রঘুরাজপুর আর মঙ্গলাজোড়ি
মঙ্গলাজোড়ি যাওয়া ফাইন্যাল অবশেষে হল শুক্রবার সন্ধেবেলা স্বর্গদ্বারে বসে লেবু চা খেতে খেতে। শনিবার কোথাও একটা যাব সেটা জানতাম কিন্তু যাওয়ার জায়গাটা নিয়ে সংশয় ছিল। কোনারক দুজনেরই দেখা, দুজনেরই নন্দনকাননে অনাগ্রহ। নাকতলার বাবা মঙ্গলাজোড়ির খবর দিয়েছিলেন। চিলিকা হ্রদের উত্তরপ্রান্তের ছোট্ট গ্রাম। সাইবেরিয়া মংগোলিয়া এই সব জায়গায় এখন ঠাণ্ডাটা একটু বেশি তাই পাখিরা উড়ে উড়ে এসে জড়ো হয় মংগলাজোড়ির বিরাট জলাজমি। নলঘাসের বনের অলিগলি বেয়ে মঙ্গলাজোড়ির মিষ্টি জল চিলকার নোনতা জলের সঙ্গে মিশেছে সে ভুলভুলাইয়া নেটিভ, পরিযায়ী মিলিয়ে এই ক'মাস, নভেম্বর থেকে মার্চ, প্রায় নাকি তিন লাখ পাখির আখড়া। গত কয়েকবছরে কিছু বদমেজাজি পায়রা ছাড়া আর বিশেষ কোনও রকম পাখির সঙ্গে ওঠাবসা নেই, আমি তাও অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে ফিঙেটিঙে চিনতে পারি, অর্চিষ্মানের কাক পায়রা শালিক চড়ুই পার হলে সব পাখিই ডাইনোসরের বংশধর। কাজেই মঙ্গলাজোড়ি যদি যাই একটা নতুন জায়গায় যাওয়া হবে ভেবেই যাব। পুরীতে সারাদিন থেকেই বা কী করব।
যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা আছে। মঙ্গলাজোড়িতে বেস্ট পাখি দেখার সময় ভোর নয়তো সন্ধে। পুরী থেকে মংগলাজোড়ি গাড়িতে লাগে দু'ঘণ্টা কাজেই ভোর আউট অফ কোশ্চেন। সূর্যোদয় দেখব বলে দুদিন পিক আপ নিয়ে দুদিনই ফেল করছি, রাত দুটোয় পাখি দেখতে বেরোনর উদ্যম আমাদের থেকে আশা করা বৃথা। কাজেই বিকেলের স্লট টার্গেট করতে হবে।
তাহলে সকালে কী করব?
রঘুরাজপুর যাওয়া যায়। পথেই পড়বে। সেখানে পট্টচিত্র শিল্পীদের গ্রাম আছে, তাঁদের স্টুডিও দেখে, শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া ফার্স্ট হ্যান্ড পর্যবেক্ষণ করে মংগলাজোড়ির রাস্তা ধরা যায়।
আমি একেবারেই উৎসাহী ছিলাম না। কারণ এই নয় যে পট্টচিত্র সম্পর্কে আমার উৎসাহ নেই। চোখের সামনে শিল্পীদের শিল্পসৃষ্টি করতে দেখার অভিজ্ঞতাটাও যে অন্যরকম তাও জানি। কিন্তু এও জানি যে ওই দেখাটা আসল ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার শুরু হবে ওসব ঝামেলা ফুরোলে। বেচা এবং কেনা। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে খবর আছে, কেনানোর ঝুলোঝুলি লিজেন্ডারি। আমি বেচাকেনার বিরুদ্ধে নই। শিল্প যে ফাইন্যালি প্রোডাক্ট ইত্যাদি নিয়েও আমার সন্দেহ নেই কিন্তু মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, আমার সত্যিই পট্টচিত্র কেনার ইচ্ছে নেই। কারণ এক, দরকার নেই, দুই, যেগুলো পছন্দ হবে সেগুলো কেনার সাধ্য আমাদের নেই, তিন, চক্ষুলজ্জার খাতিরে যেগুলো কিনে আনব সেগুলো পড়ে পড়ে ধুলো খাওয়া ছাড়া আর কোনও উপকারে লাগবে না। তার ওপর গোটা ব্যাপারটায় ফোড়ন হবে অপরাধবোধ। একজন শিল্পী এমন সুন্দর জিনিস নিজে হাতে বানিয়েছেন, সেগুলো ঝেড়েবেছে, না দাদা পোষাচ্ছে না বুঝলেন, বলে উঠে আসার পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে ফেলতে চাই না। সাধ করে তো না-ই।
