কাঠমান্ডু ২ঃ পোখরা, না পোখরা না?


সিদ্ধান্ত নিতে পাঁচ সেকেন্ড লেগেছিল। যে কারণে অর্চিষ্মানের হোটেলে উঠিনি সে কারণেই পোখরা যাব না। অফিসের সবাই সবান্ধবে পোখরা যাবে।

আমরা নাগরকোট যাব। এমন না যে সহকর্মীরা নাগরককোট যাবেন না। কিন্তু তাঁরা অলরেডি নাগরকোট চলে গেছেন গতকাল। ফিরে এসে আজ পোখরা রওনা দিয়েছেন। কোস্ট ক্লিয়ার।

অর্চিষ্মান বেরিয়ে যাওয়ার পর চা বলেছিলাম। মিল্ক টি ম্যাডাম?-এর উত্তরে বোকার মতো হাঁনজি বলে দিয়েছি। এঁদের মিল্ক টি মানে এককাপ মিল্কে দু’ফোঁটা টি। চুমুক দিয়ে ফেলেছি তাই গিলতে হল। কাপ ঢাকা দিয়ে টিভির আড়ালে রেখে এলাম যাতে অন্যমনস্ক হয়েও হাত না দিতে পারি।

অর্চিষ্মান বলে গেছে কুন্তলা এসেই বেরিয়ে পড়ব। নাগরকোটে হোটেল দেখে রেখো। ঠিক যেমন দিল্লি থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল কুন্তলা হোটেল দেখে রেখো। কাঠমান্ডু আর নাগরকোট বা ভক্তপুর যেখানে থাকা বেটার মনে কোরো।

দেখিনি। যে কারণে কত টাকা কোথায় কীভাবে এক্সচেঞ্জ হবে, সিম কোথায় কেনা হবে, এয়ারপোর্ট থেকে থামেল কদ্দূর, কত টাকা ট্যাক্সি ভাড়া রিসার্চ করিনি - সেই কারণেই।

রওনা দেওয়ার আগের ক’দিন আমার এপিসোড চলছিল। যে রকম এপিসোডে ফোন সুইচড অফ রাখতে হয়, বেল বাজলে দরজা খোলা যায় না, বিছানা থেকে নিজের শরীরটাকে জাস্ট ছিঁড়ে তোলা গেল না বলে ডিনার মিস হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে অর্থাৎ আমার প্লেন ছাড়ার বারো ঘণ্টা আগে অর্চিষ্মান ফোন করল। টাকা নিয়েছ কুন্তলা? নাগরকোট না ভক্তপুর কোথায় থাকবে ঠিক করেছ? হোটেল বুক করেছ?

না, না এবং না।

টাকা নাও। ব্যাগ গোছাও। হোটেল বেছে বুক করো। না হলে এখানে এসে কষ্ট হবে।

পাঁচ মিনিটে ট্রিপঅ্যাডভাইসর থেকে হোটেল বেছে দশ মিনিটে ব্যাগে জামাকাপড় পুরেছিলাম। টাকাপয়সার ব্যাপারে ভাবার চেষ্টা করে দেখেছিলাম. . . ইমপসিবল। মন বলেছিল মরে যাব না। আর যদি মরেই যাই টাকাপয়সার ব্যাপার সর্ট না করে বাড়ি থেকে বেরোইনি বলে আফসোসের ক্ষমতা থাকবে না। সব ঝঞ্ঝাট শেষ। মরে গেলে অ্যাকচুয়ালি বাঁচা যাবে।

থামেলের হোটেলের সকালে এপিসোডটেপিসোড চলছিল না। মরাবাঁচার ভাবনা ছিল না। বিশুদ্ধ ফাঁকিবাজি ছিল। অখাদ্য চায়ে চুমুক দিয়ে, নব্বই সেকেন্ড হোটেল দেখে ইউটিউব শর্টসে ডুব দিয়েছি। ঘণ্টাদেড়েক পর অর্চিষ্মানের ফোন। কুন্তলা, চেক আউট হয়ে গেছে, নাগরকোটের গাড়ি ঠিক করে ফেলেছি। কোন হোটেল বলব? বললাম, লেট মি সার্কল ব্যাক টু ইউ ইন ফাইভ মিনিটস। বলে পাগলের মতো ট্রিপঅ্যাডভাইসার স্ক্রোল করে কয়েকটা হোটেল বেছে অর্চিষ্মানের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালাম।

অর্চিষ্মান ফিরল। নিচে গাড়ি দাঁড় করিয়ে এসেছে। মুখ গম্ভীর। সার্কল ব্যাক করে যে যে হোটেলের নাম পাঠিয়েছি একটাও পছন্দ হয়নি। তার থেকেও বড় কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সেগুলো আমি দু'মিনিটে বেছেছি।

বিলে সকালের চা গোনা হয়নি জানাতে রিসেপশনের মেয়েটা, শিওর অনূর্ধ্ব আঠেরো, মুখ দেখলে ভয় হয় একটু জোরে কথা বললে কেঁদে ফেলবে - হাসল। দ্যাট ইজ কমপ্লিমেন্টারি, ম্যাম। গম্ভীর মুখের আবহে মেয়েটার হাসি খড়কুটো। একটু বেশিই থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ বলে ফেললাম।

অর্চিষ্মানের গম্ভীর হওয়ার কারণ আছে। আমি হলেও হতাম। ও রাতে দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে শহর উজিয়ে, সুটকেস নিয়ে, হোটেল চেক আউট করে, দরাদরি করে গাড়ি বুক করে এনেছে আর আমি এক চুমুক বাজে চা খেয়ে শুয়ে শুয়ে আয়ুর্বেদিক বোটক্সের নামে লোকে ভাত চটকে মুখে মাখতে দেখেছি আর ভেবেছি ঠাকুমা থাকলে কী বলতেন। শ্রমবিভাজনটা খুবই নির্লজ্জ রকম হয়েছে।

