বাংলা বাঁচাও / শেষ পর্ব



চিন্তামণি একটি সোফা পুরোটা দখল করে চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছেন। বিনীত সোফার হ্যান্ডেলে বসে খবরের কাগজ নেড়ে নেড়ে তাঁর মাথায় হাওয়া করছে।

প্রকাশঃ বন্ধুগণ, শ্রদ্ধেয় চিন্তামণিদা অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য আমাদের সভা খানিকক্ষণ স্থগিত ছিল। আপাতত উনি খানিকটা সুস্থ বোধ করছেন। তাই তো দাদা?

চিন্তামণি শুয়ে শুয়েই ডান হাত আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলে সম্মতি জানালেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে কথা বলার অবস্থা তাঁর এখনও আসেনি।

প্রকাশঃ কাজেই আমাদের সভা আবার শুরু হচ্ছে। আমরা সিনিয়রিটি অনুযায়ী বক্তার ক্রম সাজানোর চেষ্টা করেছি। যাতে কেউ পার্শিয়ালিটির অভিযোগ আনতে না পারে, হে হে। আমাদের লিস্ট অনুযায়ী চিন্তামণিদা’র পর বাংলাভাষা বাঁচানো নিয়ে সভায় বক্তব্য রাখবেন আমাদের সবার প্রিয় মায়াবীদি।

বেচারামঃ জিয়ো মায়াবীদি, হয়ে যাক হয়ে যাক।

মায়াবীঃ সেকী, আমার থেকে সিনিয়র কেউ নেই নাকি এখানে? আমাকে কিন্তু দেখে বোঝা যায় না, আমার খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছিল তো। আমার এই গত অক্টোবরে সাঁইত্রিশ হল।

বেচারামঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ...ইয়ে মানে, আমার হঠাৎ একটা ভীষণ মজার চুটকি মনে পড়ে গেল... কিন্তু সিরিয়াসলি মায়াবীদি, আপনাকে দেখে কিন্তু বোঝাই যায় না, হেব্বি মেন্টেন করেছেন কিন্তু। আমি মাইরি টেনেটুনে তেত্রিশ ভেবেছিলাম।

মায়াবীঃ ধ্যাত, কী যে বল।

বেচারামঃ আরে বাই গড। পরিমলদা ইস আ রিয়েলি লাকি চ্যাপ। আপনার সিক্রেটটা কী বলুন দেখি? আমার বউকেও একটু টিপস-ফিপস দিন।

মায়াবী (লজ্জিত হেসে): তুমি পারও বটে।

বেচারামঃ উফ, মায়াবীদি, ফিদা ফিদা। আপনাকে হাসলে যা লাগে না। মাধুরী ফাধুরি কোথায় লাগে। আপনি সবসময় চোখের ক্লোজ আপ ছবি সাঁটেন কেন দিদি, মাঝে মাঝে হাসির ক্লোজ আপ সাঁটবেন, আপনার ফ্রেন্ডরা পাগল হয়ে যাবে।

চিন্তামণিঃ বলি, এবার একটু সভার কাজ শুরু করলে হয় না?

বিনীতঃ এই তো দাদা কথা বলেছেন, দাদা? এখন একটু ভালো বোধ করছেন দাদা?

প্রকাশঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার সভার কাজ শুরু করা যাক। তাহলে সিনিয়রিটির দিক থেকে এখন কে বলতে উঠবেন? কবি? কবি?

কবি একমনে ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।

বেচারামঃ দাদা, আরে ও দাদা, আরে ও দাদাআআআ, আপনার টার্ন, যান গিয়ে বাংলা বাঁচান।

কবিঃ ওহ্‌ আমাকে এখন বলতে হবে বুঝি? কিন্তু আমি তো কিছু তৈরি করে আনিনি।

বেচারামঃ আরে তৈরি আবার কীসের? যুদ্ধে যাচ্ছেন নাকি। ইস্কুলে এক্সটেম্পোর করেননি?

কবিঃ আসলে আমি তো খুব নির্জন লোক, আমি মোটে লোকের সামনে কথা বলতে পারি না।

বিনীতঃ আহা, একেই বলে কবি, কেমন সুন্দর বললেন, নির্জন লোক, নি-র-জ-ন, শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন সন্ধ্যেবেলার খাঁ খাঁ রেলস্টেশন হয়ে যায় . . .

প্রকাশঃ আরে কেয়া বাত কেয়া বাত বিনীত, তুমিও তো ফাটিয়ে দিচ্ছ। ‘সন্ধ্যেবেলার রেলস্টেশন’, তোফা, উমদা।

বিনীতঃ ভালো হয়েছে? এই সকলের পায়ের কাছে বসে কিছু কিছু শেখার চেষ্টা করেছি আরকি।

বেচারামঃ অলরাইট, তার মানে কবি বলতে চান না। নেক্সট?

কবিঃ আমার খাতাখানা তো সঙ্গে আছে, যদি সময় থাকে তবে আমি সেখান থেকেই না হয় দু’খানা কবিতা...

বেচারামঃ কত বড় কবিতা? দশ লাইনের বেশি হলে একটা বললেও অসুবিধে নেই।

প্রকাশঃ এবার আমাদের সামনে কবিতা পড়ে শোনাবেন আমাদের নির্জন কবি।

কবিঃ আসলে আমি খুব সাধারণ মানুষ জানেন . . . নিঝুম মানুষ . . .  বেশি কথা বলতে পারি না . . . আমার যত যাপন সব গাঁগঞ্জের মেঠো সখাদের সঙ্গে . . . তাদের সাথেই আমার সারাবেলা হইহই টইটই . . . তাদের সাথেই আমার গালভরা পান্তাভাত . . . তাদেরই দখিনা আঙিনায় এলোমেলো ঘুরে মরি আমি . . . আদাড়বাদাড় থেকে খুঁটে খুঁটেএএএএ . . . খুঁড়ে খুঁড়েএএএএ . . . কবিতার বীজ তুলে আনি . . . এনে টেবিলের ফুলদানিতে বুনে দিই . . . বীজগুলি রাতভর ফুল হয়ে ফোটে . . . সে ফুলের নিঃশ্বাসে সারারাত জমজমাট হই . . . সকালে উঠে দেখি আমি আর আমি নেই . . . আরশির ভেতর থেকে অন্য কেউ চেয়ে আছে . . .

বিনীতঃ উঃ, মাগোদেখুন দেখুন আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠেছে, দেখুন দেখুন, চিন্তামণিদা? দেখতে পাচ্ছেন?

