কাঠমান্ডু ১ঃ ফ্রেন্ড বনাম হাজব্যান্ড
বেডসাইড টেবিলে হোটেল রেস্টোর্যান্টের মেনু, ওয়াই ফাই ইউসার লগ ইন পাসওয়ার্ডের প্রিন্ট আউট, নিঃশেষিত কাপের সাদা দেওয়ালে চুপসানো কালো টি ব্যাগ বাঁচিয়ে ফোন ধরতে হল।
ম্যাম, ইয়োর হাজব্যান্ড ইজ হিয়ার। শ্যাল উই সেন্ড হিম টু ইয়োর রুম?
দেড় মিনিটের মধ্যে দরজায় টোকা। নিরানব্বই দশমিক নয় নয় শতাংশ শিওর হওয়া সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করলাম, কে?
কারণ শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য এক শতাংশ চান্স আছে ওটা অর্চিষ্মান না হওয়ার। এমন কারও হওয়ার যিনি দরজা খোলা মাত্র কাঁচি চালিয়ে আমার জুগুলারটি কুচ করে কেটে আবার লিফটে করে নেমে যাবেন আর পরের সপ্তাহে পশ্চিমবাংলার পোর্টালে পোর্টালে খবর বেরোবেঃ কাঠমান্ডুর কানাগলিতে বাঙালি বউদির মৃতদেহ উদ্ধার।
কাজেই বললাম, কে? বাংলাতেই বললাম কারণ অফ কোর্স ওটা অর্চিষ্মান।
চনমনে গলাতেই বললাম কারণ এক, ওটা অর্চিষ্মান। দুই, এক সপ্তাহ ধরে অর্চিষ্মানের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তিন, থামেলের গলির হোটেলে দুপুরবেলা চেক ইন করার পর থেকে চারঘণ্টা অর্চিষ্মানের অপেক্ষাতেই আছি। কখন অর্চিষ্মানের ওয়ার্কশপ শেষ হবে, কখন অর্চিষ্মান হোটেল খুঁজেপেতে এসে দরজায় টোকা মারবে, আমার কে-র উত্তরে বলবে, আমি।
কিন্তু অর্চিষ্মান তা বলল না। আমি বললাম, কে? অর্চিষ্মান বলল, হাজব্যান্ড।
ছিটকিনি ছুঁয়ে হাত থেমে গেল। গলাটা অর্চিষ্মানের মতোই। মায়ের মুখ মনে করে দরজা এক মিলিমিটার ফাঁক করে বাঁ চোখ ঠেকালাম। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অর্চিষ্মান। অদূরে এক ভদ্রলোক, বডি লিফটের দিকে ঘোরানো, চোখের মণি এবং মনোযোগ আমাদের দিকে।
ভদ্রলোককে দুপুরে দেখেছি। একশোবার “লাগবে না লাগবে না ভাইসাব” বলা সত্ত্বেও আমার সাড়ে সাতশো গ্রামের ডাফেল ব্যাগ রিসেপশন থেকে লিফটে চড়ে তিনতলার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছেন। কলপ না করার এটা ম্যাসিভ পে অফ। কত লোক যে ব্যাগ বয়ে দেয় আর সিট ছেড়ে দেয়। সেবার ইন্ডিগোর কাউন্টারে অ্যানাকোন্ডা সাইজের লাইনের শেষে হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন দয়ালু অ্যাটেন্ডেন্ট “দিস ওয়ে, ম্যাম” বলে সিনিয়র সিটিজেনের খাঁ খাঁ কাউন্টারে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এসির হাওয়ায় কপালের কুচো পাকাচুল উড়িয়ে সাতান্ন সেকেন্ডে চেক ইন সেরে সিকিউরিটিতে ঢুকে গেছি। ঠিক করেছি এবার থেকে ভিড় দেখলে নিজেই চলে যাব।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বডি ফেলল অর্চিষ্মান। ভদ্রলোকের সন্দেহজনক আচরণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম।
আরে আমি তো রিসেপশনে তোমার রুম নাম্বার দিলাম। বললাম, ডু ইউ নিড মাই আই ডি? বলল, দরকার নেই ওপরে চলে যান। লোকটা আমাকে নিয়ে ওপরে এল। লিফটে উঠে বলে, আপ ওর আপকা ফ্রেন্ড ইন্ডিয়া সে আয়ে হো? আমি বললাম ম্যায় ওর মেরা ওয়াইফ ইন্ডিয়া সে আয়ে হ্যায়। শুনে অর্থপূর্ণ নীরবতা মেন্টেন করল। তারপর দরজার সামনে এসে ঘাড়ের ওপর - যেমন দেখলে - নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইল। তক্ষুনি তুমি বলে উঠলে কে? আমিও নার্ভাস হয়ে হাজব্যান্ড বলে ফেললাম।
অর্চিষ্মান হতাশ। বস্, কিছু হোটেলও বেছেছ। দেড় ঘণ্টা ধরে ঘুরছি। ওর হোটেল থেকে অ্যাপ থেকে মোটরবাইক বুক করে বেরিয়ে থামেলে পৌঁছে এ হোটেল খুঁজে বার করতে নাকি ওর দেড় ঘণ্টা লেগেছে।
থামেলের গোলকধাঁধা বিশ্ববিখ্যাত। আমার নিজেরও হোটেল বার করতে পঁচিশ মিনিট লেগেছে। তা বলে দেড় ঘণ্টাটা একটু বাড়াবাড়ি।
অ্যাপের বাইকওয়ালা তোমাকে নিয়ে দেড় ঘণ্টা এমনি এমনি ঘুরল? ইয়ার্কি হচ্ছে-টা উহ্য রাখলাম।
সেটা নাকি অর্চিষ্মানেরও অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। ভদ্রলোককে দেখেই নাকি ওর সন্দেহ হয়েছে বিহারের লোক। হয়তো নতুন কাজ ধরেছেন, থামেলের গলি নিয়ে অতটাও সড়গড় নন। মিনিট কুড়ি পর থেকেই নাকি অর্চিষ্মান আন্তরিকভাবে অনুরোধ করেছে, ছোড় দিজিয়ে ভাইসাব, ম্যায় পয়দল ঢুণ্ড লুঙ্গা। ভদ্রলোক অটল। ম্যায় আপকো পহুঁছাকে হি ওয়াপস যাউঙ্গা।
মাথা নেড়ে বললাম, হান্ড্রেড পারসেন্ট বিহারি।
অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠীর ইন্টারভিউ শুনছিলাম। সম্ভবতঃ অনুপমা চোপড়াকে দেওয়া। ত্রিপাঠী বলছিলেন, ইউ পি বিহার কি লড়কো মেঁ কুছ বাত হ্যায় ম্যাডাম। প্রথম যৌবনে টাকা রোজগারের জন্য ত্রিপাঠীকে নাকি এক হোটেলের রান্নাঘরে কাজে লাগতে হয়েছিল (সে জন্য তিনি এখনও ভালো রান্না করতে পারেন।) শেফ না, সু শেফ না, এমনকি লাইন কুকও না। বেসিক্যালি, খোসা ছাড়ানো আর কাটাকুটির কাজ। চাকরির প্রথম দিন বিশ না চল্লিশ (পাঁচের ওপর সব সমান) কিলো পেঁয়াজ দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে কাটতে বলা হয়েছিল। বেসিক্যালি, তাড়ানোর চেষ্টা। পঙ্কজ নাকের জলে চোখের জলে ভেসে সব পেঁয়াজ কেটে থেমেছিলেন। কিঁউ কি বিহার ইউ পি কে লড়কো মে ইয়ে বাত হোতা হ্যায় ম্যাডাম।
