হোটেলের পেছনের বনপথ ধরলাম। বাথরুম হিসেবে বনপথটির জনপ্রিয়তার প্রমাণ বাতাসে অকাট্য। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত হিমালয়ান সুইট। কোন ঘরটা আমাদের? বুরবকের মতো এক দুই তিন তলা গুণতে শুরু করেছি, এক দুই তিন . . . অর্চিষ্মান বলল বারান্দায় দু'সেকেন্ডের জন্য চেয়ারে বসেছিলাম মনে আছে? বাকি বারান্দার চেয়ারগুলো টেবিলের সঙ্গে লাগানো, আমাদের বারান্দার চেয়ারদুটো পাহাড়ের দিকে মুখ করা।

পার্টনারশিপে গোয়েন্দা এজেন্সি খোলার প্রস্তাব দেব কি না ভাবছি, বনপথ বড়রাস্তায় পড়ল। নাগরকোটের সব বনপথ নাম্বারড। এটা স্ট্রিট নাম্বার এগারো। রাস্তার ওপারে একতলা বাড়ির সমান ঢিপি, ঢিপির গায়ে বোর্ডে 'উইন্ডি হিল'। শৃঙ্গারোহণ করলাম।

উইন্ডি হিল সার্থকনামা। ওঠামাত্র চুলটুল উড়ে একাকার। হিলের এ পাশে কালোপিচের রাস্তা বাঁক নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেছে। অন্য পাশে পাহাড় ঢালু নেমে গেছে। ঢাল আঁকড়ে লাল নীল চালওয়ালা বাড়ি, যে রকম বাড়িতে ড্রয়িংখাতা ভরে থাকত। বিস্তীর্ণ উপত্যকার ও প্রান্তে উঁচু উঁচু পাহাড়ের আউটলাইন।

অর্চিষ্মান দুই হাঁটু জড়িয়ে বসে পড়ল। আমিও বসলাম। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম দূরে নোংরা মতো একজন রাস্তা পেরোচ্ছেন। সরকারি রাস্তা, যে কেউ পেরোতে পারে। রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার জায়গারও কোনও কমতি নেই, এত বড় জঙ্গল, এত প্রকাণ্ড হিমালয়। কিন্তু মন বলছে ইনি সে সব জায়গায় ইন্টারেস্টেড নন। ইনি আমার মতো রাডারলেস শিপ নন, এঁর গন্তব্য আছে, সে গন্তব্যের প্রতি ফোকাস ও কমিটমেন্ট আছে।

সে গন্তব্য আমরা।

অর্চিষ্মানকে সাবধান করার সময় পেলাম না, তিনি স্পিড বাড়িয়ে তিন লাফে উইন্ডি হিলের মাথায় চড়ে অর্চিষ্মানের বাঁ হাত বাঁ পায়ের মাঝখান দিয়ে মাথা আর সামনের দু'পা গলিয়ে অর্চিষ্মানের ডান হাতের ওপর দিয়ে আমার বাঁ হাঁটু আলগোছে কামড়ে ধরলেন।

দূর থেকে যতটা মনে হয়েছিলতার থেকেও বেশি নোংরা। গলায় কলার থাকলেও সম্পূর্ণ বশ্যতা মনে হয় স্বীকার করেননি। রেগুলার রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, ধুলোয় গড়াগড়ি খান এবং চান করেন না। সাদাকালো লোম জায়গায় জায়গায় জটা পাকিয়ে গেছে।

আলাপপরিচয় হচ্ছে, গায়ে মাথায় হাত বুলোনো চলছে এমন হিলের পাদদেশে বাইক পার্ক করে “কিউট পাপি কিউট পাপি” চেঁচাতে চেঁচাতে দু'জন ছেলেমেয়ে উপস্থিত। পাপি বাকি শরীরটা অর্চিষ্মানের ডান হাত ডান পায়ের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে অম্লানবদনে আমাকে পাড়িয়ে দৌড়ে তাদের কাছে চলে গেল।

আমরা অপমানিত বোধ করে হিল থেকে নেমে এলাম। কালোপিচের রাস্তার ধারে মিনিম্যালিস্ট বাড়ি। সাদা দেওয়াল, নীল অ্যাসবেস্টসের ছা। এ বাড়ি থেকেই সাদাকালো সারমেয় বেরিয়েছিলেন। সহবত বিসর্জন দিয়ে খোলা দরজার ভেতর আড়চোখ চালালাম। কংক্রিটের স্ল্যাবে সিংগল বার্নার স্টোভ, সসপ্যান। সন্তর্পণে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলাম দেওয়াল ঘেঁষা চৌকিতে এক বয়স্ক মহিলা শুয়ে আছেন।

চায় মিলেগি দিদি?