বেচারাম (হাততালি দিতে দিতে) আরে মামা, কেয়া বাত কেয়া বাত। ফাটিয়ে দিয়েছেন গুরু। নেক্সট কবিতা।

কবিঃ সেকী এটি তো কবিতা ছিল না, এটি তো মুখড়া।

বিনীতঃ মুখড়াতেই এই, অন্তরায় পৌঁছে কী হবে ভাবতে পারছেন, অ্যাঁ চিন্তামণিদা?

চিন্তামণিঃ জ্বালালে দেখছি। তুমি পারলেই হবে। আমার পারার দরকার নেই। যত্তসব।

প্রকাশঃ আঃ বেচারামদা, কবিকে এত তাড়া দেবেন না। আপনারা কবিতা লেখেন না তাই বোঝেন না। কবিতা হল নদীর মতো, তাকে নিজের গতিবেগে বইতে দিতে হবে, না হলে যে কী হবে তা অকবিরা কল্পনাও করতে পারবে না। আপনি বলুন কবি। আমাদের সমৃদ্ধ করুন।

কবিঃ আমার কবিতাটির নাম হল, ‘মশার প্রশ্ন’।

কাল মাঝরাতে

রোজকার মতো

নিজের মুখোমুখি শুয়ে আছি –

মায়াবী নীল মশারির গায়ে গায়ে, পায়ে পায়ে ঘুরছে

মশার দল,

ঘুরছে

ফিরছে

আর

জানতে চাইছে

কেন? কেন? কেন?

কেন এই প্রতিরোধ?

কীসের ভয় আমার?

শুধু কি

ম্যালেরিয়া?

নাকি আরও গভীর কোনও ভয় কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে?

আমি

পালাতে চাইছি

প্রাণপণ

দৌড়চ্ছি

হাঁপাচ্ছি

পাঁজরের খাঁচার আগল ভেঙে হৃৎপিণ্ড ফেটে বেরোতে চাইছে

বুকপকেটের সেলাই কেটে পালাতে চাইছে

ওয়ালেট

কিন্তু আমি পালাতে দিচ্ছি না

দেব না কিছুতেই

ঘামছি

জানছি

চিনে নিচ্ছি সব শালাকে

ক্রুদ্ধ

বিক্ষুব্ধ

সন্তপ্ত


চড়াইপাখির মতো প্রকাণ্ড

মশারা –

এখনও প্রতিরাতে

আমাকে

অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।


সূচীভেদ্য নীরবতা।

বিনীত (ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে) কবি,  কবি, কী করে এমন লেখেন কবি? আমি নাড়া বাঁধব আপনার কাছে, কবি। আমাকে ফেরাবেন না, না না না . . . ফেরাবেন না। সবাই আমাকে ফিরিয়ে দেয় জানেন কবি, অন্তত আপনি আমাকে ফেরাবেন না . . .

কবি বিব্রত হয়ে বিনীতকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। মায়াবী আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ খোঁচাতে লাগলেন। একমাত্র বেচারাম মুখ অল্প হাঁ করে প্রস্তরমূর্তির মতো বসে রইলেন। দেখে মনে হচ্ছিল ভদ্রলোকের মাথায় বজ্রাঘাত হয়েছে।

প্রকাশ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) এর পরেও যারা বলে যে আধুনিক কবিতার মানে বোঝা যায় না, তাদের আর কিছু বলার নেই আমাদের।

চিন্তামণিঃ আরে পড়াশোনা না করা পাবলিক কে কী বলল তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা কী বললাম, বলছি, এবং বলব---তা সে কেউ শুনতে চাক আর না চাক---সেটাই হচ্ছে জরুরি।

প্রকাশঃ সেই। যাই হোক, সভার কাজ অগ্রসর করা যাক। মায়াবীদি, কিছু বলুন।

মায়াবীঃ আমি আর কী বলব, মানে . . . চিন্তামণিদার মতো প্রাজ্ঞ লোক, প্রকাশের মতো প্রতিশ্রুতিমান লেখক, কবির মতো কবি যেখানে উপস্থিত আছে, সেখানে আমার কিছু বলতে যাওয়াই বালখিল্যতা। আমি বাংলা মায়ের তুচ্ছ সেবিকা, সেবিকার মতোই মায়ের পায়ের কাছে বসে থাকতে চাই। বাংলা আমাকে এত কিছু দিয়েছে, এত প্রশংসা, এত লাইক . . . আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার মতো একজন সাধারণ মেয়ে এতগুলো লাইক পাবে, জানেন। অবশ্য আমি জানি, লাইকটা সব নয়। আসল প্রাপ্তি হচ্ছে ফ্রেন্ডস। ফ্রেন্ডসদের ভালোবাসা। ফ্রেন্ডসদের শেয়ার করা নতুন নতুন রেসিপি। এই তো সেদিন বাবলিদি . . . বাবলিদিকে চেনেন তো চিন্তাদা? আমাদের সুকুমার রায় গ্রুপের? সেই বাবলিদি সেদিন পাঁচফোড়ন দিয়ে টোফুর একটা রেসিপি দিয়েছে, এত ভালো হয়েছিল। বাবাইয়ের বাবা তো খেতে বসে কথাই বলতে পারছিল না, খালি চোখ বুজে মাথা নাড়ছিল।

চিন্তামণিঃ বাবলি, বাবলি . . . ও হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই যে পিকনিকে ফুলকপির বড়া ভেজেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। বড় ভালো মেয়ে। আজকাল আর ওইরকম মেয়ে দেখা যায় না। ওই গরম, আমরা ভদ্রলোকেরা তো সব চিলড বিয়ার নিয়ে ছায়ায় বসে বসে হাঁসফাঁস হয়ে যাচ্ছি, ওর মধ্যে একা হাতে একশো লোকের জন্য ফুলকপির বড়া ভেজে ফেলল আর সবথেকে ভালো লাগল কী জান? সর্বাঙ্গ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, কিন্তু মুখের হাসিটি মেলায়নি। ফুলকপির থালা হাতে যখন আমার সামনে এসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘এই নিন চিন্তামণিদা, সবাইকে দেওয়ার আগে আপনার জন্য এনেছি . . .’ কী বলব ভায়া, এই বুড়ো বয়সেও বুকের ভেতরটা . . . চমকে গেছি বুঝলে, এমন মেয়েও আছে এখন জগতে?