দেড় ঘণ্টা পর ফাইন্যালি আমার হোটেল খুঁজে বার করে ভদ্রলোককে ছাড়ার আগে অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করেছিল, আপ কাহাঁ সে হো ভাইসাব? ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন বিহার নেপালের বর্ডারে তাঁর বাড়ি। বলে বাইক ঘুরিয়ে, আপ তো জরুর বংগালি হো, বলে মুচকি হেসে হাওয়া হয়েছিলেন।
অর্চিষ্মান এমন খেলিয়ে নিজের দুর্দশার বর্ণনা দিল যে আমি আর আমার দুঃখের কথা পাড়লাম না। আমিও কিছু গান গাইতে গাইতে, গোলাপের বেডে বেড়াতে বেড়াতে থামেলের গলিতে এসে ভিড়িনি। শেষরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে টি থ্রি থেকে প্লেনে চড়ে ত্রিভুবনে এসে নামা পর্যন্ত ঠিকই ছিল। তারপর গোলমাল শুরু হল।
প্রথম গোলমাল হল সিম নিতে গিয়ে। দিল্লি এয়ারপোর্টের ম্যাট্রিক্সের কিওস্কে ফোন ও ডেটার কম্বো প্যাকের দাম তিন হাজার ভারতীয় টাকা, নেপালে নেমে কিনলে সাতদিনের ডেটা প্লাস কল কার্ড পাওয়া যাবে নেপালি পাঁচশোয়। কোনও মানেই হয় না।
ত্রিভুবনে এনসেলের কিওস্কে স্ট্যান্ডার্ড প্যাক চাইলাম। কার্ড বার করলাম। ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যানজাকশন এনাবলড কার্ড। সবক’টা ডিক্লাইনড হল। “দাঁড়ান, আরেকটা ট্রাই করি” করে করে অন্ততঃ সাতটা কার্ড (যার মধ্যে একটা এক্সপায়ারড আরেকটা স্টারবাকসের মেম্বারশিপ কার্ড) ট্রাই করলাম। ভদ্রলোকরা রিয়েল ভদ্র, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। প্রত্যেকটা ডিক্লাইন্ড হল। কার্ড উল্টে দেখলাম খুদি খুদি অক্ষরে লেখা ‘ইন্টারন্যাশনাল এক্সেপ্ট নেপাল অ্যান্ড ভুটান’। ভদ্রলোকরা কিউ আর বোর্ডের দিকে তর্জনী তুললেন, জি পে খুলে তাক করলাম। স্ক্রিন আদেশ দিল “এনাবল ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট”, তড়িৎগতিতে পালন করলাম। কনফার্মেশন এল নেক্সট সাত দিনের জন্য পেমেন্ট এনাবলড। পেমেন্ট করলাম, ডিক্লাইন্ড। বললাম আমার কাছে তো নেপালি টাকা নেই, ভারতীয় টাকা নিন। (বাড়ি থেকে বেরোনোর আগের মুহূর্তে ড্রয়ারের তলায় লাট খাওয়া খানকয়েক ডলারও খামচা মেরে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু সে মুহূর্তে সামহাউ তাদের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলাম)। ওঁরা বললেন দিন। ব্যাগ খুলে গান্ধীর মুখ আঁকা কড়কড়ে পাঁচশোর নোট বার করলাম। কারেন্ট খাওয়ার মতো হাত সরালেন। সরি ম্যাম, আমরা আপনাদের পঞ্চাশ একশো ছাড়া নিই না।
কেন, নেন না কেন?
আবার কবে আপনাদের ডিমানিটাইজেশন হয়ে যায়। নো বিগ নোটস প্লিজ। চিন্তা করবেন না, এয়ারপোর্টের বাইরে সিমের দোকানে আপনাদের পাঁচশো নিয়ে নেবে।
বাইরে মানে কত বাইরে?
জাস্ট বাইরে। বলে হাত তুলে এমন ভাবে দেখালেন যেন দু’পা।
অনেকগুলো দৃশ্য মনে পড়া উচিত ছিল। অ্যাপোলো গ্লেনিগ্যালস? এই তো দু’পা, বলে উল্টোডাঙার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে বাস হাওয়া, মফঃস্বলের বালিকা ভরদুপুরে হাঁটছে। রামগড় থেকে ফেরার আগের দিন ক্যাশ ফুরিয়েছে, ক্যাশ না থাকলে বাস ধরা যাবে না, বাস না ধরলে বিকেলে বাড়ি ফেরার ট্রেন মিস হয়ে যাবে। এ টি এম? থোড়াসা আগে, শুনতে শুনতে আমি আর অর্চিষ্মান রামগড়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে ফেলেছি।
একটা দৃশ্যও মনে পড়েনি। পা কেটে রক্তারক্তি হওয়ার পর এক্স্যাক্টলি এই কুড়ুলে আগেও পা পেতেছিলাম মনে পড়াই অভিজ্ঞতা।
এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে রোদে চোখ কুঁচকে গেল। দিগন্তে দোকানের জটলা মরীচিকার মতো দপদপাচ্ছে। অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে।
ব্যবস্থার উপায় সীমিত। ফোন নেই। বাজারে চলে এমন টাকা নেই। অবশ্য ব্যাগে পাসপোর্ট আছে, পুলিসে ধরেনি। আমার পক্ষে যথেষ্ট। টাকার অভাবে এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রিপেড ট্যাক্সি বুক করতে না পারা সত্ত্বেও ফ্লুরোসেন্ট সবুজ জ্যাকেটে প্রিপেড ছাপা পুরুষেরা ঘিরে ধরলেন। ট্যাক্সি? বললাম, ট্যাক্সি তো বটে কিন্তু নো মানি। ওঁরা বললেন, কাহাঁ যানা হ্যায়? বললাম, থামেল।
ভেরি গুড। এক হাজার নেপালি মানি। বৈঠ যাইয়ে।
বৈঠ যাইয়ে মানে? বলছি না টাকা নেই। ইন্ডিয়ান মানি আছে, চেঞ্জ করতে হবে।
হয়ে যাবে উঠে পড়ুন।
একফোঁটা রিসার্চ করে বেরোইনি। এয়ারপোর্ট টু থামেল ট্যাক্সিভাড়া কত হওয়া উচিত জানি না। ফোনে নেট নেই যে দেখে নেব থামেল কদ্দূর। হয়তো পাশের গলি। কাজেই দরাদরি ভিত্তিহীন। মাকে মনে পড়ল। সোনা, পুরো বিশ্বাস করলে ঠকার চান্স কম। দোকানি মাকে 'কোন মিষ্টিটা দেব বৌদি?' জিজ্ঞাসা করলে, 'টাটকাটা' বলে মা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মায়ের ধারণা ছিল এর পরেও বাসি মিষ্টি চালাতে গেলে প্রফেশনাল ক্রিমিনাল হতে হবে আর প্রফেশনাল ক্রিমিনাল পৃথিবীতে বেশি জন্মায়নি, যারা জন্মেছে অলরেডি আলিপুর জেলে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করছে। (মা অবশ্য এও বিশ্বাস করতেন, বাচ্চা মেয়েরা মাঝবয়সী পুরুষদের কাকু জেঠু সম্বোধনে ডাকলে সে সব পুরুষের বাঁদরামো করার চান্স জিরো হয়ে যায়।) মায়ের কথা শুনে আজ পর্যন্ত বিপদে পড়িনি, কিন্তু মায়ের কথা পুরোটা শুনে ফেললে পাছে জীবন কেকওয়াক হয়ে যায় তাই বললাম, থামেলের পক্ষে হাজার টাকা কি বেশি?
