আসাম ৮ (শেষ পর্ব)/ শিবসাগর




কাজিরাঙ্গা থেকে জোড়হাট যাওয়ার পথে বোকাখাত বাসস্ট্যান্ডে প্রথম দেখেছিলাম ব্যাপারটা। এক হাত বাই এক হাত একটা চাকা লাগানো বাক্স। বাক্সের ওপর মশলাপাতি মুড়ি চানাচুরের শিশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক। দেখে মনে হচ্ছে ঝালমুড়ি বানানো হবে, কিন্তু স্টিলের গভীর কৌটো কই? চকচকে বড় চামচ কই? জানালা দিয়ে মুখ বার করে চেঁচিয়ে একটা অর্ডার করলেই রহস্যভেদ হয়ে যেত, কিন্তু চল্লিশ মিনিট আগে গলা পর্যন্ত ভর্তি করে রুটি তরকারি খেয়ে বেরিয়েছি। এমন সময় একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল। বিক্রেতা একটা চৌকো কাগজের টুকরো বার করলেন, তার ওপর উপকরণসমূহ ঢাললেন, তারপর কাগজের টুকরোর কোণাকুণি দুটি প্রান্ত ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। একটি মুড়িও বাতাসে উড়ে গেল না, একটি ছোলাও ছিটকে বাসস্ট্যান্ডের ধুলোতে পড়ল না। ঝাঁকানো শেষে কাগজের টুকরোর কান ধরে পেঁচাতেই ব্যাপারটা একটা চোঙা হয়ে গেল। আমি ভাবলাম ম্যাজিকের এখানেই শেষ। কিন্তু ছেলেটা চোঙা হাতে নিয়ে দশ টাকার একটা নোট বিক্রেতার হাতে দিয়ে কী একটা বলল। ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বাক্সের এক ধারে রাখা চানাচুরের শিশির পাশে হাত চালিয়ে একটা জিনিস বার করে আনলেন। এটাও একটা কাগজের টুকরো, তবে চোঙার কাগজের থেকে শক্ত, আর সাইজেও মোটে দুইঞ্চি বাই দুইঞ্চি। ছেলেটা এই দ্বিতীয় কাগজের টুকরোটা চামচের মতো ব্যবহার করে মুড়ি খেতে খেতে চলে গেল।

শিবসাগরের ধারে সেই চাকাওয়ালা বাক্স দেখে আমি আর দেরি করলাম না।

হলংগাপার বন দেখে, একটা অসামান্য লাঞ্চ করে আমরা শিবসাগর এসে পৌঁছেছি প্রায় সন্ধ্যে নামার মুখে। আই এস বি টি থেকে ব্যাটারি অটোতে চড়ে এ টি ডি সি-র 'প্রশান্তি'তে এসে নেমেছি। প্রশান্তি-র ঠিক মুখোমুখি প্রকাণ্ড শিবসাগর। সাগরও বলতে পারেন, বড়পুখুরিও বলতে পারেন।

তখনও খানিকটা আলো বাকি ছিল, তাই আমরা সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময়েই দিঘির ধারের রাস্তায় ব্যারিকেড দেখে আর মাইকে ঘন ঘন ঘোষণা শুনে বুঝেছিলাম একটা কিছু ঘটছে। বেরিয়ে বুঝলাম ব্যাপারটা কী। আন্তর্জেলা রোয়িং প্রতিযোগিতা। রোয়িং প্রতিযোগীদের মাবাবারা সব আমাদের পাশের ঘরগুলোতেই উঠেছিলেন। রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে আর ঘুম থেকে উঠে আমরা ঘাপটি মেরে ওঁদের কথাবার্তা শুনতাম। শুনে শুনে যতটুকু ভাষা শেখা যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ রোয়িং দেখে, ঝালমুড়ি খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। শিবসাগরের পাশেই উঁচু উঁচু চুড়োওয়ালা তিনখানা মন্দির। মাঝখানের সবথেকে উঁচু মন্দিরটি হল শিবদল। শিবদলের একদিকে বিষ্ণু অন্যদিকে দেবীদল, অর্থাৎ দুর্গার মন্দির। অষ্টাদশ শতকের প্বারথমার্নিধে এই সব মন্দির বানিয়েছিলেন অহোম রাজা শিবসিংহের দ্বিতীয় স্ত্রী অম্বিকারানী। অম্বিকারানী করিৎকর্মা মহিলা ছিলেন। আগের পোস্ট যদি আপনাদের মনে থাকে তাহলে মনে পড়বে, উদ্যোগ করে গজেন্দ্রচিন্তামণি বই লেখানোর পেছনেও ছিলেন এই অম্বিকারানীই।

