শহরে বৃষ্টি



প্যারিসে অবশেষে বৃষ্টি নেমেছে। শহরটার সঙ্গে পরিচয়ের শুরুতেই যে একটা খিটিমিটির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সেটার দায় আমার নয়, প্যারিসেরও নয়। তার আসল দায় বৃষ্টির। এই যদি শুরুতেই ঝিরিঝিরি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির জাফরির মধ্যে দিয়ে শহরটার সঙ্গে আমার দেখা হত---এই এখন যেমন হচ্ছে, সকালে অফিস যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের ছোট্ট নালা দিয়ে তরতরিয়ে বয়ে যাওয়া জল টুকটাক লাফিয়ে পেরোচ্ছি, সন্ধ্যেবেলা মেট্রোর মুখ থেকে বেরোতেই চশমার দু’কাঁচে টুপটাপ দু-ফোঁটা জল পড়ে চোখের সামনে বড়রাস্তার সব লালসবুজ সিগন্যাল ধুয়ে গিয়ে ঝাপসা---তাহলে কি আর আমি ছোটখাটো অসুবিধে গায়ে মাখতে পারতাম?
তাও যদি আমাদের কালবৈশাখীর মতো ব্যাপার হত। সারাদিনের ঘ্যানাপাড়া টিপটিপ বৃষ্টি, তাতেই গোটা শহরের ভোল পালটে দিয়েছে। ফুটপাথে ক্যান্ডির বৈকালিক দোকানের বিক্রি বেড়েছে হুহু করে। লালসাদা ডুরিকাটা শামিয়ানার তলায় বসে দুটো হাসিখুশি মোটাসোটা লোক খুব হাত নেড়ে নেড়ে লোক ডাকে। ডাকের ভাষাটা ইংরিজি তো নয়ই, আমার ধারণা ফ্রেঞ্চও নয়। দোকানির ভাষা বোঝা না গেলে অবশ্য অসুবিধে কিছু নেই, টেবিলের ওপর সারিসারি বাক্সে সাজানো সাতরঙা ক্যান্ডিরও তো নিজেদের ভাষা আছে, সে ভাষা সকলেই বোঝে। সে ডাকে সাড়া না দেওয়ার মতো বেরসিক এখনও পৃথিবীতে বেশি জন্মায়নি। তাছাড়া রোদ ঝলমলে দিনে নিজের সুখদুঃখরাগঅভিমানে, অকাজের কল্পনায় বুঁদ হয়ে হেঁটে চলে যাওয়া যত সহজ, হেমন্তের এই কাকভেজা বিকেলগুলোয় ততটাও নয়। পেছল ফুটপাথে পা টিপে টিপে সাবধানে চলতে হচ্ছে বলে সবার জীবনের গতি আপসেই কমে গেছে অনেক। লেট যখন হয়েই গেছে আর ভেবে লাভ নেই, এই ভেবে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে লজেন্স কিনছে।

আমি কিনছি না। তার কারণ এই নয় যে আমার কোথাও যাওয়ার তাড়া আছে। কারণ হচ্ছে যে আমি কখনওই খুব কিছু লজেন্স-অনুরাগী ছিলাম না। এক ওই মেনলাইনের আদা লজেন্স ছাড়া। আদালজেন্স কেমন দেখতে মনে আছে? কাদাগোলা জল আইসট্রে-তে করে জমালে অনেকটা ওইরকম দেখতে হবে না? আরেকটা ছিল ঝাল লজেন্স, সেটা দেখতে আরও সরেস। কুচকুচে কালোর মধ্যে জমানো চিনির সাদাসাদা ছিটে। খেতে অমৃত। ইচ্ছাশক্তির দ্বৈরথে হেরে গিয়ে মাঝে মাঝে মা আমাকে ঝাল লজেন্সের প্যাকেট কিনে দিতেন। তারপর যুদ্ধের সমস্ত এথিক্‌সের মুখে ঝাঁটা মেরে বলতেন, “এগুলো কী দিয়ে তৈরি হয় জানিস তো সোনা? রাস্তার ধারের নর্দ...” মা’র কথা শেষ হওয়ার আগেই প্যাকেট ছিঁড়ে একখানা লজেন্স টপ করে মুখে পুরে দিতাম আমি। পুরে মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে গা-জ্বালানো হাসি হাসতাম। মা ক্ষান্ত দিয়ে আবার হাতে ধরা দেশের পাতায় ফেরত যেতেন।