কবিঃ নারীদের দেখে আজকাল বড় যন্ত্রণা হয় জানেন। মনে হয় শুধোই, কেন? কীসের আশায় ছুটছিস, পাগলি? কেন মরছিস ধুলো ঘেঁটে? কথা তো ছিল আমার হৃদয়ের কুঠুরিতে তুই রাজরানীর মতো বন্দিনী হয়ে থাকবি, আমি রোজ আগুনপাহাড় ডিঙিয়ে এসে তোর চোখে ঠোঁট ছুঁইয়ে তোর ঘুম ভাঙাব। সে কথা কেন রাখলি না রাক্ষুসি ডাইনি? কেন নিজেকে এভাবে বিকিয়ে দিলি সবার মাঝে?

বিনীত (দ্বিগুণ জোরে ফুঁপিয়ে উঠে) কেন কেন সুরঞ্জনা, কেন?

প্রকাশঃ না সে মেয়েরা চাকরি করছে ভালো, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের যা মাইনে হয়েছে, বাড়িতে দুটো সোর্স অফ ইনকাম না থাকলে চাপ। কিন্তু আমি মানছি যে সেটা করতে গিয়ে মেয়েদের লাবণ্যের খানিক হানি ঘটেছে।

কবিঃ সেটা কি তোমার কম বড় হানি বলে মনে হয় ভাই? নারীর লাবণ্যই যদি ফুরিয়ে গেল, তবে কবির আর বেঁচে থেকে লাভ রইল কোথায়?

চিন্তামণিঃ মেয়েদের কোয়ালিটি যে কী পরিমাণে পড়েছে সেটা জাস্ট অভাবনীয়। চোখের সামনে দেখলাম, গোটা মায়ের জাতটাকে ধসে যেতে। আমাদের মায়েরা কেমন দশ হাতে সংসার সামলাতেন। কোনওদিন বাবার মুখে মুখে একটা কথা বলতে শুনিনি। কী নম্রতা, কী লাবণ্য। এখনকার মেয়েরা তার ধারেকাছে আসতে পারবে? হ্যাঁ মাসের শেষে হাত পেতে টাকা নিতে হত। তা নিতিস। কী মহাভারত অশুদ্ধটা হত? টাকাটাই কি সব? টাকার বিনিময়ে কোমলতাফোমলতা সব শিকেয় তুলে দিল। ছ্যা ছ্যা ছ্যা।

(প্রকাশের দিকে চোখ টিপে মুচকি হেসে) কিছু বলি না, বললে এই মায়াবীর মতো ফেমিনিস্টরা আবার ফোঁস করে উঠবে।

মায়াবীঃ ওরে বাবা, আমি ফেমিনিস্ট নই! মাগো, কী কাণ্ড! আমাকে আপনি এতদিনে এই চিনলেন চিন্তামণিদা? ও’রকম মেয়েদের সামনে এলেই আমি কেঁদে ফেলব।

বেচারামঃ আমিওপরিস্থিতি হেব্বি খারাপ। একটা নতুন বই বেরিয়েছে, দেখেছেন? গুলাব গ্যাং না কি যেন নামসেখানে মাধুরী যা লাঠি ঘুরিয়েছে . . . মারাত্মক ব্যাপার। এইসব দেখে দেখে শিখবে আর তারপর রিয়েল লাইফে অ্যাপ্লাই করবে। এক্ষুনি নারীঅত্যাচারনিবারণী সমিতি খুলে জোটবদ্ধ না হলে সবাই মিলে স্রেফ ঠ্যাঙানি খেয়ে মরতে হবে।

প্রকাশঃ এত ভালো লাগছে, মন খুলে সবাই কথা বলছেন, সমমনস্ক মানুষদের মধ্যে বৌদ্ধিক আদানপ্রদান ঘটছে, সত্যিকারের কথোপকথন এত বিরল হয়ে এসেছে আজকাল . . . কিন্তু আমাকে বাধা দিতেই হবে, কারণ সময় বড় নির্দয়। আমাদের আরও একজন বক্তা বাকি আছেন। বেচারামদা এবার আপনি কিছু বলুন।

বেচারামঃ এই কেলো করেছে, আমাকেও বক্তৃতা দিতে হবে নাকি? যাই হোক, বলতে যখন হবেই তখন ভ্যানতাড়া করে লাভ নেই। কথাটা হচ্ছে যে আমি একখান বই লিখেছি। এই যে, এই বইটা। নিরানব্বই পাতার বই, আটাত্তর টাকা দাম, নাম ‘বিন্দাস বাওয়ালি’। নাম দেখেই বইয়ের বিষয়বস্তু আঁচ করতে পারছেন। বাওয়ালি। প্রেম নয়, রাজনীতি নয়, দর্শন নয়, বাংলা সিরিয়াল নয়---বাওয়ালি। প্রেম, রাজনীতি, দর্শনও যে একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু যা আছে, সবই বাওয়ালির মোড়কে। আশেপাশে যা-ই দেখেছি, যা-ই শুনেছি, যা-ই দেখেছি, আমার তীব্র রসবোধ ও তীক্ষ্ণ উইটের ছিপে গেঁথে তাকে তুলে এনে পরিবেশন করেছি। গরমাগরম। আসলে ওটাই আমার ইউ এস পি। ক্লাস নাইনটাইনে পড়ার সময় থেকেই পাড়ার সব বাসরে আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। হাসানোর জন্য। এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, মুখ খুলতেও হয় না, আমাকে দূর থেকে আসতে দেখলেই মহিলারা হাসতে শুরু করেন। পেট চেপে ধরে বলেন, ‘উফ, বেচুদাটা যা হাসায় না।’

তাই আমি হাসিয়েছি। ‘বিন্দাস বাওয়ালি’র পাতায় পাতায়, লাইনে লাইনে হাসির খোরাক ঠুসে দিয়েছি। আপনারা যদি হাসতে চান, বিশেষ করে এই যে বিনীত ভাই তুমি, তোমার জীবনে হাস্যরসের ইমিডিয়েট দরকার হয়ে পড়েছে বলেই আমার ধারণা, তুমি তো ডেফিনিটলি পাঁচ কপি আজ নিয়ে যাবে . . . আপনারা সবাই ‘বিন্দাস বাওয়ালি’ কিনুন। বাংলাকে বাঁচান। আজ বাংলামায়ের প্রাণরক্ষার খাতিরে আমি একটা স্পেশাল অফার দিচ্ছি। ফ্রি-তে ‘বিন্দাস বাওয়ালি’ বাড়ি নিয়ে যান, পড়ুন, পড়ান, হাসুন, হাসান। তারপর ধীরেসুস্থে আমি আপনার বাড়ি বয়ে গিয়ে দাম আদায় করে নিয়ে আসব’খন।

