পুনর্ব্যাচেলর ভব



আর যার বিরুদ্ধেই ডিসক্রিমিনেশনের অভিযোগ আনা যাক না কেন, ডিকশনারির বিরুদ্ধে আনা যাবে না কিছুতেইআমরা যাতে হিংসে না করি, আমাদের মনে যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য সব শব্দের জন্যই আমাদের জন্য সে একটা প্রতিশব্দ বরাদ্দ করে রেখেছে। লেখকের জন্য লেখিকা, গায়কের জন্য গায়িকা, ঔপন্যাসিকের জন্য ঔপন্যাসিকা, নায়কের জন্য নায়িকা কিন্তু তা সত্ত্বেও কারও কারও মন উঠছে না, তারা “না না না, অন্য শব্দ চাই না, ওই ওর যেটা আছে সেটাই আমার চাই” গোঁ ধরে পা ঠুকছে আর টেনে ঝুঁটির রাবারব্যান্ড খুলে ফেলছে 

সেই সব নেমকহারামদের মধ্যে আমি একজন। আমি মনে করি শব্দ আলাদা হলে শব্দের মানেও আলাদা হতে বাধ্যকাজ যতই এক ও অবিকল হোক না কেন। কোনও কোনও সময় তো সে মানে এমন বদলে যায় যে বানানের মিল ছাড়া তাদের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে

যেমন ধরুন ব্যাচেলর শব্দটা।

ব্যাচেলর বললেই মনের মধ্যে কেমন একটা সুন্দর ছবি ভেসে ওঠে, বেপরোয়া বুনো ঘোড়ার মতো একটা মানুষ পৃথিবীর পথ দিয়ে টগবগিয়ে ছুটে চলেছে, সোনালি কেশরের মতো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, লাউডস্পিকারে মহম্মদ রফি গলা খুলে গাইছেন, “ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাতা চলা গয়া/ হর ফিক্‌র্‌ কো ধুঁয়া মে উড়াতা চলা গয়া”। রাস্তার দুপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘটক, পাত্রীর বাবা, বিবাহিত বান্ধবীর দলতারা হাতে ল্যাসো নিয়ে মাথার ওপর সাঁই সাঁই ঘোরাচ্ছে, ছুঁড়ে দিচ্ছে ঘোড়ার মাথা লক্ষ্য করে, কিন্তু ফসকে যাচ্ছে বারবার। পরাজিত বেতো ঘোড়ারাও মজা দেখতে এসেছে। স্বেচ্ছায় এসেছে না কি ল্যাসোধারী গৃহিণীদের রক্তচক্ষুর শাসানি অস্বীকার করতে পারেনি বলে এসেছে সেটা তর্কের বিষয়। রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে ল্যাসোছুঁড়িয়েদের দিকেই তাদের সমর্থন, যতবার ল্যাসো ফসকাচ্ছে ততবার মুখে “হায় হায়” ধ্বনি তুলছে কিন্তু মনে মনে দেখুন গিয়ে বলছে, “সাবাস বেটা, চালিয়ে যা। আমার মতো এদের হাতে ধরা পড়িসনি, পড়িসনি, পড়িসনি

উল্টো ছবিটা মনে করে দেখুন।

আইবুড়ো মেয়ে, ভাগ্যিস মা চেপে ধরে সেলাইটা শিখিয়েছিলেন তাতে করে দু’বেলা অন্নসংস্থান চলছে অবশ্য চলছে মানে চলছেই, চপ্পলের স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেছে কতদিন, সেটা সারানোর জন্য আর বাঁচছে না কিছুই। টিউশনি সেরে ফেরার সময় এঁদোগলির কোনও বাড়ির ভাঙা রেডিওর এফ এম থেকে হিংস্র দেবতার অভিশাপের মতো ভেসে আসছে সেই হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে দেওয়া হুমকি, “কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?”    