কিন্তু আমার মতো ক্যান্ডি-বিরোধী বেরসিকের জন্য বর্ষার সন্ধ্যেয় প্যারিসে আরও নানারকম ইন্দ্রিয়সুখের ব্যবস্থা আছে। মেট্রো থেকে বেরিয়েই স্টারফিশের মতো একটা মোড় পড়ে, তার প্রতিটি কোণায় একটি করে Boulangerie, অর্থাৎ বেকারি। গল্প উপন্যাস স্মৃতিকথায় পড়েছিলাম, এখানে এসে দেখছি সত্যিসত্যিই ফ্রান্সের লোকেরা প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বেকারি থেকে কাগজের ঠোঙায় মোড়া দু’হাত লম্বা ব্যাগেট কিনে বাড়ি ফেরে। তাদের টাটকা রুটির জোগান দেওয়ার জন্য এই সময়টাতেই সব বেকারির নিজস্ব আভেন থেকে থরে থরে টাটকা রুটি বার হয়। সে রুটির গন্ধ একটুখানি যদি আমি শব্দে মুড়ে আপনাদের জন্য পাঠাতে পারতাম, তাহলে তার অপার্থিবতাটা বুঝতে পারতেন। ঠাণ্ডা ভেজা হাওয়ায় কাঁপতেকাঁপতে কুঁকড়েমুকড়ে হাঁটছি, এমন সময় হয়তো রাস্তার পাশের বেকারির দরজা খুলে একজন ব্যাগেট হাতে বেরোলেন। আর সেই একসেকেন্ডের জন্য খোলা দরজা দিয়ে হইহই করে ছুটে এলো তপ্ত, সেঁকা রুটির গন্ধ। আত্মরক্ষার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে সোজা সেঁধোলো বুকের ভেতর। আর অমনি ঠাণ্ডামাণ্ডা কোথায় হাওয়া, পেটের মধ্যে চনমন করে জ্বলে উঠলো খিদে। এই একঘণ্টাও হয়নি অফিস থেকে কফি আর চকোলেট কুকিস্‌ খেয়ে বেরিয়েছি, তা সত্ত্বেও।

চকোলেট কুকিসের কথাই যখন উঠেছে তখন আরেকটা ভালো জিনিসের কথা বলে পোস্ট শেষ করা যাক। বৃষ্টি নামতে না নামতেই, যথারীতি চারদিক থেকে জীবনে সুখবরেরা জড়ো হতে শুরু করেছে একে একে। অফিসের বেসমেন্টে একটা ভেন্ডিং মেশিনের খোঁজ পেয়েছি। কাজে ফাঁকি মারার ইচ্ছে হলেই এবার যখনতখন সেখান থেকে চকোলেট কুকিস্‌ কিনে খাওয়া যাবে। কিন্তু কুকিসের থেকেও বড় সুখবরটা হচ্ছে ভেন্ডিং মেশিনের ঠিক উল্টোদিকে দেওয়ালের সামনে একটা পুরোনো রংচটা টেবিল। টেবিলও বলা যায়, আবার লাইব্রেরিও বলা যায়। অফিসের লোকেরা পড়া-গল্পের বই টেবিলে রেখে দেয়, যাতে বাকি লোকজন ইচ্ছে হলে সে বই নিয়ে পড়তে পারে। ফেলে দেওয়া বই, কাজেই তাদের ভিড়ে ভি. এস. নাইপলের দেখা পাওয়ার আশা করলে পস্তাতে হবে। টেবিলের বেশির ভাগ বইয়েরই ক্লেম টু ফেম হচ্ছে সেগুলো থেকে কোনও না কোনও সময় বিগ বাজেট হলিউডি সিনেমা হয়েছে। (সেগুলোর কোনওটারই পরিচালক স্পিলবার্গ কিংবা নোলান, নিদেনপক্ষে জেমস্‌ ক্যামেরনও নন।) বইগুলোর প্রচ্ছদ হচ্ছে সেই সিনেমারই পোস্টার।

