বেত্রবতীর তীরে/ ওরছা ২
এ যাবৎ যাঁদের ওরছা যেতে দেখেছি সকলেই বিদেশী। আমাদের ধারণা ছিল এত বিদেশী যে জায়গায় যায় সেটা আর কত ইন্টারেস্টিং হবে। তাঁরা ফিরে এসে পজিটিভ রিভিউ দেওয়ায় সংশয় জোরদার হয়েছিল। ওরছা নির্ঘাত বিদেশীদের মন ভোলানোর মতো ভারতবর্ষ।
যেন সেটা কিছুতেই আমাদের মন ভোলানোর মতো হতে পারে না।
ওরছা যাওয়ার সপক্ষে যুক্তি ছিল একটাই। ভীষণ সোজা রাস্তা। দিল্লি থেকে হাবিবগঞ্জ শতাব্দী ছাড়ে সকাল ছ'টায়, ঝাঁসিতে থামে দশটা পঁয়তাল্লিশে। ঝাঁসি থেকে ওরছা অটোতে যেতে লাগে তিনশো টাকা আর তিরিশ মিনিট।
সুবিধের মুখ চেয়ে, মনের সংশয় মনে চেপে চলে গেলাম ওরছা। বুক করলাম মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের বেতোয়া রিট্রিট, সকলেই চেনে, অটোওয়ালা শামসুদ্দিন সাঁ করে বাঁক নিয়ে গেটের ভেতর ঢুকে ব্রেক কষলেন। অভ্যর্থনা জানাতে ম্যানেজারবাবু বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁকেও এ তল্লাটে সকলেই চেনেন, শামসুদ্দিন শুদ্ধু। পরস্পর পরস্পরকে হাত তুলে নমস্তে জানালেন।
বেতোয়া রিট্রিটের ম্যানেজারবাবু অতি করিৎকর্মা লোক। সাধারণতঃ সরকারি লোকেদের প্রোঅ্যাকটিভ হতে দেখা যায় না। ইনি উজ্জ্বল উদ্ধার। বা ‘সরকারি’র চরিত্র বদলাচ্ছে, এখন আর চোখ উল্টে থাকলে চলবে না, তাও হতে পারে। যাই হোক, ভদ্রলোক সকাল থেকে সন্ধে ঘুরে ঘুরে রিট্রিটের বিরাট কম্পাউন্ডের দেখাশোনা করেন। অনবরত চলতে থাকা পরিবর্ধন, পরিমার্জন তদারক করেন। তাছাড়াও জরুরি দর্শনার্থীদের গ্রুপ এলে সঙ্গে করে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখাতে যাওয়া, রিভার র্যাফটিং-এর আয়োজন করা, সবেতেই হ্যান্ডস অন পার্টিসিপেশন। বললেন, আমরা এখানে জাবদা খাতায় ফিডব্যাক লেখাই না, কে পড়বে। বরং অনুরোধ করি আমাদের সম্পর্কে ট্রিপঅ্যাডভাইসরে লিখতে। আপনাদেরও করছি।
বললাম, নিশ্চয় লিখব। ট্রিপ অ্যাডভাইসরে লেখার সঙ্গে সঙ্গে এখানেও লিখছি, আপনারা যদি ওরছা যাওয়া মনস্থ করেন মধ্যপ্রদেশ পর্যটন উন্নয়ন পর্ষদের 'বেতোয়া রিট্রিট'-এ থাকতে পারেন। থাকার আরও অনেক ব্যবস্থা আছে, মন্দিরের ধর্মশালা থেকে শুরু করে পুরোনো রাজবাড়ি সংশোধন করে বানানো হোটেল, সবরকম বাজেটের, সবরকম রুচিপছন্দের।
কিন্তু সে সব কথা পরে। আগে আপনি ওরছা যেতে চান কি না সেটা স্থির করা দরকার। শুধু যাওয়াথাকার সুবিধের জন্য তো একটা জায়গায় যাওয়া যায় না, তাহলে এ ব্লকের ওয়ো টাউনহাউসে গিয়ে থাকলেই হয়। বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে জায়গাটা সম্পর্কে আরও কিছু জানতে লাগে।
ওরছা, উরছা, যে ভাবেই বলুন না কেন, শব্দটার মানে হচ্ছে গোপন। পনেরোশো একত্রিশ সালে বুন্দেলা রাজপুত বংশের রাজা রুদ্রপ্রতাপ সিং যখন ওরছায় তাঁর রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান গড় কুন্দের থেকে, ঘন জঙ্গলে চারদিক থেকে ঢাকা জায়গাটার সুরক্ষিত গোপনীয়তাই তাঁর চোখ টেনেছিল।
তাছাড়া বনের ভেতর, বেত্রবতীর তীরের এই জায়গাটার অপার শান্তি আর অসামান্য সৌন্দর্যও কি রাজার মন টানেনি?