অত্যন্ত কম। উঠে পড়ুন।
সব ঠিক থাকলে তখন থেকেই কাঠমান্ডুর রাস্তাঘাট আকাশবাতাস দেখা শুরু করা যেত। কিন্তু সব ঠিক নেই। টাকার ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে। যেটুকু চোখে পড়ছে মনে হচ্ছে আর পাঁচটা সাউথ এশিয়ান বড় শহর। ঘিঞ্জি, ভিড়, কুৎসিত কনস্ট্রাকশন। চিন্তামুক্ত থাকলে কুৎসিতের মধ্যেও সুন্দর বেরিয়ে পড়ত।
অন্য চিন্তাও আছে। থামেল কোনদিকে, গাড়ি সেদিকেই যাচ্ছি কি না তাও তো জানি না। ফুল অবিশ্বাসী আর ফুল বিশ্বাসী - দুই পথই কঠিন। বিপদে পড়ব না তার গ্যারান্টি বলতে এতদিন পড়িনি। এতদিন কেউ কেস খাওয়াননি অতএব এই ভাইসাবও খাওয়াবেন না - সেই আনন্দে যথাসম্ভব মাইন্ড ওভার ম্যাটার করে চললাম। মিনিট দশ পর এক পাঞ্জাবি ধাবার সামনে ট্যাক্সি থামল।
ইয়ে লোগ ইন্ডিয়া সে আকে দুকান দিয়া হ্যায়, আপকা রুপিস এক্সচেঞ্জ কর দেঙ্গে।
স্পষ্ট করেই বললাম। বাটার চিকেনের কড়াইয়ের ওপর ঝুঁকে টাকা এক্সচেঞ্জ করতে পারছি না। প্রপার এক্সচেঞ্জ দোকানে নিয়ে চলুন।
মাটি কামড়ে রেডি ছিলাম, রেজিস্ট্যান্স আসবে। ওককে, বলে ছেলেটা গাড়িতে উঠে পড়ল। মনে পড়ল আমি দিল্লিতে নেই। অত মাটি আঁকড়ানোর প্রয়োজন নেই। রিল্যাক্স করে বসলাম।
গাড়ি উল্টোদিকে চলল। ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে শহর। ব্যস্ত বাজার। মহাকালী কারেন্সি এক্সচেঞ্জের মলিন বোর্ড। আবছা কাউন্টারে একজন বয়স্ক, একজন যুবক। ইন্ডিয়ান কারেন্সি বদলাতে চাই শুনে বললেন ওয়ান পয়েন্ট ফোর মিলেগা। ডু আই গেট আ রিসিট? বয়স্ক ভদ্রলোক টাকা গুনতে গুনতে থেমে গেলেন। ম্যাডাম ইয়ে সব আন্ডারস্ট্যান্ডিং মে চল রহা হ্যায়। গভর্নমেন্ট নে অ্যালাউ নেহি কিয়া। হাম ইয়ে পয়সা লেকে বর্ডার সে চিনি খরিদ কে লায়েঙ্গে ওহাঁ ভি হামে রিসিট নেহি মিলেগা।
ছোকরা নাকের ভেতর দিয়ে হাসল।
চুপ করে গেলাম। ভদ্রলোক নরম হলেন। ম্যায় আপকো গলত নেহি বতা রহা হুঁ ম্যাডাম। আপ বাকি পয়সা হোটেল এক্সচেঞ্জ কর লেনা, ওয়ান পয়েন্ট সিক্স মিল যায়েগা। উনকা বিজনেস বড়া হ্যায় না, হামারা তো ছোটামোটা।
ভদ্রলোক আমার হাতে নেপালি পাঁচশো টাকার তোড়া ধরালেন (একটা ফাটা বেরিয়েছিল)। আমি হাসলাম। থ্যাংক ইউ। ভদ্রলোক হাসলেন। থ্যাংক ইউ। ছোকরা মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল। থ্যাংক ইউ।
সিম এখনও হয়নি কিন্তু অর্ধেক চিন্তা মিটেছে। কাজেই পুরো মন জানালার বাইরে স্থাপন করলাম। ভারতবর্ষের মতো আবার ভারতবর্ষের মতো নয়ও। পাবলিক পশু অনেক কম। একটা গরুও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। মাথার ওপর লক্ষ লক্ষ ইলেকট্রিকের তারের কালো জট। ভাইসাবকে হোটেলের নাম বলে দিয়েছি। চিনতে পারেননি কিন্তু আশ্বাস দিয়েছেন খুঁজে দেওয়ার।
কথাটা হচ্ছে আমি সোজা অর্চিষ্মানের হোটেলে গেলাম না কেন। আগের বছরও ওয়ার্কশপ অন্তে কাঠমান্ডুতে অর্চিষ্মানের সঙ্গে মিট করার কথা হয়েছিল। হচ্ছে হবে করে হয়নি। এ বছর ওয়ার্কশপের নোটিস আসাতে পুরোনো প্ল্যান চাগাড় দিল। দুজনে জোগাড়যন্ত্র করে যাওয়ার থেকে অলরেডি একজন চলে গেলে কাজ অর্ধেক হয়ে থাকে। তাছাড়া কাজ তেমন কিছু নেইও। ভিসাটিসার হাঙ্গামা নেই। টিকিট কাটো, ব্যাগ গোছাও, পাসপোর্ট নাও, হাঁটা লাগাও।
একটাই ঝামেলা। অ্যাকচুয়ালি দুটো। একটা অর্চিষ্মানের। একটা আমার।
অর্চিষ্মান যেখানে চষে সেখানে বসে না, যেখানে বসে সেখানে চষে না। ওর জীবনে প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ইউনিভার্স। একটি ইউনিভার্স আরেকটা ইউনিভার্সের কক্ষপথে ঢুকে পড়লে অর্চিষ্মানের প্যালপিটেশন হয়। ও নাকি বারো বছরের স্কুল জীবনে একজনের বেশি বন্ধুকে বাড়িতে আনেনি। এদিকে বন্ধু অগুন্তি। বিয়ের আগে বাড়ির লোকের আলাপ করানোর সময় করুণ মুখ করেছিল। আলাপ না করিয়ে বিয়ে করে ফেলা যায় না? তুমি এদিকে রইলে, বাড়ি ওদিকে। আলাপের দরকার কী? যদি কখনও হয়ে যায়, হবে।
কাজেই অর্চিষ্মানের অফিসের লোকের সঙ্গে আমার চোরে কামারে দেখা নেই। এখন তবু কে কেমন সে নিয়ে গল্প করে, শুরুতে তাও করত না। ওর দুই বস্, ভারতবর্ষের পাট চুকিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় জানিয়েছিলেন, ফেয়ারওয়েল ডিনারে স্ত্রীকে না আনার কনসিকোয়েন্স গ্রেভ। খান মার্কেটের একটি রেস্টোর্যান্টে - যা লকডাউনে দেহ রেখেছে - জার্মান বসের সঙ্গে ডিনার হয়েছিল। দু’গ্লাসের পর ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলেছিলেন দিল্লির মতো শহরে দু’জন অ্যাডাল্ট পার্সোন্যাল ট্রান্সপোর্ট ছাড়া ঘুরছে এটা আবিষ্কার করা থেকে নাকি উনি আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহ বোধ করেছিলেন। আমরা বলেছিলাম ইউ আর মিক্সিং উইথ দা রং ক্রাউড। আমাদের ঘনিষ্ঠ অধিকাংশ লোকেরই ব্যক্তিগত পরিবহন নেই।
