সাজাব যতনেঃ স্পেশাল শারদ এপিসোড




নমস্কার। সুপ্রভাত। কেমন আছেন? বাতাসে কিন্তু আমেজ এসে গেছে, দেখেছেন তো? শহরের বাইরে গেলে কাশফুলটুল দেখে হয়তো বোঝা যেত, আমাদের বাড়ির সামনে একটা শিউলি গাছ ছিল, কিছুদিন আগে কেটে ফেলায় এখন আর সেটা দেখেও বোঝার জো নেই। কিন্তু যাদের গাছ নেই, তাদেরও টিভি আছে। আর টিভিতে হইহই করে পুজো এসে গেছে। কলকাতার বচ্চন পরিবারের অ্যাডগুলো দেখেছেন? সকলে মিলে কেমন হেসে হেসে উপহার দিচ্ছে একে অপরকে? জামা, জুতো, গ্যাজেটস? নারকেল তেল? অ্যাডে কাজ দিয়েছে আশা করি? নিজের আর আপনজনদের তেলা মাথায় আরও তেল দেওয়ার জন্য, ভরা আলমারি আরও ভরার জন্য শপিং সেরে ফেলেছেন?

যতই শপিং করুন না কেন, জামাকাপড় যতই নতুন নতুন পরুন না কেন, সত্যি কথাটা হচ্ছে, লোকে দেখবে আপনার মুখ। আপনার ত্বক। আপনার গালের চমক, চুলের বাহার। কাজেই অত সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় গয়নাগাঁটির সদ্ব্যবহার করার আগে নিজেকে সুন্দর করে তুলতে হবে।  আর সেই সুন্দরের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করানোর ফুলপ্রুফ টিপস নিয়ে, পুজোর পাঁচ, থুড়ি, পনেরোদিন কী সাজবেন, কীভাবে সাজবেন, নানান খবর নিয়ে আজকেরসাজাব যতনের স্পেশাল শারদ এপিসোডে এসে গেছি আপনাদের সঞ্চালিকা সুরূপা আর আমাদের সঙ্গে আছেন, আপনাদের সবার চেনা, সবার ফেভারিট, কলকাতার বিখ্যাত বিউটি বিশেষজ্ঞ, শাইন অ্যান্ড গ্লো ব্র্যান্ডের সি ই ও রূপসী ম্যাম। ওয়েলকাম ম্যাম।

ম্যামঃ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। আমারও ভীষণ ভালো লাগছে আবার সাজাব যতনে-তে আসতে পেরে। একটা গুড নিউজ দিয়ে শুরু করতে চাইব, শাইন অ্যান্ড গ্লো কিন্তু এখন মেক ওভার নিয়ে সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো হয়ে গেছে।

ওহ, নতুন নাম রেখেছেন বুঝি দিদি, থুড়ি, ম্যাম?

হ্যাঁ ভাই। শাইন অ্যান্ড গ্লো-এর এতদিন অ্যাপ্রোচ ছিল সায়েন্টিফিক, এই বার পুজোয় আমরা আমাদের ব্র্যান্ড রি-লঞ্চ করেছি, এখন আমাদের শ্যাম্পু লোশন ক্রিমে, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেনের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে অশ্বগন্ধার রস, ঘৃতকুমারীর এসেন্স, কাঁচা হলুদের নির্যাস, পেঁয়াজের ঝাঁজ, রসুনের সুবাস। আমরা আসলে চাইছি বেদ আর বিজ্ঞানটাকে পাঞ্চ করতে। আমাদের ট্যাগলাইনও ওটাই। বেদেও আছি বিজ্ঞানেও আছি।

শুনেই তো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ম্যাম।

শুধু শুনেই? আমাদের দশ হাজার বছরের পরম্পরায় বিউটি বিষয়ক এমন সব ফিলজফিক্যাল থট আছে; আমাদের কবিতা, গানে, সাহিত্যে বিউটি নিয়ে এমন চর্চা, রান্নাঘরে বিউটিফুল বানানোর এমন সব উপাদান, এক্সপ্লোর করতে শুরু করলে তোমার মাথা ঝিমঝিম করবে।

দশ হাজার? টিভির অ্যাডে যে বলল পাঁচ হাজারি পরম্পরা?

কে বলল?

শাহরুখ... নাকি সলমান… না না মনে পড়েছে, অক্ষয়কুমার অক্ষয়কুমার। হ্যাঁ ম্যাম, অক্ষয়কুমার।

ওহ ওই হিরোটা? ওটা হচ্ছে একটা ডাম্ব অ্যাকটর। ওর কোনও সিনেমা আমি পাইরেটেড কপি ছাড়া দেখি না, কোনও মেসেজই থাকে না। উইকিটুইকি দেখে উগরে দিয়েছে দেখো গে। থিংকিং অ্যাকটর আমির খান বললে তবু বিশ্বাস করতাম, অক্ষয়কুমার বলেছে যখন তখন তো স্যাঙ্গুইন পাঁচ হাজার নয়। তুমিই বল না, এতদিনের সনাতনী ব্যাপারস্যাপার, মোটে পাঁচহাজারের হতে পারে?

আমি ঠিক বলতে পারব না ম্যাম, আমার আবার চিরকালই ইতিহাসে পাঁতিহাস।

আচ্ছা দশ যদি নাও হয়, সাড়ে সাত হাজার তো হবেই। আর কমাতে বোলো না প্লিজ, পুজোর প্রোমোশনের বউনি, এর নিচে নামতে পারব না।

সে পাঁচ দশ সাড়ে সাত যাই হোক, শাইন অ্যান্ড গ্লো এখন নবরূপে সনাতনী, সেটাই রোমহর্ষক ব্যাপার। অভিনন্দন জানবেন ম্যাম।

থ্যাংক ইউ সো মাচ। এই রি-ব্র্যান্ডিং নিয়ে যা পরিশ্রম গেল। ব্যাকব্রেকিং। উঃ।

খাটনি তো হবেই। সাড়ে সাত হাজার বছরের খনি খোঁড়া...

বেশিরভাগটাই আমাকে দেখতে হয়েছে, তবে আমার টিমও দারুণ খেটেছে। রাদার খাটিয়ে নিয়েছি। অফিস চলাকালীন পার হেড পাঁচটে স্টেটাস দেওয়ার আপার লিমিট করে দিয়েছিলাম আর মোটে তিনটে সেলফি।

কী বলছেন ম্যাম!

ওইরকম ঘাড় ধরে কাজ করিয়েছিলাম বলেই না হল? সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো-র নতুন ব্র্যান্ড নতুন লুকে, নতুন দামে বাজারে এসে গেছে, বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই।

দেখছেন তো দিদিরা বোনেরা মাসিরা পিসিরা, আপনাদের গাল ঝকঝকে, চুল চকচকে করার জন্য রূপসীম্যাম আর ম্যামের টিম কেমন পরিশ্রম করেছেন? আপনারা দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে আসুন, ম্যামের থেকে টিপস নিন, ম্যামের প্রোডাক্ট কিনুন, মাখুন, সুন্দরী হয়ে উঠুন। তার আগে আমাদের সাজাব যতনে-র স্টুডিওতে ফোন করুন, নম্বর হচ্ছে... ওহ, ফোন এসে গেছে অলরেডি, ম্যামের সঙ্গে কথা বলার জন্য সকলেই উদগ্রীব।

হ্যালো, সাজাব যতনের প্রথম কলার হওয়ার জন্য আপনাকে অনেক অভিনন্দন এবং স্বাগত। কে বলছেন?

হ্যালো হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন?  

হ্যাঁ পাচ্ছি। বলুন।

রুপুদিদিকে একটু দিন না।

ম্যাম এখানেই আছেন, আপনি বলে যান, শুনতে পাবেন।

হ্যালো রুপুদিদি?

বলছি। আপনি কে বলছেন?

দিদি আমি বনশ্রী বলছি বেহালা থেকে। অজন্তা সিনেমায় নেমে রাস্তা পার হয়ে যে সরকারি আবাসনটা আছে সেটার পাশ দিয়ে দশ মিনিট হাঁটলে, অটো পেলে...  

আপনি কি ম্যামকে হাউজ কল দেবেন?

হাউজ কল?

তাহলে বাড়ির লোকেশন ছেড়ে সমস্যায় আসুন।

সমস্যাটা হচ্ছে দিদি, আমার মুখের গ্লো কমে যাচ্ছে। মেয়েটাকে উঠিয়ে আয়নার ওপরের টিউবলাইটটা মোছানোর পরও ম্যাড়মেড়ে। চুলটাও আগের মতো ফুরফুরে হচ্ছে না। বাঁচান দিদি।

ব্যস, এই? ওর জন্য তো আমাদের..