রুদ্রপ্রতাপের নিশ্চয় টেনেছিল। রাজা নরম মনের মানুষ ছিলেন। রাজধানী স্থাপনের বছরই জঙ্গলে একটি গরুকে বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে গিয়ে রুদ্রপ্রতাপ নিজে বাঘের আক্রমণে আহত হন, সেই আঘাতই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়। ওরছা মহলের কাজ তখন সবে শুরু হয়েছে।
বাঘের আক্রমণে আহত হয়ে মৃত্যুর ব্যাপারটা যদি ফ্যাক্টও হয়, গরু বাঁচাতে যাওয়ার গল্পটা একটু বেশি গল্প গল্প শুনতে না? বিশেষ করে লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের শোয়ের অভিনেতার গলায় গরু তাড়ানোর "হ্যাট হ্যাট" শুনলে অবিশ্বাসটা আরও জেঁকে বসে। গোটা ব্যাপারটা ফ্যাক্ট হওয়ার পক্ষে একটু বেশি স্ট্রেঞ্জ। তাছাড়া করুণ গল্পের মাধ্যমে রাজাকে গ্লোরিফাই করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।
থাকলেও আমার তাতে অসুবিধে নেই। যা সত্যি, সাদাকালোয় লেখা, সে সব সকলেই জানে। রাজা এত সালে জন্মালেন, এতগুলো যুদ্ধ করলেন, এতগুলো জিতলেন, এতগুলো হারলেন, এতগুলো বিয়ে করলেন, এতগুলো সন্তানের জন্ম দিলেন, এতগুলো মন্দির বানালেন। এত সব হাঙ্গামা সেরে যত সালে তিনি পটল তুলবেন, ততক্ষণে ক্লাসের অর্ধেক মেয়ে হাই তুলবে, বাকি অর্ধেক শেষপাতায় কাটাকুটি। তার থেকে ঢের ভালো অন্য গল্পগুলো, নিন্দুকে যাদের গুল্প বলে, যেগুলো লোকের মুখে মুখে ঘুরে রং টং মেখে বেশ রোমহর্ষক হয়ে উঠেছে। সেই সব গুল্প ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায় হয়তো, কিন্তু খোঁজার পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিল সরকারি লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, যা প্রতি সন্ধেবেলা ওরছা রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে, দিওয়ান-ই-খাসের সামনের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দি ইংরিজি দুই ভাষাতেই। একঘণ্টার শো, মাথাপিছু একশো তিরিশ টাকা টিকিট। আমার মতে পয়সা হেসেখেলে উশুল। খালি মশার উপদ্রবটা অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে।
মশার উপদ্রবের জন্যই একটা মজার ঘটনা ঘটল যদিও। টিকিট কাউন্টারে দুটো অল্পবয়সী মেয়েকে দেখেছিলাম। নিজেদের মধ্যে হিন্দি, ইংরিজি মিশিয়ে কথা বলছিল। আমরাও যেচে পড়ে আলাপ করিনি, ওরাও করেনি। তারপর তো আমরা অন্ধকার মাঠে এসে বসে আছি কখন শো শুরু হবে আর মশা কামড়ে পাগল করে দিচ্ছে। হঠাৎ শুনি প্রবল চপেটাঘাতের সঙ্গে সঙ্গে একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে, বাপরে বাপ কী মশা, কী মশা।
