দ্য ইয়ং ফ্রিৎজ




“হালো, উই হাইসেন সি?”

সামনের সিটের পিঠের ওপর জেগে থাকা মাথাটা মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাথার মালিক বসে পড়েছেন। বন থেকে ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিটের মধ্যে বাকি সব স্বাভাবিক মানুষের মতো সিটে চুপ করে বসে থাকতে নিতান্ত অপারগ হয়ে তিনি সিটের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে কামরাভর্তি লোকের ওপর নজরের সার্চলাইট ঘুরিয়ে এনে অবশেষে আমার সহকর্মী আনার মুখের ওপর ফেলেছেন এবং সাব্যস্ত করেছেন যে যাত্রার বাকি ছ’ঘণ্টা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার জন্য আনা যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট।

দু’হাতের মধ্যে থেকে একজোড়া অচেনা চোখ নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকলে আর কিছুতে মনোনিবেশ করা শক্ত, কিন্তু তাও আমরা করার চেষ্টা করছিলাম। আমি আর আনা। বাকি ক্লাসের সঙ্গে ঝাঁক বেঁধে বন থেকে বার্লিন যাচ্ছি। আনা আইপ্যাড বার করে কী সব টাইপ করছে, আমি জানালার ধারে বসে দ্য কুকু’স কলিং শেষ করছি। বা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছি, কারণ ওই দু’জোড়া চোখ।

লো-কনটেক্সট্‌ কালচারের বাচ্চা বলে ভয়ে ভয়ে এড়িয়ে চলছিলাম, কিন্তু শেষটা আর থাকা গেল না। লো-কনটেক্সট্‌ কালচার হচ্ছে, এই যেমন ধরুন জার্মানরা। “হাউ আর ইউ” জিজ্ঞাসা করলে “সেয়ার গুট্‌” বলে প্রস্তরকঠিন মুখে চুপ করে থাকে। অপ্রাসঙ্গিক বা উইদাউট কনটেক্সট একগাদা কথা হাঁউমাঁউ করে উগরে দেয় না। আর আমরা হচ্ছি হাই-কনটেক্সট কালচারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। “কী, কেমন চলছে?” জানতে চাইলে বাজারের ব্যাগ হাতে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে বাতের ব্যথা থেকে শুরু করে কাজের লোকের কামাই---প্রতিটি পয়েন্ট টাচ না করে দম নিই না। বস্‌, “গতকাল অফিসে আসেননি কেন?” জিজ্ঞাসা করলে “অসুস্থ ছিলাম” বলে খেলখতম করার বদলে, “আরে আমি কী করব, অর্চিষ্মানের গরম লাগছিল বলে সারারাত জানালা হাট করে খুলে ঘুমিয়েছি, সকালবেলা উঠে দেখি টনসিল ফুলে ঢোল, ঢোঁক গিলতে পারছি না। তারপর তো ডাক্তার, বদ্যি, রাজ মেডিকো, সেট্‌জিন...”

ট্রেনিং-এর প্রথম সপ্তাহে লিডারশিপ নিয়ে বক্তৃতা দিতে এসে দু’রকম কালচারের পার্থক্য বানান করে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন এক বক্তা। তার সঙ্গে অবশ্য পইপই করে এও বলেছিলেন যে কোনও কালচারই একে অপরের থেকে ভালোখারাপ নয়, ইট’স্‌ অল অ্যাবাউট ডাইভার্সিটি---কিন্তু তাতে আমি ভুলিনি। আজন্ম শুনে আসা বাবার কথাটাও মনে ছিল। “প্রয়োজনের অতিরিক্ত এত কথা বলে বলেই বাঙালির কিছু হল না।” আমার মা আবার এতটা নৈরাশ্যবাদী নন। মা বলেন, “চেষ্টা করলে মানুষে সব পারে। আমি চিরদিন মায়ের কোলঘেঁষা, তাই মায়ের মতটা আমার বেশি পছন্দ। হাই-কনটেক্সট কালচারে জন্মেছি বটে, কিন্তু প্রাণপণ পরিশ্রম করে লো-কনটেক্সট কালচারের রকমসকম আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি।

কিন্তু শেষটা আর পারা গেল না। পাশে আনার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওরও একই অবস্থা। আইপ্যাড আর বই মুড়ে রেখে অগত্যা আমরা সৌজন্যমূলক আলাপচারিতার পথ ধরলাম। যদিও সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, ভাষার ব্যাপারটা ভুললে চলবে না। যে তিনটে জার্মান বাক্য ফ্রাউ শ্‌প্রিংগার মাথায় গজাল মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তারই প্রথমটা ঝুলি বার করে জিজ্ঞাসা করলাম, “হালো, উই হাইসেন সি?”