তবু মঙ্গলজোড়ি ফাইন্যাল হল যখন রঘুরাজপুর যাওয়াও ফাইন্যাল হল। চন্দনপুরের মোড় থেকে গাড়ি ঢুকল ডানদিকে। রাস্তা ঝপ করে সরু হয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর পথ আবার দু’ফালি, ডানদিকে রঘুরাজপুর নামের নিচে তীরচিহ্ন। গাড়ি নাকবরাবর চলেছে। ব্যাপার কী? লক্ষণ বললেন, চিত্র দেখবেন তো, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে চলুন, রঘুরাজপুরের থেকে ঢের ভালো করে দেখিয়ে দেবে সবকিছু। কী আর বলব। যেচে যন্ত্রে গলা দিয়েছি। নিয়ে চলুন যেখানে মন চায়।
গাড়ি একটা গলির মধ্যে ঢুকল। একটা সাদা রং করা ছোট বাড়ি থেকে একজন রোগা ভদ্রলোক এসে নমস্কার করে আমাদের নিয়ে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ঘরে। খালি ঘরের মাঝখানে মাদুর পাতা, একদিকে বসার বেঞ্চ, বাকি ঘর জুড়ে ভাঁজ করা তালপাতা, গোল পাকানো কাগজ ভর্তি। ঘরের লাগোয়া রোদ আসা বারান্দায় বসে তিনজন মেয়ে ডেস্কের ওপর তালপাতা রেখে তার ওপর কারিকুরি করছিলেন, পট্টচিত্রের কাজ শিখছেন। বারান্দার বাইরে একখানা মন্দির উঠেছে গা ঘেঁষে।
এই হচ্ছে তালপাতা। নিম হলুদের জলে চুবিয়ে শুকোনো হয়েছে পোকাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। চিত্র তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে একরকমের ছুঁচলো লোহার পেনসিলের আঁচড়ে পাতায় ডিজাইন আঁকা। নমুনা হিসেবে ভদ্রলোক একটা পাখি আঁকলেন। আঁকলেন মানে তিন চারটে টান দিলেন। আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, ঝট করে কিছু মাথায় এল না, তাই খুব সাধারণ একটা পক্ষী আঁকলাম আরকি। আমাকে তিন সেকেন্ডে একখানা পাখি আঁকতে দিলে যা কাণ্ড হত আর বললাম না।
তারপর উনি একটা বোতল থেকে কাজলের কালি গাছের আঠা মেশানো একটা তরল কাপড়ে ঢেলে পাখিটার ওপর ঘষঘষ ঘসলেন।
তারপর এমনি প্লেন জল দিয়ে পরিষ্কার করে মুছে দিতেই হয়ে গেল পট্টচিত্রের পাখি। সত্যিই ম্যাজিকের মতো।
তারপর উনি একটা বোতল থেকে কাজলের কালি গাছের আঠা মেশানো একটা তরল কাপড়ে ঢেলে পাখিটার ওপর ঘষঘষ ঘসলেন।
তারপর এমনি প্লেন জল দিয়ে পরিষ্কার করে মুছে দিতেই হয়ে গেল পট্টচিত্রের পাখি। সত্যিই ম্যাজিকের মতো।
এরপর যা হওয়ার তাই হল। উনি আমাদের ওঁর এবং ওঁর ছাত্রছাত্রীদের হাতে বানানো চমৎকার চিত্র দেখালেন, তালপাতার ওপর সে সব টানের সূক্ষ্মতা আমি কল্পনা করতে পারি না, আপনাদের ব্যাখ্যা করে বোঝানো তো ছেড়েই দিলাম। দশাবতার, রাসলীলা, গণেশ। ওইটুকুটুকু ছবির জায়গায় জায়গায় আবার ফ্ল্যাপের মতো করা, এপাশে ওপাশে আলাদা ছবি। দেশী সিল্কের ওপর আঁকা রঙিন ছবি, তার জৌলুস বিশ্বাস হয় না। মস্ত মস্ত কার্টন টেনে টেনে এনে ছবির পর ছবি বার করে আমাদের দেখাতে লাগলেন। এত সুন্দর সে সব ছবি, দেখলে কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তাই। এমনি এমনি তো চুল পাকেনি। যেটা চোখে লাগছে, সেটাই সাধ্যের বাইরে। বার বার বললাম, দেখাবেন না দাদা, আমরা সত্যিই পারব না। মিনিট চল্লিশ পর ওঁর বিশ্বাস হল। ভদ্রলোক অসম্ভব ভদ্র। বিরক্ত লাগছিল নিশ্চয়, তবু ব্যবহার একই রকম শান্ত রেখে পাশের ঘর থেকে আরেকটা বাক্স এনে বললেন, এইগুলো দেখুন তবে। নারকেলের খোলার গায়ে ঝলমলে রং দিয়ে আঁকা জগন্নাথের মুখ। দাম শুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু'খানা তুলে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছি এমন সময় ঝুমুর ঝুমুর। ওপরতলা থেকে নামছে দুই আড়াই হাত লম্বা বালিকা, ঝলমলে শাড়ি, চোখে কাজল, হাতে আলতার সূর্য, তেল চুকচুকে বয়েজ কাট চুলে ফুলের মুকুট। সেজেগুজে কনফিডেন্স তাদের তুঙ্গে, তাড়াতাড়ি সাইড দিলাম। অর্চিষ্মান গত বেশ কিছুদিন ওডিশায় ঘোরাঘুরি করছে, বলল, গোটিপুয়া নাচ হবে বুঝি? পাশের ঘরে অনেকক্ষণ ধরে বিদেশী গলা পাচ্ছিলাম, তাঁদের জন্য পারফরমেন্সের ব্যবস্থা হয়েছে। অর্চিষ্মানও নাকি সে নাচ দেখেছে। দেখার মতো নাকি ব্যাপার। সে অবশ্য শিল্পীদের দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল।
গাড়িতে ওঠার পর লক্ষ্মণ বললেন, আবার রঘুরাজপুর যাবেন নাকি? আমরা বললাম, না ভাই আজকের মতো নেগোশিয়েশনের কোটা শেষ, আপনি বরং এবার সোজা মঙ্গলাজোড়িই চলুন। লক্ষণ বললেন, সেই ভালো, দেরিও হয়ে যাবে। চন্দনপুরের মোড়ে এসে ডানদিকে বাঁক নিয়ে ঘুরল আমাদের গাড়ি।
নিরাকারপুর, শ্রীমুকুন্দপুর এই রকম চমৎকার চমৎকার সব নামের জায়গা পেরিয়ে গাড়ি চলল। একটা একটা বড় লোকালয় আসে, আর আমরা জানালা দিয়ে যতখানি সম্ভব জায়গাটা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করি। এই জায়গাগুলোয় কখনও বেড়াতে আসা হবে না, কাজেই এই সুযোগ। এখানে নৃত্যগীত অ্যাকাডেমির বেশ প্রচলন আছে দেখলাম। আর দেখলাম মানুষ, গরু, ফুচকার গাড়ি, চায়ের দোকান, শাকসবজির বাজার। সে সব বাঁধাকপি বেগুনের সতেজতা দেখলে সি আর পার্কের কপি বেগুন লজ্জা পাবে। বসতির মাঝে মাঝে দীর্ঘ রাস্তা জুড়ে দুদিকে নিচু ক্ষেত, জলে ভর্তি। নাকি সব জুলাই মাসের বন্যার জল, এখনও নামেনি। বারদুয়েক চা খেয়ে চিপস কিনে মঙ্গলজোড়ি পৌঁছলাম বেলা আড়াইটে নাগাদ।
মংগলাজোড়ি ইকো রিসর্ট। পাখি-উৎসাহীরা এখানে এসে থাকতে পারেন। বেসিক ব্যবস্থা, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। ছাউনি ঢাকা ওই গোল জায়গাটায় জনাপাঁচেক লোককে খেতে দেখে মনে পড়ল দুপুরের খাওয়া নিয়ে ভাবা হয়নি। অর্চিষ্মান আমার কানে কানে, জিজ্ঞাসা কর না আমাদের তিনজনকে খেতে দেবে কি না, বলেই দৌড়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
আমি মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়ে আমাকেও বাথরুমটা দেখাবেন আর ইয়ে তিনজনের লাঞ্চ পাওয়া যাবে কি?
