আমার থ্যাংকসগিভিং



ঠিক দুক্কুরবেলা যখন অফিসে বসে বসে পেটমোটা টার্কি আর লেইমার্কা আলুসেদ্ধর ছবির পর ছবি দেখতে দেখতে সেকেন্ড হ্যান্ড কার্বোহাইড্রেট ওভারডোসে চিবুক প্রায় বুকে নেমে এসেছে তক্ষুনি ব্রেনওয়েভটা খেলল। আমাকে এবছর কেউ থ্যাংকস দিতে ডাকেনি---সে ডাকেনি বাঁচা গেছে, অন্য লোকের মুখ দেখলেই রাগ ধরে যায় আমার আজকাল---কাজেই আমার সন্ধ্যেটা ভূতুড়ে বাড়ির মতো খাঁ খাঁ খালি পড়েছিল। চরিত্রে অতৃপ্তি থাকলে যা হয়, সেটাও আবার আমার পছন্দ হচ্ছিল না। নিজের ওপর কেমন মায়া মায়া হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কেন আমারই পছন্দসই কোনও বন্ধু নেই, কেন আমারই একাবোকা থাকতে হয়, কেন আমাকেই হাত পুড়িয়ে রোজ রাতে ম্যাগি খেতে হয়।

যদিও তপ্ত, ধোঁয়া ওঠা, অল্প ঝোল ঝোল ম্যাগি খেতে আমার দুর্দান্ত লাগে এবং ভালোবাসার জিনিসটা আরাম করে খাওয়ার সময় যে আশপাশ থেকে একগাদা লোক “এটা দাও, সেটা দাও, এই চ্যানেলটা বিশ্রী ওই চ্যানেলটা ঘোরাও” ঘ্যানঘেনিয়ে হাড় জ্বালায় না, সে জন্য আমি রোজ আমার কপালকে থ্যাংকস দিই। তবুও।

আসলে তো ব্যাপারটা একাদোকার নয়, ব্যাপারটা হল হরমোনের। যখন মগজে সেরোটোনিনের সাপ্লাইয়ে টান পড়ে তখন সব সুখই অসুখ মনে হয়। তখন বিশ্বচরাচর তোমার শত্রু, তুমি একা ভিকটিম। তখন কেবল সিলিঙের দিকে মুখ তুলে খুঁৎখুঁতিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করে, “কেন আমার সঙ্গেই এসব হয় ভগবান, কেন কেন কেন?”

সে এক ভয়ানক ব্যাপার।

জল সেদিকেই গড়াচ্ছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি নিজের হাতে নিলাম। তেড়েফুঁড়ে কাজ করার প্রতিজ্ঞা করার পরে মোটে চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি, তবুও দিনের মতো কাজকর্ম সরিয়ে রাখতে হল। ফাইলটাইল সরিয়ে ডেস্কের ওপর জায়গা করে খাতা পেনসিল নিয়ে বসলাম। আমার নিজস্ব থ্যাংকসগিভিং পার্টির আয়োজন করতে।

আমার বস্‌, আজ নয়, কাল নয়, রোজ রোজই আমি দিবস।

নিজের জন্য পার্টি আয়োজন করার সুবিধাও আছে, অসুবিধাও আছে বিস্তর। প্রথম অসুবিধা হচ্ছে মেনু ঠিক করা। বাইরের লোককে নেমন্তন্ন করলে তো জনে জনে ফোন তুলে জিজ্ঞাসা করতে হয় না, “ওগো আপনারা কী খাবেন গো, হ্যাঁগো আপনাদের কারও কি ধনেপাতা খেলে সাবান খাচ্ছি মনে হয় গো, আচ্ছা আপনারা কি কেউ সন্তোষী মা করছেন বলে শুক্কুরবারে নিরামিষ খাচ্ছেন, নাকি রেটে মুটোচ্ছেন বলে প্যালিও ধরেছেন?” তখন কেবল এক হাঁড়ি যেমনতেমন বিরিয়ানি আর এক গঙ্গা পাঁঠার ঝোল রেঁধে দিয়েই খালাস। শেষ পাতে ফ্রিজার খুলে যে যত চাও কেসর পিস্তা। খেলে ভালো, না খেলে আরও ভালো। লেফটওভার দিয়ে সারা সপ্তাহের টিফিনের ব্যবস্থা পাকা।

