পুরোনো অবান্তরঃ বেগুনি সোয়েটার



পুরোনো অবান্তরের পোস্ট বাছার সময় যে অসুবিধেটা প্রধানত প্রকট হয়ে ওঠে সেটা প্রাসঙ্গিকতারমোটে তিনচার বছরে মানুষ যে এত বদলায় সেটা নিজে চোখে নিজেকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় নালেখার ধরণধারণ যদি ছেড়েও দিই, বেশিরভাগ সময় লেখার বিষয়টাই অবিশ্বাস্য ঠেকেএকসময় যে বিষয়টাকে নিয়ে পাঁচশো শব্দ খরচ করা জরুরি মনে হয়েছিল, সেটার সঙ্গে এখন পাঁচ মিনিটও কাটাতে হবে ভাবলে কান্না পায়।

এবারের পুরোনো অবান্তরটি সেদিক থেকে দেখতে গেলে উজ্জ্বল উদ্ধার। তিন তিনটে বছর কেটে যাওয়ার পরও বিষয়টি শুধু আমার কাছে সমান প্রাসঙ্গিক তাই নয়, আমি নিশ্চিত দু’হাজার দশ সালের ছয়ই অক্টোবর ওই পোস্টটা লেখার সময়ে আর দু’হাজার চোদ্দোর ষোলোই অক্টোবর রাতে এই মাজাঘষা সংস্করণটি লেখার সময়ের আমার ধড়াচূড়ার অন্তত একটি বিষয় কমন। এমনকি আমি জোর দিয়ে এ কথাও বলতে পারি, আজ থেকে তিনবছর পর কোনও এক শীতের রাতে যদি এই মাজাঘষা সংস্করণটির আরও একটি মাজাঘষা সংস্করণ লিখতে বসি তখনও সেই বিষয়টি কমন থাকবে।


সোয়েটার নিয়ে তো কথা হবেই, তার আগে সোয়েটারসংক্রান্ত পোস্টটার কথা হয়ে যাক। অবান্তরের ইতিহাসে এই পোস্টটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। আমার বিশ্বাস এইটাতেই অবান্তরের প্রথম বোনাস কুইজ বেরিয়েছিল। কথাটা মনে হয়ে আমার মন এমন ভালো হয়ে গেল যে কী বলব।

সে ভালো অবশ্য বেশিক্ষণ টিঁকল না। মাজাঘষা শুরু করতে গিয়ে বুঝলাম আমার পরিবর্তিত পছন্দঅপছন্দ মেনে মেরামতি করতে গেলে কুইজটিকে রাখা চলে না। ভাবুন একবার। অবান্তরের প্রথম বোনাস কুইজ!

লেখা মাথায় উঠল। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে আমার এক ঠাকুরদার কথা মনে পড়ে গেল

নিজের ঠাকুরদা নন, নিজের ঠাকুরদার দূরসম্পর্কের কাজিন। অনেক সময় দেখবেন নিজের ভাইবোনদের থেকে কাজিনদের মধ্যে গলাগলি বেশি হয়ে ওঠে, আমার ঠাকুরদা আর কাজিন ঠাকুরদারও ছিল সেই ব্যাপার। সে টান তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও সফল ভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। কাজিন ঠাকুরদার ছেলে আর আমার বাবার খাতায়কলমে সম্পর্ক রীতিমতো ঘোরালো হলেও মনের টান ছিল সোজাসাপটা, কাছের। ছ’মাসে অন্তত দু’বার আমরা সপরিবারে দাদুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম।

আমি যখন গেছি তখন অবশ্য কাজিন ঠাকুরদা ছবি হয়ে গেছেন। কড়িকাঠের সিলিং দেওয়া টানা বারান্দার দেওয়ালে ঝুলন্ত, বাঁধানো, সাদাকালো ছবি প্রসন্ন অথচ শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষটিকে ছবিতে দেখেই আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত। শুনেছি গলার স্বরও ছিল মানানসই, আর হাইটও নাকি বাবার মতো, ছ’ফুটের ওপারে। ধপধপে ফর্সা গায়ে পৈতে ঝুলিয়ে খড়ম খটখটিয়ে এসে ঠাকুরদা যখন দরজা খুলে অপেক্ষারত আত্মীয়দের “অকস্মাৎ?” বলে আপ্যায়ন করতেন তখন যে আমি সামনে পড়তাম না সেইজন্য ছোটবেলায় মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদই দিয়েছি।

