আগের পোস্টের 'চলবে' স্থগিত রেখে নতুন একটা 'চলবে' চালাব। এটা শেষ হলে ওই ব্যাখ্যানে ফেরত যাওয়া যাবে।
ঝকঝকে প্ল্যাটফর্ম। সদ্য রং করা রেলিং, চাল, পাঁচিল। পাঁচিলে রংচঙে ছবি। তাঁর। হাঁটছেন। হাই তুলছেন। হাঁ করছেন। চোখ বুজে ঘাপটি মারছেন। চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখে সোজা চোখ রাখছেন। থাবা তুলছেন। দাঁত খিঁচোচ্ছেন। লাফ মারছেন। স্টেশনমাস্টারের ঘরের সামনে খড় বাঁশ বা ওই রকম কিছু সাসটেনেবল মেটেরিয়াল দিয়েও তাঁরই মূর্তি। আয়তনে আমাদের হুলোর বেশি বড় না কিন্তু তেজের লিগ আলাদা।
স্টেশন কম্পাউন্ডের বাইরে বোর্ডে ভেজা বেড়াল রাজনীতিক জোড়হাতে ভোটভিক্ষা চাইছেন, পার্টিপ্রতীকে তাঁর চোখ জ্বলজ্বলাচ্ছে, তিনি হুংকার দিচ্ছেন। গোলচক্করের ব্রোঞ্জ বীরপুরুষ - ছোট প্লাকে নাম পড়ার আগেই অটো সাঁ - হাতে খাটো তরবারি নিয়ে আর যেখানেই যান, তাঁর মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন না গ্যারান্টি। গোলচক্কর পেরিয়ে পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে যে দুজন বাইকারোহী অটোতে ধাক্কা মারতে মারতেও কাটিয়ে গেলেন - তাঁদের হলুদ ইউনিফর্মের পিঠেও তাঁরই কালো পাঞ্জার কিউট ধাপ্পা।
তিনি সর্বব্যাপী। সর্বময়। সর্বগ্রাসী। যেদিকে ঘাড় ঘোরাই, ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে রেডি হচ্ছেন। সেটাই হওয়ার কথা। এটা তাঁরই রাজ্য। তাঁকে দেখব বলেই তাঁর রাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছি। চরণসিংজির গাড়ি চড়ে চলেছি তাঁরই চরণে শরণ নিতে।
*****
গতকাল বিকেলে হজরত নিজামুদ্দিনে দেখা হওয়ার কথা ছিল, অর্চিষ্মান ফোন করে বলল, শোনো ভাবছি মাইন্ড চেঞ্জ করব। বাড়ি গিয়ে আবার আসব। অসুবিধে হবে?
পুরোটাই সুবিধে। দু'জনে মিলে স্টেশন যাওয়া যাবে। সেটুকু বোরও হতে হবে না।
আমি বাড়ি এলাম। অর্চিষ্মান বাড়ি এল। এসেই, 'টাকা তুলে আনি' বলে মোড়ের এ টি এম-এ দৌড়োল। উবার ভাইসাব এলেন। অ্যাপে মেসেজ পাঠালেন, আই হ্যাভ অ্যারাইভড। ফোন করলাম - দু'মিনিট দিন, ভাইসাব। বড়ি মেহেরবানি আপকি। দেড় মিনিটের মাথায় অর্চিষ্মান বাড়ি ঢুকল। গ্যাস গিজার চেক করে নিজের ব্যাকপ্যাক আর আমাদের একলওতা কেবিন সাইজ ট্রলি নিয়ে নেমে গেল। কুন্তলা, দরজাটরজা দেখে এসো। সিঁড়িতে পড়ে যেয়ো না। আমি বাঁ কানের দুলটা পরে, টিপটা এঁটে (পুরো মাঝখানে হল না কিন্তু সে রাস্তায় ঠিক করা যাবে, মাও আজীবন রবিকাকুর রিকশায় বসেই ঘড়ি পরেছেন) ফ্যানলাইট নিভিয়ে দরজায় চাবি দিয়ে হাফ সিঁড়ি নেমে আবার উঠে চাবি খুলে জুতো পরেই রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসের নবে আর একবার হাত বুলিয়ে দরজায় চাবি দিয়ে যে সিঁড়িটায় পড়ে পাঁজর ভেঙেছিলাম, সেটা হেঁটে বাকিগুলো দৌড়ে নিচে নামলাম।
মেন গেটের সামনে পায়ের কাছে সুটকেস আর হাতে ফোন নিয়ে অর্চিষ্মান। রাস্তা ফাঁকা।
কই গেল? ট্যাক্সি?
