গোয়া ১/২



আমার একসময় ধারণা ছিল খোনা গলা ছাড়া ফেরিওয়ালা হওয়া যায় না। অনেকদিন পর বুঝেছিলাম যে ও গলা ওঁদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নয়, ওটা ইচ্ছে করে করা, যাতে স্বর অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছয়। এমনকি ট্রেনের দুলুনির গাঢ় ঘুম ভেদ করেও। সেই রকম গলার চায়এএএ শব্দটা ভেসে এল যেই, ঘুম ছুটে গিয়ে পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। আমি সাইড আপার থেকে ঝুঁকি মারলাম, অর্চিষ্মান সাইড লোয়ার থেকে ঘাড় তুলল, দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলাম, “খাবে তো?” 

খাব না আবার? বার্থ থেকে নেমে অর্চিষ্মানের পাশে বসলাম। এম এ পড়ার সময় পূর্বা এক্সপ্রেসের তিনতলার বার্থ থেকে সিনথেটিক সালওয়ার কামিজ ফসকে আমি সোজা মাটিতে এসে পড়েছিলাম, সেই থেকে আমি অতি সাবধানে বার্থে ওঠানামা করি। অর্চিষ্মানও সে পতনের কথা জানে, ও-ও তাড়াতাড়ি উঠে আমার পা যেখানে পড়বে সেখানকার চাদরটাদর সরিয়ে দিল। ভাইসাব দুজনের হাতে দুখানা চা ধরিয়ে টাকা নিয়ে বিদায় হলেন। 

ট্রেন থেমে ছিল। পর্দা সরিয়ে দেখি জলের ফোঁটার দাগওয়ালা কাচের ওপারে প্ল্যাটফর্ম। আমাদের কামরাটা ভালো জায়গায় পড়েছে, ওইখানেই স্টেশনের নাম লেখা বোর্ড। রত্নগিরি। প্ল্যাটফর্মের ওপাশ থেকে সবুজ জঙ্গলের দেওয়াল উঠে গেছে, ফাঁকা পরিষ্কার প্ল্যাটফর্ম, জনহীন। একটা নেড়ি, রোগা শরীরে জেগে থাকা স্তনবৃন্ত সদ্য মাতৃত্বের প্রমাণ দিচ্ছে, নীল রঙের একটা ডাস্টবিনে সামনের দু’পা দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই, যাঁরা ছিলেন তাঁরা সকলেই নানারকম লোভনীয় পশরা নিয়ে ট্রেনে উঠে এসেছেন। গরমাগরম বড়া পাও? (নাঃ, সকালসকাল অম্বল চাই না), ঘি দেওয়া ইডলি? (সাতসকালের পক্ষে একটু ভারি), মশলা ভেল? পারফেক্ট। একটা চৌকো কাগজই প্লেট, তার ওপর মুড়ি, পেঁয়াজ, টমেটো, চানাচুর ইত্যাদি ঢেলে দুই কোণা ধরে ঝাঁকানোর সময় সেটাই বাটি, আর কবজির মোচড়ে পরমুহূর্তে সেটাই তিনকোণা ঠোঙা। 

একটা চামচও ভাইসাব দিয়েছিলেন, সসম্মানে সেটা সরিয়ে রেখে ঠোঙা কাত করে ডান হাতের তেলোয় মুড়ি ঢেলে মুখে পুরলাম। এক মুঠো মুড়ি, এক চুমুক চা। চায়ে মিষ্টি বেশি, কিন্তু সেটা প্রত্যাশিত। ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। রত্নগিরি পেছনে সরতে সরতে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

আমরা যাচ্ছি গোয়া। এর আগে অনেক জায়গায় যাওয়ার কথা হয়েছিল। ভরতপুর, মাউন্ট আবু, অমৃতসর। এখানে গেলেও হয়, ওখানে গেলেও। আবার না গেলেও কিছু না। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে অর্চিষ্মান বলল, উফ কতদিন সমুদ্র দেখিনি। সেই দু’হাজার নয়ে গিয়েছিলাম বাবামায়ের সঙ্গে পুরী, ব্যস। আমি ভাবার চেষ্টা করলাম আমি শেষ কবে সমুদ্র দেখেছি, মনেই পড়ল না। এক মিনিটের মধ্যে ঠিক করলাম সমুদ্র দেখতে হবে, তিন মিনিটের মধ্যে গোয়ার নাম মাথায় এল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনস্থির, পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সবকটা টিকিট বুক হয়ে গেল, তিন্নির কল্যাণে হোটেলও। 

আমরা এসেছি বম্বে পর্যন্ত প্লেনে, তারপর তিন্নির বাড়িতে একঘণ্টার ঝাঁকিদর্শন সেরে লোকমান্য তিলক টার্মিনাস থেকে রাত একটা দশের কারমালি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। বম্বে থেকে গোয়ার ট্রেনরাস্তা নাকি ভারি সুন্দর, দুপাশে পশ্চিমঘাটের জঙ্গল আর অগুন্তি ছোটবড় টানেল। আমরা নামব কারমালি ষ্টেশনে। কারমালি ষ্টেশনটা যে আমাদের পক্ষে খুব একটা সুবিধের হবে তা নয়, কারণ আমরা যাব সেই দক্ষিণ গোয়ার পালোলেম সৈকত, কারমালিটা উত্তরঘেঁষা, আমাদের পক্ষে বেস্ট হত মাড়গাঁও নামলে। কিন্তু মাড়গাঁওয়ের ট্রেনে সিট নেই। অগত্যা কারমালি।