অর্চিষ্মানের মতো না হলেও আমার অ্যাটাচমেন্ট স্টাইলও অ্যাভয়েডেন্ট। খুব লেপটা লাগাতেও পারি না, কেউ খুব লেপটা লাগাতে চাইলেও অস্বস্তি বোধ করি। অফিসে টানা দশ বছর একা লাঞ্চ করেছি কারণ ওটা আমার মি টাইম আর আমার মি টাইমে আমি অর্চিষ্মানকেও অ্যালাউ করি না। অর্চিষ্মানের অফিসের সঙ্গে গোটা উইকেন্ড হুলাবিলার প্রশ্নই নেই।
তবে তোমার সুবিধে হলে আমি তোমার অফিসের লোকের সঙ্গে হাই হ্যালো করে আসতে পারি।
ব্যাপারটা হাইহ্যলো-তে থামবে না, কুন্তলা। সবার ফ্যামিলি ওই উইকেন্ডে কাঠমান্ডুতে কিলবিল করবে। অলরেডি নাকি অর্চিষ্মানকে লোকে খোঁচাতে শুরু করেছে তুমহারা বিবি আ রহি হ্যায়? তাহলে সবার বিবির টিকিট এক প্লেনে একসঙ্গে কাটা হবে যাতে গানের লড়াই খেলতে খেলতে হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যায়। বিবিতে বিবিতে বন্ডিং-এর ঢেউ খেলে। অন্ততঃ সে রকমই প্রত্যাশা।
আমার ঝামেলাটা হচ্ছে প্রত্যাশা থাকলে তা পূরণ করতে আমি ব্যর্থ হব। হবই। কেউ আটকাতে পারবে না।
তাছাড়া অতক্ষণ বাধ্যতামূলক বন্ডিং প্র্যাক্টিস করতে গেলে আমার ব্রেকডাউন হয়ে যাবে। সে ব্রেকডাউন আমার সর্বাঙ্গে ফুটে উঠবে। বন্ডিং আদৌ হবে কি না তারও কোনও গ্যারান্টি নেই। সূর্য পূর্বদিকে উঠেছে কি না, মার্কারি রেট্রোগ্রেডে গেছে কি না, গত সাতদিন নেক্সিটোর ডোজ নির্ভুল পড়েছে কি না এ সব অনেক ব্যাপার আছে।
অর্চিষ্মান রিস্কে যায়নি। কুছ ভি কনফার্মড নেহি হ্যায় ইয়ার। নিজেদের মধ্যে শলা হয়েছে ত্রিভুবন থেকে আমি সোজা আমার পছন্দ করা হোটেলে যাব। অর্চিষ্মানকে হোটেলের লোকেশন পাঠাব। অর্চিষ্মান ফোন খুলে 'ওয়াও, বিবি নে সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়া হ্যায়' বলে নিজের হোটেল থেকে বেরিয়ে আমার হোটেলে এসে উঠবে।
সে রকমই ঘটেছে। অর্চিষ্মান অ্যাপের বাইক বুক করে দেড় ঘণ্টা থামেলের গলিতে ঘুরে আমার হোটেলে ঢুকেছে এবং ঢুকেই ঘোষণা করেছে হোটেলটা ওর একটুও পছন্দ হয়নি।
ট্রিপঅ্যাডভাইসরে রেটিং দেখেই তো বেছেছি। যাই হোক, একরাতের ব্যাপার। কষ্টমষ্ট করে চালিয়ে নাও। কাল সকালেই তো নাগরকোট।
সেই। অর্চিষ্মান উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। আজ শুক্র বিকেল। অর্চিষ্মান সোমে চলে যাবে। নষ্ট করার সময় নেই। তাছাড়া সাতদিনের হাড়ভাঙা ওয়ার্কশপ থেকে মুক্তি পেয়ে অর্চিষ্মানের এনার্জি তুঙ্গে।
দরজায় চাবি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার বদলে অর্চিষ্মান দেখি ওপর দিকে চলেছে।
কী গো?
অর্চিষ্মান আঙুল তুলল। বোর্ডে তীরচিহ্ন, তীরচিহ্নের ওপর লেখা রুফটপ রেস্টোর্যান্ট।
দেখে আসি একবার।
পিছু নিলাম। সিঁড়ি ছাদে উন্মুক্ত হল আর হতেই এঁদের হাই রেটিং-এর রহস্য উন্মোচিত হল।
রোদ ঢলে গেছে। সন্ধে নামতে যদিও এখনও ঘণ্টাখানেক। রেলিংঘেঁষা টবে আরিকা পাম, মন্সটেরা, ফিকাস, থুজা, সং অফ ইন্ডিয়া। বছর পাঁচেক আগে গাছের বাই চেপেছিল। গাছেরা নেই, নামগুলো ব্রেনের খাঁজে আটকে আছে।
আমার অর্চিষ্মানের দুজনেরই বিশ্বাস - ওর অ্যাক্রোফোবিয়া আছে। পাহাড়ে চড়তে ভালোবাসে কিন্তু দোতলা বাড়ির রেলিং-এর ধারে যেতে ভয় পায়। আশেপাশে এদের থেকে উঁচু ছাদ আর নেই। অর্চিষ্মান 'বাহ কী সুন্দর বাগান, কী অভূতপূর্ব ভিউ' বলছে বটে, তলায় তলায় স্ট্রেসের চোরা স্রোত। টপ করে খালি টেবিল দেখে বসে পড়লাম।
থামেল কংক্রিটের জঙ্গল। প্রচুর হোটেল, প্রচুর বাড়ি। খুপরি খুপরি ছাদ। একটা নিচু ছাদে দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা চেয়ারটেবিল পেতে বসেছেন। চা জলখাবার চলছে। বললাম, আমাদের ভবিষ্যৎ। অর্চিষ্মান বলল, অতদিন থাকবে বলছ? পাশের ছাদে এক ভদ্রমহিলা হনহনিয়ে হাঁটছেন। ফোন এসেছে, দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তা বলে সময় নষ্ট করছেন না, ফাঁকা হাত দিয়ে টবের আগাছা ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলছেন। অর্চিষ্মান বলছে, কিছু একটা কর কুন্তলা আমার পেটের ভেতর কেমন একটা করছে। নীল রং করা করোগেটেড অ্যালুমিনিয়ামের ছাদে, যেটার অবভিয়াসলি কোনও রেলিং নেই, এক মহিলা উঠে গাছের পরিচর্যা করছেন। ক্রমে ক্রমে থামেল জুড়ে ছোট বড়, উঁচু নিচু, কংক্রিট অ্যাসবেসটসের ছাদে মহিলারা উঠে গাছেদের স্নান করাতে লাগলেন।
আজকে বিকেলের থিম ছাদ হতে পারে, বল?
হ্যাঁ। আর লাল জামা পরা গাছপ্রেমী মহিলার দল।
ঠিকই। সবার পোশাকেই লাল অথবা লালের শেড। পরেও খেয়াল করেছি। নেপালে মনে হয় মহিলাদের লাল রঙের পোশাক পরার প্রবণতা বেশি।
অর্চিষ্মান বলল, মেয়েদের কি ছাদে ওঠারও প্রবণতা বেশি? হতে পারে। বাবার থেকে মা ডেফিনিটলি বেশি ছাদে উঠতেন। নাকতলাতেও সেম কেস। অর্চিষ্মান বলছে, চুল আঁচড়ানোর মধ্যে একটা ভীষণ আরাম আছে তাই না?
অকস্মাৎ?
