ভাবি এক, হয় আরেক



ঠিক করে রেখেছিলাম Rue de Cambon-এর গলি থেকে Pierre Herme-এর জগৎবিখ্যাত ম্যাকারন কুকি কিনে গলি পেরিয়ে Tuilleries-এর বাগানে ঢুকে লেকের পাশে বেঞ্চিতে বসে বসে খাব। খেতে খেতে দেড়শো বছরের পুরনো লেকের ধারে কে জানে কত বছরের পুরনো মূর্তির মাথায় মাথায় পায়রাদের ওড়াউড়ি দেখব। সেন নদীর জলে লাল আগুন লাগিয়ে লাগিয়ে le soleil দিগন্তজোড়া প্রাসাদের রেলিং-এর ওপারে টুকুস করে লুকিয়ে পড়বেন, Pont Neuf-এর মাথায় বসে সেই দেখে আমার প্যারিসবাসের গ্র্যান্ড সমাপ্তি ঘটাব---এমন সব রোম্যান্টিক আইডিয়া ছিল মনে।

বদলে একগাদা আনরোম্যান্টিক বিষয়ে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে শেষ দুটো দিন কাটল। পেপার জমা দেওয়া, ইন্টারনেটের কানেকশন নিয়ে ঝামেলা, ঘং-ঘং কাশি, বাড়তি জিনিসপত্র পার্সেল করে ভারতে পাঠানো ইত্যাদি সামলাতে সামলাতেই শেষ বাহাত্তর ঘণ্টা এমন হুস্‌ করে কেটে গেল যে বেড়াতে বেরনোর কথা ভাবারই সময় হল না।

তবে এরই মধ্যে একদিন অফিসফেরতা বাজার করতে গিয়েছিলাম। দেশের লোকের জন্য বাজার করা সোজা, একবাক্স চকোলেট কিনে নিলেই খেল খতম, বিদেশের বন্ধুদের জন্য গিফ্‌ট্‌ কেনার ব্যাপারটা আরেকটু ঘোরালো। আমার সংসারী এবং বিচক্ষণ বন্ধুরা যে যার দেশ থেকে এথনিক জিনিসপত্র সুটকেস বোঝাই করে নিয়ে এসেছিল। ইয়াও শোয়াই এনেছিল ছোট্ট কিউট হলুদ প্যাকেটে করে গ্রিন টি, ক্যামিলা এনেছিল ব্রাজিলের ফ্ল্যাগ আঁকা দেওয়ালশোভা, ইন্দোনেশিয়া থেকে আনিন্দি এনেছিল কাঠের খুদে হাতি। এর বদলে আমি যদি ফ্রেঞ্চ চকোলেট নিয়ে গিয়ে দায় সারি তাহলে আমার ইন্ডিয়ান নামে চুনকালি।

কাজেই মাসখানেক আগে একদিন Le Marais-এর গলিঘুঁজি এক্সপ্লোর করতে করতে দোকানটার খোঁজ পেয়ে আনন্দে ডিগবাজি খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। ছোট্ট দোকান। আকাশী বোর্ডে সাদা কল্কা দিয়ে লেখা নাম “দিওয়ালি”। কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকালে রঙের ছটায় চোখ ঝলসে যায়। প্যারিসের যত চুমকি, জরি আর আয়না সব এসে যেন জুটেছে ওই দোকানের ভেতর। মাথার ভেতর দোকানের লোকেশন টুকে রেখেছিলাম, বুধবার সন্ধ্যেবেলা সেখানে গিয়ে মানিব্যাগের ভার খানিক লাঘব করে এসেছি।

শুধু আমি না, প্যারিসের বাকি সব লোকেও এখন তেড়েফুঁড়ে শপিং করছে। সান্তাক্লজ সাজা লোক এখনও রাস্তায় দেখিনি বটে, কিন্তু দোকানের ভেতরে বাইরে ঝুপোঝুপো গাছের গায়ে রংবেরঙের টুনি অলরেডি জ্বলছে নিভছে। আমাদের অফিসের বারান্দাতেও রেখেছে একটা আলোজ্বলা গাছ। দিওয়ালি থেকে বেরিয়ে নন-এথনিক উপহার কেনার জন্য সেই সাততলা দোকানটায় ঢুকেছিলাম। বুধবারেই যদি ভিড়ের নমুনা ওইরকম হয় তাহলে শনিরবির কথা ভেবে আমার হৃৎকম্প হচ্ছিল। কাউন্টারের সামনে অজগরের মতো লম্বা লাইন। আমার সামনে এক ঠাকুমা দশটা খেলনা ঘোড়া, দশটা ডলপুতুল, দশটা কালারিং বুক আর দশটা রংপেনসিলের বাক্স কিনলেন। বুঝলাম আর যারই থাকুক না কেন, মা ষষ্ঠীর কৃপার অভাব নেই ঠাকুমার সংসারে।