গাড়ি স্টার্ট দিল। ফোন চার্জে বসিয়ে অর্চিষ্মান নাগরকোটের হোটেল দেখতে লাগল। বললাম, গুগলে তো লিখেছে নাগরকোটে কোটি কোটি হোটেল, গিয়ে একটায় ঢুকে পড়লে হয় না? ড্রাইভারজি আমাকে বাঁচানোর বদলে ঘি ঢাললেন। রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে বললেন, হোটেল বহোত হ্যায় ম্যাডাম লেকিন বুক নহি করকে জানে সে জগাহ্‌ নহি মিলেগা।

বাগমতী নদীর ওপর ব্রিজ, ব্রিজের রেলিং-এ বসা ছোট্ট পাখি ল্যাজঝোলা। ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। দেখলে দেখলে? উচ্ছ্বসিত হতে হতেও সামলে নিই। আমি আমার কাজ করলে অর্চিষ্মান নদী, ব্রিজ, পাখি, পাখির ওড়াউড়ি সব দেখতে পেত। দেখতে পাচ্ছে না কারণ আমি আমার কাজ করিনি। রাগ করতে হলে নিজের ওপরই করা উচিত।

জল যেমন উঁচু থেকে নিচের দিকে ধায়, রাগও বেশিক্ষণ নিজের দিকে তাক করে রাখা যায় না, ক্ষণে ক্ষণে অন্যের দিকে ধেয়ে যেতে চায়। মানছি আমার দোষ। মানছি আমার হোটেল বেছে বুক করে রাখা উচিত ছিল। রাখিনি, দোষ হয়েছে। তা বলে অর্চিষ্মান এতক্ষণ ধরে হোটেল বুক করবে? আমি হলে যেমনতেমন একটা হোটেল বুক করে ফেলতাম, অর্চিষ্মান সিটের প্রান্তে প্রিক্যারিয়াসলি তশরিফ ঠেকিয়ে, খাটো চার্জিং কেবলের অন্তে ফোন ধরে হোটেলের পর হোটেল হোটেল খুঁজে চলেছে, ডলার টু নেপালি টাকা কনভার্ট করে চলেছে, হোটেলের অবস্থান, ঘরের ছবি দেখে দেখে একের পর এক হোটেল নাকচ করে চলেছে। ও জানালার বাইরে পাখির উড়াল দেখতে পাচ্ছে না বলে আমি যে অপরাধবোধে ভাজাভাজা হচ্ছি সে বিষয়ে কেয়ার পর্যন্ত করছে না।

চল্লিশ মিনিট ধরে সাঁইত্রিশটা হোটেল ব্রাউজ করে, সাতটা হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে, একটা হোটেল ফাইন্যাল করে টাকা পাঠিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বুকিং কনফার্মেশন রিসিভ করে অর্চিষ্মান অবশেষে সিটে হেলান দিয়ে বসল। ডান হাত দিয়ে বাঁ আর বাঁ হাত দিয়ে ডান কান ধরলাম। যাতে আমার অনুতাপের মাত্রা নিয়ে ওর সন্দেহ না থাকে।

অর্চিষ্মানও হোটেল বুক করে ফেলল আর দু’পাশের রাস্তাও সুন্দরতর হয়ে গেল। পাহাড় উঁচু হল, খাদ গভীর হল। নদী বইল, পাখি উড়ল। গালে কপালে চুলের ফাঁকে হাওয়া ঠাণ্ডা হল। দু'পাশের জঙ্গলে পাইন ছাড়াও আরও যে কত রকম গাছ। যত রকম গাছ তত রকম সবুজ। আলমারির তাকে মায়ের শাড়ির থাকেও অনেক রকম সবুজ ছিল। কলাপাতা সবুজ, কুটকুটে সবুজ, শ্যাওলা সবুজ, সমুদ্র সবুজ, পান্না সবুজ, পুদিনা সবুজ।

অর্চিষ্মান বলল, রানি ঝুলাকে পাস রোকনা ভাইসাব।

নাগরকোট ডে ট্রিপ করে পোখারা চলে যাওয়ার আগে সহকর্মীরা অর্চিষ্মানকে টিপ দিয়ে গেছেন, নাগরকোটের পথ রানি ঝুলা মিস না করার। বাঁকের মুখে ড্রাইভারজি উইন্ডস্ক্রিনের উত্তর পূর্ব বিন্দুতে আঙুল রাখলেন। আদিগন্ত পাহাড়জঙ্গলের মাঝে শূন্যতায় একটি সেতু ভেসে আছে।

রানিই বটে।

প্রথম দেখায় রানিকে স্বর্গের মতো দূরে মনে হয়েছিল, আড়াইখানা বাঁক নিয়ে গোটা পাহাড়টা চড়ে ফেলে ড্রাইভারজি ব্রেক কষলেন। যাইয়ে ঘুমকে আইয়ে।

বড় রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটও লাগে না, কিন্তু ঢাল প্রায় সোজা নামে। রানি ঝুলা সাসপেনশন ব্রিজ। ধাতব, কিন্তু ব্যাপারটার কোনও সাপোর্ট নেই। ভিড় নেই, যেটুকু আছে তাতে ঝুলা ননস্টপ দুলছে। একজন হেঁটে গেলেও দুলবে। অর্চিষ্মান থমকালো।

