রকস্টার হলে



'আমি তোর জন্য এত চিন্তা করি বাট ইউ ডোন্ট লাভ মি।' 

বাড়ি নেব তখনও ঠিক হয়নি, প্রথমবার দেখতে যাচ্ছি। মোড়ের মাথার বাড়ির ভদ্রমহিলা দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন। 

বাড়ি নেব কনফার্ম হওয়ার পর এজেন্টদাদা বললেন সকালবিকেল জলের পাম্প চালানোর নিয়মকানুন বোঝানোর ক্লাস নেবেন। দিন ঠিক করে অফিস থেকে বেরিয়ে মিট করে আসছি দুজনে। পাশের বাড়ির গেট খুলে ফোন কানে একজন বেরিয়ে এলেন। 

'কফ বেরোচ্ছে? সাদা না ঘোলাটে? বলছি কফ সা-দা না ঘো-লা-টে?'

আগের পাড়াদুটোয় পাশের বাড়ির লোককে রাস্তায় দেখলে চেনার উপায় ছিল না। সবার দরজা পাটে পাটে বন্ধ, জানালার ডান বাঁ ওপর নিচ ব্ল্যাকআউট পর্দা টানটান। এই নতুন পাড়ায় সবাই কেমন খোলামেলা, রাখঢাক নেই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনের কথা বলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে  ব্লাড রিপোর্ট রিডিং পড়ে শোনানো পাড়ায় বড় হওয়া কুন্তলা ইমপ্রেসড হয়েছিল। 

শিফটের পর ঘরভর্তি বাক্সপ্যাঁটরার মধ্যে বসে ভাবছি কোথা থেকে শুরু করব, আজ করব নাকি কাল করাটাই বেটার হবে, আজ বরং সিনেমা দেখে আসি, ভেবে বুকমাইশোর অ্যাপ খুলতে যাচ্ছি, এমন সময় 'মা কলিং'। 'হ্যালো, মা... হ্যালো...হ্যাঁ হ্যাঁ বল...আমরা পৌঁছে গেছি, পোঁ-ও-ও-উ-ছে গে-এ-ছি... হ্যাঁ হ্যাঁ খেয়েছি, খে-য়ে-এ-এ ছি-ই-ই...হ্যালো, হ্যালো... 'বলতে বলতে টের পেলাম আমি আর ঘরের মধ্যে নেই। ফোন কানে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি। 

ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গলি পেরিয়ে মেনগেট খুলে রাস্তায় নেমে যেতে হয়েছে, তবে মা আমার কথা শুনতে পেয়েছেন, আমি মায়ের।

এই লাইনের বাড়িগুলোতে ফোনের নেটওয়ার্ক অকথ্য। ঘরের ভেতর, বিশেষ করে ভেতরের দিকের ঘরে থাকলে মোবাইল স্ক্রিনের বাঁদিকের ওপরের ত্রিকোণের সাদাটা কমতে কমতে ল্যাজের কাছে টিমটিম করে, অনেক সময় গোটা ত্রিকোণ খালি হয়ে গিয়ে পাশে ঢ্যাঁড়া পড়ে যায়। 

অর্থাৎ যতক্ষণ এ বাড়ির ভেতরে থাকব, সকালে কী খেলাম বিকেলে কী খাব জেরার মুখে পড়তে হবে না, বিজয়া ছাড়া আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ফোন করে নিয়মিত খবর দিই-নিই না কেন গঞ্জনা সইতে হবে না, রিওয়ার্ড মিলা হ্যায়, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর বাতাইয়ে-র চিটিংবাজির মোকাবিলা করতে হবে না, দুঃস্থ শিশুদের জন্য কাজ করা মানুষজনের জেনুইন আবেদনের উত্তরে, 'ভেরি ভেরি সরি' বলে ফোন নামিয়ে রাখার পর অলরেডি অষ্টাবক্র বিবেকের শূন্য দৃষ্টির সামনাসামনি হতে হবে না। 

'বল তো আমি কে? চিনতে পারছিস না? গেস গেস' খেলাটা আমাকে আর কখনও খেলতে হবে না, যতক্ষণ আমি এ বাড়ির ভেতর থাকব। এ বাড়ির চার দেওয়ালে মাথা কুটে নেটওয়ার্ক ফিরে যাবে, আমার গায়ে আঁচড়টি পড়বে না। 

