পাকে পাকে বাঁধা



গত বছরের অক্টোবর বা নভেম্বরে, প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত কৃত্তিবাস পত্রিকায় আমার একটা ছোটগল্প বেরিয়েছিল। ভদ্রস্থ পরিমাণ সময় অতিবাহিত হয়েছে আশা করে জানতে চেয়েছিলাম গল্পটা এবার আমি আমার ব্লগে দিতে পারি কি না। অবশ্যই পারি জানতে পেয়ে গল্পটা অবান্তরে দিয়ে রাখলাম।





পাকে পাকে বাঁধা

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়



সবথেকে সহজ এবং সাফসুতরো হচ্ছে সায়ানাইড। খাবে, মরে যাবে। আর্সেনিক হলে কষ্ট বেশি। পেটব্যথা, খিঁচুনি, ডায়রিয়া। বমি করে করে ন্যাতা হয়ে যাবে, তখনও শরীর মোচড় দিয়ে দিয়ে নিশ্চিত করতে চাইবে যাতে বিষ ভেতরে না থেকে যায়। মোমের মতো চামড়া ফেটে ঘা বেরোবে। সারা শরীরে কালশিটে।

এখনও তোমার সুবিধের কথা ভাবছি। আমার সুবিধে আর্সেনিকেই। আজকাল সুপারমার্কেটগুলোতে সব পাওয়া যায়। আমি ওদিক থেকে এঞ্জিন কুল্যান্ট তুলব, তুমি এদিক থেকে হারিসা আর অরগ্যানিক ডিম, ব্রাউন খোলের। ব্রাউন আর সাদা খোলের মধ্যে স্বাদ গন্ধ এমনকি নিউট্রিশন্যাল ভ্যালুরও কোনও তফাৎ নেই, বলার চেষ্টা করেছিলাম একবার। বাঁকা হেসেছিলে। দামের আছে।

কিন্তু সায়ানাইডকে যতটা ইন্সট্যান্টেনিয়াস বলা হয়, ইন্টারনেট দাবি করছে ততটাও না। কারা যেন খেয়ে মরে যাওয়ার আগে লিখে গেছে, অ্যাক্রিড অ্যান্ড বিটার। তুমি পারবে না। তুমি শুক্তো খেতে পার না, মুখ ভেচকে বাটি ঠেলে দাও। তোমার মা হাসেন। সেই ছোট্ট থেকেই মিতুল তেতো সহ্য করতে পারে না। তুমি এখন তেত্রিশ। তুমি এখনও তেতো সহ্য করতে পার না। তুমি তোমার কষ্ট হয় এমন কিছুই করতে পার না। যেমন বিয়ে করা স্বামীকে ভালোবাসতে। ভালোবাসারও দরকার নেই। কত দম্পতি স্রেফ নিয়মরক্ষা থেকে যায়। তুমি পার না।


ঘন ঘন বেল বাজছে। দ্বৈপায়নরা কি এসে গেছে অলরেডি? এলে হইচই শুনতে পেতাম। বলা বাহুল্য, আমার নাম ধরে। আসলে যাকে চাই সে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই জন্য অন্য লোকের নাম ধরে অত হাঁকডাক।

সাতাত্তরজন হচ্ছে। পেন দাঁতে চেপে বলেছিলে তুমি। কপাল কনসেন্ট্রেশনে কুঁচকে। টিকউডের বুককেসে সারিসারি চামড়াবাঁধাই ওকালতি বইয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে তোমার মুখ ফুলের মতো ফুটে ছিল।

ওহ, মামণিদেরই তো গোনা হয়নি। দেখছ, আরেকটু হলে। পেন নামিয়ে মামণিদের - আমার কোনও আইডিয়া নেই তারা কারা - লিস্টে যোগ করে নিয়েছিলে। মামণি, মামণির বর আর বাচ্চা। আটাত্তর, ঊনআশি, আশি।

গুড। রাউন্ড ফিগার। হাসার চেষ্টা করেছিলাম। তুমিও হাসতে পারতে। বলতে পারতে, অনেক চেষ্টা করেও কমানো গেল না। আমিও হাসতাম। বলতাম, দরকার নেই কমানোর। দশ বছর বলে কথা।

উঠে আসতে। হাত বাড়িয়ে টেনে নিতাম। তারপর আরেকটা বার্ষিকী উদযাপনের প্ল্যান করতাম দুজনে মিলে। খাতাপেন লাগত না, নো গোনাগুনতি। নিমন্ত্রিত কেবল আমি আর তুমি। নেমন্তন্নবাড়ির সম্ভাবনা অগুন্তি। কচ্ছের রান। নাগাল্যান্ডের অরণ্য। মাচুপিচুর চুড়ো। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের খাদ। অরোরা বোরিয়ালিসের সাইকেডেলিক নাচ। সফেন সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া ওয়েলসের ভাঙাচোরা তট। আমাদের ঘিরে সবুজ ঘাসে মুখ ডুবোনো ধপধপে ভেড়ার দল।

হাসোনি। পেন টেবিলে রেখে উঠে পড়েছিলে। অ্যানিভার্সারি পার্টির খুঁটিনাটি আলোচনার জন্য নয়,এ ঘরে এসেছিলে ওই পেনের খোঁজেই। কারণ তোমার নিজের কোনও পেন নেই।

তোমার আলমারি ভর্তি শাড়ি, তোমার লকারভর্তি গয়না, তোমার ফেসবুকভর্তি বন্ধু। তোমার একটাও নিজস্ব পেন নেই। একটাও প্রিয় বই নেই। একটাও লুকোনো ডায়রি নেই মনের কথা লেখার। জেনেছিলাম যেদিন, ফেরার পথে জি সি লাহা থেকে একটা ওয়াটারম্যান কিনে এনেছিলাম তোমার জন্য।

