ক্যাফে লোটা
দিল্লির মতো জায়গায় যদি কোনও খাবার দোকানে একবার
নয়, দু’বার নয়, তিনতিনবার
যাওয়া হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে দোকানের মধ্যে একটা ব্যাপার
আছে। ব্যাপারওয়ালা দোকান, ব্যাপারওয়ালা মানুষের মতোই বিরল।
এতদিনে এত রেস্টোর্যান্ট চাখার পর সে রকম গোটা পাঁচেকের সন্ধান পেয়েছি আমরা। তার
মধ্যে প্রথমেই থাকবে জনপথের সারাভানা ভবন। সারাভানা
ভবনের মেদু বড়া আর ফিল্টার কফি আমার পছন্দের আর অর্চিষ্মানের পছন্দের হল দোকানটার
‘যখনই-যাও-তখনই-গমগম-করা’র চরিত্রটা। সারাভানা
ভবনে আমরা শ’খানেক বার গেছি, আরও হাজার
বার যাব। আরও যে ঘন ঘন যাওয়া হয় না তার কারণ আমাদের বাড়ি থেকে দোকানটার দূরত্ব।
একশো টাকা অটো ভাড়া দিয়ে সত্তর টাকার ফিল্টার কফি যেতে গা করকর করে। আমাদের বাড়ির পাশে গ্রেটার কৈলাস মেট্রো স্টেশনের কাজ হইহই করে চলছে,
হয়ে গেলেই আমরা আরও ঘনঘন সারাভানা ভবন যাব। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন
আমাদের পাশের পাড়ার ‘নৈবেদ্যম’-এ কাজ
চালিয়ে নিতে হবে। নৈবেদ্যম-এর বাটারমিল্কের জবাব নেই। তাছাড়া আমি যে ছ’মাস অর্চিষ্মানকে রেখে ভাগলবা হয়েছিলাম তখন ও শনিরবিবার সকালবেলা ‘নৈবেদ্যম’-এ গিয়ে উত্থাপাম আর কফি খেতে খেতে গল্পের
বই পড়ত। সে কথা শোনার পর থেকে ‘নৈবেদ্যম’-এর প্রতি আমি সদয়।
আমাদের রিপিট করা দোকানের তিন নম্বরটা হচ্ছে ‘স্বাগত’। ‘স্বাগত’-এ উত্তরী, দক্ষিণী, চাইনিজ
নানারকম খাবার পাওয়া যায়, তবে আমরা যাই দক্ষিণী খাবার খেতে।
এ ছাড়া আর যে দুটো দোকানে আমরা একাধিকবার গেছি তার একটা হচ্ছে খান মার্কেটের
‘সোডাবটলওপেনারওয়ালা’ আর অন্যটা গ্রেটার
কৈলাসে টু-এর এম ব্লক মার্কেটের ‘ইয়েতি’। প্রথমটা পার্সি (কেউ কেউ
বলে ওটা যত না পার্সি তার থেকে বেশি ইরানি) খাবারের দোকান, দ্বিতীয়টা
হিমালয়ান কুইজিনের। নেপাল, তিব্বত,
ভুটান অর্থাৎ ইত্যাদি নানা হিমালয়ান অঞ্চলের খাবার পাওয়া যায়
‘ইয়েতি’তে। একবার খেলে সারাজীবন মনে রাখার মতো
খাবার। পরে একদিন অবান্তরে সে দোকানের গল্প লিখব।
আর যে দোকানটায় আমরা আগেও গেছি, পরেও যাব,
সে দোকানটার নাম ‘ক্যাফে লোটা’। আমি অনেকদিন ভাবতাম এ লোটা
কোন লোটা, তারপর দোকানে ঢোকার মুখের আল্পনা দেখে বুঝলাম এ লোটা
লোটাকম্বলের লোটাই বটে।
দোকানের নামও অন্যরকম, খাবারও
অন্যরকম, অবস্থানও অন্যরকম। ভৈঁরো মার্গে ন্যাশনাল ক্রাফটস
মিউজিয়াম, সে মিউজিয়ামের বারান্দায় এই ক্যাফে লোটা। আপনি যদি
একঢিলে দুই পাখি মারতে চান তবে মিউজিয়াম ঘুরে ক্যাফে লোটায় খেয়ে ফিরতে পারেন। ইন
ফ্যাক্ট, এক ঢিলে তিন পাখি মারাও সম্ভব। কারণ রাস্তার ওপারেই শেরশাহের তৈরি পুরানি কেল্লা। মহাকাব্যের ইন্দ্রপ্রস্থ।