দলের উঁচু বিস্তৃত বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে শিবসাগর শহরের চলাচল দেখতে দেখতেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। আমরা গেস্টহাউসে ফিরে এসে লেপের তলায় ঢুকলাম। এ গেস্টহাউসের ভাড়া শুনে আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি, ভেবেছি শুরুর একটা এক ভুলক্রমে বাদ পড়েছে বুঝি। তারপর দেখলাম ভুল কিছু হয়নি, ভাড়া সত্যিই অত কম। কিন্তু কম কেন? বাথরুমে আলোবাতাস গিজার আছে, ঘরে দুখানা খাট, চেয়ার টেবিল, ড্রেসিং টেবিল আছে, ড্রেসিং টেবিলের পাশে সুন্দর পর্দা টানা বড় বড় জানালা আছে, জানালার ওপাশে চওড়া বারান্দা আছে, বারান্দায় শক্তপোক্ত কাঠের (গদি ছেঁড়া) চেয়ার আছে, চেয়ারের সামনে যত্ন করা ফুলের বাগান আছে, ফুলের বাগানের পর পাঁচিল আর শান্ত ঝকঝকে রাস্তা পেরিয়ে বিরাট দিঘি আছে। তাহলে ভাড়া কম হওয়ার কারণ কী?

কারণ ঘরে টিভি নেই।
                        
আমরা অবশ্য ঘাবড়াইনি। কারণ এই প্রথমবার আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম নিজেদের বিনোদন নিজেদের ট্যাঁকে পুরে। কাজিরাঙ্গায় রাতে শুয়ে শুয়ে আমরা দেখেছিলাম সিক্রেট লাইফ অফ ওয়াল্টার মিটি, মাজুলিতে ক্লান্ত থাকায় কিছু দেখা হয়নি, জোড়হাটে কোন সিনেমা দেখেছিলাম এখন আর মনে নেই, শিবসাগরে আমরা দেখলাম পাতালঘর। আগে দেখা, তবু আবার দেখলাম।

পরদিন সকালে গেস্টহাউসেরই চেতিয়া সাহেবের গাড়ি করে সাইট সিয়িং-এ বেরোনো হল। শিবসাগরের দেখার জিনিস প্রচুর। বেশিরভাগই অহোম রাজাদের ইতিহাসের অংশ। ষোলশো নিরানব্বই থেকে সতেরোশো অষ্টাশি পর্যন্ত শিবসাগর ছিল তাঁদের রাজধানী। প্রথমেই এল রংঘর। সতেরোশো চুয়াল্লিশ সালে অহোম রাজা প্রমত্ত সিং-এর আমলে এই রং ঘর তৈরি হয়। এই ঘরের দোতলায় বসে রাজারানীরা সামনের মাঠে মোষের লড়াই, লাঠি খেলা দেখতেন। রং ঘরের নৌকোর মতো ছাদটা খেয়াল করুন।


আমাদের দ্বিতীয় স্টপ জয়সাগর। মা রানী জয়মতীর উদ্দেশ্যে এই সাগর কাটিয়েছিলেন রাজা রুদ্রসিংহ। রানী জয়মতী ভয়ানক বীর ছিলেন। তাঁর আমলে অহোম বংশে সিংহাসন দখলের মারামারি বেধেছিল। রানীমার বর ছিলেন গদাধর সিংহ, যিনি তকালীন রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। গদাধর সিংহের খবর বার করার জন্য তৎকালীন রাজা রানী জয়মতীকে বন্দী করে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। কিন্তু রানী মুখ খোলেননি। চোদ্দ দিন পরে অত্যাচারের চোটে রানী মারা যান। বিপ্লব সফল হয়। গদাধর সিংহ রাজা হন। গদাধরের ছেলে রুদ্রুসিংহ মায়ের স্মৃতিতে, যেখানে মা শেষনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সেখানেই জয়সাগর দিঘি খনন করেন। তিনশো আঠেরো একরের এই দিঘিটি খোঁড়া হয়েছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনে। অনেকে বলে মানুষের খোঁড়া এত বড় দিঘি নাকি ভারতবর্ষে আর নেই।