এখানেই নাকি ছিল। অর্চিষ্মান ট্যাক্সির দরজা খুলে সুটকেস পুরো আর নিজের মুন্ডু অর্ধেক সবে গলিয়েছে, অমনি নাকি ভাইসাব বলে উঠেছেন, ক্যান্সেল হো গয়া। অর্চিষ্মান 'ওহ্' বলে মাথা আর সুটকেস বার করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, ভাইসাব গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছেন। এখন অর্চিষ্মান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর একটা কিছু বুক করার চেষ্টায় আছে।
চলে গেছে মানে? আমি তো বললাম দাঁড়াতে। দু'মিনিট বলেছিলাম, মোটে . . . ফোন জ্বালিয়ে দেখলাম . . . প'নে তিন মিনিট হয়েছে।
গেছে তো গেছে, কুন্তলা। এ নিয়ে মেজাজ গরম কোরো না।
যেন আমার মেজাজের ঠাণ্ডাগরম ভালোখারাপ হওয়ার ওপর আমার কন্ট্রোল আছে। পরিষ্কার টের পাচ্ছি মগজের টেম্পারেচার বাড়ছে, ধোঁয়া বেরোবে বেরোবে করছে এমন সময় এ টি এম-এর পাশ দিয়ে অটো বাঁক নিল। দুজনে অটোতে উঠে পড়লাম এবং আবারও প্রমাণ হয়ে গেল - তখনও হয়নি রাদার, আসন্ন পাঁচ দিন ধরে প্রমাণ হবে, পুনঃপুনঃ হবে - দিনের পূর্বাভাসে মর্নিং ম্যাটার করে না।
*****
ছত্তিসগড় সম্পর্কক্রান্তি, নিজামুদ্দিন থেকে সন্ধে পাঁচটা পঞ্চান্নয় ছাড়বে, রাত পার করে সকাল সকাল উমরিয়া পৌঁছবে। আটনম্বরে ট্রেন দিয়ে দিয়েছে। বগি বি টু, সিট আটান্ন ঊনষাট। আর এ সি টিকিটের একটা সাত দিন, একটা দু'ঘণ্টা আগে কনফার্ম হয়েছে।
রাতভরের ট্রেনযাত্রা অনেকদিন পর। টিকিট কাটা হওয়ার পর থেকে এই রাতটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই রাত আমার আর রেলগাড়ির। আপার বার্থে রাতজাগা দুলুনির। অন্য রাতেরা যদি হইচইয়ের হয় এ রাত মুবির। অন্য রাতেরা যদি একেনবাবুর হয় এ রাত ব্রাদার উইলিয়াম অফ বাস্কারভিলের। অন্য রাতেরা যদি গোলগাপ্পার হয় এ রাত ফুচকার।
এই রাত নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে সব দাঁতভাঙা বই না পড়ে মরে গেলে বেঁচে থাকার কোনও মানেই থাকবে না, আইনিবেআইনি উপায়ে যাদের পাহাড় জমিয়েছি ফোনে, তাদের সব থেকে দাঁতভাঙাটার অন্ততঃ একশো পাতা শেষ করব।
কিন্তু এখন সবে বিকেল। বই পড়ার জন্য গোটা রাত পড়ে আছে। সবে তো চুয়াল্লিশ হল, বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য গোটা জীবন বাকি আছে। এত স্ট্রাগল করে ট্রেনে উঠলাম, আই ডিজার্ভ লাইট বিনোদন।
ইউটিউব শর্ট খুললাম। একজন এক্সপার্ট এসে বললেন কোন রকম কুর্তার সঙ্গে কোন রকম পাজামা আর কোন রকম পাজামার সঙ্গে কোন রকমের জুতো পরলে আপনাকে কেউ ভালোবাসবে না।
এক্স্যাক্টলি সেই তিনরকমের আইটেমেই গা থেকে পা ঢেকে রেখেছি। পাত্তা দিলাম না। কারণ আমি চুয়াল্লিশ। চুয়াল্লিশে অন্ততঃ এটুকু বোঝা হয়ে যায় ভালোবাসার সঙ্গে জামাকাপড়জুতোর কোনও সম্পর্ক নেই। কপালের আছে। চুয়াল্লিশে কার্যকারণের সম্পর্কটাও অনেকটা ক্লিয়ার হয়। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে তাতে এক্সপার্টের কিস্যু এসে যায় না। তিনি এত হাঙ্গামা করছেন পয়সা পাবেন বলে। আমিও পয়সা রোজগারের জন্য সিরিয়াস বিষয়ে হাবিজাবি মতামত দিই। সেগুলো যদি কেউ সিরিয়াসলি নেয় তার দায় যেমন আমার নয়, তেমনি ইউটিউবের কোন এক্সপার্ট কোন স্পনসরের ঘাড় ভেঙে কী মতামত দিচ্ছেন, সেই দেখেশুনে আমি আমার ভোল পাল্টালে সে সমস্যাও এক্সপার্টের নয়।