আশ্চর্যরকম ভাবে, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে এই ভয়াল ঠাকুরদারই জনপ্রিয়তা ছিল সবথেকে বেশি। জনপ্রিয়তা মানে কিন্তু পিঠে চাপড় মারা জনপ্রিয়তা বলছি না‘অ্যাপ্রোচেবল’ ব্যাপারটা গুণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এই সবে কিছুদিন হল, তার আগে একে অপরের থেকে সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্ব রক্ষা করাটাই ছিল নিয়ম। আজকাল দূরত্ব কথাটাকে আমরা ক্ষোভ, রাগ বা ন্যূনতম উদাসীনতার প্রকাশ বলে ধরে নিই, সেটা যে কত ভুল তার প্রমাণ ছিলেন আমার কাজিন ঠাকুরদা। সকলের থেকে অপরিসীম দূরত্ব বজায় রেখেও তিনি সকলের প্রিয়, সকলের শ্রদ্ধেয় ছিলেন। এখনও আছেন। কাজিন ঠাকুরদার অতিদীর্ঘ ছায়া থেকে তাঁর ছেলেমেয়েরা বেরোতে পারেননি কোনওদিন। তাঁরা তাঁদের বাবার সন্তান, তাঁদের স্বামীস্ত্রীরা কাজিন ঠাকুরদার জামাতা-পুত্রবধূ, তাঁদের সন্তানরা কাজিন ঠাকুরদার নাতিনাতনি হিসেবেই আত্মীয়মহলে খ্যাত হয়েছেন। 

কাজেই ঠাকুরদা মারা যাওয়ার বেশ কয়েকবছর পরেও আমরা ‘ঠাকুরদার বাড়ি’তেই বেড়াতে যেতাম। সে বাড়িতে ছিল কড়িকাঠের ছাদ, খড়খড়ির জানালা, জানালায় শিকের গরাদ, দেওয়ালে কুলুঙ্গি, কালো বেড়া দেওয়া লাল সিমেন্টের মেঝে। বসার ঘরের ছাদ ফুঁড়ে উঠেছিল একটা পূর্ণবয়স্ক নারকেল গাছ।

গাছের ব্যাপারটা বোঝানোর আগে কাজিন ঠাকুরদার সম্পর্কে কিছু কথা বোঝানো দরকার। ঠাকুরদার নানারকম গুণ ছিল। তিনি সেই বিরল আধার ছিলেন যিনি লক্ষ্মী স্বরস্বতী দুজনকেই সমান সমাদরে নিজের জীবনে ঠাঁই দিতে পেরেছিলেন। রসবোধ ছিল অসামান্য, তার থেকেও অসামান্য ছিল বাঁকা করে সোজা কথা শুনিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। সে কথার খোঁচা এমন সূক্ষ্ম ছিল যে অর্ধেক লোক ধরতে পারত না, যারা পারত তারা আড়ালে পেট চেপে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতসামনে হাসার প্রশ্নই ছিল না। বেলা বারোটায় কাজিন ঠাকুরদার বাড়ির হেঁশেলের দরজায় শিকলি পড়ত, খুলত আবার বিকেল চারটেয়, চায়ের সময় হলে। এই সময়টুকুর মধ্যে বিনা নোটিসে কেউ গিয়ে হাজির হলে ঠাকুরদা তাঁকে সদর ঘরে বসিয়ে নিজে হাতে জল এবং মুড়িবাতাসা জাতীয় খাবার এনে দিয়ে বলতেন, ‘মেয়েরা এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, চারটের সময় উঠে চা করে দেবেন এখন।’