শব্দের দোষ নয়, দোষ আমার দেখার? হতে পারে।

এই তো গেল দিশি ব্যাচেলরেটদের ছিরি, বিদেশী ব্যাচেলরেট বললেই আমার মাথায় যে ছবিটা ভেসে ওঠে সেটা আরও চমৎকার। ‘ব্যাচেলর’ নামক রিয়্যালিটি শো-এর বাঁধভাঙা সাফল্যের পরের সিজনেই ‘ব্যাচেলরেট’বেসিক্যালি, স্বয়ংবরসভা। বেদপুরাণের যুগেও যে নারীস্বাধীনতা ছিল তার মোক্ষম প্রমাণ। তা সেই সভায় পাণিপ্রার্থী হয়ে যাঁরা আসেন তাঁদের দেখলে, সত্যি বলছি, আমি মালাটালা ফেলে উল্টোদিকে দৌড়তাম। ওই স্বয়ংবরসভার নায়িকা হওয়ার থেকে ছেঁড়াচপ্পল পরিহিতা সেলাইদিদিমণি হওয়া একশোগুণ ভালো।

আঙুর ফল টক? হতে পারে।

সে যাই হোক, আমি কেন ব্যাচেলর শব্দটার জন্যই বায়না ধরি আর ব্যাচেলরেট শব্দটার সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক স্বীকার করতে চাই না সেটা নিশ্চয় আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। বিশেষ করে আমার জীবনের একটা বেশ বড় অংশ আমি যখন সেই ব্যাচেলর অবস্থায় কাটিয়েছি। এবং এখনও মাঝে মাঝে কাটাই, যখন “এই একটু আসছি” বলে হাতে সুটকেস ঝুলিয়ে অর্চিষ্মান চম্পট দেয়। পাঁচ, সাত, পনেরোদিনের জন্য।

একদিক থেকে দেখলে এই অধুনা ব্যাচেলরত্বটা আমার আগেকার ব্যাচেলরত্বের থেকে ভালো। যখনতখন এদিকসেদিক থেকে ল্যাসো এসে গলায় পড়ার হুমকি নেই, ঝাড়া হাত পা হয়ে থাকার নিশ্চিন্তিটুকু আছে। সেট্‌ল্‌ করার ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার আতংক নেই, ভিট্রুভিয়ান ম্যানের ভঙ্গিতে একটা খাট একাই দখল করে শোওয়ার আরাম আছে।

আশ্চর্যের ব্যাপারটা হচ্ছে সেই একলা জীবনের সবটাই যে যে এই দোকলা জীবনটার থেকে ভালো ছিল তা তো নয়, (ঠিক যেমন এই দোকলা জীবনটারও সবকিছু সেই একলা জীবনটার থেকে ভালো নয়) তবু আমি ভয়ানক উৎসাহের সঙ্গে এই ক’দিনের জন্য সেই জীবনটায় ফিরে যাই।  সেই আগের মতো নিজে নিজের মনে থাকি, ন্যূনতম দরকারের বাইরে সমস্ত রকম মনুষ্যসংসর্গ পরিহার করে চলি, দেদার ম্যাগি আর বেগুন খাই। বেছেবেছে সেই সব গানগুলো শুনি যেগুলো আমি সেই আমার সত্যিকারের ব্যাচেলর থাকার দিনগুলোতে লুপে চালিয়ে শুনতাম।

আজ আমার এই খেপের পুনর্ব্যাচেলরত্বের শেষ রাত্তির। আজ ডিনারে নিশ্চিত ম্যাগি। পিৎজা হাটের ডেলিভারির সঙ্গে আসা চিলি ফ্লেকস ছড়ানো। তারপর খালি আমি আর ইন্টারনেট, ইন্টারনেট আর আমি। যতক্ষণ না ক্লান্তিতে দু’চোখ বুজে আসে, ল্যাপটপের তলায় বুকের পাঁজরগুলো কনকন করে ওঠে। তখন তাকে খাটে নামিয়ে, জোয়ান হিকসনের গলায় 'আ মার্ডার ইস অ্যানাউন্সড' অডিওবুক চালিয়ে উল্টোদিক ফিরে ঘুম।

ঘণ্টা পাঁচেক পর যখন মিস মার্পল সবাইকে বুঝিয়ে দেবেন কী করে যুক্তি আর অভিজ্ঞতার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে তিনি খুনীকে ধরে ফেললেন, গল্প ফুরোবে, তখন নৈঃশব্দের ভারে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবে আমার। ল্যাপটপ, চশমা, ফোন, চার্জার, বই, খাতা, পেন, চুলের ব্যান্ড, মাউস, চায়ের কাপে ছত্রাকার ব্যাচেলর বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসব। নিদ্রা আর জাগরণের মাঝের শূন্যতাটা পেরিয়ে আসতে দু’সেকেন্ড যা দেরি, তারপরেই হুড়মুড়িয়ে মনে পড়ে যাবে। আজ সাতাশ! ফোনটা চোখের কাছে এনে সময় দেখব, আর মাত্র ক’ঘণ্টা!