জানি জানি দিদি, গ্লো ফেস আর শাইন হেয়ার, আমি তো কিনে এনে রেগুলার মাখছি। এক মাস হল।

তাহলে তো হয়েই গেল। সমস্যা কীসের?

ইয়ে, বাড়ির ভেতরে তো গ্লো ভালোই হচ্ছে, কিন্তু বাইরে বেরোলেই দিদি গরমে সব গলে গলে পড়ছে। অজন্তা পর্যন্ত আসতে না আসতেই সব ক্রিম রুমালে। মুখে যদি ক্রিম না-ই থাকল তাহলে গ্লো কী করে থাকবে ম্যাম? ঘাম বন্ধ করার কোনও ক্রিমটিম, পাউডারটাউডার যদি বলে দেন...

সে বলব না হয় কিন্তু সবার আগে ইম্পরট্যান্ট একটা প্রশ্ন অ্যাড্রেস করা দরকার। তুমি রোদে হাঁটছিলেই বা কেন?

আর বলবেন না দিদি। অটো পাওয়াই যায় না। পেলেও অটোওয়ালার পাশের পাশের সিটে বসতে হয়, হাঁটার থেকেও বেশি পরিশ্রম। আরও বেশি ঘাম।

হোয়াই অটো? স্মার্ট ফোন নেই? ওলা ডাকবে, উবার ডাকবে, কাঁচ বন্ধ করে বসে থাকবে। বলবে এসি বাড়িয়ে দিন। রোদে খবরদার বেরোবে না। ইউ ভি রে জানো? স্কিনে লাগলে কী মারাত্মক সব ব্যাপার ঘটতে পারে জানো? বাই দ্য ওয়েআমাদের সনাতনী সব প্রোডাক্টে আমরা এস ইউ ভি আগের থেকে বাড়িয়েছি।

সঞ্চালিকা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন। ক্যামেরা সামনে রাখা টেবিলে ফোকাস করল। বেগুনি রঙের ছোট বড় বোতল, টিউব, জার ঠাসাঠাসি।

যাই হোক, তুমি এখন আমাদের নিউ অ্যান্ড ইম্প্রুভড সনাতনী গ্লো ফেস ব্রাইটেনার আর সনাতনী শাইন হেয়ার ভলিউমিনাইজারটা কিনে ব্যবহার করা শুরু কর, ফেসের ফরমুলাটায় আমরা ঘৃতকুমারীর নির্যাস আর হেয়ারেরটায় পেঁয়াজের রস অ্যাড করে বাজারে ছেড়েছি। দুটোরই দাম আগের দামের দেড়গুণ, কাজ কগুণ সে আর নিজে মুখে বলছি না, নিজেই টের পাবে।

বাঁচালেন দিদি। বলছি ওতে মুখের অয়েলি ভাবটাও যাবে তো?

অয়েলি! আমাদের প্রোডাক্ট তো ফ্রম দ্য বিগিনিং কমপ্লিটলি অয়েল ফ্রি। তুমি কী বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। রেগুলারলি ইউজ করছ নাকি একবার মেখেই এই হল না সেই হল না বলে নালিশ করতে লেগেছ?

এই আপনাকে ছুঁয়ে বলছি দিদি, গত তিন মাস তিন বেলা করে মেখেছি, একদিন তো অফিসে বেরোনোর আগে লেট হয়ে যাচ্ছিল বলে চান বাদ দিয়েছি, তবু গ্লো না মেখে বাড়ির বাইরে পা রাখিনি।

প্রসিডিওর ফলো করছ? শুধু ধাঁই ধাঁই করে প্রোডাক্ট মাখলেই তো হবে না, তার আগে ফেসটাকে প্রিপেয়ার করতে হবে। নানারকম স্টেপ আছে। ক্লিনিং, ময়েশ্চারাইজিং অ্যান্ড টোনিং অ্যান্ড…

স---ব করি দিদি…

সব স্টেপে আমাদের ব্র্যান্ড ইউজ করতে হবে, প্রেপিং-এ যা তা সস্তা ব্র্যান্ডের জিনিস মেখে স্কিন মাটি করলে তারপর শাইন অ্যান্ড গ্লো কিছু করতে পারবে না।

আপনার শাইন অ্যান্ড গ্লো ছাড়া আর কোনও কসমেটিকস ব্র্যান্ড আমার বাড়ির চৌকাঠ পেরোয় না দিদি। রোজ আমি শাইন অ্যান্ড গ্লো ফেস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে, শাইন অ্যান্ড গ্লো ময়েশ্চারাইজার সারা মুখে  থুপে থুপে লাগিয়ে...

হোয়াট!

সঞ্চালিকাঃ কী হল ম্যাম?

থুপে থুপে লাগাচ্ছে! আমাদের ব্যাক ব্রেক করা করে টেস্ট টিউব আর গ্লাভস পরে বানানো সিক্রেট ফর্মুলায় বানানো প্রোডাক্ট তুমি থুপে থুপে লাগাচ্ছ কী রকম? আমি তো পইপই করে বলে দিয়েছি, কী ভাবে কী করতে হবে।

সাজাব যতনে-তে তো ডেমোও দিয়েছেন ম্যাম, দেখোনি?

তাছাড়া প্যাকেটের গায়েও তো লেখা আছে। ওয়েট ওয়েট, তুমি ঠিক কী লাগাচ্ছ বল তো? গ্লো-ই লাগাচ্ছ তো?

হ্যাঁ দিদি, ওই যে আপনাদের সামনে রাখা আছে অবিকল ওই বেগুনি বাক্স।

বাক্সের গায়ে আমার হাসি হাসি হলোগ্রাম ফেস ছিল?

সেটা তো ঠিক খেয়াল করিনি দিদি।

সঞ্চালিকাঃ কী সর্বনাশ, জাল শাইন অ্যান্ড গ্লো?

কিছুই বলা যায় না। কালচারটাই তো ঝাড়ার। সাড়ে সাত হাজার বছর ধরে একে অন্যের আইডিয়া ঝেড়ে যাচ্ছে। শোনো আমি আবার বলে দিচ্ছি। এক নম্বর, তুমি ইমিডিয়েটলি শাইন অ্যান্ড গ্লো-র জায়গায় সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো-তে আপগ্রেড কর। ফেস ওয়াশ থেকে ফিনিশিং টাচ পাউডার পর্যন্ত, এভরিথিং। ওই সব থোপাথুপি অ্যাবসলিউটলি বন্ধ কর। উল্টো এফেক্ট হবে। ভালো করে শুনে নাও কী করতে হবে।

ঘুম থেকে উঠে ফেসটা সনাতনী অ্যালোভেরা গ্লো ফেস ওয়াশ দিয়ে ওয়াশ করে, হ্যাঁ ওয়াশ করবে। ধোবে না। স্যাঁতসেঁতে ছ্যাতলা পড়া বাথরুমে প্লাস্টিকের বালতি থেকে প্লাস্টিকের মগ দিয়ে জল তুলেও লোকে মুখ ধোয়। আর ওয়াশ হচ্ছে টিভিতে যেমন দেখায়, দুই হাতে জল তুলে মুখে ছেটাবে। জলের ফোঁটা ইউনিফর্মলি মুখের চারপাশে ঝর্নার মতো ঝরবে। বুঝেছ? তারপর খবরদার গামছা দিয়ে ফেস ঘষবে না, ফেসে কত সূক্ষ্ম কার্টিলেজ থাকে জান? একবার ড্যামেজ হলেই হয়েছে। না না বেহালার সের দরের তোয়ালের সঙ্গে গামছার এসেনশিয়ালি কোনও ফারাক নেই। টার্কিশ টাওয়েল তো অ্যাফর্ড করতে পারবে না, এয়ার ড্রাই করে নিয়ো বরং। ফ্যান পাঁচে চালিয়ে ঠিক নিচে মুখ ফ্যানের দিকে তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে, যতক্ষণ না শুকোয়। তারপর সনাতনী গ্লো ময়েশ্চারাইজার রিং ফিংগারের টিপে অল্প একটু নিয়ে সারা মুখে প্যাট করে করে... কী করে?

সঞ্চালিকাঃ প্যাট করে করে...

ম্যামঃ ওকে বলতে দাও…

কলারঃ প্যাট করে করে...

সঞ্চালিকাঃ ম্যাম- আপনি কী ভালো টিচার...

ম্যামঃ ইয়েস, প্যাট করে করে লাগিয়ে নেবে। তারপর আমাদের সনাতনী গ্লো আই রি-কনস্ট্রাক্টিং ক্রিম, রিং ফিংগারের টিপে নিয়ে…

সঞ্চালিকাঃ প্যাট করে করে, বলুন বলুন, আমার সঙ্গে রিপিট করুন।

কলারঃ প্যাট করে করে..

