বান্ধবগড় ২ঃ জঙ্গল জঙ্গল পতা চলা হ্যায়


এমন কোথাও থাকতে পারবে যেখানে বাজার বলতে বড় রাস্তার এদিকে একটা গন্নে কা জুসের ঠেলা, ওদিকে ফালুদার, হাবিব খানের চিকেন এবং (অ্যান্ড নয়) মাটন সেন্টার আর বান্ধবগড় রয়্যাল স্টেশনারি স্টোরস?

রয়্যাল ইজ ওপেন টু ইন্টারপ্রিটেশন। চারটে দোকানই ছ’টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।

পুলিস শুনেছি এমন কোনও প্রশ্ন করে না যার উত্তর পুলিসের অলরেডি জানা নেই। যদি পুলিস আপনাকে জিজ্ঞাসা করে কাল রাত দশটা চার থেকে দশটা সাতের মধ্যে কোথায় ছিলেন, তাহলে শিওর হতে পারেন যে নামধাম কন্ট্যাক্ট নম্বর এমব্রয়ডারি করা যে রুমালটা সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা ডেডবডির পাশে ড্যাবড্যাব করে পড়ে ছিল। সিসিটিভি খারাপ ছিল তো কী হয়েছে, পাশের বাড়ির ফুড ব্লগার ভন্টু মাকে ঘামিয়ে ঠাকুরবাড়ির টেংরি রাঁধিয়ে, সে টেংরিতে কামড় বসানোর সময় ক্যামেরার কোণায় আপনাকে স্পষ্ট দেখা গেছে। ভিকটিম দুই হাত তুলে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করছে আর আপনি ছোরা নিয়ে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ছেন। ভিকটিম ফ্রেমের বাইরে চলে গেছে কিন্তু আপনি আছেন। আপনার ছোরাও। নামছে আর উঠছে। আবার নামছে। নিজের ফিংগার প্রিন্টটিন্ট শুদ্ধু ছোরা (বেরোনোর সময় তাড়াহুড়োয় গ্লাভস খুঁজে পাননি সে দায় পুলিসের না) ফেলে আসার সময় জানালা দিয়ে ভন্টুর মায়ের হাতে ধরা ক্যামেরা দেখে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় আঙুল তুলে ভিক্টরি দেখিয়েছিলেন - সব ফুটেজ পুলিস থানায় গোল হয়ে বসে দেখেছে।

রুমাল, ছোরা, ভিক্টরি সাইন - সব পুলিসের পকেটে। ডি এন এ টেস্টের রেজাল্ট এল বলে।

আমি যখন অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলাম, এমন কোথাও থাকতে পারবে যেখানে বাজার বলতে বড় রাস্তার এদিকে একটা গন্নে কা জুসের ঠেলা, ওদিকে ফালুদার, হাবিব খানের চিকেন এবং (অ্যান্ড নয়) মাটন সেন্টার আর বান্ধবগড় রয়্যাল স্টেশনারি স্টোরস? রয়্যাল ইজ ওপেন টু ইন্টারপ্রিটেশন? চারটে দোকানই ছ’টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়?

অর্চিষ্মানের উত্তরটা অলরেডি জানতাম।

না বস্‌। পাগল হয়ে যাব।

অর্চিষ্মান যখন আমাকে প্রশ্নটা উল্টে করল, ও-ও আমার উত্তরটা জানত। আমি পারব। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে, নাহ্‌ আখের রসে রুচি নেই, ফালুদা খেতে পারি। খেয়ে রয়্যাল থেকে নতুন খাতা আর কালির দোয়াত কিনে, বলেছিলেন যে শরদিন্দুবাবুর ব্যক্তিগত চিঠির সংকলনটা আনিয়ে দেবেন? তারপর শালবনের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। অপেক্ষকৃত পরিষ্কার পলাশ কুড়িয়ে খোঁপায় গুঁজে, অপেক্ষাকৃত কম নোংরা শালপাতার কোণা কামড়াতে কামড়াতে ভাবব কতদিন অর্চিষ্মানের হোয়াটসঅ্যাপ ...

আর শালগাছের আড়াল থেকে বাঘ লাফ দিয়ে তোমার ঘাড়ে পড়বে।

বান্ধবগড়ে নাকি বাঘ লিটারেলি গিজগিজ করছে। বান্ধবগড়ে গিয়ে যারা বাঘ দেখতে পায়নি সাফারিতে হান্ড্রেড পার সেন্ট ঘুমোচ্ছিল।

হোটেল বুক করার সময় কোন ঘরে কী অ্যামিনিটিজ ইত্যাদি বাছাবাছির সময় অর্চিষ্মান অধৈর্য হয়ে বলেছিল, ও সব ছাড়ো কুন্তলা, কোন ঘর থেকে বাঘ দেখতে পাওয়া যাবে সেটা লিখেছে কি না বল।

লেখেনি। সে হয়তো বিনয় করেছে। যারা অথেনটিক দেমাকি তারা নিজের কথা অত ফলাও করে বলে না। কম দামের ঘরগুলো থেকে হয়তো গ্লিম্পস দেখা যাবে। সবুজ পাতায় হলুদ ঝলক। তার ওপরের টিয়ারে ঘরের জানালায় টোকা দিয়ে হাই বলবে। তার থেকেও ওপরের টিয়ারে? দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজাবে। গলায় বো-টাই, হাতের ট্রে-তে ভেজ পকোড়া, চায়, চিনি অলগ সে। আমরা যতক্ষণ খাবদাব, দরজার বাইরে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমাদের ভেজ পকোড়া শেষ হলে নন ভেজ পকোড়া খাওয়ার আশায়।

হোয়াইট টাইগার লজের ছ’নম্বর কটেজে আমাদের বুকিং। পর্দা সরালে কাঁচ, কাঁচের ওপারে জঙ্গল। শাল পলাশ অর্জুন, ফাঁকে ফাঁকে মহুয়া, আবশ্যিক অশ্বত্থ।

অর্চিষ্মান পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। অনেক বড় বড় গাছওয়ালা বাড়িতে থাকতে কেমন লাগবে? প্রেফারেবলি একতলা। আচ্ছা দোতলা অ্যালাউ করা যাবে, ব্যস। বারান্দা। বারান্দায় আমি আর তুমি। তুমি আর আমি। আমাদের ঘিরে গাছ। উঁচু উঁচু, ঝাঁকড়া, বুড়োর হদ্দ, বাকলফাটা। এমন একটা বাড়ি, আমরা আসার আগেও যে বাড়িতে গাছেরা ছিল, আমরা চলে যাওয়ার পর যে বাড়িতে যে গাছেরা থাকবে। This is not our world with trees in it. It's a world of trees, where humans have just arrived. -- Richard Powers, Overstory

আমি জানি কেমন লাগবে। সে রকম একটা বাড়িতে আমি বড় হয়েছি। বুড়োও হচ্ছি। যদিও টানা থাকা হয় না। কিন্তু আমার  পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস ওটাই। একটাই ক্যাচ, বাড়িটা আমার নয়। যদি কখনও আমার হয়, আমরা একটা গাছওয়ালা বাড়ি ছপ্পর ফুঁড়ে পেয়ে যাব। কিন্তু সে সব অনেক দূর। ঘোর বাস্তব। সে বাস্তব জুড়ে মিউটেশন, এন ও সি, ফেয়ার ইভ্যালুয়েশন, সেল ডিড।

বিন্ধ্য আর সাতপুরা পর্বতমালার ফোঁকরে গোঁজা প্রাচীন ও ঝিলমিল জঙ্গলের দিকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকার মুহূর্তটাতে অর্চিষ্মান বা আমি - কেউই বাস্তবের পেরেক বেঁধাতে চাইছিলাম না। গাছ, বাড়ি, পোলাও, ঘি - সবই স্বপ্নের।

*****

স্বপ্নটপ্ন দেখা পরিশ্রমের কাজ। খিদে পেয়ে যায়। রেস্টোর‍্যান্টের দিকে গেলাম। কটেজগুলো উঁচু পিলারের ওপর। মাজুলিতে বাঁশের ওপর বাঁশের কটেজে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এ সম্পূর্ণ আধুনিক। কংক্রিটের ফুটপাথ কটেজদের জুড়ে রেখেছে।

দশটা বেজে গেছে। ব্রেকফাস্ট বুফে শেষ। কিন্তু এম পি টুরিজমের সব জায়গায় আতিথেয়তা টপ নচ। খিদে পেয়েছে বললে দেওয়ালে সাঁটা ব্রেকফাস্টঃ সেভেন টু টেন লেখা নোটিসের দিকে আঙুল দেখিয়ে তারপর কবজিতে টোকা মেরে ঘড়িতে দশটা তিন বেজে গেছে - পয়েন্ট আউট করবেন না। বিনয়ী গলায় জিজ্ঞাসা করবেন, কী খাবেন বলুন।

কী পাওয়া যাবে?