সাগর থাকলেই দল থাকবে। এই হচ্ছে জয়সাগরের তীরে জয়দল। এও রুদ্রসিংহের আমলে তৈরি। 


এই চমৎকার ছোট্ট বাড়িটি ঘনশ্যামের। ঘনশ্যাম শুরুতে ছিলেন ঘিয়াসুদ্দিন। তিনি ছিলেন জয়সাগর আর জয়দলের প্রধান কারুকৃৎ।


জয়সাগরের পর তলাতল ঘর। ঘর মানে অবশ্য প্রাসাদ। এ প্রাসাদও প্রথম বানিয়েছিলেন রুদ্রসিংহ। মাটি, কাঠ, ও আরও নানারকম স্থানীয়, সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে। পরে রাজেশ্বর সিংহ এসে ইটপাথর ব্যবহার করে প্রাসাদ বড় করেন। তলাতল নাম কারণ এই প্রাসাদের তলে তলে অনেক তলা ছিল। মাটির ওপর তিন তলা, মাটির নিচে চার। ওপরের তলাগুলো কাঠ মাটি দিয়ে বানানো হওয়ায় এখন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। মাটির নিচের তলাগুলোতেও আপাতত টুরিস্টদের জন্য বন্ধ।


শিবসাগরের আগে প্রায় চারশো বছর ধরে অহোম রাজাদের রাজধানী ছিল শিবসাগর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরের গড়গাঁও। উঁচু 'আদরণী' গেট পেরিয়ে চেতিয়া সাহেবের গাড়ি গড়গাঁও-এ ঢুকল। এখানে আমরা দেখব কারেং ঘর। কারেং ঘরও প্রথম বানানো হয়েছিল কাঠ মাটি দিয়েই। রাজেশ্বর সিংহের পূর্বপুরুষের কীর্তি রক্ষার জন্য তৎপর ছিলেন বোঝা যায়। তলাতল ঘরের মতো কারেং ঘরেরও বর্তমান ইটপাথরের পাকা কাঠামো তাঁর অবদান।


শিবসাগরের শেষ দ্রষ্টব্য চরাইদেও। প্রায় ছশো বছরের অহোম সাম্রাজ্যের শুরু হয়েছিল এই চরাইদেও-তে। অধুনা চিনের ইউনান প্রদেশের অন্তর্গত এক আঞ্চলিক রাজপরিবারের ছেলে সুকাফা পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে নতুন রাজ্যের খোঁজে পথে বেরিয়েছিলেন। অনেক ঘুরে অবশেষে চরাইদেও-তে এসে তিনি তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন বারোশো তিপ্পান্ন নাগাদ। এখন সে রাজধানীর কোনও চিহ্নই আর বাকি নেই। যেটুকু আছে তা হল অহোম রাজাদের সমাধি।

চরাইদেও-এ একসময় দেড়শোরও বেশি অহোম রাজারানীর সমাধি ছিল, কমতে কমতে তাদের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে তিরিশে। ঘাসে ঢাকা ছোট পাহাড়ের মতো সমাধিগুলো দেখলে মিশরের পিরামিডের কথা মনে পড়ে। এসময় এসবদিকে মেলার সিজন। তলাতল ঘর, কারেং ঘরের বাইরে দেখেছিলাম, চরাইদেওয়ের বাইরের মাঠেও দেখি বাঁশটাশ পুঁতে, ত্রিপল খাটিয়ে মেলার আয়োজন হচ্ছে। কিছু দোকান অলরেডি বসে গেছে। মেয়েদের চুড়ি হার দুলের দোকান, ছোটদের খেলনা বল আর বন্দুক, আর খাওয়ার দোকান। আমি আর অর্চিষ্মান মিল্ক কেক দিয়ে চা খেলাম। চেতিয়া সাহেব ভাত আর গাহরির মাংস (পর্ক) দিয় মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলেন। আমাদেরও ডেকেছিলেন, কিন্তু আমাদের মতলব অন্য ছিল, সে কথায় পরে আসছি।

