তেষট্টি



আলোকচিত্রীঃ বাবা ওরফে শ্রী কল্যাণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

ডিফেন্স কলোনির মোড়ে অটোটা দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় ফোনে আওয়াজটা হল। মেল এসেছে। আমাকে সাধারণত পেপারফ্রাই আর ফ্লিপকার্ট ছাড়া কেউ ইমেল করে না। আর কয়েকটা ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি। যারা মেঘ না চাইতেই জলের মতো আমাকে কার্ড অ্যাপ্রুভাল পাঠিয়ে যায়। তাদের ইমেল চলন্ত গাড়িতে বসে খুলে দেখার তাড়া আমার নেই। 

তবু কী মনে করে, অটোতে বসে বসেই সেদিন মেলটা খুললাম। খুলতেই চক্ষুস্থির। বাবার মেল। সাবজেক্ট লাইনে অল ক্যাপস-এ লেখা TIGER HILL E SUJYODOY, আর তার নিচে থাম্বনেল-এ ওপরের  ছবিটা।

পরের রাস্তাটুকু মনটা অস্থির হয়ে রইল। অফিসে পৌঁছে চায়ের ব্যবস্থা করারও আগে ফোন করলাম। ওদিক থেকে মা "হ্যালো" বললেন। পেছনে ভীমসেন জোশী তেড়েফুঁড়ে বিলাবলের তান ধরেছেন।   

"তোমরা কোথায়?"

"এই তো নতুন ঘরে।  যা সুন্দর রোদ উঠেছে না সোনা, ঘর একেবারে ভেসে যাচ্ছে। ঝোলাগুড় দিয়ে রুটি খাচ্ছি আমরা, তোদের ওখানে ঝোলাগুড় পাওয়া যায় সোনা? না হলে আমি স্পিডপোস্ট..."

"বাবা কোথায়? এখন হঠাৎ দার্জিলিং গেছে কেন?"

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর মা হোহো করে হেসে উঠলেন। 

আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না। আগের সপ্তাহেই  বাবার ভয়ানক ঠাণ্ডা লেগেছিল। জন্মসূত্রে পাওয়া হাঁপানির অসুবিধেটা এমন বেড়েছিল যে শেষে ডাক্তারবাবু বাড়ি এসে ইনজেকশন ফুটিয়ে সেটাকে বাগে এনেছেন। তার তিনদিন পর দার্জিলিং গিয়ে বাবা টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখছেন, আর মা বাড়িতে বসে বসে ঝোলাগুড় দিয়ে রুটি খাচ্ছেন, গান শুনছেন আর আমার প্রশ্ন শুনে হাহা করে হাসছেন?   

"দার্জিলিং...হা হা হা... শুনছ, সোনা বলছে দার্জিলিং... হো হো হো..."

এবার পাশ থেকে আরেকটা হাসির শব্দ শুরু হল।

ইস, আমি কী গাধা। ছি ছি ছি। 

“হ্যালো, সোনা?”, গুড়রুটির থালা নামিয়ে রেখে বাবা এসে মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিয়েছেন।

আমি যথাসম্ভব নিজের নির্বুদ্ধিতা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। 

“বুঝেছি, বুঝেছি, আর বলতে হবে না।”

“টাইগার হিলের থেকে কোনও অংশে কম কি? তুইই বল?”

“কম তো নয়ই, বরং বেটার।”

সত্যি তো। লিস্ট বানিয়ে ব্যাগ গোছানোর হ্যাপা নেই, গাড়িঘোড়ায় চাপার ঝাঁকুনি নেই, হোটেল খোঁজার মাথাব্যথা নেই। স্রেফ সোয়েটার গলিয়ে আর গলায় মাফলার পেঁচিয়ে প্রথমদফায় ন’টা, তারপর টার্ন নিয়ে আরও সাতটা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে নারকেল গাছের ওপারে তাকালেই যদি এমন সূর্য দেখা যায়, তাহলে তাকে টাইগার হিলের সূর্যের থেকে বেশি নম্বর দিতে হয় বইকি।

