একদিন রাতে



ছোটবেলায় মাঝে মাঝে দেখতাম মিউনিসিপ্যালিটির রিকশা বেরোতে। রিকশার সিটে বসে থাকত ওপাড়ার শম্ভু নয়তো রবি নয়তো ভোমলা। বছর পাঁচেক কোনও এক দাদার পিছু পিছু ঘোরার পর অবশেষে মিউনিসিপ্যালিটিতে তার চাকরি পার্মানেন্ট হয়েছে। পাড়ায় হইচই, ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে। ঘরে ঘরে মায়েরা নিজেদের বেকার ছেলেদের সকালবিকেল গঞ্জনা দিতে শুরু করেছেন, শম্ভুর মতো ‘দাদা-বাছা’য় দূরদৃষ্টি দেখাতে পারেনি বলে।

শম্ভুর হাতে থাকত মাইক, মাইকের তার জোড়া থাকত রিকশার পা রাখার ঢালু জায়গাটায় বসানো একটা বেঢপ কালো বাক্সের সঙ্গে। রিকশা ধীরে ধীরে এপাড়া ওপাড়া দিয়ে ঘুরত, আর নবলব্ধ চাকরির আত্মবিশ্বাস গলায় নিয়ে শম্ভু মাইকে ঘোষণা করত, ‘এতদ্বারা জনসাধারণকে অবহিত করা যাইতেছে যে, নবীনপল্লীর মোড়ের ট্রান্সফর্মার মেরামতি উপলক্ষে অদ্য সন্ধ্যা পাঁচ ঘটিকা হইতে রাত্রি এগারো ঘটিকা পর্যন্ত এলাকায় কারেন্ট থাকিবে না। কারেন্ট থাকিবে না অর্থাৎ কলে জলও আসিবে না। জনসাধারণকে অনুরোধ করা হইতেছে, তাঁরা যেন আগে হইতেই বালতি, গামলা, কুঁজো ও জগে যথেষ্ট পরিমাণে জল ভরিয়া রাখেন।’

গোটা ব্যাপারটায় শম্ভুর সিরিয়াসনেসের অভাব না থাকত না একচুলও, তাও সবাই হাসত। হাসির কারণ শম্ভু বা শম্ভুর সাধু বাংলা নয়, কারণ হচ্ছে অত ঘটা করে লোডশেডিং-এর ঘোষণা। রোজ রাতেই কারেন্ট যায়, পাঁচটা থেকে এগারোটা না হলেও, ছ’টা থেকে দশটা তো বটেই। বাড়তি দু’ঘণ্টার জন্য এত মাইক-রিকশার কামান দাগা দেখে না হেসে উপায় থাকত না।

এখন মিউনিসিপ্যালিটিও আছে, রিকশাও আছে, শম্ভু তো আছেই। শুধু আছে নয়, শম্ভু থেকে শম্ভুদা হয়ে গেছেন নির্ঘাত এতদিনে। তাঁর পিছু পিছু কত ছেলেরা হাত কচলে কচলে ঘোরাঘুরি করছে, মিউনিসিপ্যালিটিতে একটি পার্মানেন্ট চাকরির আশায়। আমিই শুধু নেই। আমি এখন যেখানে থাকি, টাচ উড, সেখানে কারেন্ট যায় না। ন’মাসে ছ’মাসে একবার হয়তো গেল, শীতকালে দিনের বেলা হলে টের পাওয়ার উপায় নেই, শুধু হেডফোনের ভেতর ‘ইয়ে দুনিয়া পিত্তল দি/ হো বেবি ডল ম্যায় সোনে দি’ মাঝপথে নিভে যাওয়া ছাড়া। বিরক্ত মুখে ‘বস্‌স্‌স্‌’ বলে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলতে না তুলতেই আবার গান শুরু।

