হরিয়ালি



আমাদের নতুন অফিসবাড়ি গ্রিন বিল্ডিং। বিল্ডিং কীসে গ্রিন হয়, তার ভাইট্যাল স্ট্যাটস, আকারপ্রকার, বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী, কার্বন ফুটপ্রিন্ট খুঁটিনাটি জানতে চাইবেন না, আমি জানি না। খালি জানি যা যা হলে গ্রিন বিল্ডিং হয়, এ বাড়ির তা তা আছে। আমাদের নতুন বাড়ি রীতিমত স্ট্যাম্প মারা গ্রিন বিল্ডিং।

আমার মতো মূর্খ মানুষের চোখ দিয়ে ওপর ওপর দেখলেও বোঝা যায় বাড়িটি গ্রিন। প্রচুর গাছ। প্রচুর ফুল। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে ছাদ। ব্যালকনি থেকে সিঁড়ি। প্রতি ফ্লোরের জানালায়। গ্রিন আর গ্রিন। এত গ্রিন যে পাখিরা ক্রমাগত পথ ভুলে ঘরে ঢুকে পড়ে। নতুন দরজার স্প্রিং এত টাইট যে কেউ ঠেলে ঢুকলে স্বস্থানে ফেরত যেতে অন্তত পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড সময় নেয়। সেই ফাঁকে একটা ছোট পাখি ঢুকে পড়েছিল। আমরা যতই তাকে দরজার দিকনির্দেশ করি, সে ততই এদিক থেকে ওদিক ফরফরায়। এক্সিট লেখা বোর্ডের ওপর গিয়ে বসছে, অথচ এক্সিট নিচ্ছে না। নিরক্ষরতার অভিশাপ। ঝাড়া দশ মিনিট হুস হুস করার পর সে অবশেষে বেরোল।

চারপাশে এত গাছ দেখেই বোধহয় সবার মনে একটা গাছ গাছ ভাব জন্মেছে। আমার টেবিলে গাছ আছে অনেক বছর ধরেই। তাদের দেখে আশেপাশের টেবিলের লোক খুব যে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বলতে পারি না। নতুন অফিসে পরিস্থিতি বদলেছে। আমার ফ্লোরে, ওপরনিচের ফ্লোরেও নিশ্চয়, সবার টেবিলে গাছ। কেভেন্টারস-এর মিল্কশেকের বোতলে, ডাবর হানি আর বারিসতার আইস টির শিশিতে পথোস আর সিংগোনিয়ামরা হইহই করে বাড়ছে।

আমার তো মনে হচ্ছে লোকে কথাও বলছে কম। অকারণ উশখুশ কমে গেছে আগের থেকে অনেক। সৎসঙ্গের ফল। টেবিলে পার্সেল দিতে এসেছিলেন একজন, দাঁড়িয়ে হাত বুলোলেন পাতায়। কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে 'ইয়ে সব ছোড়কে ইয়ে সব করো।’ বলে গাছেদের দিকে তাকালেন। বললাম, 'পয়সা নহি মিলেগা।' তিনি জবাব দিলেন, 'হরিয়ালি মে রহ পাওগে।' 

‘গান আইল্যান্ড’ লঞ্চ অনুষ্ঠানে অমিতাভ ঘোষ রিচার্ড পাওয়ার্সের ‘দ্য ওভারস্টোরি’ বইটির কথা বলছিলেন। এত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন যে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছনোর উবারে বসেই কিন্ডলে কিনে ফেলেছিলাম। সে বইয়ের সম্পর্কে বিস্তারিত বলব সময়সুযোগ হলে, কিন্তু বইটার সবথেকে ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে যে মানুষের থেকেও মেন রোল হচ্ছে গাছের। মানুষের মতো গাছেদেরও সমাজ আছে, সংসার আছে, ইন্টারনেট আছে, লং ডিস্ট্যান্স কল, প্রেম ভালোবাসা আছে। একটা গোটা সভ্যতা আছে। এবং সভ্যতায় যা থাকেই, সংগ্রাম, যুদ্ধ, হিংসাহিংসিও ভরপুর আছে। একটা কোন গল্পে পড়েছিলাম, নাম মনে নেই, ওভারস্টোরি নয় - জঙ্গল নিজেকে নিজে খেয়ে বেঁচে থাকে।

