হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে



এক শহরে বেশিদিন থাকার একটা অসুবিধে হচ্ছে যে চেনা লোকের সংখ্যা বাড়ে। দিল্লিতেও তাই হয়েছে। অবশ্য নতুন চেনা যত না তার থেকে বেশি পুরোনো চেনা। দশবারো বছর আগের। তবে সুবিধেটা হচ্ছে যে এদের বেশিরভাগের সঙ্গেই আমার পথেঘাটে, চরম ব্যস্ততার মধ্যে দেখা হয় এবং “কেমন আছিস, বাড়ির লোক কেমন আছে” ইত্যাদি সেরে আবার যে যার নিজের কাজে চলে যাওয়া যায়।

কিন্তু কেউ কেউ থাকে যাদের এটুকুতে মন ভরে না। তারা দাবি করে বারো বছরের বন্ধুত্বের জন্য বারো সেকেন্ড যথেষ্ট নয়, অন্তত একটা গোটা সন্ধ্যে তার পাওয়াই উচিত। হলুদ আলো জ্বালিয়ে, ঘর ধোঁয়ায় ভরে, গিটার বাজিয়ে, গলা ফাটিয়ে। ঠিক সেই যেমন হত।

শুনতে ভালো লাগছে তো? স্বাভাবিক। যে কোনও ফাঁদই দেখতেশুনতে ভালো হয়। বেশিরভাগ সময়েই আমার সৎবুদ্ধি কাজ করে, আমি ভয়ানক ব্যস্ততার ভান দেখিয়ে এইসব ফাঁদ এড়িয়ে নিজের বাড়িতে বসে টিভি দেখি। মাঝেসাঝে বদবুদ্ধি জেগে উঠে আমাকে নানারকম পরামর্শ দেয়। হাজার হোক মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। হাজার হোক পুরোনো বন্ধু। হাজার হোক প্রবাসে ডাকখোঁজের লোক। তাছাড়া গেলে হয়তো ভালোই লাগবে। মাঝে মাঝে এইসব কুপরামর্শ মনেও ধরে। আমি গাত্রোত্থান করে সেধে সেধে ফাঁদে পা দিতে চলি।

জুতো খুলে দরজার ভেতর পা দিয়ে খানিকক্ষণ চোখ সইতে যা দেরি অবশ্য। হলদে, ঘন ধোঁয়ার সমুদ্র ভেদ করে ঘরের আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, বালিশতাকিয়া অ্যাশট্রে, চায়ের কাপ, খবরের কাগজ, কাগজের আড়ালে চেনাঅচেনা মুখ চোখে পড়ে। আর তারপরেই আঁতকে উঠি। ঘরের ঠিক মাঝখানে তাকিয়া বগলদাবা করে অনন্তশয্যার ভঙ্গিতে শুয়ে আছে একটা হাতি।

হাতি মানে কি আর সত্যি সত্যি হাতি? হাতিসুলভ একজন মানুষ। হাতির কথা কিন্ত এখানে আমি আকারআয়তনের অর্থে তুলছি না। এমনকি ইংরিজি ভাষায় এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম সংক্রান্ত যে প্রবাদটি আছে, তেমন কোনও অনুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথাও বোঝাতে চাইছি না। এক্ষেত্রে হাতির কথা তোলার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষটির হাতিসুলভ স্মৃতিশক্তির কথা বোঝানো। ছোটবেলায় মায়ের কাছে হাতির অসাধারণ স্মৃতিশক্তির একটা গল্প শুনেছিলাম। শহরের রাস্তা দিয়ে হাতি হেলেদুলে চলেছে, পিঠে অঙ্কুশ হাতে বসে আছে মাহুত। চলতে চলতে মাহুতের হঠাৎ খিদে পেল। তার কোঁচড়ে একখানা নারকেল বাঁধা ছিল। সে সেই নারকেলখানা হাতির মাথায় ফাটিয়ে আরাম করে খেল।

আমরা হলে ওখানেই মারা পড়তাম, কিন্তু হাতির মাথার ব্যাপারই আলাদা। হাতির মাথা শুধু দেখতেই বাহারি নয়, সেই মাথার ভেতর রয়েছে প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের মগজ। বাংলায় যাকে ব্রেন বলে। সেই ব্রেনের ভেতরের স্নায়ুতন্ত্রের জটিল কারুকার্যও নাকি দেখার মতো। হাতি ব্যথা পেলেও টসকাল না। ঘটনাটা মনে রেখে দিল।

অনেকদিন পর আবার সেই একই হাতি, একই মাহুত। এবার মাহুত এসেছে তার হাতিকে নিয়ে মন্দিরের সামনে খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার করতে। নানারকম খেলার পর নারকেল ভাঙার খেলা। হাতি শুঁড়ে করে নারকেল তুলে নিয়ে, ফাটিয়ে, দেবতাকে উৎসর্গ করবে। রুদ্ধশ্বাস জনতার সামনে হাতি শুঁড় বাড়িয়ে নারকেল তুলে নিল, কিন্তু মন্দিরের চাতালের বদলে সেটা ফাটাল মাহুতের মাথায়।