কাজিন ঠাকুরদার সুসংবদ্ধ, সুশৃঙ্খল জীবনাচরণে একটাই বিড়ম্বনা ছিল। তিনি যে সদবংশোদ্ভূত কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান, এই কথাটা ঠাকুরদা কোনওদিন ভুলতে পারেননি। সারাজীবন ধরে লালনপালন করা এমন বিদ্যাবুদ্ধি, শান দেওয়া অমন রসবোধ – সব থাকতে ঠাকুরদা নিজের ওই পরিচয়টা, যেটাতে তাঁর নিজের কোনও কৃতিত্বই নেই, যেটা নিতান্তই দৈবের খেলা – সেটাকে অত মুখ্য করে তুললেন কেন সেটা একটা রহস্য। সেটা করতে গিয়ে মাশুলও অবশ্য ঠাকুরদা কম গোনেননি, শীতগ্রীষ্মনির্বিশেষে ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলেছেন, একাদশী দ্বাদশী ত্রয়োদশী চতুর্দশী আরও যত রকম দশী হতে পারে সব পালন করেছেন, চল্লিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর একবেলা আহার করেছেন, তাও ঠাকুমার হাতের অমৃতের মতো তেতোচচ্চড়ি মুখে দিয়ে হাঁটু চাপড়ে ‘কেয়াবাত কেয়াবাত’ বলে প্রশংসায় উদ্বেলিত হয়ে উঠতে পারেননি, যতক্ষণ না খাওয়া মুখধোওয়া ইত্যাদি শেষ হয়ে এক ঢোঁক জল খাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ মৌন পালন করেছেন।

এমন ঠাকুরদার ছেলেমেয়েরা বড় হল যখন তখন ঘরদোরের সংখ্যা কিছু বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিল। ঠাকুরদা মিস্তিরি ডাকলেন। মিস্তিরি সাঙ্গোপাঙ্গসহ এসে দেখেশুনে মাপজোক নিয়ে ভেবেটেবে বললেন, ‘হয়ে যাবে বাবু, আপনি শুধু এই নারকেল গাছখানা কাটিয়ে রাখবেন, ব্যস্‌।’

মিস্তিরি তো ব্যস বলে খালাস হলেন, এদিকে ঠাকুরদার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নারকেলগাছ কাটিয়ে রাখবেন কী রকম? ব্রাহ্মণের বাড়ির নারকেলগাছ কাটলে কী ভয়ানক সব কাণ্ড হতে পারে সে কথা কি মিস্তিরি জানে না?

ঠাকুরদা বললেন তিনি গাছ কাটতে পারবেন না, মিস্তিরি বললেন গাছ না কাটলে তিনি বাড়ি বানাতে পারবেন না। প্রত্যাশিতভাবে ঠাকুরদারই জয় হলনারকেলগাছকে স্বমহিমায় রেখে তাঁর চারপাশে বাড়ি উঠল। নারকেলগাছ রক্ষা পেল, ঠাকুরদার ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা পেল, ঠাকুরদা রক্ষা পেলেন, ঠাকুরদার বংশ রক্ষা পেল, সূর্য আবার আগের মতো পূর্বদিকে উঠতে শুরু করল।

পরে জেঠিমাকাকিমারা বুদ্ধি খাটিয়ে নারকেলগাছ ঘিরে সুন্দর বসার জায়গা বানিয়ে দিয়েছিলেন। যতই সাজান, কেউই গিয়ে লাফিয়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসতে যেত না। যেমন আমার বাবা মা। নিজেরা ঘরে ঢুকেই মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার ভঙ্গিতে দৌড়ে দেওয়ালে ঠেকানো চেয়ার সোফায় বসে পড়তেন, আর গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিষ্টি করে আমাকে বলতেন, ‘যাও সোনামা, ওখানে গিয়ে চুপটি করে বোস।’

আমি পা ঠুকে, চুলের ঝুঁটি টান মেরে খুলে, চিৎকার করে বলতেই পারতাম, ‘না না আমি ওখানে বসব না, ও জায়গাটা বিশ্রী, আগের বার গাছের খোঁচা লেগে আমার চুল এবড়োখেবড়ো হয়ে গিয়েছিল আর ওপর থেকে একটা কুঁকড়োনোমুকড়োনো মরা কালো পিঁপড়ে আমার রসগোল্লার প্লেটে পড়েছিল। না না না, আমি ওখানে বসছি না কিছুতেই, বসতে হয় তোমরা বস গে যাও।’

বলিনি। বললে বাবামায়ের মুখটা কেমন হত শুধু সেটা দেখার জন্যই একবার টাইমমেশিনে চড়ে গিয়ে কথাগুলো বলে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সময় আর হাতের তীর, একবার গেলে আর ফেরে না। কেন বলিনি তার কারণ অবশ্য আমার জানা। মেয়ে বড় করতে গিয়ে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি বাবামায়ের হয়েছিল নিশ্চয়, কিন্তু একটা কাজ তাঁরা অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে করেছিলেন। আমার মধ্যে থেকে বিপ্লবের বীজ নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পেরেছিলেন তাঁরা। খেলার মাঠ থেকে ফেরা সদ্য আলোকপ্রাপ্ত শিশুকে যেমন মুখ করে মাবাবারা বোঝান, ‘ছি, শালা বলতে নেই, শালা পচা কথা’, ঠিক তেমনি মেঘাচ্ছন্ন মুখে আমার মা আমাকে বোঝাতেন, ‘‘বেশ করেছি’ কথাটা কোনওদিন কাউকে বোলো না সোনামা, ওটা বলতে নেই, ওটা পচা কথা।’