ম্যামঃ লাগিয়ে নেবে। এর পর সনাতনী সেরাম, বাম আরও যা যা আছে, সব সিকোয়েন্স ফলো করে মাখবে। মনে না রাখতে পারলে আমাদের প্যাকেটের ভেতর প্রোভাইড করা লিফলেট দেখে দেখে করবে। আধখানা স্টেপও বাদ দেবে না। আমার হলোগ্রাম ফেস সাঁটা প্যাকেজ ছাড়া কিনবে না। অ্যান্ড অফ কোর্স, রোদে বেরোবে না, অটো চড়বে না, এসি ছাড়া দশ মিনিটের বেশি কোথাও বসবে না।

সঞ্চালিকাঃ এগুলো তো ম্যাম কমনসেন্স।

কমনসেন্সই সবথেকে আনকমন তো। এগুলো যে বলে দিতে হয় আগে জানতাম না, যত দিন যাচ্ছে শিখছি। বেসিক ব্যাপারগুলোই আমাদের দেশের মেয়েরা জানে না। হার্টব্রেকিং।

সঞ্চালিকাঃ আমরা এবার পরের ফোনে যাব, কিন্তু তার আগে একটা জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে, ওই আই-রিকনস্ট্রাক্টিং ক্রিমটা কী ম্যাম? পুরোনো চোখ ভেঙেচুরে নতুন করে চোখ বানাবেন ম্যাম? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

পুরোনো চোখ তো নতুন হবেই, দৃষ্টি পর্যন্ত বদলে ফেলবে। বিউটিফুল ফ্রম উইদিন। না হলে শুধু বাইরে থেকে লোশন লাগিয়ে কী হবে? সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো একেবারে ভেতর থেকে বদলে দেবে। দৃষ্টি এমন বদলে যাবে যে পিতৃমাতৃদত্ত চেহারা আর সহ্য হবে না। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মনে হবে, মাগো আমি কী কুচ্ছিত, মাগো আমার চোখটা কেন কুতকুতে, মাগো, ভুরুটা এ রকম শেপলেস কেন, মাগো এই থোবড়া নিয়ে রাস্তায় বেরোব কী করে।

সে তো ভয়ানক প্যাথেটিক হবে ম্যাম।

প্যাথেটিক হওয়ানোই তো আমাদের উদ্দেশ্য। হোমিওপ্যাথিতে শোনোনি, বাড়িয়ে তারপর কমায়? আমাদের সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লোয়ের অ্যাপ্রোচও এক্স্যাক্টলি ওটাই। আত্মবিশ্বাস যত তলানিতে ঠেকবে, তত মোটিভেশন বাড়বে। সনাতনী গ্লো কেনার, তিনবেলা রিলিজিয়াসলি মাখার। এমন কী শুরুতে অনেকসময় এও হতে পারে যে সনাতনী গ্লো-তেও কাজ দিল না...

সেটাও বুঝি ইচ্ছে করে করা ম্যাম? যাতে আত্মবিশ্বাস আরও চুরমার হয়…

আর মোটিভেশন আরও কিক ইন করে...আরও কেনার, আরও মাখার...অ্যান্ড দেন, মে বি, কে বলতে পারে, অবশেষে শাইন এল। গ্লো এল। আপনি ফাইন্যালি শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে গেলেন।  

উঃ, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ম্যাম। ঠিক যেন জেমস বন্ডের সিনেমা।

কিন্তু প্যাকেটে যা যা যেমন করে লেখা আছে, সব ইন্সট্রাকশন মেনে ইউজ করতে হবে।

সে তো বটেই, প্যাটের বদলে থুপবেন তারপর ম্যামের, ইয়ে, শাইন অ্যান্ড গ্লো-র পিণ্ডি চটকাবেন, সে কী করে হবে।

এক্স্যাক্টলি। ব্র্যান্ড রি-লঞ্চ করার পর, প্যাকেজিং-এর ডিজাইন বদলে আমরা আরও কিছু ইম্পরট্যান্ট ইন্সট্রাকশন অ্যাড করেছি। কিছু অফারটফারও চালু হল বলে। আমাদের ওয়েবসাইট থেকে মিনিমাম দেড় হাজার টাকার প্রোডাক্ট অর্ডার করলে পাঁচটাকা মূল্যের প্লাস্টিক রুদ্রাক্ষ ফ্রি দেওয়া হবে। রোজ সকালে প্রোডাক্ট ফেসে বা হেয়ারে যেখানে দরকার মেখে যতক্ষণ না শুকোয় জপতে হবে। বিশুদ্ধ বৈদিকমতে জপতে পারলে ডবল গ্লো।

চমৎকার। কিন্তু দিদি এবার আমরা আরেকটা কলে যাব। হ্যালো কে আছেন?

হ্যালো হ্যালো?

হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি, বলুন, আপনার নাম, বয়স আর লোকেশন?

হ্যালো হ্যালো?

হ্যাঁ বলুন। নাম বয়স লোকেশন।

এটা কি মোদের গরব মোদের আশা চ্যানেলের সাজাব যতনে স্টুডিও?

ঠিক ধরেছেন।

একটু রূপসী ম্যামকে দিন না।

হ্যাঁ আমি শুনতে পাচ্ছি আপনি বলুন।

ম্যাম? ইইইইইই, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি লাইন পেয়েছি, ম্যাম, ইইইইইইইই আমার কতদিনের ড্রিম...কান্ট বিলিভ ইট।

আমাদের চ্যানেলের পলিসি হচ্ছে পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে কাজের কথা শুরু না হলে কেটে নেক্সট ফোনে চলে যাওয়া। আপনার কাউন্টডাউন এখন তেরো সেকেন্ড, চোদ্দ সেকেন্ড…

পিম্পল, পিম্পল...কাটবেন না প্লিজ, ওহ মাই গড…আমার লাইফের ফার্স্ট পিম্পল উঠেছে ম্যাম, চিবুকের বাঁদিকে, লাইফের ফার্স্ট পিম্পল...

ম্যামঃ লাইফের ফার্স্ট? ওয়াও।

সঞ্চালিকাঃ জীবনের প্রথম ব্রণ? গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, উঃ। প্রথম প্রেমের মতোই প্রথম ব্রণর একটা রোমাঞ্চ আছে কিন্তু, না ম্যাম? সেই থরথর ভাব, সেই টনটন ব্যথা...

আর কত মেমোরিজ, পহলা পিম্পল, পহলা নশা, পহলা খুমার।

ম্যাম সুর ধরলেন, সঞ্চালিকা গলা মেলালেন। ক্যামেরা দুজনের চোখ বন্ধ, সামান্য উত্তোলিত মুখের ওপর প্যান করে গেল।

(গান থামিয়ে) ম্যামঃ শুনেছ গানটা?

কলারঃ আমি তো তখন জন্মাইনি ম্যাম, আমার মা নাইনটিস ওল্ডিস বলে একটা অ্যালবাম চালায় মাঝে মাঝে, সেটাতে শুনেছি। একটু স্লো, তার ওপর  লিরিক্সে  তেনু, সাড্ডি, চঙ্গা এইসব ওয়ার্ডস নেই তো, মিনিং-ও ভালো বুঝতে পারি না।

অ। যাই হোক, এবার পিম্পলের ব্যাপারে বল। কবে হল, কী হল, কী বৃত্তান্ত একেবারে গোড়া থেকে গুছিয়ে বল।

এই তো পরশু, ম্যাম। আর্লি মর্নিং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি চিবুকের বাঁ দিকে একটা... আমি তো ডেভাস্টেটেড।  অ্যাডের অ্যাডোলেসেন্টদের কী সুন্দর সাপোর্ট সিস্টেম থাকে, বন্ধুটন্ধু, দিদিটিদি, বলেটলে দেয়। আমি তো সিংগল চাইল্ড।  মাকেই জিজ্ঞাসা করলামতোমার যখন প্রথম ব্রণ হয়েছিল কী করেছিলে মা’, মা বলল...

ম্যাম + সঞ্চালিকাঃ কী বলল? কী বলল?

বলল, মা নাকি প্যাট করে গেলে দিয়েছিল।

ম্যামঃ ওহ মাই গড...

সঞ্চালিকাঃ মাগো…

ম্যামঃ শোনো...তোমার নামটা কী  যেন?

সঞ্চালিকাঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, তালেগোলে নামটাই জানা হয়নি।

দিপান্‌ভিতা, ম্যাম।

কী?

দিপান...ভিতা।

সঞ্চালিকাঃ নামটা চেনা চেনা লাগছে না ম্যাম? কোথায় যেন শুনেছি?