চোখ কচলে বিছানা ছাড়ব। বাথরুম থেকে ফিরে বিছানাটাকে পরিষ্কার করে ঝেড়ে মুছে, আবার ভদ্রলোকের মতো চেহারায় ফিরিয়ে আনব। সিংকে জমা বাসনক’টা ধোয়ামোছা হয়ে শুকোতে যাবে, ও ঘরের বিছানায় জড়ামড়ি করে পড়ে থাকা সুগন্ধী সাবানের গন্ধ মাখা জামাকাপড়েরা বাধ্য শিশুর মতো হাত পা গুটিয়ে কাবার্ডের নির্দিষ্ট খোপে ঢুকে যাবে। ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা গত ক’দিনের খবরের কাগজেরা চলে যাবে বিক্রির ঝুড়িতে। ল্যাপটপে বেজে উঠবে আমার আজকের জীবনটার সঙ্গে মানানসই সংসারী, বিচক্ষণ গান। মৃদু আওয়াজে যাতে দরজার বাড়াবাড়ি রকম আস্তে টোকাটা আমি মিস না করে যাই।

সে টোকা শুনে লাফ মেরে গিয়ে দরজা খুলব যখন তখন আমার ঘরে, মেঝেতে, জানালায়, জানালার পর্দায়, টেবিলের ওপর পাটপাট করে রাখা খাতাবইয়ের খাঁজে, কোথাও আমার ব্যাচেলর জীবনটার তিলমাত্র ছায়াও আর লেগে থাকবে না। ম্যাজিকের মতো নিজের সমস্ত চিহ্ন মুছে নিয়ে আমার মগজের অসংখ্য খুপরির একটায় লুকিয়ে পড়বে সে। বালিশবিছানা পেতে আরামে শীতঘুম লাগাবে। ততক্ষণ ঘুমোবে যতক্ষণ না আবার একদিন সকালে অর্চিষ্মান ভাগলবা হচ্ছে, আর একা বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আমি আবার তাকে ডাক পাঠাচ্ছি।

       

Comments

  1. এই স্বীকারোক্তি টুকু একেবারেই সত্যি
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. একেবারে বিদ্যাছোঁয়া সত্যি, মিঠু।

      Delete
  2. Oshadharon! Amar golpo aek i rokom, shudhu ami tour ae jai bolae room ta hotel room hobae ar cupboard er jaygay suitcase :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. Amar o tai cholche agami sombar obdi... ki odvut ei feelings gulo. Karor sathe mile gale aro valo lage go.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে তো লাগেই, রাখী।

      Delete
  4. অর্চিষ্মানের মত এত ঘনঘন না হলেও সোমদত্তাদেবী ন'মাসে ছ'মাসে একবার করে হপ্তা-দশদিনের জন্য পগারপার হন। মাইরি বলছি, আমার ভালো লাগে না। কখন ফিরবেন, তার দিন গুনি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও ভালো লাগে না, দেবাশিস। ইন ফ্যাক্ট কত যে খারাপ লাগছিল সেটা ফেরার পর বেশি করে টের পাই।

      Delete
  5. আপনিও অডিও বুক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন? আমি ভাবতাম আমিই নিতান্ত নিরেট বলে এত সুন্দর করে বানানো অডিও বুক আর শ্রুতিনাটক গুলো শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি, আর লেখক এবং পাঠক/অভিনেতাদের প্রতি ভয়ানক অবিচার করছি ভেবে অপরাধবোধে ভুগতাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঘুমপাড়ানি গান/গল্প কথাটার মর্ম আমি এই বুড়ো বয়সে এসে আবার বুঝছি, সুগত। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে কানের কাছে গল্প না চললে ঘুমোতে পারি না।