মহিলা জিভ কাটলেন। এই মহিলার সঙ্গে গতকাল রাত থেকেই ফোনে কথা হচ্ছে। যা বুঝলাম, উনি রিসর্টের ফোনও ধরেন, প্যাকেজের খবরও দেন, রান্নাঘরেরও তদারকি করেন, টাকাপয়সারও হিসেব রাখেন। বললেন, পাওয়া তো যায়, কিন্তু আগে থেকে বলতে হয়। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ঠিক আছে ঠিক আছে, আমরা পাখিটাখি দেখে এসে না হয়... মহিলা বললেন, আসতে ছ'টা বেজে যাবে। দাঁড়ান দেখছি। আমি কাঁচুমাচু হয়ে পেতে রাখা টেবিল চেয়ারে বসলাম। অর্চিষ্মান এসে বলল, ব্যবস্থা করে ফেলেছ? বাঃ।
খাবার এল। ভাত, ডাল, আলু ফুলকপির তরকারি আর বেগুনভাজা। দইয়ের সঙ্গে শশা, গাজর, পেঁয়াজ। প্রত্যেকটি জিনিসই যা বোঝা গেল আরও চাইলে পাওয়া যেত। আমরা চাইনি। কারণ আমাদের হয়েও বেশি হয়েছিল।
ওডিশা আর আসামের খাবারের সম্পর্কে আমরা একটা আলোচনা মাঝে মাঝেই করি। বিশেষ করে যখন এ দুটি রাজ্যের খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়। আলোচনার বিষয় হল যে এই রাজ্যদুটোর খাবারের প্রতি অবিচার করতে আমরা বাধ্য। কারণ এ জায়গাদুটোর খাবার বড্ড বেশি আমাদের খাবারের মতো। মানে মাছের ঝোল আর মুগের ডাল আর কলমি শাক নিয়ে কত উচ্ছ্বসিত হওয়া সম্ভব, সে যতই ভালো রান্না হোক না কেন? গত আটত্রিশ বছরে যে আটত্রিশ কোটি বার আমি মাছের ঝোল, ডাল, তরকারি খেয়েছি বাড়ির পিঁড়ি কিংবা টেবিলে বসে, কখনও না কখনও তো এর থেকে ভালো রান্না হয়েইছিল। সরসোঁ দা সাগ খেয়ে বরং আমার পক্ষে অভিভূত হওয়া সহজ। আলুনি কিংবা নুনপোড়া না হলেই হোক না কেন হাড়িপ্পা বলে লাফিয়ে উঠব।
আমরা যতক্ষণ খেলাম গাছের ডালে একটা কাক আর মাটিতে একটা বেড়াল বসে পাহারা দিল। ছাউনির নিচে পাখিড়ুদের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, একজন লাগলেন, আর ভাই আমি কলকাতায় থাকি না, আমার আবার স্ট্যাটাস, হ্যাঃ।
সেদিন দুপুরের খাওয়া সম্পর্কে একটাই বলতে পারি, আমাদের খাওয়া আটত্রিশ কোটি ডাল ভাত তরকারির মধ্যে মনে করে রাখার মতো ডালভাত তরকারি খাইয়েছিল মঙ্গলাজোড়ি ইকো রিসর্ট। খাওয়া সেরে টাকাপয়সা মিটিয়ে গাড়ি চড়ে চলে গেলাম বার্ড ওয়াচিং টাওয়ারে, যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন অশোক। অনেকগুলো দাঁড়-বাওয়া নৌকো সারি দিয়ে দাঁড় করানো ছিল, একটার দাঁড় বেয়ে একজন কাছে নিয়ে এলেন। আমি, অর্চিষ্মান আর অশোক চড়ে বসলাম। আমাদের একটা বাইনোকুলার দেওয়া হল।
মঙ্গলাজোড়ির ইতিহাস রোমহর্ষক। একসময় এই গ্রামের লোকজন পরিযায়ী পাখি শিকার করে খেতেন। । বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে এখন ভক্ষক টু রক্ষক হয়েছেন। পাখি চেনার চোখের এঁদের তৈরি হয়েছিল এক কারণে, এখন অন্য কারণে কাজে লাগছে। অশোকের ট্রেনিং হয়েছে সে রকম একজন ওস্তাদ শিকারীর হাতে। একদিনে একটা পাখি, এই ছিল তাঁর পাখি চেনানোর পদ্ধতি।