বেরোলো দু'জন হচ্ছে মামাতো পিসতুতো বোন, একজন জে এন ইউ-তে মডার্ন হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছে, একজন চাকরি, একজনের বাড়ি সি আর পার্কের সি ব্লকে, আরেকজনের জি কে ওয়ান, দু'জনে উঠেছেও বেতোয়া রিট্রিটে। ব্রেকফাস্টে, ডিনারে তো পরের দেড়দিন দেখা হলই, ওইটুকু জায়গার মোড় ঘুরতে, মন্দিরের চাতালে, নদীর পারেও কেবলই দেখা হতে লাগল। মেয়েদুটিকে আমাদের ভালো লাগল বেশ। দুই বোনে মিলে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। আলাপ হয়ে গেল। আমরা বাংলাতেই নিজেদের মধ্যে চারদিকে যে বাঙালি গিজগিজ করছে সেই নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলাম।
বেরোলো দু'জন হচ্ছে মামাতো পিসতুতো বোন, একজন জে এন ইউ-তে মডার্ন হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছে, একজন চাকরি, একজনের বাড়ি সি আর পার্কের সি ব্লকে, আরেকজনের জি কে ওয়ান, দু'জনে উঠেছেও বেতোয়া রিট্রিটে। ব্রেকফাস্টে, ডিনারে তো পরের দেড়দিন দেখা হলই, ওইটুকু জায়গার মোড় ঘুরতে, মন্দিরের চাতালে, নদীর পারেও কেবলই দেখা হতে লাগল। মেয়েদুটিকে আমাদের ভালো লাগল বেশ। দুই বোনে মিলে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। আলাপ হয়ে গেল। আমরা বাংলাতেই নিজেদের মধ্যে চারদিকে যে বাঙালি গিজগিজ করছে সেই নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলাম।
ওরছার রাজবংশ বুন্দেলা রাজপুত বংশের। এঁদের প্রাসাদের সিংহদ্বারে, দেওয়ালেট সূর্যের মুখ, ঠিক যেমন দেখেছিলাম উদয়পুরের প্যালেসে। কাশীর রাজপুত সিংহাসনের ভাগ না পেয়ে রাজার ছেলে জগদাস বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর তপস্যায় বসেন। দেবীর আশীর্বাদে এক বুঁদ রক্ত থেকে জন্ম নেন জগদাসের বীর পুত্র বুন্দেলা। শুরু হয় বুন্দেলা রাজপুত বংশের।
এই বুন্দেলারও অনেক পরে আসেন রাজা রুদ্রপ্রতাপ সিং, যিনি পনেরোশো একত্রিশে, ওরছাতে রাজধানী স্থানান্তর করার বছরেই বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। ওরছা মহলের কাজ তখন সবে শুরু হয়েছে। রুদ্রপ্রতাপ সিং-এর ছেলে ভারতীচাঁদ বাবার অসম্পূর্ণ কাজ চালিয়ে নিয়ে যান। ভারতীচাঁদের ভাই ছিলেন মধুকর শাহ। এই দুই ভাইয়ের সময় শেরশাহ কালিঞ্জর, যা কিনা বুন্দেলখণ্ডের আরেকটি দুর্গ ছিল, আক্রমণ করেন। ভারতীচাঁদ ওরছার প্রতিনিধি হিসেবে সৈন্যসামন্ত সহকারে মধুকর শাহকে কালিঞ্জরের যুদ্ধে পাঠান। ওই যুদ্ধেই শের শাহ মারা যান। মধুকর শাহ বিপুল ফ্যানফেয়ারের সঙ্গে বাড়ি ফেরেন।