কারমালি স্টেশন ছোট এবং সুন্দর। প্ল্যাটফর্মের লাগোয়া অফিসবাড়ির বারান্দায় গোল থাম আর ছাদের রেলিং-এ কলসি ডিজাইন। কারমালি থেকে ট্যাক্সি নিলে পড়বে একুশশো মতো, অটো নিলে পনেরোশো চল্লিশ। দরাদরির ব্যাপার নেই, সব ভাড়া ল্যামিনেটেড হলুদ কাগজে কালো অক্ষরে লেখা আছে। বেড়ানোর শুরুতে পরিশ্রম করার উৎসাহ প্রচুর থাকে, পয়সা বাঁচানোর লিপ্সা প্রবল থাকে, আমরা অটোই নিলাম। এদিককার অটোগুলো আমাদের ওদিককারই মতো, কেবল দরজা আঁটা। আঁকাবাঁকা পথ ধরে অটো চলল। বেশিরভাগটাই বড় রাস্তা ধরে, দুপাশে জঙ্গল নয়তো ফাঁকা মাঠ, মাঝে মাঝে মাঠের ভেতর ঢুকে আসা খাঁড়ি। সে সব তো দারুণ দৃশ্যপট, কিন্তু ইন্টারেস্টিং হচ্ছে যখন অটো চলেছিল পাড়ার ভেতর দিয়ে। রংবেরঙের প্যাস্টেল রঙের বাড়ি, কোনওটা একচালা, কোনওটা দোচালা, কোনওটা একটু বড়, কোনওটা একটু ছোট, কিন্তু সবগুলোই ভয়ানক ঝকঝকে তকতকে, সবগুলোরই সামনে ছোট একফালি জমি, জমিতে নয়নতারা ফুল ফুটে আছে। 

এত বিচ থাকতে আমরা পালোলেমই বাছলাম কেন সে বলতে গেলে অনেক আগে থেকে শুরু করতে হয়। যখন থেকে গোয়া যাওয়া ঠিক হল। গোয়া বলতেই আমার মানচিত্রে দেখা পুঁচকে, প্রায় চোখে দেখা যায় না, রাজ্যটার কথা মাথায় এসেছিল, তলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম তার রীতিমত উত্তরদক্ষিণপূর্বপশ্চিম আছে। এবং সেগুলো বেশ দূরে দূরে। একবারে সব দেখে ফেলব সেরকম হবে না। হয় তোমাকে উত্তরে যেতে হবে নয় দক্ষিণে। গোয়ার বিখ্যাত বিচগুলো, বাগা, কালাংগুটে, সব উত্তরে। বিখ্যাত, অর্থাৎ ভিড়ও ওখানে বেশি। ভেবেচিন্তে আমরা দক্ষিণই বাছলাম। তিন্নি-সায়ক পালোলেম ঘুরে এসেছে, মুক্তকণ্ঠে রেকোমেন্ডেশন দিল। 


হোটেলও ওদের রেকোমেন্ডেশন। প্যাপিলন, পালোলেম। বারান্দা থেকে সমুদ্র, সমুদ্রের তীরের বাঁকা নারকেলগাছের কুঞ্জ, নৌকো, রোদপোয়ানোর রঙিন ছাতার ঘের, সব দেখা যায়। বেতের চেয়ার পাতা আছে, বসে বসে চেয়ে থাক। যতক্ষণ না চোখ ব্যথা হয়ে যায়, কিংবা পেটে ছুঁচো ডন মারে। 

ভেলপুরি হজম হয়ে গেছে সেই কখন। নেমে খাবারের খোঁজে গেলাম। খাওয়ার জায়গায় বড় বড় গদিআঁটা তক্তপোশ, ইতিউতি তাকিয়া ছিটোনো। খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে গেলে পেছন দিকে শরীর ফেলে দিয়ে বিশ্রাম করে নেওয়া যায়। ফিশ কারি আর চিকেন জাকুটির মাঝখানে তাই করলাম। খেতে খেতে গান করলে পাগল হয় বলতেন ঠাকুমা, শুয়ে পড়ছি শুনলে কী বলবেন কে জানে। 