আসলে আমি বইটা কেনানোর জন্য এত ঠ্যালাঠেলি করছি কেন বলুন তো, কারণ বইটা ভালো। আমি নিজে বলছি না, আমার পিসতুতো ভাই, মাকড়াপাড়া সাপ্তাহিক সংবাদে চিফ জার্নালিস্টের পোস্টে আছে, অপ-এড ছাড়া কিছুতে কলম ছোঁয়ায় না, সে নিজে ‘বি-বা’র রিভিউ লিখেছে নিজের কাগজে। কী লিখেছে শুনুন।

(পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো বার করে)

‘শ্রীযুক্ত বেচারাম বসাকের প্রথম বই ‘বিন্দাস বাওয়ালি’ গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য ‘প্রকাশিত’ শব্দটি এই বইটির পক্ষে নিতান্ত অপ্রতুল। বরং গত বইমেলায় শ্রী বেচারামের বইটি বাংলা সাহিত্যের ভাগ্যাকাশে ‘আবির্ভূত’ হয়েছে বললে বাস্তবের অনেকটা কাছাকাছি হয়। স্বর্গীয় হুতোম প্যাঁচার পর বাংলা সমাজ ও সময়ের বহুরৈখিক যাপনকে এমন স্বচ্ছতার সঙ্গে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন বলে জানা যায় না। বইখানির সম্পদের তুলনায় আটাত্তর টাকা দাম কিছুই না। এক প্যাকেট সিগারেটের দামও ওর থেকে বেশি। বাঙালি যদি এই বই না কিনে সিগারেট কিনে আটাত্তর টাকা উড়িয়ে দেয়, তাহলে আমার মতো অভিজ্ঞ সাহিত্যবোদ্ধার মতে সেই সিগারেটের ছাই নিজের সারা গায়ে ছিটিয়ে বাঙালির গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়া উচিত।

হে হে হে, ওই গঙ্গায় ঝাঁপের জায়গাটা নিজগুণে ইগনোর করুন। গুপের সব ভালো, কেবল একটু মাথাগরম। কিছু করার নেই, হেরিডিটি। আমার পিসিকে দেখেছি, সারাজীবন মাথায় ঘৃতকুমারীর রস থাবড়ে ঘুমোতে যেতেন। পিসেমশাই বলতেন নাহলে নাকি পিসির মাথা এমন গরম হয়ে যাবে যে গ্যাস লাগবে না, পিসির মাথাতেই সারা বাড়ির রুটি সেঁকা হয়ে যাবে। হা হা হা। আমাদের বাড়ির জামাইগুলোরও হেব্বি সেন্স অফ হিউমার।

তবে ‘বি-বা’ কিছু নেগেটিভ রিভিউ-ও পেয়েছে। আমি মশাই অনেস্ট লোক। খানিক বলব, খানিক ঢাকব, ওসব হিপোক্রিসি আমার মধ্যে পাবেন না। আমাকে প্রচুর লোক বলেছেন যে ‘বি-বা’ প্রাইসিং-এ গোলমাল আছে। আটাত্তর টাকা খুচরো দিতে গিয়ে অনেকেই নাকানিচোবানি খেয়েছেন। সবথেকে মুশকিল হয়েছে যারা রাজিন্দরের থেকে ‘বি-বা’ জোগাড় করেছেন। একশো টাকার খুচরো দেওয়ার সময় ব্যাটা রেগুলার কুড়ি টাকা আর দু’খানা করে সেন্টার ফ্রেশ গছিয়েছে।

আমি সবার ফিডব্যাক মন দিয়ে শুনেছি। না শুনলে নিজেকে উন্নত করব কী করে। আমার আবার অত ইগোটিগো নেই। নেক্সট বইয়ের দাম আর আটাত্তর রাখা হবে না। ঝামেলাটা হচ্ছে পঁচাত্তর রাখব না আশি, সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারছি না। এ বিষয়ে আপনাদের ফিডব্যাক আমার খুব দরকার।

(এই মুহূর্তে হাতে এক মস্ত ট্রে নিয়ে প্রায় টলতে টলতে টুনির প্রবেশ। ট্রে-র ওপর প্লেটে কেক, পেস্ট্রি, প্যাটিস থরে থরে সাজানো। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সারাঘরে লক্ষণীয় রকমের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। বিনীত এতক্ষণ দুহাতের ওপর মাথা রেখে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছিল, সে মাথা তুলে তাকাল, প্রকাশ ঘোষণার তাড়া কাগজ দ্রুত সরিয়ে রেখে হাতে হাত ঘষতে লাগল, সোফায় পড়ে থাকা চিন্তামণি হাত দিয়ে হাওয়া খামচে ধরে উঠে বসার অক্ষম চেষ্টা করতে লাগলেন। বেচারামের মুখ দেখে যদিও মনে হচ্ছিল তাঁর আরও অনেককিছু বলার আছে, তিনি তাড়াতাড়ি বক্তৃতা গোটাতে লেগে গেলেন।)

ব্যস্‌। আর তো কোনও কথা নেই। আপনারা সবাই ‘বিন্দাস বাওয়ালি’ কিনুন কেনান হাসুন হাসান, নিজে বাঁচুন ও বাংলাকে বাঁচান। মনে রাখবেন, বাংলার অনারে আজ বি-বা টোটাল ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রি ফ্রি ফ্রি।

এই না বলে বেচারাম ট্রে-র ওপর লাফ দিয়ে পড়লেন। বাকিরা ভদ্রতা করে গুটি গুটি এগোচ্ছিল, বেচারামের লাফ দেখে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। টুনি ঠিক সময়ে সড়াৎ করে ট্রে-র কাছ থেকে সরে গিয়েছিল, না হলে বেচারার দু’চারটে হাড়গোড় মটকে যাওয়া কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। ভিড় যখন সরল দেখা গেল ট্রে প্রায় খালি, কয়েকটা প্যাটিসের গুঁড়ো আর একখানা পেস্ট্রির হাফ থেঁতলানো মৃতদেহ পড়ে আছে।

ঘণ্টাখানেক পর এই প্রথম মায়াবীদেবীর ঘোড়াময় ঘরে নীরবতা বিরাজ করতে লাগল। মাঝে মাঝে শুধু তৃপ্ত চিবোনোর শব্দ। পরের দশ মিনিট আর বাংলা সম্পর্কে কারও দুশ্চিন্তা রইল না।
   
চিন্তামণি (গলা ঝেড়ে): বাঃ মায়াবী। ভালো ব্যবস্থাপত্র করেছ। এখন দেহে বেশ বল পাচ্ছি। একেবারে কাহিল হয়ে পড়ছিলাম। যাক, আমি যেটা বলছিলাম . . . আমাদের সময় থেকে অবশ্য এখন সবই বদলেটদলে গেছে, তবু . . . আমি বলছিলাম যে, নিজের মুখে নিজের এত প্রশংসা করা কি ভালো দেখায়? মানে ভালো জিনিস হলে তো লোকে কিনবেই, যেমন আমার বইটি, তিন মাসে তিনবার মুদ্রণ , কিন্তু তা বলে কি আমি সবাইকে কিনুন কিনুন বলেছি?