তিন নম্বর কারণটার সঙ্গে চুয়াল্লিশের সম্পর্ক নেই। ক্রিস্টোফার হিচেন্সের আছে। ক্রিস্টোফার হিচেন্স বলেছেন, পিকচার অল এক্সপার্টস অ্যাজ ইফ দে ওয়্যার ম্যামালস।
পরিচিত বললেন, খুব খারাপ বলেছেন। এক্সপার্টাইজের গুরুত্ব আছে। সেটা নিয়ে কারা হাসাহাসি করে দেখছ তো চারদিকে।
দেখছি। যোগ্যতাকে উড়িয়ে দিয়ে বানরসেনার হাতে লাঠি ধরানো সবার পক্ষে ব্যাড নিউজ। কিন্তু এই ধরণের সমস্ত সংক্ষিপ্ত প্রবাদেরই কন্টেক্সট থাকে। স্থানকাল থাকে। পাত্রপাত্রী বিচার থাকে।
আমার মতে হিচেন্সের এ বাণী এক্সপার্টদের নিয়ে যারা হাসছে তাদের জন্য নয়। অনেক বেশি তাদের জন্য, যারা এক্সপার্টদের দেখে কাঁপছে। অনেকের তো এক্সপার্টও লাগছে না। স্রেফ কাঁপছে। কেঁপেই যাচ্ছে। এক্সপার্ট, নো এক্সপার্ট। কাঁপছে কিংবা ভাসছে। যাদের অস্তিত্বের দুটোই অবস্থাঃ ইনটিমিডেটেড ও ইমপ্রেসড। ভয় আর মুগ্ধতা যাদের স্টেবল ইকুইলিব্রিয়াম। কেউ থেমে থেমে চিবুক চুমরে কথা বললেই যারা ধরে নেয় নির্ঘাত ঠিকই বলছে, কর্তৃপক্ষ জোরে কথা বললে যাদের কান্না পেয়ে যায়, টু এক্স স্পিডের স্পোকেন ইংরিজির সামনে যাদের আই গো ইউ গো গুলিয়ে যায়, মুহূর্ত আর নূপুরে হ্রস্ব দীর্ঘ-র অর্ডার ঠিক রেখেছে দেখলেই যাদের হৃদপিণ্ড ধকধকায় - তাদের জন্য হিচেন্স হেল্পফুল।
ম্যান্ডেটরি, অ্যাকচুয়ালি।
এ রকম একজনকে চিনি। তিনি আবার বাংলা মিডিয়াম। স্কুলে যে শব্দগুলো বাংলায় পড়েছিলেন সেগুলো মরে গেলেও ইংরিজিতে ভাবতে পারবেন না। বন্ধু চ্যাটবক্সে মেয়েকে এরিয়া আর পেরিমিটার পড়াচ্ছি রে লিখলে ইনি উত্তর দেন, ও আচ্ছা, ক্ষেত্রফল আর পরিধি? সারা পৃথিবী যে তেরছা লাইনটাকে হাইপোটেনিউস বলে ডাকছে তাকে ইনি অতিভুজ অতিভুজ করে চলেছেন। সবাই ইলন মাস্কের রকেট চড়ে মার্সে চলে গেলেও ইনি অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ কর্কট বিষুব মকরে পৃথিবী মাপবেন। হিচেন্স যতবার এক্সপার্টদের ম্যামাল ভাবার সুপরামর্শ দেবেন, এর মাথায় স্তন্যপায়ী আসবে।
তাতে কার্যকারিতা কমবে না। ইমিডিয়েটলি ব্লাডপ্রেশার নেমে আসবে, পেটের ভেতর বাটারফ্লাই হাই তুলে পাশ ফিরবে।
সাম্যদর্শনের এর থেকে ফুলপ্রুফ টোটকা আমি আর দেখিনি। একবার ভাবুন। স্টিফেন হকিং? স্তন্যপায়ী। দীপিকা পাডুকোন? স্তন্যপায়ী। বিদ্যাসাগর? স্তন্যপায়ী। যোগী আদিত্যনাথ? স্তন্যপায়ী। রবীন্দ্রনাথ রোদ্দুর, সত্যজিৎ সৃজিত - সবাই স্তন্যপায়ী। স্তন্যপায়ী, মেরুদণ্ডী, স্থলচর, দ্বিপদী, উষ্ণশোণিত।
সবাই বাঁদর। সবার চোদ্দহাজার পুরুষ বাঁদর।
*****
লাইট বিনোদনের ব্যূহ ভেঙে অর্চিষ্মান ঢুকে পড়ল।
ডিনারের ব্যাপারটা কী করবে? রাতে তো খাবার দেবে না।
কেন তোমার খিদে পেয়েছে?