ব্যস্, আমার প্যারিস-পর্বের এইখানেই ইতি। লাস্ট এপিসোডে গ্র্যান্ড কিছু করতে পারলাম না বলে যে সামান্য খোঁচাটা রয়ে গেল মনের ভেতর সেইটা এই ভেবে ভোলার চেষ্টা করছি যে আজ থেকে অনেকদিন বাদে প্যারিস বললেই যে ঘটনাগুলো মাথায় ভেসে উঠবে, সেগুলো খুব সম্ভবত একটাও গ্র্যান্ড হবে না। স্মৃতির সঙ্গে ঘর তো কম দিন করা হল না, এতদিনে তার চালচলন খানিকটা বোধগম্য হয়েছে। Miromesnil  স্টেশনে নেমে মেট্রো বদল করতে হত আমায়, প্রতিদিন দ্বিতীয় এসক্যালেটরটায় চাপার আগে সেই গন্ধটা নাকে আসত। অনেক মাখন, চড়া আভেনে অনেকক্ষণ ধরে বেক করলে যে গন্ধটা বেরবে ঠিক সেই গন্ধ। পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে আবার হইহই করে ক্ষিদে পেয়ে যাওয়া গন্ধ। অথচ ধারেকাছে একটাও বেকারি নজরে পড়েনি কোনওদিন। খোঁয়াসঁর প্যাকেট হাতে চলাফেরা করা লোকজনও দেখিনি। ফার্স্টক্লাস রহস্যগল্পের ক্লু হয়ে উঠতে পারার মতোই ঘটনা কি না বলুন? রোজই গন্ধ পেতাম, রোজই ভাবতাম গন্ধের উৎস সন্ধানে যাব, কিন্তু যাওয়ার আর সময় নেই। আমি নিশ্চিত যেখানেই থাকি না কেন, প্যারিস বললে ওই গন্ধটা আমার নাকে আসবে।

প্যারিস বললেই মেট্রোর কথা মনে পড়বে আমার। মেট্রোর দরজার ওপরে মরা গাছের মতো ডালপালা মেলা রেললাইনের ম্যাপ, ডালে ডালে স্টেশনের নাম মার্ক করা। অফিসটাইমের ভিড়ের মাথা ডিঙিয়ে সে নাম পড়তে পারা ভগবানের দেখা পাওয়ার মতোই শক্ত ব্যাপার, তাই বেঁটে লোকদের সুবিধার্থে ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগে এক দয়ালু মহিলা স্টেশনের নাম বলে দেন। মুশকিলটা হচ্ছে ফ্রেঞ্চ-না-জানা বেঁটে লোকদের তাতে সুবিধে কিছু হয় না, কারণ ফ্রেঞ্চ শব্দের লিখিত এবং বলিত রূপের মধ্যে লতায়পাতায় আত্মীয়তাও নেই। উইকএন্ডে ফাঁকা মেট্রোয় আমার ফেভারিট টাইমপাস ছিল স্টেশনের নাম দেখে তার উচ্চারণ গেস করার চেষ্টা করা। এইবার মহিলা ‘t’ উচ্চারণ করবেন না, এইবার ‘ll’-এর ঘাড়ে কোপ পড়বে।