নিজের মনের সঙ্গে এত সোজাসাপটা হওয়া যায় না। কী খাবে জিজ্ঞাসা করলে সে খানিকক্ষণ পেনসিল চিবোয়, এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা চুলকোয়, যেন সিঁড়িভাঙ্গা সরল অঙ্ক কষতে দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগ্রহণে সাহায্য করার জন্য আপনি যদি বলেন, “চাইনিজ কেমন হবে?” অমনি চেঁচিয়ে ওঠে, “সেকি কালকেই চিলি গারলিক নুডলস অর্ডার করা হয়েছিল তো! এরই মধ্যে ভুলে গেলে নাকি!”

“তাহলে পিৎজা? উইথ এক্সট্রা হ্যালেপিনো?” ছোট বাচ্চাকে লোভ দেখানোর মতো আপনি বলবেন।

জবাবে মন শুধু একবার ঠোঁট ছ্যাতরাবে।

“তাহলে ইথিওপিয়ান মাংসের ঝোল? মালয়েশিয়ান মোগলাই পরোটা? লেবানিজ শিক কাবাব?”

উদাস চোখে মন চুপ করে থাকবে। আলতো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলবে, “বলে দাও কিছু একটা, আমার তো সবেতেই চলে যায়।”

আমার সব সহ্য হয়, এই শহিদ-শহিদ হাবভাবটা ছাড়া। আমি দড়াম করে খাতা বন্ধ করে দিয়ে বললাম, “অলরাইট। আজ রাতে আমি নিজেই রান্না করব। গরম ভাত, দই দিয়ে মুরগির ঝোল আর ঘি কিশমিশ দিয়ে সুজির পায়েস।”

মন লাফিয়ে উঠে বলল, “আমিও হেল্প করব প্লিইইইইজ, কী মজা কী মজা...”

হয়ে গেল প্ল্যানিং। অফিস থেকে ফেরার পথে দরকারি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এলাম। বেশি কিছু কেনার ছিল না, কেবল কিশমিশ, ফুল ফ্যাট দুধ আর দই ছাড়া। আপনাদের এই বেলা বলে রাখি, আগেভাগে না বলে হঠাৎ এসে পড়লে কিশমিশ-টিশমিশ আমার বাড়িতে পাবেন না। চানাচুর ভুজিয়াও না। ও সবের যত বড় প্যাকেটই কিনি না কেন, একদিনে শেষ হয়ে যায়। দইটাও না কিনলে হত, কিন্তু ফ্রিজের ভেতরের দইটার এক্সপায়ারি ডেট নিয়ে কনফিডেন্স পেলাম না। দুধও বাড়িতে ছিল, কিন্তু টু পার্সেন্ট। থ্যাংকসগিভিং-এর সন্ধ্যায় ফ্যাকাশে পায়েস খেতে মন চাইল না।

তারপর আর কী, বাড়ি এসে মাংসটা দইটই দিয়ে মেখে ম্যারিনেট করতে বসিয়ে দিলাম। ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে উনুনে দুধ চাপালাম। হাফ সসপ্যান দুধ, ধৈর্য ধরে নাড়তে নাড়তে সিকি সসপ্যান হল। রং ফিকে সাদা থেকে ফিকে ঘিয়ে হল, সসপ্যানের গায়ে সরের পাতলা স্তর জমল। হাত বলল, অনেক হয়েছে এবার থামো; মন বলল, না না আরেকটু হোক। শেষপর্যন্ত হাত যখন একেবারে বেঁকে বসল, তখন কড়াইয়ে একখাবলা ঝর্ণা ঘি দিয়ে আমি সুজি আর কিশমিশ ঢেলে দিলাম। আবার নাড়ো নাড়ো নাড়ো, যতক্ষণ না ঘিয়ে ভাজা সুজির গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। তারপর গরম দুধ সাবধানে ঢেলে দাও সুজির ওপর। গরম ধোঁয়া পাকিয়ে উঠে চশমার কাঁচ আবছা করে দিল, আঙুলের নখের ভেতর ঢুকে নরম চামড়া পুড়িয়েই দিল প্রায়, মন লাফিয়ে উঠে হাততালি দিয়ে বলল, “দারুণ হবে মনে হচ্ছে, কী বল?” তারপর সেই ফুটন্ত সাদা লাভায় গুনে গুনে চার চামচ চিনি দিয়ে নেড়ে, আগে থেকে থেঁতো করে রাখা এলাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে আমি গ্যাস বন্ধ করে দিলাম।