ভারতবর্ষের যে কোনও সেলফ-রেসপেক্টিং ব্রেকফাস্টে যা পাওয়া যাওয়া উচিত। ব্রেড অমলেট, পুরি, পরাঠা, আলু ভাজি। আর অফ কোর্স, পোহা। মধ্যপ্রদেশের মেনুতে পোহা না থাকলে উইয়ার্ড।

মধ্যপ্রদেশের পোহা এবং অন্যান্য খাবারদাবার নিয়ে বক্তব্য আছে আমার, সেটা পরের পোস্টে হবে, এখন ব্রেকফাস্ট শেষ করতে হবে কারণ টিকিটের লাইন দিতে হবে। অর্চিষ্মান পোহা বলল আমি পরোটা। পরোটা নিমিত্ত মাত্র, আমার লক্ষ্য আলুর তরকারি। জাগাজাগা আর কাদাকাদার মাঝামাঝি মাখোমাখোর টানটান দড়ি ধরে আর্টিস্টের অনায়াস হেঁটে যাওয়া। উত্তরপ্রদেশে যেমন জিলিপির সঙ্গে দই, এঁদের তেমনি চিঁড়ের পোলাওয়ের সঙ্গে জিলিপি। অর্চিষ্মান বলল, জিলিপি না খাও, পোহাটা টেস্ট করে দেখো। বলে হাফ প্লেট পোহা আর দুটো জিলিপি আমার পাতে ট্রান্সফার করল। পোহা খেতে খেতে পিসির কথা মনে পড়ল, সেবকসংঘ মাঠ, মাঠের ধারে গোলপোস্ট, গোলপোস্ট ধরে দোল খেতে গিয়ে বাবার কাঁধে বিষম ব্যথার কথা।

বাবাকে ফোন করলাম।

কফি এল। ফাঁকা ডাইনিং হলের কোণার টেবিলে দোকা বসে আছি। অর্চিষ্মানের দিকটা রোদ, আমার দিকটা ছায়া। জীবনের চারশো চৌষট্টি রকম জ্বালার কোনওটার আঁচ গায়ে লাগছে না। অর্চিষ্মান সম্ভবতঃ মজার কথা বলছে কারণ ওর মুখটা হাসি হাসি, কিন্তু আমার কানে কিছু ঢুকছে না। দুঃখ নেই। তার জায়গায় একটা ভয় বুকের ভেতর হানিসাক্‌ল মিসলটো-র মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।

কার জানি না, যারই হোক, যার জীবনে চুরি করে ঢুকে বসে আছি - এক্ষুনি কেউ দু'গালে দুটো চড় মেরে সে জীবন থেকে আমাকে হিড়হিড় করে বার করে নিয়ে যাবে। বলবে, কী ভেবেছিলি, কেউ টের পাবে না?

*****

কফি শেষ করে, কাউন্টারে চাবি জমা দিয়ে, হাবিববাবুর চিকেন এবং মটন সেন্টার, রয়্যাল স্টেশনারি, আখের রস ও ফালুদার ঠেলা, মেন রাস্তার দু'পাশের পাঁচিলে শেরখানের একশো আট অবতারের রংচঙে পোর্ট্রেট পেরিয়ে টিকিট কাউন্টারের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।

যারা গুছিয়ে সব কাজ করে তারা অনলাইন সাফারি বুক করেই বাড়ি থেকে বেরোয়। গুছিয়ে বা অগুছিয়ে কোনও রকম কাজই করি না, ক্যান্ডি ক্রাশ খেলি, তাই ও সব করা হয়নি। করতে যে হবে সে কথা মাথাতেও আসেনি। যতক্ষণ না বেরোনোর আগের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরে অর্চিষ্মান ফোন করে বলল, কুন্তলা সাফারির কী হবে?

আমি বললাম, কী আবার হবে? কিছু একটা হবে।

অর্চিষ্মান বলল, না হওয়ালে জীবনে কিছু হয় না, কুন্তলা। হওয়াতে হয়। তুমি আজ সেটা হইয়ে ফেলো।

ওয়েবসাইটে সব সাফারি বুকড দেখাল। হোটেল থেকেও ক্যান্টর সাফারি হয়। ফোন করলাম, সিট নেই।

গলায় বেচারা ভাব ফুটিয়েছিলাম। কী হবে? এতদূর থেকে গিয়ে বাঘ দেখা না হোক, বাঘ দেখার অ্যাটেম্পটও নেওয়া হবে না?

ভদ্রলোক বললেন, জিন্দেগি মে নেহি হোগা বলে কুছ নেহি হোতা, ম্যাডাম। এসে পড়ুন, কুছ না কুছ হো যায়েগা।

চেক ইন করার সময় চিনতে পেরেছিলেন। খাতার পাতা উল্টে মাথা নেড়েছিলেন, উঁহু, সাফারির সিট একটাও ক্যান্সেল হয়নি। কাউন্টার থেকে সশরীরে টিকিট কিনে ঢুকতে হবে। কাউন্টার খোলে দেড়টায়। তা বলে একটা পঁচিশে যাবেন না আবার। সাড়ে বারোটায় গিয়ে লাইন দেবেন।

কফি খেতে খেতে অর্চিষ্মানকে বলেছিলাম, চরণসিংজি যে বললেন সাড়ে দশটা থেকে লোকে লাইনে দাঁড়ায়? কনফিউজিং।

কনফিউশনের কিছু নেই, অর্চিষ্মান কফির সঙ্গে আসা চিনির বাটি থেকে এক চামচ চিনি মুখে ছুঁড়ল, আমরা সাড়ে এগারোটা থেকে লাইনে দাঁড়াব।

*****

সাফারির টিকিটের লাইন দেওয়ার অভিজ্ঞতা কাজিরাঙায় আছে। নট আ প্লেজেন্ট ওয়ান। আমরা আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকব, আড়াই মিনিট আগে লোকে এসে লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে। হয় আগে থেকে লোক দাঁড় করানো ছিল, নয়তো ভেতরে দাদা আছেন।

আমরা কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে এগারোটায় লাইনে দাঁড়ালাম। আমাদের আগে চারপাঁচজন। লাইনের সামনে উঁচু বারান্দায় চেয়ারটেবিল। সেই টেবিল থেকে দুপুর দেড়টায় টিকিট বিক্রি শুরু হবে।

অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা তুমি হোটেলে চলে যাও।

হোটেলে গিয়ে কী করব?

শুয়ে থাকবে। চাকফি কিছু একটা আনিয়ে টিভি চালিয়ে ক্রাইম পেট্রল দেখবে। বেড়াতে এসে এই গরমে লাইনে দাঁড়ানোর তো দরকার নেই।

ব্যাখ্যা করতে হল যে লাইন দেওয়াটাও বেড়ানোরই অঙ্গ। নর্ম্যাল সারক্যামস্ট্যান্সে তো আমি আর অর্চিষ্মান কোথাও গিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি না। তাছাড়া এ তো হাওড়া যাব বলে রিষড়ার টিকিট কাউন্টারে লাইন দেওয়া নয়। কিংবা রিষড়া ফিরব বলে হাওড়ার। লাইনের অন্তে এমন একটা কিছু পাব যার আমাদের যুগ্ম জীবনের টপ ফাইভ রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার একটা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

বুঝেছি কুন্তলা, যা প্রাণে চায় কর, বলে অর্চিষ্মান জোম্বি মেরে টাউনশিপ পত্তন করতে গেল, আমি আকাশবাতাস দেখতে লাগলাম। লাইন দিতে হলে বান্ধবগড়ের টিকিট কাউন্টারেই দেওয়া উচিত। আকাশভরা গাছ। গাছভরা পাখি আর বাঁদর। আপাতত শান্ত, পরিস্থিতি বদলালে অশান্ত হয়ে উঠবে কি না জানি না। চিতোরে অর্চিষ্মান আমাকে এক দস্যু বাঁদরের হাতে ফেলে পালিয়েছিল। সবে মীরাবাঈয়েের মন্দির থেকে বেরিয়েছি, হাতের প্লাস্টিকে ফাইভস্টার কমলালেবুফেবু - একটা প্রায় আমার সমান বাঁদর ফুল স্পিডে দৌড়ে এসেছে। এসেই হাত আকাশে তুলেছে, মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যে আমার গালে নামবে। আমি তো প্লাস্টিক যত দূরে সম্ভব ছুঁড়ে ফেলেছি। বাঁদর লুটের মাল নিয়ে গাছে উঠে গেছে, গাছ থেকে কমলালেবুর খোসা আমার মাথা টিপ করে ছুঁড়ছে, শ্রবণের প্রায় সীমান্ত থেকে কেউ বাংলায় চিৎকার করে বলল, দিয়ে দাও, কুন্তলা, দিয়ে দাও। বাঁদরের সঙ্গে অ্যাট লিস্ট ইগোর লড়াইয়ে নেমো না।

খুব ধুলোর জায়গায় দেখবেন, কেউ না কেউ ঝাঁট দেবেই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইজের শলাঝাড়ু দিয়ে একটা ছেলে কম্পাউন্ড জুড়ে পড়ে থাকা শালপাতা আর শালপাতার নিচের জমা ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে আমাদের সারা গায়ে দিতে লাগল। যে জায়গাটা ঝাঁট দিয়ে গেল, শুকনো শালপাতা পাক খেতে খেতে ঠিক সেই জায়গাটায় স্লো মোশনে নেমে এল, আড়ালেআবডাল থেকে পাখিরা কিচমিচিয়ে হাসল। বাঁ কানের কাছ থেকে হাত নেড়ে যে মাছিটাকে তাড়ালাম, সেটা ডান কানের পাশে এসে বোঁ বোঁ করতে লাগল।

পাতা গলে গায়ে পড়া রোদ্দুরের তাপ অলরেডি বেশ বেশি।

মার্চেই এই, মে জুনে কী হবে বুঝতে পারছ?

ফ্যান্টাস্টিক হবে, কুন্তলা। চমৎকার হবে। সারাবছর এ রকম হওয়া উচিত।

অর্চিষ্মান শীত ঘৃণা করে।

গাছ দেখে ঘাড় ব্যথা হলে মনোযোগ মাটিতে নামাচ্ছিলাম। আধার লাগবে না লাগবে না, হার্ডকপি না ডিজিলকার, কাল কোন জোনে ক'টা বাঘ বেরিয়েছে, কুম্ভমেলার সময় জঙ্গলে ফাঁকা জিপসি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছিল এখন হোলির কাছাকাছি দেখুন না কত ভিড় হয় - জোর আলোচনা চলছিল। দুয়েকজন এজেন্ট - আমি শিওর তাঁরা আদারওয়াইজ লাভলি, পেশার কারণেই সম্ভবতঃ চেহারাটা ধান্দাময় হয়ে গেছে - একটা কিউরিয়াস ব্যাপার করছিলেন - যারা স্পষ্ট জোড়ায় এসেছে, যেমন আমি আর অর্চিষ্মান, আমাদের সামনে আর এক বাচ্চা দম্পতি, যাদের সঙ্গে আমরা জিপসি শেয়ার করব এবং নাম জানব রানি ও মন্নু, তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে গলা নামিয়ে বলছিলেন - একটা জিপসিতে একটা সোলো সিট আছে, চাহিয়ে?