পুরানি কেল্লার পাশেই দিল্লির চিড়িয়াখানা, চিড়িয়াখানার পাশেই
সুন্দরনগর, সেই সুন্দরনগরেই কপিলদেবের বাড়ি, যে বাড়িতে করণ থাপার সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। কাজেই বুঝতে
পারছেন শুধু খেতে অতদূর ঠেঙিয়ে যেতে যদি কারও আপত্তি থাকে তাহলে তার ওপাড়ায় যাওয়ার
অজুহাতের অভাব নেই। আমরা অবশ্য যতবার গেছি শুধু খেতেই গেছি। একবার শুধু বসার জায়গা
পাওয়া যাচ্ছিল না বলে দোকানের লাগোয়া মিউজিয়াম শপে ঢুকেছিলাম। ঢুকে মনে হল যা
দেখছি সব কিনে ফেলি। মধ্যপ্রদেশের পাথরের কুঁদে বানানো নিখুঁত নটরাজ, কাশ্মীরের কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি রঙিন পুতুল, ওডিশার
তালপাতার ক্যালেন্ডার, পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্র। তাছাড়াও
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের তৈরি চামড়ার ছোট ছোট হাতি, গণ্ডার,
শুয়োরছানাও ছিল, তাদের উল্টো করে ধরলেই দেখা
যাবে চারটের মধ্যে যে কোনও একটা পায়ের পাতায় টিপ বোতাম লাগানো, সে বোতাম খুলে আপনি তাদের পেটের মধ্যে খুচরো পয়সা জমাতে পারেন।
কিনব বলে একরকম মন ঠিক করেই ফেলেছিলাম, তারপর
শুভবুদ্ধির উদয় হল। মনে পড়ল শুধু কিনলেই হবে না, ঘর সাজালেই
হবে না, সে সজ্জাদ্রব্যের ধুলোও ঝাড়তে হবে। এই রঙিন হাতি যা
এখন নিরীহ মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কালে কালে তার ধবল দাঁত মলিন হবে। তারপর
আমাকে ঝাড়ন হাতে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে। ভাবতেই গায়ে কম্প দিয়ে জ্বর এল। আমি
তাড়াতাড়ি হাতিকে যথাস্থানে নামিয়ে রেখে সরে এলাম। এসে দেখি অর্চিষ্মান একটা শেলফের
পাশে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে কী সব দেখছে। দেখি সেখানে সব কাঠের জিনিসপত্র। বাহারি
বাক্স, হাতাখুন্তি, পেনদানি। আমাদের
দুজনেরই একটা সাবানদানি দারুণ পছন্দ হল। কাজের জিনিস। তাছাড়া কেরালা থেকে তিলক
মামা আর সুমিতা মামি ঝিনুকের মতো বাক্সে পোরা সাবান এনে দিয়েছে, তার চন্দনের গন্ধে মন ভালো হয়ে যায়। প্লাস্টিকের সাবানখোপে তাকে রাখা মানে
ঘোর অপমান করা। কিনে নিলাম। খাওয়া সেরে অটো চেপে ফিরতে ফিরতে আরেকবার সাবানদানিটা
বার করে দেখতে গিয়ে দেখি পেছনদিকে একটা ছোট্ট কুচি স্টিকারে লেখা আছে ‘মেড ইন ক্যালকাটা’।
যাই হোক, মিউজিয়াম শপের কথা ছেড়ে এবার
ক্যাফে লোটার কথায় আসি। ক্যাফে লোটা একটি ফিউশন রেস্টোর্যান্ট। প্রথম যখন ক্যাফে
লোটার প্রশংসা শুনি তখন সঙ্গে সঙ্গে এই শব্দটিও কানে আসে এবং সত্যি কথা বলতে কি
আমি একটু নিরুৎসাহই হয়ে পড়ি। বক কিংবা কচ্ছপ, বকচ্ছপের থেকে