মায়াবীঃ ঠিক, বাবাইয়ের বাবাও তো গত মাসে প্রোমোশন পেয়েছে, সেলিব্রেট করতে এবার গরমে আমরা পাটায়া যাচ্ছি, আমি কি নিজে থেকে সেটা সবাইকে বলতে গেছি? নেহাত যারা ফ্রেন্ড, তাদের না বললে দুঃখ পাবে, পরে, ‘আমরা কি আপনার পর? আমাদের সঙ্গে কি সুখদুঃখের কথা শেয়ার করতে নেই’ বলে কথা শোনাবে, তাই ফ্রেন্ডদের জানিয়েছি।

বেচারামঃ হাহাহাহা, আপনিও সেই বস্তাপচা শামুকেই পা কাটালেন চিন্তামণিদা? আরে মশাই জাগুন। চোখ মেলে চেয়ে দেখুন আপনি কোথায় আর দুনিয়াটা কোথায়। একটা গোটা জাত স্রেফ জয়েন্ট দিয়ে দিয়ে ভোগে চলে গেল। এদিকে গুজরাতিরা দেখুনগে এম বি এ পড়ে কোথায় পৌঁছে গেছে। লেখালেখির পাঁপড় অনেক বেলেছেন মামা, সেই চণ্ডীদাসবিদ্যাপতিফতি, আরও কী সব নাম পড়েছিলাম অসিত বাঁড়ুজ্যের বইতে, সেই তবে থেকে বাঙালি লিখে আসছে। পরিণতি কী হয়েছে? কোন মুখোজ্জ্বলটা হয়েছে? না আরও তিনটে বাঁড়ুজ্যে নোবেল পেতে পারত, কে জানে কে কাঠি করেছে বলে সে সব ফসকে গেছে, সেই গর্বে এখনও গাল ফুলিয়ে বসে আছে বাংলাকে বাঁচাতে গেলে আর লিখে হবে না মামা, এবার লেখা বেচতে হবে। 

বিনীতঃ না সে আপনি যতই বলুন দাদা, এখনও নিজের কথা নিজের মুখে বলতে গেলে কেমন কেমন লাগে . . .

এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির প্রবেশ। লম্বা ছ’ফুট, ওজন কম করে একশো কেজি, গায়ের রং আবলুশকে লজ্জা দেবে, চিবুকে গোটি মাথায় ঝুঁটি, ভয়েস ব্যারিটোন।

ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন তো, রবীন্দ্রনাথ যখন সুইডিশ নোবেল অথরিটির কাছে নিজের কবিতা নিজেই অনুবাদ করে সেধে সেধে পাঠিয়েছিলেন, তখন ওঁর কেমন কেমন লাগছিল কি না?

চিন্তামণিঃ ইকি এ এখানে কী করছে?

প্রকাশ (উত্তেজিত গলায়) আরে এ তো ‘ভাঙো চোরো নতুন করে গড়ো’ সমিতির ফাউন্ডার, রুদ্র ‘কালাপাহাড়’ বটব্যাল।

কালাপাহাড়ঃ কেন অসুবিধে আছে? বাংলার পিণ্ডি খালি একা তোমরাই চটকাবে, আমরা বসে বসে আঙুল চুষব, এমন কোথাও লেখা আছে নাকি?

বেচারামঃ না না, তা কেন, বাঙালি হয়ে জন্মেছেন যখন বাংলার পিণ্ডি চটকানোয় আপনারও সমানাধিকার। আসুন আসুন, বসুন বসুন। মায়াবীদি, কেক পেস্ট্রি আর আছে নাকি?

কালাপাহাড়ঃ আমি এখানে পেস্ট্রি গিলতে আসিনি। আমার অত ফালতু সময় নেই। ওয়ালে দেখলাম এখানে আজ বাংলার পিণ্ডি চটকানো হবে, তাই ভাবলাম একটু বাওয়াল দিয়ে আসি।

কবিঃ এ সব কী হচ্ছে, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

কালাপাহাড় (কবির মিহি গলা নকল করে): আপনি বোঝার চেষ্টাও করবেন না, ও রকম কিশমিশের মতো শুঁটকো ইন্টেলেক্ট দিয়ে বোঝার আশা করাই অন্যায়। (স্বাভাবিক গলায়) প্রকাশ? তুমিই তো পালের গোদা মনে হচ্ছে, তো কী সিদ্ধান্ত হল বাংলা বাঁচানো নিয়ে? আর কত জঞ্জাল লিখে ভ্যাট উপচোবে?

বেচারামঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ . . .

কালাপাহাড়ঃ বেচুবাবুর হঠাৎ এত হাসি পাচ্ছে কেন? অনেক বিক্কিরি হয়েছে বুঝি?

বেচারামঃ সে আপনাদের কৃপায় হচ্ছে মন্দ না। কিন্তু আমি হাসছি আপনার গোদা আইডেন্টিফিকেশনের গলদ দেখে। (চিন্তামণির দিকে ভুরু নাচিয়ে ইঙ্গিত করে) উনি যেখানে আছেন সেখানে আর কারও সাধ্য কি পালের গোদা হয়?

কালাপাহাড়ঃ বা বা বা, আমাদের চিন্তাদাও আছেন দেখছি এখানে। এই তোমরা সবাই ওঁকে বক্তৃতা দিতে দিয়েছ তো? না হলে কিন্তু ওঁর আবার গোঁসা হবে। দল ছেড়ে দুমদুমিয়ে চলে যাবেন। তাতে অবশ্য সবার মিটিং-এর খাবার কম পড়া বন্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনও ক্ষতি হবে না।

চিন্তামণিঃ দেখ রুদ্র, আমার মুখ খুলিয়ো না বলছি। তোমাদের ভাঙো চোরো গ্রুপের সব কেচ্ছা আমার জানা আছে, নেহাত আমি তোমাদের মতো অশিক্ষিত অভদ্র নই, আমার শরীরে ডিগনিটি বলে একটা পদার্থ এখনও বাকি আছে, তাই . . .