***** 

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অনেকে অনেক কারণে ফ্যান। কেউ বব বিশ্বাসের 'নমস্কার, এক মিনিট' শুনে, কেউ হাতকাটা কাত্তিকের সপ্রতিভতা দেখে। হালের শবর দাশগুপ্তের চরিত্রেও ওঁকে ছাড়া আর কাউকে ভাবা শক্ত। কিন্তু আমি এ সবের কোনও কারণেই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের ফ্যান নই। শাশ্বত যদি এঁদের একজনও না হয়ে শুধু শাশ্বত হয়েই থাকতেন তা হলেও আমার ওঁকে পছন্দ হত। 

কারণ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় মোবাইল ফোন পছন্দ করেন না। কোনও এক ইন্টারভিউতে শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম, ওঁর মোবাইল ফোন নেই। কখনও ছিল না, এখনও নেই। যোগাযোগ করতে গেলে ল্যান্ডলাইন ভরসা। 

এতে পেশার ক্ষতি হয় কি না জানতে চাওয়ায় শাশ্বত অতি ভদ্র ভাষায় যে উত্তরটা দিয়েছিলেন সেটা প্যারাফ্রেজ করে বললে হয়, চব্বিশঘণ্টা 'অ্যাকসেসিবল' নই বলে যদি কাজ না জোটে তবে মুখে ঝাঁটা অমন কাজের। 

আপনি কাকে বলেন জানি না, আমি রকস্টার এঁকেই বলি।

মোবাইল ফোন যে সাক্ষাৎ শয়তানের অবতার সে নিয়ে আমার কোনওদিন কোনও ভ্রম ছিল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চার বছর হোস্টেলে থাকা হয়ে যাওয়ার পর মা আমাকে মোবাইল ফোন নিতে বললে আমি চেঁচামেচি করি এবং মায়ের ব্যক্তিত্ব আমার তুলনায় মিনিমাম একশোগুণ শক্তিশালী হওয়ায় অচিরেই হার মেনে মোবাইল ফোন নিই। চাকরিতে জয়েন করার সময় বাকি সব তথ্যের সঙ্গে আমার মোবাইল নম্বর দিতে বলা হয়। দিয়ে দিই। 

দেওয়ার আগে মনে কিছু প্রশ্ন জাগতে পারত। জাগা উচিত ছিল। 

আমাকে মাইনে দেওয়া হচ্ছে দিনে সাড়ে আটঘণ্টা অফিসে কাজ করার জন্য। কাজের কথা আলোচনার জন্য সে সময় যথেষ্ট বলেই আমার বিশ্বাস।  আর যদি এমারজেন্সি কিছু হয়, ইমেল তো আছেই। কাজেই আমার মোবাইল ফোন নম্বর নেওয়ার অফিসের কোনও কারণ থাকতে পারে না। 

এসব প্রশ্ন আমার মনে জাগেনি। কারণ এক, আমি রকস্টার নই। দুই, ওই সময় ফোন নম্বর কেন, চাকরি পেতে গেলে এক বোতল রক্ত দান করতে হবে বললেও আমি দিয়ে ফেলতাম। 

হ্যাঁ, সামান্য মনখারাপ হয়েছিল। আমি যে রকস্টার নই, সেটা বার বার প্রমাণ হতে দেখলে কারই বা ভালো লাগে।

কিন্তু মনখারাপ নিয়ে বাঁচা শক্ত। বিশেষ করে আমার মতো নন-রকস্টারদের পক্ষে। তার থেকে ঢের স্বস্তির আমার থেকেও যারা দুঃখে আছে তাদের কথা ভেবে নিজের দুঃখ ভুলে থাকা বা থাকার ভঙ্গি করা। আমি এমন টিমের কথা শুনেছি, যার অংশ হতে হলে বসের যে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট আছে সেখানে সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে বসের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে হয়। যাতে আমি কবে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি, কী খাচ্ছি, কী ভাবছি, কোন ইস্যুতে কোন পক্ষকে সমর্থন করছি এ সব বস আঙুলের ছোঁয়ায় জেনে নিতে পারেন। 

আমার কোনও সন্দেহ নেই, আমি যদি অমন বসের পাল্লায় পড়তাম এবং আমাকে যদি ওটা করতে বলা হত 'না' বলার সাহস আমার হত না।  সেটা যে আমাকে করতে হয়নি, মোবাইল ফোনে যখনতখন সাড়া দেওয়ার জন্য তৈরি থেকেই পার পাওয়া গেছে, সে জন্য আমি রোজ সকালে উঠে ভগবানকে থ্যাংক ইউ বলি।

*****

নেটওয়ার্কহীন বাড়িতে পায়ের ওপর পা তুলে থাকব ভেবে প্রথমটা খুব ফুর্তি হয়েছিল। তারপর কতগুলো হাড়হিমকরা সম্ভাবনা মাথায় এল।

যদি মাঝরাতে হার্ট অ্যাটাক হয়?
যদি ধূমকেতু মাথায় পড়ে?
যদি রাতদুপুরে ডাকাত এসে বেল বাজায়? 