নানারকম পাখি দেখা হল। পার্পল মুরহেন, কমন মুরহেন, হুইস্কারড টার্ন, উড স্যান্ডপাইপার, নর্দার্ন পিনটেইল, গ্রেহেড আর রেড ওয়াটল ল্যাপউইং, রাডি শেলডাক যা নাকি আমাদের পুরাণের চখাচখী, সর্বদা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। যারা পরিযায়ী পাখি নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা বলতে পারবেন আমরা বেশি পাখি দেখেছি না কম দেখেছি নাকি এই রকমই দেখা যায়। আমার সবথেকে চমক লাগছিল পাখিগুলো যখন হঠাৎ উড়ান নিচ্ছিল, আর অমনি একরঙা পাখির ডানায় ম্যাজিকের অন্য রং, সাদা ডানার মাঝখান দিয়ে হঠাৎ চওড়া বাদামী রঙের পোঁচ, কারও একই রঙের ভিন্ন ভিন্ন শেডসারি সারি, শাড়ির কুঁচির মতো।
কিন্তু সত্যি বলব? এই একটি পাখিও না দেখতে পেলে আমার মঙ্গলাজোড়ি একই রকম ভালো লাগত। দাঁড়ের ঠেলায় নলঘাসের বনের গলিতে ভেসে পড়ার প্রথম মুহূর্ত থেকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম. শান্ত জায়গায় তো অনেক গেছি। পাহাড় শান্ত, ভোরবেলা আমার বাড়িও শান্তই, কিন্তু এ আমি আগেও খেয়াল করে দেখেছি, জলের একটা আলাদা শান্তি আছে। স্থির জলের। মাইথন, মুকুটমণিপুর, এমনকি আমাদের পাড়ার পুকুরঘাটটারও শান্তিকেও আর কোনও শান্তির সঙ্গে যাকে গুলোন চলে না। সব কষ্ট শুষে নেওয়া, মুছে নেওয়া শান্তি।
অথচ একেবারে শান্তও তো ছিল না জায়গাটা। চখাচখী তো ভয়ানক চেঁচামেচি লাগিয়েছিলই, মোষগুলোও হেঁড়েগলায় ডেকে উঠছিল মাঝে মাঝেই। দাঁড়ের ঘায়ে জল জলের গায়ে লাট খাচ্ছিল। আমরা মঙ্গলাজোড়িতে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম দিনের ব্যস্ততম সময়ে। পাখিদের, মোষদের তখন বাড়ি ফেরার সময়। মোষগুলোকে না হয় জড়ো করার জন্য লোক আছে, কিন্তু পাখিরা বাড়ি ফেরার সময় হলে নিজেরাই হেঁকে ডেকে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়। খালি চোখেই বোঝা যাচ্ছিল, অশোকের জোরাজুরিতে চোখে বাইনোকুলার ঠেকিয়ে দেখলাম একটা বিরাট জায়গা পাখিতে পাখিতে কিলবিল করছে। পাখিদের সাড়ে ছ'টার হাওড়া স্টেশন। একে একে উড়ছে আকাশে।
এমনকি যারা উড়তে পারে না, ডাকতে পারে না, দূর থেকে দেখলে ধ্যানস্থ মনে হয়, তারাও কাছে গেলে বোঝা যায় জেগে রয়েছে দিব্যি। জলের দু'ইঞ্চি নিচ দিয়ে শিকড়ের স্তূপ, গুল্ম, শ্যাওলা, জড়াজড়ি করে ভেসে চলেছে সংসার নিয়ে। অশোকের নির্দেশে নৌকোর ছুঁচোল নাক ঢুকে যাচ্ছে কচুরিপানার বনে, খসখস আপত্তির তুলে জায়গা দিচ্ছে নারাজ কচুরিপানার জঙ্গল।
জল যখন চারদিক থেকে যখন ঘিরে ধরে, অনভ্যস্ত চোখের দিক গুলিয়ে যায়। কোনদিক থেকে এসেছিলাম, কোথায় যাচ্ছি সব একশা। উঁচু হয়ে থাকা লাল মাটির রাস্তাটা অনেকক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিলাম। কখন হারিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। ঘণ্টাদুয়েক পর উঁচু নলঘাসের পাঁচিল সরে যেতেই দেখি নৌকো দাঁড়িয়ে আছে ফেরির একেবারে সামনে।
khub sundor.
