পিকাসোর পাড়ায়




আমার চরিত্রের একটা বড় দোষ হচ্ছে, অত্যন্ত দ্রুত মুগ্ধ হয়ে পড়া। বই, জায়গা, মানুষ, সবকিছুতেই। দশ পাতা পড়েই ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দিই, এইটাই হচ্ছে আমার সারাজীবনে পড়া সেরা বই। দশ মিনিট কথা বলেই ধরে নিই লোকটা “জানে”। মনে মনে শিষ্যত্ব গ্রহণে আর এক মিনিটও দেরি করি না।

কিন্তু তার থেকেও বড় দোষ আমার একটা আছে, সেটা হচ্ছে মুগ্ধতা কেটে যাওয়ার দোষ। যে জিনিয়াসের প্রেমে যত জোরে পড়ি, তার ওপর থেকে ভক্তিও তত দ্রুত চটে। যখন ইমপ্রেসড্‌ হচ্ছিলাম, তখন হুড়োতাড়ার চোটে একটি খুঁতও নজর করতে পারিনি, একে একে সেগুলো চোখে পড়তে শুরু করে। নিতান্ত ছোটখাটো খুঁত, কিন্তু আমার সদ্য ঘোরকাটা চোখে সেগুলোই প্রকাণ্ড হয়ে ধরা দেয়। এও যে আমারই মতো নশ্বর, সেটা আবিষ্কার করে মুহ্যমান হয়ে পড়ি। মুহ্যমানতা ক্রমশ কেটে গিয়ে তার জায়গায় রাগ বাসা বাঁধে। বোকা বনে যাওয়ার রাগ। ঠকে যাওয়ার জ্বলুনি।

হিপস্টার ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা, ওপরে যা বললাম, অবিকল তাই। জীবনের একটা সময় উলোঝুলো ভবঘুরে গিটার ঘাড়ে ঘোরা লোকজনের হাতে এমন বশ হয়েছিলাম, যে এখন সে কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। ঘোর কেটে গেছে বহুদিন হল, কিন্তু বুকের ভেতর বিরাগটা রয়ে গেছে। হিপস্টার এবং হিপস্টারঘটিত সমস্ত জিনিসের প্রতি। গিটার, নোংরা জিন্‌স্‌, জাংক জুয়েলারি, লংস্কার্ট...

মনের কোণের সেই সুপ্ত বিরাগ ছাড়া Montmartre দেখতে যাওয়াটা একটা না একটা ছুতো করে ক্রমাগত পিছোনোর আর কোনো কারণই তো দেখি না। হাজার হোক, প্যারিসের সমস্ত টু-ডু জায়গার মধ্যে ওটাই আমার বাড়ির সবথেকে কাছে। হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট, মেট্রোয় চাপলে পাঁচ। খরচ করতে করতে শেষে অজুহাতের ভাঁড়ারে যখন টান পড়ে গেল, তখন ঠিক করলাম শুক্রবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে টুক করে ঘুরে আসব। Montmartre-এর পেছনে গোটা শনিরবি ইনভেস্ট করার কোনও মানে হয় না। ওগুলো তোলা থাক গ্র্যান্ড জিনিসপত্রের জন্য। মোনালিসা, সেন্ট মাইকেল, ল্যাটিন কোয়ার্টার।