কী আশা করছিলেন? আমি অর্চিষ্মানকে বা অর্চিষ্মান আমাকে, রানি মন্নুকে বা মন্নু রানিকে - ওকে ডার্লিং বাই বলে লাফ দিয়ে একটা সিটে চড়ে বাঘ দেখতে বেরিয়ে পড়বে?

অদ্ভুত।

অর্চিষ্মান একটু আগে, কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে, একটা জিনিস খেয়াল করেছ বলে কেঁপে কেঁপে হাসল, হাসি থামিয়ে কথাটা শুরু করেও আবার হাসিতে বেঁকেচুরে গেল। 

কিছু পুরুষ, জঙ্গলে বেড়াতে এলে শিকারী শম্ভুর মতো সাজে, দেখেছ? ঢোলা প্যান্ট, চিবুকের নিচে ইলাস্টিক দেওয়া টুপি, গগলস?

কথাটা ওর কাদের দেখে মনে হয়েছে আমি জানি। আমাদের লাইনের সামনে তিনজন দাঁড়িয়ে আছেন। ক্যামোফ্লাজ প্রিন্টের হাফপ্যান্ট, শ্যাওলা রঙের টি শার্ট, ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন বলে ইলাস্টিক দেওয়া টুপি পিঠে ঝুলছে, ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও চোখে গগলস। ডেকাথলন থেকে কেনা জলের বোতলে শিওর ইলেক্ট্রল। এঁদের ক্যামেরাগুলো আমার দিকে তাক করলে, সে সময় যদি চশমা না পরে থাকি, হার্ট অ্যাটাক হওয়া বিচিত্র নয়। এঁরা জানেন গত ছ'মাসে বান্ধগড়ের কোন জোনে ক'টা বাঘের সাইটিং হয়েছে, কোন নক্ষত্র আকাশের কোন জোনে না থাকলে বাঘ দেখতে বেরোনো টোটাল ওয়েস্ট অফ টাইম।

*****
 
সোয়া একটা। কর্তৃপক্ষ গোছের কোনও লোকের দেখা পর্যন্ত নেই। কম্পাউন্ড খাঁ খাঁ করছে। জানতাম। ভারতবর্ষ বলে কথা। টাইমজ্ঞান আশা করেছিলাম যে সেটা আমার ছাগলামোই প্রমাণ করে।

অর্চিষ্মান ফোনে সুঁই সুঁই জোম্বি মারছে আর বলছে, কুন্তলা ওই তো ওখানে চেয়ার আছে গিয়ে বোসো না। এক পেগ মদ খেয়ে লোকে যেমন অতিরিক্ত সাবধানে গাড়ি চালায় তেমনি টাউনশিপ পত্তনের সময় অর্চিষ্মান আমার সঙ্গে প্রম্পটনেসে ইন্টারঅ্যাক্ট করে। যে চুটকি বলিনি তাতেও হাসে।

বসতে হলে লাইনের দুপাশে লোহার রডেও বসা যায়। এই রডে লাফ দিয়ে বসে ওই রডে পায়ের ঠেকনা দিয়ে ব্যালেন্স। বসার দশ সেকেন্ড পরেই বোঝা যায় বসাটা সাসটেনেবল নয়। অর্চিষ্মান যতবার আমাকে চেয়ারে গিয়ে বসার পরামর্শ দিচ্ছিল লাফিয়ে রডে উঠে পড়ছিলাম, উঠেই বুঝতে পারছিলাম ব্যাপার সুবিধের না এবং নেমে পড়ছিলাম।

এই শর্ট টার্ম মেমোরি লসের লুপ কেটে বেরোতে আর অর্চিষ্মানকে মুক্তি দিতে রডের নিচ দিয়ে গলে বেরিয়ে পড়লাম। বারান্দায় নোটিসবোর্ডে প্রচুর নোটিস। সেদিন আট তারিখ। নারীদিবস। (শ্রমজীবী, বাই দা ওয়ে)। সেই উপলক্ষ্যে বাফার জোনের সাফারির টিকিট আমার ফ্রি। ভাবছি খবরটা অর্চিষ্মানকে বারান্দা থেকেই চেঁচিয়ে দেব নাকি নেমে কাছে গিয়ে সভ্য ডেসিবেলে - এমন সময় ভ্রুম ভ্রুম ভ্রুম।

মেঘ ডাকছে না বাঘ ভাবতে ভাবতে গেট দিয়ে তিনটে এস ইউ ভি ঢুকল। ফোর হুইল ড্রাইভের চাকায় ধোঁয়ায় ধোঁয়া চারদিক।

সবার ঘাড় ঘুরে গেছে। গ্যাংস অফ বান্ধবগড়-এর ফার্স্ট সিন। ধোঁয়ার আড়ালে গাড়ি থেকে দশবারোজন নামলেন, হাতে ফাইল, গায়ে কারও সাফারি, কারও মিলিটারি ইউনিফর্ম। এঁরা এম পি টুরিজমের সরকারি কর্মচারী। টিকিট কাউন্টারে বসেন।

নিজে সরকারি কর্মচারী না হয়ে যতখানি সরকারি কর্মচারী হওয়া যায়, আমি ততটা সরকারি কর্মচারী। জন্মে থেকে সরকারি কর্মচারীদের ছত্রছায়ায় বড় হয়েছি। আমার চোদ্দপুরুষে সবাই সরকারি চাকরি করত। কেউ সেধে বেসরকারি চাকরিতে ঢুকেছে শুনলে আমাদের বাড়ির সবাই ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিত। ব্যবসা যে একটা লেজিটিমেট পেশা থিওরেটিক্যালি জানলেও প্র্যাকটিকালি বিশ্বাস করতে আমার বেশ বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। 

আমার চেনা সরকারি কর্মচারীদের হাবভাব আচারআচরণের সঙ্গে এককণাও মিল নেই এঁদের। সেটাই স্বাভাবিক। বিহার পেরোলেই মানুষজন, শরীর ও ভাবভঙ্গিতে অনেকটা বড় আর তীব্র হয়ে যায়।

তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে নেমে আমার রোগা বাঙালি বরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোকেরা নেমে হাঁকডাক দিতে লাগলেন। একটা ছাব্বিশ বাজল। অফিসঘরের দরজায় তখনও তালা। একটা সাতাশ। সবাই মিলে হেলেদুলে হাঁটছেন দরজার দিকে। তাড়াহুড়োর ত নেই। একটা আঠাশ। তালায় চাবি ঘুরছে। সাড়ে আঠাশ। তালা খুলে গেছে। ঊনত্রিশ। সবাই ঘরের ভেতরে সেটল করছেন। সাড়ে ঊনত্রিশ। এক ভাইসাব, খাতা হাতে বেরোচ্ছেন। ইনিই নাকি? নাহ্‌, অন্য দিকে চলে গেলেন। একটা তিরিশ।

ঘর থেকে আর এক ভাইসাব বেরিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। লাইনের প্রথম শিকারী শম্ভুর দিকে হাত বাড়ালেন। আই ডি।

ডট দেড়টায় বুকিং শুরু হয়ে গেল। যে অর্ডারে লোক দাঁড়িয়েছিল সেই অর্ডারেই সবাই টিকিট পেল। কেউ এসে লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল না। নো দাদা, নো ভাইসাব। এমনকি দেওয়ালের ইলেকট্রনিক বোর্ডে বিভিন্ন জোনে জিপসি ক্যান্টরের ভেসে ভেসে যাওয়া হিসেবও ঘাপলাহীন। ভাইসাব বুকিং নিতে নিতে ঘাড় ঘুরিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন। খিতৌলির তিনটে অ্যাভেলেবল জিপসি নিয়ে তিন শিকারী শম্ভু বীরদর্পে বেরিয়ে গেলেন। তালা জোনের দুটো অ্যাভেলেবল জিপসির একটা পরের ভদ্রলোকের কাছে গেল। তালার দ্বিতীয় ও শেষ জিপসিটা অর্চিষ্মান আমি, রানি মন্নু, আর সাতনা থেকে আসা এক নবদম্পতি শেয়ারে বুক করে নিলাম।

*****

জিপসির পর গাইড বুক হল। তিনটেয় জিপ ছাড়বে। এখনই তো দুটো দশ। হোটেলে ফিরব, নাইব, খাইব, হেঁটে আসব। তিনটেতেই ছাড়তে হবে? দশ পনেরো মিনিট লেট করা যায় না?

বিলকুল যায়, ম্যাডাম। আপনি জিপ বুক করেছেন, এবার আপনি তিনটেয় বেরোন কি সাড়ে পাঁচটায় - আপনার মর্জি। যেটা যাবে না সেটা হচ্ছে সন্ধে সাড়ে ছ'টার পর জঙ্গলে থাকা। যখনই ঢুকুন, সাড়ে ছ’টায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। ওখানে নড়নচড়ন হবে না।

না দৌড়ে যত জোরে হাঁটা যায় হেঁটে, গন্নে কা জুস, ফালুদা সেন্টার, হাবিব খানের চিকেন এবং মটন সেন্টার পেরিয়ে হোটেলে ফিরলাম। রুমে যাওয়ার পথে রেস্টোর‍্যান্ট - লাঞ্চ বুফে শুরু হয়ে গেছে। এফিশিয়েন্সি ম্যাক্সিমাইজ করতে খেয়ে ঘরে যাওয়া উচিত কিন্তু ফোনে চার্জ নেই। দৌড়ে রুমে গিয়ে ফোন চার্জে বসিয়ে খেতে ফিরলাম। চান বাদ। তাছাড়া এখানে যা ধুলো, সাড়ে তিন ঘণ্টা জঙ্গলে ঘোরার পর আবার চান করতেই হবে।