ম্যামঃ হ্যাঁ, দিপানভিতা, শোনো তুমি একেবারে ঠিক জায়গায় এসেছ, তোমার দিদি নেই তো কী হয়েছে, শাইন অ্যান্ড গ্লো, আমি, আমার পুরো টিম…

সঞ্চালিকাঃ আমিও আমিও...

ম্যামঃ আমরা সবাই তোমার সাপোর্ট সিস্টেম হব। তোমার ফার্স্ট পিম্পলকে সেলিব্রেট করব, প্রফেশনাল কেয়ার প্রোভাইড করব। কত বয়স তোমার?

এই তো পনেরোতে পড়ব ম্যাম।

থ্যাংক গড। তুমি ঠিক সময়ে এসেছ। অ্যাকচুয়ালি বারোতে এলে ঠিক হত, কিন্তু তিন বছর লেট ইজ স্টিল ম্যানেজেবল। এখন থেকেই যদি রেজিমেন্টেড ওয়েতে স্কিনের টেক কেয়ার করা শুরু কর, লং রানে মারাত্মক ফল পাবে। গত বছর থেকে আমরা সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো-র একটাক্যাচ দেম ইয়ংলাইন শুরু করেছি...

সঞ্চালিকাঃ ওটা এর জন্য বেশ মানানসই হবে না ম্যাম? ইয়ংও আবার ক্যাচ কট কট হওয়ার জন্য বেশ উদগ্রীবও।

ওটা বারো থেকে পনেরোর এজ গ্রুপকে টার্গেট করে বানানো হয়েছে। ওখানে সনাতনী পিম্পল প্যাকেজ পেয়ে যাবে। প্যাকেটের ভেতরে সব লেখা আছে দেখে দেখ ইউজ করবে। তাছাড়াও তোমাকে আমার ভারি ভালো লেগেছে কি না, তাই আমি ফ্রিতে কিছু স্কিন ভালো রাখার টিপস দিয়ে দিচ্ছি, মন দিয়ে শোনো।  ফুচকা রোল আলুকাবলি আরও যা যা সব তোমার বয়সী মেয়েরা খায়, অ্যাট এনি কস্ট অ্যাভয়েড করবে কারণ এক, তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও, দুই, গ্লোয়িং স্কিন নিডস গ্রেট স্যাক্রিফাইসেস। খালি জল আর ফলের ওপর থাকতে পারলেই ভালো। অন্য  মেয়েদের মতো মুটোবে না, দারুণ কনফিডেন্স পাবে। আর যা-ই কর না কেন, রোদকে প্লেগের মতো পরিহার করবে। বাড়ি থেকে বেরোতে হলে গাড়ি ব্যবহার করবে, না পারলে সারা মুখ কাপড়ে বেঁধে বেরোবে। চোখ দুটো খোলা রাখলেও রাখতে পারো, তবে আমি বলব গগলস পরে নিতে। সান থেকে প্রোটেকশন তো আছেই, তাছাড়া এই রকম আনপ্রিপেয়ারড  ফেস নিয়ে পৃথিবীকে ফেস করার জন্য এখনই তুমি রেডি নও।

ওকে ম্যাম। ইইইইই, আই অ্যাম সো এক্সাইটেড।

সঞ্চালিকাঃ আমরাও দিপানভিতা-......দিপান... ভিতা... দিপান.....এই তোমার নাম দীপান্বিতা নাকি? হ্যালো হ্যালো, কেটে গেছে। ওহ, আরেকটা কল এসেও গেছে। হ্যালো কে আছেন লাইনে? সাজাব যতনে-তে আপনাকে স্বাগত জানাই।

হ্যালো, আমি শ্রীরামপুর থেকে মৌমিতা বলছি।

হ্যাঁ মৌমিতা বলুন।

আমার চুল পেকে যাচ্ছে।

সঞ্চালিকাঃ যাক, আমি ভাবছিলাম আজ খালি ফেস নিয়েই কথাবার্তা হবে। সাজাব যতনে-র আজকের এপিসোডের প্রথম হেয়ার কলার হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন মৌমিতা।

ম্যামঃ পেকে যাচ্ছে? হুম, আপনার হেয়ার সম্পর্কে আরেকটু ডিটেলস দিন।

কলারঃ এই তো পিঠের মাঝখান পর্যন্ত পৌঁছোয়, কালো রঙের...  

সঞ্চালিকাঃ যা কিনা দ্রুত সাদা হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।

ম্যামঃ আহা, টেক্সচার বলুন, খরখরে না ফিনফিনে, ভারি না হালকা, স্ট্রেট না ওয়েভি...এই রকম স্কেচি ডিটেলস ফোনে শুনে ডায়াগনসিস এত ডিফিকাল্ট হয়ে যায়। শুনুন আপনাকে ক্লিনিকে আসতে হবে। আমরা চুলের এক্সরে, এম আর আই করাব, লেজার গান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুলের জাত গোত্র ধর্ম সব বার করে ফেলব। তারপর ট্রিটমেন্ট শুরু হবে। যতদিন সেটা না হচ্ছে আপনি নিউ অ্যান্ড ইমপ্রুভড শাইন অ্যান্ড গ্লো হেয়ার সেরামটা রেগুলারলি ব্যবহার করুন। ওটায় অ্যালোভেরা অ্যান্ড অ্যাকটিভেটেড চারকোল ঠেসে দিয়েছি। আর আমার ক্লিনিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন। অ্যাসাপ।

সঞ্চালিকাঃ ফোন নম্বর দেখুন স্ক্রিনের নিচে ভেসে ভেসে যাচ্ছে।

কলারঃ ওককে ম্যাম, থ্যাংক ইউ ম্যাম।

ম্যামঃ ব্যস শুধু হেয়ার? আর কিছু সমস্যা নেই? স্কিন, পিম্পল...  

সঞ্চালিকাঃ সেও কি সম্ভব?

ম্যামঃ রেগুলারলি ট্রিটমেন্ট করান? ফেশিয়াল? ব্লিচিং? এনি কাইন্ড অফ প্যাম্পারিং?

কলারঃ না, মানে ও সব তো...

বয়স কত?

এই অক্টোবরে সাতাশ পূর্ণ করে আঠাশে পড়ব।

আঠাশ! কী সাংঘাতিক! তুমি আঠাশেও বসে বসে ঘুমোচ্ছ? মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি শোননি?

সঞ্চালিকাঃ এইটা ঠাকুমাও বলত।

ম্যামঃ মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয়, পঁচিশ থেকে মেয়েদের মুখের চামড়া ঢিলে হতে শুরু করে, মুখে বিশ্রী দাগ বেরোয়, ঠোঁট ঝুলতে শুরু করে, হাতপায়ের চামড়া কোঁচকায়। আর তুমি আঠাশ বছর বয়সে নিজের আঢাকা আকাচা মুখ, পাকা চুল নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছ? দেশে আইনআদালত নেই নাকি?

সঞ্চালিকা শিউরে ওঠার ভঙ্গি করলেন।

সনাতনী গ্লো ফ্লো ছাড়ো, এই স্টেজে এক্সটারনাল অ্যাপ্লিকেশন আর কাজ দেবে না, তোমার এখন সনাতনী বোটক্স দরকার। আমাদের সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো রিপেয়ারিং প্যাকেজ আছে, ইঞ্জেকশন দিয়ে ঠোঁটে গাঁদাল পাতার রস ঢুকিয়ে দেব, ভৃঙ্গরাজের সঙ্গে ভিটামিন সি পাঞ্চ করে মাথায় মাখিয়ে দেব, গন্ধে আশেপাশে লোক ঘেঁষতে পাবে না, প্রাইভেসির হদ্দমুদ্দ। কিন্তু তোমাকে ইমিডিয়েটলি শাইন অ্যান্ড গ্লো আই সি ইউ তে আসতে হবে। দয়া করে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এসো না। ওই লেভেলের স্ট্রেস ফেসের ডেলিকেট স্কিন হ্যান্ডল করতে পারে না। ওলা উবার নেবে। নিতান্ত দৈন্যদশা হলে পুল বা শেয়ার নিতে পার।

সঞ্চালিকাঃ হ্যালো মৌমিতা, হ্যালো? লাইনে আছেন? আহা রে, ভয়ে গলা একেবারে বসে গেছে, শুনুন আপনি ঘাবড়াবেন না, আমাদের ম্যাম টাফ লাভে বিশ্বাস করেন। আপনি সময় করে একদিন ম্যামের ক্লিনিকে চলে আসুন। না না, শ্রীরামপুর থেকে ওলা নেওয়ার দরকার নেই, আসলে ম্যামের ভূগোলটা একটু… এদিকে হেদো ওদিকে পাটুলি পেরোলে শ্রীরামপুরও যা সাসকাচুয়ানও তাই। শুনুন, টা নাগাদ একটা শ্রীরামপুর লোকাল আছে না? সেটায় আসবেন, আগেভাগে উঠলে জানালার ধারের সিট পেয়ে যাবেন, স্ট্রেস হবে না বেশি। ওকে? ভয় পাবেন না। টাটা, বাই বাই আবার যেন দেখা পাই।