Montmartre হচ্ছে প্যারিসের হিপস্টার প্যারাডাইস। শহরের যত কবি, আঁকিয়ে, ভবঘুরে, স্নান না করা লোক, সব গিয়ে জুটেছে Montmartre-এর অলিগলির ভেতরAnvers  মেট্রোস্টেশন থেকে বেরোলেই সেটা টের পাওয়া যায়। বাকি শহরটার স্কাইলাইন জুড়ে যখন অনবদ্য কারুকার্য করা মার্বেলরঙা রেলিং-এর ছড়াছড়ি, Montmartre-এর গলির ঠিক মুখটায় তখন কালি পড়া, তেল গড়ানো, শ্যাওলা ধরা একখানা পোড়ো বাড়ি বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সাবধান করে দিচ্ছে, সুসজ্জিত পার্ক আর ঝকঝকে ফুটপাথের খোঁজে যারা এসেছ এখানে, এই বেলা মানে মানে ফিরে যাও। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু যারা জানে তারা জানে, এই বাড়িটাই হচ্ছে এককালের L'Élysée Montmartre। আঠেরোশো সাত সালে যখন শহরের অর্ধেক বাড়ির---অনবদ্য কারুকার্য করা মার্বেলরঙা রেলিং-এর মুকুট মাথায় পরে যাদের দেমাকের চোটে ফুটপাথে পা পড়ছে না---চিহ্নমাত্র ছিল না, তখন এই বাড়িতে নিয়মিত জলসা বসত। প্রতি সন্ধ্যেয় সূর্য ডোবার পর, ধবধবে সাদা ওয়েস্টকোটের ওপর ভেলভেটের কোট চাপানো ভদ্রমহোদয়েরা একহাতে ছড়ি আরেকহাতে নারী নিয়ে দলে দলে গান শুনতে আসতেন এই বাড়িতেই।


পোড়োবাড়ির চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করে আমি এগিয়ে চললাম। পাথরে বাঁধানো গলির দু’ধারে অগুন্তি সুভেনির শপ। বুকের ওপর চুমকি বসিয়ে “আই লাভ প্যারিস” লেখা টিশার্ট, আইফেল টাওয়ার আঁকা টুপি, মোনালিসার মুখ আঁকা ঘড়ির ডায়াল। একমানুষ উঁচু অক্ষরে নাম লেখা কাপড়ের দোকানের সামনের ফুটপাথে ডাঁই করা জামাপ্যান্টের ঢিবি হাঁটকাচ্ছে উবু হওয়া লোকজন। বড়বড় ব্র্যান্ডেড দোকানের ট্রাক এসে রোজ দুবেলা ট্রাকে করে রিজেক্ট হওয়া জামাকাপড় এখানে ফেলে দিয়ে যায় নাকি।  

আর আছে খাবারের দোকান। দোকান মানে স্টল। মেরেকেটে দু-ফুট বাই দু-ফুট। সেই ঘুপচি ঘরের ভেতর থেকে মিনিটে মিনিটে কাগজের প্লেটে করে বেরিয়ে আসছে “অথেনটিক” ফ্রেঞ্চ ক্রেপ, অ্যামেরিকান হট ডগ, ইট্যালিয়ান পাস্তা, লেবানিজ ফালাফেল।

Montmartre-এর গলির গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া যেমন সোজা, আবার তেমন শক্তও। শক্ত বলছি এই জন্য যে জায়গাটা বেসিক্যালি একটা ছোট্ট পাহাড়। মাউন্টেন অফ দ্য মারটিয়ারস্‌। আর সে পাহাড়ের ঠিক চুড়োয় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে ব্যাসিলিকা অফ দ্য সেক্রেড হার্ট, Sacré-Cœur তার ধবধবে সাদা রঙের চুড়ো আমার মেট্রোস্টেশন থেকে পর্যন্ত দেখা যায়। Montmartre-এর যত কিলবিলে গলি, সবের টিকি বাঁধা আছে ওই ব্যাসিলিকার পায়ের কাছে। অন্ধের মতো ঢাল ধরে উঠে গেলেই হল।

ব্যাসিলিকায় পৌঁছতে হলে অবশ্য খানিক সিঁড়ি ভাঙার ব্যাপার আছে। ভগবানের এক্কেবারে পায়ের কাছে যাব, আবার কষ্টও করব না, তা বললে তো চলবে না। তবে শর্টকাটের ব্যবস্থা আছে, funicular বলে একরকম হাফ লিফট-হাফ ট্রেন, সেটা নিয়মিত ওপরনিচ করে লোকজনকে ব্যাসিলিকায় পৌঁছে দেয় আর ফেরত নিয়ে আসে। কিন্তু আমি সিঁড়ি ভাঙাই ঠিক করলাম। তার একটা কারণ চক্ষুলজ্জা, প’নে তেত্রিশ বছর বয়সে যদি ট্রেনে চেপে পুঁচকে পাহাড়ে উঠতে হয় তাহলে আর কিছু বলার নেই। আর অন্য কারণটা হচ্ছে সিঁড়িটা বড্ড সুন্দর। বাহারি ল্যাম্পপোস্ট আর গাছের ছায়ার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গেছে।