এই রকম কারেন্ট যাওয়াকে আমরা বলি ‘খাম্বা হিলানো’ কারেন্ট যাওয়া। এই নামকরণের একটা ইতিহাস আছে। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় একবার আমরা সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে বারের বেড়ানো ছিল ‘তীর্থ স্পেশাল’। গয়া, কাশী, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন---সব তীর্থ ঠাকুমাকে এক চোটে ‘করিয়ে’ নিয়ে আসাই ছিল উদ্দেশ্য। বাকি সব জায়গাতেও নানারকম মনে রাখার মত গল্প সঞ্চয় হয়েছিল, কিন্তু এই খাম্বা হিলানোর ঘটনাটা ঘটেছিল খোদ বৃন্দাবনে।

বাঁদর আমি অনেকরকম দেখেছি, অনেক জায়গার দেখেছি, এবং দেখে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে বাঁদরামিতে বৃন্দাবনের বাঁদরদের কেউ হারাতে পারবে না। আমার মাসতুতো দিদির ছেলেকে এককালে যেই দেখত সেই কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, ‘বাপরে বাপ, অনেক বাঁদর দেখেছি ছুটকি, তোর ছেলের মতো আর একটিও দেখিনি’, ছুটকিদির সেই ছেলেকেও বৃন্দাবনের বাঁদররা বলে বলে ফেল ফেলবে। গেস্টহাউসের দরজা মিনিটখানেকের জন্য খোলা রাখার উপায় নেই, এসে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে দৌড় মারত। এমন সব জিনিস যেগুলো ওদের কোনও দরকারেই লাগতে পারে না। ঠাকুমার চশমা, আমার মাথার ফিতে, বাবার হাওয়াই চটি। বাঁদরামি জাস্ট ফর দ্য সেক অফ বাঁদরামি।

সেই গেস্টহাউসে দেখ-না-দেখ কারেন্ট যেত। প্রথমটা আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদই যে ওঁচাতম নয়, তার থেকেও খারাপ পর্ষদ আছে, সেই দেখে। কিন্তু কারেন্ট এসেও যেত তৎক্ষণাৎ। আসত, আবার পাঁচমিনিট পরে যেত, আবার দু’মিনিট পরে আসত। দিনকয়েক চলার পর কৌতূহল চাপতে না পেরে বাবা গেস্টহাউসের কেয়ারটেকারকে রহস্যটা জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন।

কেয়ারটেকার মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ‘কেয়া করে বাবু, বান্দর খাম্বা হিলাতা হ্যায়, তার ঢিলা হোকে কারেন্ট চলা যাতা হ্যায়। ফির কিসিকো যাকে খাম্বা হিলানা পড়তা হ্যায়।

কারেন্টের যাওয়াআসা সম্পর্কে আগেভাগে সতর্ক করার জন্য আমার আশেপাশে এখন শম্ভু, শম্ভুর মাইক, রিকশা কিছুই নেই। তাই সেদিন সন্ধ্যেবেলা যখন জোরে হাওয়া দিল, আমি বুঝতেই পারিনি সে হাওয়া কোনদিকে গড়াতে চলেছে।

হাওয়ায় তেজ ক্রমে বাড়ল জানালার বাইরের বাড়িওয়ালার সাধের সজনেডাঁটা গাছের দুলন্ত মাথায় এতক্ষণ হাওয়ার চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম শুধু, এখন পাটে পাটে বন্ধ করা কাঁচের জানালার ওপাশ থেকে তার শোঁশোঁ গর্জনও কানে এল। মা ওষুধ কিনতে বাজারে গেছে। বাড়ি ফিরবে কী করে কে জানে। ছাতা নিয়ে যায়নি তো। ভাবতে না ভাবতেই একটা ভীষণ সাদা আলো ঝলসে উঠল জানালার বাইরে . . . সজনেগাছ, বারান্দা, বারান্দার ফোল্ডিং আলনায় ঝোলানো আমার টি-শার্ট একঝলকের জন্য চোখের ওপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল . . . ব্যস্‌ তারপর আর কোথাও কিছু নেই। চারদিকে ঘুরঘুটে অন্ধকার।