নিঃসন্তান ভারতীচাঁদের মৃত্যুর পর মধুকর শাহ সিংহাসনে বসেন। ভালো সেনাপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছিলেন কৃষ্ণঠাকুরের অন্ধ ভক্ত। রানি গণেশ কুঁয়রির ভক্তি ছিল আবার রামচন্দ্রের প্রতি। ভক্তি জিনিসটা প্রাইভেট গুড, একজনকে দিলে অন্যজনের ভাগে কম পড়ে যায়। রাজারানি কেউই একে অন্যের ইষ্টদেবতাকে ভক্তি করতে পারলেন না। প্রতিবছরই ছুটিতে বৃন্দাবন যাওয়া হবে না অযোধ্যা সেই নিয়ে মারামারি।
কিন্তু রাজ্যটা ফাইন্যালি রাজার। রাজা রানিকে বললেন, আমার রাজ্যে থেকে এত রামভক্তি চলবে না, যদি চালাতে হয় তো রামকে রাজ্যে নিয়ে এসে দেখাও, না হলে আর নিজের মুখ দেখিয়ো না।
সরযূর তীরে গিয়ে গণেশ কুঁয়রি তপস্যায় বসলেন। দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাস গেল। রাম দেখা দিলেন না। 'হায় রে আমার সব গেল' কেঁদে রানি ঝাঁপ দিলেন জলে, দাসদাসী সাঙ্গোপাঙ্গ হায় হায় করে উঠল, রানি জলের ভেতর অদৃশ্য হলেন। একটু পর সরযুর জলে ঢেউ তুলে তুলে রানি উঠে এলেন, কোলে একখানি নয়নাভিরাম শিশু। রাম এসেছেন তাঁর বালক অবতার ধারণ করে।
বালক রাম রাজি হলেন রানির সঙ্গে ওরছা আসতে, তিনটি শর্তে। অযোধ্যা থেকে ওরছা গোটা রাস্তা রানিকে হেঁটে যেতে হবে। গোটা রাস্তা বালক রামকে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে, প্রথম যেখানে রানি তাঁকে নামিয়ে রাখবেন সেখানেই তিনি স্থাপিত হবেন। আর নড়বেন চড়বেন না।
হইহই করে ওরছা ফিরে এলেন গণেশ কুঁয়রি। মধুকর শাহ অ্যাপোলোজেটিক হয়ে তাঁর স্ত্রীর আরাধ্য রামের জন্য তাড়াতাড়ি চতুর্ভুজ মন্দির বানাতে বসলেন। রানি বললেন, উফ হেঁটে হেঁটে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে, একটু রাখি, বলে কোলের রামকে নিজ শয়নকক্ষে পালংকে নামিয়ে রাখলেন। মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার সময় হলে রানি, রাজা, পুরুতমশাই সবাই মিলে হেঁইও বলেও বালক রামকে স্থানচ্যুত করতে পারল না। তখন রানির বেডরুমেই দেবতা স্থাপিত হলেন। রানিমহল হয়ে গেল রাম রাজা মন্দির। চতুর্ভুজ মন্দির মধুকর শাহ শেষ করে যেতে পারেননি, তাঁর যোগ্য পুত্র বীর দেও সিং সে মন্দির সম্পূর্ণ করেন।
আমরা চতুর্ভুজ আর রামরাজা মন্দির দুটোতেই গিয়েছিলাম, বলা বাহুল্য। না যাওয়ার কোনও যুক্তিই নেই, একটা অপরের ঘাড়ের ওপর। ওরছায় সবই ভয়ানক কাছাকাছি। চৌমাথার ডানদিকে গেলে প্রাসাদ, বাঁদিকে গেলে চতুর্ভুজ আর রাম রাজা মন্দির, চৌমাথার মাঝখানে পণ্ডিতজির আলু টিক্কি আর শ্রীরাধে সুইটসের ফুচকা খাচ্ছেন বাঙালি কাকু কাকিমা বাবুসোনার দল। রাম রাজা মন্দিরে এখনও হই হই করে পুজো হয়। সন্ধেবেলা হারমোনিয়াম আর ঢোল সহযোগে চিৎকার করে বেসুরো কীর্তন, সবই চলে। অর্চিষ্মান কীর্তন শুনে বলল, ওরে বাবা, এরা তো আমার মতো গাইছে দেখছি। আমি বললাম, এখানে গানটা পয়েন্ট নয়, ফিলিংটা পয়েন্ট। এই যে হেমন্তের সন্ধেয় সবাই মিলে চেঁচামেচি করে রক্তগরম হচ্ছে, সেটাই মোক্ষ।