আমার ব্রেনে কনসিকোয়েন্সের সুইচ পার্মানেন্টলি অফ থাকে কাজেই আমার এ সব পরিস্থিতিতে নেমে যেতে অসুবিধে হয় না। বেতোয়ায় র‍্যাফটিং করতে করতে যেই না মাঝিভাই বলেছেন অব আপলোগ নাহা সকতে হ্যায়, দাঁড়িয়ে উঠে জলে ঝাঁপ দিয়েছি। ছ'জনের র‍্যাফটে দু'জন মাঝির সঙ্গে ছিলাম আমি, অর্চিষ্মান আর ন্যাশনাল জিওগ্র্যাফিকের দুই আলোকচিত্রী। মহিলাটি আমার বয়সী; পুরুষটি আমার হাঁটুর বয়সী। আমাদের জীবনে ওই প্রথম র‍্যাফটিং তাও নেটিভ নদীতে, মহিলা এদিকে জাম্বিয়ায় বাঞ্জি জাম্পিং করে এসেছেন। আকাশচুম্বী হাঁ করেছিলাম। মহিলা জানিয়েছিলেন এই সব রোমহর্ষক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের স্পিরিচুয়াল সাইডেরও নিয়মিত যত্ন নেন। ইউ মাস্ট নো অ্যাবাউট ঈশা ফাউন্ডেশন? অ্যাবাউট সদগুরু? দেশেবিদেশে বিপজ্জনক প্রাণী ও পরিবেশের ছবি তোলার পর যেটুকু সময় পান, সদগুরুর সেবায় খরচ করেন। স্লো মোশনে হাঁ বন্ধ করেছিলাম। আমরা প্রেজুডিসড পাবলিক, তথ্যটা জানার পর ন্যাট জিও, জাম্বিয়া, বাঞ্জি সব মুছে গিয়ে মহিলার 'সদগুরুর চ্যালা' পরিচয়টাই প্রধান হয়ে উঠল। এখনও আমরা '"সেই যে গো সদগুরু" বলে মহিলাকে রেফার করি।

যাই হোক, মাঝিরা গ্রিন সিগন্যাল দিতে আমি জলে নেমে গেছি, হাঁটুর বয়সী পুরুষও নেমে গেছেন, অর্চিষ্মান আমার দিকে হাফ বিরক্ত হাফ আতংকিত দৃষ্টি হেনে উদাস মুখে আবার আকাশবাতাস দেখা শুরু করেছে, মহিলা কমলা লাইফ জ্যাকেট পরে হেলমেট হাতে রেডি অথচ নামার উপক্রম করছেন না।

কারণ ওঁর নিজে জলে নেমে হবে না, অর্চিষ্মানকেও নামাতে হবে। অর্চিষ্মান যত বলে আরে আমি সাঁতার জানি না, মহিলা বলেন আরে কুছ নহি হোগা, লাইফ জ্যাকেট হ্যায় না। বলে মাঝিভাইদের দিকে তাকান, মাঝিভাইরা ঘাড় নাড়েন, তখন ডবল উৎসাহে অর্চিষ্মানকে তা দেওয়া শুরু করেন।

ওরছার রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে বেত্রবতীর ঠাণ্ডা জলে চিৎ হয়ে ভাসতে ভাসতে ভাবছিলাম। টেনাসিটি থাকলে জীবনটা কেমন হত। অবশ্য ভালো ভালো গুণ থাকলেই হয় না। তাদের কোথায় কতখানি অ্যাপ্লাই করতে হবে সে মাত্রাজ্ঞান থাকাও জরুরি।

অর্চিষ্মান অনেকক্ষণ মহিলাকে কনভিন্স করানোর চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে চুপ করে বসে আছে, মহিলা অর্চিষ্মানকে কনভিন্স করিয়ে চলেছেন। লাইফ জ্যাকেট আছে, হেলমেট আছে, ধরে ভেসে থাকার জন্য র‍্যাফট ঘিরে রেলিং আছে, মাঝিরা আছেন আর লাস্ট বাট নট দা লিস্ট, উনি তো আছেনই।

ভাবলাম একবার জল থেকে মাথা তুলে বলি, ঝুলোঝুলি থামান, সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়তেও পারে। বললাম না। আমি বলে দেওয়ার থেকে নিজে ঠেকে শিখলে বেশি দিন মনে থাকবে।

ঝুলায় পা দিতেই ঝুলা দুলে উঠল। অর্চিষ্মান দু'দিকের রেলিং ধরে ফ্রিজ করে গেছে। বললাম আমার হাত ধর। রেলিং ছেড়ে আমার হাতের দিকে হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিল। না কুন্তলা। জাস্ট না। অর্চিষ্মান পিছিয়ে যাচ্ছে। আরে কিচ্ছু হবে না। সবাই তো যাচ্ছে। যাক। আমার কষ্ট হবে।

আমি যাই?