বুফের লাইনে লোকে যা স্পিডে থালাবাটি নিচ্ছে, আনবিলিভেবল। সুইট কর্ন সুপের হাঁড়িতে এমন সাবধানে উঁকি মারছে যেন নরকের কুণ্ডে পাতকীর মুণ্ড সেদ্ধ হওয়ার লাইভ শো দেখছে। ওপেন হার্ট সার্জারির প্রিসিশনে চিমটে দিয়ে শশাপেঁয়াজ তুলছে। অর্চিষ্মান বুদ্ধি খাটিয়ে সোজা ডাল ফ্রাইয়ে চলে গেছে। ডাল ফ্রাই, ভাত, মাংস নিয়ে সিট বেছে বসেছে, আমি ঘি-মাখানো রুটি আর আলুগোবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এঁদের হলে শশাটমেটো নুন গোলমরিচ নেব।

হোয়াইট টাইগারের রান্না এত ভালো যে বেশি স্পিডে খাওয়া যায় না। অর্চিষ্মানের চিকেন ভালো, আমার আলুগোবি ভালো। রান্নার ভালোমন্দ নিয়ে আমার থিওরি সবাই জানে। ইনোভেশনে আমি বিশ্বাস করি না। কে মাথা খাটিয়ে ডিমের ঝোলে কামরাঙা দিচ্ছে, আই অ্যাম লিস্ট ইন্টারেস্টেড অ্যান্ড লিস্ট ইম্প্রেসড। আমাকে ইমপ্রেস করতে হলে নর্ম্যাল আলুফুলকপি নর্ম্যালি রেঁধে দিতে হবে।

কাজুবাটা দিলে পত্রপাঠ ডিসকোয়ালিফায়েড।

শশা শেষ করে আলুগোবি ধরেছি, অর্চিষ্মান এক হাতে দালিয়ার পায়েস অন্য হাতে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে এল। বাড়িতে মাঝে মাঝে দালিয়া প্রসেনজিৎকে করে দিতে বলি। এক্স্যাক্টলি উপমার রেসিপি, শুধু সুজির বদলে দালিয়া। অর্চিষ্মান নাম শুনলেই জিভ বার করে বমি করার ভঙ্গি করে। এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে জানাল, বাড়িতে এ ভাবে দালিয়া বানালে নাকি ও খেতে পারে।

ঘর থেকে ফোন উদ্ধার করে দৌড়তে দৌড়তে টিকিট কাউন্টারে গেলাম। সকালের ফাঁকা কম্পাউন্ড জিপস, গাইড, টুরিস্টের ভিড়ে গমগম করছে। গাইডও এত হয়ে গেছে যে তাঁদেরও লাইন পড়ে। সবাই রোজ কাজ পান না। একটা গাছের তলায় আমাদের জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। সাতনাদম্পতি অলরেডি জিপের পেছনের সিটে ঘেঁষাঘেঁষি বসে। আমাদের উদ্দেশ্যে হাত তুললেন।

অর্চিষ্মান, ন্যাচারেলি, খেতে খেতে ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে রেখেছে। গাইড বসবেন ড্রাইভারের পাশে। পেছনের দুটো সিটে তিন তিন ছ'জন। এক জোড়াকে আগেপিছে বসতে হবে, কুন্তলা।

অফ কোর্স, আমরা বসব। গ্রুপের হয়ে ফর্ম ফিলআপ করার সময় সবার নামধাম বয়স দেখেছি আমি। রানিমন্নু চব্বিশ ছাব্বিশ, সাতনাদম্পতি আঠাশ বত্রিশ। এদের আলাদা বসিয়ে ঊনচল্লিশ চুয়াল্লিশ ঘেঁষাঘেঁষি করলে সোজা নরক। আমি গাইডের পেছনের সিটে বসলাম, অর্চিষ্মান আমার পেছনের সিটে সাতনার ছেলেটার পাশে বসল।

জিপ ছেড়ে দিল। তালা জোন একেবারে কাছে। বেসিক্যালি আমরা তালাতেই আছি। গেটে সবার আধার চেক হল, আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম।

*****

দেখুন, আপনি জঙ্গলে কী করতে যাবেন সে আপনার ব্যাপার। বাঘ যদি দেখতে যান, আমার আলাদা করে কোনও রেকোমেন্ডেশন নেই। লাইনে শিকারী শম্ভুরা যখন সাইটিং-এর ইতিহাসভূগোল নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিলেন, এক ভদ্রলোক না থাকতে পেরে বলে ফেলেছিলেন, আরে শেরকো জোনওন কেয়া পাতা, ও ঘুমতি রহতি হ্যায়।

হক কথা। কাজেই আপনি কোন জোনে গেলে বাঘমামার দেখা পাবেন সে আমি বলতে পারব না। তবে যদি জঙ্গল দেখতে চান, তালা জোনটা একবার টার্গেট করবেন। মগধিতে যাইনি,  পরের দু'দিনে খিতৌলিতে একবার গেছিলাম আর তালাতে আরও একবার। খিতৌলিও সুন্দর। প্রকৃতি অসুন্দর হয় না, অফ কোর্স, তবু গাছ, গুহা, চরণগঙ্গা নদী আর আন্ধিরিয়া ঝিরিয়া নিয়ে তালা ম্যাগনিফিসেন্ট।

জঙ্গলে শালের পরেই বাঁশের প্রাচুর্য। ছোট ছোট ঝুঁটির মতো বাঁধা। এক একটা ঝাড় মাটিতে শুয়ে পড়েছে। অর্চিষ্মান চিন্তিত - এগুলো পড়ে গেল কী করে? ওর কৌতূহল রেটোরিক্যাল ধরে নিয়ে প্রথমটা চুপ করে ছিলাম, তারপর এক মিনিট পর পর অর্চিষ্মান ঘাড়ে টোকা দিয়ে আমাকে ভূপতিত বাঁশঝাড় দেখাতে লাগল।

দেখো হয়তো ঝড়টড়ে পড়ে গেছে।

ঝড়ে পড়লে তো সব ঝাড়ই পড়ত। এই দেখো এই ঝাড়টা পড়েছে, ঠিক পাশেরটাই দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। উঁহু, দিস ইজ সামথিং এলস।

পরদিন খিতৌলির সাফারিতে গাইড ভাইসাব অর্চিষ্মানের কিউরিয়াস কেস অফ ফলেন ব্যাম্বু-র সমাধান দিয়েছিলেন। বেসিক্যালি, হাতি। ইতনা সা খানে কে লিয়ে পুরা ঝাড় গিরাতা হ্যায়।

জঙ্গলের মধ্যে পিঁপড়ের সারির মতো জিপসি চলে। উল্টোদিক থেকে যে আসে তার সঙ্গে শুঁড়ে শুঁড় ঠেকিয়ে খবর নেয়। এক ফিমেল হ্যায়, বচ্চোঁ কে সাথ। নালা কে পাস এক গাড়ি কো দিখা।

বাঘ নেই, বাঘের গল্প আছে। বান্ধবগড় রামলক্ষ্মণের জায়গা। দূরে পাহাড়ের ওপর যে দুর্গমতো দেখা যাচ্ছে, ওটা রাম ভালোবেসে লক্ষণকে দিয়েছিলেন বা ওই রকম কিছু। সে দুর্গ দেখানোর দশ মিনিটের মধ্যে যদি বাঁ দিকে গুহা দেখিয়ে গাইড বলেন ইয়ে দেখিয়ে সীতামণ্ডপ, তাহলে ভারতবর্ষের একশো পঁয়তাল্লিশ কোটি লোকের এক বিশেষ সীতার কথাই মনে হবে। 

একশো পঁয়তাল্লিশ কোটি লোকই ভুল করবে। এ সীতা অন্য সীতা। বান্ধবগড়ের ওজি ফিমেল। বান্ধবগড়ের ওজি মেল, চার্জারের সঙ্গে, বত্রিশটি পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই অরণ্য সীতা চষে বেড়াত। সীতাচার্জারের প্রেমকাহিনী এখনও সন্ধেবেলা বান্ধবগড়ের প্রতি হোটেলে, যাদের প্রোজেক্টর আছে অ্যাট লিস্ট, চা কফি পকোড়ার সঙ্গে দেখানো হয়। প্রেমের গল্প তো ভালোই, আমার আরও ভালো লেগেছে নায়কনায়িকার নাম। ভাবুন। সীতাচার্জার। চার্জারসীতা। প্যানপেনে ঘ্যানঘেনে রোমিওজুলিয়েট হীররঞ্ঝা লায়লামজনুর বাজারে ঝোড়ো বাতাস। ঝোড়ো এবং বাস্তব। বিশ্বাসযোগ্য। সীতা নামের মেয়ের, সরি নট সরি, রাম নামের ছেলের থেকে চার্জার নামের ছেলের প্রেমে পড়ার চান্স হান্ড্রেড পার সেন্ট বেশি। উল্টোটাও তাই। চার্জারটার্জাররা সর্বদা সীতালতাতেই আছাড় খায়।

সীতাচার্জারের সন্ততি হল। সন্ততিদের আবার ছেলেপুলে। এই করে বান্ধবগড় বাঘে বাঘে ভরে উঠল। সব সময় এ রকম ছিল থোড়াই। মাচা থেকে, জিপের মাথা থেকে, ছাগলের টোপ দেখিয়ে টেনে এনে বীরপুরুষরা বাঘের বংশ ধ্বংস করেছিলেন। বান্ধবগড়ের অবস্থাও সারিস্কার মতোই হতে চলেছিল। বাঘ আসলে জিরো - অ্যানুয়াল রিপোর্টে লোকে পেনসিল কামড়ে যাতা একটা নম্বর লিখে দিচ্ছে।

তখন কিছু লোক, ঘরের খেয়ে বাঘ বাঁচাতে নামলেন। সরকারি টিম তৈরি হল, তাঁরা দেশবিদেশের আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্রসেমিনার থেকে শিখেটিখে এলেন। আমি অবশ্য শিওর যারা এফর্ট দিয়েছিলেন, তাদের বাঘ দেখলে এমনিও মন ভালো হত। শুধু মাইনের মুখ চেয়ে কাজের কাজ করা যায় না। সাধারণ মানুষও অসুবিধে মেনে নিলেন। ভিটেমাটি ছেড়ে জঙ্গলের কিনারে নতুন বাসা বাঁধলেন। পনেরোশো ছত্রিশ বর্গ কিলোমিটারের জঙ্গল বাঘেদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হল। এখন সেই পনেরোশো ছত্রিশ বর্গ কিলোমিটারে একশো পঁয়ষট্টিটি বাঘ রাজত্ব করে।

বললাম, বাঘ গোনা হয় কী করে? পায়ে জি পি এস কড়াটড়া কী সব পরানো হয় শুনেছি?