কালাপাহাড়ঃ ডি গ নি টি ? চি ন্তা ম ণি র? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ। প্রকাশ, তোমাদের মিটিং-এ এত রগড় হবে আগে জানাওনি কেন বাবা, তাহলে আরও আগেই আসা যেত? কীসের ডিগনিটি বে? যে তিনমাস ছিলে কী গুল খিলিয়েছিলে মনে আছে? কী সব উড়ো চিঠি এসেছিল মনে আছে? চিন্তামণির মাথার ফণী হয়ে কে যেন বিরাজ করছিলেন? কোন কচি কবিনী?

চিন্তামণিঃ কী, এত বড় সাহস? আমার চরিত্রহনন? আমার . . . (হঠাৎ বুক চেপে ধরে পতন)

মায়াবীঃ খুন! খুন! মাগো, তোমরা কেউ পুলিশ ডাকছ না কেন? টুনি, টুনি, আমার ফোনটা নিয়ে আয় শিগগিরি, বাবাইয়ের বাবাকে এক্ষুনি ফোন করতে হবে . . .

প্রকাশ ঘর থেকে ছুটে পালায়।

বিনীতঃ দাদা! দাদা! কী হল দাদা? আপনারা কি মানুষ, এই অভদ্র অসভ্য বর্বর লোকটাকে ঘরে ঢুকতে অ্যালাউ করেছেন? ঘাড় ধরে বার করে দিন।

কালাপাহাড়ঃ আরে এই পাপোষটা এখানে কী করছে? ঘাড় ধরবি তুই আমার? তোর হাইট কত বে? কবিতা পরে লিখবি, আগে ডনবৈঠক দে। (বিনীতের ঘাড় ধরে ঝাঁকানি। বিনীত এলিয়ে পড়ে যায়, সোফায় যেখানে চিন্তামণি পড়ে আছেন, তার কাছাকাছিই) এই এম সি বি সি গুলো ঢুকে বাংলা সাহিত্যটাকে একেবারে শেষ করে দিল।

বেচারামঃ আরে রাম রাম, ছি ছি ছি ছি, মায়াবীদি শিগগিরি কানে আঙুল দিন।

মায়াবীঃ এম সি বি সি মানে কী?

কালাপাহাড়ঃ কচি খুকি? ন্যাকা? আবার সাহিত্য করতে বসেছে। এই দুগ্ধপোষ্যগুলোর হাতে পড়েই বাংলার এই অবস্থা।

কবিঃ এই, ভদ্রমহিলাদের সামনে কোনও অশালীনতা আমরা সহ্য করব না।

কালাপাহাড়ঃ সহ্য করবি না মানে কী র‍্যা? সাহিত্য ফলাচ্ছিস, জানিস না শ্লীল অশ্লীল বলে কিছু হয় না? (গদার মতো হাত উত্তোলন, বেচারাম ঠিক সময়ে কবিকে টেনে না নিলে রদ্দাটা সোজা এসে কবির ঘাড়ে পড়ত।)

বেচারামঃ রুদ্রবাবু, রুদ্রবাবু, ডিপ ব্রেথ নিন। গুনে গুনে পাঁচবার। এত মেজাজ গরম করবেন না। আপনি যদি একাই সবাইকে মেরে ফেলেন, বাংলা বাঁচানোর জন্য কে থাকবে বলুন?

কালাপাহাড়ঃ চাই না, চাই না, এই গাধাগরুগুলোকে লাগবে না আমার বাংলা বাঁচাতে। এরা কিস্যু বোঝে না, কিস্যু জানে না, কিস্যু পড়েনি, এরা বাঁচাবে বাংলা? এরা মরলে তবে যদি বাংলা বাঁচে। যত্ত সব বুড়ো হাবড়ার দল বসেছে শখের সাহিত্য করতে। এতদিনকার একটা ঐতিহ্যশালী সাহিত্য, কারা সব লিখে গেছেন এখানে, তাদের উত্তরসূরী কি না হবে এরা? এরা ভাষাটার গলা টিপে মারবে। যেটুকু বাকি আছে সেটুকুও শেষ না করে ছাড়বে না এরা। এদের দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়, মনে হয় শালা সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিই . . . শালা অশিক্ষিত নির্বোধের দল . . .

হাতের এক ঝাপটে কাছের বিষ্ণুপুরী ঘোড়ার কান উড়ে যায়। কালাপাহাড় কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। মা, মা গো, তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না মা। আমাদের তুমি ক্ষমা করে দিয়ো।
  
মায়াবীঃ ও মা গো, আমার ঘোড়ার কান ভেঙে দিলে। এটা কি মানুষ, না জানোয়ার? এ নাকি কবিতা লেখে? টুনিইই, টুনিইইই, শিগগিরি আমার মোবাইল নিয়ে আয়, এক্ষুনি বাবাইয়ের বাবাকে খবর দিতে হবে।

কালাপাহাড় (কান্না থামিয়ে) আরে এ সব মালকে কোথা থেকে জোগাড় করে এনেছে? মেটাফোর বোzএ না? মাসিমা, আপনার ভাটের বাড়ি ভাঙার আমার টাইম বা প্রবৃত্তি কোনওটাই নেই। অবশ্য ভাঙলে আপনার উপকারই হত, রুচির যা নমুনা দেখছি।

মায়াবী কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যান। মুখ দু’বার খোলেন ও বন্ধ করেন। চোখ বিস্ফারিত। মনে হয় এক্ষুনি কেঁদে ফেলবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জলের বদলে চোখে আগুন ঝলসে ওঠে।

মাসিমা?! মাসিমা কাকে বললি হতভাগা?! তোর বয়স কত? ঝুঁটি বেঁধে থাকিস বসে কি ভেবেছিস বয়স বোঝা যায় না? ধেড়ে খোকা, উনি সবাইকে সাহিত্য বোঝাতে এসেছেন। (কোমরে আঁচল গুঁজে) টুনি, ফোন কাটা, রান্নাঘর থেকে সাঁড়াশিটা নিয়ে আয় বরং, ‘মাসিমা’ ডাকার শখ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিই। টুনিইইইই . . . .

