বাজরার রুটি আর গোস্ত/ ওরছা ১
আমার জন্য করওয়াচওথ পালন করনি না হয় মেনে নেওয়া গেল, আমার এতদিন বাদে বাড়ি ফেরা উদযাপন করতে অন্ততঃ ভালো কিছু খাই চল।
এই "ভালো"র সঙ্গে কিন্তু গুণগত ভালোর কোনও সম্পর্ক নেই। এই ভালো খাওয়ার মানে হচ্ছে বাড়ির বাইরে কোথাও, যে কোনও জায়গার খাওয়া। যে খাওয়া খেতে ধড়াচুড়ো পরে গাড়ি চড়ে যেতে হয়, পয়সা খরচ করতে হয় আর খাবারগুলো হজম হতে অনেএএক সময় নয়। অনেকসময় হয়ও না।
যেতে যেতে অর্চিষ্মান বলল, আজ খেতে যাব, পরশু বেড়াতে যাব...
আমি বললাম, কোথায় যাবে? বলনি তো? মোটে তো ছ'বছর কেটেছে কি কাটেনি, সম্পর্কে কী সব যেন 'ইচ' টিচ হয় শুনেছি, তাতেও তো মিনিমাম সাত বছর লাগে, আর তুমি কি না এখনই একা একা বেড়াতে যাবে?
অর্চিষ্মান বলল, আহা আমি একা যাব নাকি, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।
লোকে বলে একটা মানুষকে চিনতে অনেক সময় লাগে, নিজেকেই গোটা জীবনে চেনা হয়ে ওঠে না হ্যানোত্যানো, কিন্তু অর্চিষ্মানের শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য বলতে বললে আমি লম্বা রোগা চশমা ইত্যাদির সঙ্গে আর যেটা যোগ করব তা হল যে অর্চিষ্মান ইমপালসিভ নয়। ইচ্ছে হল আর অমনি একটা কিছু ঘটিয়ে ফেললাম, এ জিনিস ওর ধাতে নেই। ওটা আমার স্পেশালিটি।
আমি বললাম, সে কী, কিছু তো ঠিক হয়নি। অর্চিষ্মান বলল, এই তো খেতে খেতে ঠিক করে ফেলব।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। অর্চিষ্মান যেই আমার মতো হয়ে লাগল আমি অমনি ওর মতো হয়ে গেলাম আর কেবলই বলত লাগলাম, আরে এত হুড়োতাড়া করলে হবে? আগে ভাবতে হবে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, তারপর ভাবতে হবে কোথায় কোথায় যাওয়া হয়নি, কোথায় কোথায় ট্রেন এবং হোটেলের বুকিং পাওয়া যাবে, কিছুই তো জানা নেই...
অর্চিষ্মান অটো থেকে নামতে নামতে বলল, কেন একটা জিনিস জানা আছে তো, পাহাড়ে যাব না।
মনে পড়ে গেল একবার কাজে ফাঁকি মেরে 'অফবিট উইকেন্ড গেটঅ্যাওয়েজ ফ্রম দিল্লি' খুঁজতে খুঁজতে গুগল সার্চের পাঁচ পাতা পার করে একটা লিংক পেয়েছিলাম যার নাম ছিল উইকেন্ড গেট অ্যাওয়ে ফ্রম হিলস। হাসি পেয়েছিল, দুঃখও হয়েছিল। কারণ আমরাও একই ফ্রাস্ট্রেশনের ভুক্তভোগী। সবাই বলে দিল্লিতে থাকলে বেড়াতে যাওয়ার সুবিধে, আমরাও গোড়াতে সেই রকমই ভেবেছিলাম কিন্তু ওপরওপর যেমন দেখায় সবটাই তত চমৎকার নয়। পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা যে ইচ্ছে হলেই টপাটপ বাঁকুড়ার মন্দির, দীঘার সমুদ্র, ডুয়ার্সের জঙ্গল, সিকিমের পাহাড় দেখে নিতে পারেন, আমাদের অত অপশন নেই। আমাদের লং উইকএন্ড মানে সেই পাহাড় আর পাহাড়।
সমুদ্র আছে বটে গুজরাতে, কিন্তু বিচের নাম সোমনাথ শুনলে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে অন্তর্হিত হয় না? আর এখানকার জঙ্গলগুলো? মরুভূমির মধ্যে ঝোপ বলা উচিত। কোথায় সেই কোথায় সেই উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক থেকে অল্প অল্প সূর্যের আলো, কোথায় সেই শ্যাওলার স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, কোথায় সে রাতপাখির গা ছমছম ডাক। যে রকম জঙ্গলের সমার্থক শব্দ অরণ্য কিংবা বনানী, সে রকম জঙ্গল এ দেশে পাওয়া যায় না।
এ দেশে খালি পাহাড় আর পাহাড়।
অর্চিষ্মান বলল, ও বরং এ ব্লকের ওয়ো টাউন হাউসে স্টেকেশনে যাবে কিন্তু পাহাড়ে যাব না।
আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সারপ্রাইজ আমি পছন্দ করি। জীবনের চলার পথে নাকবরাবর অটোপাইলটে চলার থেকে এ বাঁক ও বাঁক থেকে লাফ মেরে সারপ্রাইজরা লাফ মেরে বেরিয়ে পিলেকে দু দুদণ্ড সুস্থির থাকতে দেবে না, সে রকমটাই আমার পছন্দ, তা বলে একই বেলায় এত?
এইরকম অপশনহীন বাক্যও অর্চিষ্মানের মুখ থেকে বেরোয় না কখনও। মরে গেলেও এটা করব না, মেরে ফেললেও সেটা খাব না - এই ধরণের হুংকার আমি অহরহ ছাড়ি, অর্চিষ্মান ছাড়ে না।
খেটে খেটে বেচারার কেমিক্যাল ইমব্যালেন্স হয়ে গেল নাকি?