অফিসের প্রিভিলেজড গাছেদের জল মাটি আলোর জন্য একে অপরের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয় না বলেই বোধহয় এ যাবত ভ্রাতৃত্ববোধেরই নমুনা দেখেছি। একই টিমের দুজনের, দুই বন্ধুর, টেবিল পাশাপাশি। দুজনে দুটো কেভেন্টারসের বোতলে একই গাছ থেকে কাটিং নিয়ে রেখেছে। ডেস্কবিভাজিকার দুপাশে। প্রাকৃতিক আলোর সাপ্লাই দুজনেরই ডান দিকে। একজনের গাছ নিয়ম মেনে ডানদিকেই নতুন পাতা বার করেছে। আর অন্যজনের পাতা, সোজা বাঁ দিকে গিয়ে অন্য বন্ধুর পাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এ যোগাযোগ রেখে চলতে চাওয়া গাছ। উল্টোদিকের গাছটা অত গায়ে পড়া নয়। সে বরং একটু থমকেই গেছে। 

কারি গাছের ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম। গোড়া থেকে একা একাই ছিল। কিন্তু যে কদিনের জন্য লংকাগাছগুলো পাশে লাগানো হয়েছিল, কারিদার মধ্যে একটা চনমনে ভাব লক্ষ করেছিলাম। কচি গাছগুলো যাতে বেশি বাঁদরামো না করে সেটা দেখাশোনার দায়িত্ব অফিশিয়ালি হাতে তুলে দেওয়ার পর কারিদার ভেতর একটা গার্জেনসুলভ ভারিক্কিভাবও জেগেছিল। শেষটা যখন রোদের অভাবে লংকাবাহিনীকে ছাদে চালান করে দেওয়া হল, স্পষ্ট দেখলাম কারিদা মুষড়ে পড়েছে। তখন জল দিতে গিয়ে একদিন কারিদাকে উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দার গ্রিল থেকে ঝুলন্ত লালনীল টবের ফুলগাছগুলোকে দেখালাম। দিনদুয়েক পর কারিদার নতুন পাতা গজালো। নির্ভুল ফুলগাছগুলোর দিকে। কারিদার আসলে বয়স হয়েছে কি না, নিজে থেকে আলাপ করতে লজ্জা পায়।

রিষড়ার বাড়িতেও একই ব্যাপার। ও বাগানে তো অত ভেবেচিন্তে গাছ লাগানো হয় না। যে যেখানে পারছে হচ্ছে। আমের গায়ে শিউলি, টগরের ঘাড়ে নারকেল, পেঁপের ঘাড়ে পদ্ম। গুচ্ছের ফাঁকা জায়গা, অথচ একে অপরের গায়ে না পড়লে শান্তি নেই। কাল যোগাযোগ নিয়ে অত কথা বললাম, গাছেরাও যোগাযোগ রাখতে চায়। আমার মতো একাচোরা গাছ কি নেই একটাও? হয়তো আছে। এখনও চোখে পড়েনি, তবে বাকি জীবনে আরও অনেক গাছ দেখার সুযোগ হবে আশা করি, দেখা যাক।

আমার টেবিলে যতদিন দুটো গাছ ছিল ধীরেসুস্থে বাড়ছিল। যেই আরও দুটো জুটিয়েছি ফুর্তি চারগুণ। বৃষ্টি নামতে সবাইকে জানালার ধারে নামিয়ে দিয়ে আসি। আমার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখার উপায় নেই, সে প্রতিশোধ ওদের ওপর নিয়ে কী লাভ। ওরা আমার হয়ে দেখে। সকালবেলা এসে লোকলৌকিকতার জন্য এ বাড়ির গাছেদের কাছাকাছি রেখে আসি। যতক্ষণ না গায়ে রোদ পড়ছে, হাই হ্যালো করুক। না হলে আবার আমার মতো একাচোরা তৈরি হবে। চেহারা থেকে খুশি উপচে পড়ে। মুখে বলে না কিন্তু বোঝা যায়। সে খুশির ছবি আপনাদের দেখাই।