আমার মাথায় গজাল মেরে গোঁজানো হয়েছিল বাধ্যতা মানুষের সবথেকে বড় গুণ। অন্তত জীবনের শুরুতে তো বটেই।

‘ছেলে বয়সটা মেনে চলারই বয়স, ___,’ এ কথা বাবা অনেকবার বলেছেন। ‘বিশেষ করে গুরুজনদের কথা মানতেই হবে। নিজের ইচ্ছে মত সব কিছু করার বয়সও আছে একটা, কিন্তু সেটা পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর। তখন তোমাকে কেউ বলবে না এটা কর, ওটা কর। বা বললেও, সেখানে তোমার নিজের মতটা দেবার অধিকার আছে। কিন্তু সেটা এখন নয়।’

কোন গল্প বলতে পারলে হাততালি। (না না, এটা সেই ঐতিহাসিক বোনাস কুইজ নয়। সেটা নিচে আছে।)

পোস্টের স্বাস্থের জন্য দরকারি গাত্রমার্জনায় আপোষ করেও অবান্তরের প্রথম বোনাস কুইজ আমি রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্রাহ্মণত্বের গৌরবের কাছে ঠাকুরদা স্বাভাবিক যুক্তিবুদ্ধি বলি দিয়েছিলেন। রবিঠাকুরের গান নয়, গালিবের শায়েরি নয়, জীবনের বেশিরভাগ পরিস্থিতিতেই আমি যে সত্যজিৎ রায়ের লেখা একখানা লাগসই লাইন ঝরঝরে মুখস্থ বলে উঠতে পারি, সে দম্ভের পায়ের কাছে আমিও লেখার ভালোমন্দ বলি দিলাম। গোল্লায় যাক অবান্তরের অঙ্গসৌষ্ঠব, বোনাস কুইজ স্বমহিমায় বিরাজ করুক। কাজিন ঠাকুরদার স্বহস্তে পোঁতা প্রাচীন, গম্ভীর নারকেলগাছের মতো।     

*****


সবকিছুতেই বাড়ির আর বাইরের মধ্যে পার্থক্য করা আমাদের স্বভাব। বাড়ির নাম বাইরের নাম, বাড়ির জামা বাইরের জামা, বাড়ির খাবার বাইরের খাবার আমরা মুখে বলে থাকি ও সব বলাবলির পার্থক্যে কিছু এসে যায় না, ছবিই বলি বা বই, লেখক বলি বা লেখিকা, ব্যাপার তো সেই একই হল হল না। সত্যিটা হচ্ছে ডাকের পার্থক্য থাকলে মনোযোগে পার্থক্য হতেই হবে। ঠিক যেমন বাড়ি আর বাইরের মধ্যে ভাগ করলে অনিবার্যভাবে ঘরোয়া সংস্করণটি মনোযোগ কম পাবে