নেটওয়ার্ক থাকলে দরজা খুলে দেওয়ার আগে পুলিশকে ফোনটা অন্তত করে রাখা যাবে। 

আট বছর আগে ব্রডব্যান্ডের যে প্ল্যানটা কিনেছিলাম, যেটা এখনও ব্যবহার করি, তাতে একটা ল্যান্ডলাইনের অপশন জোড়া ছিল গোড়া থেকেই। একটা ফোনই লাইফ হেল করার জন্য যথেষ্ট ভেবে আমি ল্যান্ডলাইন নিইনি। অর্থাৎ গত আট বছর ধরে আমার একটা ব্যক্তিগত ল্যান্ডলাইন ফোনের নম্বর আছে কিন্তু ফোন নেই।

গত সপ্তাহে অ্যামাজন থেকে একটা সস্তা দেখে ফোন কিনেছি। বাইরে থাকলে মোবাইলে আর ঘরে থাকলে ল্যান্ডলাইনে, আমি এখন চব্বিশঘণ্টা অ্যাকসেসিবল।

*****

চলতেফিরতে ফোনটাতে চোখ পড়লে একটা ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছে। কেমন হবে এখন থেকে কেউ কন্ট্যাক্ট নম্বর চাইলে যদি মোবাইলের বদলে ল্যান্ডলাইন নম্বরটা দিই? ফোননম্বর বলতে তো এককালে ল্যান্ডলাইন নম্বরই বোঝানো হত। নিজের ফোনে আমার নম্বর টুকতে টুকতে যতক্ষণে সে ব্যাপারটা টের পাবে ততক্ষণে আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, শেষ দৃশ্যে শবররুপী শাশ্বত যেমন ফেরান। ছবি স্লো মোশন হয়ে যায়, ঝম্পরপম্পর বাজনা বেজে ওঠে। বাকি সবাই ঝাপসা। বুকপকেট থেকে বার করে একটি অব্যর্থ ঝাঁকুনিতে ডাঁটির ভাঁজ খুলে চোখে পরে, পকেটে হাত পুরে দর্শকদের দিকে হাঁটতে শুরু করেন রকস্টার।

কিছু স্বপ্ন এ জীবনে পূর্ণ হওয়ার নয়। 



Comments

  1. নিজের মোবাইল না থাকলে অনেক সুবিধে। কিন্তু অন্যের কাছে মোবাইল ফোন না থাকলে মাঝে মাঝে বড় অসুবিধেয় পড়তে হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. একঘর অবজার্ভেশন।

      Delete
  2. এতে পেশার ক্ষতি হয় কি না জানতে চাওয়ায় শাশ্বত অতি ভদ্র ভাষায় যে উত্তরটা দিয়েছিলেন সেটা প্যারাফ্রেজ করে বললে হয়, চব্বিশঘণ্টা 'অ্যাকসেসিবল' নই বলে যদি কাজ না জোটে তবে মুখে ঝাঁটা অমন কাজের।

    আপনি কাকে বলেন জানি না, আমি রকস্টার এঁকেই ব

    Ekdam moner kotha. Ei smartphone er jomanai abosor bole kichhu nei. Sabsomoy at your service...aami er dwara bhishonbhabe asubidhei porechhilam. Office e without pay hoye chhuti niye phd thesis joma dichchi kolkatai. 6 maas just ghumoini...sathe NRI chhele je kothai kothai asustho hochche. Amar boss sarakhon phone kore eta seta jiggesh kore cholechhe office theke...ki je tanaporen ki bolbo...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, মোবাইল ফোন থাকা মানে উত্তর দিতে বাধ্য থাকা, সুস্মিতা।