ওয়ান আইটেম ডাউন। ইন ফ্যাক্ট সবথেকে ঝামেলার আইটেমটাই।

লোকে যাই বলুক না কেন, মাছমাংস রান্নায় কোনও কেরামতি নেই। ওর থেকে দুধ জ্বাল দেওয়াও শক্ত। সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকো, সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারি না মুখ করে দুধ ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। কোথাও কোনও চাঞ্চল্য নেই, একটি বুদবুদও না। কিন্তু তাকে ছেড়ে একটি সেকেন্ডের জন্য অন্য ঘরে যান, জল খেতে বা চুল আঁচড়াতে, অমনি দুধ উথলে পড়ে সারা রান্নাঘর একাকার।

এই দুর্ঘটনাটা আমার সঙ্গে এতবার ঘটেছে যে আমি আজকাল দুধ বসিয়ে গ্যাসের সামনেই তাঁবু খাটিয়ে বসে পড়ি। কতক্ষণে হবি হ’। আমার কোনও তাড়া নেই।

যাই হোক এত কথার পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে এইটা বলা যে মাংসটা বিনা ঝামেলায় হয়ে গেল। আমি মাঝে মাঝে ঢাকনা তুলে খুন্তি খেলালাম, খোঁচা মেরে আলু নরম হয়েছে কিনা দেখলাম, নুনঝাল চাখলাম---ব্যস হয়ে গেল রান্না।

তারপর প্রেশারকুকারের ভাতে দুটো সিটি মারতে আর কতক্ষণ।

এই ছিল আমার থ্যাংকসগিভিং। খুব ভালো কেটেছে জানেন। আমি আর আমার বাঁদর মন, দুজনে মিলে একটা সন্ধ্যে নিরিবিলিতে দারুণ আনন্দে কাটিয়েছি। মাঝখানে বান্টি একবার ফোন করে সাতকাহন করে কার বাড়িতে শুকনো টার্কি চিবিয়ে থ্যাংকসগিভিং উদযাপন করছে সে গল্প দিতে এসেছিল, আমি "ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব" বলে ফোন কেটে দিয়েছি। ভালো করেছি না?

Comments

  1. ওসব বিলিতি উৎসবে আমার ইন্টারেস্ট নেই, নইলে আপনাকে একটা ধন্যবাদ তো জানাতেই হয়। এই যে একদিন অন্তর অন্তর আমাদের গল্প শোনান? তার জন্য থ্যাঙ্কস, আর হ্যাপি থ্যাঙ্কসগিভিং।

    তা ডিএসএলআর কেনা হল? কোনটা কিনলেন? নিকন, ক্যানন, অলিম্পাস, না অন্য কিছু? সাথে বড় লেন্স কিনেছেন তো? খাবারের ফোটো পোস্ট করা নিয়ে কি একটা কথা হয়েছিল না? তা মাংস আর পায়েস তো মেরে দিয়েছেন মনে হচ্ছে, নেক্সট উইকেন্ডে একটা জম্পেশ কিছু রাঁধবেন, আর ফোটো আপলোড করবেন, কেমন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. DSLR নিয়ে...ক্রমশ প্রকাশ্য। বড় লেন্স কি আমার মতো ছোট লোকেদের হাতে মানায় দেবাশিস? দেখি যদি নতুন রান্না করি, তাহলে ছবি দেওয়া যেতে পারে।

      আপনাকেও আমার তরফ থেকে অনেক থ্যাংকস। অবান্তরে নিয়মিত এসে ভালো ভালো কমেন্ট রেখে দেওয়ার জন্য। আমার অনেক চেনা লোক পোস্ট না পড়ে খালি কমেন্টগুলো পড়ে, জানেন তো?

      Delete
  2. lekhata darun. Rannaguloo chamotkar. :-).

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।

      Delete
  3. ki bhalo lekhata...hyare egulor chabi dekha jabe na?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা ক্যামেরা থাকলে তবে না ছবি?