দুটোই আমি বেশি পছন্দ করি। শুনতে হলে আমি হয় ক্ল্যাসিকাল শুনি, নয় ফোক, নয় রক, কোক স্টুডিও
শুনি না। অর্চিষ্মান অবশ্য আমার মতো খুঁতখুঁতে আর
খিটখিটে নয়, অনেক বেশি উদার আর মনখোলা। “আহা, ট্রাই করে দেখাই যাক না” এই
হচ্ছে ওর জীবনের মোটো। একরকম ওর তাড়াতেই অতিষ্ঠ হয়ে আমি ক্যাফে লোটায় প্রথমবার
যেতে নিমরাজি হই এবং গিয়েই পত্রপাঠ প্রেমে পড়ে যাই।
গুজরাটের ধোকলা, পণ্ডিচেরির মাছের ঝোল, আসামের কালো চিকেন, কুমায়ুনের রায়তা – ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের খাবারদাবার জড়ো করে গড়ে উঠেছে ক্যাফে লোটার
মেনু। রকমারি উপকরণ আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি জিভে চট করে যাদের স্বাদ মেলে না সে
সব ভরপুর রয়েছে মেনুতে। রাগির রুটি, পদ্মডাঁটার রায়তা,
কাঁঠালের বিরিয়ানি, খেজুরের পুর ভরা মিষ্টি
সামোসা। কখনও কখনও পদের থেকে প্রাধান্য পেয়েছে কোনও একটি স্পেশাল উপকরণ বা মশলা।
পাঁচফোড়ন দেওয়া খিচুড়ি, কাঁচা আম দেওয়া চিংড়ি মাছ। তাছাড়া
সর্বভারতীয় নস্ট্যালজিয়া যা নির্দিষ্ট কোনও প্রদেশের সম্পত্তি নয়, সে সবও রয়েছে। ডাকবাংলো মাটন, রেলওয়ে চিকেন। সবথেকে
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিটি রান্নাই (গত তিনবারে আমরা দুজনে মিলে যা যা খেয়েছি) রাঁধা হয়েছে একই রকমের সাবলীলতায়।
প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম তখন ক্যামেরা সঙ্গে ছিল
না। দ্বিতীয় আর তৃতীয়বার ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম, তার ছবিসহ প্রমাণ রইল এই
আপনাদের জন্য।
ক্যাফে লোটা,
ব্রেকফাস্ট, জুলাই ২০১৫
ক্যাফে লোটার ব্রেকফাস্ট মেনু অভিনব। বিলিতি
ধাঁচের দই মুয়েসলি, মাখনটোস্ট যেমন আছে, তেমনি আছে রাগি
প্যানকেক, লংকার চাটনির সঙ্গে সাবুদানার বড়া, বম্বে স্টাইল এগ ভুরজি, রেলওয়ে স্টাইল মসালা এগ পাও।
শেষের পদটার ওপর খানিকক্ষণ তর্জনী বুলিয়ে আমি শেষমেশ কান্দা বাটাটা পোহা-য় গিয়ে
থামলাম। চিঁড়ের পোলাওয়ের প্রতি আমার দুর্বলতা চিরদিনের। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে
খাবারটা কমই হত। অন্তত কখনও মনে পড়ে না খেয়েছি বলে। তারপর একদিন পিসির সঙ্গে সেবক
সংঘের মাঠে বিকেলে বেড়াতে গিয়ে পিসির এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাঠের ধারেই
তাঁর বাড়ি। তিনি আমাদের জোর করে বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে আদর করে চিঁড়ের পোলাও খেতে দিলেন। চিঁড়ে ব্যাপারটার সঙ্গে আমার তার আগে কেবল দুধের
বাটিতেই মোলাকাত হয়েছে, সে চিঁড়েকে আলু আর বাদামভাজা দিয়ে যে