Comments

  1. তোমার লেখাগুলো অনেক পুরোনো কথা মনে করায় ... ত্রিবান্দ্রামে এমনি বেশি বৃষ্টি হতো কলকাতার থেকে , কিন্তু যেদিন বর্ষার প্রথম বৃষ্টি নামতো , সেই দেখতে সবাই হুড়মুড় করে অফিসের বারান্দায় চলে যেত , রীতিমত ভিড় ... হাতে একটা চা বা কফি নিতে পারলে ভালো নাহলে শুধু মুষলধারে বৃষ্টি দেখা তার সাথে মাটি আর গাছের পাতা মেশানো গন্ধ ... চারিদিকে গাছের মাঝখানে কি যে ভালো লাগতো দেখতে ... চারপাশে গাছ বলেই হয়তো ওখানে ডেস্কে গাছ রাখতে দেখতাম না ... কিন্তু ব্যাপারটা ভাবতে বেশ ভালো লাগছে ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ত্রিবান্দ্রমের বৃষ্টি নিশ্চয় দিল্লির বৃষ্টির থেকে অনেক সুন্দর, ঊর্মি। তোর বর্ণনা পড়ে আমার দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে। একসঙ্গে বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা। আমাদের তো প্রথম যেদিন ছিটে পড়ল আকাশ থেকে, অফিসশুদ্ধু লোক ছাদে দৌড়েছিল।

      Delete
  2. আমের গায়ে শিউলি, টগরের ঘাড়ে নারকেল, পেঁপের ঘাড়ে পদ্ম। গুচ্ছের ফাঁকা জায়গা, অথচ একে অপরের গায়ে না পড়লে শান্তি নেই।

    ki daroon bagan...eitai tow chai...oto hiseb kore "makey" bagan diye ki hobe!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমাদের গাছগুলো ভয়ানক গায়ে পড়া, মফঃস্বলী কালচার পুরো। আর দেখে দেখে আমারও দৃষ্টি বায়াসড হয়ে গেছে, বেশি ছাঁটাকাটা পালিশ করা গাছ দেখলে মনে হয় কষ্টে আছে বোধহয়।

      Delete
  3. khub moner moto topic! eta amio dekhi bagane.. kachakachi ghesaghesi bhalo thake. athoba amar mone hoy tai ei boita porar por theke - "The Hidden Life of Trees: What They Feel, How They Communicate"

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই বইটার নাম জানতাম না, কাকলি, যদি কখনও সুযোগ হয় পড়ব। তোমার বাগানের গাছরাও সোশ্যাল জেনে ভালো লাগল।

      Delete
  4. বৈজয়ন্তীAugust 16, 2019 at 1:38 PM

    আমার হাতে ভীষণ গাছ মরে যায়। এতদিন নিজেকে খুব দোষারোপ করতাম। হে ঠাকুর, নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কিছু গড়বড় আছে, তাই গাছগুলো টেকেনা।এইবার বুঝলাম, একা একা থাকতে থাকতে বোরডমেই নির্ঘাত ওরা মরে যায়।
    এবার থেকে একসাথে কয়েকজনকে রাখতে হবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা একটা আইডিয়া বৈজয়ন্তী। কাজে দিল কিনা জানতে আগ্রহী রইলাম।

      Delete
  5. darun lekha... amader chhotto bagan tateo oi ghnesa ghnesi .. ar chhadeo ghare ghare gachh... gachheder chhobitao bhari sundor... - Ichhadana

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঘেঁষাঘেঁষিতেই ওরা ভালো থাকে, ইচ্ছাডানা, আমাদের মতো।

      Delete

Post a Comment