      Delete
  4. Besh korechho. Two thumbs up. Nijer jonyo nije ranna kore ja sukh, serom ar kichhute nei!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এক্স্যাক্টলি বিম্ববতী। ভূত খাইয়ে কোনও লাভ আছে বল?

      Delete
  5. Ei erakom lekha gulor jonnoi to abantore asi :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ রুচিরা। লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুব আরাম পেলাম।

      Delete
  6. দারুণ দারুণ কুন্তলাদি। পাকা রাঁধুনি হয়ে উঠছ তো। তবে নিজেকে খাওয়াতে 'খাতা-পেন' নিয়ে বসাটা একটু কিরকম যেন। আর মাংস রান্না নিয়ে যা বলেছ একদম খাঁটি কথা। মাংস খারাপ রান্না করা খুব চাপের ব্যাপার, সে নেহাত নুন-টুন দেব না, এরকম গোছের কিছু পণ করে না বসলে। পায়েসটা নিশ্চয় ফাটাফাটি হয়েছিল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা প্ল্যান করতে হলে খাতা পেনসিল না থাকলে কী করে চলবে আবির? নিজের মুখে তো বলা ঠিক নয়, তবে লোকজন তো চেটেপুটে খেল পায়েসটা।

      Delete
  7. khasa post...khub khub bhalo. tomar kolom er dogay phul chondon poruk..abantor er bhumi te aaro aaro emon post poruk :)
    TG uppolokshe jibon er shob bhalo jinis incl abantor, ke mone mone anek thanks dilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ শম্পা। তোমাদেরও অবান্তরের বন্ধু হওয়ার জন্য অনেক অনেক থ্যাংকস। একেবারে মনের ভেতর থেকে।

      Delete
  8. aar ami khali deal khunje khunje mathaar chool uriye fellam :|

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুক্রবার কাকভোরে ওয়ালমার্ট অভিযানে বেরিয়েছিলে নাকি পরমা?

      Delete
    2. .. are ebaare to era shob thursday bikel thekei dokaan khule diechilo, aar amar shopping er obostha kichuta amar phd er moto-i, chorom indecision aar confusion!
      prothome bhablam dslr kinbo, tai niye onek research kore time waste kore bhablam, kobe alaska gie chobi tulbo taar jonne ekhon theke camera kine ki hobe, bole bhablam tahole i pad kini, die tai niye aro 2 din time waste, tarpor bhablam iphone jokhon aachei tahole i pad nie ki korbo? ek-e to apps. tahole samsung er notun tablet ta kini? tai niye prochur mathaar chool chinre deal khunje khunje dekhlam totokhone sunday sokal hoe geche, ogotta je shob bondhuder etodin dhore deal niye khunchiye khunchiye pagol kore dilam tader thenganeer theke banchaar tagide aaj sokale decision nie galaxy note ta online deal e kinei fellam. Amar ei bochorer deal hunting er apatoto somapti, babbah weekend gelo bote ekta!

      Delete
    3. আরে সফল উইকএন্ড গেল তো! নতুন ট্যাবলেট বাধাই হো পরমা।

      Delete
  9. Arey amader to Wednesday office e bhishon chaap gelo. Kothay long weekend er agey amader 3tey bari chole jaoyar katha, tar jaygay 6:30 obdi 55 ta jhamela. Er eta cholena, o bole "arey ami to ekhuni ota fix korlam", ke server er code refresh korte client er code refresh kore boshe ache...jachhetai abastha. Tai Thanksgiving e ami ekta gota turkey khaoar plan korechilam.
    Amader ek bishal gobda bondhu ekta bishal gobda turkey redhechilo. Ar tar mihi bou baki sob ranna korechilo. Ami besh theshe theshe sei 15 pound turkey'r besh khanikta khelam ar khanikta ora baksho bhore diye dilo :) Amar oboshyo stuffing ta beshi bhalo legechilo ar last e pecan pie (dudh diye pie ta khelam ami).
    Tarpor friday te ekta dutch oven kinlam ar ONEKTA Julia Child er bouef bouguignon radhlam. Seta ekhono kheye cholechi :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ওয়াহ ওয়াহ, দারুণ থ্যাংকসগিভিং কাটিয়েছ তো রিয়া। ডাচ ওভেনের জন্য অভিনন্দন। কী রঙের কিনলে?

      Delete

Post a Comment