মিলেগি।

দুধচিনি ছাড়া দু'কাপ চা বলে বারান্দার বেঞ্চে বসলাম। ঘরের ভেতর একটি অল্পবয়সী মেয়েও ছিল; চায়ের জল সে-ই বসাল। দৃষ্টির আড়াল বেরিয়ে এল একটি বছর সাতের বালকও। রাস্তায় দৌড়োদৌড়ি করে খেলছে। দু’হাতে কাচের গ্লাসে সোনালি চা নিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে এসেছে, এসেই চোখ কপালে তুলে চেঁচাচ্ছে, উঠে পড় উঠে পড়! সেরেছে, বেচাল করেছি নাকি? মেয়েটা হাত থেকে গ্লাস মেঝেতে নামিয়ে বেঞ্চিটা দেখাচ্ছে। কীসের ওপর বসছ দেখে বসোনি? মোটামুটি সমান দূরত্বে পোঁতা বাঁশের তিনটে খুঁটি। সাইডের দুটো বেঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। বেসিক্যালি একটা বাঁশের খুঁটিতে ব্যালেন্স করা তক্তার ওপর ফিজিক্সের আশ্চর্য কেরামতিতে গত দশ মিনিট আমি আর অর্চিষ্মান বসে আছি। মেয়েটা হাসছে। দুটো দুঃস্থ মোড়া বার করে দিচ্ছে ঘর থেকে। বসছি।

ছবির মতো রাস্তার ধারে ছবির মতো বাড়ির বারান্দায় বসে ছবির মতো নিসর্গের দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। আহ্‌। ঘরের পেছন দিক থেকে বেরিয়ে আসছে দুটো রাজকীয় মোরগ, একটা বাদামি একটা সাদা রাজকীয় মুরগি। অদৃশ্য নোংরা বাঁচিয়ে পা ফেলতে ফেলতে, অশ্রুত হিপহপের সঙ্গে ঘাড় নাড়তে নাড়তে। বাদামি নিজের মনে মাটি ঠোকরাচ্ছে, সাদা অর্চিষ্মানের মোড়ার গোড়া থেকে শুরু করে ঠোকরাতে ঠোকরাতে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। মোড়া শেষ, শ্বেতমোরগের আই লেভেলে এখন অর্চিষ্মান, ধারালো ঠোঁট উদ্যত করে ঘাড় পিছিয়ে সবে পিক আপ নেমে, “সামলে” বলে চেঁচিয়ে উঠলাম, অর্চিষ্মান লাফ মারল, মোড়া কাত হয়ে পড়ল, চা চলকে অর্চিষ্মানের কবজিতে পোড়াল, সাদামোরগ উদাস হেঁটে দৃশ্যের বাইরে বেরিয়ে গেল।

মোড়া তুলে, কবজিতে ফুঁ দিয়ে ফের সেটল করলাম। উইন্ডি হিলের টপে মেয়েটা লাফিয়ে, পাক খেয়ে, ওড়না উড়িয়ে নানারকম কসরত করছে, ছেলেটা বসে, উবু হয়ে, বুকে হেঁটে ছবি তুলছে। কিউট পাপি দৌড়োদৌড়ি করে ফোটোবম্ব করছে। কিউট পাপির উল্লাস এখান থেকে শুনতে পাচ্ছি।

চায়ের কাপ ঝুড়িতে ফেলে হাঁটা দিলাম। রাস্তা রীতিমত চড়াই। বাঁক ঘোরার সময় ইজিলি তিরিশ ডিগ্রি। গাড়িগুলোও গোঙাচ্ছিল। একটা মার্সিডিজকে দেখে তো রীতিমত চিন্তা হল। আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠলাম। অর্চিষ্মান এই লাইনটা পড়ে বলবে অগৌরবে বহুবচন ব্যবহারের বদঅভ্যেসটা ছাড়ো কুন্তলা। ছাড়লাম। আমি হাঁপাচ্ছিলাম, অর্চিষ্মান তেনজিং নোরগের সাবলীলতায় হাঁটছিল। অর্চিষ্মানকে বললাম কীসের ভরসায় উঠছি বল দেখি?

এর পর শুধু নামতে হবে?

হাই ফাইভ।

সূর্য মাঝআকাশ পার করেছে অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে শোঁ শোঁ করে মোটরবাইক উল্টো দিক থেকে আসছে। রাস্তার একটা অংশে দশ হাত পর পর কালভার্ট। এই কাল্ভার্টে একটা ছেলে বসে আছে, সামনে বাইক পার্ক করা। পরের কালভার্টে একটি মেয়ে; সিমোন বাইলসের অ্যাংগলে ঘাড় বাঁকিয়ে সেলফি তুলছে। আমরা তিন নম্বর কালভার্টে বসলাম। উইন্ডি হিলেও ছবি তোলা হচ্ছিল এখানেও ছবি তোলা হচ্ছে অথচ আবহাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা।

এদের প্রেম নামবে বলে মনে হচ্ছে না।

বা নেমেছিল। উঠে গেছে।

আমরাও উঠে পড়লাম। স্ট্রিট নম্বর বারো তেরো চোদ্দ পেরিয়ে এসেছি। পরিষ্কার পথের পাশে ময়লার ঝুড়িতে চিপসের প্যাকেট, জলের বোতল। ফার্মের সাইনবোর্ড। স্ট্রিট নম্বর পনেরো ষোল সতেরো। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ঢিবি জেগে উঠেছে। উইন্ডি হিলের থেকে প্রশস্ত, উঁচুও বেশি। তীরচিহ্নের ওপর কাঁপা তুলিতে লেখা ‘কফি শপ’। ঠিক হল কফি খেয়ে ফিরতি রাস্তা ধরব।