অথচ আমার মতে বাইরের থেকে ঘরের জিনিসের আদর অনেক বেশি হওয়ার কথা। বাইরের জন্য যা কিছু, তা সে নামই হোক কি পোশাক কি খাওয়াদাওয়া, সে সব নিতান্তভাবেই বাইরেটুকুর সৌন্দর্য বা মানবৃদ্ধির জন্য, অন্তরের আরামের স্বার্থ সেখানে তুচ্ছবাইরের খাবার রসনায় ক্ষণস্থায়ী সুখ দেয় এবং পাকস্থলীতে দীর্ঘস্থায়ী অসুখ পাকায়। ঘরের খাবার শরীরে পুষ্টি যোগানোর সঙ্গে সঙ্গে জিভ পেরিয়ে মনের তৃপ্তির ব্যবস্থা করে। কিন্তু খেতে বসে অত কথা মনে রাখে কার সাধ্য। তখন মাথায় রাখতে হয়ে এটিকেট। কাঁটাচামচের ডানবাঁ। ট্যারিফভ্যাট। টিপস। টিপসের কথা মনে পড়ে গেলেই বুফের হাঁড়ি থেকে দ্রুত আর এক হাতা খাবার তুলে নিতে হয়, পাছে উশুলে কিছু কম পড়ে। এদিকে বাড়ির রান্না যতই ভালো হোক না কেন, তার কপালে একখানা তুবড়োনো থালা ছাড়া আর কিছু জোটে না। নিজেকে যত্ন করে আসন পেতে ভাত বেড়ে হাওয়া করে খেতে বসানোর থেকে উঁচু হয়ে ওঠে বাসন বাঁচানোর আরাম। স্বাদের থেকে বড় হয়ে ওঠে সময়সংক্ষেপ। দামি রেস্টোর‍্যান্টে খাওয়া শেষ হতে না হতেই বিল নিয়ে এলে আমরা ছোটলোক বলে গালি দিই, এদিকে বাড়িতে ‘সব তো একই জায়গায় যাবে’ বলে ভাতের ওপর ডালের ওপর ঝোল ঢেলে কোনওরকমে গলাধঃকরণ করি।

একই রকম অবিচার চলে ঘরের জামার সঙ্গেও। বাইরের জামার প্রতি আমাদের কত নজর, তাকে সর্বদা ধুয়ে শুকিয়ে ইস্তিরি করে টানটান রাখার প্রতি আমাদের কত মনোযোগ। ঘরের জামাকাপড়ের প্রতি যদি তার এককণাও থাকত। সেলাই খুলে গেছে হুঁশ নেই, বোতাম ছিঁড়ে কোথায় পড়ে গেছে খেয়াল নেই। অথচ বাইরের জামাকাপড়ের সঙ্গে ঘরের জামাকাপড়ের উপযোগিতার তুলনা করে দেখুন। লজ্জানিবারণের বাইরে একটার উপযোগিতা কেবলমাত্র ব্যাংকব্যালেন্স এবং ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের বিজ্ঞাপন করা। এ দুটো কাজ ছাড়া অন্য কিছু করতে গেলে, আরাম করে খেতে শুতে বসতে টিভি দেখতে হলে অন্যটার দ্বারস্থ হয়তে হবে।

তবে বাইরের পোশাকের সঙ্গে ঘরের জামার মূল পার্থক্যর জায়গাটা যোগ্যতার। বাইরের পোশাক হয়ে ওঠার জন্য কোনও যোগ্যতা লাগে না। এককাঁড়ি গাঁটের কড়ি খরচ করে বাজার থেকে কিনে এনে পরে ফেললে যে কোনও জামাই নিমেষে বাইরের জামা হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ঘরের জামা হওয়ার প্রক্রিয়াটা এত সহজ নয়। নির্দিষ্ট কতগুলো শর্ত পূরণ করতে না পারলে কোনও জামার পক্ষে আদর্শ ঘরের জামা হয়ে ওঠা দুষ্কর। কোনও কোনও বাইরের পোশাক ঘরের জামা হয়ে উঠতে পারে, বেশিরভাগই পারে না।

কী কী শর্ত পূরণ করলে তবে একটা জামা সার্থক ঘরের জামা হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে আমি বিস্তর ভেবেছি।  

এক, প্রাচীনত্বের শর্ত। শুধু প্রাচীন হলে চলবে না, বহুব্যবহৃতও হতে হবে। ব্যবহারে ব্যবহারে রং চটে, সেলাই খুলে তার চেহারা এমন হতে হবে, যে বাড়িতে নতুন কাজের মাসি এসে তাকে ঘর মোছার ন্যাতা বলে ভুল করবে। এত পুরোনো যে আমার শরীরের খাঁজভাঁজ উত্তলঅবতল সে জামার কণ্ঠস্থ হয়ে যাবে, মেমোরি ফোম ম্যাট্রেসের মতো। পরামাত্র সে জামা আমার শরীরের অংশে পরিণত হবে। আমি ছাড়া পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও মানুষের গায়ে সে ফিট করবে না। আমার আলমারি থেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুলে নিয়ে গিয়ে গায়ে তুললে সে খাটো হবে, ঢলঢল করবে, কামড়ে ধরবে, এমন কুটকুট করবে যে অপহরণকারী কেঁদেকেটে নাকখত দিয়ে তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন।