পালোলেম বিচটা কাস্তের মতো গোল। সোনালি বালি পেরিয়ে সেই পরিধি ঘিরে সারিসারি কুটির। আর কুটিরের পেছনে নারকেল গাছের সারি। উত্তরের সৈকতের তুলনায় ফাঁকা তা বলে জনশূন্য নয়। লোকজন স্নান করছে, বোটে চড়ছে, কায়াকিং করছে। সাদারা প্রাণপণে কালো হওয়ার চেষ্টা করছে, কালোরা চেষ্টা করেও আরও কালো হওয়া রুখতে পারছে না। অর্চিষ্মান বুদ্ধি করে দুটো হাওয়াই চটি এনেছে, একটা ভেতরে পরার একটা বাইরে, আমার আবার মিনিম্যালিস্ট প্যাকিং-এর বাতিক আছে, আমার কপালে বিচে হাঁটার জন্য সেই বাটার জুতো। দু’পা ফেলতে না ফেলতে বালি ঢুকে একাকার। 

হাঁটতে হাঁটতে কাস্তের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছলাম। পায়ের তলার বালি নরম থেকে শক্ত হয়ে আবার নরম হল, জলের নিচে বালির গায়ের ডিজাইন একবার সাপের মতো আঁকাবাঁকা হল, একবার মৌমাছির চাকের মতো খুপরি খুপরি হল, তারপর একসময় বালি ফুরিয়ে গিয়ে উঁচু উঁচু পাথর শুরু হল। সেগুলোর কোনও কোনওটার গায়ে সারিসারি মাছের আঁশ না ঝিনুক, কী জানি কী শুকিয়ে খরখরে হয়ে রয়েছে, অসাবধানে খালি পা পড়লে প্রাণ বেরোনোর জোগাড় হয়। দেখেশুনে একটা ফাঁকা পাথর দেখে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আমাদের আশেপাশে মসৃণ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে সাহেবমেমেরা কেউ কেউ শিরদাঁড়া টান করে, তর্জনী বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে স্থির নেত্রে ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর টের পেলাম আশেপাশের সমস্ত শব্দ, নারকেলপাতার খসখস, পাথরের গায়ে জলের ছলাৎ ছলাৎ, দৈবাৎ উড়ো পাখির ডাক, হিন্দি ইংরিজি কথোপকথনের টুকরো, সব কী অদ্ভুত রকম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


সূর্য ডুবল। আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। এরই মধ্যে সমুদ্র এগিয়ে এসে বালির ভেতর কোথাও কোথাও ঢুকে পড়েছে, জিনসটা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল, ভাঁজ করে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত তুলেও রক্ষা হল না, আবার ভিজে গেল। 

রাতে খেতে বেরোলাম। সারা সৈকত জুড়ে টেবিল পাতা হয়েছে, টেবিলের ওপর কাচের ঢাকনার ভেতর মোমবাতি জ্বলছে। বিচের মেন গেটের কাছে ‘ দ্রোপদী’ নামের গমগমে দোকান। সেখানে গিয়ে অর্চিষ্মান কী খেল ভুলে গেছি, আমি খেলাম সিফুড স্যালাড। খেতে খেতে দেখলাম সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে কারা যেন ফানুস ওড়াচ্ছে। রঙিন কাগজের ঠোঙায় পোরা আগুন, দুলে দুলে উড়ে যাচ্ছে কুচকুচে কালো আকাশের দিকে।
                                                                                                                                   (চলবে)


Comments

  1. apurbo. porer part ta taratari dao.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, চুপকথা। লিখছি, তাড়াতাড়িই হয়ে যাবে মনে হয়।

      Delete
  2. আমি সাইড আপার থেকে ঝুঁকি মারলাম, অর্চিষ্মান সাইড লোয়ার
    ki masti hoy na balo..side upper side lower peye gele..

    darun lekha..khub bhalo..

    প্যাপিলন...darun ekta boi ache ei name..khub bikhyato..ami bangla onubaad ta porechi..parle poro..

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, নিশ্চয় পড়ব, প্রসেনজিৎ। সাইড আপার সাইড লোয়ার দুজনের জন্য পারফেক্ট। হাই ফাইভ।

      Delete
  3. আহা, গোয়া। আমার ফেভারিট হলিডে ডেস্টিনেশন। বাকিটুকুর অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. গোয়া আমাদেরও অন্যতম ফেভারিটে পর্যবসিত হয়েছে, দেবাশিস।

      Delete
  4. anekdin por bhraman kahini! thank you.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভ্রমণও তো অনেকদিন পর, কাকলি, তাই। তবে গোয়া অনেকদিন না বেড়ানোর দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে, এটা সত্যি।

      Delete
  5. Replies
    1. সেকী, যাওয়াআসা নিয়ে চার রাত, পাঁচ দিন তো আমাদের কাছে রীতিমত গড়িমসি বেড়ানো।

      Delete
  6. তা অবশ্য ঠিক। তবে গোয়া তে অনেক কিছু দেখার (ইংরেজি তে বললে experience করার) আছে। আরও অনেকবার আসতে হবে তোমাদের। আর গোয়া এমন জায়গা যে হুড়মুড়িয়ে বেড়াতেও ইচ্ছে করে না। একটু ল্যাদ খেয়ে, আরাম করে ঘোরায় আনন্দ বেশী।

    আমরাও গেছিলাম অজন্তা ইলোরা আওরঙ্গবাদ। ওই তিন দিন। ওতে ঠিক মন ভরে না।

    ReplyDelete

Post a Comment