খাবারের অর্ডার দিয়ে যে যার ফোনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
উইকএন্ডে বেড়াতে যাওয়ার একটা সমস্যা হচ্ছে সময়। একদিনের বেশি ছুটি নিতে আমরা দুজনেই নারাজ, কাজেই যাওয়া আসা ঘোরা খাওয়া সব তিনদিনে সারতে হবে। কাজেই এমন জায়গাতেই যেতে হবে যেখানে তিনদিন অপ্রতুল ঠেকবে না। তাছাড়া চাকুরীজীবীর সংসারে টাকার চিন্তা সর্বদাই চমৎকারা। পড়তা পোষাবে কি ন। যেমন পন্ডিচেরি হয়তো তিনদিনে ঘোরা যায়, কিন্তু তাতে যে খরচটা পড়বে সেটা হঠকারিতা হয়ে যাবে। যা বুঝলাম, খরচ ভদ্রস্থ রাখতে হলে বিন্ধ্যপর্বত পার করা যাবে না। তবু চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। দিল্লি থেকে প্লেনের ভাড়া কোন শহরে কম বার করে সেই শহরের লোকেরা উইকএন্ড গেটঅ্যাওয়েতে কোথায় কোথায় যায় সে সব খোঁজাখুঁজি হল।
খাবার শেষ হয়ে গেল, একটা মনের মতো জায়গা পাওয়া গেল না।
শুক্রবার সকালে উঠে মনে পড়ল হাতে আর মোটে চব্বিশ ঘণ্টা। চা খেতে খেতে জায়গা বাছলাম, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ট্রেনের টিকিট কাটলাম, একজন যখন গাছে জল দিল অন্যজন হোটেল বুক করল।
আপনারা যতক্ষণে এই পোস্ট পড়ছেন ততক্ষণে শতাব্দী ছেড়ে দিয়েছে। এত ঘনাঘন টিকিট কাটলে যা হয়, দুজনে আলাদা আলাদা "নো চয়েস" সিট। কে জানে কারও হাতেপায়ে ধরে সিট চেঞ্জ করে পাশাপাশি বসা গেল কি না (যায়নি), কে জানে ট্রেন যেদিকে যাবে সিটের মুখ সেদিকে হল কি না (হয়নি)। কে জানে আপনারা আন্দাজ করতে পারলেন কি না আমরা শেষমেশ কোথায় চলেছি।
ভারতবর্ষের যে জায়গার লোকদের জোড়া ভুরু হয় আর যে জায়গার লোকেদের চোয়াল দেখলেই বোঝা যায় যে তারা ভাত আলুভাতের বদলে বাজরার রুটি আর গোস্ত খেয়ে থাকে, আমরা চলেছি সেই জায়গার একটি প্রাচীন শহরের উদ্দেশ্যে।
Bhopal? Naki Jhansi? ( Same shatabdi)
ReplyDeleteখুব কাছাকাছি, অর্পণ। ওরছা। শতাব্দী অবশ্য ওটাই।
Deleteফেলুদার কোন গল্পটা, প্লীজ় বলে দিন। পেটে আসছে, মুখে আসছে না। মারাত্মক অস্বস্তি হচ্ছে।
ReplyDeleteপ্রসঙ্গাতরে, ইকনমিক্স নোবেল নিয়ে কিছু বলুন। নোবেল পেতে না পেতেই, প্রশংসা এবং তীব্র নিন্দার এই ঝড় তো অমর্ত্য় সেন এর সময় ও হয়নি।
অমর্ত্য সেনের সময়ের থেকে তো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোফাইলের সংখ্যাও বেড়েছে, কাজেই।
Deleteগল্পটা হত্যাপুরী, সম্বরণ। ওখানে প্রথম ডেডবডি আবিষ্কার করে লালমোহনবাবু বলেছিলেন বডির জোড়া ভুরু দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বাঙালি নয় আর চোয়াল দেখে মনে হচ্ছে বাজরার রুটি আর গোস্ত খাওয়া চেহারা। যদ্দূর মনে হচ্ছে বুন্দেলখণ্ডের লোক।
আন্দাজে ঝাড়ছি। রাজস্থান, দিল্লী আজমের শতাব্দী, আজমের। দেখি, গোয়েন্দাগিরি টা খাটে কিনা।
ReplyDeleteদারুন শুরু।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, নালক।
DeleteRajasthan?
ReplyDeleteমধ্যপ্রদেশের ওরছা, চুপকথা। ঝাঁসির কাছে।
Deletedarun to. Jhotpot beranor golpo lekho.
DeleteBah.. darun beranor golpo hobe mone hocche.. Ami jaini Amar ma masira gechilo .. ora purono palace hotel banano hoyeche sekhane Chilo, puro rajar golpo ar bhuter golpo meshano ekta experience ..
ReplyDeleteওরে বাবা, রোমহর্ষক ব্যাপার তো, ঊর্মি। আমরা সম্ভবতঃ ওই হোটেলটা দেখেছি, থাকিনি যদিও।
DeleteDarun shuru..Porer bhaager jonno opeksha roilo..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, রণদীপ। তোমরা ওরছা গেছো? না গিয়ে থাকলে শিগগিরি ঘুরে এস। আমাদের খুব ভালো লেগেছে।
DeleteNa, jaoa hoyni...kintu khub jabar ichhe roilo; sei Haridwar ar Lansdowne jachhi Diwali's chhuti te... Khub bhir thakbe jani..kintu oi barite baki sobai etai thik korlo..
Deleteনা না, ভিড় নাও থাকতে পারে। ভালো করে ঘুরে এস। হ্যাপি জার্নি।
Delete