ঠাকুমার তোষক


কে বলেছিলেন জানিনা, কিন্তু কেউ না কেউ নির্ঘাত বলেছিলেন, সব ট্র্যাজেডির মধ্যেই কমেডি লুকিয়ে থাকে। অ্যান্ড ভাইসি ভারসা। বাস্তবে এর ভুরিভুরি উদাহরণ আছে। যেমন ধরুন ওই সিনেমাটা, হ্যালো ব্রাদার। সেই যে সলমন খান, সলমন খানের ভাই আর রানি মুখার্জি? কোনো একটা গরমের ছুটিতে টিভিতে দিয়েছিলো। তার আগে সাপ্তাহিক বর্তমানে আমি পড়ে রেখেছিলাম, সলমন খান ইন্টারভিউতে বলেছেন, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এরকম দমফাটা হাসির সিনেমা নাকি এর আগে আসেনি। অনেক আশা নিয়ে দেখতে বসে শেষে কেঁদেকেটে কূল পাইনি, হাড়ে হাড়ে মনে আছে এখনো।

কাজেই এখন যে ঘটনাটা আমি আপনাদের বলতে যাচ্ছি, সেটা পড়ে আমাকে পাষাণহৃদয় ঠাওরাবেন না। কারণ ঘটনাটা হাসির, অন্তত আমার হাসতে হাসতে হেঁচকি উঠে গেছে, কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষাপটটা অত্যন্ত ট্র্যাজিক।

ঘটনাটা ঘটেছে আমাদের রিষড়ার বাড়ির একটা ঘরে, যে ঘরে আজকাল চব্বিশ ঘণ্টা, তিরিশ দিন আমার ঠাকুমা জলের বিছানার ওপর চোখে একটা অদ্ভুত ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে সিলিঙের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকেন। শখে নয় বুঝতেই পারছেন। উঠতে পারেননা বলে শুয়ে থাকেন। গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে। এই গরমের মধ্যে। ঠাকুমার নাকি ঠাণ্ডা লাগে। শুতে শুতে পাছে বেডসোর হয়ে যায়, তাই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো জলের বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব খারাপ সময়টা কেটে যাওয়ার পর, যখন থেকে একটু একটু কথা বলতে পারছেন ঠাকুমা, তখন থেকেই এই জোলো বিছানা সরানোর দাবি জানিয়ে আসছেন তিনি। সত্যিই তো, পিঠের নিচে কীরকম বিশ্রী অস্বস্তি, নড়াচড়া, দুলুনি। কিন্তু তাঁর কথায় কান দেওয়া হচ্ছেনা, কারণ তিনি এখন অসুস্থ, আর কে না জানে অসুস্থ লোক নিজের ভালো বোঝেনা।

এরকম যখন পরিস্থিতি, তখন একদিন সকালে মা তাঁর শেষ সপ্তাহের অফিসে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, দেওয়াল আলমারির পাল্লায় লাগানো আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে খোঁপায় কাঁটা গুঁজছিলেন, মুখে পাউডার মাখছিলেন, এমন সময় হঠাৎ ঠাকুমার ঘর থেকে বাড়ি ফাটানো আর্তনাদ ভেসে এল, “বৌদিইইইইইইইইই, জল বাইরইতাসেএএএএএ...”  

মফস্বল পাড়ায় থাকার অনেক গোলমালের মধ্যে একটা হলো, একবার বৌদি বলে হাঁক পাড়লে চারদিক থেকে বৌদিরা বেরিয়ে আসেন। আমার মা প্রথমটা ভেবেছিলেন, চিৎকারটা অন্য কোনো হতভাগ্য বৌদির উদ্দেশ্যে, ভেবে নিশ্চিন্তমনে মুখে পাফ বোলাচ্ছিলেন। কিন্তু সেকেন্ডখানেক পরেই ঠাকুমার লেটেস্ট আয়া নয়নতারা মাসি হাঁপাতে হাঁপাতে মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ে বলল, “বৌদি আপনি এখানে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে পাউডার মাখতাসেন, মাসিমার তো বিছানা ফ্যাইট্যা সব জল বাইরইয়া গেলো।”

আমার মায়ের ওই মুহূর্তের মুখটা আমি স্পষ্ট কল্পনা করতে পারি। এক হাতে পাউডারের পাফ নিয়ে হাঁ করে মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন আর ভাবছেন, মহিলা কি পাগল? রাখার সময় বুঝিনি তো?