অন্ধকারে চুপ করে শুয়ে শুয়ে ঝড়ের আওয়াজ শুনতে লাগলাম। ঝড় বাড়ল, বিদ্যুৎ চমকাল, গুড়গুড় করে বাজ ডাকল, একটু পরে নিচের তলার ভাড়াটেদের একফালি বারান্দার সবুজ রঙের ছাদে বড় বড় জলের ফোঁটার শব্দ হতে লাগল। ঠাকুমার কথা মনে পড়ল। বড় ফোঁটার বৃষ্টি নাকি বেশিক্ষণ থাকে না। তাই যেন হয়, যেন বৃষ্টি তাড়াতাড়ি ধরে যায়, যেন তাড়াতাড়ি কারেন্ট চলে আসে।

দু’মিনিট গেল, পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল। বুঝলাম এ খাম্বা-হিলানো কারেন্ট যাওয়া নয়, এ লোডশেডিং-এর পেডিগ্রি আছে। মহা চিন্তা হল। কারেন্ট না এলে জীবন চলবে কী করে। টিভি না চলে না চলুক, কিন্তু ইন্টারনেট? অবান্তর পাহারা দেওয়া যাবে না, ইউটিউবে টার্টে টার্টাঁর রেসিপি দেখা যাবে না, মিডসমার মার্ডারসের একশোবার দেখা এক-একটা এপিসোড, আবার নতুন করে দেখা যাবে না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে রইলাম। মোমবাতি কোথায় জানি না, বাড়িতে আছে কি না তাই বা কে জানে। একবার ফোন করে মাকে বললে হয় নিয়ে আসতে। ভাবতে ভাবতেই দরজায় টোকা। লেংচে লেংচে উঠে দরজা খুলে দিলাম।

পেছনের গলির স্ট্রিটল্যাম্পটা জ্বলছে, তার আলোয় ঘরের কিছু কিছু অংশ আবছা দেখা যাচ্ছে। সেটা বিপজ্জনক। কারেন্ট যাওয়া নিয়ে অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তারা বুঝবেন। সারাপাড়ার আলো গেলে একরকম। রাস্তার একদিকের আলো গেছে, অন্যদিক দিব্যি ঠিকঠাক---তাহলেই ঝামেলা। তখন যাদের দিকের আলো গেছে তাদের উদ্যোগ নিয়ে ইলেকট্রিক অফিসে ফোন করতে হবে, স্যার স্যার বলে ডাকাডাকি করতে হবে। এখানও সে রকম কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে। গলির ওপারের বাড়িগুলোর জানালা থেকে উজ্জ্বল আলো ছিটকোচ্ছে। ভেতরে নিশ্চয় পুরোদমে সিরিয়াল চলছে, ইউটিউব খুলে কেউ টার্টে টার্টাঁ কী করে বানাতে হয় শিখে নিচ্ছে মনোযোগ দিয়ে।

বাইরে থেকে আসা আলোয় হাতড়ে হাতড়ে মা কোথা থেকে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আনলেন। ও ঘরের অন্ধকার থেকে মোমবাতি হাতে বেরিয়ে এলেন, ঠিক মনে হল মিউজিয়ামের দেওয়ালে টাঙানো একটা পেন্টিং। পুরো পেন্টিং নয়, খানিক তফাৎ আছে। পেন্টিং-এর মহিলাদের হাতে সাধারণত আলো ছাড়া কিছু থাকে না, মায়ের একহাতে মোমবাতি, অন্য হাতে একটা বাটি। বাটিতে চামচ গোঁজা।

মোমবাতি সাবধানে টেবিলের ওপর নামিয়ে বাটি আমার হাতে দিলেন মা। আলোআঁধারি বাটির ভেতর উঁকি দিয়ে দেখি অফ-হোয়াইট মুড়ির বিছানা। আর সে বিছানার ওপর শুয়ে আছে নরম তুলোর মতো দুটি দুধসাদা রসগোল্লা।

উঁকি দিয়ে দেখলাম আর অমনি কী যে একটা ঘটে গেল। স্টিলের বাটির ভেতর পনেরো টাকা প্যাকেটের মুড়ি, আর দশ টাকা পিসের রসগোল্লাটোল্লা সব বদলে গিয়ে হয়ে গেল একটা চমৎকার পোর্ট-কি, আর তাতে চড়ে আমি সোজা গিয়ে উপস্থিত হলাম আমাদের বাড়ির ছাদে। একসঙ্গে পনেরোশো কিলোমিটার আর কুড়ি বছরের দূরত্ব নিমেষে সাবাড়।