মধুকর শাহের পর সিংহাসন ভাগ হয়ে গেল তাঁর আট ছেলের মধ্যে। ওরছার সিংহাসনের ভাগ পেলেন মধুকর শাহের ছেলে রাম সিং। দিল্লির মসনদে তখন আকবর, তিনি রাম সিং-কে ওরছার রাজা বলে মেনে নিলেন। এটা বীর সিং দেও, যিনি মধুকর শাহের আরেক ছেলে ছিলেন এবং যার কপালে বারোনির জায়গির জুটেছিল, মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। ওদিকে আকবরের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘনিয়ে উঠছিল, ঘনাচ্ছিলেন শাহজাদা সেলিম। বীর সিং দেও সেলিমের সঙ্গে হাত মেলালেন। সেলিম অভিযোগ করলেন তাঁর বাবা আবুল ফজলকে দিয়ে তাঁর ওপর নজর রাখছেন। কুছ পরোয়া নেই, আশ্বাস দিয়ে, শান্তিচুক্তি সই করানোর নামে আবুল ফজলকে ডেকে এনে খুন করলেন। তারপর তাঁর কাটা মুণ্ডু ভেট পাঠালেন সেলিমকে।
প্রতিদানও দিলেন সেলিম। সম্রাট জাহাঙ্গির হয়ে দিল্লির মসনদে বসার পর ওরছার সিংহাসন থেকে রাম সিংকে সরিয়ে বন্ধু বীর সিং দেওকে বসালেন। বীর সিং দেওয়ের স্বপ্ন সফল হল। কৃতজ্ঞ বীর সিং দেও বন্ধু সম্রাটের জন্য তাঁর নিজের মহলের পাশে বানিয়ে দিলেন জাহাঙ্গির মহল। রাজপুত আর মুঘল স্থাপত্যের মিশেলে বানানো প্রাসাদটি দেখার মতো।
ভার্সেইয়ের বারান্দার থেকে কম কীসে?
জাহাঙ্গির মহলের বারান্দা থেকে দেখা যায় উটেদের আস্তাবল, আর বাঁ দিকে ঘাড় ফেরালে আপনি দেখতে পাবেন একটি একটেরে ছোট বাড়ি। ওটি হচ্ছে রাই প্রবীণের বাংলো। রাই প্রবীণ ছিলেন ওরছার রাজপ্রাসাদের রাজনর্তকী, রাজগায়িকা। এ ছাড়াও তিনি কবিতা, গান লিখতেন, মোট কথা রত্ন ছিলেন। তাঁকে দেখেশুনে আকবর মুগ্ধ হলেন আর বললেন, ওরছায় হিডেন জেম হয়ে থেকে কী হবে, দিল্লির রাজসভায় চল, তোমাকে আমি সারা ভারতের রত্ন বানাবো।
রাই প্রবীণ রাজি হলেন না। বীর সিং দেওয়ের এক ভাই ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তাঁর ভাবভালোবাসা ছিল। কিন্তু ওরছার রাজারা বললেন, ওঁরা যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, প্রবীণ যেন ট্যাঁ ফোঁ না করে দিল্লি রওনা দেন। রাই প্রবীণ দিল্লি এলেন এবং গানে গানে সম্রাটকে জিজ্ঞাসা করলেন,
"Vinti Rai Praveen ki, suniye sah sujan. Juthi patar bhakat hain, bari, bayas, swan.."