এমন স্বর্গীয় রূপান্তর সম্ভব, আমার মগজে সে কথা অবিশ্বাস্য
ঠেকেছিল। রান্নাটার নামটাও কী সুন্দর, পোলাও। হলুদের মধ্যে
আবার চকচকে মুক্তোর মতো বাদামভাজারা জেগে রয়েছে। তারপর শত শত অখাদ্য চিঁড়ের
পোলাওয়ের শিকার হওয়া সত্ত্বেও (তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটা আমার নিজের হাতেই বানানো)
চিঁড়ের পোলাওয়ের প্রতি সেই যে আমি অনুগত হয়ে পড়লাম আজও তা থেকে বেরোতে পারিনি।।
খটখটে শুকনো গলায় আটকে যাওয়া চিঁড়ের পোলাও, ডেলা পাকানো
কাদাকাদা চিঁড়ের পোলাও, বাদাম ছাড়া (বা-দা-ম-ছা-ড়া!) চিঁড়ের
পোলাও। তবু এখনও চিঁড়ের পোলাও বলতেই আমার মনে পড়ে একটা বিরাট সবুজ মাঠের পারে
লালসাদা ইঁটের ডিজাইন করা দোতলা বাড়ির ডাইনিং রুমের টেবিল। ফ্রয়েড যে বলে গেছেন
একজন মানুষের পছন্দঅপছন্দ, বিদ্রোহ আনুগত্য, সবের বীজ রয়েছে তার শৈশবে আর স্বপ্নে, মিধ্যে নয়।
আমি কান্দা বাটাটা পোহা অর্ডার করলাম, অর্চিষ্মান কিমা পরাঠা অর্ডার করে আমার দিকে “কেমন দিলাম” ভাব করে তাকাতে লাগল।
এ চিঁড়ের পোলাও শুকনো নয়, ভেজাও নয়,
বাদামও এতে আছে বিস্তর।
কিমার পুর ভরা পরোটা তো ভালো ছিলই, তার সঙ্গে
সমান ভালো ছিল ঠাণ্ডা রায়তা। আর রায়তার বাটির পাশে সারা গায়ে দানা দানা নুন মাখানো
ওই যে কাঁচা লংকাটি উঁকি মারছে, আমার মতে সবথেকে ভালো ছিল
ওইটি।
জুলাই মাসের গরমে অটো চেপে চিত্তরঞ্জন পার্ক
থেকে দশ কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা যেতে গিয়ে আমাদের দুজনেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল।
তাই আমরা খাওয়া শুরু করেছিলাম পুদিনাপাতা দিয়ে সাজানো, জিরেগুঁড়োর
সুবাস ছড়ানো ছাস (আমি) আর টকমিষ্টি আম পান্না
(অর্চিষ্মান)। খাওয়া শেষ হয়েছিল কাটিং গ্লাসে মসালা চা (আমি) আর ফিল্টার কফি
(অর্চিষ্মান) দিয়ে। কিন্তু সে সবের ছবি নেই।
ক্যাফে লোটা, নৈশভোজ,
অক্টোবর ২০১৫
আমাদের তিন নম্বর ক্যাফে লোটা অভিযান ঘটল এই
শনিবার। একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল যে এবার সন্ধ্যে নামার একটু আগে গিয়ে শেরশাহের
বানানো পুরানি কেল্লাটা একটু ঘুরে দেখব, দেখব ইন্দ্রপ্রস্থ শহরের কোনও
চিহ্ন এখনও বাকি আছে কি না, কিন্তু সৎ কাজে শত বাধা। সামান্য
ভুল বোঝাবুঝিতে অটো ভাইসাব আমাদের নিয়ে মথুরা রোডে পড়লেন। আর মথুরা রোডের প্রায়
পুরোটা জুড়ে রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে মেরামতির জন্য। সে জ্যামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
দেখলাম সূর্য আকাশ বেয়ে নামছে। কেল্লা খোলা থাকবে সুরজ ডুবনা তক। তারপর নিজেদেরই
বোকামিতে আমরা পুরানি কেল্লার দরজায় না নেমে ভৈঁরো মন্দিরের দরজায় গিয়ে নামলাম,