ওই ছাদে একজন চুল আঁচড়াচ্ছেন।
কোথায়? ওই তো। কই তো? তুমি কী দেখছ বল? আমি দেখছি তিনটে কালো ট্যাংক। ট্যাংকের বাঁদিকের ছাদটা দেখ। দেখেছ? দেখেছি। হলদে দেওয়াল ঠেসান দেওয়া মই? মই। এবার ঠিক তার পেছনের ছাদের দড়িতে লাল শাড়ি? লাল শাড়ি। বাঁপাশ ঘেঁষে চোখ চালাও। চালিয়েছি। তিনজন মহিলা। রাইইইট, একজন চুল আঁচড়াচ্ছেন। এখন আর আঁচড়াচ্ছেন না। হাতকে রেস্ট দিচ্ছেন। মাও অফিস থেকে ফিরে অনেকক্ষণ ধরে জোরে জোরে চুল আঁচড়াতেন। লম্বা চুল ছিল মায়ের। হয়তো ক্লান্তিটা চুল বেয়ে নেমে যেত।
দূরে আরেকটা রুফটপে হলুদ টুনির সারি জ্বলে উঠেছে। সূর্যাস্ত এখানে পিক টাইম। আমাদের ছাদের টেবিলে টেবিলে গোর্খা স্ট্রং আর চেয়ারে চেয়ারে মানুষ। অধিকাংশই ককেশিয়ান। পেছনের টেবিলে একজন সাউথ এশিয়ান ভদ্রলোক টেবিলে কাগজ পেতে, এঁকেজুকে দুই সাহেবকে রুট বোঝাচ্ছেন। টেন্টের খরচ কত। গাইডের খরচ কত। গাড়ির খরচ কত। ওয়েদার কেমন থাকবে। পাশের টেবিলে দুঃখী মুখের একলা সাহেব অস্তমান সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্চিষ্মান বলছে ওরা কেমন একা একা ঘোরে। আমারও ইচ্ছে করে কিন্তু হাইলি বোর হয়ে যাব। আমিও। দু'তিনদিন ঠিক আছে, মাসের পর মাস একা একা ব্যাকপ্যাক নিয়ে এ দেশ ও দেশ পোষাবে না। এরা অন্যভাবে ভাবে। অর্চিষ্মানের কলিগের স্ত্রী হাই প্রোফাইল চাকরি ছেড়ে একবছরের জন্য ফিলজফি পড়ছেন। পড়া শেষ হলে আবার চাকরি করবেন। ছাদের রেলিং-এর লাগোয়া বেসিন, তার নিচের কল থেকে নীল বালতিতে জল ভরে সবুজ মগে করে টবে টবে ঢালছেন একজন কর্মী। দুঃখী সাহেব ফ্রায়েড রাইস অর্ডার করেছেন। ভেরি আর্লি ডিনার মনে হয়।
আমরা গোর্খা স্ট্রং-এর সঙ্গে আলুভাজা আর ফ্রায়েড মোমো (ভেজ) নিয়েছি। নেপালে এই প্রথম আমার মোমো ভক্ষণ। মেয়োনিজের ধাষ্টামোটা নেই। এমনকি লাল চাটনিও না। কাসুন্দি রঙের কী একটা চাটনি কিন্তু কাসুন্দি নয়।
অস্ফুট ঢিকচিক ঢিকচিক কানে আসছে। থামেল প্রস্তুত হচ্ছে ফ্রাইডে নাইটের জন্য। আকাশে আবছা লাইন গ্রাফের মতো পর্বতের আউটলাইন। হিমালয়ের একেবারে কোলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সূর্য নিচে নেমে আসাতে আউটলাইন স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে কিন্তু ছমছমে ব্যাপারটা কাটেনি এখনও। সূর্যটা রং বদলাতে বদলাতে লালের দিকে যাচ্ছে। মাথার ওপর একঝাঁক পাখি ভি-এর মতো লাইন করে উড়ে গেল।
অর্চিষ্মান বলছে, একটা ফিলিং হচ্ছে না?
হচ্ছে।
এক্স্যাক্টলি কী জন্য হচ্ছে আইডেন্টিফাই করতে পারছ?
ভাবলাম। সূর্যাস্তের জন্য? থামেলের ছাদে ছাদে লালজামা মহিলাদের বৈকালিক বাগান পরিচর্যার জন্য? পাখিদের ওড়াউড়ি, রুফটপের টুনিলাইট, গলিতে গলিতে ডিজে মিউজিকের কাঁপুনির জন্য? নাকি এ রকম একটা নেমে আসা সন্ধের মাঝে তুমিআমি টেবিলের এপাশে ওপাশে বসে আছি সে জন্য?
সূর্য এখন কাঠমান্ডুর কপালে টিপ। আর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞাসা করতে এসেছেন ভাইসাব। দুজনে আলোচনা করছি এখন কিছু খাওয়া অবিবেচনা হবে কি না। রাতে বেরিয়েও তো খেতে ইচ্ছে করবে। থাক। বিল প্লিজ। ভাইসাব চলে যাচ্ছেন। চোখ ঘুরিয়ে দেখি টিপ অদৃশ্য।
কোথায় গেল? কোথায় গেল? এ অলৌকিক মুহূর্তকে শেষপর্যন্ত চোখে চোখে আগলে রাখতে পারলাম না?
দুঃখ সামলাতে না পেরে উঠে পড়লাম। টায়ার্ড লাগছে। রেস্ট নিয়ে বেরোই নাকি? ঘরে গিয়ে বিছানায় লম্বা হচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়ব শিওর, কিন্তু থামেল সারারাত জাগবে। যখন ঘুম ভাঙবে বেরোব। অর্চিষ্মান বলছে, কুন্তলা ডেকো কিন্তু। ম্যাকলয়েডগঞ্জ মনে পড়ছে। প্রথম যুগ্ম ট্রিপ। পেমা থাং-এ বুকিং ছিল। সারা বিকেল বৃষ্টি। অপেক্ষায় থেকে থেকে অর্চিষ্মান ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামল, বৃষ্টি ধরল। আমি হাফ অন্ধকার ঘরে চুপ করে ঘুমন্ত অর্চিষ্মানের পাশে বসে রইলাম। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে অর্চিষ্মান হতভম্ব। ডাকলে না কেন কুন্তলা?