দুই, পোর্ট কি-র কাজ করার ক্ষমতা। তার গায়ে লেগে থাকা অসংখ্য দাগ ছোপ ক্ষতচিহ্ন একএকটা সময়ের, মুহূর্তের আয়না হবে। একএকটা ছ্যাঁদা, একএকটা বিস্মৃত বাড়ির বিস্মৃত দরজায় জেগে থাকা বিস্মৃত পেরেকের কথা মনে পড়াবে। এই দাগটা? ওঃ এটা চায়ের। ধাবায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম সবাই মিলে। ভারতের বৈদেশিক নীতি নিয়ে কি একটা তুমুল তর্ক চলছিল। না না, আমি তর্ক করছিলাম না, আমি হাঁ করে শুনছিলাম। এমন মগ্ন হয়ে শুনছিলাম যে হাতে ধরা চায়ের কথাও মনে ছিল না। এমন সময় একটা মস্ত সাদা গরু হেলতেদুলতে পেছন থেকে এসে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছিল। যেন সেটাই স্বাভাবিক। যেন রোজ বিকেলে ঠিক চারটের সময় এক কাপ চা না খেলে ওর মাথা ধরে। তাতে আমি চিৎকার করে চায়ের কাপ আকাশে ছুঁড়ে দিতে খানিকটা চা চলকে জামাটায় পড়েছিল।

তিন নম্বর শর্তটা হচ্ছে . . .

দুঃখের বিষয়, তিন নম্বরটা যে কী সেটা লালমোহনবাবু অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না।

কোন গল্প?

আমার বেগুনি সোয়েটারটা, এই যেটা পরে আমি এখন ঝড়ের গতিতে টাইপ করছি আর মনে মনে বলছি, ‘আজও যদি এটা ছাপাতে না পার সোনা, তবে ও পোড়ামুখ আর আমার কাছে দেখিও না’ সেই বেগুনি সোয়েটারটা ওপরের সবক’টা শর্তই পূরণ করেছে।

প্রাচীনত্বের কথাই ধরা যাক। এটা বোনা হয়েছিল উনিশশো বিরানব্বই সালে। ক্লাস সিক্সের সেলাই পাঠক্রমের অংশ হিসেবে। তখন নিজের কাজ মাকে দিয়ে করিয়ে খুব একটা চালাকি করলাম মনে হয়েছিল, এখন আফসোস হয়। তখন নিজে বুনলে হয়তো বোনাটা শেখা হয়ে যেত।

বেগুনি সোয়েটার পোর্ট কি হিসেবে কেমন কাজ করে জিজ্ঞাসা করলে অবশ্য একটু ভাবতে হবে। বেগুনি সোয়েটারের সঙ্গে আমার আলাপ তখনকার যখন আমার জীবনটার মালিকানা ছিল মায়ের হাতে। দিনের চব্বিশটা ঘণ্টা এখন এত কম মনে হয়, তখন মা তারই মধ্যে কেমন সাজিয়ে দিতেন দুবেলা নিয়ম করে পড়তে বসা, গান প্র্যাকটিস, গল্পের বইয়ে ডুবে থাকার ফাঁক, আট ঘণ্টার নিটোল, নিশ্চিন্ত ঘুম। মা ম্যাজিক জানতেন নিশ্চয়। সেই তখন থেকে শুরু করে আজকের এই পলক ফেলতে না ফেলতে ফুরিয়ে যাওয়া দিন মাস বছর - গোটা জীবনটারই তো সাক্ষী বেগুনি সোয়েটার। তার মধ্যে বিশেষ কোনও মুহূর্ত বেছে নেওয়া শক্ত। 

তা বলে কি একটাও নেই? মথুরার গেস্টহাউসের তিনতলার ঘর আছে। লুডোর চালে ঠাকুমা আমার একটার পর একটা গুটি খেয়ে নিচ্ছেন এমন সময় রাস্তায় হই হই চিৎকার। বাঁদরবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাড়ার ওপর, যা পাচ্ছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘরের জানালার পাশের পাঁচিলে লাফিয়ে এসে বসেছে একটা গুণ্ডা মতো বাঁদরশিশু, মেলে রাখা আমার সোয়েটারে সবে থাবা বসিয়েছে। লুডোর মায়া ত্যাগ করে আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছি আমার সোয়েটারের ওপর। বাঁদরশিশুর হাতে সোয়েটারের ডান হাত, আমার হাতে বাঁ। চারপাঁচ সেকেন্ড মরণপণ টানাটানি খেলে শেষে বাঁদরবাচ্চা বোর হয়ে মুখ ভেংচে ল্যাজ দুলিয়ে চলে গেল।