রাতে পাবে কুন্তলা।
অনেক গুণের মধ্যে অর্চিষ্মানের এই একটা অবগুণ। মোমেন্টে বাঁচতে পারে না। পরে কী হবে সেই নিয়ে ভেবে চলেছে। আগামীর হাঁড়িকাঠে আজকের গর্দান নামাচ্ছে অবিরাম।
বললাম, রাতে খিদে পেলে রাতে দেখা যাবে। এখন তো সন্ধেও হয়নি।
অর্চিষ্মান বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল। তিন সেকেন্ড পর জানালার কাচে ভেসে উঠেছে। বি টু-র দরজার সামনেই খাবারের স্টল। স্টলের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা রোগা একটা ছেলে, টেকনিক্যালি লোক, আমার কাছে ছেলেই - নীল জিনস, গাঢ় নীল শার্ট। কিউ আর কোডের দিকে ফোন তাক করছে। হাত বাড়িয়ে দোকানির হাত থেকে কাগজের প্লেট নিচ্ছে। প্লেটে দুটো বোম্বেটে সামোসা, বুড়ো আঙুল দিয়ে কেচাপের প্যাকেট চেপে রাখা, এ হাতে একটা কুরকুরে একটা টেড়েমেড়ে।
উঠে গিয়ে স্প্রিং দরজা খুলে দাঁড়াই। অর্চিষ্মান সিটে লুটের মাল নামিয়ে রেখেই পেছন ফেরে। চা দুটো নিয়ে আসি। আমি বসে বসে সামোসা পাহারা দিই। আমার চা-টা মনে করে ফিকি বলেছে কি না ভেবে ভেবে অল্প অল্প টেনশনে ভুগি।
অর্চিষ্মান চা নিয়ে ফেরার পরপরই গাড়ি ছেড়ে দেয়। আমি অর্চিষ্মানকে বলি, টাইমে ছাড়ল কিন্তু। অর্চিষ্মান আমাকে বলে, একেবারে টাইমে, বল? যে সব সহযাত্রী একলা চল রে-র নীতি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন, ফোন কানে চাপেন। হাঁ, হ্যালো হ্যালো, বিলকুল টাইম পে ছুটি হ্যায়।
চা সবে শেষ হয়েছে, লাল জামা থেকে সিঙাড়ার সোনালি গুঁড়ো ঝাড়ছি, অর্চিষ্মান কুরকুরের প্যাকেটের মুখ দু'হাতে ধরে হ্যাঁচকা টান দেবে দেবে করছে এমন সময় এক ভদ্রলোক 'মিল চাহিয়ে? মিল চাহিয়ে?' করতে করতে নোটখাতা আর পেন নিয়ে এসে পড়লেন। অর্চিষ্মান টান মেরে কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়েছে। কেয়া মিলেগা ভাইসাব? ওনলি ভেজ, নো ননভেজ। অর্চিষ্মান অল্প দমেছে, পুরোটা না। দো ভেজ কর দিজিয়ে।
আমি বলছি, না না দো না, একটাই কাফি।
খিদে পেয়ে যাবে কুন্তলা। নিয়ে রাখো। দরকার না হলে খেয়ো না।
তিনবার সাধাতেও ঘাড় পাতলাম না। ভালো-কথা-বললে-শোনো-না-কেন মুখ করে অর্চিষ্মান একটা ভেজ থালি বলে দিল। ভদ্রলোক কূপের এদিকের বাকি চারজন, সাইড আপার লোয়ারের দুজনের মুখের সামনে মিল চাহিয়ে মিল চাহিয়ে করে নোটপ্যাড ঝাঁকাতে লাগলেন, সবাই সটাং না করে দিল।
নেহি। নোপ। নেভার। খেপেছেন? মরি আরকি। তাহলেই হয়েছে।
ভদ্রলোক নোটপ্যাড গুটিয়ে হাঁটা দিলেন। অর্চিষ্মান ঘাড় বাড়িয়ে যতদূর পারা যায় ফলো করল। তারপর শরীর ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, গোটা কামরায় একা আমিই মিল নিলাম নাকি গো?