পরে যখনই সে দিনের কথা উঠেছে অর্চিষ্মান মাথা নেড়েছে। বস্, তুমি কিছু প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ। আমি বলেছি, ওটার একটা মাচ বেটার প্রতিশব্দ বাংলাভাষায় আছে। অভিমানী।
সেই থেকে বেড়াতে গিয়ে ঘুম পেলে বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে পাঁচবার করে বলে অর্চিষ্মান। কুন্তলা, ডেকে দিয়ো। ঘুমোচ্ছি বলে রাগ করে বসে থেকো না। জল ঢেলে হলেও জাগিয়ে দিয়ো।
সে অভিমানও নেই, সে কুন্তলাও না। দশটার কাছাকাছি ঘুম ভাঙল। কী গো বেরোবে? ঝাঁকুনি দিলাম। অর্চিষ্মানেরও ঘুম পাতলা হয়ে এসেছিল, উঠে পড়ল।
দিল্লির পাহাড়গঞ্জ যাঁরা দেখেছেন থামেল কল্পনা করতে পারবেন। শেডিনেস এক কোটিগুণ কমিয়ে নিন, পরিচ্ছন্নতা এক কোটিগুণ বাড়িয়ে। বাকি সেই সেম অলিগলি, কুল পাবের জটলা। এত কুল যে দরজার রং চটে গেছে, দেওয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। বাড়ির ফার্নিচার কিনতে গিয়ে দেখেছি, ,ডিসট্রেসড লুকের আলমারি বুককেসের দাম সর্বদাই বেশি। দু’প্রজন্ম আগে একজনের কথা জানি যিনি শাড়ি কিনে ধুয়ে পেঁচিয়ে রেখে দিতেন ন্যাতা হওয়া পর্যন্ত। দোকান থেকে সদ্য কেনা চকচকে, মড়মড়ে জামাকাপড় পরে বিশ্বশুদ্ধু লোকের সামনে মশমশিয়ে চলতে তাঁর লজ্জা করত।
তিন্নি সেদিন একজন প্রথিতযশা লোকের যৌবনের ছবি পাঠালো। স্ট্রাইকিং ছবি। ভদ্রলোক সিনেমার লোক কিন্তু ক্যামেরার পেছনের। তিন্নি বলল প্রোডাকশন স্টিল। ভদ্রলোক ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নেই ঠিকই কিন্তু এক প্রোজেক্টের মাইনে বাজি - ব্যাপারটা ওঁর অনবধানে ঘটেনি। এ ছবি হল 'প্ল্যান্ডিড', অর্থাৎ প্ল্যান করা ক্যান্ডিড।
তিন্নি আমাকে ওর ভালোলাগার একটা কিছু পাঠিয়েছে বা জানিয়েছে - গান, ছবি, সিনেমা, বেড়ালছানার ভিডিও - আমি তার চুল চিরিনি, হয়নি। তবু যখন এখনও পাঠায় ধরে নিতে হবে ক্ষমা করে দিয়েছে। ছবিটায় আমি নাতিশীতোষ্ণ লাইক দিলাম দেখে তিন্নি বলল ওর খুব ভালো দেখতে লেগেছে ভদ্রলোককে ছবিটায়। বললাম আই এগ্রি যে ওঁকে চমৎকার দেখতে লাগছে। ঝামেলাটা হচ্ছে যে উনিও জানেন ওঁকে ভালো দেখতে লাগছে। তিন্নি বলল ঠিকই বলেছিস। ফিল্মের লোকদের এই লজ্জাটা চলে যায় মনে হয়। আবারও এগ্রি করলাম। চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে নন-ফিল্মি লোকদেরও এই লজ্জাটা ঘুচে গেছে। নিজেকে সুন্দর দেখতে চাওয়াটা মানুষের বেসিক তাড়নার মধ্যে পড়ে, কিন্তু যে ছবিতে আমাকে সুন্দর লাগছে লাফিয়ে পড়ে সেটাকে পৃথিবীর সবাইকে দেখাতে সংকোচ হওয়াটাও বেসিক বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা কালেকটিভলি সে সংকোচ অতিক্রম করতে পেরেছি।
রাস্তাভর্তি মানুষ। পাঁচতলার ছাদের ডান্সবার থেকে সাইকেডেলিক আলো ছিটকোচ্ছে। দোকানের নাম লেখা লোগো আঁকা আলোর বৃত্ত কুচকুচে পিচে ঘুরছে। ভাবছি লোগোটা পাড়িয়ে গেলে বেশি মজা হবে না এড়িয়ে গেলে, আঙুলে টান পড়ল। অর্চিষ্মান থমকে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। এবার আমিও শুনতে পেয়েছি। ওর নাম ধরে কেউ ডাকছে। ওই তো। হাসিমুখে হাত নাড়ছে অর্চিষ্মান। রাস্তার পাশের দোতলা বাড়ির আবছা বারান্দায় হাসিমাখা মুখ। আমিও ফাউ হাত নাড়ি। পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করি। অর্চিষ্মানের বাংলাদেশের সহকর্মী। নাম শুনে চিনতে পারি। যার সঙ্গে তুমি ননস্টপ ফোনে কথা বল? ঠিক ধরেছ। প্রোজেক্টের বাংলাদেশের কনট্যাকট পয়েন্ট।
থামেলের ভরকেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছি। ভিড় বাড়ছে। এঁকেবেঁকে হাঁটতে গিয়ে গতি কমছে। আলো পেঁচিয়ে লেখা ‘পার্পল হেজ’ বোর্ডের নিচে একটা আনঅ্যাসিউমিং দরজা বাজনার তালে তালে কাঁপছে। লাইন দিয়ে লোক ঢুকছে। থামেলের বিখ্যাত ক্লাব। অর্চিষ্মান বলছে ঢুকবে? দোনোমনা করছি। অর্চিষ্মান বলছে আরেকটা আছে, স্যাম’স, সেটায় চল। আগের বার ও গেছিল। ভালো নাকি। স্যাম’স-এর সরু কাঠের সিঁড়ির ধাপে লেখা, প্লিজ ক্লাইম্ব স্লোলি। সিলিং এত নিচু অর্চিষ্মানকে কুঁজো হয়ে উঠতে হচ্ছে। প্রতিবারের মতো রিফ্লেক্সে আমিও কুঁজো হয়ে গেছি তারপর মনে পড়েছে আমার কুঁজো হওয়ার কোনও দরকার নেই। ঘুপচি সিঁড়ি উজ্জ্বল, উচ্ছল গুহায় উন্মুক্ত হল। গমগমানি উপচে পড়ল। কানায় কানায় ভিড়। শক্তিশালী ভদ্রলোক গুহার ভ্যান্টেজ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নজর রাখছেন। অর্চিষ্মান দু’আঙুল তুলে সিটের অনুরোধ জানাতে হাসিমুখে পাঁচ আঙুল নেড়ে জানালেন জায়গা নেই। চোখে চোখে পরামর্শ সেরে পিছু ফিরছি, এক ভদ্রলোক অর্চিষ্মানকে ডাকলেন। সিঁড়ি আর গুহার দেওয়ালের মাঝখানে চিলতে জায়গায় টুলের সারি, সিঁড়ির রেলিংটা বেসিক্যালি একটু চওড়া