দিদি, পরের কলে যাওয়ার আগে ওই যে সনাতনী রিপেয়ারিং প্যাকেজ না কী বললেন, সেটা সম্পর্কে আরেকটু খোলসা করুন না প্লিজ-

হ্যাঁ, সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো রিপেয়ারিং প্যাকেজ। গত বছর থেকেই আছে। না রেখে আর থাকতে পারলাম না। আমাদের এডুকেশন সিস্টেমটা এত ফ্লড। চালকলা বাঁধা শিক্ষাই শুধু হয়েছে, কোনও কাজের কাজ হয়নি। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক জয়েন্ট স্পোকেন ইংলিশ নিয়ে পাগলা হয়ে যাচ্ছে সব। আরে বাবা খানাখন্দ ছোপছাপওয়ালা মুখ নিয়ে বাংলায় লেটার তো ভুলেই যাও, হড়হড় করে ইংরিজি বললেও চিঁড়ে ভিজবে না। সালোকসংশ্লেষ গিলিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর অথচ আমাদের বডির বৃহত্তম অর্গ্যান যে স্কিন সেটার টেক কেয়ার কী করে করতে হবে সে ব্যাপারে স্পিকটি নট। থিওরির তো এই অবস্থা, প্র্যাকটিক্যালও তথৈবচ। শহরের বাইরে গেলে সমস্যাটা ভয়াবহ ম্যাগনিচিউডে। বিঘে বিঘে জমির ওপর স্কুল বানিয়েছে, খাঁ খাঁ মাঠ, ঝাঁ ঝাঁ রোদ, সেই মাঠে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা দৌড়চ্ছে। হা হা করে হাসছে। কেউ কিছু বলার নেই। অত ভায়োলেন্টলি হাসাহাসির ফলে চোখের নিচের স্কিনে টান পড়ছে, কুঁচকে যাচ্ছে। ওই জায়গার স্কিন কী ডেলিকেট তোমাকে কী বলব, ও জিনিস আর সারবে? আমি অনেস্ট তাই বলছি, সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো-ও সারাতে পারবে না। সাম ড্যামেজেস আর পার্মানেন্ট।

ইস, জোরে হাসতে কত করে মানা করেছিল ঠাকুমা । তখন এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বার করেছি।

ঠাকুমাদিদিমার কথা না শুনে শুনেই তো পরিস্থিতি এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাড়ে সাত হাজার বছরের ঐতিহ্য, তার একটা মুল্য নেই? এই যে এত হেয়ারের প্রবলেম মেয়েদের আজকাল, এও তো ট্র্যাডিশন ভাঙার শাস্তি।

কী বলছেন ম্যাম?

আচ্ছা তোমার ঠাকুমার ছবি আছে বাড়িতে?

হ্যাঁ ম্যাম, সাদা চুল,ফোকলা দাঁত, আমার দিদির মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে হাসছে।

আহা যৌবন বয়সের।

একটা ছিল বোধহয় বাবার কাছে, ভীষণ খারাপ কোয়ালিটি। হলদে মার্কা, ঠাকুমা উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মাথায় ঘোমটা।

অ্যায়, অ্যায়। তোমার ঠাকুমার চুল কবে পেকেছে?

তা তো মনে নেই ম্যাম, আমি তো অনেকদিনই দেখছি।

আঠাশ বছরে পেকেছিল কি?

মনে হয় না।

আলবাৎ পাকেনি। কোনও ঠাকুমাদিদিমার চুল আঠাশ বছরে পাকেনি। ভূভারতে কেউ দেখাতে পারবে না। কেন বল তো?

খাবারে ভেজাল ছিল না বলে নাকি ম্যাম? আমি ক্লাস ফাইভে অংকে ফেল করেছিলাম সবাই মারতে এসেছিল। একা ঠাকুমা বলেছিল আমার কোনও দোষ নেই, এত ভেজাল দেওয়া খাবার খেয়ে পাশ করলেই আশ্চর্য হত।

উফ্‌, সেটা কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট ইস্যু। মেয়েদের চুল পাকার এপিডেমিকের পার্শিয়াল এক্সপ্ল্যানেশন খাবারে ভেজাল হতে পারে, পুরোটা কী করে হবে।

তাহলে কী ম্যাম?

ভাবো ভাবো, তোমার ঠাকুমার ছবিতেই ক্লু আছে, এটাও বলে দিচ্ছি।

উঃ, ক্লু, ডিটেকটিভ গল্প আমার ফেভারিট ম্যাম। ঠাকুমার ছবি, ঠাকুমার ছবি… সাদাকালো...আয়তাকার…

ওরে বাবা, ছবিটা না ছবিটাতে ঠাকুমার কথা ভাবো।

ঠাকুমা... ঠাকুমা... উঁচু কপাল, খাড়া নাক, উদাস চোখ, তবে ওটা বোধহয় ফটোগ্রাফারের ইন্সট্রাকশন...আচ্ছা আচ্ছা ভাবছি... গলায় চেন, মাথায় ঘোমটা...

স্টপ!

গলার চেন?

উঁহু।

মাথায় ঘোমটা?

হেয়ারের সব থেকে বড় এনিমি কী জানো? থাক আমিই বলছি, সান। আর সেই সান থেকে ঘোমটা সাড়ে সাত হাজার বছর ধরে মেয়েদের কী লেভেলে প্রোটেকশন দিয়েছে জানো?

তার মানে ম্যাম, বলছেন সনাতনী ঘোমটায় ফেরত গেলেই...

আমি কিছুই বলছি না ভাই, হার্ড এভিডেন্স যা বলার বলছে।

ম্যাম, প্রোডিউসার হাত নাড়ছেন, এই লাইনে আর এগোতে বারণ করছেন বোধহয়। আবার কখন তেনারা বল্লম নিয়ে এসে পড়বেন...

কেনারা?

ভরদুপুরে তেনাদের নাম নিতে নেই, ম্যাম। ডেঞ্জারাস ব্যাপার।

কী বলছ কী? কারা?

জানেন না? ফ-এ এ-কার, ম-এ হস্‌সি, ন-এ হসসি…

ও মাই গড, দ্যাট এফ ওয়ার্ড। আরে ছাড়ো তো, ওদের আবার ভয় পাওয়ার কী আছে? সমান হতে চাস তো ক্যান্সারের ওষুধ বার করে দেখা, তা না যত কোপ ঘোমটা আর বাপভাইয়ের সম্পত্তির ওপর। শেমফুল। আসুক না কার আসার, দেখিয়ে দেব। সাজাব যতনের দর্শকদের বলছি, প্লিজ, প্লিইইজ অত জোরে হাসবেন না। অল্প করে ঠোঁট ছেতরান। পার্সোন্যালিটিও মেন্টেন হবে, চোখের ঠোঁটের চামড়াও কুঁচকোবে না।

আসলে ওটা না অনেকের হাতে থাকে না, ম্যাম।  অনেকে না হাসি পেলে চাপতে পারে না। আমারও ওই রোগটা আছে। হাসি পেলে একেবারে বত্রিশ পাটি বার করে পেট চেপে গড়াগড়ি হাসি। মুচকি হাসিতে সারব যে তা হবে না।

চেষ্টা করবে। সনাতনী একটা টোটকা আছে হাসি কন্ট্রোল করার। ডান নাক চেপে বাঁ নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়বে, আবার বাঁ নাক চেপে ডান নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়বে। ওটা পাঁচবার করতে না করতেই হাসির ঠাকুরদা বাপ বাপ বলে পালাবে। অন্যের তোমাকে দেখে হাসি পেতে পারে, তোমার পাবে না। গ্যারান্টি। তাছাড়া দাঁতেরও যা ছিরি। প্লিজ নন-হোয়াইটেনড দাঁত দেখিয়ে হাসবেন না। ডাক্তারদের কাছে নিয়মিত গিয়ে দাঁত সাদা করে আসুন। তবে দাঁতের ডাক্তাররা আজকাল ভিজিট বাড়িয়েছেন...