ঢিবিটা একটা ভিউপয়েন্ট। নাগরকোট থেকে আটহাজারি ক্লাবের ছ’টা শৃঙ্গই নাকি দেখা যায়। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালু, মানাসলু, ধৌলাগিরি, অন্নপূর্ণা। মাঠের কিনারে হেলানো বোর্ডের ম্যাপে একটি গোটা রেঞ্জের ছবিতে তীর দিয়ে এঁদের চেনানো আছে, সঙ্গে মচ্ছাপুছরে, অন্নপূর্ণা সাউথ, অন্নপূর্ণা সেকেন্ড, লামচুং, হিমচুলি, গৌরীশংকর ইত্যাদি চমৎকার নামের শৃঙ্গ। অর্থাৎ পরিষ্কার দিনে এই মাঠ থেকে গোটা হিমালয়টাই দেখতে পাওয়া যাবে। যেটুকু দেখা যাবে না, দেখার যোগ্যও না।

এখন সে সব কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য দেখা যাচ্ছে কি না সেটা ডিপেন্ড করবে দেখা বলতে কে কী বোঝে তার ওপর। দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার ওপরেও। এখন শূন্যতার ওপারে কুয়াশার দেওয়াল। দৃষ্টিসীমায় উঁচু পাহাড়ের আবছা আউটলাইন। দৃষ্টিসীমার কল্পনার কূল ছাপানো উঁচু উঁচু পাহাড়। পায়ের নিচে খাদ, কল্পনার থেকেও গভীর।

তাছাড়া মানুষ তো আছেই। নারী পুরুষ শিশু। শোনার জিনিসও কম পড়েনি। মাঠে ওঠার মুখে বেঞ্চে এক ভদ্রলোক রেডিও নিয়ে বসে আছেন। অকথ্য সব রোগের কানে আঙুল দেওয়া উপসর্গের বর্ণনা পাহাড় জুড়ে ইকো হচ্ছে। রেডিওর অবস্থা এত খারাপ যে কণ্ঠস্বর নারী না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না।

কফি শপ কাম রেস্টোর‍্যান্ট, দোতলায় বসার ব্যবস্থা। অর্চিষ্মান ভেতরে ঢুকে সাজানো ঘরে জানালার পাশে বসল। আমি বললাম ইস এখানে গুমোট বসব না। একতলায় নেমে খোলা কিচেনের একটু তফাতে, যেখানে ভিড় সামলানোর জন্যই সম্ভবতঃ একসারি চেয়ারটেবিল পেতে রাখা হয়েছে, বসলাম।

নেপালে লোকে অনেক কারণে যায়। কাউকে এভারেস্ট ডাকে, কাউকে পশুপতিনাথ ডাকেন, অন্নপূর্ণার বেসক্যাম্প অর্চিষ্মানকে নিয়মিত হাতছানি দেয়। আমাকে ডাকে আলু সদেকো।

জি কে টু-র এম ব্লক মার্কেটের হিমালয়ান কিচেনে আমরা স্রেফ আলু খেতেই যাই। অর্চিষ্মানের ফেভারিট আলু কো আচার, যেটা কমপ্লিমেন্টারি আসে, যেটা অশ্লীলরকমের ঝাল, যেটা ননস্টপ খেতে খেতে আমরা একে অপরকে বলি, ঝোলটা খেয়ো না। তারপর প্লেটে চড়ে আসে আলু সদেকো। আমার ফেভারিট। মেথি, সেচুয়ান মরিচ, কাঁচা লংকা, শুকনো লংকা, পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দেওয়া সর্ষের তেল মাখামাখি সেদ্ধ আলুর টুকরো। সাদা তিলের গার্নিশ। জি কে টু-র আলু সদেকোতে যদি ওই সুখ, নেপালের আলু সদেকোতে কেমন হবে যতবার কল্পনা করার চেষ্টা করেছি গায়ে কাঁটা দিয়েছে।

মেরে লিয়ে এক আলু সদেকো প্লিজ, বলে এমন ভঙ্গিতে মেনুটা বন্ধ করলাম যাতে আমার সিদ্ধান্তের অটলতা নিয়ে কারও সংশয় না থাকে। অর্চিষ্মান মেনুর কয়েকটা পদ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে চাউমিন নিল। আর ফ্যান্টা। ইয়ে, ফ্যান্টা কি ক্যান না বটল?

ছেলেটা বলল, শিশি।

একবার এক পাকিস্তানি দোকানে রোববারের মাংসভাত খেতে গেছিল অর্চিষ্মান। খাওয়ার পর এক কাপ চা। কাউন্টারের মহিলাদ্বয় স্পষ্টই বাংলাদেশি। অর্চিষ্মান বাঙালিসুলভ ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ না করে হিন্দিতেই অর্ডার দিয়েছিল। কিন্তু ব্রেন ইনফরমেশনটা প্রসেস করে ফেলায় জিভ দিয়ে "এক কাপ চা দিজিয়ে" গোছের কিছু একটা বেরিয়ে পড়েছিল। ভদ্রমহিলা দুজন নাকি চায়ের আয়োজন করতে করতে বলাবলি করেছিলেন, চা-টা আমাদের মতো করে বলল, দেখলি?

ছেলেটা অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার পর বললাম, শিশিটা আমাদের মতো করে বলল, দেখলে?