অর্থাৎ নিচু জাত, নাপিত আর কাকেরাই অন্যের এঁটোকাঁটা খায়, সম্রাট আকবর এদের মধ্যে কোনজন?
মেটাফর শুনে আমার তাজ্ঝিমমাজ্ঝিম লেগে গিয়েছিল কিন্তু আকবর মুগ্ধ হলেন রাই প্রবীণের সাহস দেখে। বললেন আমার শিক্ষা হয়েছে, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি, তুমি ফিরে যাও নিজের ওরছায়, ভালোবাসার মানুষের কাছে। রাই প্রবীণ মহাসমারোহে ওরছায় ফিরে এলেন আর তাঁর জন্য সুদর্শন মহলটি বানিয়ে দেওয়া হল।
বীর দেও সিং-এর পর সিংহাসনে বসলেন ঝুঝর সিং। এই ঝুঝর সিং মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর আমলের সবথেকে ইন্টারেস্টিং গল্পটা যুদ্ধের নয়।
ঝুঝর সিং-এর ভাই ছিলেন লালা হরদৌল। হরদৌল ছিলেন যুবক, সুপুরুষ, জনপ্রিয়, যুদ্ধে দড়। হরদৌল প্রিয় ছিলেন রাজ্যের সমস্ত প্রজা আর তাঁর ভাবিজী, ঝুঝর সিং-এর স্ত্রীর কাছে।
লোকে ঝুঝর সিং-এর কান ভাঙালো, কেউ বলে স্বয়ং মুঘলসম্রাট দিল্লিতে ডেকে নিয়ে ঝুঝর সিংকে সাবধান করেছিলেন। ঝুঝর সিং বললেন, আমি বিশ্বাস করি না। হরদৌল আমার আড় আমার স্ত্রীর কাছে সন্তানসম। লোকে বলল, এটা প্রমাণ করার তো খুব সহজ উপায় রয়েছে। স্ত্রীকে বলুন হরদৌলকে বিষ খাওয়াতে। আপনার প্রতি যদি তাঁর ভালোবাসা হরদৌলের প্রতি ভালোবাসার থেকে বেশি হয় তাহলে তিনি আপনার কথাই শুনবেন।
ঝুঝর সিং তাই করলেন। অনেক কান্নাকাটির পর রানিমা একবাটি বিষমেশানো পায়েস নিয়ে দেওরের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। পায়েস মুখে ছোঁয়ানো মাত্র হরদৌল মৃতপ্রায় হলেন। রানি কেঁদে বললেন, লালাজি আমি আপনাকে মেরে ফেললাম। হরদৌল বললেন, আমি নিজেকেই নিজে মেরেছি ভাবিজি, আমি জানতাম পায়েসে বিষ আছে। আমি স্বেচ্ছায় সে বিষ খেয়েছি কারণ আমার প্রাণের থেকে আমার ভাবিজির চরিত্ররক্ষা বড়।
যদিও লাইট অ্যান্ড সাউন্ডে ঝুঝর সিং-এর চরিত্রের অভিনেতা খুব কেঁদে কেঁদে আফসোস করছিলেন, বাস্তবের ঝুঝর সিং বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন কি না সন্দেহ। কারণ শুধু তো স্ত্রী হারানোর ভয় ছিল না, হরদৌল জনপ্রিয় ছিলেন, মোটে চব্বিশ বছরের ছিলেন, শোনা যায় ওরছার অফিশিয়াল সেনাবাহিনীর বাইরে তাঁর নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল। অচিরেই হয়তো সিংহাসনের দাবি করে বসতেন। এ কথা বলছি কারণ কয়েকবছর পর ঝুঝর সিং-এর বোন কুঞ্জবতী তাঁর মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন নিয়ে ঝুঝর সিং-এর কাছে এলে তিনি নাকি বাঁকা মন্তব্য করেন যে তাঁকে কেন, প্রিয় ভাই হরদৌলকে নেমন্তন্ন করলেই হত।