করে গ্লাস রাখার জায়গা। ফুল প্লেট রাখারও জায়গা পাওয়া শক্ত হবে। ভদ্রলোক আর এঁর বন্ধু সে রকম দুটো টুলে বসে ছিলেন। বন্ধুর সাজপোশাক, হাবভাব পুরো বিগ লেবোস্কির ডুড। আর যিনি আমাদের থামালেন - মিনি হ্যাগ্রিড। ওঁরা নাকি পাঁচ মিনিট পরে চলে যাবেন। কাজেই ওঁদের টুলে আমরা বসতে পারি। শত 'না না' শুনলেন না, টুল ছেড়ে দিলেন। আমরা বসে পড়লাম। ওমা দেড় মিনিটের মধ্যে মেন বসার জায়গা থেকে এক জোড়া লোক উঠে গেল আর তাদের ছেড়ে যাওয়া গদি আঁটা চেয়ারে দুজনে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়লেন। তিন ঘণ্টা বাদে যখন বেরিয়ে আসছি তখনও ওঁরা ওঠেননি। আরও পাঁচজন বন্ধু জুটিয়ে ছাদ ফাটিয়ে হাসাহাসি করছেন। নির্ঘাত টের পেয়েছিলেন ভালো চেয়ারগুলো খালি হচ্ছে। অমনি আমাদের টুল ছেড়ে দিয়ে মহান হয়ে নিজেরা গদিআঁটা চেয়ার দখল করলেন।
যদিও টুল আমাদের পছন্দ। দুজনে একই দিকে ফেস করে থাকায় লোক দেখতে সুবিধে । এখন তাকিয়ো না, কিন্তু তোমার পেছনের টেবিলে যিনি বসে আছেন - এই সব করতে হয় না। অর্চিষ্মানের বিয়ার আমার জিন অ্যান্ড টনিক এসে গেল। ঝুড়িতে পপকর্ন।
টুলের আরও একটা সুবিধে, যেহেতু সিঁড়ির ওয়েলের ওপর বসে আছি, পৃষ্ঠপোষকদের স্যাম’স-এ প্রবেশপ্রক্রিয়ার প্রায় তিরিশ সেকেন্ড নিরবচ্ছিন্ন নিরীক্ষণের সুযোগ পাচ্ছি। ঔরঙ্গাবাদ ফোর্টেই সম্ভবতঃ এই চমৎকার ব্যাপার দেখেছিলাম। দুর্গে ঢোকার একটাই সরু সুড়ঙ্গ। এত সরু যে একবারে একজন করে যেতে পারে। সুড়ঙ্গের মাথা যেখানে শেষ হচ্ছে একটি পাথর আরামদায়ক চেয়ারের ভঙ্গিতে স্থাপিত। গাইড বলছিলেন এই চেয়ারে একজন বসে থাকতেন। সুড়ঙ্গ বেয়ে বিপক্ষের একজন করে সৈন্য মাথা তুললেই ঘচাং করে মুণ্ডু নামাতেন। থিওরেটিক্যালি, এ পক্ষের মাত্র একজন সেনানী অন্যপক্ষের গোটা সেনাদল এই প্রক্রিয়ায় সাবাড় করতে সক্ষম হতেন।
টুলে বসে গোটা স্যাম'স-এর প্যানোরামিক ভিউ পাচ্ছিলাম। কোন নেটিভ যুবকের মেমসাহেবের সঙ্গে জুটি বেঁধে হাসি থামছে না। তিন বন্ধুর মধ্যে থার্ড হুইল কোনজন। কোন আনস্মার্ট লোক স্মার্ট জামা পরে অস্বস্তিতে ভুগছে। অনেক বিচারবিবেচনার পর আমরা জামাকাপড় ভালো, না-ভালো দেখানোর, মানানো না-মানানোর দুটো ক্রাইটেরিয়া চিহ্নিত করেছি। এক, ফিট। দুই, ক্যারি করা। সব পোশাক মানিয়ে যায় যদি ফিট করে আর যদি পরিয়ের মনে খুঁতখুঁত না থাকে। এই দুই অবজার্ভেশন থেকে যে কনক্লুশন আমরা ড্র করেছি তা হল আমাদের দুজনেরই স্মার্ট জামা পরা অর্থহীন। কারণ সে সব জামা যদি ফিট করেও যায় সেগুলো পরে আমরা মনে মনে এমন আধমরা হয়ে ঘুরব যে আমাদের পাগলের মতো দেখাবে।
একটা টেবিলে দুটি মেয়ে দুটি ছেলে হাহাহিহি করছিল। আলাপ সম্ভবতঃ আজ সন্ধেরই। রাত ঘনাতে তারা উঠে কোথায় চলে গেল। গ্লাসের রিমের ওপর দিয়ে চোখাচোখি করলাম।
দেখাশোনা চলছিল আর মাথার মধ্যে একটা ভাবনাও। গাদাগাদি ভিড়ের নিভুনিভু বারে, কানফাটানো ইংরিজি বাজনার ব্যাকগ্রাউন্ডে রাত জেগে লোক দেখা - পাঁচ বছর আগেও যদি কেউ আমাকে বলত এটা আমার জীবনের মোটামুটি রেগুলার একটা আনন্দের উৎসে পরিণত হবে, নির্দ্বিধায় তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বলতাম।
অর্চিষ্মান বলল, কেমন লাগে ব্যাপারটা তোমার? এত দ্রুত, এতখানি বদলে যাওয়াটা?
লাগার কিছু নেই। আমার বেসিক্যালি কোনও আইডিয়াই নেই আমি কী রকম। আমার কীসে আনন্দ হয় কীসে দুঃখ সে বিষয়ে ধারণা জিরো। পাঁচ বছর পর এই আমিকে মনে করেও নির্ঘাত বিষম খাব।
অর্চিষ্মানও বদলেছে। ইদানীং দিনের পর দিন, রাতের পর রাত যে কাজ ও যেভাবে করে, চোদ্দ বছর আগে আমাকে বললে বিশ্বাস করতাম না। অর্চিষ্মান নিজেও বোঝে। একদিন চিরাগ দিল্লির সিগন্যালে অটোতে আটকে ছিলাম। ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স বা ফিল্ড একটা কিছু চলছিল ওর। সে ব্যাপারে বলতে বলতে অর্চিষ্মান বলেছিল, আজকাল অনেকসময়ই রিয়েলাইজ করি, ঘরের মধ্যে সব থেকে লাজুক লোকটা আর আমি নই। আমার থেকে মুখচোরা আরও অনেকে আছে।
কথাটা বলার সময় ওর মুখচোখের বিস্ময়টা ভুলব না। বিষণ্ণতাটাও।
তোমার তাতে মনখারাপ হয়?
না, তবে মনে হয় নিজের কোর পার্সোন্যালিটি হিসেবে যেটা চিনতাম সেটাই বদলে ফেললাম? আমার তো ওই আমিটাকে খারাপ লাগত না। আমার কি এই আমিটাকে ভালো লাগে?
আহা পুরোটাই যে বদলে গেছে তাও তো নয়। অনেক কিছু তো বদলায়ওনি। বেশিরভাগটাই বদলায়নি।
অবশ্য আজকাল সন্দেহ হয় কোর বলে আদৌ কিছু আছে কি না। হয়তো কোরটা ফাঁপা, পরিস্থিতি বুঝে একেকটা জামা গায়ে চাপাচ্ছি। সবাই চাপাচ্ছে। সবার দিকে তাকালে মনে হয় অ্যাকটর। কেউ কোনও কাজ ভালো করলে বুঝি লোকটা এই চরিত্রে ভালো অ্যাকটিং করছে। খারাপ করলে বুঝি খারাপ অ্যাকটিং।
এভরিবডি ইজ ফেকিং ইট টিল দে আর মেকিং ইট?