গাইড ড্রাইভার সজোরে মাথা নাড়লেন। বান্ধবগড়ের বাঘেদের সঙ্গে ও সব করা হয় না, ম্যাডাম। ন্যাচারাল নেহি হ্যায়। ওসব করা হত যখন বাঘ অল্প ছিল, পোচিং প্রবল ছিল। তখন বাঘেদের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থেই পায়ে জিপিএস পরানো থাকত। যাতে চব্বিশঘণ্টা নজর রাখা যায়। তারপর বাঘ বাড়ল, পোচিং বন্ধ হল। বাঘেদের পা থেকে কড়ামড়া খুলে নেওয়া হল। আহ্‌, মুক্তি। এখন স্বাধীনতার আরাম আর মজা দুইই বুঝা যাইবে।

এখন বাঘ গোনে হাতি। বুনো হাতি ধরে পোষ মানানো হয়, বাঘ গোনার কাজে লাগে। তালাজোনের গেটের পাশেই হাতির ক্যাম্প দেখেছি বটে। হাতিও দেখেছি। দুটো অলরেডি পোষমানা বড় হাতি, একটা বাচ্চা হাতি। একটা বড় হাতিকে পোষ মানানো চলছে তাই পায়ে দড়ি বাঁধা। সে দড়ি বাঁধা পা টেনে টেনে বাকি হাতিদের কাছে আসার চেষ্টা করছে। 

হাতি বাঘ গোনে, মানুষ বাঘ গোনে, মেঠো পথের পাশে পাশে বেঁটে লাঠির ডগায় বসানো ক্যামেরা বাঘ গোনে। সবাই মিলে গুণে বার করেছে,আপাতত একশো পঁয়ষট্টিটা বাঘ আছে গোটা বান্ধবগড়ে। তাদের মধ্যে পনেরো ষোলটা আপাতত তালাতে ঘুরছে। কপাল ভালো থাকলে তাদের একটাকে আমরা দেখতে পাব।

একশো পঁয়ষট্টি? একেবারে রাউন্ড ফিগার? নির্ঘাত দু'পাঁচটা কমবেশি হবে।

অর্চিষ্মান অবাক হল। তোমার এ অবিশ্বাসের বেসিস কী?

বেসিস আবার কী, চুয়াল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা। অর্ধেক জীবন পার করেও যদি মানুষকে অবিশ্বাস না করি, তাহলে আর কবে করব? মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ হতে পারে, কিন্তু স্যানিটির। আমার এ বিশ্বাস আমি বদলাচ্ছি না।

অর্চিষ্মান ঘাড় পাতল না। একশো পঁয়ষট্টি না হওয়ার কিছু নেই। বলছে যখন হতেই পারে।

হোটেলে চার্জার, সীতা, বিট্টু, বজরং, চক্রধারা, ডি টু - এদের সবার নাম লেখা ছবি টাঙানো ছিল, দেখেছিলে?

অফ কোর্স।

নাম সরিয়ে নিলে চিনতে পারবে? আমি তো মুখ দেখে চার্জার সীতার তফাৎ করতে পারব না। তুমিও পারবে না। আর ওঁরা একেবারে নিখুঁত গুণে ফেলছেন?

আমি তুমি পারব না বলেই তো আমাদের গুণতে দেয়নি, কুন্তলা। যারা পারবে তারাই গুণছে।

কুড়িটা শাল পার হল। পনেরোটা অর্জুন, পাঁচটা চিতল, একটা সম্বর। মাথার ভেতরে ধীরে চাকা ঘুরছে। আমার আনাড়ি চোখে যদি চার্জার চক্রধারে তফাৎ ধরা না পড়ে তাহলে আনাড়ি বাঘের চোখে আমি আর রবীন্দ্রনাথও সেম? আমি আর আগাথা ক্রিস্টি? আমি আর দীপিকা পাডুকোন?

এই দাগাবাজ দুনিয়ায় এমন কেউ ঘুরেফিরে বেড়ায় যার চোখে আমি আর দীপিকা, দীপিকা আর আমি সেম টু সেম? ভাবা যায়?

কান্না পেলে এবার থেকে ক'দিন বান্ধবগড়ে এসে কাটিয়ে যাব। 

*****

এক একটা বনপথের সামনে কাঠ আর বাঁশের সাসটেনেবল বেড়া। আশি শতাংশ বন বেড়া দিয়ে টুরিস্টের নাগালের বাইরে। আগে খোলা ছিল, এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেড়ার ওপারে এখন শুধু প্রফেশনালরা যেতে পারেন। গাড়ি যায়, তবে সাইকেলই মূলতঃ।

সাইকেল?

সাইকেল।

দু’চাকাওয়ালা? নর্ম্যাল সাইকেল?

বিলকুল নর্ম্যাল।

সত্যিই। নর্ম্যাল মহিলা পুরুষ পেট্রল কর্মচারীরা নর্ম্যাল সাইকেল চড়ে ঘুরছেন। হ্যান্ডেল থেকে বাজারের ব্যাগ ঝুলছে। জঙ্গলের মধ্যে একটা রহস্যময় কুটিরমতো থেকে ধোঁয়া উঠছিল। ওখানে কয়েকজন পরিদর্শক নিজেদের রান্নাবান্না করছেন। বাঘ তাঁদের অ্যাটাক করেছে কি না কখনও জানতে চাইলে গাইড না বললেন।

বাঘ এসে পড়লে? সাইকেল নিয়ে কী করবেন ওঁরা?

বাঘ আসে না, এ ছাড়া আর কোনও রকম স্যাটিসফ্যাকটরি উত্তর পাওয়া গেল কি না। আমি পরের লজিক্যাল এবং জরুরি প্রশ্নটা করলাম।

সাইকেল দেখলে না হয় ঘেঁষতে সাহস পায় না, জিপের প্রতি অ্যাটিচুড কী?

যে সব বাঘ জঙ্গলে জন্মে জঙ্গলে বড় হয়, তারা এ সব জিপটিপে ঘাবড়ায় না, পাপারাৎজির মতো ট্রিট করে। যারা বাইরে থেকে আসে বা বদ্ধ জায়গায় থেকে অভ্যস্ত, তাদের একজন নাকি লাফ মেরেছিল। কিন্তু সে অনেক বছর আগে।

একটা বেশ বড় গুহার মুখে গ্রিলের গেট। তালা দেওয়া। এটাও খোলা ছিল একসময়। দু'হাজার বারো না কততে একদল টুরিস্ট বুক ফুলিয়ে গুহায় ঢুকে দেখে এক ফিমেল বসে বসে অল্প অল্প ল্যাজ আছড়াচ্ছে। পেটভরা ছিল ভাগ্যিস, নেহি তো কাহানি বন যাতি।

ওই যে পাহাড়ের ওপর রামলক্ষ্মণের দুর্গ আর দুর্গে মন্দির, সেও বছরে মোটে দু'বার খোলা হয়। এখন বন্ধ আছে।

বাঁচা গেছে। খোলা থাকলে বাঘের টাইম কেটে রাম দেখতে যেতে হত। ধুয়ো উঠেওছিল। যেই না কানে ঢুকেছে মন্দির, অমনি চলে? চলে? যাওয়া যাবে না শুনে তিরিশ সেকেন্ডের মৌনপালন। সস্তায়, কম পরিশ্রমের পুণ্য ফসকে গেল।

কিন্তু ভারতবর্ষেও থাকব আবার ভগবানকেও এড়াব, অত খায় না। মন্দিরটন্দিরের বাইরে খুল্লমখুল্লা এক বিষ্ণু শুয়ে আছেন, তাঁকে দর্শন করতে যেতে হল। এই ভগবানকে ইউটিউবে দেখেছি। বিশ্রামরত বিষ্ণু বলতে হাতে মাথা ভর দেওয়া সাইড হওয়া যে বিষ্ণুর কথা আপনার মনে পড়ে সে রকম না। ফুল চিত। নিদ্রামগ্ন। শ্যাওলাবৃত। অরণ্যের আশ্রয়ে সে শ্যাওলাবৃত মূর্তি দেখলে একটা ছমছম হয় বটে। সৃষ্টির সময় নিশ্চয় বিরাট গোল হয়েছিল, লাইমস্টোনে ছেনিহাতুড়ির দুমদাম, ধুলোয় ধুলো, লোকে ঘেমেনেয়ে একশা। প্রতিষ্ঠার সময়েও নিশ্চয় গাছপালা কাটা পড়েছিল। কিন্তু সে সব সংগ্রাম, ধ্বংসলীলা - জঙ্গল হয় ভুলে গেছে বা ভুলে যাওয়ার ভান করেছে। সংলগ্ন জলাশয় থেকে শ্যাওলাছানারা স্ট্রেঞ্জার ডেঞ্জার ভুলে উঠে এসেছে, উঠে এসে দেবতার ঘাড়ে পিঠে চড়েছে, নাকমুখ ঢেকে খেলনাবাটি পেতেছে।

তারপর একজন, নিশ্চয় বড়গোছের ভক্তই হবে, এসে সে সব শ্যাওলা ঘষে মুছে দিয়েছে। অরণ্যকে অওকাত বুঝিয়ে বাউন্ডারি টেনে দিয়েছে। এখন আবার দেবতা মানুষের হয়ে গেছেন। যাবতীয় অলৌকিকত্ব খুইয়ে মানুষের দাস। যেদিন পুজো বসবে, লোকে নাওয়াবে, বাতাস করবে, মুখে সন্দেশ গুঁজবে - পুতুলে পর্যবসিত হবেন।