অর্চিষ্মানের ফ্যান্টা, আমার কফি আগে এসে গেল। বসে রইলাম। বসে থাকতে এত ভালো লাগে। একটা দুটো মাছি উড়ছে। আমি প্রবেশপথের দিকে পিঠ করে বসেছি, মানুষের নড়াচড়া হাসিগল্পের আভাস পাচ্ছি। অর্চিষ্মান বলছে, একটা যা মজার বাচ্চা এসেছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছি। ঝুঁটিতে ম্যাচিং রিবন বেঁধে টাইট চুড়ি পরা থাবা দিয়ে টেবিল থাবড়াচ্ছেে। একটা কুকুর সরু পাঁচিল বেয়ে হেঁটে ঠিক আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে উদাস মুখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্চিষ্মান হেই হুই করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে, পাত্তাই দিচ্ছে না। রান্নাঘরে ছ্যাঁকছোঁক রান্না হচ্ছে। এত দেরি করছে কেন বল তো? অর্চিষ্মান বলছে, এরা খুব স্ক্র্যাচ থেকে রান্না করে বলে দেরি এবং টেস্টি দুটোই হয়।

দেরিতে আমাদের অসুবিধে নেই। খেয়ে উঠে হোটেলে ফিরব। ফেরার পথ যে রেটে ঢালু, একবার নামতে শুরু করলে ধাঁই ধাঁই করে পৌঁছে যাব। বসে বসে আকাশবাতাস দেখলাম। হাবিজাবি গল্প করলাম। খাবার এসে গেল। ইয়াব্বড় প্লেটভর্তি চাউমিন, ইয়াব্বড় প্লেটভর্তি আলু সদেকো। জি কে টু-র হিমালয়ান কিচেনের থেকে ঘরোয়া, একই রকম সুস্বাদু। দিল্লির খাবারের ভ্যারাইটি ও কোয়ালিটির প্রতি নতুন করে সম্ভ্রম জাগল।

বিল মেটাতে ওপরে গেলাম।

বাচ্চা কোলে এক ভদ্রলোক ইন্ডিয়ান পাঁচশো টাকার নোট ধরে কাউন্টারের ছেলেটার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমাদের নেপালি টাকা ছিল। ভদ্রলোককে দাঁড়াতে বলে ছেলেটা আমাদের অ্যাটেনশন দিল। চামচে মৌরি তুলতে তুলতে অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করল, টাওয়ার কিতনা দূর হ্যায় ভাইসাব?

ক্লাসিক অর্চিষ্মান।

ধরা যাক রাতে দু’নম্বরে খাওয়ার কথা হয়েছে। মা তারায় খাব। কী খাব। কেন খাব। প্যাক করিয়ে আনব কি না। আগেরবার মোচাটা সুবিধের লাগেনি এবার ধোঁকা ট্রাই করা যেতে পারে। বেগুনিতে পারপেচুয়ালি নুন কম দেয় কাজেই বেগুনভাজা অর্ডার করা বেটার। সন্ধে থেকে শুধু ওই কথাই হচ্ছে। যথাসময়ে বেরিয়েছি, হাঁটছি, আকাশবাতাস লোকজন দেখতে দেখতে। জলওয়ালার দাদা ফলওয়ালা, নীলকমল চেয়ারে বসে আনন্দবাজার পড়ছেন, পোলাইট ঘাড় নাড়ছি। মাছের দোকানের সামনের কুকুরগুলোকে ডিঙোচ্ছি, বাঁদিকে করুণাদি চিমটে দিয়ে মোমো তুলে ঠোঙায় পুরছেন, ডানদিকে ঠং ঠং শাওয়ার্মা, ও বাবা এই নতুন ফুচকাটা আবার কবে খুলল? খুলবি তো খোল খুলেছে আমার বাঁধা ফুচকার দোকানের পাশেই, ওখানে দাঁড়িয়ে নতুন ফুচকা চেখে দেখার স্মার্টনেস হবে না আমার। ওহম্‌ (ওম্‌ না কিন্তু) ইলেকট্রিশিয়ানসের পুত্রবধূর দুই কান থেকে দুই দুর্গাঠাকুরের মুখ দুল দুল দুলছে। অন্নপূর্ণার ভিড় বাঁচিয়ে নারকেলকুরুনির দোকান পেরিয়ে মা তারার বাইরে টেবিলে বসা ছেলেটার দিকে পরিচয়ের ভুরু তুেছি, ছেলেটা হেসে বলছে দিদি অনেকদিন পর, ভালো আছ? দাঁত বার করে কাচের দরজার পুশ লেখার ওপর হাত রেখে ঠেলছি আর অর্চিষ্মান কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলছে, ওপরে সোনার বাংলায় গেলেও হয়।

আমি অ্যাংজাইটির রুগি। কী হয়, কী হতে পারে, হলে কী হবে হ্যান্ডল করার ক্ষমতা আমার নেই। কী হচ্ছে সেটাতে ফোকাস করতেই আমার নেক্সিটো খেতে হয়। অথচ অর্চিষ্মান রেগুলার আমাকে এই খাদের কিনারে নিয়ে যাবে। প্রসেনজিৎকে রাজমা করতে বলা হবে ঐকমত্যে পৌঁছনোর দশ মিনিট পর টাইপ করবে মুগ ডাল করালেও হয়। দেখো তোমার যা ইচ্ছে।

আমরা টাওয়ারে যাব না, কফি আলু সদেকো খেয়ে হোটেলে ফিরে আসব ঠিক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও অর্চিষ্মান টাওয়ারের খোঁজখবর নিচ্ছে। নিচ্ছে মানেই যে টাওয়ার যাওয়া হবে তেমনও নয়। হতেও পারে, নাও হতে পারে।