শিবসাগরের সাইট সিয়িং-এর লিস্টে যা যা থাকে তার সবকটাই আমাদের কভার করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা শুরুতেই চেতিয়া সাহেবকে বলে রেখেছিলাম যে আমাদের একটা বাড়তি জায়গা দেখাতে হবে। সেটা হচ্ছে দিসাংমুখ। দিসাং আর দিখো, শিবসাগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দুই প্রধান নদী। যেখানে গিয়ে তারা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিশেছে সেই জায়গাদুটির নাম হয়েছে যথাক্রমে দিসাংমুখ আর দিখোমুখ।

আসামের সুন্দর সুন্দর রাস্তার কথা আগেও বলেছি। চরাইদেও থেকে দিসাংমুখ যাওয়ার রাস্তাটা দেখেও চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার একপাশে ক্ষেত, আরেকপাশে সরু খাল, খালের ওপাশে বাঁশের ছোট ছোট বাড়ি। মাটির উঠোনে নীলকমলের রঙিন প্লাস্টিক চেয়ার পেতে নারীপুরুষ বসে আছেন। তাঁদের খোলা পিঠে, তেল মাখা লম্বা চুলে রোদ এসে পড়েছে। সে সব বাড়ি থেকে একেকটা ছোট বাঁশের সাঁকো খাল পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে মিশেছে। ভাবুন একবার, শুধু নিজের বাড়ি আর লাগোয়া বারান্দা পেলেই আমি বর্তে যাব, আর এঁরা কি না একেকটা নিজস্ব সাঁকো বাগিয়েছেন।

আমরা দুজন রাস্তার সৌন্দর্য নিয়ে আহাউঁহু করছি শুনে চেতিয়া সাহেব দেখি খুব হাসছেন। বললেন, এই রাস্তার নাম কী জানেন? ধোদার আলি। ধোদা মানে কুঁড়ে, আর আলি মানে পথ। অর্থাৎ কি না কুঁড়েদের বানানো পথ। দেশের কুঁড়েদের কাজে লাগানোর জন্য রাজা গদাধর সিংহের মাথায় একটা ফন্দি আসে (ইনিই হচ্ছেন বীর জয়মতীর স্বামী)। তিনি ঘোষণা করেন রাজ্যের সব কুঁড়েকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। কুঁড়েরা সব বসে বসে খাওয়ার সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে রাজবাড়ির সামনে লাইন দেয়। তখন রাজা তাদের ধরে রাস্তা বানানোর কাজে লাগিয়ে দেন। তৈরি হয় দুশো এগারো কিলোমিটার দীর্ঘ ধোদার আলি।


দিসাংমুখে অনেককিছু করতে যাওয়া যায়। মিশিং উপজাতির লোকেরা ওখানে বাসা বেঁধে থাকেন, তাঁদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখতে হলে, বা ঝাঁক বেঁধে আসা পরিযায়ী পাখিদের দেখতে হলে আপনি দিসাংমুখ যেতে পারেন। আমরা অবশ্য সেসব কিছু ভেবে যাইনি। আমাদের যাওয়া একেবারেই নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়ার মতো করে যাওয়া। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা আড়াইটে বেজে গেছে, নদীর ধারে পিকনিক পার্টিদের লাঞ্চ তুঙ্গে। তারস্বরে হিন্দি গান বাজছে, দুয়েকটা নোংরা শুয়োর খাবারের লোভে লালনীল ছাউনির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। একটা ছাউনি থেকে একবালতি জল উড়ে এসে একটা শুয়োরকে আগাপাশতলা ভিজিয়ে দিল। শুয়োরটা গা ঝেড়ে ধীর লয়ে হেঁটে গিয়ে পরের ছাউনির সামনে দাঁড়াল। আশেপাশে অপেক্ষারত এস ইউ ভি-র আড়ালে দুচারজন  বোতল খুলেও বসেছেন দেখলাম। দেখেটেখে আমাদেরও ক্ষিদে পেয়ে গেল, আমরা চেতিয়া সাহেবের গাড়িতে উঠে পড়লাম। মিশিং গ্রামের ভেতর দিয়ে আবার ফিরতি পথে শিবসাগর টাউন, যাওয়ার পথে (আর ইন্টারনেটেও) সেখানে স্কাই শেফ নামের ঝকঝকে হোটেল দেখে রেখেছি, সেখানেই আমরা খাব।