ঘুরে চললাম। হাতি দেখলাম, হরিণ দেখলাম, বাঁদর দেখলাম, চিতল, সম্বর, এমনি ময়ূর, পেখমমেলা ময়ূর। ভাইসাবেরা জলাশয়ের ধারে ধারে জিপসি নিয়ে যাচ্ছিলেন। আশ্চর্য টলটলে সে জলের ধার ধরে হরিণরা হেঁটে যাচ্ছে। জমিতে যেমন স্পষ্ট, জলেও তেমনই। মরা গাছ জলের ওপর শুয়ে আছে।

সব আছে, সবাই আছে, শুধু তিনি নেই।

*****

তিনি নেই, তাঁর উপস্থিতি সর্বত্র।

শালের গুঁড়িতে আঁচড়ের ক্ষত শুকিয়ে কালো হয়ে রয়েছে। রিষড়ার গেটের বাঁদিকের আমগাছটায় এ রকম আঁচড়ের দাগ আছে। বেড়ালের আঁচড়। আম তবু সামলাতে পারে, কিন্তু প্যাংলা টগর? শেষমেশ মা টগরের গুঁড়িতে প্লাস্টিক জড়িয়ে দিয়েছিলেন। গরম লাগবে, রক্তপাতের থেকে তো বেটার। বেড়াল বা বাঘ - এই ভাবে টেরিটরি মার্ক করে। অন্য বাঘকে এ টেরিটরিতে ঢুকতে গেলে এই দাগের থেকে উঁচুতে আঁচড়ে নিজের শক্তির প্রাধান্য বোঝাতে হবে।

বাঘের থেকে শিখুন। আড়ালে যান। রহস্যময় হোন। হোয়াটসঅ্যাপ বা জীবনে - অ্যাভেলেবল থেকে কেউ কোনওদিন বড়লোক হয়নি।  সম্মাননীয় বা আদরণীয়ও না।

তিনি নেই, কিন্তু একটু আগেও যে ছিলেন তার ছাপ রাস্তার ধুলোয়। পারফেক্ট ক্যাটওয়াকে চার থাবা, একটিমাত্র সরলরেখায় চলেছে। নাকমুখচোখ গায়ের রঙের থেকে কিছু কম ইম্পরট্যান্ট নয় হাঁটাচলা ওঠাবসা কাঁধের অ্যালাইনমেন্ট। কত চকচকে লোকের চাকচিক্য ধূলিসাৎ হতে দেখেছি স্রেফ ক্যাবলার মতো হাঁটেন বলে। আবার একেবারে হেঁজিপেঁজি - স্রেফ বেটার হাঁটা দিয়ে মাত করে দিচ্ছে।

বাঘের মতো হাঁটুন। ল্যাগব্যাগ করবেন না। প্রতি স্টেপে চটি পা থেকে ছিটকে যাচ্ছে - এভাবে জীবনের মধ্য দিয়ে চলবেন  না। পুরো ব্যাপারটাকে সন্নিবদ্ধ রাখুন। আর প্লিজ, ফেলার আগে পা জমি থেকে পুরো তুলুন। ওই ভয়াবহ ঘষটানিটা ঘষটাবেন না। নিঃশব্দে হাঁটুন। মোদ্দা কথা, গোটা ব্যাপারটা নিজের কন্ট্রোলে রাখুন।

স্পটেড বা চিতল হরিণের পাশাপাশি আর এক দল মোটাসোটা হরিণও ঘুরছে, এদের নাম সম্বর। এরা বাঘের ফেভারিট শিকার। এরা নাকি তাড়া খেয়ে দৌড়তে দৌড়তে বারবার পেছন ফিরে পরীক্ষা করে বাঘ আসছে কি না। বাঘ, অফ কোর্স, অল্প চেজ দিয়ে ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। বোকা সম্বর পিছু তাকিয়ে বাঘকে খোঁজে। স্পিড কমে যায়, তখন বাঘ টুঁটি লক্ষ করে ঝাঁপায়।

জীবনে চলার পথে চোখ সামনে রাখুন। স্পিড কমাবেন না। পিছু তাকাবেন না। ওয়ান ওয়ে হ্যায় ইয়ে জিন্দেগি কে গলি, এক হি চান্স হ্যায়ঁ/ আগে হাওয়া হি হাওয়া হ্যায়ঁ, অগর সাস হ্যায়ঁ তো রোম্যান্স হ্যায়ঁ।

*****

ছ'টা বাজছে। সূর্য ঢলছে। জিপ দুলছে, জিপের সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত শরীর। তার থেকেও বিরক্ত মন। কিস্যু দেখাফেখা যাবে না। সব ধোঁকা হ্যায়। বান্ধবগড়ে গেলেই বাঘ দেখা যায়, একা হাতে এই মিথ ভেঙে বাড়ি ফিরব। আজ পর্যন্ত দিওয়ালি তাম্বোলাতে কুড়ি টাকা পর্যন্ত জিতিনি, আমি দেখব বাঘ?

অর্চিষ্মান বলল,  তোমার ব্যাডলাক আমার গুডলাক দিয়ে অফসেট হয়ে যাবে কুন্তলা। আমার বাঘভাগ্য ভালো। যতবারই বাঘসাফারিতে বেরিয়েছি ততবারই বাঘ দেখেছি। 

বললাম, এ যাবত তুমি এক্স্যাক্টলি একবার বাঘসাফারিতে বেরিয়েছ, রণথম্ভোরে। সেই সাফারিতে তোমার সঙ্গে আমিও ছিলাম আর আমিও বাঘ দেখেছি। কাজেই তোমার বাঘের ভাগ্য এক্স্যাক্টলি আমার মতো।

তাহলে তো হয়েই গেল। আজ আমিও বাঘ দেখব, তুমিও আমার সঙ্গে দেখবে। দেখলে রাতে তুমি আমাকে জিন খাওয়াবে, না দেখলে আমি তোমাকে জিন খাওয়াব।

একটা কিছু জেতার সম্ভাবনায় চাঙ্গা হলাম। হরিণ, বাঁদর, ময়ূর আবার নতুন উৎসাহে দেখতে লাগলাম। আবার একটা নৃত্যরত পুরুষ ময়ূরের সামনে দাঁড়ানো হল, সে ফুল পেখম মেলে নেচে চলেছে। নেচেই চলেছে। আমি ফোন তুলে অপেক্ষা করে আছি তো আছিই, এদিক আর ফেরে না। অর্চিষ্মান বলল, যার জন্য নাচছে তার দিকে ফিরেই তো নাচবে কুন্তলা, তোমার জন্য তো নাচছে না।

তাও বটে। আমি এদিকে হাফচলন্ত জিপের ওপর ত্রিভঙ্গমুরারি হয়ে একপায়ে ধ্যান করছি আমার জন্য নাচবে কেন। তার জন্য নাচবে যে উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে পোকা ঠোকরাচ্ছে। প্রেমের নিয়ম মানুষ ময়ূর সবার জন্য সমান। 

তেমাথায় দুটো জিপ দাঁড়িয়ে আছে, জিপ থেকে দুই সাহেব শম্ভু কুতুবমিনারের সাইজের ক্যামেরা বাগিয়ে আছেন। একটা গউর ঘাস খাচ্ছে। এ রকম শরীরের শেপ দেখলেই আমার আলতামিরার ছবির কথা মনে পড়ে। ডিসপ্রোপোরশনেটলি বড় কাঁধ, গুঁতোনোর জন্য রেডি। জিপ নিয়ে গউরের সামনে যেতে একটা মজার জিনিস দেখলাম। এই মুষকো ষণ্ডা জোয়ানের এই শিং থেকে ওই শিং-এ একটা সরু, সূক্ষ্ম এবং পরিপাটি একটি সাদা লোমের ফালি। অ্যাবসলিউটলি আননেসেসারি। আগাপাশতলা আলংকারিক। আমার টিপের মতো। আমি যেমন কোনও কারণ ছাড়াই নিজের কপালে লালরঙের গোল স্টিকার সেঁটে ঘুরছি, ভাবছি উফ চেহারা না জানি কী খোলতাই হয়েছে, এও সুন্দর দেখাবে বলে পার্লার থেকে চুলে হাইলাইট করে এসেছে।

বাঘের সঙ্গে এর লড়াই হলে কে জিতবে?

বলা মুশকিল। এরা বাঘকে ঘাঁটায় না, বাঘও এদের এড়িয়ে চলে। এদের স্পিড কম, কিন্তু গায়ে জোর আছে। দলবল মিলে থাকলে বাঘকে মেরেও ফেলতে পারে।

কই এর তো দল নেই?

গোলমেলে পুরুষ হলে অনেক সময় দলের লোকেরা বার করে দেয়। এরও সেই কেস মনে হচ্ছে।

গোলমেলে গউরটির ওপর ওইটুকুর মধ্যেই মায়া পড়ে গেল। তুমি বেঁচে থাকো। বুড়ো হয়ে বেশি কষ্ট না পেয়ে ঘুমের মধ্যে টুপ করে মোরো। কোনও রকম হিংস্রতা যেন না ছোঁয়।

মাঠের মধ্যে এক জায়গায় গোল করে বেড়া দেওয়া। কী ব্যাপার? না জঙ্গলে স্পেশাল হরিণ আনানোর কথা হচ্ছে কিন্তু তাদের খাওয়ানোর জন্য স্পেশাল ঘাস নেই। সেই স্পেশাল ঘাস চাষ হচ্ছে বেড়া দিয়ে। নন-স্পেশাল হরিণরা বেড়ার চারপাশে ঘুরঘুর করে নন-স্পেশাল ঘাস খাচ্ছে।

*****

ছ'টা বারো। অর্চিষ্মানের স্পনসরশিপে খানাপিনার সম্ভাবনা ক্রমশঃ উজ্জ্বলতর, অথচ উত্তেজনা তলানিতে। এই বাজিটায় হারলেই ভালো হত। এমনকি একটা মনের মতো পরাজয়ও কপালে নেই। হেউ। জিপের সিটে ঘুঁষি মারতে যাব এমন সময় ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ।

চিৎকারটা ময়ূরের কাছাকাছি, কিন্তু ময়ূর নয়। বার্কিং ডিয়ার। জঙ্গলের চৌকিদার। একটা বিশেষ বিপদ কাছাকাছি এলে চেঁচিয়ে সাবধান করে।