ওরে বাবা ম্যাম, গত বছর আমার রুট ক্যানাল হয়েছিল, দাঁতের ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছিল পকেটের ব্যথা। পুজোয় একটা শাড়ি কম কিনতে হল। এবার বাইরে কম খেয়েছি, একটা বেশি কিনে মেক আপ করে নেব।

এত কৃচ্ছ্রসাধনের আর দরকার নেই। পকেটকে কষ্ট না দিয়ে দাঁত ঝকঝকে করার উপায় আমরা আমাদের ল্যাবে রিসার্চ করে বার করেছি। (ম্যাম হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে বেগুনী টিউব তুলে নিলেন) এই যে আছে, সনাতনী দন্তরুচি শাইন অ্যান্ড গ্লো টুথপেস্ট। নুন আছে, কয়লা আছে, আরও যা যা উপকরণ বেদে লেখা ছিল সব ঠেসে দিয়েছি। সাতদিন মাজুন, দাঁত একেবারে ঝকঝক করবে।

ঠাকুমা বলতেন আমলকি নাকি দাঁতের পক্ষে ভালো, সনাতনী পেস্টে আমলকি রেখেছেন ম্যাম?

অফ কোর্স, রেখেছি। তবে আমলকি নয়, আমলা। প্যাকেজিং-এর রিয়েল এস্টেট আজকাল হেবি চড়া। যেখানে তিন অক্ষরেই সারা যায়, চার অক্ষর কেন ভাই? কম কথায় সারা বাঙালির ধাতে নেই। বাংলা ইজ দ্য মোস্ট ইনএফিশিয়েন্ট ল্যাংগোয়েজ। ইনএফিশিয়েন্ট অ্যান্ড ইউজলেস।

এইটা একদম ঠিক বলেছেন ম্যাম। আমারও কোনও ইউজে লাগেনি। উল্টে বাঁশ। আমি দাঁতনমাজি বালিকা বিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট বলে আমাকে সামনে ল্যাপটপ নিয়ে বসতে দেয়নি, জানেন? সেই কবে থেকে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে রেখেছি। এদিকে যারা সেন্ট আর মেরি থেকে বেরিয়েছে, সবার সামনে ল্যাপটপ, গায়ে জ্বলজ্বলে লালসাদা  টুথপেস্টের অ্যাড সাঁটা। আমাকে ল্যাপটপ দিলে আমি আমারটায় সনাতনী মাজনের বেগুনি অ্যাড সাঁটার অ্যাপ্লাই করব, ম্যাম। প্রমিস।

থ্যাংক ইউ সো মাচ।

আচ্ছা ম্যাম, এই রিপেয়ারিং প্যাকেজে আপনারা লোমটোম তোলেন? গোঁফ চাঁছেন? নারীকে নির্লোম করে দেন?

অফ কোর্স। লোম থাকলে অর্ধেক নারীত্ব মাটি।

তাছাড়া হাতে লোম না থাকলে শুনেছি ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেটের গ্রিপও ভালো হয়। একটা হেয়ার রিমুভাল ক্রিমের অ্যাডে দেখলাম দীপিকা পাড়ুকোনকে, কী জোরে মারল, বাপস....

এই তো তোমরা অ্যাড দেখে বোকা বনে যাও। দীপিকা পাড়ুকোন ব্যাডমিন্টন ভালো খেলবে না তো কি তুমি খেলবে? ওদের দেখানো উচিত অর্ডিনারি নারীদের, এই ধরো তোমার মতো যারা, তাদের হাত স্মুদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রং হচ্ছে কি না।

হচ্ছে নাকি ম্যাম?

দেখো চামড়ার কোয়ালিটি আর বিয়ের বাজারে মেয়ের দামের কোরিলেশন তো অলরেডি এস্ট্যাবলিশড। বাকি বিষয়গুলোতে এখনও সে রকম নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না তবে রিসার্চ চলছে। বিউটি অ্যান্ড কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রির জায়েন্ট প্লেয়ারদের আর এন ডি ডিপার্টমেন্টরা কোমর বেঁধে নেমেছে। ডেটা কালেকশন হচ্ছে, গ্লোবাল ডেটা, বিগ ডেটা

গায়ে কাঁটা দিচ্ছে...

সেই ডেটা নিয়ে কোটি কোটি ইকনমিস্ট, স্ট্যাটিসটিশিয়ান দিবারাত্র অংক কষছে, ভেরিয়াস টপিকসে, মেয়েদের হাতের লোমের সঙ্গে র‍্যাকেটের গ্রিপের, মেয়েদের চুলের ঘনত্বের সঙ্গে ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ দেখানোর সাহসের এটসেটরা এটসেটরা। আমরা তো ছোট আউটফিট, আমরাও আমাদের মতো করে চেষ্টা করছি। স্মল স্কেলে ডেটা কালেকশন চলছে। আমার বোনপো মাস্টার্স করছে ইকনমিক্সে, ওর সামার ভেকেশন চলছে, এখন ও বসে বসে ল্যাপটপে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছে, বলেছে ডেটা এসে গেলেই রিগ্রেশান রান করে রেজাল্ট বার করে দেবে। মেনলি দুটো রিসার্চ কোশ্চেন রেখেছি। এক, চুলের শাইনের সঙ্গে অফিসকাছারিতে অপমানিত হওয়ার সম্পর্ক; দুই, ফেসের গ্লোর সঙ্গে জয়েন্ট ক্র্যাক করার কোরিলেশন। আমার গাট ফিলিং বলছে, ওই সেকেন্ড রেজাল্টটা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেক্যাচ দেম ইয়ং’-লাইনের সেলসের পালে হাওয়া লাগবে।

লাগবে কি ম্যাম, লেগে গেছে ধরে নিন।

বলছ? থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। রিপেয়ারিং প্যাকেজের তিনটে অপশন রয়েছে, ডিলাক্স, এক্সিকিউটিভ, প্রিমিয়াম প্যাকেজ।

তিনটের তফাৎ কী যদি বলে দেন।

দেখো ডিলাক্সটা আমি দেখি না। শাইন অ্যান্ড গ্লো অ্যাকাডেমির আনপেড ইন্টার্নরা দেখে। ডিলাক্স প্যাম্পারিং প্যাকেজ অপট্ করলে আমরা একটা মুচলেকা সই করিয়ে নিই যে পরিণামের দায়িত্ব শাইন অ্যান্ড গ্লো কর্তৃপক্ষের নহে। ইনটার্নরা ফেশিয়াল করতে গিয়ে চোখের মণি ম্যাসাজ করে দিল নাকি গরম ওয়্যাক্স ফেলে অর্ধেক ভুরু উড়িয়ে দিল, সে সব দায় আমরা নেব না। আপনি সজ্ঞানে সবথেকে চিপ অপশনটা বাছলে এ সব হতেই পারে। এক্সিকিউটিভটা শাইন অ্যান্ড গ্লো-র ছেলেমেয়েরাই দেখে। তবে ইয়াং ব্লাড তো, মজা করার লোভ সামলাতে পারে না। মাঝে মাঝেই হাসতে হাসতে এসে আমাকে বলে, দিয়েছি দুটো ভুরু দুরকম করে। প্রিমিয়ামের পয়সা না বার করার মজা বুঝুক এইবার।

আর প্রিমিয়ামটা ম্যাম?

সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো প্রিমিয়াম রিপেয়ারিং অ্যান্ড প্যাম্পারিং প্যাকেজ, ইটস দ্য স্টাফ ড্রিমস আর মেড অফ। এখানে শাইন অ্যান্ড গ্লো-র বাছাই করা শিল্পীরা আপনার মাথার চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বিউটিফাই করবে, প্যাম্পার করবে। আপনি সুন্দরী তো হয়ে উঠবেনই, আপনার স্ট্রেস গলে পড়বে, যতক্ষণ আপনি আমাদের স্টুডিওতে থাকবেন, বেশিক্ষণ না, পুরো প্রসিডিওরটায় ঘণ্টা বারো সময় লাগবে, ততক্ষণ জীবনের কোনও ক্লেদ আপনাকে ছুঁতে পারবে না, বসের মুখে মনে পড়বে না। চুল আপনি যেমন চান তার থেকেও ফুরফুরে হয়ে উঠবে, স্কিন যতটুকু চান তার থেকেও বেশি গ্লোয়িং। প্রতিবেশী, বস, বর, বয়ফ্রেন্ড যে দেখবে চমকে যাবে।

উঃ দারুণ হবে বলুন দিদি...আচ্ছা এই প্যাকেজগুলো করতে গেলে কত খসবে যদি...অ্যাঁ... আরেকটা ফোন এসে গেছে? নেওয়া যাক। হ্যালো?