সেখানে বসে থাকা দারওয়ান ভাইসাবরা আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন কোই
বাত নেহি, এই রেড লাইট থেকে বাঁ দিক নিয়ে পরের রেড লাইটে
গেলেই পুরানি কেল্লার দরজা পেয়ে যাবে। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। প্রথম রেড লাইটে
পৌঁছতে পৌঁছতেই দেখলাম রাস্তার ওপারে গাছেদের মাথার ওপর সূর্য লুকিয়ে পড়ল। অগত্যা
পুরানি কেল্লাদর্শনের সদিচ্ছায় জল ঢেলে আমরা ক্যাফে লোটায় ঢুকে পড়লাম।
মিউজিয়ামে ঢোকার ঢাকা করিডরের গায়ে শিল্পকর্ম
চলছিল। যাঁর পিঠ দেখা যাচ্ছে ছবিতে তিনিই ছবির শিল্পী, ওডিশার
অক্ষয়।
বিকেলের চা মিস হয়ে গেছে, কাজেই আমরা
ডিনার শুরু করলাম কফি দিয়ে। ক্যাফে লোটা-র মেনুর চা কফির দিকটা কালটিভেট করার মতো।
ক্যাপুচিনো, ফ্রাপে, লাটের দৌরাত্মের
বদলে ক্যাফে লোটায় রয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের প্লান্টেশন থেকে বাছাই করে আনা
চা কফির সম্ভার। কুর্গ, চিকমাগালুরের প্ল্যান্টেশনের সিংগল
এস্টেট কফি, ডিব্রুগড়ের ম্যানকোটা টি এস্টেটের চা। পাছে
এক্সপেরিমেন্ট বুমেরাং হয়ে যায় সেই ভয়ে আমি নিলাম গতে বাঁধা সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্টার
কফি, সাহসী অর্চিষ্মান নিল কুর্গের বিবি প্লান্টেশনের কফি।
আমার ফিল্টার কফিও ভালো ছিল, কিন্তু টেবিলের উল্টোদিকে রাখা অর্চিষ্মানের
কফির কাপ থেকে যা সুগন্ধ আসছিল, ঠিক করেছি পরের বার আমিও ওই
কফিটাই অর্ডার করব।
ক্যাফে লোটার খাবারের মেনু বেশ অভিনব। অন্যান্য
দোকানে যেমন স্টার্টার বা অ্যাপেটাইজার আর মেন ডিশের ভাগাভাগি থাকে, সে জায়গায়
ক্যাফে লোটার ভাগাভাগিটা হচ্ছে স্মলার প্লেটস আর লার্জার প্লেটস। নাম আলাদা হলেও
কাজ একই, স্মলার প্লেটস খেয়ে আপনি খিদে চাগাবেন আর মেটাবেন
লার্জার প্লেটস খেয়ে।
স্মলার প্লেটসে থেকে আমরা বাছলাম পালক পাত্তা
চাট। পালং শাকের পাতা বেসন বা ওই জাতীয় কিছুর মিশ্রণে ডুবিয়ে মুচমুচে করে ভাজা আর
সঙ্গে দইয়ের চাট। সে চাটের অংশটা বাজারের আর পাঁচটা চাটের মতোই, তফাৎ এই যে
সে সব চাটের থেকে সেটা অনেক বেশি ভালো খেতে। মিষ্টি, ঘন
ভাজামশলার সুবাসওয়ালা দইয়ের লেপের তলায় সেদ্দ আলু আর কাবুলি চানা, আর প্রায় প্রতি চামচে মুখে পড়া পাকা ডালিমের দানা। আর সেউভাজাতেও যে ওঁরা
কোনও কার্পণ্য করেননি সেটা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
আমরা মাস্টারশেফ দেখে একটা জিনিস বুঝেছি যে
বিচারকরা সবসময় টেক্সচারের ওপর জোর দেন। মানে একই রান্নায় যদি একাধারে মিহি,
কুড়মুড়ে, দানাদানা ইত্যাদি নানারকম ব্যাপারের