বললাম, ভালো তো। রাত ন'টার সময় সবাই যখন খিদেয় পেট চেপে সম্পর্কক্রান্তির নোংরা মেঝেতে কাতরাবে, একা তুমি স্মাগ মুখে ফয়েল ছিঁড়ে মটর পনীর চিবোবে।
রাত ন'টায় অর্চিষ্মানের খাবার আসার আগে অন্ততঃ তেরোবার পোহা, বারোবার সামোসা ব্রেড পকোড়া, চোদ্দবার ইডলি দইবড়া, পনেরোবার আলুপরোটা, কুরকুরের প্যাকেটের মালা সারা শরীরে পেঁচিয়ে সতেরোজন ভাইসাব ঘুরে গেলেন। চা কফি টমেটো সুপ গুনতে বসলে দশ আঙুলের কর কম পড়বে। একে অপরকে সুপ খাওয়ার উৎসাহ দিতে দিতে আমরা চা খেলাম। আমার ডানদিকে ভাইসাব ইয়ারফোন ছাড়া ফুল ভলিউমে ইউটিউবের শর্ট স্ক্রোল করে চললেন, উল্টোদিকের মেয়েটা (টিটি টিকিট চেক করার সময় কান খাড়া রেখে জেনেছি নাম ভাবনা) ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে গেল, পাশের কুপের সাইড আপার লোয়ারে দুই প্রেমিক প্রেমিকা ব্রেড পকোড়া ভেঙে একে অপরকে খাইয়ে দিল, অর্চিষ্মানের পাশের সাইড লোয়ারের টুপি মাথায় তরুণ ফোনে পালা করে ক্লায়েন্টের ফ্ল্যাটে দরজা ইন্সটলেশনের এস্টিমেট দিল আর তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে বত্রিশ পাটি বার করে সিট থাবড়ে হাসল, ভাবনার মাম্মির ফোন এল, 'হাঁ হাঁ মাম্মি খা লেঙ্গে ওক্কে বাই' বলে ভাবনা সিরিয়ালে ফেরত গেল, এ দিকের ভদ্রলোক ভোজপুরি গান, চুটকি, বেড়ালের ম্যাও স্ক্রোল করে যেতে লাগলেন। এক প্রাণবন্ত পুরুষকন্ঠ বলে উঠলেন 'আপ অগর পরাঠা মে ঘি' . . .
আমার জেনুইন কৌতূহল হয়েছিল কিন্তু ভদ্রলোকের বোধহয় খাবারদাবারে ইন্টারেস্ট নেই, উনি স্ক্রোল করে নেক্সট শর্টে চলে গেলেন। অর্চিষ্মান ফিসফিস করে কুন্তলা ছোটবেলায় আমরা কেমন ট্রেনে করে বেড়াতে যেতাম, কেমন লুচি তরকারি খেতাম, কেমন বালিশ ফোলাতাম - স্মৃতিমেদুর হতে লাগল। দাদা সুপ সুপ করতে করতে গেলেন, আমরা আর এক কাপ করে কফি খেলাম, ভাবনার পাশের ছেলেটা (এর নাম ফাহাদ) রুকস্যাক থেকে আইপ্যাড বার করে টোকা মারতে লাগল, আমার ডানদিকের ফোনে ভারতবর্ষের সব বাড়িতে বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই যে নারীদিবস সেই চুটকি পেরিয়ে চেনা প্রাণবন্ত পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল - আপ অগর পরাঠা মে ঘি - আমার শরীরের সব রন্ধ্র টানটান - ভদ্রলোক স্ক্রোল করে পরের রিলে চলে গেলেন।
ধুত্তেরি বলে আপার বার্থে উঠে পড়লাম। অর্চিষ্মানের খাবার এসে গেল।
এখনও টাইম আছে কুন্তলা। অনেকটা দিয়েছে। হাফ হাফ করে খাই।
থ্যাংকস বাট নো থ্যাংকস। ওদিক থেকে ভাবনাও আপার বার্থে উঠে পড়েছে। শুয়ে শুয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছে। খাওয়া সেরে হাত ধুতে যাওয়ার আগে অর্চিষ্মান আমার কানে ফিস ফিস করল। মটর পনীরটা ভালো ছিল, মাঝরাতে খিদের চোটে ঘুম ভাঙবে যখন বুঝবে।
*****
মাঝরাতের আগেই ভাঙল। এগারোটা নাগাদ। সম্ভবতঃ ঝাঁসিতে গাড়ি থেমেছিল। ততক্ষণে সব আলো নিভে গেছে। যে যার বার্থে চড়ে কম্বলের নিচে ফোন দেখছে। এমন সময় কুপের নিস্তব্ধ অন্ধকার চিরে "সামোসে! সামোসে!"