শক্ত মাটিতে পা রেখেই অর্চিষ্মান মুচকি হাসি ফিরে পেয়েছে। অ্যাবসলিউটলি। যাওয়ার আগে একবার এদিক ফিরে দাঁড়াও। তোমার বীরত্বের প্রমাণ তুলে রাখি।

রানি ঝুলার মূল ভিড়টা পনেরো থেকে বাইশের। চুটিয়ে রিলের শুটিং চলছে। ঝুলার মেঝেতে ফোন রেখে একজন ধরে আছে, একজন মুসাফির মুসাফির মুখে হেঁটে যাচ্ছে। পাশাপাশি দু’জনের বেশি হাঁটা যায় না, শুটিং চলাকালীন থেমে থেমে যেতে হচ্ছিল। ভাবছিলাম এ দৃশ্য কোন গানের সঙ্গে আপলোড হবে। আমার মাথায় 'তেরি দুনিয়া সে হোকে মজবুর' এসে গেল কিন্তু এরা নিশ্চয় অত প্রাচীন গান দেবে না, সিমিলার আবেগের নতুন কোনও গান নির্ঘাত বেরিয়ে গেছে। দূরে লালসাদা ফুলছাপ ফ্রক বালিকা পা ছড়িয়ে শরীরের ভার একবার এ পায়ে আবার ও পায়ে ট্রান্সফার করে ঝুলার দুলুনি প্রবলতর করার চেষ্টা করছে।

একবার কিছু বোঝার আগেই ইউটিউব শর্টসে গুজরাতের এক কাঠের ব্রিজ ভেঙে পড়ার ভিডিও চলতে শুরু করেছিল। সেখানে দেখেছিলাম ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্তে কিছু লোক এক্স্যাকটলি এই ভঙ্গিতে ব্রিজটা দোলাচ্ছিল। দোলাতে দোলাতেই মড়মড় করে ব্রিজ জলে। রক্ত জল করা চিৎকার।

হোপফুলি রানি ঝুলা ভেঙে পড়বে না। যদি পড়ে আর চোখের সামনে ঝুলাটুলা শুদ্ধু আমি নিচের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যাই অর্চিষ্মানের মেন্টাল হেলথ কী চেহারা নেবে কে জানে। অবশ্য মনের মতো মনের স্বাস্থ্যের গতিপ্রকৃতিও রহস্যময়। কীসে যে টসকায় আর কীসে যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রেডিক্ট করা অসম্ভব।

কার যে টসকায় কার যে দাঁড়িয়ে থাকে সেটাও অনেক সময় বোঝা যায় না। অর্চিষ্মানের দেমাক, ও আমাকে হাড়েমজ্জায় চিনে গেছে। দেমাকটা আমার ভালো লাগে না। আমার সাধ যায় বেশ আলোছায়া রহস্যময় হয়ে থাকি। সেদিন আবারও হইচই দেখতে দেখতে কী কথায় অর্চিষ্মান হাত তুলে বলল, বোঝা গেছে, কুন্তলা। সে জানি তুমি আমাকে বুঝে গেছ, বলে চুপ করে গেলাম। অর্চিষ্মানের দয়া হল বোধ হয়।

পুরোটা বুঝিনি। একটা জায়গায় মিস করেছি।

কোন জায়গাটায়?

কাকিমার জায়গাটায়।

অবাক হলাম। মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের থেকে সরলতর এ পৃথিবীতে কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

আমিও সেটাই ভেবেছিলাম।

কেউ যদি কারও সঙ্গে দিনে মিনিমাম তিনবার কথা বলে, দোসা খেলে ফোন করে, হাওয়া দিলে ফোন করে, অটোওয়ালা জোরে কথা বললে ফোন করে - সেই লোকটা দুম করে নেই হয়ে গেলে এই লোকটা কী লেভেলে ধ্বসে যেতে পারে, বিশেষ করে সে যদি তুমি হও . . . (বাকিটা অর্চিষ্মান গিলে নিল, যে কি না সকাল বিকেল সন্ধে ফর অ্যাবসলিউটলি নো রিজন ধ্বসে যাচ্ছে) তার অবস্থা কী হতে পারে, ঘটনার পাঁচ বছর পর অর্চিষ্মান স্বীকার করেছে সে নিয়ে ওর আতংক ছিল। সে ধ্বস যে ওকেই সামলাতে হবে সেটা মনে করে আরও আতংক।

তাই যখন ধ্বসলাম না, ও চমকে গেল।

মায়ের সঙ্গে দিনে তিনবার কথা ডিপেন্ডেন্স থেকে বলতাম না তো। ভালো লাগত বলে বলতাম।

সেটাই ভুল হয়েছিল। ভালো লাগাকে ডিপেন্ডেন্স ভেবেছি।

আমি ভাবিনি। আমার ইনডিপেন্ডেন্স বাইরে থেকে বোঝা না যেতে পারে, অর্চিষ্মানেরটা জ্বলজ্বলে। দীর্ঘ অদর্শনের আগে নাকতলার বাবামা বলে দেন, কুন্তলা যাচ্ছ যাও, জিষ্ণুর মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যেয়ো না। ফোন কোরো। যোগাযোগ রেখো। আমাকে নিয়ে রানি ঝুলা ভেঙে পড়লে অর্চিষ্মান শক পাবে। সে শক কেটেও যাবে। সবারই যায়। ওটাই মানবসভ্যতার সারভাইভ্যাল ইন্সটিংক্ট। অর্চিষ্মানেরও যাবে। অ্যাভারেজ মানুষের থেকে দ্রুতই যাবে।

আড়াইশো মিটার ঝুলার প্রায় মধ্যবিন্দুতে পৌঁছে গেছি। ঝুলার সবথেকে নিচু বিন্দুতেও। শুটিংমুটিং, রিলটিল, ডিপেন্ডেন্স ইনডিপেন্ডেন্স থেকে মন তুলে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। দৃষ্টি জুড়ে ফুলে ওঠা জঙ্গল, মাথার ওপর প্রকাণ্ড আকাশ, নিচে অদৃশ্য মাটি। কত নিচে জানি না। আকাশটা যত দূরে, হতে পারে ততটাই।