টাওয়ারের ব্যাপারে অর্চিষ্মান কোথা থেকে জেনেছে আমি জানি। হোটেলের সেই প্যাকেজের প্রিন্ট আউটে। টাওয়ার যখন ভিউ পয়েন্ট হওয়ার চান্স আছে। এই রাস্তা ধরে গেলেই যে টাওয়ারে পৌঁছনো যাবে সেটাও ব্যাক অফ দা মাইন্ড ছিল কারণ নাগরকোটের শিরদাঁড়া এই রাস্তাটাই আর রাস্তাটা যে রকম কোনওদিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে ধেয়েছে, টাওয়ার জাতীয় কিছু থাকলে এ রাস্তার অন্তেই থাকার সম্ভাবনা।

পাশের ভদ্রলোক লাফিয়ে পড়লেন। টাওয়ার কী ব্যাপার? ছেলেটা বলল। ইহাঁ সে এক কিলোমিটার দূর এক ভিউ পয়েন্ট …

আমরা চেনা লোক দেখলে ফুটপাথ বদলাই, এঁরা বেড়াতেও চেনা লোক ছাড়া যান না। বিরাট টিম। ভ্যান ভাড়া করে বেরিয়েছেন। ভদ্রলোক টিমের কাছে টাওয়ার যাওয়ার প্রস্তাব পাড়লেন। পয়দল যানা হ্যায়? টিম পত্রপাঠ না করে দিল। ভদ্রলোক, স্ত্রী বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ভ্যানের জানালায় কনুই রেখে মোবাইলরত ড্রাইভারকে বললেন আপনি অপেক্ষা করবেন, আমরা টাওয়ার হয়ে আসব? ড্রাইভার বললেন হেঁটে যাওয়ার দরকার কী, গাড়িতে উঠুন নিয়ে যাচ্ছি। ভদ্রলোকের লাফটা মনে আছে। চেয়ারটেবিলে এলিয়ে পড়ে থাকা হোল টিম দৌড়ে ভ্যানে উঠল আর ভ্যান আমাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।

আমরা ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভ্যানের ভটভটের শেষটুকু মিলিয়ে যেতে সবে বলতে যাব কী নিস্তব্ধ না? অমনি এক পুরুষকণ্ঠ হেঁকে উঠলেন। ভাষা নয়, ধ্বনি। উত্তরে ম্যাঅ্যাঅ্যা ভেসে এল। এই চলল কিছুক্ষণ। এদিকে পুরুষ, ওদিকে পাঁঠা। ছাগলের গলার টোনের তফাৎ করতে পারি না তাই বুঝলাম না একটাই ছাগল উত্তর দিচ্ছে না একাধিক। তাছাড়া ছাগল হলেও ম্যানার্স আছে। একে যবে কথা কয় অন্য সবে মৌন রয়। টিভি চ্যানেলের প্যানেলিস্টদের মতো নয়। কাজেই একজন উত্তর দিচ্ছিল না একাধিক ছাগল পালা করে, সেটা বুঝতে পারলাম না।

মাঠের মাঝখানে এক ভদ্রলোক একটা ঘোড়ার রাশ হাতে ছবির মতো স্থির দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্চিষ্মান বলল টাওয়ার কিতনা দূর ভাইসাব?

ভদ্রলোক জানালেন দেড় কিলোমিটার।

অর্চিষ্মান আমার দিকে তাকাল। যাবে?

সব কমপিটিশনে হারলেও আমি ভয়ানক কমপিটিটিভ। শেষ চালে হেরে যাবই তবু আমি, আবার খেলব চাইবই প্রতিশোধ। আমরা সেই সকাল থেকে টাওয়ারের বিষয়ে জেনে বসে আছি আর ওরা পাঁচমিনিট আগে জেনে আমাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে টাওয়ার দেখতে চলে গেল ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়নি। টাওয়ার যাওয়ার পক্ষে একটু দেরি হয়ে গেছে কিন্তু জোরে হাঁটলে মেক আপ হয়ে যাবে।

তবে জোরে হাঁটা কষ্টকর। কারণ আগেই বলেছি, রাস্তাটা আনবিলিভেবলি চড়াই। বিশেষ করে বাঁকগুলো। হাঁটতে হাঁটতে যখন মনে হচ্ছে ধুর না এলেই হত তক্ষুনি কানে আবছা ক্যালরব্যালর, চোখে হলদেগেরুয়ার ঝলসানি। এক ভদ্রলোক, অর্চিষ্মানকে হাইটে প্রায় ধরে ফেলেন, ওই রঙের সুতির পাঞ্জাবি আর ফ্লপি টুপি পরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

বললাম, ইনি যদি বাঙালি না হন আর পাঞ্জাবিটা যদি শান্তিনিকেতন থেকে না কিনে থাকেন আমি ওঁর টুপিটা চিবিয়ে খেয়ে নেব।

একটা, দুটোও হতে পারে, বাজখাঁই বাসভর্তি বাঙালি এসেছে। বাবু এদিকে আয়, বাবু ওদিকে যাস না, ওরে বাবা আরও সিঁড়ি উঠতে হবে নাকি, জলের বোতলটা বাসে কি রয়ে গেল-র বর্শার ফাঁক গলে গলে, খানবিশেক সিঁড়ি দৌড়ে আমরা টাওয়ারের চাতালে উঠে গেলাম।