বেরোলো নয়নতারা মাসির মাথা একেবারে টনটনে আছে, আমার ঠাকুমার জলের বিছানা সত্যি সত্যি ফেটে গিয়ে জল বেরোচ্ছে। চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে খুন্তি ফেলে মীরা মাসি দৌড়ে এলো, কুয়োতলা থেকে বাসন ফেলে ভগবতীর মা দৌড়ে এলো, চারজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন, ঠাকুমার কিং সাইজ বিছানার কিং সাইজ জলের তোষকের ভেতর যত জল ছিলো সব ধীরেসুস্থে বেরোচ্ছে, বেরিয়ে ধীরেসুস্থে জলের তোষকের নিচের তুলোর তোষক, জাজিম, বেডকভার ভিজিয়ে, খাটের পায়া বেয়ে নেমে, সারাঘর ভাসিয়ে, চৌকাঠ পেরিয়ে সারাবাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে, আর ঠাকুমা বিজয়গর্বে ক্রমশ পাতলা হতে থাকা তোষকের ওপর শুয়ে শুয়ে ধীরেধীরে নিচের দিকে নেমে আসছেন।

যতক্ষণে ঠাকুমা নেমে তাঁর সাধের সত্যিকারের বিছানায় পৌঁছলেন, ততক্ষণে আমাদের বাড়িতে বান ডেকে গেছে।

তারপর তো ঠাকুমাকে তুলে, গা মুছে, শুকিয়ে, বিছানা বালিশ মাদুর জাজিম বয়ে বয়ে ছাদে শুকোতে দিয়ে, আলমারির তলা, খাটের তলার চালের ড্রাম আর লোহার ট্রাঙ্ক টেনে বার করে জল পরিষ্কার করে, মুছে, নতুন শুকনো বিছানা পেতে আবার ঠাকুমাকে সে বিছানায় সেট করা হলো।

শেষ সপ্তাহেও মায়ের অফিস লেট। আর আমার বাবা ঘুম থেকে উঠে বললেন, “হবেই তো, বাড়িতে সিস্টেম বলে একটা কিছু নেই...”

যাই হোক, এখন বেচারা বাবা সেই ফুটো ম্যাট্রেস ঘাড়ে করে দোকানে দোকানে ঘুরছেন, সারানোর আশায়। ঠাকুমা মহানন্দে তুলোর বিছানায় শুয়ে বিড়বিড় করে অষ্টোত্তরশতনাম গাইছেন। মা একবার কীরকম যেন সন্দেহ হতে বিছানা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছেন, কোথাও কোনো লুকোনো সেফটিপিন ছিলো কিনা। পাননি।   

*****

এই ঘটনাটার সাথে কোনো মিল নেই হয়তো, কিন্তু সেদিন থেকে আমার খালি ঘুরেফিরে একটা জিনিসের কথা মনে আসছে। এমনিতে জিনিসটা কোনো কাজে লাগতো না, কেবল বেড়াতে যাওয়ার সময় আলমারি থেকে বেরোতো, এয়ার পিলো। আপনাদের বাড়িতে ছিলো? জলের ম্যাট্রেসে কী করে আবার জল ঢোকানো হবে সেটা ভাবতে গিয়েই ওটার কথা মনে পড়েছে হয়তো। আমাদের তিনজনের জন্য ছিলো তিনটে বালিশ। বিশ্রী ভুষো রঙের। মুখের কাছে দড়ি দিয়ে কালো ছিপি ঝুলতো। আমার অতি সিস্টেম্যাটিক বাবা প্রত্যেকবার বেড়িয়ে ফেরার পর সেগুলোর ভেতর পাউডার পুরে রাখতেন, যাতে বালিশ ভালো থাকে।    

আমি কিছু ভালোবাসতাম বালিশগুলোকে, বাসরে। লুচি আলুরদম ডিনার সাঙ্গ হলে মা যখন সুটকেস থেকে বালিশ চাদর বার করে বিছানা পাততে লাগতেন, আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশের দখল নিতাম। “আমি ফোলাবো মাআআআআআ।” বলাই বাহুল্য, দুবার বলতে হতো না। ট্রেন ছুটতো, ট্রেনের সাথে সাথে জানালার বাইরে অন্ধকার ছুটতো, আমি প্রাণপণে গাল ফুলিয়ে একের পর এক বালিশ ফুলিয়ে যেতাম। ফুঁ দিতে দিতে পাউডারে আমার ঠোঁট শুকিয়ে সাদা হয়ে যেত, ছোট্ট ফুসফুস খালি হয়ে যেত, তবু আমি থামতাম না। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না বালিশগুলো এমন মোটা হচ্ছে, যে ঘুমের মধ্যে ট্রেন জোরে ঝাঁকুনি দিলে মাথা পিং পং বলের মতো ছিটকে বালিশের বাইরে পড়ে যাবে। 


Comments

  1. মিলেছে! আমারও ওই ডাকব্যাকের বালিশ ফোলানো নিয়ে ভয়ানক উত্সাহ দেখা যেত লুচি আলুরদম খাবার পরেই| আর জানেন তো, ওই বালিশ পুরো ফুলিয়ে ছিপি আটকানোর সময়ে যখন ভুস করে খানিকটা হাওয়া ফাঁক পেয়ে বেরিয়ে যেত, তখন ভয়ানক রাগ ধরত| ছিপিটার গায়ে আবার দু-তিনটে উঁচু মতন... আমার দ্বারা বড়জোর একটা ঢুকত, কাজেই পুরো টাইট করতে বাবার শরনাপন্ন হতেই হত শেষে| বড় হওয়ার পর অবশ্য কোনো কারণে আমরা বালিশ ছাড়াই যাতায়াত করতাম| আজ আপনার গল্পটা শুনে মনে পড়ে গেল|
    ওয়াটার বেড আমি দেখিনি কিন্তু মনে হয় যারা সাইকেলের লিক সারায় তারা সারাতে পারবে| অবশ্য তারা টিউব টা কে হাওয়া ভরে জলে ডুবিয়ে লিক খুঁজে বের করে, গদির ক্ষেত্রে জলে ডোবানোর চেষ্টা করলে যা কান্ড করতে হবে, মনে হবে আপনারা "টাইটানিকের ১০০ বছর" নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছেন|