দেখলাম আমি ছাদে বসে আছি। আমার নিচে মাদুর, মাদুর ফুঁড়ে সারাদিন রোদ খাওয়া তপ্ত ছাদের আঁচ উঠে আসছে। চারদিক অন্ধকার। ডানদিকে গাছপালা ফুঁড়ে অমিতকাকুদের জেনারেটরের আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের জেনারেটর নেই কিন্তু এমারজেন্সি লাইট আছে। সেটা এখন পাশে রাখা। তার ফুল চার্জ পাওয়া দুটো রোগা রোগা টিউবলাইট বাঘের চোখের মত সোজা ফোকাস করেছে সামনে খুলে রাখা অঙ্ক খাতার পাতার ওপর। পাতায় ঐকিক নাকি সরল, সে সব কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে কিছুক্ষণ আগে এই অঙ্ক নিয়েই একটা ভীষণ বকাবকি হয়েছে। বকেছেন মা, বকা খেয়েছি আমি। হোমওয়ার্ক দিয়ে অফিসে গিয়েছিলেন, আমার কাজ ছিল গরমের ছুটির দুপুরে বসে বসে সব অঙ্ক সেরে রাখা। আমি আমার কাজে ফাঁকি দিয়েছি। মা এসে নিজের কাজ করতে গিয়েই সেটা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। পরিণতি---লোডশেডিং-এর মধ্যে মাদুর, এমারজেন্সি লাইট ও কেশব নাগ-সহ আমার ছাদে নির্বাসন।

জাজের মেজাজ বেশি কড়া নয়, তাই নির্বাসন বেশিক্ষণ সইতে হত না। স্নান করে, হাতপাখা নিয়ে মা ওপরে আসতেন। সন্ধিস্থাপনের জন্য কোনওদিন মুড়ির সঙ্গে আসত রসগোল্লা, কোনওদিন বোঁদে, কপালের শিকে মাঝেমধ্যে ছিঁড়লে, সিঙাড়াও।

একআধটা তো নয়, হাজার হাজার লোডশেডিং-এর রাত কাটিয়েছি আমি আমাদের ছাদের ওপর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমি আর আমার ঐকিক অঙ্ক, মুড়ির বাটি, মা, বাবা, ঠাকুমা, আশেপাশের ছাদে আমার প্রতিবেশীরা। প্রায় একটা গোটা জীবনই বলা চলে। নিচের তলার জীবনটার মতো নয়, তার থেকে ভালো। স্নানে যাওয়ার তাড়া নেই, খেতে বসে মাকে গাজরসেদ্ধ মাখতে দেখার আতঙ্ক নেই। অঙ্ক আছে, কিন্তু সে আর কতক্ষণ। একটু পরেই এমারজেন্সির চোখ ঘুমে ঢুলে আসবে, আর চোখে খাটো মেয়ের ওপর মায়ের দয়া হবে। তখন বইখাতা মুড়ে রেখে ছাদের অন্ধকারে ঘোরফের, গান গাও, আমগাছের ঝুপসির আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তা দিয়ে টুং টুং বেল বাজিয়ে যাওয়া সাইকেলযাত্রীদের চেনা যায় নাকি তার পরীক্ষা নাও।

গোটা একটা রাত যেমন করে খুশি নষ্ট কর।

ভাবতেই শিউরে উঠলাম। পোর্ট-কি আবার হুশ করে পনেরোশো কিলোমিটার আর কুড়ি বছর পেরিয়ে আমাকে আমার বর্তমান খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল। যেখানে মোমবাতির নিষ্কম্প শিখার আলোয় বসে বসে আমি মুড়ি-রসগোল্লা খাচ্ছি। খাচ্ছি আর ভাবছি, এই যে কর্মহীনতায় জলের মতো বইয়ে দিচ্ছি সোনার থেকেও দামি সময়, এর কি কোনও ক্ষমা আছে?