চিপসের প্যাকেট ও টুরিস্ট ছত্রাকার চাতাল। বাঙালি মাসিপিসি কাকুজেঠুদের সঙ্গে কফিশপের ফ্যামিলিটাকেও দেখলাম। চাতালের মাঝখানে উঁচু টাওয়ার। নব্বই ডিগ্রি সোজা ধাতব মই বেয়ে টাওয়ারের টঙে উঠতে হয়। টঙে চারপাঁচজনের বেশি দাঁড়ানো যায় না। ওপরে অলরেডি ভিড়। মইয়ের নিচে লাইন দিলাম। অর্চিষ্মানও দেখি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। দু'জন মই বেয়ে নেমে এলেন। আমরা মই বেয়ে উঠে গেলাম। এক মহিলা খুব ছবি তুলছেন। দিগন্তে বাড়িঘরদোরের জটলাটা কি কাঠমান্ডু? দূরের থেকে কাছের ভিউ ইন্টারেস্টিং। চাতালের রেলিং ঘেঁষে তুমুল প্রেম। একটু দূরে একটা সমতল মাঠে বক্স থেকে নেপালি গান বাজছে, সঙ্গে সমবেত নাচ। আমরা আবার উল্টো হয়ে মই বেয়ে নেমে এলাম। অর্চিষ্মান বলল একবার ওই নাচগানের মাঠে যাবে?

ওটা তো প্রাইভেট পিকনিক মনে হচ্ছে।

অর্চিষ্মান উদাস। জানি, কিন্তু খুব মজা হচ্ছে মনে হচ্ছে।

মজা চাই? সে তো এখান থেকেই হতে পারে। বলে দূরদর্শনের নেপালি অনুষ্ঠান মনে করে করে হাত ঘুরিয়ে মিউজিকের তালে তালে নাচের চেষ্টা করলাম। অর্চিষ্মান বলল ওরে বাবা কুন্তলা থামো। আমার মজার সাধ মিটে গেছে।

মনে পড়ে গেল। রেডিওতে গান হচ্ছে, একটা নিঃশ্বাস এক্সট্রা ফেললে চুয়াত্তর মিস হয়ে যাবে, মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসতেন। সোনা, এই গানটায় কেমন ভালো নাচ হয় দেখবি, বলে খুন্তি হাতে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে আমার পেট কনকন করছে, মা চরম সিরিয়াস। মা'র কমিটমেন্ট, অ্যাজ অলওয়েজ, নিশ্ছিদ্র। আমার কাতর অনুনয়ে অবশেষে মা থামছেন। রান্নাঘরে দৌড়ে যেতে যেতে বলছেন, কেন ভালো হচ্ছিল না নাচ?

প্রচণ্ড ভালো হচ্ছিল, কিন্তু দরকার নেই।

সব কর্মফল। আমি মাকে নাচতে দিতাম না, এখন আমাকে অর্চিষ্মান মনের সুখে নাচতে দিচ্ছে না।

অর্চিষ্মান বলল পা চালাও কুন্তলা, অন্ধকার হল বলে। চালাও বললেই তো চালানো যায় না, উঠতে হার্টে চাপ পড়ে, নামতে হাঁটুতে। ওঠার সময় ভেবেছিলাম এখন কষ্ট করে নিই নামার সময় আরাম হি আরাম। আমার চিরকাল সন্দেহ ছিল এই সব 'এখন পরিশ্রম করে নাও পরে আরাম করবে' জাতীয় থিওরির সততায়। একবার পরিশ্রমের ফাঁদে পড়ে গেলে এখনও পরিশ্রম করতে হবে পরেও পরিশ্রম করতে হবে। যদি পাহাড়ে না চড়তাম, টাওয়ারে না উঠতাম, হোটেল থেকেই না বেরিয়ে শুয়ে শুয়ে দাবাং টু দেখতাম তাহলে ওঠার কষ্টও হত না, নামারও না।

দূর থেকে খ্যানখ্যান গান ভেসে আসছে। সেই ভদ্রলোক যিনি বেঞ্চে অকথ্য রোগের রেডিও নিয়ে বসেছিলেন, হাতে রেডিও দুলিয়ে সামনে সামনে চলেছেন, ভদ্রলোককে ঘিরে চলেছে দশ থেকে বারোটা বিভিন্ন সাইজের ছাগল।

স্পিডে হাঁটার ইনসেনটিভ হিসেবে উইন্ডি হিলে বসে সূর্যাস্ত দেখার গাজর ঝুলিয়েছিলাম, শেষরক্ষা হল না। পাইন গাছের ফাঁকের সূর্য আগুনের মতো জ্বলে নিভে গেল।

কালচে নীল আলোর আভায় চায়ের দোকান পেরোলাম আবার। বাচ্চা ছেলে নেই, মহিলা নেই, মোরগও না। উইন্ডি হিলও অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে আছে, নো প্রেমিকপ্রেমিকা, নো কিউট পাপি। স্ট্রিট নম্বর এগারোতে ঢুকে পড়লাম। বাঁশবনে সরসর দিনের বেলা একরকম, রাতে আরেকরকম। আমাদের হোটেলের লাগোয়া, পাহাড়ের ঢালে অল্প নিচের হোটেলে আলো জ্বলেছে। চাইনিজ ল্যাম্পশেডের লাল নীল আলোতে ডাইনিং রুম আলোকিত।

এই হোটেলের খাবার ভালো হবে মনে হচ্ছে।

কৌতূহলী হলাম। কী দেখে মনে হচ্ছে?