কলারঃ শুনুন, আমি অনেকক্ষণ থেকে আপনাদের অনুষ্ঠান শুনছি, কিন্তু এক্ষুনি একটা কথা আপনারা বললেন যেটার প্রতিবাদ করতে আমাকে ফোন করতেই হল।

ওরে বাবা ম্যাম, দেখেছেন ফ-জুজু এসে গেছে। কেন ও সব ঘোমটার উপকারিতাটুপকারিতা বলতে গেলেন ম্যাম, প্রোডিউসার আবার আমার ল্যাপটপ ঝুলিয়ে দেবে। ধুস।

ম্যামঃ আহা শোনাই যাক না, কী বিষয়ে প্রতিবাদ। বলুন ভাই।

আপনি যে এই বললেন না যে আপনাদের প্রিমিয়াম প্যাকেজটা ইউজ করলে বর বয়ফ্রেন্ড অফিসের লোক পাড়ার লোক সব চমকে যাবে। আমি অ্যাকচুয়ালি ভাবছিলাম প্যাকেজটা নেব, কিন্তু আমি তো কাউকে চমকাতে চাই না।

সঞ্চালিকাঃ সেকি কাউকে চমকাতে চান না অথচ নিজের ত্বক চমকাতে চান?

মানে চমকালে চমকাতে পারে, কেউ যদি চমকাতেই চায় তাহলে আমি তো বাধা দিতে পারি না, আমি আবার ব্যক্তিস্বাধীনতার পূজারী।

আপনি খুবই অন্যরকম কিন্তু। এই রকম আমি আগে শুনিনি, আপনি শুনেছেন ম্যাম?

আমি এই করে চুল লাল বেগুনী নীল সবুজ করেছি হে, স-অ-অ-ব আমার দেখাশোনা আছে। দাঁড়ান আমি বলছি, আপনি আর্টিস্ট, মেক আপ আপনার ক্রেয়ন বাক্স, মেক আপ ব্রাশ আপনার তুলি, মুখ আপনার ক্যানভাস। রোজ সকালের সাজগোজ আপনার ক্রিয়েটিভ আউটলেট। তাই তো?

কলারঃ কী কাণ্ড, আপনি তো এ যুগের নস্ত্রাদামুস...

সঞ্চালিকাঃ খনাও হতে পারেন। আসলে কী বলুন তো, কবি তো বলেই গেছেন, মুখই মনের আয়না। আর আমাদের ম্যাম সারাদিন মুখ নিয়েই চর্চা করেন, শত  শত মুখ...
  
ম্যামঃ বিভিন্ন শেপের, শেডের...

হ্যাঁ শেপের শেডের মুখ, নাড়েন চাড়েন ঘাঁটেন। কাজেই কার মনে কী চলছে সেটা যে ম্যাম ধরে ফেলবেন তাতে অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই।

ম্যামঃ  যাই হোক আপনি আর্টিস্ট যখন জানেন নিশ্চয়, ছেঁড়া ফাটা ছোপ লাগা ক্যানভাসে ভালো আর্ট হয় না। কাজেই ক্যানভাসটাকে টানটান আর চকচকে রাখতে হবে। আমাদের সনাতনীর গ্লো ময়েশ্চারাইজার আর গ্লো সেরাম, গ্লো ফেস ওয়াশ আরও যা যা বলে মুখে রক্ত তুললাম এতক্ষণ সব নিয়মিত ইউজ করুন। আমাদের একটা সনাতনী প্যালেট বার করেছি, এক্সাইটিং সব কালারস, আর্টের বেগ আসলে সেগুলো যেখানে যা ইচ্ছে যেমন খুশি মিশিয়ে লাগিয়ে নিন। তবে আমার একটা পরামর্শ আছে, অ্যাপ্লিকেশনে খুব একটা অরিজিন্যালিটি দেখাতে যাবেন না। এ ক্যানভাসে সালভাদর দালি না হতে যাওয়াই বেস্ট। আর্টিস্টিক আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, চারপাশের ক্রিয়েটিভরা যা করছেন, চোখ বুজে তাই করে যান।

কলারঃ সে তো বটেই, আগে তো রুল শিখতে হবে, তবে তো ব্রেক।

সঞ্চালিকাঃ উঃ কী বললেন। আগে রুল শেখা, তারপর ব্রেক। ভালো বলেছে না ম্যাম?

শুধু বললেই তো হবে না, কাজে করতে হবে।

তা ঠিক। জ্ঞানপাপী থাকে অনেকে। ঠাকুমা বলত আমারও নাকি ওই টেন্ডেন্সি আছে। যাই হোক, এবার আমরা আমাদের প্রোগ্রামের শেষের দিকে চলে এসেছি, আর একটাই ফোন নেওয়া যাবে। ম্যামের কাছে আরও কোনও প্রশ্ন বাকি থাকলে স্ক্রিনের নিচে ভেসে ভেসে যাওয়া নম্বরে ফোন করুন, মেল করুন, প্যাকেজ কিনুন, সুন্দরী হোন কিংবা আর্ট প্র্যাক্টিস করুন, আপনার যেমন অভিরুচি।

হ্যালো হ্যালো, কে আছেন। সাজাব যতনে-র আজকের এপিসোডের শেষতম কলার হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। বলুন আপনার কী প্রবলেম হচ্ছে? স্কিন ম্যাড়ম্যাড়ে নাকি হেয়ার ফল?

কলারঃ প্রবলেম আমার হয়নি, তোর ম্যামের হবে এবার।

এ কী, আপনার গলায় কেমন বেসুর বাজছে… হে ভগবান আপনি ফ-জুজু নাকি? দেখুন ওই ঘোমটার ব্যাপারটা কিন্তু আমি বলিনি, হ্যাঁ হ্যাঁ প্রোডিউসার হাত নেড়ে বলতে বলছেন উনিও বলেননি, আমাদের প্রোগ্রামের গেস্টরা কে কী বলল সে রাগ আমাদের ওপর ঝাড়বেন না প্লিজ…

তোর ম্যামকে ফোনটা দে…

দিচ্ছি দিচ্ছি... তবে আপনার ভাষাটা যদি একটু পরিশীলিত করেন...এটা তো ব্রাভো টিভি নয় ভাই, আমাদের চ্যানেলের নামমোদের গরব মোদের আশা’...

ফোনটা দিবি নাকি…

দিচ্ছি দিচ্ছি, বাবাগো…

ম্যামঃ হ্যাঁ দাও তো, দেখি এত তড়পানি কীসের। হ্যালো বলুন ভাই আপনার কী কী গ্রিভ্যান্সেস।

গ্রিভ্যান্সেস মানে? এই সাজাব যতনে-তেই তিন মাস আগে এসে খুব জাঁক করে বলেছিলেন, সপ্তাহে তিনদিন মাখলে নাকি মুখ এমন চকচক করবে ফোন থেকে টর্চ অ্যাপ ডিলিট করে দিলেও চলবে?

দেয়নি বুঝি?

দেড়শো টাকায় দেড় চামচ পাউডার, তিন বাক্স কিনে ফুরিয়ে ফেললাম, তারপর মাসতুতো দিদির বিয়েতে গিয়ে সবাই মামাতো বোনের স্কিনের গ্লো নিয়েই সবাই উদবাহু। আমার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠছে, এ কী চেহারা, কিছু করাচ্ছিসটরাচ্ছিস না কেন? ওই চলল গোটা বিয়েবাড়ি।

ম্যামঃ ভুলভাল মেখেছিলেন নিশ্চয়

সঞ্চালিকাঃ প্যাট করে করে লাগিয়েছিলেন? না থুপেই দায় সেরেছিলেন?

আরে রাখুন আপনার প্যাট। আর কী যেন চুল গজানোর মলম? মাখতে গিয়ে আমার চার আঙুল কপাল পাঁচ আঙুল হয়ে গেছে, সারা মাথা গুঁড়ি গুঁড়ি, তিন দিন বাদে ফুলে উঠে ফেটে গিয়ে পুঁজ...শেষটা ডাক্তার ডেকে, গোটা মাথা কামিয়ে এখন ব্যান্ডেজ বেঁধে বসে আছি, চুল উঠবে কি না গ্যারান্টি দিচ্ছে না ডাক্তার। আমি উকিলের চিঠি পাঠাচ্ছি তৈরি থাকুন।

সঞ্চালিকাঃ সেকী কাকে চিঠি পাঠাচ্ছেন? আমাদের পাঠাবেন না দয়া করে, স্ক্রিনের  নিচে ম্যামের ঠিকানা ভেসে ভেসে যাচ্ছে সেখানেই বরং...

ম্যামঃ পাঠাতে বল উকিলের চিঠি, আমিও দেখে নেব। কী না কী মেখে শেষে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে...