আমদানি করা যায় তা হলে সে রান্নার রাঁধুনির পরের এপিসোডে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে
যায়। টেক্সচারের সমাহার দিয়ে বিচার করলে ক্যাফে লোটার পালক পাতার চাট প্রতিযোগিতায়
নিশ্চিত ফাইন্যালিস্ট। মুচমুচে পালংপাতার বড়া, মসৃণ দই, নরম চানা আর আলুসেদ্ধ, আর মাঝে মাঝে মুখের মধ্যে ডালিমদানার মিষ্টি রসের বিস্ফোরণ, সব মিলিয়ে পালংপাতার চাট একখানা চ্যাম্পিয়ন ডিশ।
ক্যাফে লোটার লার্জার প্লেটস অর্থাৎ প্রধান
পদগুলোর বেশিরভাগই আসে রুটি বা ভাত আর একটা ছোট সাইড ডিশের সঙ্গে। আমাদের পছন্দ হল
ইমলি ফিশ। তেলাপিয়া মাছ ভেজে তার ওপর কারিপাতা আর নারকেলের ‘ক্রাম্বল’
ছড়িয়ে নিয়ে এলেন পরিবেশক। সঙ্গে এল ট্যামারিন্ড
রাইস আর ছোলা নারকেলের তরকারি। প্রতিটি পদেরই স্বাদ চমৎকার।
শেষপাতে আমরা নিলাম আপেল দারচিনির জিলিপি আর
নারকেলের রাবড়ি। এ জিলিপি আমাদের চেনা জিলিপি নয়, জিলিপির থেকে ডোনাটের সঙ্গেই
তার সাদৃশ্য বেশি। কিন্তু স্বভাব আমাদের জিলিপির মতোই। চকচকে, কুড়মুড়ে বহিরাবরণ দাঁত দিয়ে চূর্ণ করলেই ভেতরে হাল্কা দারচিনির গন্ধওয়ালা
রসালো আপেলের পুর। পাছে শুধু জিলিপিতে কারও ক্যালরি কম পড়ে তাই সতর্কতা হিসেবে
পাশে বাটিতে করে ঘন নারকেলের দুধের রাবড়ি দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত রাতের খাওয়ার পর চা খাওয়াটাই আমাদের
নিয়ম, বাইরে গেলেও আমরা এ নিয়মের ব্যত্যয় করি না, কিন্তু কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি আসে যে চা, এমনকি চা
খাবারও পেটে জায়গা থাকে না। ক্যাফে লোটায় গেলে সেরকমটা হয়। আমরা বিল আনতে বলে
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পেট চেপে ধরে হাঁ করে দম নিতে লাগলাম। ওখান থেকে প্রগতি
ময়দান মেট্রো হেঁটে লাগে মোটে দশ মিনিট। হাঁটাই উচিত ছিল আমাদের, পয়সাও বাঁচত, খাবারগুলোও হজম হত। কিন্তু তখন দু’পা চালনা করার থেকে একটা আঙুল চালিয়ে ওলাক্যাবস অ্যাপ থেকে অটো ডাকা একশো
কোটি গুণ সোজা মনে হচ্ছিল। ভাইসাব ফোন করে জানালেন যে তিনি মথুরা রোডের জ্যামে
আটকে আছেন, মিনিট সাতেক লাগবে পৌঁছতে। ওই সাতমিনিটে আমরা
খানিকটা ধাতস্থ হলাম, ম্যাপে যখন দেখাল যে অটো মিউজিয়ামের
প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে, লোটাকম্বল গুটিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল।
*****
Cafe Lota
National Crafts
Museum, Bhairon Marg, Pragati Maidan, New Delhi
+91 7838960787
প্রতিবার আপনার খাবারের লেখাগুলো ঠিক লাঞ্চটাইমের সময় পড়ি, আর নিজের টিফিন খেতে ইচ্ছে করে না। বাড়ি গিয়ে মুখনাড়া খাই। আজকেও তাই হবে। এত ভালো কি করে লেখেন বলুন তো?