দূর থেকে ধুপধাপ পায়ের শব্দ। তিন সেকেন্ড পরে ঘরের দরজায় টুনির আবির্ভাব। আসন্ন অ্যাকশনের আশায় ছোট্ট মুখ জ্বলজ্বল করছে। টুনির এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে সাঁড়াশি। হ্যালফ্যাশানের নয়, কুচকুচে কালো লোহার সাঁড়াশি। মায়াবীদির দিদিশাশুড়ি মরার আগে নিজে হাতে নাতবউয়ের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যত্ন করে রাখিস। সাঁড়াশি বলে হেলাফেলা করিস না। স্বামীপুত্র নয়, দরকারে এ-ই তোর সবথেকে বড় সহায় হবে।

কবিঃ আহা আহা, নারী, উত্তেজিত হবেন না . . .

বেচারামঃ খাইসে, গুলাব গ্যাং জেগে গেছে মাইরি, আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে না। (কবির হাত ধরে টেনে) প্রাণ বাঁচাতে চান তো শিগগিরি সোফার তলায় লুকোন, আপনার যা বডি মাস, আপনি এ ঝড় আটকাতে পারবেন না।

বেচারাম ও কবি সোফার পেছনে বসে পড়লেন। কালাপাহাড় অবশ্য সে সুযোগ পেল না, তার আগেই সাঁড়াশির ঠোঁট এসে তার নাক টিপে ধরল। 

আঁ আঁ আঁ আঁ আঁ. . . . 

কানফাটানো সেই আর্তনাদ ছাপিয়ে শোনা গেল মায়াবী গোধূলির রণহুঙ্কার। আর টুনির কচি গলার উল্লাস। আরও জোরে টানো পিসি, তোমার ঘোড়ার কানের মতো ওর নাকটাও টেনে ছিঁড়ে নাও। ঝাপটাঝাপটিতে আরও কতগুলো ঘোড়ার কান উড়ে গেল, ঘরময় ভাঙা কাঁচের প্লেটের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল। তবু মায়াবীর রোষ কমার লক্ষণ দেখা গেল না। হুঙ্কার, কান্না, কচি গলার খিলখিল হাসির আওয়াজ সন্ধ্যের আকাশবাতাস ছেয়ে ফেলল।

খুব কান পাতলে শোনা যেত হয়তো, অতি প্রাচীন ও ক্ষীণস্বরে কোথাও যেন কেউ কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘ওরে তোদের দুটি পায়ে পড়ি, আমায় ছেড়ে দে।’ কিন্তু এত কোলাহলে সে কাকুতি চাপা পড়ে গেল, কারও কানে পৌঁছল না।
  
                                                                                                    (সমাপ্ত)

Comments

  1. Replies
    1. বুঝলাম, সোমনাথ।

      Delete
    2. কি বুঝলে কে জানে ! তবে আমি ঠিক বুঝেছি ঃ)

      Delete
    3. হা হা, আরে না না, আমিও ঠিকই বুঝেছি। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. বাংলায় ঠিক বলতে পারলাম না। You're coming of age.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. darun laglo Kuntala , :) :) sabtheke bhalo laglo kobike

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, কবির মনটা ভালো তিন্নি।

      Delete
  4. Guchia tule rekhechilam...weekend e porbo bole...purota eksathe porlam...
    Apnar lekhar prosongsa kore r bakkobay korbona...sudhu bolbo ai style a likhe jan...subhechha roilo...apni lomba race er ghora!

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ সৌমেশ। আপনার উৎসাহ পেতে সবসময়ই ভালো লাগে। অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  5. এম সি বি সি
    chorom :D :D :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে তওবা তওবা কুহেলি, এ সব কী পচা কথা।

      Delete
  6. ওহ কুন্তলা'দি... এ তো ছক্কার পর ছক্কা! বলে বলে ছক্কা প্রতি বল-এ...! একটানা একসাথে পড়লাম দু'খানা কিস্তি... যাকে বলে জবরদস্ত ! কোনো কথা হবে না!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা সায়ন্তরী, থ্যাংক ইউ। তোমার মন্তব্য পেয়ে থেকে আমি নিজেকে ইডেন গার্ডেনে কল্পনা করছি, মাথায় হেলমেট পরে ব্যাট ঠুকছি মাটিতে। যতবার কল্পনা করছি, শিহরণ হচ্ছে।

      Delete
  7. আপনার সব কটা লেখা পড়ে ফেললাম গত এক মাসে, এখন বন্ধুদের পড়াচ্ছি। অপূর্ব। এই লেখাটাও দিব্যি লাগলো। মাঝের কিছুটা পড়ে চলচিত্তচঞ্চরী ধরনের মনে হলো। লিখতে থাকুন। :) ... অভীক

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্বাগত স্বাগত অভীক। বড় ভালো লাগে নতুন লোক দেখতে পেলে। আশা করি আপনার বন্ধুরা আপনার পছন্দকে দূরছাই করছে না। আপনি আরও অনেকদিন অবান্তরকে অ্যাটেনশন দিন, এই কামনা। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  8. Kuntala, lokhhiti, full time lekho. Apishe hoyto tomay dorkar, kintu shotti Bangla bhashar tomake aro beshi dorkar.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহাহা, হোহোহোহো শকুন্তলা, আপিসের আমাকে দরকার? হেসে কেঁদে একশা হয়ে যাচ্ছি তোমার কথা শুনে। যাকগে, কার কাকে দরকার সে কথা থাক। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি তোমার লেখাটা পছন্দ হয়েছে আর তাতেই আমি সপ্তম স্বর্গে উঠে গেছি। নামতুতো বন্ধু প্লাস লীলা-কমরেডের কাছ থেকে ভালো কথা শুনতে সবসময়ই ভালো লাগে। থ্যাংক ইউ।।

      Delete
    2. Apishe dorkar nei tomake?? Jak baba, tahole chagri ta ar keno korbe - 100% shomoy dao edike, amra anonde 8 khana hobo.

      Delete
    3. লীলা-কমরেড shune bhoyanok gorbo hochhe.

      Delete
    4. লীলা-ক্যামারাডারি হাই ফাইভ শকুন্তলা।

      Delete
  9. খুব সুন্দর। অসাধারণ লাগলো। .এ এমন এক লেখা যা পুনরাবৃত্তি করলেও পুরনো হবেনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বলছ সুমনা? অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  10. uff darun. sobta abar eksonge porlam. Kuntala, protidini abantor ke aro beshi beshi bhalobese phelchhi. :-) .