কুঞ্জবতী কাঁদতে কাঁদতে গেলেন হরদৌলের সমাধিতে। বোনের কান্না শুনে হরদৌলের আত্মার মন ভিজল, তিনি বললেন আমি নিশ্চয় যাব তোর মেয়ের বিয়েতে।
সেই থেকে এ অঞ্চলের সব বিয়েতে সবার আগে লালা হরদৌলের কাছে নেমন্তন্ন পাঠানো হয়। লালা হরদৌলের নামে প্রচুর বিয়ের গান আছে, ইউটিউবে, শুনতে পারেন।
ঝুঝর সিং যথাসময়ে মরে গেলেন। তাঁর নাতির নাতি ইন্দ্রমণি সিং-এর সময় আবার একটা বলার মতো গল্প ঘটল। ইন্দ্রমণির সময় দিল্লির মসনদে ছিলেন সম্রাট অওরংজেব। সম্রাটের কানে এক সাংঘাতিক খবর গেল। ইন্দ্রমণির সঙ্গে নাকি তাঁর মেয়ে, রাজকন্যা বদরুন্নিসার ভাবভালোবাসা হয়েছে। অগ্নিশর্মা হয়ে আউরংজেব হুকুম দিলেন চতুর্ভুজ মন্দির দখলের। সেনাপতি এল, ওরছা রাজ্য ভয়ে আধমরা হল। সবাই মিলে আলোচনা হল কী করা যায়, কোনও উপায় বেরোল না, এমন সময় মাথায় পাগড়ি পরা একটি অল্পবয়স্ক ছেলে এসে বলল, চিন্তা কোরো না, তোমাদের মন্দির আমি রক্ষা করব।
আপনি যা ভাবছেন, টুইস্টটা সেটা নয়।
যথাসময়ে সম্রাটের দূত এসে মন্দিরের দরজার কড়া নাড়ল। সবাই বেরোও, আজ থেকে এ মন্দির আমাদের। পূজারী বললেন, আমার পক্ষে এ মন্দির ছাড়া সম্ভব নয়, তোমাদের যা করার কর। তবে রে? বলে দূত পণ্ডিতমশাইয়ের মস্তকছেদন করতে যাবেন, সেই কিশোর এসে পথরোধ করে দাঁড়াল।
দূত বলল, তুই কে? কোত্থেকে এলি?
কিশোর তার মাথার পাগড়ির প্যাঁচ খুলতে শুরু করল। পাগড়ির নিচ থেকে বেরোল কালো চুলের গুচ্ছ, সবাই হাঁ হয়ে দেখল দাঁড়িয়ে আছেন রাজকুমারী বদরুন্নিসা।
আরও অনেক ছোটখাটো গল্প শুনেছিলাম লাইট অ্যান্ড সাউন্ডে, যে ক’টা মনে ছিল লিখলাম। ইতিহাস, গল্প, গান, বাজনা, আলো, ছায়া সব মিলিয়ে এক ঘণ্টা হুশ করে কেটে গেল। বেরিয়ে দেখি পরের হিন্দি সংস্করণের শো-এর জন্য দর্শকরা অলরেডি জমা হয়ে আছেন।
তাঁদের ভিড় পেরিয়ে আসতেই অবশ্য টের পেলাম, ওরছা অলরেডি ঘুমঘুম।
খাঁ খাঁ রাস্তার পাশের ঝুপড়িতে বারান্দায় এসে পড়া ল্যাম্পপোস্টের আলোয় খেতে বসেছে বাবা মা দুটি বাচ্চার সংসার। তফাতে থাবায় মাথা রেখে মেলে অপেক্ষা করছে দুটো কুকুর। পা চালালাম। সেই কোন ভোরে উঠেছি। তাছাড়া কাল একটা মারাত্মক রোমহর্ষক ব্যাপার ঘটবে। আজ রাতে দেরি করা চলবে না।
(চলবে)
ওরছা ১
ওরছা ৩
Baah besh bhalo laglo pore. Amar kokhono Orchha jaoar sujog hoini tabe besh anek bochhor aage aami Orchha beranor golpo amar Sasurmoshai er theke shunechhilam. onar khub bhalo legechhilo. Deshe fire gele ichche aachhe esab jaiga berabar.