আমি বড় দেখে একটা দম নিয়ে চড়তে শুরু করলাম। আশপাশ থেকে কেউ কেউ কনুই ধরে টানল, “লেডি, আই গিভ ইউ দিস্‌” ইত্যাদি বলে আমাকে হার-দুল ইত্যাদি গছানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আমি বিচলিত হলাম না। দু’পাশ থেকে টুকটাক চেনাশোনা সংলাপ ভেসে আসছিল। “শনিবারের কাজটা ছাইর‍্যা দিসি। মোটে ছয় টাকা দ্যায়, লাভ নাই।”


অবশেষে ব্যাসিলিকায় পৌঁছলাম। এহ্‌ক্যুল পোয়াহো-র মতে “ইইত্‌ ইইস্‌ লাইক অ্যান এনরমাস্ বার্থদে কেক, ইইস্‌ ইইত্‌ নত?” (1:10-1:15) এর থেকে নির্ভুল বর্ণনা Sacré-Cœur-এর আর কেউ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বার্থডে কেকই হোক আর যাই হোক, জিনিসটা যে দেখার মতো সে নিয়ে তর্ক চলে না। প্যারিসে যাঁরা যাবেন তাঁদের সকলকে আমার উপদেশ, Montmartre-এ যান, হেঁটে হোক ট্রেনে চেপে হোক পাহাড়ে চড়ুন, ব্যাসিলিকা মন ভরে দেখুন, প্রাণ ভরে ছবি তুলুন।

এবার একবার পেছন ফিরে তাকান।


লে পাহি। আদিগন্ত ছুঁয়ে শুয়ে আছে। তার সমস্ত ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য, উন্নাসিকতা নিয়ে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে শহরটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকুন। ভাবুন, কী আছে এই সারিসারি বাড়িঘরদোর অট্টালিকা গাছপালা সবুজ পার্ক গাছপালা ঘাম ভিড় ওপচানো ডাস্টবিনের মধ্যে, যা অন্যদের নেই? একবার দেখে মন না ভরলে বারবার দেখুন। ফিরে ফিরে দেখুন। রোদঝলমলে দুপুরে দেখুন, কুয়াশাভেজা সকালে দেখুন, গোধূলির আলোয় দেখুন। একটা জিনিস জেনে রাখুন, সে আইফেল টাওয়ারের টং-ই হোক কিংবা অ্যান্থনি বোর্ডেন, প্যারিসকে এইভাবে আর কেউ দেখাতে পারবে না। Montmartre যেমন করে পারে

সে তো পারবেই। কারণ Montmartre-এর চোখ যে শিল্পীর চোখ। দালি থেকে শুরু করে পিকাসো থেকে শুরু করে রেনোয়াঁ থেকে শুরু করে ভ্যান গঘ থেকে শুরু করে, সব্বাই এই Montmartre-এর অলিতেগলিতে ঘুরেছেন, ছবি এঁকেছেন, স্ট্রাগল করেছেন। এই গলি থেকে পাঁচমিনিট হেঁটে গেলেই যে দুনিয়াটা---যেখানে বড় বাড়ি, চকচকে গাড়ি আর ঝকঝকে পোশাকের পেছনে জিভ বার করে ছুটছে সাকসেসফুল মানুষজন, সেই দুনিয়াটাকে কোন্‌ মন্ত্রবলে তাঁরা মগজের বাইরে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন সে তাঁরাই জানেন।


ব্যাসিলিকা থেকে নেমে এসে গলি ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। Montmartre-এর কোণে কোণে আলো জ্বলে গেছে ততক্ষণে। এই একটা গলির মুখে ট্যুরিস্ট গিজগিজে খাবার দোকান, তো ওই গলিটাই আবছা অন্ধকারে ঢাকা। নোংরা জিনস্‌ পরা, গিটার হাতে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে খালি। এই অলিগলির ভেতর কোনও একটা ক্যাফেতেই আমেলি কাজ করত না? এখানের কোনও একটা মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি শস্যের বস্তায় হাত ঢুকিয়ে দিত?