স্কাই শেফ ভয়ানক কায়দার রেস্টোর‍্যান্টকালো দরজা, এয়ারকন্ডিশনিং, ঝাড়লন্ঠন, ইউনিফর্ম পরা পরিবেশক, টাই বাঁধা ম্যানেজার। মোগলাই, চাইনিজ সবরকম খাবার পাওয়া যায়, আমরা কোনরকম খেয়েছিলাম মনে নেই। যেটা মনে আছে সেই ঘটনাটা আপনাদের বলি। সাজসজ্জার সঙ্গে মানানসই একটা প্রকাণ্ড ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি স্কাই শেফের দেওয়ালে লটকানো ছিল। অর্চিষ্মান সেটা দেখা মাত্র দৌড়ে গিয়ে এমন একটা সিটে বসে পড়ল যেটা থেকে টিভিটা সোজাসুজি দেখা যায়। অগত্যা আমি পাশের চেয়ারটায় বসলাম। অবশ্য দেখার মতো কিছু হচ্ছিলও না। তার ওপর আমরা যতক্ষণ খাচ্ছিলাম ততক্ষণ একজন পরিবেশক রিমোট দিয়ে ক্রমাগত টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছিলেন। টুকরো টুকরো নানারকম খবর, গানের লাইন কানে আসছিল। এই শুনলাম আলফা নেতা অনুপ চেতিয়া গুয়াহাটি জেল থেকে জামিন পেয়েছেন, আবার শুনলাম একজন সাংবাদিক কোন এক নদীর ধারে গিয়ে একপাল পিকনিকরত কলেজের ছাত্রীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। এই রকম হতে হতে হঠা এমন একটা জিনিস কানে এল যে আমি একেবারে ছিটকে উঠে বসলাম।

আমার চকিত পরিবর্তন আমাদের পরিবেশকের চোখ এড়ায়নি। তিনি রিমোটচালকের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললেন,র রতারপর আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়ে আপলোগোকা গানা হ্যায় না?” আমরা ঘাড় নাড়লাম। টিভি ওই চ্যানেলেই থেমে রইল। আমরা যতক্ষণ ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করলাম, খাওয়ার পর আরাম করে চা খেলাম, সংগীত বাংলা আমাদের সঙ্গ দিল। চলে আসার সময় পরিবেশক হাসিমুখে দরজা খুলে দিলেন। আবার আসবেন। সে আর বলতে। এমন সুন্দর আকাশবাতাস নদী পাখি গণ্ডার হাতি আর এমন ভালো মানুষদের দেশে বার বার ফিরে আসতে হবে বইকি।

আমাদের আসাম বেড়ানোর গল্প এখানেই শেষ। এখনও একটা রাত বাকি আছে, তবে সেটুকু শুধু ছুটি ফুরিয়ে গেল ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলার জন্য। পরদিন সকালে উঠে আই এস বি টি থেকে বাস ধরে যাওয়া হবে ডিব্রুগড় এয়ারপোর্ট। আড়াইঘণ্টার পথ। যেতে লাগবে প্রায় সাড়ে তিন। শেষ আধঘণ্টা প্লেন মিস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমাদের হাতপা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকবে। যদিও প্লেন মিস হবে না। প্লেনের জানালা দিয়ে হিমালয়ের বরফ ঢাকা চুড়ো দেখতে দেখতে দিব্যি দিল্লি পৌঁছে যাব। ফিরে আসার পর আরেকটা বিচ্ছিরি অ্যাডভেঞ্চার অবশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু তখন সে সব কিচ্ছু টের পাইনি। তখন সারা মনপ্রাণ জুড়ে কেবল আসামের শান্তি। 