ReplyDeletePoroborti porber jonyo apeksha korchhi.
ওরছা আমাদেরও খুব ভালো লেগেছে, সুস্মিতা। কখনও সুযোগ হলে যাবেন।
Deleteসব প্রাসাদ বেশ সুন্দর কিন্তু ঝাড়ামোছা হয়নি যেন .. গল্পগুলো বেশ.. তুমি এত মনে রাখলে কিভাবে? আমি তো ভিক্টোরিয়া আর লালকেল্লায় গল্পগুলো আগে এমনিতেই জানা ছিল তাই ,নাহলে গোলকোন্ডা ফোর্টে দেখেছিলাম সে গল্প ভুলে গেছি ..পরে কোথাও দেখলে অবশ্যই মনে রাখার চেষ্টা করব ..
ReplyDeleteআরে এই গল্পগুলো পরীক্ষার সিলেবাসে নেই বলে মনে আছে, ঊর্মি। থাকলে শোণামাত্র ভুলে যেতাম।
DeleteKaal ki hobe? Nishchoi River Rafting?
ReplyDeleteইস, আমার এত সাধের ক্লিফহ্যাংগারে জল ঢেলে দিলে। র্যাফটিংই বটে।
DeleteChobigulo otyonto, otyonto bhalo hoyeche..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ।
DeleteKhub bhalo bornona.. apnara khub bhalo ghurechen. Delhi theke jaoa subhidha jene aro bhalo lagche. Amrao Hrishikesh khub bhalo ghurlam, Bangali gijgij korchhilo, kintu Lansdowne besh phanka phanka, shanto jayga...
ReplyDeleteOrchar kotha age shunini..notun jayga suggestion er jonno apnake dhonnobad..
ভালো ঘুরেছ শুনে ভালো লাগল, রণদীপ। বাঙালি সর্বত্রই গিজগিজ করে, ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ওরছা কিন্তু এন আর সি-র ভ্রমণার্থীদের জন্য পারফেক্ট। সুযোগ পেলে ঘুরে এসো।
DeleteKi bhalo chhobi... r darun lekha... berate jetei hobe bole je list banachhi ejanme ta ghure sesh hobe kina ke jane... - Ichhadana
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা। আপনি যখন বলছেন ছবি ভালো, তখন কলার তুললাম। লিস্ট বানানোর যে মজাটা, আমি তো সেটাই উপভোগ করে জীবন কাটানোর প্ল্যান করেছি। সত্যি সত্যি যাওয়ার ছুটি, টাকা, এনার্জি, কোনওটাই নেই।
Delete"আমরা বাংলাতেই নিজেদের মধ্যে চারদিকে যে বাঙালি গিজগিজ করছে সেই নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলাম"ঠিক এরকমই আমরা ইউরোপে বেড়াতে গিয়ে "ভারতীয়রা বেড়াতে এসে ইউরোপের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে" বলে দুঃখ করছিলাম। আপনার ফটোগ্রাফির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমার ওই সিলিংটা দেখে ভার্সেই-এর কথাই মনে হয়েছিল।
ReplyDeleteনাঃ, এবার কলার তুলতেই হচ্ছে। থ্যাংক ইউ, সুগত। বাঙালি হয়ে বাঙালির নিন্দে না করলে মজা নেই।
Delete