বাঁদিকে ঘাড় ঘোরালাম। অর্চিষ্মানকে দেখা যাচ্ছে না। একবার মনে হল ফিরে যাই। দেখলাম তো ঝুলায় হাঁটতে কেমন লাগে। তারপর মনে হল নাহ্‌ এসেছিই যখন পুরোটা হেঁটে আসি। ফুলছাপ ফ্রক আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্রেস পরা দাঁত। এক ভিডিও খিঁচ দেঙ্গে? বললাম আমার তোলা প্রত্যেকটা স্টিল ফোটো ঝাপসা ওঠে আর ফোটোতে সবার চোখ বন্ধ থাকে। মেয়েটা শব্দ করে হাসল। ইউ উইল ডু ফাইন। সির্ফ পকড়কে রখ্‌না হ্যায়। মেয়েটা গোটা সিন অলরেডি কোরিওগ্রাফ করে রেখেছে। উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসবে, ফ্রকের ঘের ঘুরিয়ে একবার পাক খাবে তারপর ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসবে।

ফোন ধরে কাঠ হয়ে রইলাম। মেয়েটা হাঁটা ঘোরা হাসি শেষ করে এসে ফোন চেক করে বলল, সি? পারফেক্ট। এত বার থ্যাংক ইউ বলল আমি আর বললাম না যে জীবনের প্রথম ডি ও পি হিসেবে ব্রেক দেওয়ার জন্য আমারই উল্টে ওকে থ্যাংক ইউ বলা উচিত। হেঁটে হেঁটে ব্রিজের শেষ পর্যন্ত গেলাম। দুয়েকটা চায়ের দোকান জটলা। অর্চিষ্মান সঙ্গে এলে খাওয়া যেত। একা আর থামলাম না। উল্টো হাঁটা শুরু করলাম। অর্চিষ্মান ফুটকি থেকে ফুল সাইজ হয়ে উঠল। ফোন খুলে বীর কুন্তলার ছবি দেখালো। বললাম, তুমি অন্ততঃ দু’পা ঝুলার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াও, তোমার একটা ছবি তুলে দিই। বলল, হুস্‌।

ঝুলার মুখে মেঠো পথ ভেঙে দু'খান হয়েছে। একটা বড় রাস্তায় ফেরার, অন্যটার ধারে বোর্ডে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা ওয়াটারফল। কত দূরে কী বৃত্তান্ত কিছু লেখা নেই।

চল যাই। অর্চিষ্মান কনুই ধরে টানল।

বাঁদিকে পাহাড় উঠে গেছে, ডানদিকে পাহাড় নেমে গেছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাইন গাছের জঙ্গল। অন্য গাছও আছে। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুরের খানাখন্দ টপকে হাঁটছি। পায়ের ওপর ফার্ন নুয়ে পড়েছে। জঙ্গলের সেই গন্ধটা পাচ্ছি। পাখি, ঝিঁঝিঁ, পাতার ফাঁকে হাওয়ার আওয়াজ। হাঁটছি আর পিছু ফিরে ফিরে দেখছি এক্স্যাক্ট কোন মুহূর্তে রানি ঝুলা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।

বাঁ দিকের ঢালে দু'একটা পিকনিকের দল। একটা দলে চারটে মেয়ে। মেরেকেটে কলেজ, একটা তো ডেফিনিটলি স্কুল। খাটো ট্রাইপডে - গোরিলা ট্রাইপড বলে বোধহয় -আঁটা ফোন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেদের ভিডিও তুলছে। ছড়ানোছেটানো লে'জ-এর প্যাকেট, দু'লিটারের কোক।

অনেকক্ষণ ধরে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখছি। পাইন ডালের ডগায় একটা ভার্টিকাল পাতা। অন্যান্য পাতার থেকে কচি। আমার কেন যেন ধারণা ছিল ছোট পাইনকোন এক্স্যাক্টলি প্রাপ্তবয়স্ক পাইনকোনের মতো চেহারা নিয়েই জন্মায়। ভুল। এই ভার্টিক্যাল পাতা বেসিক্যালি পাইনকোনের শুঁয়োপোকা অবস্থা। ক্রমে এই সবুজ রোঁয়া খসে পাইনকোনের প্রজাপতি বেরিয়ে আসবে।

আমার বটানির মা এই রাস্তায় হাঁটতে পেলে সব গাছেদের বাংলা ইংরিজি ল্যাটিন বৈজ্ঞানিক নাম বলে দিতেন। বাড়িতে ইনভার্টার আসার আগে পর্যন্ত রোজ সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলে ঠাকুমা সি এ টি ক্যাট, বি এ টি ব্যাট, নামতা জোরে জোরে আবৃত্তি করছেন। আমার জীবনে এমন কোনও পরিস্থিতির উদয় হয় না যেখানে আমি সরকারের ঘাড় ভেঙে আজীবনের আহৃত বিদ্যা ঝালিয়ে নিতে পারি। মাত্র দু’জেনারেশনে পরিস্থিতি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।

কী গো কোথায় তোমার ওয়াটারফল?

লংটার্ম কমিটেড রিলেশনশিপের নাকি বেনিফিট প্রচুর। ইউটিউব শর্টসে বুড়োবুড়িরা বলে। হ্যাঁ বোরিং, হ্যাঁ হার্ড ওয়ার্ক, কিন্তু মাটি কামড়ে থাকো শেষ বয়সে ডিভিডেন্ড পাবে। এস আই পি গছানোর আগে এজেন্টরা যা বলে মুখে ফেনা তোলে এক্স্যাক্ট সেই স্পিচ। সাড়ে এগারো বছরের বিয়ে সে অর্থে লং টার্ম কি না জানিও না, কিন্তু বেনিফিট বলতে একটা স্মৃতির কমন সিস্টেম তৈরি হয়েছে। মিউচুয়াল মেমোরির মানচিত্র।