Comments

  1. অতি উত্তম। আগেও বোধহয় বলেছি, আপনার লেখা মনের জানালা খুলে দেয়। জোড়হাট, মরিয়ানি, শিবসাগর আমার চষে বেড়ানো। নিমাতিঘাটের খুব কাছেই আমার অফিস ছিল, আমার কাকা ছিলেন মরিয়ানি কলেজের বাংলার অধ্যাপক, আমার সবচেয়ে বিটেল বন্ধুর বাড়ি বোকাখাত, আস্ত এক বোতল হুইস্কি খেয়ে শিবসাগর থেকে জোড়হাট একবার বাইক চালিয়ে এসেছিলাম। হুইস্কিটা কেনা হয়েছিল দাস অ্যান্ড কোং দোকান থেকে, যার উল্টোদিকের একটা দোকানে আপনারা অসমিয়া থালি খেয়েছিলেন, হাঁস এবং মুরগি সহযোগে। সেই সময় অরণ্য-ই ছিল কাজিরাঙার সবচেয়ে ভালো থাকার জায়গা, ইদানীং শুনি ল্যান্ডমার্ক উডস বা গ্রিনভিউ গোছের প্রচুর খুলেছে।
    আপনাদের হানিমুনে শিলং, তারপর এবার বহু বছর পর আপনার চোখ দিয়ে আবার আসামকে দেখলাম। থ্যাংক ইউ।
    পুনশ্চঃ দৌল কথাটা বোধহয় দেবালয়ের অপভ্রংশ। অসমিয়ারা বেজায় তাড়াতাড়ি কথা বলে, এই একটা ব্যাপারে লাহে লাহে খাটে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক, একটা ব্যাপারে অন্তত লাহে লাহের করাল হাত এড়াতে পারা গেছে জেনে শান্তি পেলাম দেবাশিস। আপনার চেনা জায়গাগুলো আমরাও দেখে এসেছি জেনে ভালো লাগছে। লেখা ভালো লেগেছে জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  2. Khub bhalo laglo pore. Eyi choto choto jayega gulor kotha keu lekhena, jaye o na. Jodi konodin Assam jai tomar post gulo e refer korbo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সময় পেলে আসাম একবার ঘুরে এস, শর্মিলা। মনে হয় ভালো লাগবে।

      Delete
  3. Replies
    1. ধন্যবাদ, চুপকথা।

      Delete
  4. chhobigulo chamotkar hoechhe , beranor galpo to darun hoeichhe. Assam er lokjoner shantipriyota khub mone dhorechhe. bhabchhilam kolkata sahorta jodi oirakom hoto... mane lokjon ototai shantipriyo hoto...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা। আমারও ওই শান্তিটা খুব ভালো লাগে, ইন ফ্যাক্ট আসামের ওটাই সবথেকে ভালো লাগে।

      Delete
  5. chomotkar asam brhomon holo , kajiranga, kamakhya mondir , cha bagan er baire asam er kono dharonai chilo na . Thank you :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  6. khub sundor chobigulo,jhalmurir bepartao interesting besh

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঝালমুড়িটা চমৎকার খেতে ছিল, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  7. anyo rokom berano..tourist spot er baire jorhat, sibsagar, majuli sob bhishon bhalo laglo. assam hoyto ar jaoa hobena, tai tomar chokhe dekhe nilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমিও এবারেই কাজিরাঙ্গা গিয়েছিলে না, কাকলি? দেখা হয়ে গেলে কী ভালো হত।

      Delete
    2. তাই তো বলছিলাম! পাশের জীপ্ এ তোমায় দেখলে আমি হয়ত জীপ্ থেকে পরেই যেতাম - তোমার fan তো তাই :) বাড়ির সবাই কেও তোমার কথা বলেছি।
      আমরা কাজিরাঙ্গা , মানস আর ভালুক্পং ঘুরে এলাম। কাজিরান্গায় গন্ডার হাতি ইত্যাদির থেকেও বেশি ভালো লেগেছে অসাধারণ সব পাখি, নীলকন্ঠ পর্যন্ত!

      Delete
  8. oitihasik bornona khub bhalo laglo :) Bratati

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ব্রততী।

      Delete
  9. mone hocche eita aro cholte thakle bhalo hoto..

    ReplyDelete
  10. sorbonash. moner radio?
    Ahom(?) Raja der Pyramid er moto somadhi hoto ei funda ta shune khubi chomotkrito holam. Enader religion ta ki chhilo? sotti, ghurte berole koto ki shekha jaye.

    ReplyDelete

Post a Comment