আমার পরিচিত আড্ডার মধ্যমণি হাতির স্মৃতিশক্তিটিও দেখার মতো। আজ থেকে বারো বছর আগে কে কী বলেছিল, কে কী করেছিল, মাঝরাত্তিরে সরস্বতীপুজোর প্যান্ডেল সাজাতে সাজাতে কে কার দিকে কেমন করে তাকিয়েছিল – সব তিনি অক্ষরে অক্ষরে মনে করে রেখে দিয়েছেন। এখনও আড্ডায় আড্ডায় ঘুরে সেই সব নস্ট্যালজিয়ার নারকেল লোকজনের মাথায় ফাটিয়ে বেড়ান।

আমার অবশ্য এদিক দিয়ে সুবিধে আছে। আজ থেকে বারো বছর আগে আমার আত্মবিশ্বাস আরও অন্তত বারোগুণ কম ছিল, যত্রতত্র মুখ খোলার আগে আমি আরও অন্তত বারোবার ভেবে দেখতাম। অর্থপূর্ণ তাকানো তো ছেড়েই দিলাম।

কিন্তু তা বলে কি আমার নেমেসিস নেই? আড্ডার আঁচ যেই একটু নিবুনিবু হয়, গৃহস্বামী চায়ের বন্দোবস্ত করতে ওঠেন, দুয়েকজন বুককেস থেকে বই নামিয়ে পাতা ওলটায়, অমনি হাতির দৃষ্টি আমার দিকে ফেরে।

“অ্যাই তো কুন্তলা, একটা গান গা দেখি . . . সেই যে . . .  ওই যে . . . যে গানটা ধাবায় বসে খুব গাইতিস . . .”

আমি প্রাণপণে ভগবানের নাম করি। কিন্তু ভগবানের স্মৃতিও হাতির মতো, আগের সপ্তাহেই সারিস্কার জঙ্গলের মন্দিরে যাওয়া না-যাওয়ার ভোটাভুটির সময় নিজেকে অ্যাগনস্টিক বলে চালিয়েছিলাম, সে কথা মনে করে রেখেছেন। “এখন কেন?” বলে ভেংচি কেটে উল্টোদিকে তাকিয়ে থাকেন। নারকেল সজোরে আমার মাথায় নেমে আসে।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো, যদি বল আড়ি/ তোমাকেও ছেড়ে যেতে পারি . . . ওটা একবার হয়ে যাক।”

নস্ট্যালজিয়া নিয়ে আমার সমস্যা এটাই। আমার গতকালকের আমিটাকেই পছন্দ হয় না, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সেটার বোকামোর কথা মনে পড়ে আমার আবার লেপের তলায় সেঁধোতে ইচ্ছে করে, বারো বছর আগের আমির কথা তো ছেড়েই দিলাম। সেই আমিটার বোকামির কথা মনে পড়লে আমি শিউরে উঠি। সেই আমিটা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করত ‘যদি বল হ্যাঁ’-র থেকে ভালো ভালোবাসার গান পৃথিবীতে লেখা হয়নি আর লেখা হবে না কোনওদিন, বিশ্বাস করত বহুগামিতা মানুষের সহজাত অতএব প্র্যাকটিসযোগ্য, বিশ্বাস করত ভ্যালেনটাইনস ডে-র পুঁজিবাদী চক্রান্তে যারা বিশ্বাস করে তারা আর যাই হোক বুদ্ধিমান হতে পারে না। অন্তত আমার মতো বুদ্ধিমান তো নয়ই।

কিন্তু বারোটা বছর কম কথা নয়। আমি আমূল বদলেছি। আমার বিশ্বাসঅবিশ্বাসরা আমূল ভোল পাল্টেছে। এখন আমিও ভ্যালেনটাইনস ডে-তে বিশ্বাস করি। গ্লোবাল ভ্যালেনটাইনস ডে-র কথা জানি না, আমার আর অর্চিষ্মানের ব্যক্তিগত ভ্যালেনটাইনস ডে পালনে আমার উৎসাহের অভাব নেই। সকালে উঠে নতুন চায়ের কাপে চা খেয়ে, দুপুরে দোকানে গিয়ে ভালোমন্দ খেয়ে, তিনটে তালার চাবি খোলাখুলির আতংককে কাঁচকলা দেখিয়ে রাত দশটার সময় দৌড়ে গিয়ে পাড়ার দোকান থেকে কর্নেটো কিনে এনে খেতে খেতে প্রেমদিবসে সমাপ্তি টানি।

হয়তো এ রকমটা থাকবে না। হয়তো বারো বছর অপেক্ষা করতে হবে না, আর মাত্র পাঁচবছর বাদেই আমার বুদ্ধি খুলে যাবে, আর আমি সারা বছরের মধ্যে ভালোবাসার জন্য মোটে একটা দিন বেছে নেওয়ার অর্থহীনতাটা উপলব্ধি করব। কিন্তু যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন এই ভুলটা চলুক। যারা আমারই মতো এই মুহূর্তে এই ভুলে মজে আছেন তাদের সকলকে আমার শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানাই।

হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে।


            