      Delete
  6. Keu ekta kothau bolechilo je bachelor life er sobcheye boro subidhe ghum theke uthe bichanr du dik diyei nama jai.. ekdom sotti kotha.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা একটা সুবিধে বটে, অর্ণব।

      Delete
  7. khub bhalo lagbe na , erokom besi katate hoyni tao besh kharap lage..bishesh kore jokhon ami bari chhara hoi seta to prochondo koshtokor......husband bari-chhara hole tao ami to atleast meye ke pai r bariteo thaki !! Ami bachelor life e phire jete raji achhi koyekdin er jonyo jodi meyer chinta na korte hoy, tabe meye ke chokhe dekhte pabo kintu kono dayittwo na nite hoy erokom byabostha hote habe, jemon dhoro if she is in very safe hands jemon amar ma-baba .. r amio okhane theke besh "bhojonrosik" bhabe din katabo :) - Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্রততী, আমার তো মনে হয় মাঝে মাঝে ব্যাচেলর দিনযাপন আমরা সকলেই 'ডিসার্ভ' করি।

      Delete
  8. Ekei ki "Mean-reversion" bolen boignyanik ra?

    Apnader katha jani na bapu, amar to eka thakte bejay bhoy kore! Nijekei bhoy kore. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এঈ নিজেকে ভয় পাওয়াটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা কথা বললেন। আমিও নিজেকে বেশ ভয় পাই।

      Delete
  9. biyer aage sei orthe aka thaka hoyni , hoy hostel e aneker sathe noyto kokhono room share kore , taai sompurno aka thakar swaad ta nite parini jodio jokhon jekhane thekechi se baba-ma r sathe thakar somayteo , amar charpase akta odrisshyo abar kokhono drisshyo deyal ( jokhon aki barite holeo nijer ghor e dhuke gele mone hoto eta amar akar ) thaktoi ... jaaihok sather manushti aar amar sobkichutei atota parthokyo je beshirbhag somay tei nijeder moto alada alada bhabe amra amader pochonder jinish upobhog kori .

    achcha tumi je aka thakle begun beshi khao ta seta kibhabe ? begun bhaja ? amaro seta khoob priyo .

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই একসঙ্গে থেকেও আলাদা আলাদা থাকতে পারাটা কিন্তু খুব ভালো (আমার মোটে জরুরিও) প্র্যাকটিস। তোমরা সেটা পার শুনে ভালো লাগল, অনিন্দিতা।

      আমি বেগুন ভেজে খাই, পুড়িয়ে খাই, এমনকি পাস্তায় দিয়েও খাই।

      Delete
  10. Aha ei bachelor jibon ar hoyar noy! Aro duto monishhi achhey je!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই মনিষ্যিরাই হচ্ছে সব সুখ আর সব দুঃখের মূল, রুণা।

      Delete
  11. amar begun pora o khoob bhalo lage , pasta jinishta emnitei khaina , aaj porjonto jibone kotobaar kheyechi sunle loke hasbe , amon noy je bhalo lagena kintu ei dese & europe eo somosto kichutei gada guchcher cheese aar cream daoa noyto oi ak khabla tomato sauce akdom bhalo lagena , barite 4,5 rokomer pasta 2 bochor dhore sajiye rekhechi , akdiner jonnyeo baniye khaoa hoyni . tobe thai curry r moddhye begun anekbaar kheyechi restaurant e , bhaloi lage seta .

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, চিজের বাড়াবাড়িটা আমারও মোটে সয় না, অনিন্দিতা।

      Delete
  12. Pasta chhere Posto'r bandona koratai someechin.

    ReplyDelete
  13. akdom thik bolecho posto r kono tulona hoyna , jate deya jaay taar i swad gondho bere jaay .

    ReplyDelete
  14. সোনার তরী, অনিন্দিতাঃ বেগুনপোস্ত বেগুনপাস্তাকে বলে বলে গোল দেবে যে কোনও দিন, কিন্তু পোস্ত বাটার ঝামেলা এড়াতে পাস্তায় দিয়েই খাই। কম্প্রোমাইজ করে করে লাইফটাই হেল হয়ে গেল।

    ReplyDelete
  15. High five posto premi der jonney!

    ReplyDelete

Post a Comment