কুড়ি বছরে কত বদলায় মানুষ। মানুষের চোখ। কারেন্ট যাওয়াকে আর ‘ছুটি ছুটি, মুড়ির বাটি!’ মনে হয় না। বাড়ি থাকলেই তার একটা ছাদ থাকতে হবে, এ বাড়িরও আছে। মনেই পড়ে না এই সুযোগে সেই ছাদটায় পালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কেজো মন যুক্তি দেয়, ছাদ আছে, কিন্তু সে ছাদ তোমার নয়। বাড়িওয়ালা উঠতে দেবে কেন? পোর্ট-কি চেপে সদ্য ঘুরে আসা মন তর্ক ছাড়ে না। আচ্ছা ছাদের কথা না হয় ছাড়লাম, বারান্দা তো আছে। এখন না হয় পা ভেঙেছে, সুস্থ থাকলে যেতে বুঝি সেখানে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়াতে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোদাতালার আকাশবাতাস দেখতে? চিলতে পার্ক? গলি দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ? এ গলিটা দু’দিকের বাড়িরই ব্যাক-সাইড বলে হাঁটার সময় সবাই ভাবে কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না বুঝি। দোতলা থেকে নজর রাখতে পারে যে কেউ, সে সম্ভাবনা মাথায় খেলে না। কাজেই লোকে ফ্রি হয়ে হাঁটে। রাশভারি একটা লোক, ভুরু কুঁচকে চলতে চলতে হঠাৎ ঝুঁকে দাঁড়-করানো গাড়ির কাঁচের আয়না দেখে চুল ঠিক করে নেয়। আরেকটু রসিক প্রকৃতির যারা তারা হয়তো দু’কলি গেয়েই ফেলল। দুইয়ের বেশি তিনটে ছেলে থাকলে মাঝে মাঝে থেমে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দেয়। একটাই সিগারেট, গন্ধ অন্য সিগারেটের থেকে অনেক বেশি কড়া।

এখন কারেন্ট যাওয়া মানে শুধু সময় নষ্ট। অমূল্য সময়। প্রোডাকটিভ সময়। টার্টে টার্টাঁর রেসিপি শেখার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল ভেবে হাত কামড়ানো। এখন ছুটি মানে শুধু আফসোস আর আফসোস।

সেদিনের লোডশেডিং-টা এতক্ষণই চলল যে আফসোসও ক্লান্ত হয়ে বাড়ি চলে গেল। মুড়ির বাটি ফাঁকা হয়ে গেল, মোমবাটি বেঁটে হয়ে এল। ঝড়েরই শুধু থামার লক্ষণ নেই। আমরা খাটে শুয়ে শুয়ে নানারকম কথা বলতে লাগলাম। নতুন কথা, পুরনো কথা। অনেক দিনের ভুলে যাওয়া একটা গান, চরম আনকুল, কেউ ‘গাও দেখি’ বললে ভুলেও কোনওদিন সে গান গলা দিয়ে বার করি না, সেটার কথা মনে পড়ে গেল। সত্যভারতী ইস্কুলের মেয়েরা প্রার্থনায় গাইত। ‘তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে।’ প্রথমবার শুনে ‘কর’ আর ‘করে’ এমন বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ দেখে ইমপ্রেসড হয়েছিলাম মনে আছে। ইমপ্রেসড হয়ে শুনে শুনে গোটা গানটা শিখে নিয়েছিলাম নিজে নিজে। ‘প্রভু বিশ্ববিপদহন্তা, তুমি দাঁড়াও রুধিয়া পন্থা’। প্রভু কে জানি না, আদৌ কেউ আছে কি না সে নিয়েও সন্দেহের অভাব নেই, তবু লাইনদুটো গাইবার সময় কেমন করে বুকের ভেতর। সব দোষ গানের সুর আর কথার ধর্মাবতার, আমার নয়।

একসময় কথা ফুরোল, গানও। অন্ধকারে শুয়ে রইলাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, অখণ্ড অবসর কি এইরকমই দেখতে হয়? ছুটি কি একেই বলে?