সেই যে বিদেশবিভুঁয়ে বিপদের মুখে ওকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তার প্রতিদান গত বাইশ বছর ধরে আমাকে দিয়ে চলেছে বেগুনি সোয়েটার। গত বাইশ বছর ধরে নিজের বাঁধুনি একটু একটু ঢিলে দিয়ে আমার বর্ধিত শরীরকে নিজের মধ্যে আশ্রয় দিয়েছে। আমিও যতখানি পেরেছি ওর খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছি। সুটকেসে জায়গা কম পড়লে মহার্ঘ লেদার জ্যাকেটকে টেনে বার করে বেগুনি সোয়েটারকে পুরে নিতে একবারের বেশি দেড়বার ভাবিনি। লোকের চোখ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি পাছে ওর রোঁয়াওঠা চেহারাটা দেখে কেউ মন্তব্য করে, বলে বসে, “ইকী, এটাকে এখনও ছুঁড়ে ফেলে দিসনি?”

পারস্পরিক বোঝাপড়া, অ্যাডজাস্টমেন্ট থাকলে যে একটা সম্পর্ক কত দীর্ঘ, কত নিরাপদ, কত মধুর হতে পারে আমার আর আমার বেগুনি সোয়েটার তার প্রমাণ। আর কোনও পরিস্থিতিতে করি না করি, আর কারও সঙ্গে পারি না পারি, আমার বেগুনি সোয়েটারে যে আমি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ফিট করে যাব, এ আত্মবিশ্বাস আমার আছে। এই ক্ষণে ক্ষণে রংবদলানো জগতে সেটা খুব কম কিছু কথা নয়।



Comments

  1. Porlen Porashor ar likhlen emni jhorjhore goddo!!! Ektu chondo miliye kobita o likhe dite parten to!! :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা অর্ণব, পরাশরের পদ্যের গুঁতোয় আমি কাহিল, ঠিকই বলেছ। আর ছন্দ মিললে তো কবেই কবি হয়ে যেতাম, মিললো না বলেই তো হতভাগা ব্লগার হয়ে পড়ে আছি।

      Delete
  2. এত মস্ত লেখেন কি করে? কাল আবার পড়তে হবে।

    প্রথমটা বোধহয় অঙ্কস্যার গোলাপিবাবু ও টিপু। দ্বিতীয়টা বোম্বাইয়ের বোম্বেটে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে বলছি দেবাশিস, আর কাউকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। এই লেখাটা পোস্ট করে আমার নিজের ওপর এমন ঘেন্না হয়েছিল যে দুঃখের চোটে অবান্তরের তল্লাট ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, এসেই দেখব সকলে হাসছে আর হাতে তালি দিয়ে দুয়ো দিচ্ছে।

      এসে অন্য রকম দেখে ভালো লাগছে। আপনারা বড়ই ভালো বন্ধু। আমার হৃত সাহস খুঁজে এনে দেওয়ার জন্য অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      কুইজে দুইয়ে দুই। অভিনন্দন।

      Delete
  3. Kuntala di, kono bariye bolar jonno bolchina.. ek bochor to regular porchi abantor.. tumi ebar golper boi lekho...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর দুঃখের জায়গায় পাড়া দিস না রে ঊর্মি। গল্প লেখার সাধ কি আমার কম? কিন্তু গল্পরা আমার মাথায় ধরা দেয় না। না ভূত, না চোর, না ছোট সাইজের মানুষেরা। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তুই বল যেন সফল হতে পারি।

      Delete
  4. ki voyanok thakurda. erom ak piece thakurda thakle sob mamdobaji (jegulo ami kore berai) dur hoye jeto amar. vaggis nei :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে না, কুহেলি, উল্টোটাও হতে পারত। গোমড়া ঠাকুরদারা মামদোবাজি করে বেড়ানো নাতিনাতনিদের বেশি প্রশ্রয় দেন, এটা আমি পুনঃপুন দেখেছি।

      Delete
  5. Onko sir, golapibabu o Tipu! Sotti bolchi, onno comment chokh dei ni!

    ReplyDelete
  6. Replies
    1. দুটো উত্তরই এক্কেবারে ঠিক, রুণা।

      Delete

Post a Comment