টেবিলভর্তি ফ্রেঞ্চ বইয়ের বেনাবন হাঁটকে সবেধন মুক্তোর মতো একটি ইংরিজি বই উদ্ধার করেছি আমি, তার নাম “দ্য ফার্স্ট ওয়াইভস’ ক্লাব”। নাম পড়ে যেমন হবে ভেবেছিলাম, বইখানা তেমনই। প্রথম দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে ও বই পড়তে খুবই কুণ্ঠা হচ্ছিল। গোটা রাস্তা ছাতা দিয়ে মলাট আড়াল করে রাখছিলাম, পাছে কেউ বইয়ের নাম দেখে আমার বৌদ্ধিক বিকাশের মাত্রা নিয়ে ঝপ করে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিন্তু ওসব করতে গিয়ে অফিসটাইমের মেট্রোর ভিড়ে টাল সামলাতে যারপরনাই অসুবিধে হচ্ছিল। তার ওপর স্টিফেন কিং-এর কথাটাও মনে পড়ে গেল---You want to remember that while you’re judging the book, the book is also judging you. কাজেই এখন কারও তোয়াক্কা না করে বুক ফুলিয়ে চিক-লিট পড়তে পড়তে অফিস যাচ্ছি এবং আসছি। চল্লিশ মিনিটের রাস্তা চার মিনিটে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে।

Comments

  1. '..সেঁকা রুটির গন্ধ' ta ekhan theke ektu pachhi mone hochhe. tobe jeta dukhhu roe galo ta holo bheja Paris er chhobi- r. Abdar ta beshi hoe galo taina? obosso chhobi chharao , sobde mora bristi bheja Paris - Daruun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ছবি তুলতে আমারও খুব ইচ্ছে করে ইচ্ছাডানা। কিন্তু ডি এস এল আর-এর সমস্যা হচ্ছে ঘাড়ে করে ঘোরা বড় শক্ত। এখন বুঝছি লোকে হইহই করে আইফোন কেন কেনে। পকেট থেকে বার করে বোতাম টিপলেই ঝকঝকে ছবি।

      Delete
  2. কুন্তলা, আপনার লেখা পড়লেই অনেক সময়ে মনে হত কার যেন লেখার একটা ছায়া দেখ্তে পাচ্ছি। আজকে হঠাৎ মনে হল আপনার লেখার ধরণটা নবনীতা দেবসেনের মত। সত্যি মিল পাচ্ছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে কী যে বলেন SG. কীসে আর কীসে। থ্যাংক ইউ।

      ছায়া পড়াটা খুব একটা ভালো ব্যাপার না অবশ্য। কিন্তু একে অত শক্তিশালী লেখক, তায় আমার ফেভারিট---দুয়ের মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধ করার শক্তি আমার লেখার নেই, বোঝাই যাচ্ছে।

      Delete
  3. Ekta chhobi missing, greyscale e hole aro bhalo, tobe tomar jol pora chosmar lense er bhetor diye pray shobtai chhobir moton bheshe utheche. Mone hochhilo ami e shei starfisher moton rastar more danriye konar boulangerie gulo dekhte ar shei gondho pachhi.
    Ami amar bondhur bolate prothom chick lit porte shuru korechi 2 bochhor age, beshirbhag e Marian keyes er, boi gulo porar kintu ekta alada e anondo achhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. চিক-লিটের একটা রহস্যময় আবেদন যে আছে সেটা অস্বীকার করার সত্যি উপায় নেই রাকা। রহস্যটা হচ্ছে এত খারাপ লেখা এত জনপ্রিয় হয় কী করে।

      Delete
  4. আহা ওই পাঁউরুটির গন্ধটা আমি কল্পনা করতে পারছি। এখানেও ঐরকম দুয়েকটা বেকারি আছে যার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে। আচ্ছা আপনি ফ্রান্সে গিয়ে হ্যাদ্দেহোয়া খেয়েছেন?
    ঐরকম ফেলে দেওয়া বই পেলে, আর তুলে না আনলে আমার পেট কামড়ায়, তাই যা পাই এনে পড়ি। তবে একবার একটা এত জঘন্য বই পেয়েছিলাম, যে তার পর থেকে প্রবনতাটা একটু কমেছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাদ্দেহোয়া, খুবই বিস্ময়জনকভাবে, এখনও দেখিনি আমি এখানে। তবে চোখকান খোলা রেখেছি, দেখলেই খপাৎ করে কিনে ফেলব।

      ফ্রি জিনিস তুলে না আনলে পেট কামড়ানোর ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন---হাই ফাইভ।

      Delete
  5. Amar ekhono mone ache chotto belay parnasri masir bari jayoarr shomoy Brittania factory cross kore jete joto.....shei gondho ekhono nake lege ache.....khub bhalo laglo lekhata

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইটা একটা মোক্ষম সুগন্ধের কথা বলেছ রণিতা। কেকের কারখানার পাশে বাড়ি হলে কী মজা বল দেখি।

      Delete

Post a Comment