অনেক রাতে, মোমবাতি তখন নিভেও গেছে বোধহয়, আধোঘুমের মধ্যে একটা শব্দ পেলাম। ফ্রিজ চলতে শুরু করেছে। কারেন্ট এল। আধসেকেন্ডের জন্য মনে হল ই-মেলটা একবার চেক করে নিই? সে চিন্তাকে আর বাড়তে দিলাম না। বকেঝকে নিজেকে ফের ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।  

                 

Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। অনেক ছোটোবেলার কথা মনে পড়ল। পা শিগগিরি ভালো হোক - এই আশা থাকলো

    ইনিয়া

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাঙ্ক ইউ, ইনিয়া।

      Delete
  2. বাঃ, শুধুমাত্র একটা পাওয়ারকাট নিয়ে এত কথা লেখা যায়?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আরে কাজ না থাকলে যা হয় আরকি।

      Delete
  3. :-) onek onek purono kotha mone korie dile. somoi kato tofat ene dai se kothao...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও ভীষণ অবাক হয়ে যাই ইচ্ছাডানা, সময়ের কেরামতি দেখে।

      Delete
  4. Replies
    1. আমি তো বুড়োই হয়ে গেলাম, রাখী।

      Delete
  5. এটা একটা অদ্ভুত ভাল লেখা। :)
    সারাদিন পর মনটা কেমন ভাল হয়ে গেল। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ অরিজিত।

      Delete
  6. Lekha bhalo, kintu pore amar mon ektu o bhalo holo na, anek purono smriti khuchiye emon dhulo bali oralen... Tar e kichhu chokhey pore .. Chokh ta bodo jwala korchhey.
    Load shedding..chhoto belar hotath porar fakey, sei pore paoa ektu annyo somay. Lompho/mombati jwala andhokar ghore, elomelo haoatey dulte thaka nijeder chhaya tokhon nijeder e achena. Baire megh na thaka akase kokhono jhokmokey Tarader jege otha. Kokhono megh brishtir dine gurum garum megher dakey paoa bhoy er sathey palla diye chhaya gulor aro beshi kore dule chola. Ma er kol e matha rekhe suye pora ba kokhono ma er e chokh lukiye mombati r lompho niye didir sathye bose nana keramoti. Abar gorom er dupur e nischal fan er dikey takiye hath pakha nartey nartey ghamtey ghamtey klantow hoye ghumiye pora ... Ei sob e tow smriti hoye gechhey ajker inverter/generator er jugey. Mombati ekhon sudhu diwali r jonmodin e jole, lompho ... Kawjon er ghore achhey ke janye, ar hathpakha sudhu bodhoy jamai soshthi(amra bangal ki na)tei kaje lage.. Ar sei bhule jaoa chhotto chhotto smriti beye amader boro hoye othar tukrogulo jokhon hothath mone pore jai .. Bujhte pari na .. Bhalo lagchhey na kharap lagchhey.... Tai khanikta baje prolap boke nilam ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাতপাখা নিয়ে ঘামতে ঘামতে ঘুম - চেক। লম্ফ (আমাদের বাড়িতে আবার কুপিও বলে) - চেক। বাঙাল - চেক চেক চেক। আপনার খেলার সঙ্গী দিদি ছিল, আমি একাবোকা্‌ এইটাই যা তফাৎ। প্রলাপ কিছুই নয় আত্মদীপ। এই রকম রাত আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে তো, কাজেই তার কথা ভোলা মুশকিল। আপনার আমার থেকে বেশি মনে আছে অ্যাকচুয়ালি, বর্ণনা পড়ে বোঝা যাচ্ছে।

      মিঠাই কেমন আছে?