সে মেমোরিতে দুজনেরই আরেকটা হাঁটার ছবি উঠে আসছে। ফেরার দিন ভোরবেলা শেষবারের মতো আরেকবার কসৌলিকে দেখে আসার অভিপ্রায়ে বেরিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে মেন রোড ছেড়ে ডানদিকে চড়াই পথে সরকারি দপ্তর, উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বাংলো। সে সব বাংলোর বাগানে লালনীল ফুল। ক্রমে বাংলোটাংলো শেষ হয়ে গেল, আচমকা কুয়াশায় সব ঢেকে গেল। সে এমন কুয়াশা আমি অর্চিষ্মানকে দেখতে পাচ্ছি না অর্চিষ্মান আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় যাচ্ছি কতদূর যাচ্ছি কেন যাচ্ছি জানি না, ফিরতেও পারছি না কারণ একটা কোথাও না পৌঁছে ফিরতে অদ্ভুত লাগে।

এ রোদঝিলমিল দুপুর দুজনের মাথাতেই সে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের ছবি মনে করাল কেন ভাবছিলাম। পথ সরু হয়ে আসছিল। পাশাপাশি দুজনে হাঁটা যাচ্ছিল না, আমি এগিয়ে গেছিলাম অর্চিষ্মান পিছিয়ে। এমন সময় একবার পথের ধুলোয় একবার আমার জুতো হড়কে গেল আর অর্চিষ্মান টেনস গলায় বলে উঠল কুন্তলা, কী করছ কী? প্লিজ অত কনফিডেন্ট হয়ে হেঁটো না।

এক্স্যাক্টলি এই লাইনটা অর্চিষ্মান কসৌলির সেই সকালেও বলেছিল।

ফিরি চলো। ঝর্না দেখার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। হাঁটাই উদ্দেশ্য। ড্রাইভারজিও অপেক্ষা করছেন। মেয়েগুলোকে আবার দেখা যাচ্ছে। মেয়েগুলো এখন আর বসে নেই। উঠে দাঁড়িয়েছে। হাসতে হাসতে হাত পা নেড়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। জোরে গান বাজছে।

অর্চিষ্মানের হাত এত জোরে খামচালাম যে অর্চিষ্মান উঃ করে উঠল।


এতে উত্তেজনার কী আছে?

জীবনে যে একটিমাত্র নেপালি গান আমি লুপে শুনেছি, মেয়েগুলো সে গানটার সঙ্গেই নাচছে। হ্যাঁ, গানটা ভাইরাল হয়েছিল কিন্তু সে তো আট বছর আগে। সেই আট বছর আগে ভাইরাল হওয়া বিদেশী ভাষার গান, যে ভাষায় গুড মর্নিং আই লাভ ইউটুকুও আমি জানি না, সে গানটা এই পাইনবনে বাজছে। এতেও যদি উত্তেজিত না হই তাহলে আমার ক্ষুরে ক্ষুরে।

অর্চিষ্মানের চাপা গলার “কুন্তলা, ও রকম তাকিয়ো না” শুনেও নিশ্চয় হাঁ করে তাকিয়েই ছিলাম কারণ যত কাছাকাছি এগোলাম বাচ্চাগুলোর নাচের উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে এল। লজ্জা পেয়েছে। চোখ সরিয়ে গতি বাড়িয়ে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। পেছনে নাচ পূর্বের টেম্পো ফিরে পেল।

এক মিনিট চুপ করে হাঁটার পর অর্চিষ্মান বলল, এ রকম আর হবে না। তাই না?

নাহ্‌। একটা রোদে ভাসা পাইনের বন পেলে আর চার বন্ধু এক জায়গায় হলে প্রাণের যে উচ্ছ্বাস হাত পা ছুঁড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, কোমর দুলিয়ে, অট্টহাসি হয়ে শরীর ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে, সে উচ্ছ্বাসের উৎস আমাদের চিরকালের মতো রুদ্ধ হয়েছে।

বয়স হওয়া ব্যাপারটা আমি উপভোগ করি। শৈশব তবু একরকম ছিল। কৈশোর, প্রাকযৌবন, যৌবনের কথা মনে পড়লে আমার ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং হয় না। নাটকনভেল পথনাটিকা যা বলে বলুক, যৌবনের আমির থেকে এখনকার আমি অনেক বেশি ডোন্ট কেয়ার। কনফর্ম করার তাড়না, ভ্যালিডেশনের বাসনা, অ্যাকসেপ্টেড হওয়ার আকুলতা থেকে বয়স আমাকে মুক্তি দিয়েছে। আমি কী চাই, কী থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চাই বুঝতে আমার সময় লেগেছে। নিজের ইচ্ছের মর্যাদা আমি লজ্জাজনক রকম লেটে দিতে শিখেছি।

অর্চিষ্মান বলে ওরও নাকি এ ব্যাপারে লেট হয়েছে। তবে আমার মতো লেটের দায় পুরোটা বয়সের ঘাড়ে চাপায়নি ও। বিষয়টা বয়সের না। আমাদের বুদ্ধি কম বলে টাইম লেগেছে। বুদ্ধিমানেরা হয়তো বাচ্চা বয়সেই বুঝে গেছে যে লোকের পাত্তাকে পাত্তা দিতে নেই।

তবে নিজের ইচ্ছেকে সর্বোচ্চ পাত্তা দেওয়ার বিপদও আছে। কে কী বলল, কে কী ভাবল সে সব চিন্তা থেকে মুক্ত বুড়োবুড়ি দেখেছ নিশ্চয়? অর্চিষ্মান অপাঙ্গে তাকিয়েছে। তুমি মনে হয় ও রকম হয়ে যাবে বুড়ো হলে।