ReplyDeleteওই শেষের প্রশ্নটার উত্তর দিতে হবে না। শচীন তেন্ডুলকরের ব্যাটিং দেখেও আমি এই প্রশ্নটাই করতাম, আর শচীন তার জবাবে খুট করে আরও একটা চার মারতেন।
পুরানা কেল্লায় (পুরানি নয়, পুরানা। কেল্লা পুংলিঙ্গ। কেল্লার মত একটা বিষম বস্তু স্ত্রীলিঙ্গ হতেই পারে না) ঢোকার আগে সূর্য পাটে নেমেছিলেন বলে আপনারা ভেতরে ঢুকলেন না? কি কাণ্ড! অর্চিষ্মান কে ইশক-এ-দিল্লি দেখাতে পারতেন তো। একটা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, মশার কামড় খেতে খেতে দেখতে হয়, কিন্তু কনটেন্ট ভালো। আপনারও তো ইতিহাসে ইন্টারেস্ট আছে।
থ্যাংক ইউ, দেবাশিস। ওই লাইট অ্যান্ড সাউন্ডটা দেখা যেত, কিন্তু কেল্লাটা দেখা যেত না ভালো করে। সেই জন্য লাইট অ্যান্ড সাউন্ডটাও পরের জন্য তুলে রাখলাম। একদিন এসে ভালো করে কেল্লা দেখব, যদি দেখতে দেখতে অন্ধকার নামে তাহলে শো দেখে বাড়ি যাব।
DeleteKichu mone korben na, probol hingsha holo. Bhalo achen delhi te, sara bharot er khabar khachen ar tar upor emon mon kara chobi ar lekha. Porle i amar khide paye jai.
ReplyDeleteহাহা ঘনাদা, না না মনে করার কিছু নেই। আমারও আপনাকে দেখে হিংসে হয় তো, কেমন সুন্দর ঝকঝকে একটা দেশে থাকেন, ঘাম হয় না, সপ্তাহের এ মাথা ও মাথায় রাস্তায় কারও সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে হয় না।
Deletebhalo hoeche lekhata,borabor e hoy.khabar er chobi gulo o darun.oi dharoner pure desi coffee tumi e bay te pabe.alada alada daam er ache.tobe se banano hapa ache.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। লেখা, ছবি ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। ওই কফিগুলো যদি ফিল্টার পদ্ধতিতে বানানোর কথা বলেন তাহলে হ্যাপা বিশেষ নেই। কারণ আমাদের বাড়িতেও ফিল্টার কফির ব্যবস্থা চালু করেছি বেশ কিছুদিন হল। একেবারে দক্ষিণী কায়দায়। তবে আমাদের কফি অত মহার্ঘ নয়, সাধারণ ব্লেন্ড।
DeleteKhub bhalolaglo lekhata. Sakalbelay kemon khidhe khidhe peye gelo ar ki :-P
ReplyDeleteহাহা, ধন্যবাদ, সায়ন।
Delete" বক কিংবা কচ্ছপ, বকচ্ছপের থেকে দুটোই আমি বেশি পছন্দ করি। শুনতে হলে আমি হয় ক্ল্যাসিকাল শুনি, নয় ফোক, নয় রক, কোক স্টুডিও শুনি না। "
ReplyDeleteএক্কেবারে আমার মনে কথাটি বললেন| আমিও ঠিক এই কারণেই কোক ষ্টুডিও থেকে দূরে থাকি | কেমন যেন মনে হয় সব বড় বেশি নিখুঁত, খুব অস্বস্তিদায়কভাবে ভালো| সব সিনেমার সেট-এর মতন, যেখানে লোকে আসে যায় , কিন্তু রাতে থাকে না, সকালে উঠে ঘুমচোখে দাঁত মাজতে মাজতে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে না|