লাইটিং দেখে। আমি বলছি কুন্তলা এই হোটেলের খাবার ভালো হবে। রাতে এখানেই খাব।

আমাদের হোটেলে বাস ভর্তি জাপানি টুরিস্টরা এসে নেমেছেন। ডাইনিং রুম জুড়ে অবোধ্য কলকলানি। এতক্ষণ পাহাড় জঙ্গল ছাগলের সান্নিধ্যে অর্চিষ্মান হাঁপিয়ে উঠেছে, বলছে কোণের টেবিলটায় বসি নাকি? চা খাব আর আড়চোখে এদের দেখে আলোচনা করব? এতক্ষণ পাহাড় জঙ্গল ছাগলের সান্নিধ্যের ওম থেকে বেরিয়ে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার, অর্চিষ্মান নিজের ইচ্ছের গলা টিপে ঘরে চলে আসছে।

অ্যাকটিভ পরিশ্রমের ক্লান্তি একরকম, পরিশ্রম শেষ হয়ে বিশ্রাম শুরু হওয়ার পরের ক্লান্তির সঙ্গে তার তুলনা নেই। শরীর বিছানার ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু নাগরকোটে আমাদের একটাই রাত। বেরিয়ে পড়লাম। আটটা বাজতে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় টিমটিমাচ্ছে অফসিজনের পাহাড়ি শহর। দোকানের বন্ধ শাটারের সামনে গোল পাকানো কুকুর। ফ্লুরোসেন্ট সবুজ জ্যাকেট পরা লাঠি হাতে দুই 'টুরিস্ট পুলিস'কে ঘিরে চারপাঁচজন টুরিস্ট। কাঠমান্ডু ফেরার রুটের তুলনামূলক র‍্যাংকিং চলছে।

চাইনিজ ল্যাম্পশেডওয়ালা হোটেলেই প্রথম খোঁজ করেছিলাম। ওঁরা 'আমরা শুধু আমাদের হোটেলের লজারদেরই খেতে দিই' গোছের অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে হাঁকিয়ে দিয়েছেন। তাই আমরা এখন খাওয়ার জায়গা খুঁজছি। ক্যাফে ডু মন্ড নামের একটা দোকানের রিভিউ ভালো কিন্তু ম্যাপ মানলে সতেরো মিনিট হেঁটে যেতে হবে। ইমপসিবল।

ঠাণ্ডা বাড়ছে। হাত পকেট থেকে বেরিয়ে বুকের কাছে বিবেকানন্দ। এবার দোকান না পেলে ব্যাক টু হিমালয়ান গ্লেসিয়ার। রুম ডেলিভারি খেয়ে খেল খতম। দু'পা এগোতেই জ্যাকপট; দু'দুটো খাবার দোকান খোলা। রাস্তা থেকে দশবারোটা সিঁড়ি দিয়ে একটা নিভুনিভু দোকান। অর্চিষ্মান ইজ রাইট। লাইটিং ম্যাটারস। পাশেরটা বার্গ হাউস ক্যাফে অ্যান্ড হোটেল। এটার রিভিউ ট্রিপঅ্যাডভাইসরে দেখেছি। ভালো? ভালোই তো লিখেছে। জমকালো পুরোনো বাড়ি, টুনিবাল্বে মনোরম। দরজার সামনে দুটো ঝুপো কুকুর শুয়ে আছে। শুয়েই থাকবে। আমাদের সুবিধে হবে বলে সরে রাস্তা ছেড়ে দেবে না। দু’নম্বরের পাজি মোটকা কুকুরটার মতো। লোকের বাজারের ব্যাগ যতই ভারী হোক না কেন, শুয়ে শুয়ে ভুরু সেকেন্ড ব্র্যাকেট করে দেখবে কিন্তু সরবে না। সরবে, যখন কেউ ব্যাগ নিয়ে ওর ওপর উল্টে পড়ার ভঙ্গি করবে। তখন উসেইন বোল্টে লজ্জা দেওয়ার স্পিডে দৌড়বে।

দরজার ফ্রেম ধরে ব্যালেন্স করে, স্বাস্থ্যবান স্বার্থপর সারমেয়দের টপকে বার্গে ঢুকে পড়লাম। উঁচু সিলিং, কাঠের চেয়ার টেবিল, পা মুড়ে বসার দু’তিনটে কিওস্ক। অ্যাকোয়ারিয়ামের বুদবুদের ভেতর গোল্ডফিশরা সাঁতরাচ্ছে। একটা টেবিলে দুজন স্থানীয় লোক গোর্খা স্ট্রং নিয়ে বসে আছেন। একটা কিওস্কে একটা বছর দশেকের ছেলে বসে ফোন দেখছে।

একজন মোটামতো মহিলা মেনু দিয়ে গেলেন। নেপালে গেলে সবাই থাকালি খায়। বেসিক্যালি, থালি। অর্চিষ্মান মাটন থালি নিল, আমি শাকপাতা থালি। কাঁসার থালার মাঝখানে গোল করে ভাত। চারপাশে ছোট ছোট বাটিতে ডাল, শাক, ভাজা, শুকনো তরকারি, পনীরের ঝোল, পায়েস। দু'রঙা দু'রকম চাটনি পাতের পাশে। আর শাকের মতো একটা জিনিস, যার নাম গুন্দ্রুক। ফার্মেন্টেড শাকপাতা। অসামান্য খেতে। অসামান্য পুষ্টিকর। তবে দাঁতে আটকাবে। না আটকালে পয়সা ফেরত চাইবেন। কারণ ওটা গুন্দ্রুক নয়। অর্চিষ্মানেরও থালিতে আমার থেকে একটা তরকারি কম, বদলে মাটনের ঝোল।