Comments

  1. ব্যক্তিগত ভ্যালেনটাইনস ডে পালন খুব ভালো জিনিস.. আমার ও পছন্দ। .. মানে আমিও এই মুহূর্তে এই ভুলে মজে আছি। .. :)

    ReplyDelete
  2. Opurbo onubhuti. Choto choto muhurtogulo jaa amader bhisonvabe banchiye rakhey, tader oswikaar korata bokami aar folao kore dhaak petanota chyablami. Taar cheye benchey thakuk kichu manusher khyapami....
    Tomra bhalo theko

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

      Delete
  3. নিন্দুকের কোথায় কান দেবেন না। বছরের-সবকটা-দিনই-প্রেমদিবস গোছের যুক্তি মেনে চলতে হলে বছরের সবকটা দিন শিক্ষকদিবসও পালন করতে হয়।
    যদি বল আড়ি গানটা আগে শুনিনি, ইউটিউবে খুঁজে দেখব আজ। ব্যোমকেশ ফিরে এল দেখেছেন কি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক, একজন মনের কথা বলেছে। তাহলে তো বছরের সব দিনই সব দিবস, বলুন দেবাশিস?

      দেখলাম তো, কাল। দুটো পঁয়তাল্লিশের শো, নেহরু প্লেস সত্যমে। আমি আগ বাড়িয়েই বলে দিচ্ছি, খুব খারাপ লেগেছে।

      Delete
  4. khub shundor laglo pore ... mane, last line ta jei ses holo r cup gulor chhobi dekhlam, totokhone kintu amar hashita kaan obdi pouchhey gache ... amar bola uchit na, tobuo na bole parlam na, i wish oi 5 bochhor porer upolobdhi ta jano kokhonoi na hoy apnar ... bhalo thakben

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও মনে মনে সেইটাই বাসনা, অনুরাধা। হাই ফাইভ।

      Delete
  5. Amake vor dupure prem celebrate korar jonne Roy dekhte hoyeche!! ar se je ki baje cinema. Otar pace ar inzama ul haq er running between the wicket er speed puro ek.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে অর্ণব, প্রেমের খাতিরে লোকে প্রাণ দিয়ে দিচ্ছে, ভরদুপুরে রয় দেখাটা খুব অল্পের ওপর দিয়েই গেছে আমার মোটে।

      Delete
  6. AI KUNTALA , SARABOCHOR JODI VALENTINES DAY HOI , AR ROJ ARCHISMAN TOKE ROSE KINE DEI , SETA KEMON AKGHEYE HOYE JABE NA???? TAR CHEYE BOCHORE 1 DIN SOKALE TOKE ARCHISMAN HAPPY VALENTINES DAY WISH KORBE, TORE DUJONE ENJOY KORBI , GIFTS DIBI , MONE BESH " AJKER DINTA" FEELING ASBE ETAI BESI BHALO NOI KI???? ABAR WAIT KORBI NEXT YEAR TAR JANYE...... BOCHORE SOB KOTA DAY E 1 BAR KOREI HOA UCHIT... VALENTINES DAY TAO...

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই সোজা কথাটাই যদি সবাই বুঝত রে ভট্টা। তোকে আমার ভ্যালেনটাইনস ডে-র বিলম্বিত শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানাচ্ছি। সৌম্য আর টুকটুককেও।

      Delete
  7. as usual bhalo likhechho..ei valentine's day palon koechho nijo paddhoti te seta besh bhalo byapar, bishesh kore cornetto at night :) ami Valentine's day r byapare khub berasik chhilam, kintu ei oporer comment ta pore mone hochhe celebrate koratai bhalo byapar, khub miss kore gechhi eto bochhor dhore :)
    Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, ভালোমন্দ জানি না ব্রততী। করতে মজা পাই তাই করি। লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

      Delete
  8. দারুন লেখা। আগে আমি ভ্যালেনটাইন'স ডে'র ন্যাকামি দেখে বিরক্তি প্রকাশ করেছি, আপনার এই ব্লগেও করেছি। তবে এ বছর আমিও ব্যক্তিগত ভ্যালেনটাইন'স ডে পালন করিয়েদের দলে যোগ দিয়েছি, তাই লেখাটা আরও ভালো লাগল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আশা করি আপনার ভ্যালেনটাইন দিবস ভালো কেটেছে, সুগত।

      Delete
  9. onek subhechha... darun katiechho bojhai jachhe... ar cup duto khub sundor hoechhe...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা।

      Delete
  10. cup duto toh darun :) - tinni

    ReplyDelete
  11. Tumio v day celebrate korecho? Ami sottii minority r dole chole jacchi din ke din. Ami sudhu vday spl discount e akta tshirt kinechi. Nijei nijeke bhalobese gift dilam ar ki.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও ভি ডে সেলিব্রেট করেছি, কুহেলি। তবে মাইনরিটির দলে থাকা কিছু খারাপ নয় কিন্তু। আমার প্রিয় এক সেলিব্রিটি (মার্ক টোয়েন) বলেছেন, Whenever you find yourself on the side of the majority, it is time to pause and reflect , কাজেই অভিনন্দন।

      Delete

Post a Comment