ওই, আবার করল।

ড্রাইভার ব্রেক কষেছেন, গাইড উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমিও দাঁড়িয়েছি। অর্চিষ্মান বলছে, কুন্তলা কী করছ, বসে পড়। ভান করছি শুনতে পাচ্ছি না।

ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ। বান্ধবগড়ের আকাশবাতাস ফালাফালা। প্রথম ক্যাঁ-র প্রতিধ্বনি মেলাতে না মেলাতে গাইড বললেন, পিছে লে, ড্রাইভার বললেন, পকড়কে বৈঠিয়ে, অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা প্লিজ। আমাদের জিপসি ফুলস্পিডে পেছোতে শুরু করল। আমি রানির ঘাড়ে পড়লাম। রানি মন্নুর ঘাড়ে পড়ল। 

জীবনে একবারই গোকার্ট চালিয়েছিলাম। বান্ধবগড়ের ড্রাইভারেরা, আই গেস, সব জঙ্গলের সাফারি ড্রাইভারেরাই, জিপসিগুলোকে গোকার্টের মতো ব্যবহার করেন। যে স্পিডে ইচ্ছে, যে দিকে খুশি।

যে মেঠোপথ ধরে আমরা পনেরো মিনিট আগে এসেছি, অন্ততঃ সাতাশটা জিপসির জটলা। কালো কালো মুন্ডু। তেমাথার মোড় এসে গেছে, গউরটা দৌড়চ্ছে। আমাদের জিপসি ডিরেকশন বদলে গউরের উল্টোদিকে দৌড়লো। রাস্তাজোড়া জিপের জঙ্গল গুলির গতিবেগে এগিয়ে আসছে। ক্যামেরা হাতে দেশীবিদেশী সাহেবমেমেরা ডানদিকের বাঁশঝাড়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কী দেখছেন? হরিণ? বাঁদর? ময়ূর?

জিপের জঙ্গল পার হয়ে সামনে না যেতে পারলে জানাই হবে না বাঁশঝাড়ে কী দেখার জন্য সবার এত ছটফটানি। বার্কিং ডিয়ারগুলো এমনি এমনিই চেঁচাচ্ছে কি না। বাজিতে অর্চিষ্মান না আমি - কে জিতল।

ড্রাইভার আবার বললেন, পকড়কে বৈঠিয়ে, অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা বাড়াবাড়ি কোর না, আর আমাদের জিপসির ডানদিকের দুটো চাকা ঘাসজমিতে নেমে পড়ল। বাকি দুটো মেন রোডে।

অতিভুজের নিচের বিন্দুতে যদি মন্নু হয়, ওপরের বিন্দুতে আমি। সে অবস্থায় রাস্তার জিপের ভিড় সম্পূর্ণ পেরিয়ে একেবারে জটলার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

রানি শিউরে মুখে হাত চাপা দিয়েছে, হৃদপিণ্ড আটকে যাওয়া গলায় অর্চিষ্মান বলছে, কুন্তলা দেখছ? দেখছ?

অফ কোর্স পাচ্ছি না। সবাই দেখতে পাচ্ছে, আমি ছাড়া। বাঘ তো আমার জন্য পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। আর ফ্র্যাকশন অফ সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাবে, আমি দেখতে পাব না। বান্ধবগড়ে বাঘ দেখলি কি না বললে গুল দিতে হবে। দেখলাম মানে? কানের পাশ দিয়ে হালুম করে লাফ দিল। সত্যিটা শুধু জানব আমি, বাঘ আর অর্চিষ্মান।

অর্চিষ্মান প্রাণের মায়া ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছে। ডান হাতে আমার ঘাড় শক্ত করে ধরেছে। বাঁ হাত কানের পাশ দিয়ে সোজা সামনে। স্ট্রেট আমার আঙুল ফলো কর। করেছ? বস্‌, এখনও না দেখতে পেলে . . . 

ক্যামোফ্লাজের যাবতীয় লজিককে কাঁচকলা দেখিয়ে সবুজ বাঁশঝাড়ের ফাঁকে হলুদ ঝিকিয়ে উঠল। গোল মুখ, গোঁফ। কাঁধের ডানদিকের হাড়টা উঠল, তারপর বাঁদিকেরটা।

জিনিসটা সোজা আমাদের দিকে আসছে। স্ট্রেট আমার দিকে।

শুনুন, আপনাকে কে কী বলেছে আমি জানি না। বাঘ সাইড থেকে ভালো, পেছন থেকে ভালো, দূরে  জলে ঝাঁপাঝাঁপি দেওয়া ভালো, ন্যাট জিওতে লাফ দিয়ে মোষের পিঠ আঁকড়ে ধরা তো দারুণ ভালো।

কিন্তু সামনে থেকে খুব খারাপ। কারণ সামনে থেকে বোঝা যাবে জাস্ট দেড় মিনিট লাগবে। দেড় মিনিট, আর একটা চড়। উঠবে, নামবে। একটা গোল রাগী মুণ্ডু হাঁ করবে, দুটো ধারালো দাঁত ঝলসাবে। 

এভরিওয়ান গ্যাংস্টাহ্‌, যতক্ষণ না উনি চোখ তুলে তাকাচ্ছেন। এভরিওয়ান শিকারী শম্ভু, যতক্ষণ না কাঁধের দুটো হাড় উঠতে নামতে, উঠতে নামতে এগোচ্ছে।
 
বাঘের পেটে যাওয়া কুষ্ঠিতে লেখা নেই বলেই হয়তো বেঁচে গেলাম কারণ ঠিক চার পা আমার দিকে এগোনোর পর জুনিয়র চক্রধারা ডিরেকশন চেঞ্জ করে বাঁদিকে বেঁকল। অমনি জুনিয়র চক্রধারার আড়াল থেকে যে বেরিয়ে পড়ল, সাইজে হাফ না হলে আমার চোখ তার সঙ্গে জুনিয়র চক্রধারার তফাৎ করতে পারত না।

রানি আমার কাঁধ খামচে ধরেছে, ও মাই গড, সো কিউট।

জুনিয়র চক্রধারা আর জুনিয়র চক্রধারার তিনটের একটা লাফ মেরে ঘাসজমিতে ঢুকে গেল।

আমি যা দেখলাম অর্চিষ্মানও তা-ই দেখল কি না পেছন ফিরে মিলিয়ে নেব ভাবছি, এমন সময় চঞ্চলতা। শিকারী শম্ভুদের ক্যামেরা ঘুরে গেছে বাঁশবনের ওই প্রান্তে।

একটা কিছু খসখসাচ্ছে।

সাতাশটা জিপসির ইঞ্জিন একসঙ্গে চালু হল। সাতাশটা জিপসি একসঙ্গে সামনের দিকে লাফ মারল।

আমাদেরটা ছাড়া। কারণ আমরা এখনও পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি হেলে। আমাদের জিপসির অর্ধেক এখনও ঘাসজমির ভেতর। সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে ঈশানে নৈঋতে - যে কোনও দিকে যেতে গেলেই আমাদের আগে সোজা হতে হবে, রাস্তায় উঠতে হবে।

রানি বলল, ক্যায়সে নিকলেঙ্গে ইয়ার? চোখেমুখে লাল ধুলো ছুঁড়ে যেতে যেতে পাশের জিপসি থেকে টুপি পরা দিশি মেম বললেন, হাউ অন আর্থ?

গাইড বললেন, চেপে বসুন। অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা।

ড্রাইভার কিছু না বলে পেছোতে শুরু করলেন। মন্নু আর মন্নুর পেছনে সাতনাদম্পতির মেয়েটা আশ্চর্য প্রতিভায় এখনও জিপে সেঁটে আছে। অবশ্য একমিনিট আগে জুনিয়র চক্রধারা বাচ্চা নিয়ে ঘাসজমিতে নেমেছে। পড়ে না যাওয়ার এর থেকে বড় ইনসেনটিভ আর কিছু নেই। 

সুবিধেজনক দূরত্ব পিছিয়ে এসে প্রায় জুনিয়র চক্রধারার মতোই লাফ মেরে জিপসি রাস্তায় উঠে পড়ল। সে ঝাঁকুনিতে বাকি সবাই যার যার ভাইয়াকে, আমি আর অর্চিষ্মান আমাদের বাবাদের স্মরণ করলাম।  জিপসি সামনে ছুটল।

আলোকবর্ষ স্পিডে, কারণ পেছোতে, কাত থেকে সোজা হতে যতক্ষণ গেছে, বাকি জিপসিরা বাঁশবনের ওই প্রান্তে পৌঁছে গেছে। তাদের চাকায় রাস্তা থেকে ওড়া ধুলোয় আমাদের ভিশন ঘোলাটে। ধুলোর ওপারে ডানদিকের বাঁশবনে নড়াচড়া চলছে, আমরা কাছে যেতে যেতে কালো একটা ছায়া লাফ মেরে সরে গেল।

জুনিয়র চক্রধারার তিনটের দ্বিতীয়টা। রাস্তা পেরিয়ে লাফ মেরে বাঁদিকের ঘাসজমিতে ঢুকে গেছে।

ইসকো লেনে চক্রধারা আয়েগি।

কোথা থেকে আসবে? কী করে আসবে? মাঝখানে তো রাস্তা, আমরা আটার নুইসেন্সের মতো সে রাস্তা আটকে রেখেছি।

রাস্তা তো একটা না, ম্যাডাম। রাস্তাও আছে, রাস্তা পেরোনোর দায়ও আছে। জুনিয়র চক্রধারা ঠিক আসবে।

ঘং। আকাশ বাতাস পলাশ বাঁশ হাতিঘাসে চক্রধারার ডাক ধাক্কা খাচ্ছে। ওই তো! ওই তো! হাতিঘাসের সমুদ্রে সাঁতার দিতে দিতে চক্রধারা চলেছে, বাচ্চার দিকে। মাথাটা পুকুরেপড়া ফুটবলের মতো দুলছে। আমি অর্চিষ্মানকে বললাম, কী গো দেখছ? অর্চিষ্মান আমাকে বলল, কী গো দেখছ? রানি বলল, মন্নু দেখ রহা হ্যায়? মন্নু রানিকে বলল, রানি দেখ রহি হ্যায়? সবাই জানে সবাই দেখছে, তবু উচ্চারণ করে দেখাটাকে যথাসম্ভব সত্যি করে তোলা। যথাসম্ভব রক্তমাংসের। শব্দ ও ধ্বনির পেরেক ঠুকে ঠুকে স্মৃতিতে গুঁজে দেওয়া। যাতে কিছুতেই গলে পড়ে না যায়। স্বপ্নের সঙ্গে গুলিয়ে না যায়।

জিপসিগুলো একসঙ্গে ঘুরল। ঘাসের সমুদ্রে চক্রধারার 'এই আছি এই নেই' মুন্ডুতে ফোকাস করা টুরিস্টরা টলে গেল। সবক'টা জিপসি থেকে গাইডদের আঙুল দূরে যেখানে ঘাসজমি পাতলা হয়ে এসেছে, চিকচিক করছে জল। একটা পুকুর।

মুন্ডু না, এবার প্রায় গোটা শরীরই দেখা যাচ্ছে। কী স্পিড ভাবা যায়? এই এখানে ছিল, এই পুকুরধারে পৌঁছে গেছে?