অ্যাবসোলিউটলি। তবে ভাবো এটা যেমন ভয়ের তেমন আশ্বাসেরও যে আমরা আসলে কোনও একটা রকম নই। চাইলে আমরা অনেক কিছু হতে পারি।
এত সোজা হলে আমি একটা পদস্থ কিছুর অ্যাকটিং করে উঠতে পারছি না কেন? হোয়াট ইজ রং উইথ মি? শরীরের ভেতর প্যানিক ফুলেফেঁপে বিপদসীমা ছাপাতে চায়। পেছনের বারের চেঁচামেচি বাঁচিয়ে দেয়। বার সামলাচ্ছেন একজন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলা। বকুনি দিচ্ছেন কাউকে।
সিঁড়ির দেওয়াল জুড়ে উইটি ওয়ানলাইনার, ক্যাচফ্রেজ। অ্যাম্বিশাস জনগণের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল। নামের পাশে নাম। যোগ বিয়োগ হৃদয় তীর। অর্চিষ্মান বলে, সঙ্গে পেন আছে? না থাকলে এদের কাছ থেকে পেন চেয়ে তোমার নাম লিখে রেখে যাও। বলি, লিখলে আমার নামের সঙ্গে তোমার নামও লিখব। তাহলে থাক বলে গ্লাসের তলানি গলায় ঢেলে, পপকর্নের শেষ গুঁড়ো আঙুল বুলিয়ে জিভে পৌঁছে অর্চিষ্মান বিল চায়।
মাঝরাত অনেকক্ষণ অতিক্রান্ত। রাস্তায় ভিড় বেড়েছে। পার্পল হেজ থেকে মানুষের স্রোত রাস্তার ভিড়ে মিশে যাচ্ছে। আমাদের ডিনার হয়নি। স্যাম’স-এ খেলেও হত কিন্তু অন্য একটা দোকান তাক করে রেখেছি। দুপুরে আসার সময়েই দেখেছিলাম। একফালি দোকান। নামেও কল্পনার অবকাশ নেই। স্যান্ডউইচ শপ। দুপুরেও দেখেছি, রাতে অর্চিষ্মানের সঙ্গে হেঁটে আসার সময়েও দেখলাম, দোকানের ভেতরের একটিমাত্র বেঞ্চি ঠাসাঠাসি সাহেবমেম। ভিড়টা পজিটিভ সাইন, সাহেবমেমটা নেগেটিভ। সাহেবমেমদের বিরুদ্ধে আমার কিছু নেই। শুধু এটাই যে ওঁদের প্যালেট আমার প্যালেটের থেকে আলাদা। কবীর সুমন এক জায়গায় বলছিলেন সাহেবরা আমাদের থেকে এত কিছু নিল, রান্নাবান্নাটা শিখল না। যাই হোক, আসার সময় অর্চিষ্মানকে দোকানটা দেখাতে ও-ও উৎসাহিত বোধ করেছে।
এত রাতেও স্যান্ডউইচ শপ খদ্দেরময়। যেটা ভালো সেটা হচ্ছে খদ্দেররা সবাই স্থানীয়। স্যান্ডউইচ মানে সাব। অর্চিষ্মান চিকেন সাব নিল, আমি মাশরুম। ভদ্রলোক টোস্টার থেকে সাব বার করে, চিরে, মেয়োনিজ গোছের কিছু বোলালেন, লেটুস ইত্যাদি রাখলেন, বন্ধ করে প্লাস্টিকের ব্যাগে পুরে আমাদের দিলেন। আমরা জিনিসটা এগরোলের মতো করে ধরে খেতে লাগলাম। দিল্লি থেকে আসছি শুনে ভদ্রলোক জানালেন উনি গুড়গাঁওতে অনেক বছর ছিলেন। সেক্টর…চোখ তিন সেকেন্ডের জন্য সিলিং ছুঁয়ে ফিরে এল… টোয়েন্টি ফাইভ। আরও তিনজন স্থানীয় লোক এসে স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলেন। একজন মাতাল দোকানের দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। দোকানি কৃষ্ণা! কৃষ্ণা! বলে হাঁকলেন, একটা ছেলে এসে হ্যাট হ্যাট করল। টাকা মিটিয়ে দোকানের বাইরে এলাম। মাতাল ভদ্রলোক পুরো যাননি, অল্প সরে গুটিসুটি মেরে রাস্তায় শুয়ে আছেন।
আবার হাঁটা। কোর আছে কি নেই সেই নিয়ে এত কথা হল, রাত জেগে শহরের ভিড়ে অর্চিষ্মানের সঙ্গে হেঁটে বেড়ানো আমার একটা কোর স্মৃতি। আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল একটি নির্ঘুম শহরে। তার রাস্তায় রাত জেগে আমরা অনেক হেঁটেছি। সিনেমা দেখেছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, ভিজে গোবর হয়ে কফিশপে ঢুকে রাস্তার ধারের টেবিলে বসে অন্যদের হাঁটতে দেখেছি।
হয়তো তাই হাঁটতে ভালো লাগে। তখনও লাগছিল। দোকান অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। এক হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের পাতা বন্ধ শাটারে ঠেস দিয়ে বেসবল টুপি, ব্যাগি টিশার্ট পরা অল্পবয়সী ছেলেরা ঢলঢলে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে হাঁকছে, চুরোওওওট চুরোওওওট।
হোটেলের দরজায় তালা পড়ে গিয়েছিল। টোকা দিতে লাউঞ্জের সোফায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা যুবক উঠে এসে দরজা খুলে দিলেন।
ঘণ্টাকয়েক পরেই অ্যালার্ম বাজল। অর্চিষ্মানের নিজের হোটেলের ঘরে সুটকেস ইত্যাদি এখনও রাখা। গিয়ে, সেগুলো নিয়ে চেক আউট করে আসবে। তখন আমিও এ হোটেল থেকে চেক আউট করে ট্যাক্সি বা বাস - এখনও ঠিক করিনি - ধরে নাগরকোট যাব। মুখ ধুয়ে, জামা পরে, আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরোল অর্চিষ্মান । দরজা খুলে গলা বাড়িয়ে টাটা করতে করতে ছাদের সমান হাই উঠল। হাই ফুরোতে হাঁ বন্ধ করে চোখ খুললাম। করিডরের কোণাকুণি বালিশবিছানার ওয়াড়ের ঢিপি হাতে কালকের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দেখছেন। এবার আর টেরিয়ে নয়, ড্যাবডেবিয়ে। অর্চিষ্মান লিফটে ঢুকে গেল, আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।
(চলবে)
Darun lekha. Ektana ek nis:swashe porlam. Porer porbo taratari asuk.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, সায়ন। আমিও চাই তাড়াতাড়ি লিখতে, তবুও দেরি হয়ে যায়।
Deleteচমৎকার লাগছে। কথাটা ভারী ভালো বলেছ, মানুষের কোর বলে কী আদৌ আছে? দশ বছর আগের আমি আর এখনকার আমির যা তফাৎ, নিজে দেখলে চমকে যাই। মনে হয়, কিছু জিনিস থাকে আসলে ওই কোর, কিন্তু তার প্রকাশটাও এতই আলাদা, কোর বলে চেনা শক্ত হয়ে যায়।
ReplyDeleteআর অর্চিষ্মানবাবুর মতো আমিও আলাদা পকেট রাখতেই পছন্দ করি। এক এক জায়গায় আমি একেক রকম, ডাল খোল অম্বল এক হয়ে গেলে মুশকিল লাগে।
-প্রদীপ্ত
থ্যাংক ইউ।
Deleteঅর্চিষ্মানবাবু এক এক জায়গায় এক এক রকম নন, সব জায়গায় মোটামুটি একই রকম, খালি জায়গাগুলো আলাদা আলাদা রাখতে পছন্দ করেন।
ইয়ে মানে ওটাই বলতে গেছিলাম।
DeletePorer porbota taratari publish korben please. Eta barabari rokomer bhalo laglo
ReplyDeleteধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ঈপ্সিতা। দেখা যাক আজ হয় কি না।
DeleteDaaarun lekha.. ki pleasant surprise.. hothat abantor khule eto bhalo beRanor golpo poRe mon bhore gelo. khub bhalo thakben - Indrani
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। আপনিও ভালো থাকবেন।
Deleteসাহেব মেম রা এখন আমাদের খাবার নিয়ে নিয়েছে পুরো। মাস কয়েক আগে ইংল্যান্ডের এক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করছি, এক ইংরেজ সাহেব ঢুকল একদল সুইস টুরিস্ট নিয়ে। তারপরেই ভাষণ শুরু হলো, বন্ধুগণ আমরা এখন ইংল্যান্ডের জাতীয় খাবার খেতে এসেছি চিকেন টিক্কা মশলা আর রায়তা সমেত দম বিরিয়ানি।
ReplyDeleteসে ভালোই করেছে। আমার জাতীয় খাবার বিনস অন টোস্ট হলে আমিও অন্যদের খাবার নিজের বলে চালাতাম।
Delete