হাঁটতে হাঁটতে মায়াটা আবার টের পাচ্ছিলাম বুকের ভেতর। হিপস্টারদের আর কিছু না থাকুক, চার্মের অভাব নেই। নোংরা চুলের বোঝা ঝাঁকিয়ে কপাল থেকে সরিয়ে এমন হাসবে যে বুকের ভেতর শক্ত করে আঁটা কবচকুণ্ডল টপাটপ খসে পড়ে যাবেMontmartre-এর খাঁজেভাঁজে সে চার্মের চাষ হয়। উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে জুতোর ভেতর বুড়ো আঙুলের কোণা টনটন করে, তবু মনে হয়, ইস্‌ ওই গলিটার ভেতর কী আছে তো দেখাই হল না। লোভ লাগে, মোনালিসা কাটিয়ে দিয়ে কাল আবার আসব নাকি এদিকে একবার? দিনের আলোয় কেমন দেখতে লাগে একবার দেখে যাব?

এ লক্ষণ আমার বিলক্ষণ চেনা আছে। লাফ মেরে গলির বাইরে বেরিয়ে এলাম। গলির বাইরে ঝলমলে, ঝকঝকে, প্র্যাকটিক্যাল প্যারিস আমার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করেই ছিল। বেরোনো মাত্র টপ্‌ করে গিলে নিল। মেট্রোর ভিড়ে ব্যালেন্স করতে করতে, সুপারমার্কেটে ফ্যাট ফ্রি দুধের বোতল আর পাতিলেবু কিনতে কিনতে Montmartre-এ ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা কখন যে উবে গেল সেটা টেরই পেলাম না। খালি মনে রইল, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোনালিসা। উত্তেজনায় আজ রাতে ঘুম আসলে হয়।

          

Comments

  1. Tarpor? Tarpor? TARPOR?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা, তারপর ক্রমশ প্রকাশ্য বিম্ববতী।

      Delete
  2. "প্যারিসে যাঁরা যাবেন তাঁদের সকলকে আমার উপদেশ, Montmartre-এ যান, হেঁটে হোক ট্রেনে চেপে হোক পাহাড়ে চড়ুন, ব্যাসিলিকা মন ভরে দেখুন, প্রাণ ভরে ছবি তুলুন।

    এবার একবার পেছন ফিরে তাকান।"
    সত্যি বলতে কি আমার ঝটিকা সফরে ওইটাই খুব ভাল লেগেছিল। একেবারে ঠিক বলেছ।
    বেশ কিছুদিন পর অবান্তরে এলাম ।এখনো কিছু পড়া বাকি আছে।
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. কিছু তাড়া নেই মিঠু। ধীরেসুস্থে পড়লেও হবে।

      Delete
  3. lekhata khub bhalo laglo pore :) hipsterder charmer byaperta ekdom lagsoi

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ তিন্নি।

      Delete
  4. এরকম কান্ড কেউ করে? আপনার ব্লগে এহ্ক্যুল পোয়াহোর লিংক দিয়েছেন, আরেকটু হলেই ব্লগ পড়া ছেড়ে আরেকবার ডেথ ইন দ্য ক্লাউডস দেখতে বসে যাচ্ছিলাম! বাই দ্য ওয়ে, আর্ট ভালো লাগলেও আমার হিপষ্টারদের প্রতি কোনও আকর্ষণ কোনদিন ছিলনা। নাকি এটা শুধু মেয়েদের থাকে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধুর কী যে বলেন। এত কাজল, আর জাঙ্ক জুয়েলারি আর লং স্কার্ট বিক্রি হত নাকি তাহলে বাজারে? হিপস্টার মেয়ে ছাড়া আর কোনওরকম মেয়ে সইতে পারে না, এমন ছেলে আমি হুদ্দুহুদ্দু দেখেছি। পুরোটাই পার্সোন্যাল পছন্দ।

      Delete

Post a Comment