আমি বুড়ো হবে আর তুমি চিরযুবক থাকবে ? তুমিও হবে। স্পষ্টবাদী বুড়ো।

উঁহু, আমি তো বিপদ সম্পর্কে অ্যাওয়্যার। আমি হব না। আমি কুল বুড়ো হব। তুমি যা মনে আসবে ফিল্টার ছাড়া বলে যাবে আর আমি তোমাকে দেখে ধীরে ধীরে ডানদিকে বাঁদিকে মাথা নাড়ব।

রানি ঝুলা থেকে বড় রাস্তার পথ ধরলাম। ভ্রমণার্থীর সংখ্যা আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে কি? আরও বাড়বে মনে হয়। পথের ধারে ত্রিপল বাঁধা ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান, মুলতঃ মহিলা মালিকের তত্ত্বাবধানে, বসেছে। মনে পড়ল আসার সময় নীল সালওয়ারকামিজ পরা এক দিদিকে দেখেছিলাম। একটি নীল প্রকাণ্ড প্লাস্টিকের সঙ্গে প্রবল সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। এখন নীল প্লাস্টিক পরাস্ত হয়ে চারটি গাছে চারটি লম্বা দড়ির সাহায্যে হাত পা চিতিয়ে পড়ে আছে।

তখন দিদির দোকানে টেবিল ছিল না, বেঞ্চি ছিল না, বালতি ছিল না, বালতির জলে ভেজানো শশা (পার পিস একশো টাকা) ছিল না, বয়াম ছিল না, বয়ামে লজেন্স ছিল না, স্টোভ ছিল না, দুধের সসপ্যান, চায়ের কেটলি, পেপার কাপের উল্টোনো থাক ছিল না, রানি ঝুলাও ছিল কি না কে জানে, যখন শুধু প্রাচীন পর্বতের ঢালে দিদিতে ত্রিপলে শুম্ভনিশুম্ভের সংগ্রাম চলছিল তখন থেকে আমি আমার অস্থি, মজ্জা, তন্তু দিয়ে জানতাম একদিন ত্রিপল হারবে, দিদি জিতবে আর দিদির দোকানের নড়বড়ে টেবিলের বয়ামে শোভা পাবে গোল গোল পুষ্ট ফুচকা।

বৈঠিয়ে বলে দিদি দুটো হাফ ভাঙা নীলকমলের টুল পেতে দিলেন। জীবনে সব কিছুরই প্রথম থাকে। এই আমার প্রথম টুলে বসে ফুচকা খাওয়া। দিদি আলু সেদ্ধ বসাচ্ছেন। অর্চিষ্মান পকেট থেকে ফোন বার করেছে। হ্যালো ভাইসাব? আমাদের রানি ঝুলা দেখা হয়ে গেছে। আমরা এখন পানিপুরি খাচ্ছি। ফোনের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না। পানিপুরি খেয়েই চলে আসব।

অন্ধকার ফোন পকেটে পুরল অর্চিষ্মান। আমাদের এখন আর কোনও তাড়া নেই। কৈফিয়ত দেওয়ার নেই। কাউকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার অপরাধবোধ নেই।

বিশহাত দূরে আরেক দিদির দোকান। দুই দোকানের মধ্যবিন্দুতে কলের নিচে বালতি পাতা। বালতি উপচে জল পড়ে যাচ্ছে। বালতিটা কার? এ দিদির না ও দিদির? উঠে গিয়ে কল বন্ধ করে দিলে কি "আপনাদের থেকে আমার নাগরিক চেতনা বেশি" প্রমাণের অসভ্যতা হয়ে যাবে? খলখল করতে করতে একদল অনূর্ধ্ব পঁচিশ আসছে। একটা ছেলে দৌড়ে এসে কলের প্যাঁচ ঘোরাচ্ছে। ঘোরাচ্ছে কিন্তু কল বন্ধ হচ্ছে না। কলটা খারাপ তার মানে। নিজের নিষ্ক্রিয়তার অপরাধবোধে সামান্য হলেও মলম পড়ছে। আলু মাখতে মাখতে দিদি জিজ্ঞাসা করছেন, তিখা বনাউ? বহোৎ তিখা বনাইয়ে। বস্‌ ঝোল বনানা বাকি হ্যায়। আভি হো যায়েগা। আমরা বলছি আমাদের কোনও অসুবিধে নেই। সুবিধেও যে নেই চেপে যাচ্ছি। কলের মুন্ডু ঘোরাতে বেকায়দায় জল ছিটকে ছেলেটার জামা ভিজিয়ে দিয়েছে। সবাই হাসছে। ছেলেটাও। জলসংরক্ষণের মহৎ উদ্দেশ্যে জল ঢেলে হাসতে হাসতে বাচ্চাগুলো চলে যাচ্ছে। দিদি বয়াম থেকে একটা করে ফুচকা বার করে আলু পুরে একটা ছোট প্লেটে রাখছেন। এক সারির ওপর আরেক সারি। দিদির বোধহয় একটার বেশি প্লেট নেই। দু’প্লেট ফূচকাই একটা প্লেটে সাজাচ্ছেন। দু'প্লেটেই বা কতগুলো ফুচকা দিচ্ছেন গো? ফুচকার পাহাড় যত উঁচু হচ্ছে, আমাদের প্যালপিটেশন বাড়ছে। এত পরিশ্রমের পরিণতি যদি মাটিতে লুটোয়? পড়ে যাবে না তো দিদি? মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। দিদি বলছেন, জুঠা নহি খাতে হো? না না সে সব কিছু না। অবশেষে ফুচকার পাহাড় নির্মাণ শেষ । চব্বিশটা পর্যন্ত গুণেছিলাম। দিদি হাত মুছে আরেকটা নীলকমলের টুল পেতে ফুচকার প্লেট সাবধানে তার ওপরে নামিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ভাবছি জলের ব্যাপারটা কী হবে। বেশিক্ষণ ভাবতে হচ্ছে না। দুটো পেপার কাপে জল ঢেলে দু'হাতে নিয়ে দিদি আসছেন। এতক্ষণে ক্লিয়ার। প্লেট ঠেক একটা করে ফুচকা নাও, কাপ থেকে জল ঢেলে মুখে পোরো। একটা মুখে দিয়েই বুঝেছি দিদির পরিশ্রম, আমাদের প্রতীক্ষা সার্থক। আঙুল দিয়ে “নাজুক” মুদ্রা দেখাচ্ছি দিদির।