হাই, হোয়াট’স ইয়োর নেম?

তার উত্তরেই আমাদের নজরদারের সবেগে অন্তর্ধান। বুঝলান তিনি কথা বলতে চান না, শুধু তাকিয়ে দেখতে চান। উঁচু পিঠওয়ালা সিটের ব্যারিকেডের ওপার থেকে চাপা মহিলাকণ্ঠে জার্মান কথাবার্তা শোনা যেতে লাগল। সে কথার মানে বোঝার বিদ্যে আমার আনার কারওরই নেই, কিন্তু আমরা দু’জনেই নিশ্চিত ছিলাম যে কী বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। হাই, লো---সবরকম কনটেক্সটের কালচারেই কিছু কিছু কথোপকথন হুবহু এক।

“এ মা, এ রকম করতে হয় নাকি? নাম বল। না হলে কী ভাববেন বল দেখি ওঁরা? ভাববেন সোনা নিজের নামটাই জানে না। উঠে দাঁড়িয়ে হ্যালো বলে নিজের নাম বল। আর জিজ্ঞাসা কর আপনাদের নাম কী।”

অতি ধীরে প্রথমে চাইনিজ কাট চুলে ভরা মাথা, আর তার নিচে নীল কাঁচের গুলির মতো একজোড়া চোখ, সিটের ওপার থেকে আবার ভেসে উঠল। এতক্ষণ চাউনিতে যে সপাট আত্মবিশ্বাসের ভাবটা ছিল সেটা আর নেই। তার জায়গায় এখন অবিশ্বাস, ভয়, আর খানিকটা লজ্জা মিশে আছে।

নাম জানতে পেলাম না, কিন্তু চোখ এই প্রথমবার আমাদের মুখের ওপর থেকে সরলো। এখন তারা আনার আইপ্যাডের দিকে নিবদ্ধ। আছে আছে, আলাপের আশা আছে! দ্বিরুক্তি না করে আনা আইপ্যাড তুলে ধরেছে, “ইউ ওয়ান্ট টু সি ইট?”

উত্তেজনায় জার্মানের জায়গায় ইংরিজি বেরিয়ে পড়েছে। তাতে অসুবিধে কিছু নেই, কারণ বন্ধুত্বের বডি ল্যাংগোয়েজ সকলেই বোঝে। ভাষা দিয়ে তাকে প্রকাশ করতে হয় না।

সেই শুরু হল। আমাদের সিটের কথাবার্তা শুনে ততক্ষণে বাকি ক্লাসমেটরাও ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে লেগেছেন ব্যাপারটা কী। কার মনজয়ের জন্য আমার আর আনার এত কাঠখড় পোড়ানো। তাদের মধ্যে দু’একজন গুটিগুটি আমাদের তিনজনের নির্বাক কথোপকথনের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি আর আনা কাজটা যতখানি সূক্ষ্মভাবে করার চেষ্টা করছিলাম, কেউ কেউ তার ধার ধারলেন না। সোজা গামি বিয়ার্‌সের প্যাকেট তুলে ধরে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইউ লাইক ক্যান্ডি?”

ডেসপ্যারেশনের মাত্রাটা বুঝে দেখুন।

আমাদের অনামা বন্ধু ততক্ষণে সিট থেকে নেমে এসেছে। তারপরের ঘন্টাখানেক ধরে সে আইলে ছুটেছুটে সকলের সঙ্গে আলাপ করে, তাদের সম্পত্তির হিসেবনিকেশ নিতে লাগল। মৌনব্রতও ভেঙে গেছে তার ততক্ষণে। তার একটা প্রধান কারণ হতে পারে যে সে বুঝে ফেলেছিল যে আকারেআয়তনে আর পাঁচটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো দেখতে হলে কী হবে, ভাষাগত বিকাশের দিক থেকে লোকগুলো তারই সমবয়সী। কিংবা হয়তো তারও কম। আলাপচারিতা মূলত চলছিল Wh-Questions-এর পথ ধরে। আমাদের “ওয়াস্‌ ইস্‌ট্‌ দাস্‌?” প্রশ্নের উত্তরে সে মহোৎসাহে আমাদের “দাস্‌ ইস্‌ট্‌ ফেনস্টাহ্‌, দাস্‌ ইস্‌ট্‌ শুহ্‌, দাস্‌ ইস্‌ট্‌ টাশে...” ইত্যাদি দেখিয়ে যেতে লাগল।