আমি তো দশ সেকেন্ড থালার দিকেই তাকিয়েই থাকলাম। ইট লুকস্‌ সো গুড। মহিলা মুচকি হাসলেন। অ্যাপ বলছে আজ সাতাশ হাজার একশো তেতাল্লিশ পা হেঁটেছি। মানানসই খিদে পেয়েছে। অর্চিষ্মান ভাত নিল। ভদ্রমহিলা ডাল তরকারিও সাধলেন। দরকার হল না।

খাওয়া শেষ। দরজার সামনের কুকুরগুলো নেই। রাস্তা আরও ফাঁকা, হাওয়া আরও কনকনে। হাফ হেঁটে হাফ ছুটে হোটেলে ফিরে বিছানায় গা ঠেকানোমাত্র ঘুম এসে গেল।

                                                                                                                                                        (চলবে)




Comments

  1. bhishon bhishon bhalo laglo. Amaro beRano holo mone holo. khub bhalo thakben - Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ইন্দ্রাণী।

      Delete
  2. খুব আরাম হলো পড়ে... বিভিন্ন কারণে ঘেঁটে আছি, খুব অস্থির, এজিটেটেড হয়ে আছি। এমন সময় এই লেখাটা পড়ে কেমন আমারও কিছুটা বেড়ানো হলো। পুরোটা যেন চোখের সামনে দেখতে পেলুম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, শাল্মলী।।

      Delete
  3. সবসময়ের মতোই, ভালো লাগলো পড়ে।
    আপনাদের প্রচুর সাহস আছে - ওরম অচেনা কোনো কুকুর হটাৎ করে লাফিয়ে এলে তো আমি হুড়মুড় করে পালতে গিয়ে কান্ডই বাধতাম, আর এ তো আবার কামড়েও (সে আলগোছেই হোক না কেন) ধরেছিলো বললেন!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর ক'বছর আগে হলে আমাদের রিঅ্যাকশন আপনার থেকেও খারাপ হত, রাজর্ষি। কুকুরবেড়ালদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা র‍্যাডিক্যাল বদল ঘটেছে। সপ্তাহের এমাথা ওমাথা একে অপরকে সামলাই, পাছে কিছু একটা পুষে না ফেলি।

      Delete
  4. তোমার লেখাটা পড়ে তোমার সাথে মনে মনে আমিও ঘুরে নিলাম।

    ReplyDelete
  5. Ki bhalo je laglo lekhata pore ki bolbo Kuntala! Chokher shamne jeno shob dekhte pacchi. Thank you so much eto guchiye, protyek ti details diye likhbar jonne.
    Hoyeto Nepal konodin e jawa hobena ... kintu mone hocche bolte parbo giyechi bole :-)
    Hyan ... aloo sadeko ta ekbaar try kortei hocche ... dekhi kothaye payi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আলু সদেকো তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাড়িতে বানাতে পারবে, শর্মিলা। মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য একটা রেসিপি ভিডিও বার কর ইউটিউবে, তারপর বানিয়ে ফেলো। আলু, সর্ষের তেল আর বেসিক মশলা। ঠেসে ঝাল দিয়ো।

      তোমার যে লেখাটা ভালো লেগেছে সেটা যে আমাকে কতটা ভালোলাগা দিল সেটা বললে বোকার মতো শোনাবে। থ্যাংক ইউ। ভালো থেকো।

      Delete
    2. আলু সদেকোর জন্য ভিডিওটা দেখতে পার। সেচুয়ান পেপারের জায়গায় ইজিলি গোলমরিচ চালানো যাবে।

      https://youtu.be/FwsVcKrCCQE?si=MQc42dlyzABJLnKC

      Delete
    3. Arey! Eta ekta boro upokar korle Kuntala. Ami kichu video o kichu blogs dekhlam kintu bujhte parchilam na konta thik original taste dite pare. Tumi taste korecho tai eyi video tai follow korbo. Onek onek dhonnobad. Banale tomaye janabo. Ar tumio khub khub bhalo theko. Thank you again.

      Delete
    4. প্লিজ এত থ্যাংক ইউ বোলো না। আলু সদেকো অত্যন্ত ঘরোয়া খাবার কাজেই একেকজন একেক রকম বানান। তবে আমি যতগুলো খেয়েছি, তাদের সবার কাছাকাছি টেস্ট এই ভিডিওর রেসিপিটায় পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। অ্যাকচুয়ালি, আমিও উইকেন্ডে বানাব এটা দেখে দেখে। তুমি অবশ্য করে জানিয়ো তোমাদের কেমন লাগল।

      Delete
  6. প্রদীপ্তAugust 31, 2024 at 12:38 PM

    এর আগে আমি কমেন্ট করেছিলাম কেন হলনা কে জানে!

    ফের লিখি, ভারী আরামদায়ক লেখা। সাতাশ হাজার একশো তেতাল্লিশ! সাবাশ ব্যপার।

    ReplyDelete
  7. এত কাছে তাও নেপাল ঘুরতে যাইনি, তিনটে পর্ব দারুণ লাগলো পড়তে :) শেষ হয়নি তো নাকি ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. রোজ তোর কথা মনে করছি ঊর্মি। পোস্টগুলোতে আগে পরের পোস্টের লিংক দিতে হবে, রোজ ভুলে যাচ্ছি। আজ তুই কমেন্ট করলি, আজ ওটা সারবই সারব।

      Delete

Post a Comment