আমরা শুনতে না পেলেও পাইনের বনে মেয়েগুলো এখনও নিশ্চয় গানের তালে তালে নাচছে, আমরা দেখতে না পেলেও আকাশ মাটির মাঝখানে রানি ঝুলা এখনও নিশ্চয় দুলছে। জঙ্গলের মুখরিত নির্জনতা আমাদের ঘিরে ঘনিয়ে এল। আমরা বসে বসে ফুচকা খেতে লাগলাম।

                                                                                                                                                        (চলবে)




Comments

  1. বৈজয়ন্তীAugust 22, 2024 at 2:38 AM

    লোকের পাত্তাকে পাত্তা না দেবার শিক্ষাটা বয়েস বাড়ার বোধহয় একমাত্র ঠিকঠাক প্রো, এক কোটি কনের ভিড়ে।
    রানী পুল সম্পর্কে জানতামনা, বেশ ইন্টারেস্টিং। দিলসে-র শাহরুখ দৌড়ে আসছে - ব্রিজটা মনে পড়ে গেলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, কিন্তু ওই প্রো-টা আমার পক্ষে খুবই জরুরি।

      Delete
  2. দুটো লেখাই ভালো লাগলো।

    পড়তে পড়তে নিজের ৬ / ৭ বপছর আগের কাঠমান্ডু ঘোরার কথা মনে পড়ল। হোটেল বুকিং এর মেইলে কিছু একটা লেখা ছিল যেটা থেকে বুঝেছিলাম যে আমাদের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড চলবে না - তাই ওটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম। আবার ২০০৮ / ২০০৯ এর সময়ে, পুনেতে থাকাকালীন কুন্ডলিকা নদীতে র‍্যাফটিং করেছিলাম, সেটাও মনে এলো - সেখানে র‍্যাফটিং এর শেষে ঝপাং করে জলে নেমে দারুন ভালো লেগেছিলো।

    "প্লিজ অত কনফিডেন্ট হয়ে হেঁটো না।" - এইটা লাইনটা অসাধারণ!

    ReplyDelete
    Replies
    1. নদীর নামটা মচৎকার। কার্ড নিয়ে খুব ভুগতে হল কাঠমান্ডুতে। তবে হোয়াটেভার ডাজন'ট কিল ইউ...

      Delete
  3. অনেকদিন পরে !! এলাম, পড়লাম, মন ভালো করলাম !
    মাঝে মাঝে আসি, চুপি চুপি পড়ি আর তারথেকেও বেশি চুপি চুপি কেটে পড়ি !
    তাই কমেন্ট হোক বা না হোক, আপনার লেখা কিন্তু আমার মতো অনেকেই পড়েন বলেই আমার ধারণা।
    খুব সুন্দর লাগলো কি, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম তিনটে পর্বই । প্রত্যেক বারেই ভাবছিলাম, এই বোধহয় লালমোহন গাঙ্গুলি বাবুর কোনও কথা মনে পড়ল আপনার।

    যদিও বললাম মন ভালো করলাম, কোথাও গিয়ে মনটা একটু খারাপ ও হয়ে গেলো। গত ৬-৭ বছর ধরে বাবা বিছানায় , তাই মা বাবাকে রেখে আর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না, আর এই আমরাই আগে প্রতি ৬ মাসে একবার করে নিউ জলপাইগুড়িতে নামতাম। ওই যে পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটা , ওই যে পাহাড়ি ছেলেপুলে , তাদের বাজানো গান , রকমারি ড্রাইভার , রাস্তার ধারে বা দোকানে অন্যরকম খাবার , সব কিছু হটাৎ করে মিস করা শুরু করলাম । পুরোনো ছবি দেখেও যে সব কথা মনে পরে না, আপনার লেখা পড়ে সেগুলো মনে পরে গেলো।

    ভালো থাকবেন ।
    শেষ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও মন ভালো হল আপনার মন্তব্য পড়ে। আপনার বাবার কষ্ট নিরাময় হোক।

      Delete
  4. তোমার মা বোটানির লোক? আমার বাবাও বোটানিস্ট ছিল জানো? বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে কাজ করতো। তোমার মায়ের মতনই বেড়াতে গেলে রাস্তার পাশের সব গাছের বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন নাম, তাদের গুনাগুন সব বলতে থাকত। তোমার লেখার এই পার্টটা পড়ে হঠাৎ বড্ডো মন খারাপ হয়ে গেলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই। কোন জিনিসটা যে সময়ে মনখারাপের বা মনভালোর অনুঘটক হয়ে দাঁড়াবে বোঝা যায় না।

      Delete
  5. এই লেখাটা তোমার সেরা লেখা গুলোর মধ্যে মনে হলো আমার। নিজের ভেতরের কথা গুলো পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিয়েছো, খুব কঠিক কাজ ।

    ReplyDelete

Post a Comment