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে আমারও শেষে বাবার শরণাপন্ন হতে হতো। আর বাবা ছিপির শেষ দুটো ঘাট ঢুকিয়ে এমন একটা ভাব করতেন যেন পুরো কাজটা নিজেই করেছেন। জঘন্য।

      রোগীর বিছানা নিয়ে ওই কালিঝুলি মাখা সাইকেলের দোকানে যাওয়াটা ভালো দেখাবে না বোধহয়। মানে আর কোন অসুবিধে নেই, কাজটাও হবে, কিন্তু পাড়ার লোকে দেখে যদি নিন্দে করে?

      Delete
    2. সাইকেল সারানেওয়ালাকে একটু বেশি পয়সা দিলে বোধহয় বাড়িতে এসে লিক সারিয়ে দিয়ে যাবে| দেখবেন তো?

      Delete
    3. ওকে, বাবাকে বলবো তাহলে।

      Delete
  2. ঘটনাটা মজার হলেও ঠিক খুশি হতে পারলাম না জানো.. কিরম যেন একটা দুঃখ হলো একসময়ের কত কর্মঠ মানুষগুলোর শেষ বয়সে এই পরিনতি ভেবে.. যাকগে, লিখেছ সুন্দর...

    ReplyDelete
  3. ঠিক ই বলেছে সুগত.. আমি আমার মেয়ের ফোল্ডিং বাথ tub টা কিন্তু ওই সাইকেল wala দের থেকেই সারিয়েছিলাম

    ReplyDelete
    Replies
    1. সোহিনী, ঘটনাটা খুবই করুণ সত্যি। কিন্তু এখন এইসব হাসিতামাশা দিয়েই আমরা/আমার বাড়ির লোক কাজ চালাচ্ছি আরকি।

      ওহ, তোমাদের সবার কাজের বুদ্ধি দেখে আমি মুগ্ধ। আমার সাইকেলওয়ালাদের কথাটা মাথাতেই আসতো না।

      Delete
    2. balish gulo folate gele ekta gondho beroto...jeta kharap ei platform e bola jachhe na...karon opore oneker ii bepar ta bhalo lagto bole mone hochhe..

      Delete
    3. হাহা রু, তুমি বললে বলে গন্ধটা মনে পড়ল। সত্যি কথা আমার খারাপ লাগত না, কিন্তু কারো যে খারাপ লাগতে পারে সেটা এখন বুঝতে পারছি। ভালোই করেছ বিশদে না বলে।

      Delete
  4. Uff haste haste amar pet byatha hoye gelo! Airpillow gulo jemon chhipi ta hathat khule gele bhus kore anekta hawa berie tarporeo phus phus kore ektu ektu berote thakena, serakom hese jachhi!

    Oh, amake tumi cheno na (tumi-i bolchhi karon bayes-e chhoto boi baro hobe na). Ami Ruchira, facebook-e keu ekta tomar ekkhana blog-er link diechhilo, seta porar por theke kaj kammo shikey tule baki gulo porei cholechhi, porei cholechhi!

    ReplyDelete
    Replies
    1. রুচিরা, পেটব্যথাই যদি হতে হয় তাহলে হেসে হওয়াই ভাল, একাই একবয়াম চানাচুর খেয়ে ফেলে হওয়ার থেকে। কিন্তু ইয়ার্কি অ্যাপার্ট, তোমার (আমিও তুমির স্বাধীনতা নিচ্ছি) অবান্তর ভালো লেগেছে জেনে যারপরনাই খুশি হয়েছি। আশা করি এই ভালোলাগা দীর্ঘজীবী হবে। মন্তব্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete
  5. Kuntala, na na ami kakkhono eka ek boyam chanachur khaini. Tobe ek packet badam bhaja kheye phele du char bar... ta se jak, abantor pore bolte ichhe korchhe, apnake to cultivate korte hochhe mashai! baree ese amar maa keo abantor poralam khanikta. maayer-o khub bhalo legechhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ রুচিরা, তার মানে তুমি আমার মায়ের দলে। মাও সবকিছুর লোভ সামলাতে পারে, ওই এক বাদামভাজা ছাড়া। মা আবার চানাচুরের শিশি থেকেও বাদাম বেছে বেছে খেয়ে শেষ করে রাখে। কাকিমার অবান্তর ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম।

      Delete

Post a Comment