      Delete
  3. "ওই সময় ফোন নম্বর কেন, চাকরি পেতে গেলে এক বোতল রক্ত দান করতে হবে বললেও আমি দিয়ে ফেলতাম। "eta ekkebare amar maner katha balechen.Landline er katha pare chotobelar kato gulo smriti mane chale elo.Jakhan pratham amader barite phone elo takhan j utsaho nie sabai k phone number die beriechilam tar sikivag utsaho nie o kauke ami amar notun mobile number di na ekhn.-Sunanda.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, একদম ঠিক সুনন্দা। ল্যান্ডলাইনের নম্বর দরাজ হাতে বিলোতাম বটে।

      Delete
  4. Amio Saswata ke khub ei pochhondo kori. Tomar karon gulo chhara arekta karone -- amra ek schoole porechhi. Obsooyo ek year noi.
    24 ghanta connected thaka oti joghnyo byapar.

    ReplyDelete
    Replies
    1. জঘন্য বটে, কিন্তু সামহাউ থাকা হয়েই যায়। বাধ্যতায় বা স্বেচ্ছায়।

      শাশ্বতর স্কুলের নাম জানতে কৌতূহল বোধ করছি, কোন স্কুল?

      Delete
    2. South Point High School, Kolkata

      Delete
  5. darun lekha. :)
    ekdom shotyi kotha, mobile phone thakar fol e jiboner onek anondo mati hoye gechhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অরিজিত। হ্যাঁ, অনেক কাজেও লেগেছে মানি। ফোন ছাড়া আমি এখন অফিস পৌঁছতে পারব না। কিন্তু যখন বসের ফোন আসে কিংবা যাকে এড়াতে চাই সে ফোন করে "আর কী খবর" জিজ্ঞাসা করে তখন মনে হয় সাক্ষাৎ শয়তানের দূত।

      Delete
  6. " চব্বিশঘণ্টা 'অ্যাকসেসিবল' নই বলে যদি কাজ না জোটে তবে মুখে ঝাঁটা অমন কাজের"
    মুশকিল হল, আমরা যারা শাশ্বতর মত অতিমানবিক প্রতিভার অধিকারী নই তারা বুক বাজিয়ে ওরকম বলতে পারি না :( আমাদের ওই এক বোতল রক্তই ভরসা :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটাতে পুরো একমত হতে পারলাম না, অন্বেষা। প্রতিভার থেকেও এই সব ব্যাপারে সাহস বেশি জরুরি মনে হয়। শাশ্বতরও নিশ্চয় নিজের কেরিয়ার নিয়ে সেই সব স্বপ্ন, ইনসিকিউরিটি আছে যা আমাদের বাকি সবার আছে। উনি আমাদের থেকে বেশি সাহসী বা কম লোভী বা দুটোর কম্বিনেশন। অন্তত আমি সে রকমই ভেবে নিয়েছি।

      Delete
  7. office er social site group,whatapp office,ei dhoroner dhong guli besh cholche ekhon,ki ar korbe

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই, প্রসেনজিৎ। কী আর করব, সকালবিকেল ভগবানকে ডাকব যাতে ওই চক্করে পড়তে না হয়।

      Delete
  8. saswata babu besh matir manush. onyo ekti sutre ekbar kotha bolechilam. kono star sulobh hab bhab nei, ekdom sadharon manusher moto. even jibonjatra o koren sadharon manusher moto. ar ekta byapar, onar stri jini english literature er shikkhika, tini kothar modhye khub kom english shobdo byabohar koren

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি জানতাম, শাশ্বত খারাপ লোক হতেই পারেন না। থ্যাংক ইউ, ঋতম। আমার জানাটা কনফার্ম করার জন্য। কথার মধ্যে ইংরিজি শব্দ বেশি ব্যবহার করার সঙ্গে সম্ভবত ইংরিজি বেশি জানার কোনও সম্পর্ক নেই, এটাও আমার সন্দেহ হত মাঝে মাঝে। সে ব্যাপারে আলোকপাতের জন্যও অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
    2. ar ekta byapar miss kore gechi. saswata babu besh jhorjhore bangla lekhen. nijer baba ke niye ekta lekha likhechilen , nam "tara rao joto alokborsho dure". besh bhalo lekha. rituparno ghosh sompadito robbare beriyechilo, 2008 nagad. tokhon sobe first year e uthechi. khuje pele upload kore debo kokhono

      Delete
    3. যাক, ঠিক লোককেই পছন্দ করেছি।

      Delete

Post a Comment