      Delete
    2. Bhulei tow gechhilam, apni e tow mone koriye dilen :) ... Mithai naam ta mone achhey dekhey darun laglo ... se dibbi achhey :)

      Delete
  7. Rajanikanta-r gaan ki, na ki Atulprasad ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখেছেন ঘনাদা। ভাগ্যিস কথাটা তুললেন। কাল মা যখন জিজ্ঞাসা করছিলেন, আমি বুক ফুলিয়ে বলে দিলাম 'অতুলপ্রসাদ, অতুলপ্রসাদ'। আজ আপনার কমেন্ট পড়ে গুগল করে দেখি, রজনীকান্ত।

      http://banglasonglyrics.com/1793/%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%AE/

      Delete
  8. দারুণ .... ছোটবেলার অনেক কথা মনে পড়ে গেল ... আর মনে হল এই গানটার কথা ... শুনেছেন নিশ্চয় ...
    http://nagorikkobiyal.info/%E0%A6%B9%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A7%8E-%E0%A6%9B%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A6%BF/

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী সাংঘাতিক, এই গানটা আগে শুনিনি তো! থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ পিয়াস। ইস, সুমনের সঙ্গে মত মিলেছে দেখে কী খুশি যে হচ্ছি।

      তোমার সব ভালো চলছে আশা করি পিয়াস। গরমে আসছ নাকি দেশে?

      Delete
  9. নিচের দিকে গানের অডিওর লিঙ্কটা চলেছে তো?
    গরমে দেশে ফিরব কিনা এখনো জানিনা ... :-(
    আপনাকে জানানো হয়নি ... বন্ধুকে দিয়ে দু'কপি অবান্তর কিনিয়ে ফেলেছি ... অবান্তর হাতে পাওয়াটাও দেশে ফেরার একটা বড় আকর্ষণ ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. চলছে চলছে, গানটা শুনে সুমন পোকা নড়েচড়ে উঠেছে মাথায়, এখন, এই মুহূর্তে বাজছে 'এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া।'

      কাল শুভ মহরৎ হচ্ছিল টিভিতে। সেখানে নন্দিতা দাশ অনিন্দ্যকে সেই বলছেন না, আপনাকে আমি থ্যাংক ইউ দিচ্ছি, আবার দিচ্ছিও না... অবান্তর কেনার ব্যাপারে তোমাকেও আমি থ্যাংক ইউ দেব কি দেব না ভাবছি। দেওয়া নিশ্চয় উচিত, আবার মনে হচ্ছে পিয়াসকে থ্যাংক ইউ বলাটা বেশি ফর্ম্যাল হয়ে যাবে। তাই বলছিও না।

      Delete
    2. হে হে, আমারও মাঝে মাঝে অমন সুমন-ম্যারাথন চলে ...
      থ্যাংক ইউ একেবারেই দেবেন না ... আপনার এত্ত ভাল ভাল লেখা পড়ে আমি থ্যাংক ইউ বলি নাকি? :-)

      Delete
    3. যাক, বাঁচালে।

      Delete
  10. Kuntala ki bhalo lekha ...Ar kotodin bade ei gaanta mone pore gelo..ekhon youtube e sunchi..amar 4 bochorer cheler khub bhalo legeche tai otai repeat hochee..aaj school bunk koreche se...Ar ki mil..kal amio subhomohorot dekhechii...

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ বাঃ, স্কুল বাংক করা উচিত মাঝে মাঝে। স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কোন গানটা শুনছ গো, সুমন না রজনীকান্ত? শুভ মহরৎ আমার এত ভালো লাগে দেখতে, বিশেষত রাঙাপিসিমাকে, টিভিতে দিলেই দেখি।

      Delete
  11. Rojonikanto.....Ar swastha bhalo na bolei school bunk ..nahole edeshe ei boyose sokal theke sondhye obdhi school hole ki hobe ..kono porasuno nei..khata pencil nei..sob i hoy khelar chole..abar dekhi last week e ekta mojar science dvd pathieche school theke...na bujhei amar chele reaction,microbiology esob bolche..bhalo ki kharap janina..tobe or kache science ta naki magic.r school mane anonder jayga...r rangapisima te rakhike amar eto bhalo legeche..pore arekta story dekhechilam..tahar naam ti ranjana..okhane jini ranga pisima hoyechilen bhalo lage onake..tobuo rakhi i amar ei choritre beshi pochondo..