আমার বাবা অন্তত দেন। পাহাড়ের চুড়োয়, সাগরের তীরে, মরুভূমির পারে, জঙ্গলের পাতার ফাঁকে কম সূর্যোদয় তো তিনি দেখেননি, তবু এখনও বাড়ির ছাদে উঠে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তিনি হাঁ হয়ে যান। আর তারপরই একটা ভয়ানক মজার প্ল্যান তাঁর মাথায় আসে। নিচে গিয়ে ফোনটা নিয়ে এসে ছবি তুলে সেটার ওপর টাইগার হিলের সূর্যোদয় ক্যাপশন দিয়ে সোনাকে মেল করার প্ল্যান।

হ্যাপি বার্থডে, বাবা। গত তেষট্টিটা বছর তুমি যেমন আনন্দে, যেমন পরিতৃপ্তিতে কাটিয়েছ, তোমার পরিস্থতি অনুকূল ছিল বলে নয়, ওভাবে থাকাই তোমার চরিত্র বলে, আগামী তেষট্টি হাজার বছরও ততখানি আনন্দে আর তৃপ্তিতে কাটাও, এই আমার মনের একেবারে ভেতরের চাওয়া।


Comments

  1. অনেক দিন পর অবান্তরে এলাম।
    আর এসেই এমন একখানি লেখা পেয়ে মন দারুণ খুশি হয়ে গেল।
    এ কমাস সত্যিই খুব কাজের চাপে ছিলাম।
    আস্তে আস্তে আবার অবান্তরের নিয়মিত না হোক পাঠক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

    --------------

    এবার জানায় জানায় জেঠুকে ৬৩তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সত্যিই ছবিটা দারুণ উঠেছে। আর তোমাকে জানায় হ্যাপী নিউ ইয়ারের শুভেচ্ছা, কুন্তলা দি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অনুজিৎ। তোমাকেও আমার নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা জানাই।

      Delete
  2. oh guru ki lekha,mon ta fooool bhore gelo.ki kore lekho go guru.
    baba mar sathe regular phone e galpo kora hoy na,tomar kache eta sekhar ache,tumi time kore ei kaj ta karo,amra bastotar dohai diye kaj ta eriye jai....hats off guru.

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, প্রসেনজিৎ, তোমার এই কমেন্টটা পড়ে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। এই যে সময় করে মায়ের সঙ্গে (বাবার সঙ্গে সপ্তাহে একবার কি দুবার, তার বেশি হয় না) রোজ কথা বলা (দিনে তিনবার করে) এটার একতিল কৃতিত্বও আমার নয়। নিজের হাতে থাকলে আমি করছি করব করে করতাম না। কিন্তু আমার জীবনের আরও সব বিষয়ের মতোই এটাও মা নিজের হাতে নিয়েছেন এবং বকে, ঝকে, চোখ বড় বড় করে আমাকে দিয়ে রোজ ফোন করিয়েছন। একা থাকতাম যখন তখন রোজ বাড়ি ফিরে মাকে খবর দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল, যে আমি হাতপা মনমাথা সব যথাস্থানে নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। না দিলেই মা এমন রাগ করতেন...তখন ভয়ে ভয়ে করতাম, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। অফিসে পৌঁছে খবর দিই, বাড়ি ফিরে খবর দিই, মাঝখানে লাঞ্চ খেয়ে উঠে খবর দিই, বসের কাছে বকুনি খেয়ে খবর দিই। মাঝে মাঝে মনে হয় মা বোধহয় দিনে এতবার ফোন ধরতে বিরক্ত হন। কিন্তু তাঁর আর কিছু করার নেই। আফটার অল, শেয়ালকে ঘাড় ধরে ভাঙা বেড়াটা উনিই দেখিয়েছেন।

      Delete
  3. ki sundor shubhechha janano..
    onar rosikotabodh r o proshongsa korte hoi..

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই প্রশংসাটা শুনলে বাবা খুব খুশি হবে। থ্যাংক ইউ, সঙ্গীতা।

      Delete
  4. amar tarof theke onake onek onek Subhechha.

    ReplyDelete
  5. Kaku ke janmodin er anek shubheccha :) :)

    ReplyDelete
  6. jonmodiner onek shubhechha onake.
    Bratati.

    ReplyDelete
  7. ইচ্ছাডানা, তিন্নি, ব্রততী, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। বাবাকে নিশ্চয় শুভেচ্ছার কথা জানাব।

    ReplyDelete

Post a Comment