ReplyDeletebhalo laglo.
মাটিতে একটা বেড়াল বসে পাহারা দিল। oke kichu khabar dile na?
prosenjit
দিলে হত। আসলে পশুপ্রেমটা বুড়ো বয়সের অ্যাকোয়ার্ড প্রেম। এখনও ধাতে আসেনি। এবার থেকে মনে করে দেব।
Deletekhub sundor laglo, manglajodi jete ecche korche.
ReplyDeleteআমাদের তো খুব ভালো লেগেছে, সুহানি।
DeleteRaghurajpur ta amar jawa hoyeni. Mangalajodi ta besh shundor jaayega toh. Porer baar list e rakhbo.
ReplyDeleteAmra Chilika e prochur Flamingos dekhte peyechilam.
Accha ... okhane maach ba chingri ba kaankra khele na? Khub fresh pawa jaye ar ora darun raandhey. Deri hoye giyechilo bole tai na?
তাই হবে বোধহয়, শর্মিলা। আমরা জাস্ট খাব বলেছিলাম, কী খাব কিছু বলিনি।
DeleteManglajori khub sundor laglo.. pakhir jonno na.. joler modhye jawar wxperiexpe.. jawa hoyni.. Raghurajpur theke amar maa oi chokkhulojjar khatire ja enechilo segulo ordhek dhulo khacche.. ekdom thik.. amaro jawar icche nei.. tomader moto oi ekta chena bari pele jawa bhalo..
ReplyDeleteবাড়িটা আমাদের চেনা ছিল না ঊর্মি, ড্রাইভারের চেনা। ঝুলোঝুলি একইরকম ফেস করতে হয়েছিল সম্ভবতঃ খালি অনেকের বদলে একজনের ঝুলোঝুলি।
DeleteChhobigulo dekhei boro shanti lagchhey. lekhata mochotkar.
ReplyDeleteধন্যবাদ, চুপকথা।
Deleteসম্পূর্ণ অজানা জায়গা ও তথ্য জেনে ভালো লাগলো।তবে আমার প্রথম ছবিটা দেখে কেন জানিনা সেই হাউন্ড অব বাসকারভিলসের জলাভূমি আর নৃসিংহ রহস্যের বাদাবনের কথা মনে আসছিল।
ReplyDeleteআপনার কমেন্টটা প্রথম যখন পড়লাম, নালক, ব্যাকগ্রাউন্ডে সানডে সাসপেন্সে বাস্কারভিলসের হাউন্ড রক্তজলকরা আর্তনাদ করে উঠল। টেলিপ্যাথির ঠাকুরদাদা।
Deleteকোথাও বেড়াতে গেলে সঙ্গে চাই একজন সমমনস্ক মানুষ। আমার বাবা চলে যাবার পর আমি সঙ্গীবিহীন হয়ে গেলাম। তাই এরপর যেখানেই গেলাম, সেটা শুধু যাওয়াই হল। আজ এই সত্তর বছরের বুভুক্ষু হৃদয়ের কাছে তোমার লেখাগুলিই পরম প্রাপ্তি। তোমার লেখাগুলিএত চিত্রকল্প যে একেক সময়ে ছবিটাও বাহুল্য মনে হয়। কুন্তলাসুন্দরী, তুমি এইভাবেই নেচে বেড়াও (অবশ্যই স- অর্চিষ্মান, নইলে সুরে তালে জম্পেশ হবে না), আর আমি পরিতৃপ্ত হতে থাকি।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Delete