    ReplyDelete
  12. লোড শেডিং তো চিরকাল খারাপ জিনিস বলেই জেনে এসেছি। সেটা নিয়ে যে এত সুন্দর একটা লেখা হয় কে জানত? (অপ্রাসঙ্গিক, তাও বলি, কাল সন্ধ্যেবেলাই বাড়ি ফিরতে ফিরতে সানডে সাসপেন্সে সত্যজিত রায়ের "লোড শেডিং" গল্পটা শুনছিলাম। আমার খুব প্রিয় একটা গল্প।) মুড়ি আর রসগোল্লা খাওয়ার গল্পটাকে ইগনোর করলাম। লোড শেডিং এ ছাদে যাওয়া আর কেশব নাগ শুনে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সত্যি, এখন জোর করে ছুটি ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও যেন মনে হয় কত কি রাজকার্য মিস হয়ে গেল! আর ইন্টারনেট ছাড়া মানুষে বাঁচে? তাও কি সম্ভব?

    আরেকটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেই ফেলি এ প্রসঙ্গে, আজ ইন্টারনেটের ২৫ বছরের জন্মদিন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেকি ইন্টারনেটেরও যৌবন চলে গেল দেখছি। স্যাড।

      Delete
  13. বেশ ভালো লাগলো পড়ে - btw আমার নামটাও কিন্তু প্রায় আপনার (না তোমার?) মতো !!! তাই মাঝে মাঝে আমার ব্লগ-এও ঢুঁ মারলে ভালো লাগবে !!
    http://kuntalm.blogspot.com/

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয় নিশ্চয় কুন্তল।

      Delete
  14. aha ki sundor lekha...chotobelar loadsheding er chader kotha mone koria dilen...aha seki bhalo dinguli chilo..

    btw..apni 10 taka damer rosogolla khachhen r বেবি ডল ম্যায় সোনে দি gan sunchen..pa bhangar side effect?

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ সৌমেশ।

      Delete
  15. Darun lekha. Pore khub bhalo laglo.

    ReplyDelete
  16. porte porte amar o chotobelar loadhsheding kaler kotha mone pore gelo.. sondhye holei jhup kore ondhokar, amra tokhon koyek bochorer jonye tangra r bhitorer dike office quarters e thaktam, sekhane ondhokar mane sotyi nischidro ondhokar.. sobai mile madur jol muri ei sob niye chad e chole jetam. bishal chhad, sob flat thekei babar onyo sob colleague ra tader poribar somet uthe esechen, hu hu hawa, pasher narkel gach ta haway dule uthlei tate chiler basa theke bhoy peye jede othe chiler chana ra, r tar modhye baba ar aro aneke mile anek anek gaan.. kokhono sokhono porkkhar age na hole oi ghonta dui amar bishudho chuti i thakto.. sei raat gulo i amar kalpurush prothm chenar somoy, prothom jim corbett er ga-chomchom shikarkahini shonar somoy..
    Nirmolo koro gaan tao bhishon bhalo lage amar, er modhyei akdin khub mathay ghurchilo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইয়েস ইয়েস স্বাগতা, নারকেল গাছ। আমাদের বাড়িতেও আছে, কিন্তু চিলের বাসা নেই। তোমাদের লোডশেডিং-এর ছাদের গল্প শুনে খুব ভালো লাগল। গানটা কী মন ভালো করা না?

      Delete
    2. hya, oi bari te thakar tin te bochor emni te practical osubidhe khub hoyechilo, kintu otherwise jayga ta bhari sundor chilo..

      Delete
  17. কে যেন বলেছিলেন আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটলে সময় থমকে যায়। আর তার চেয়েও বেশি গতিতে ছুটলে সময় পিছিয়ে যায়। আপনার 'লোডশেডিং' আলোর চেয়েও বেশি গতিতে ছুটল.....আমাদের সঙ্গে নিয়েই। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. তাই? গুড গুড শঙ্খদীপ। অবান্তরে নতুন মনে হচ্ছে? সুস্বাগতম। কমেন্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
    2. হ্যাঁ, বাংলা ব্লগ ফলো করা শুরু করেছি সম্প্রতি। এবং ফলো করা টা যে ফলপ্রসূ হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। :)

      Delete

Post a Comment