ইয়ে জুনিয়র চক্রধারা নেহি হ্যায়। ইয়ে বজরং হ্যায়।

হোয়াট দা?

বজরং পুকুরধার ধরে হাঁটছে। বজরং ঘন ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে। বজরং আর বজরং-জুনিয়র চক্রধারার তিনটের তৃতীয়টা।

ওরা সবাই মিলে এদিকে আসছে। কারণ ওদের রাস্তা পার হতে হবে। যে রাস্তাটা পাঁচ সেকেন্ডে পেরোনোর কথা, তিন বাচ্চাকে গুছিয়ে সেটা পেরোতে বাবামায়ের পঁচিশ মিনিট লাগছে।

ব্রিটিশ কৌতুকশিল্পী মাইকেল ম্যাকিনটায়ারের একটা বিট শুনেছিলাম। শুরুর কয়েকটা লাইন এ রকমঃ The people that don't have children, they think they know what it means to have children. You think you know what you're talking about. You have no idea.

একটা গরগর শব্দ হচ্ছে। বজরং অলরেডি এসে পড়ল নাকি? একসঙ্গে বারোজন গাইড চাপাগলায় ধমকে উঠেছেন - ওয়ান সেভেন নাইন! ইঞ্জিন বনধ্‌ কর।

একশো ঊনআশি নম্বর জিপসি ইঞ্জিন বন্ধ করল। আর শব্দ নেই কোথাও। পাখি ডাকছে না। বার্কিং ডিয়ার চেঁচাচ্ছে না। জিপসিতে জিপসিতে উশখুশও থেমে এসেছে। গাইডরা শব্দসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাসূচক হাত শূন্যে ভাসিয়ে রেখেছেন।

বজরং রাস্তায় উঠে এল। বজরং ক্যাটওয়াক করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছে। বজরঙের উজ্জ্বল হলুদকালো পশমের নিচে পেশীরা স্রোতের মতো বইছে।

এত সুন্দরের সামনে শ্বাস নেওয়া যায় না। এই উজ্জ্বলতায় চোখের পলক ফেলতে নেই। এই প্রখরতার সামনে হ্যাহ্যা করতে লজ্জা হয়। এ রাজকীয়তার সামনে নিজের সমস্ত ছেঁদোমি নিয়ে সঙ্কুচিত সরে দাঁড়াতে হয়। এই কুলনেসের সামনে নিজের অন্তহীন ক্যাবলামো ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখতে হয়।

বাঘের বাবারাও সামনে সামনে হাঁটে। বজরং রাস্তা পার হওয়ার প্রায় দেড় মিনিট পর জুনিয়র চক্রধার ঘাসবন থেকে রাস্তায় উঠে এল। গা ঘেঁষে জুনিয়র চক্রধারার দুই জুনিয়র। মা ধীরেসুস্থে হাঁটছে, ওরা মাকে ঘিরে দৌড়ে দৌড়ে।

আর একটা কোথায়? শশশশ্‌। পেছনে পড়ে গেছে। বচ্চা হ্যায়, ডর রহা হ্যায়।

সব চুপ। সবাই চুপ। ডানদিকের ঘাসে মৃদু খসখস।

রানি পাশে ফিসফিস করছে, আযা বেটু, ডরনে কি কোই বাত নেহি হ্যায়। কোই কুছ নেহি করেগা।

বাঁ পাশের বাঁশবন থেকে সংক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ ঘঁক শোনা গেল। আমার মনে হল হয়তো বলছে, এত ভয়ের কী আছে? ওরা যদি সারাদিন জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তুমি সারাদিন ঘাসের মধ্যে ঘাপটি দিয়ে বসে থাকবে? তিন্নি বলল, মোর প্রব্যাবল, জুনিয়র চক্রধারা বলছে, অনেক ন্যাকামি হয়েছে, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়াও আমার অন্য কাজ আছে।

তিরিশ সেকেন্ড পর অর্চিষ্মানের হাঁটুদৈর্ঘ্যের একটা বাচ্চা - রিয়েল বাঘের রিয়েল বাচ্চা - অসীম সাহসিকতায় একদৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে গেল।

বাঁশবনে মৃদু খসখস উঠল, ছায়া ছায়া নড়ল। তারপর সব শান্ত।

*****

হাতেপায়ে সাড় ফিরতেও তো সময় লাগে। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসতে। গলা থেকে শব্দ বার করতে। প্রথমটা শুধু মোনোসিলেবল ম্যানেজ হয়। বস্‌। ফাক। তারপর, আনবিলিভেবল। অবশেষে সরল বাক্য। হোয়াট জাস্ট হ্যাপেনড?

জিপসিরা জটলা ভেঙে এদিকওদিক চলে গেল।

তেমাথা পেরিয়ে সেই প্রডিগ্যাল গউর। একা একা ঘাস খাচ্ছে। অদূরে বাকি দলটাকেও দেখা যাচ্ছে।

পিছু তাকালাম। আকাশ বাতাস ঘাসবন বাঁশবন মেঠোপথ। প্রায় মাটি ছুঁয়েফেলা সূর্যের আলোয় ধিকিধিকি জ্বলছে। জিপসির চাকাওড়ানো ধুলোয় তিরতির কাঁপছে।


                                                                                                                                                    (চলবে)


বান্ধবগড় ১


Comments

  1. বৈজয়ন্তীMarch 27, 2025 at 9:48 PM

    এযে পুরো থ্রিলার। ভূমিকা, ইতিহাস, শিক্ষা থেকে শেষে চেজ, হ্যাপি এন্ডিং, ফিল গুড সব সমেত।

    কিছুদিন আগে একজনের সাথে পরিচয় হয়েছে, যাঁর পিএইচডি ছিল, রনথম্বর থেকে সারিস্কাতে বাঘ আনার প্রজেক্টটা। চেহারা গোলগাল, চোখে চশমা, গড়পড়তা বাঙালির মতোই পাঁচ ছয়, পাঁচ সাত। না জানলে, চেহারা দেখে আইটি বা ব্যাংক কর্মচারী মনে হবে। কিন্তু সেদিন থেকে আমার চোখে উনি অলমোস্ট চার্জার।
    একমত, ভালো না বাসলে শুধু মাইনের জন্য এসব করা যায়না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হায়েস্ট ফাইভ, বৈজয়ন্তী। "চার্জার"নেসটা বাইসেপট্রাইসেপে থাকে না। ওটা অন্য জিনিস। প্রায় সব জরুরি জিনিসের মতোই - অভ্যন্তরীণ।

      আপনি যখন পড়েছিলেন - অনেক টাইপো ছিল। তা সত্ত্বেও পড়েছেন এবং ভালোলাগা জানিয়েছেন - সে জন্য থ্যাংক ইউ। এই লেখাগুলো আসলে এত লম্বা হয়, আর এত সময় লাগে যে শেষটা পাগল পাগল লাগে, বিশেষ করে আমার মতো লোকের পক্ষে, পরিশ্রম যাদের পোষায় না। তাই অনেক সারানোর পরেও একটা পয়েন্টের পর ধুত্তেরি বলে পাবলিশ করে দিতে হয়।

      Delete
  2. দুর্দান্ত!!

    আর কিছু বলার জায়গা নেই এটায়। শুরু থেকে পড়তে পড়তে আরো দুএকটা কিসব লিখেছিলাম, স্রেফ ডিলিট করে দিলাম। দারুন লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন থেকে ধন্যবাদ আর ভালোলাগা জানালাম, রাজর্ষি। বৈজয়ন্তীকে যা লিখেছি আপনার জন্যও খাটবে। অনেক টাইপো আর ভুল ছিল। এখন সারানোর চেষ্টা করেছি, শিওর তবু কিছু রয়ে গেছে।

      Delete
  3. Bas. Decided. Ei bochor Bandhavgarh jachchi. Parle White Tiger ei thakbo. Tenar dekha pai kina dekhi. Dugga dugga.

    ReplyDelete
    Replies
    1. পাবে পাবে, বিম্ববতী। আমাদের বাঘদর্শনের ভাগ্য তোমাকে পাস অন করলাম। বর্ষার পর জঙ্গল খুললে যেয়ো। সব সবুজে সবুজ হয়ে থাকবে। আগে থেকে হোটেল সাফারি দুইই বুক করে যেয়ো।

      Delete
  4. পড়তে পড়তেই ভাবছি শেষে কিছু ঘটবে মনে হয় , তারপর রোমহর্ষক বাঘ দেখা। ওই কথায় আমিও একমত, বাঘ সামনে দেখে যথেষ্ট ভয় লাগে, একটা দূরত্ব রেখে হাঁটলে শান্তি। লেখাটা দারুণ, পুরো ধারাবাহিক উপন্যাসের মত লাগছে :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ঊর্মি। ভালো লাগল তোর ভালো লেগেছে জেনে।

      Delete

Post a Comment