কলারঃ আমি সব বোতল সব রসিদ রেখে দিয়েছি, আমি একা নই, আমাদের পাড়ায় আরও দুটো কেস আছে, একজনের শাইন অ্যান্ড গ্লো মেখে সারা মুখে পাঁচড়া উঠেছে, আরেকজনের এক্স্যাক্টলি আমার কেস, ন্যাড়া মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘুরছে। আমরা দুজনে গোটা মিউনিসিপ্যালিটি, মহকুমা, জেলা ঘুরে ঘুরে সই সংগ্রহ করছি, শাইন অ্যান্ড গ্লো মেখে খোসপাঁচড়ায় ছেয়ে যাওয়া, ভুরু  উঠে যাওয়া কেস হুড়হুড় করে বাড়ছে, দরকার হলে নিখিল বঙ্গ অ্যান্টি শাইন অ্যান্ড গ্লো সই সংগ্রহ ক্যাম্প খুলব, তবু ছাড়ব না। সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো-র সবাইকে আমি জেলের লপ্সি না খাইয়ে থামব না। আর এই যে আপনারা, যত সব ভুঁইফোঁড় চ্যানেল খুলে বসে চোরচোট্টা চিটিংবাজদের জায়গা দিচ্ছেন, তারাও বাদ পড়বেন না, তৈরি থাকুন, এই আমি বলে রাখলাম।

সঞ্চালিকাঃ মাগো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, বাপিদা কী করছ, লাইনটা কাটো শিগগিরি... উঃ, বুকটা কী জোরে ধড়ফড় করছে।

ম্যামঃ আরে যান যান বসান ক্যাম্প, করান সই, দেখব কার ঘাড়ে কটা মাথা। আমার জামাইবাবু হাই কোর্টে আছেন। দেখ গে, বংশের সবার টাক, সে এক্সপেক্ট করে কী করে যে একমাস শাইন অ্যান্ড গ্লো মেখে কেশবতী কুন্তলা হবে? এ কী ম্যাজিক নাকি? সাতদিনে আলকাতরা থেকে দুধে আলতা? আমারও কপাল যেমন। এই সব খেন্তিপেঁচিদের সুন্দরী করে তুলতে তুলতে লাইফ হেল হয়ে গেল, কেরিয়ারে একটা গায়ত্রী দেবী পেলাম না, না হলে দেখিয়ে দিতাম, সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লো কী খেল দেখাতে পারে...

শান্ত হন ম্যাম, এত রাগলে আমার ভয় লাগছে,  ও বাপিদা জল আনতে বল না... ঠাকুমা বলত জল খেলে রাগ কমে, খান ম্যাম এই জলটা আস্তে করে চুমুক দিয়ে দিয়ে খেয়ে নিন।

জানো এই সব নেমকহারামদের জন্য আমি দিনরাত এক করে খাটি, আমার ফেভারিট সিরিয়াল একেকদিন মিস হয়ে যায়, আর তার প্রতিদানে...

ম্যাম কাঁদবেন না প্লিজ  কে কোথাকার হেটার কী বলল তাতে কেউ এভাবে কাঁদে? এত কষ্ট পেলে চলে? আমি বলছি আপনাকে ম্যাম, এ বছর সনাতনী শাইন অ্যান্ড গ্লোয়ের যা বিক্রি হবে কসমেটিকসের ইতিহাসে কখনও কোনও ক্রিমের তত হয়নি। মিলিয়ে নেবেন, ম্যাম। ঠাকুমা বলতেন, ভালোর খারাপ হয় না, হতে পারে না। ষাট ষাট...ইস কেঁদে কেঁদে একেবারে হেঁচকি উঠে গেছে গো, ষাট ষাট...

আমাদের প্রোগ্রাম শেষ করার সময় এসে গেছে। দেখুন দেখি শেষে কেমন সব তিতকুটে হয়ে গেল। যাই হোক। ম্যামও কী রকম কেঁদেটেদে... ম্যামের মন ভালো করার জন্য আপনারা ম্যামের ক্রিম, লোশন, দাঁতের মাজন দলে দলে কিনুন, মাখুন। সুন্দরী হবেন কি না হবেন সে সব পরের ব্যাপার। চেষ্টা তো করতে হবে। আপনার হাতে শুধু চেষ্টা করাটাই আছে। করে যান। আমার ঠাকুমা বলতেন, মা ফলেষু কদাচন। গ্লোয়ের আশা না করে মেখে যান। গ্লো আসার হলে আসবে, না আসলে ধরে নেবেন কপালে ছিল না। আপনারা সবাই আমার আসন্ন উৎসবের প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা নেবেন। আজকের মতো আসি? টা টা।


Comments

  1. sharodiya uponyas ta ja dile.khanik ta porei pet betha korche.
    jomiye porbo pujo barshikir moto
    মাগো এই থোবড়া নিয়ে রাস্তায় বেরোব কী করে...
    jio boss jio..
    prosenjit

    ReplyDelete
  2. কখন যেন পড়েছিলাম যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় চাইছিলেন যে বিজ্ঞাপনের লেখায় যেন ত্বকের বদলে চামড়া কথাটা ব‍্যবহার করা হয়,কারণ এটাই বেশি অথেনটিক। লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল। সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, এই উক্তিটা জানা ছিল না তো, থ্যাংক ইউ, নালক।

      Delete
  3. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। ভালো লাগল জেনে।

      Delete
    2. ei sudur Chin desheo batase ekta pujo pujo chhuti-chhuti amej...shit-shit pore gechhe...nil akashe sada megh...kaaje mon bosano kothin hoye porechhe.

      Delete
    3. আপনার আমেজগুলোর সঙ্গে আমাদের অ্যাড হয়েছে পার্কে পার্কে প্যান্ডেলের বাঁশ, ওই পাঁচদিন অফিসফেরত সি আর পার্কে ঢোকার মুখে জ্যাম এবং সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত সংস্কৃতির ঠেলায় দুই ঘরের সব জানালার কাঁচ ঝনঝন কাঁপুনির প্রতিশ্রুতির আমেজ। কাজেই আপনাকে হিংসেই করলাম।

      Delete
    4. sanskritir thela ei dudiner Kolkatai jhotika safarei bujhte parlam...Bishwakarma r Ganesh pujoi jebhabe sangeetsadhona cholchhe Durgapujor kotha bhebe bhoi-i laglo...

      Delete
  4. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিলকমামা।

      Delete
  5. Porte porte amar omuk sheth tomuk broto der mukhgulo bhese uthchilo mathar modhye. hasir sathe besh dom atkano feeling akta.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, এই পোস্টের অনেক অনুপ্রেরণা আছেন, কুহেলি।

      Delete
  6. Darun hoeche. Haste haste pet bathay hoe gelo.

    ReplyDelete
  7. khub khub bhalo laglo ... onek diner onek research kore fact accumulate korano lekha eita, bujhte parchhi karon aemon ekta jinish er bishoye details shoho likhechhen jeta apnar chorchar bishoy na bodhoy ... aeto roshwala r aeto pranjol shaar shoyto bhora lekha onekdin pore porlam ... bhalo thakben

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, অনুরাধা। চর্চার বিষয় নয় বলছেন কী, আমরা তো মাঝে মাঝেই রুটি তরকারি খেতে খেতে হয় জ্যোতিষ নয় সৌন্দর্যসংক্রান্ত চ্যানেল দেখি। রোমহর্ষক ব্যাপারস্যাপার।

      Delete
  8. Darun pujor suru to...Puro pujo ta tumi erokom bhabe jomiye debe bhebei bhalo lagche Kuntala di..

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, পুরো পুজো কথা দিতে পারছি না, তবে তোর যে লেখাটা ভালো লেগেছে সে জেনে খুশি। থ্যাংক ইউ, ঊর্মি।

      Delete
  9. অনেক দিন আগের লেখা পোস্ট নিউ গোল্ডেন ওয়ার্ল্ড মনে পরে গেল| লেখাটা অসাধারণ হয়েছে যথারীতি|

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সৌগত। ওই লেখাটার কথা আমিই ভুলে গিয়েছিলাম।

      Delete
  10. amar lekhata porei mone holo school e jai aar sharodtosber prostuti shuru kori...ki asadharan script Kuntaladi, pujo special srutinatok ekkebare!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, পারমিতা।

      Delete
  11. apurbo! bechari sanchalika - shyam rakhi na kul rakhi obostha :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, তা ঠিক, কাকলি।

      Delete
  12. Haa haaa .. porte porte pete khil lege gelo ... "baidik mote" heshe cholechhi .. darun lekhata ....

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, বৈশালী।

      Delete
  13. Aha, onekdin pore eto boro ekta lekha pelam.
    Tukhor hoyechhe :D
    Prak-sharodiya'r shubheccha janalam. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, অরিজিত। শুভেচ্ছা আপনাকেও।

      Delete
  14. দুর্দান্ত হয়েছে কুন্তলা!

    ReplyDelete

Post a Comment