গোটা বি টু খলবল করে উঠল। খলবল খচমচ খসখস। কম্বলের ভাঁজ থেকে বিসলেরির বোতল ধুপধাপ পড়ছে। ভাইয়া ভাইয়া আর্তনাদ। কিতনা করকে? এক প্লেট মে কিতনে পিস? আমার নিচের বার্থ থেকে বাংলায় কে যেন বলছে, কুন্তলা জেগে আছ? সিঙাড়া খাবে? ওপাশের আপার বার্থে কম্বল ফুঁড়ে ভাবনার ছায়া উঠে বসেছে। গরম হ্যায় না, ভাইয়া? নিচ থেকে আবার বাংলা। গরম আছে বলছে কুন্তলা, খাবে নাকি?
এর পর সত্যিই আর গোলযোগ হয়নি। দু'টো সাতচল্লিশে ঘুম ভেঙে চারটে তিন পর্যন্ত জেগে আকাশপাতাল ভাবাটা বাদ দিলে সলিড ঘুম। মাঝখানে দু'বার আপ অগর পরাঠা মে ঘি শুনতে পেয়েছিলাম মনে হল। স্বপ্নেও হতে পারে।
*****
কফির ডাকে ঘুম ভাঙল। বার্থ থেকে হাত নামিয়ে হাওয়ায় হাতড়াতে চেনা নাক।
কফি খেতে খেতে কাটনি এসে গেল। দরজাব্যবসায়ী মাথার টুপি ভালো করে এঁটে নেমে গেলেন। লাফ দিয়ে ওঁর সাইড লোয়ারের দখল নিলাম। জানালার বাইরে ভারতবর্ষের ভিউ। লাইনে চাকায় ঝমঝম ধমধম ঝড় তুলে সম্পর্কক্রান্তি ছুটছে। মল্লিকার্জুন মনসুর নাকি এত স্পিডে তান করতেন রেওয়াজের জন্য তবলিয়া পাওয়া যেত না, কাজেই ওঁকে সুপারফাস্ট ট্রেনের কামরায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ঝড়ের লয়ে পালটা প্র্যাক্টিস করতে হত।
কাটনি গেল। চান্দিয়া আসছে। এর পর উমরিয়া আসবে। নাম শুনলেই নেমে পড়তে ইচ্ছে করে, দেখলে তো করেই। নিচু প্ল্যাটফর্ম, উৎসুক নেড়ি, পত্রহীন পলাশ। অর্চিষ্মানের মতে জায়গার নাম দেওয়াতে ওডিশা আর মধ্যপ্রদেশ দেশের মধ্যে ফার্স্ট। ওঁদের ফুলবনি, কোরাপুট, চিকিটি, ভদ্রক, ভিতরকণিকা, ময়ূরভঞ্জ। এঁদের ঝাবুয়া, খান্ডওয়া, মান্ডি, রেওয়া, বেতুল, বিদিশা।
আমার মায়ের প্রিয় জায়গা, বা জায়গার প্রিয় নাম ছিল ঝুমরি তিলাইয়া। ঝুমরি তিলাইয়ার নাম মা প্রথম শুনেছিলেন রেডিওতে অনুরোধের আসরে। শেষে এমন হয়েছিল গানের থেকেও মায়ের অপেক্ষা থাকত ঝুমরি তিলাইয়া থেকে গানের ফরমায়েশের। ঝুমরি তিলাইয়া মাকে হতাশ করেনি, রোজ কোনও না কোনও গানের অনুরোধ আসতই। ভাবা যায়? এই ভারতবর্ষের মধ্যে একটা জায়গা, সত্যিকারের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশওয়ালা, যার ঝুমকো দুলের মতো নাম আর যেখানকার লোকেরা রোজ অনুরোধের আসরে চিঠি লেখে ?