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো লেগেছে ইচ্ছাডানা? থ্যাংক ইউ। ভালো তো বাসবেনই, অবান্তর আপনাকে এত ভালোবাসে তার একটা প্রতিদানের ব্যাপার নেই? ভালো না বাসলেই বরং বহোত না ইনসাফি হত।

      Delete
  11. Nah .. Abantor ar office e kokhhono porbo na !!!
    Ami o jemon , kono kandogyan nei .. chardikey sobai chup chap kaaj korchhey ar ami kina apner ei abantor prolap portey gelam ...
    Prothome mukh nichu kore thoth chipe, tar po mukhe hath diye aral kore dat bar kore ...byaperta manage kora jachhilo .. kintu jei oi sarashi hathey tunir probesh ar tar porer ghotonaboli chokher samney fute uthlo .. abodomito hasir abeg domchhut hoye kemon bibhotso sobdey amar sob chesta bifol kore bemokaa beriye elow .. asey paser lokjon cubical thekey mukh uthiye, ghar ghuriye ar chokhey dekhe abar kaj e mon deoar bhan korlo .. ar ami chokher jol muchhey abar kaaj e mon debar chesta kori !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে, আপনাকে বিপদে ফেলেছি জেনে খারাপও লাগছে আত্মদীপ, আবার ফেলতে পেরেছি জেনে একটু একটু ভালোও যে লাগছে না সেটা বলতে পারব না। আশা করি সহকর্মীরা বেশি মাইন্ড করবেন না।

      Delete
  12. ভাল লাগল কুন্তলা। চলচিত্ত চঞ্চরি আর পরশুরামের মিশেলটা সত্যিই খুব খোলতাই হয়েছে। এর সঙ্গে একটু মুজতবা আলির ফোড়ন যদি থাকত!

    আর শেষ প্যারাগ্রাফটা মাস্টারপিস। শুভেচ্ছা রইল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তথাগত।

      Delete
  13. আপনি কত ভালো গল্প লেখেন সেটা জানা ছিল, নাটকটা তাও নাহয় আন্দাজ করতে পারতাম, কিন্তু আপনি যে এত ভালো আধুনিত কবিতা লিখতে পারেন এটা কল্পনাও করতে পারিনি। মশার প্রশ্ন টা "দেশ"-এ পাঠিয়ে দিন, ছেপে দেবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  14. "একটা গোটা জাত স্রেফ জয়েন্ট দিয়ে দিয়ে ভোগে চলে গেল। এদিকে গুজরাতিরা দেখুনগে এম বি এ পড়ে কোথায় পৌঁছে গেছে।" এইটা এবার থেকে যেখানেসেখানে কোট করব! আর কবির সত্যিই জবাব নেই, আমার খালি 'নেড়া'র কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল পড়তে পড়তে!

    ReplyDelete
    Replies
    1. নেড়াদা নমস্য ব্যক্তি, আমাদের কবি তাঁর পায়ের কাছে বসে কিছু শিখতে পারলেই বর্তে যাবে।

      Delete
  15. ki shundor likhecho....bhishon moja pelam pore....aditi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ অদিতি।

      Delete
  16. অসাধারণ… দারুণ… ইত্যাদি নানা প্রশংসার কথা এতক্ষণে সবাই বলে ফেলেছেন। পুনরুক্তি করব না।
    তবে এই মাসিক সাহিত্য আসরগুলোর একটা বড় আকর্ষণ যে মধ্যপথে খাবারের আগমন, এবং আমি আর আমার মত আরো দু'চারজন যে তার লোভেই অনাহূত রবাহূত হয়ে হাজির হই, এ'টা শতকরা দু'শো ভাগ সত্যি। দেরি হলে অন্যের লেখা পাঠের মধ্যেই পাশের জনকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, 'এ্যারা আইজ খাইতে দিবো না?'
    আর হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি। বেচারাম বাবুকে আমি চিনি। দেখাও হয়েছিল এ'বার বইমেলায়। ফেসবুক থেকে মুখটা চিনতাম। মুখোমুখি সেই প্রথম।
    বিনা মন্ত্যব্যে থাকি মানে পড়ি না তা' কিন্তু নয়। আপনার ব্লগের সমস্ত লেখা বেরোনো মাত্রই পড়ি। আর অপেক্ষায় থাকি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে অরুণাচল, আপনার সঙ্গে এইখানে হাই ফাইভ। আমিও সেমিনারে স্রেফ খেতে যাই। আমার মতো অনেকেই যায়। এতদিন ধরে এত সেমিনারে গিয়ে গিয়ে আমি এখন লোকের মুখ দেখেই ধরতে পারি কে জ্ঞানবৃদ্ধি করতে এসেছে, কে পেটভর্তি করতে। সবাই লাঞ্চডিনার নিয়ে মাতামাতি করে, আমার অবশ্য চোখ থাকে টি ব্রেকের দিকে। কী সুন্দর করে কাপে ঢেলে চা দেয়, সঙ্গে আবার রকমারি বিস্কুট। আমার ফেভারিট বিস্কুট হচ্ছে চিজ স্ট্র। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে দু'খানা নিয়ে নিই।

      যাক গে, চিজ স্ট্রয়ের কথা। আপনার যে লেখাটা ভালো লেগেছে সেটা জেনে আমি খুব খুব খুশি হয়েছি। একেবারে মন থেকে খুশি হয়েছি। আরও খুশি হয়েছি আপনি অবান্তর নিয়মিত পড়েন শুনে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. আমি কিন্তু অফিস বা কলেজের সেমিনারের কথা বলিনি। আক্ষরিক অর্থে মাসিক বা পাক্ষিক সাহিত্য বৈঠকের কথাই বলেছি। আমাদের বারাসতে যেমন কয়েকটাই বেশ নিয়মিত বসে। 'বহুস্বর' আর 'দৌড়' লিটল ম্যাগাজিনের তরফে যে দু'টো, তাতে আমি যাই। ওই যা বলেছি… লুকোবার কিছু নেই… শুদ্ধমাত্র ইয়ের লোভে। দূরেও যাই। তবে ওই, শর্ত একটাই।

      Delete
    3. না না, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমার এখনও পর্যন্ত কোনও সাহিত্যসভায় গিয়ে খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, আমার খালি সেমিনারেই যা চান্স, তাই সেমিনারের উদাহরণ দিলাম আরকি।

      Delete
  17. লেখার গুণ নিয়ে কথা বলার স্পর্ধা দেখাবো না। শুধু বলবো একটু পায়ের ধুলো দেবেন। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে রাম রাম শঙ্খদীপ, পায়ের ধুলোটুলো আবার কেন। লেখাটা ভালো লেগেছে বুঝলাম, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  18. terrrriiiiiific!!!! durdanto! daaaarun laglo... thank you thank you...

    Iniya

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো লেগেছে ইনিয়া? গুড গুড।

      Delete

Post a Comment