আর শুধু কোক ষ্টুডিও না, যেসব রেস্টুরেন্টের বাইরে 'মাল্টি-ক্যুইজিন' লেখা থাকে সেগুলোও ওই হাতিমি ভেবেই এড়িয়ে যাই|
ও, কিন্তু আমার তো কোক স্টুডিওকে নিখুঁত কিংবা ভালো, দুটোর একটাও মনে হয় না। আমার জাস্ট খারাপ লাগে।
Deleteএবার থেকে খেয়াল রাখতে হবে, কখনও, বিকেল–সন্ধে নাগাদ, খিদের মুখে অবান্তর পড়তে আসবো না! :)
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, শীর্ষ।
DeleteNah, khidher mukhe abantor pora chharte hobe dekhchhi. Jemon sundor lekha temoni sundor chhobi. Asadharon hoyechhe.
ReplyDeleteApnar sabandani kenar galpo pore nijer ekta abhigyota mone pore gelo. Deshe ekjonke gift korbo bole IKEA theke uncommon design er cup dish kine bari firey dekhi lekha "Made in India". Chinese ra deshe kikore gift niye jaay kejane?
ধন্যবাদ, ধনব্যয়াদ, সুগত। চাইনিজদের বিড়ম্বনাটা আমি আগে ভেবে দেখিনি, সত্যি ভাবার মতই ব্যাপার।
DeleteSotti , ei lekhar post gulo amar janye ekta torture...... Ki bhalo bhalo khabar re........ Khub khete icche korche...
ReplyDeleteভালো, তবে বাড়ির খাবারের থেকে ভালো না, বিশ্বাস কর, ভট্টা।
Deleteপ্রতিবার একটা নতুন খাবারের জায়গার কথা শুনি আর wish list এ লিখে রাখি... এটায় খেতে হবে ... কিন্তু sarvana bhavan নামটা পড়েই মনে হল ... এটা চেনা ... প্রায়ই খাই ... আর cafe lota টা list এ add হল ... তোর লেখা গুলি খাবার গুলিকে আর লোভনীয় করে তোলে
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, বৈশালী। তোদের পাড়াতেও সারাভানা ভবন আছে বুঝি? ভেরি গুড।
DeleteProthomei boli je apnar lekhoni boro sundar---aar Abantor pora shuru korar por "delhi giye kothai khabo" er list hoo-hoo kore barchhe.
ReplyDeleteSatti proti saptahe ekhon arekta kaaj to do list-e jog hoyechhe seta holo Abantor pora.
tabe oi restaurant repeat na korar byaparta besh mojar---amar-o khub bhalo laage bibhinno khabar khete. kintu emon ekta jaigai thaki jader cuisine thik amader jwibh er pokkhe akorshoniyo noi. tai sab restaurant ei tar ekta abhas chale aase.
থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। অবান্তরের অভ্যেস দীর্ঘজীবী হোক, এই কামনা করি।
Deleteজানা ছিলো না । ধন্যবাদ
ReplyDeleteইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
Deleteজবরদস্ত লেখা।. আর অভিনব সব খাবার বটে! পালং পাতা বেসনে ডুবিয়ে ভাজা , আপেলের জিলিপি, বাপরে!
ReplyDeleteখাবারগুলো সত্যি খুব ভালো ছিল, কাকলি।
Delete