মা কোনওদিন ঝুমরি তিলাইয়ায় যাননি। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল? জানি না। কী করছ কী খাচ্ছ-র ভিড়ে এই সব জরুরি খবরগুলো নেওয়া হয় না। সময় চলে যায়। গত কয়েক বছর ধরে উত্তরটা গেস করার চেষ্টা করছি। আপাততঃ একরকম উত্তরে এসে পৌঁছেছি। কারণ মায়ের একটা প্রিয় কবিতার কথা মনে পড়েছে। সে কবিতার দুটো লাইন মা প্রায়ই বলতেন।
Enough if in our hearts we know/ There's such a place as Yarrow.
হৃদয়ে থাকাটাই এনাফ। হইহই করে সশরীরে চড়াও না হলেও চলে।
আমাদের সবারই ইয়ারো থাকে। যার যার নিজের ঝুমরি তিলাইয়া। আমারও আছে। ভারতবর্ষের মধ্যেই আছে। যে জায়গাটায় আমি কোনওদিন যাব না। নামও বলব না কাউকে।
*****
উমরিয়া এসে গেছে। আমরা নেমে পড়েছি। চরণসিংজির অটোতে চড়ে চলেছি। বত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা, চরণ সিংজি বচন দিয়েছেন পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কভার করবেন। আমরা পেছনের সিটে এলিয়ে আকাশবাতাস দেখব। ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া চুলে জট পড়াবে, চশমার ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে বিঁধে নোনা জল বার করে আনবে, তবু আমরা, ব্রেভ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, ভাইয়োঁ অর বহেনজিয়োঁ - সে হাওয়ার ঝাপটের মুখে চোখ, যত সরু করেই হোক না কেন, খুলে রাখব। দ্রুত সরে সরে যাওয়া উমরিয়াকে দেখব। ভোরের উমরিয়া, পরিপাটি উমরিয়া। একতলা বিশ্রামগৃহ আর দোতলা অধিকারী কার্যালয়ের উমরিয়া। কালেক্টর'স বাংলোর বিস্তৃত বিশ্রান্তির উমরিয়া। পাগড়ির ডিজাইনের চুড়োওয়ালা ছোট্ট শিবমন্দিরের উমরিয়া। কালভার্ট আসবে, নাকি টোলবুথ মনে নেই, গুমটি থেকে মাথায় ফেট্টি পাকানো গোঁফ বৃত্তাকার ভদ্রলোক বাঁশের এদিকের দড়ি টেনে ধরবেন, ওদিকটা উঠে গিয়ে আমাদের যাওয়ার অনুমতি দেবে। মেরা বচপন কা সাথি। চরণসিংজি আমাদের বলবেন। দূরে উঁচু আলপথে হলুদ, লাল, বেগুনি, রানি রং শাড়ির লাইন। মাইলফলকের ওপর ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে কলাবিনুনি স্কুলবালিকা। বুকের বোতামখোলা বাইক বুলেটের মতো পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। চরণসিংজি বিচক্ষণ মাথা নাড়বেন। দেখা? হেলমেট ভি নেহি হ্যায়। অর্চিষ্মান বিবেচক কণ্ঠে সংগত দেবে। কেয়া বতায়েঁ ভাইসাব। আমি চুপচাপ থাকব। ও রকম চুল থাকলে আমিও হেলমেট পরতাম না।
অর্চিষ্মানের দিকে কালো ডালে কমলা পলাশ। আমার দিকের নীল আকাশে ছায়া ছায়া টেবিলটপ। ক্ষেতে হাঁটুদৈর্ঘ্যের ফসলের মাথায় হাওয়া।
গেহুঁ?
ইসকো সর্সোঁ বোলতে হ্যায় ম্যাডাম।
দূরে আর্চ গেট ওয়েলকাম টু বান্ধবগড়। লেখার দু'পাশে তাঁর সন্দেহজনক প্রসন্নমুখ।
ফাঁকা জমি ফুরোয়। পলাশের কমলা কমে। শালের ধূসর ঘন হয়। মাঝে মাঝে ফর্সা অর্জুন। দেখলে! দেখলে! আমি অর্চিষ্মান একে অপরের কবজি চেপে ধরি। দৌড়ে রাস্তা ক্রস করল হরিণ। হনুমানের হোল ফ্যামিলি রাস্তা লরি আটকে বাদামভাজা ট্যাক্স আদায় করছে। বিকট ভটভট ছাপিয়ে শালীনতা না পেরিয়ে চরণসিংজির কানের যথাসম্ভব কাছে মুখ এগিয়ে চেঁচায় অর্চিষ্মান। আপনে তো জরুর দেখা হোগা, সিংজি?