বার্লিনে নেমে যে যার ব্যাগপত্র সামলাচ্ছি, স্টেফানি আর শার্লটে নার্ভাস মুখে সকলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে হাতে ধরা নামের লিস্টে টিক মারছে, এমন সময় দরজা দিয়ে দুই ভদ্রমহিলা নেমে এলেন। একজনের মাথায় শরতের মেঘের মতো ধপধপে সাদা চুলের মুকুট আর আরেকজনের মাথা এখনও কুচকুচে কালো। কালোচুলের মহিলা একটা ডাবল্‌-স্ট্রোলার ঠেলছেন। তার একদিকের সিটে একটি একেবারেই দুধের শিশু, মুখে প্যাসিফায়ার গুঁজে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। আর পাশের সিটে অঘোরে ঘুমোচ্ছে আমাদের বন্ধু। অবিন্যস্ত চুল কপালে এলোমেলো ছড়ানো, নীল কাঁচের গুলির মতো চোখ বড়বড় পাতার নিচে ঢাকা।

দল স্টেশনের বাইরে অপেক্ষায় থাকা বাসের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করেছিল, আমি আর আনা ভদ্রমহিলাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। স্ট্রোলারের সামনে পৌঁছে হাসিমুখে হাত এগিয়ে দিয়ে আনা বলল, “ইয়োর চাইল্ড ইস রিয়েলি সুইট্‌। হোয়াট’স্‌ হিস নেম?”

কালোচুলের মা আনার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, “ওহ্‌, হি ইস ফ্রিৎজ্‌।”


*****

ফ্রিৎজের ছবি তুলেছে আমার ব্রাজিলের বন্ধু আনা। আনা জানাইনা সোওজা। আলাপ হওয়ার পর থেকে অবশ্য আমরা ভারতীয়রা ওকে ‘আনাজানা’ বলেই ডাকছি।


Comments

  1. Ki ashchorjo. Amar dharona chhilo German ra (bachcha ki buro) khub gombhir prokritir hoy. Obviously bhul dharona chhilo. Young Fritz ra bodh hoy sob deshei ekrokom. :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. একেবারে একে অপরের কার্বন কপি হয়, বিশ্বাস কর বিম্ববতী। তবে গম্ভীর বাচ্চাও রাস্তাঘাটে প্রচুর দেখি, তোমার ধারণাটা একেবারে ভুলও নয়।

      Delete
  2. "হাউ আর ইউ” জিজ্ঞাসা করলে “সেয়ার গুট্‌” বলে প্রস্তরকঠিন মুখে চুপ করে থাকে....

    eita aami haare haare bujhechilam jakhon prothom prothom train e uttar europe beratam. prothombar dur palla gari te berlin to amsterdam jachhi...choto kamray facing seats.....aami chara aaro tin jon achey...8 hour ride....bishwas korbe na sarata rasta keu ekti shobdo korlo na :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর এই আমাদের রাজধানী হলে? কথা বলে বলে মাথা খারাপ করে দিত। মনে হত মাঝরাস্তায় চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচি।

      Delete
  3. :-) ki misti bachha :-). darun hoechhe tomader jatrapoth seta lekha porei bojha jachhe, ar mone pore jachhe...onekdin age train e kore Ahmedabad jabar somoi ekta pnuchki bachhar songe bhab jomie phelechhilam, ki je anonde ketechhilo amader train er somoituku.. seshe Ahmedabad station e neme jabar age oi pnutkir pichhon pichhon kamrar aro du charti bachha amader seat er kachhe joro hoe amader 'Dandiya' dekhie gechhilo ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনে ভালো লাগল ইচ্ছাডানা। রাস্তাঘাটে কিছু মজার বাচ্চার দেখা পাওয়া যায় কিন্তু।

      Delete
  4. লেখাটা গোলাপি বুড়ির চুলের মতো । মিষ্টি মিষ্টি
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. ফ্রিৎজ যা মিষ্টি ছিল না, মিঠু। কহতব্য নয়। লেখাটা সম্পর্কে তোমার সিমিলিটাও দুর্দান্ত হয়েছে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. দুই ফ্রিৎজ কে নিয়ে লেখাই খুব ভাল লাগলো... অনেকদিন পর পড়ার সময় পেলাম, গত প্রায় ঘন্টাখানেক অবান্তর থেকে বেরোতে পারিনি - ব্লগটা যেখানে গেছে, অতুলনীয়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. একজন সম্পাদকের কাছ থেকে প্রশংসা পেলে মন এক্সট্রা খুশি হয়। থ্যাংক ইউ সুনন্দ।

      Delete

Post a Comment