আর মনে পড়বে আমার বাড়ির পাশের মিউনিসিপ্যালিটি স্কুলটার কথা। স্কুল তো একটা ইটকাঠকংক্রিটের জড়ভরত বস্তু, তার কথা মনে রাখার তো কিছু নেই, স্কুল বলতে আমি বলছি স্কুলের পড়ুয়াদের কথা। সাইজে তারা আমার হাঁটু থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত, কিন্তু ওইটুকু শরীরে যে ওই পরিমাণ শব্দ সৃষ্টির ক্ষমতা লুকিয়ে থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ছুটছে, লাফাচ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে, পড়ছে, আবার উঠে ডিগবাজি খাচ্ছে। বন্ধুকে এমন চেঁচিয়ে ডাকছে যেন বন্ধু এক হাত দূরে নয়, সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের বাড়ি থেকে এখনও নিতে লোক আসেনি, সে করুণ মুখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের বাবা সময়মতো এসে গেছেন, সে বাবার হাত ধরে প্রসন্নমুখে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে, তার হাঁটার নিয়মটা হচ্ছে ফুটপাথের ওপর ঝরে পড়া শুকনো পাতার ওপরেই পা ফেলা যাবে শুধু। পাতার বাইরে কংক্রিটে পা পড়লেই আউট। আর এ সব ঝামেলার মধ্যে একজন স্কুলের সিঁড়িতে বসে লিখছে। ঝুঁটিবাঁধা মাথা ঝুঁকে পড়েছে খাতার ওপর। স্লো বাট স্টেডি পেনসিল এগিয়ে চলেছে রুলটানা পাতা ধরে। মনঃসংযোগের বহর দেখেই বোঝা যাচ্ছে হোমওয়ার্ক নয়, ডায়েরি লেখা হচ্ছে। সারাদিনের ঘটনাবলী, সুখদুঃখ, অন্যায়অবিচার---সব পুঙ্খানুপুঙ্খ বন্দী হচ্ছে ডায়েরির জেলখানায়। এই ডায়েরি লুকিয়ে রাখার জন্য কত পরিশ্রম যে করতে হবে মেয়েটিকে। তাও কি পারা যাবে? ব্যাগ গুছোতে গিয়ে মা ঠিক দেখে ফেলবেন, পড়ে হো হো করে হেসেও উঠবেন। সে হাসি মেয়েটির কানে ঠিক কংসমামার হাসির মতোই বাজবে। চোখের জল প্রাণপণে চাপতে চাপতে মেয়েটি ভাববে, এর পরেও কি মায়ের সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বলা যায়, না বলা উচিত?

হাজার প্রাসাদ, হাজার মিউজিয়াম, হাজার মোনালিসা ছাপিয়ে, প্যারিস বললেই আমার ওই ছোট্ট মেয়েটার কথা মনে পড়বে। যেখানেই থাকি না কেন, যত দূরেই থাকি না কেন।

  

Comments

  1. একটা জায়গায় ঝুলি খুলে বসলে সেগুলো সামলে সুমলে আবার রওনা হওয়া বেশ বড়-সড় ঝামেলার ব্যাপার, সেটা ঠিকই। কিন্তু এত ঝামেলা ঘাড়ে নিয়েও নিয়মিত অবান্তরের জন্য লেখার জোগান দেওয়া? জিও কুন্তলা, যুগ যুগ জিও।

    ReplyDelete
    Replies
    1. না লিখলে আপনারা থোড়াই আমার সঙ্গে কথা বলতেন মালবিকা? আপনাদের মনোযোগ টেনে রাখার জন্য নিয়ম করে বাজে বকি। ওতে আমার কৃতিত্ব কিছু নেই।

      Delete
  2. Ashchorjo bhalo likhechhen. Bhaloi awboshyo lekhen, eta ektu beshi bhalo hoyechhe. Bhalo croissant er mawtoi bhalo onubhuti holo lekhata porre.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধন্যবাদ ধন্যবাদ। ভালো খোঁয়াসঁর সঙ্গে আমার লেখার তুলনা করে আমাকে একেবারে সপ্তম স্বর্গে পৌঁছে দিলেন। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. সত্যি, আপনার চোখেও পড়ে, আর মাথাতেও আসে। খুব ভাল হয়েছে লেখাটা। আপনার লেখা পড়ে বাবার তোলা একটা ছবি মনে পড়ে গেল - এইরকম বড়দিনের আগে তোলা, Arc de triomphe এর সামনের রাস্তার ছবি, দুদিকের গাছগুলোয় মশারির মতন জাল দিয়ে আলো লাগিয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখেছেন, রাস্তাটার কথা মনে পড়ে আবার দুঃখ দুঃখ হচ্ছে। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ সুগত।

      Delete
  4. খুব ভালো হয়েছে লেখাটা , ছোট্ট মেয়েটির কথা তোমার জন্যে আমরাও হয়ত মনে রেখে দেব। :-) এইবারই কি দেশে ফেরা?

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রায় মেরে এনেছি ইচ্ছাডানা, আর পনেরো দিন। তারপরই "বাড়ি বাড়ি!" বলে হাল্লার ভালো রাজার মতো ছুট লাগাব।

      Delete
  5. Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ তিন্নি।

      Delete

Post a Comment