অর্চিষ্মানের নাদান প্রশ্নে চরণসিংজির চোখেমুখে বেনেভোলেন্ট হাসি ফোটে। দেখতে হি রহতেঁ হ্যায়, ভাইসাব। মেন রোড পে চার চার দেখে হ্যায়ঁ। অর্চিষ্মান নার্ভাস হাসে। বাপরে। শালের বড় বড় পাতা ছেঁকে রোদ্দুর মাটিতে পড়ে। অর্ধেক পাতা লাল হয়ে গেছে। আর এক মাসের মধ্যে বাকি সবুজগুলোও লাল হয়ে ঝরে যাবে। তারপর রিবুট। নতুন সবুজ পাতা বেরোবে।
ডানদিকে ছড়ানো কম্পাউন্ডে হলুদ বাড়ি। কপালে কালো হরফে 'টিকিট কাউন্টার'। ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলতে অনলাইন সাফারি বুকিং করতে ভুলে গেছি। এখানে লাইন দিয়ে টিকিট কিনতে হবে।
মিল যায়েগা না?
চরণসিংজি আশ্বাস দেন। মিলবে তো বটেই। টিকিট ভি। দর্শন ভি।
Jaak. finally eshe porle. onek din opekhaye chhilam notun jaigar.
ReplyDeletedekha pele ki na jani na...tobe amaar ei shob jongol gulo gele mone hoy ora achhe, nishchoi achhe.
অর্পণ, দেখা পেলাম কি না সেটা এখনই কনফার্ম করছি না, কিন্তু অন্য একটা কথা বলি। বান্ধবগড়ের তিনটে কোর জোনের একটা হচ্ছে তালা। তালার গেট দিয়ে বেরোনোর মুখে একটা বোর্ড আছে। বোর্ডে তাঁর ছবি দিয়ে লেখা আছে "পারহ্যাপস ইউ মে নট হ্যাভ সিন মি, বাট ডোন্ট বি ডিস্যাপয়েন্টেড। আই হ্যাভ সিন ইউ।" আই হ্যাভ সিন ইউ-টা বোল্ডে।
Deleteওঁর মতো চেহারার লোককে তো সবাই দেখবে, লাইন দিয়ে দেখবে। কিন্তু ওই চেহারা নিয়ে উনি যে আমার মতো চেহারার লোকের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছেন সেটা বেশি রোমহর্ষক না?
ট্রেনে রাত কাটানো অনেকদিন হয়ে গেলো করা হয়নি। পড়তে পড়তে মিস করছিলাম।
ReplyDelete"দু'টো সাতচল্লিশে ঘুম ভেঙে চারটে তিন পর্যন্ত জেগে আকাশপাতাল ভাবাটা বাদ দিলে সলিড ঘুম" - দারুন।
পরের অংশগুলো আসুক।
হ্যাঁ, ভালো লাগল বেশ, রাজর্ষি। তবে অসুবিধেও অনেক আছে। কিউট করে লিখেছি বটে কিন্তু এই ইয়ারফোন ছাড়া মোবাইল শোনাটা জাস্ট নেওয়া যায় না। অথচ ভারতবর্ষের সর্বত্র।
Deleteবাথরুমে যাওয়ারও চেষ্টা করিনি। করলে কী হত কে জানে।
ইয়ারফোন ছাড়া রিল সহ্য করেছ যখন তুমি সাধনার চূড়ান্তে পৌঁছেই গেছ। আমি আজকাল সোজাসুজি বলিই, কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনুন। কাজ হয় বা হয়না, কিন্তু বুকের মধ্যে কিছুই করলাম না ভাবটা বন্ধ হয়।
ReplyDeleteবান্ধবগড় যাবার ইচ্ছে আছে অনেকদিন। বাঘ দেখলে বা না দেখলে। জঙ্গল ব্যপারটাই এত ভাল্লাগে।
সহ্য করেছি কারণ ভয় পেয়েছি। যাচ্ছেতাই অপমান করে দেবে। আর উল্টো অপমান আমি করতে পারব না, ঝেড়ে ফেলতে তো আরওই পারব না। নেক্সট বারোঘণ্টা ও জিনিস গায়ে মেখে বসে থাকার থেকে বারো ঘণ্টা পরাঠা মে ঘি শোনা বেটার।
Deleteআমার ভূবনে স্বাগতম
ReplyDeleteআপনাকেও অবান্তরে স্বাগত জানাই, রূপম।
Delete