একটা কিছু খানখান। অট্টহাসি।

আজ ঘুমোতে ওষুধ লাগবে আমার। তোমার লাগবে না। তুমি যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পার। বাড়িতে, সিনেমাহলে, সাফারিতে জলের ধারে হাতির দলের অপেক্ষায়। গালের পাশে নরম মুঠো অল্প অল্প কাঁপে, ঠোঁটের কষ আর্দ্র হয়। পিতৃতন্ত্রের কেরামতি,আমার মতো টনসিলদীর্ণ, থাইরয়েডজীর্ণ লোকের গলায় তোমার মতো রত্ন দুলিয়েছে। টাকা প্রতিপত্তি কেরিয়ারের বিনিময়ে। যেগুলোর কোনওটাই আমার কৃতিত্ব নয়। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।

কাজেই তোমাকে ঘুমের বড়ি খাওয়ালে লোকে সন্দেহ করবে।

তুমি কি হাসছ? হাসতে হাসতে চুল ঠিক করছ নাকি আলতো আঙুল রাখছ পাশে দাঁড়ানো কোনও ছেলের বাহুতে? নতুন কেউ? নাকি দ্বৈপায়নই? নাকি রাঙাপিসিমার শ্বশুরবাড়ির দিকের ভাইপো, শুভজিৎ না শুভজ্যোতি, পিসিমার বাড়ির সত্যনারায়ণ পুজোর গোটা সন্ধে তুমি কথায় কথায় যার হাত ছুঁচ্ছিলে, চোখে চোখ রেখে চুল গুঁজে নিচ্ছিলে কানের পেছনে, ছেলেটির ভ্রূভঙ্গিতে হেসে চুরমার হচ্ছিলে। ঘড়ি ধরে সতেরো মিনিটে ছেলেটা তোমার প্রেমে পড়ে গেল।

প্রকৃত সুন্দরী বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন তোমার বাবা। পাত্রীপক্ষের দরখাস্তের জেলাওয়াইজ ফোল্ডার ছিল বাড়িতে। কলকাতা, হুগলী, হাওড়া, নদীয়া, উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। রবিবার সকালে ফোল্ডার বেছে মা উত্তর লিখত। উত্তরের সঙ্গে খামের ভেতর যেত তুলোট কাগজে সোনালি ক্যালিগ্রাফিতে লেখা লাহিড়ীদের বংশলতিকা, যা শুরু হয়েছিল নবাবি মনসবদারির আমল থেকে। বিয়ের বিজ্ঞাপনের ভাষা মা ততদিনে ডিকোড করে ফেলেছে। প্রকৃত সুন্দরী মানে চলনসই। সুশ্রী মানে কুচ্ছিত। ফর্সা মানে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মানে কালো ভুত।

তবু তোমাকে দেখতে যাওয়া হয়েছিল কারণ আমার আইবুড়ো থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা ততদিনে রিয়েল হয়ে উঠছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপচারিতায়, আহ্লাদীগলায়, আমাকে শ্রবণসীমার মধ্যে রেখে মা বলছে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে রুবু একটা প্রেম করে নিলে এ ঝামেলা পোয়াতে হত না আমাকে। মনে পড়ত প্রতিদিন কলেজ থেকে ফেরার পর টিফিনবাক্স বার করার ছুতোয় মায়ের আঁতিপাঁতি ব্যাগ হাতড়ানো। ফ্রেশার্সে আলাপ হওয়া দেবার্পিতা নামের মেয়েটি ফোন করেছিল। দ্বিতীয়দিন ফোন তুলে মা বলেছিল, রেবন্ত বাড়ি নেই। মায়ের গলা আন্টার্কটিকা। রিসিভার নামিয়ে আমার চোখে রাখা চোখে খাণ্ডবদাহন।

শালকিয়ার লিফটহীন পাঁচতলার দু'কামরার ফ্ল্যাটে, প্লাস্টিকের লালফুল সবুজপাতা ফুলদানিসজ্জিত টেবিল ঘিরে দলাপাকানো গদিওয়ালা চেয়ারে বসে ছিলাম। এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখা মায়ের চায়ের কাপে সর পড়েছিল। বারো বাই দশ ঘরে জুন মাসের হাওয়ার ঘূর্ণি তুলছিল সিলিংফ্যান। দেওয়ালে ফরফর করে উড়ছিলেন রামকৃষ্ণ সারদামা বিবেকানন্দ। পিঠসোজা হাতলহীন চেয়ার অপেক্ষা করছিল তোমার এসে বসার। শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকা একটা একলা ঘামের ফোঁটার শিরশিরানি সহ্য করতে করতে মায়ের মুখচোখ দেখছিলাম। প্রত্যাখ্যানের সুযোগের উত্তেজনায় জ্বলজ্বলে। আমার কাঁধের ওপর দিয়ে মা সোজা তাকিয়েছিল যেখানে অন্তত সত্তরবার কাচা ফুলছাপ পর্দা সরিয়ে তুমি এসে দাঁড়াবে। এসে গেছ বুঝলাম যখন মায়ের চোখমুখের উল্লাস, ধাপে ধাপে অবিশ্বাস এবং হতভম্বতা পেরিয়ে পরাজয়ে নেমে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে তোমার দিকে তাকানোরও আগে জেনে গিয়েছিলাম তোমাকেই বিয়ে করব।

ঘুমের না, মনখারাপের ওষুধ দেব তোমাকে। যদিও সেটাও তোমার হয় না। রাগ হয়, ঈর্ষা হয়, কিন্তু বিকেল পেরিয়ে ঘুম ভেঙে কখনও জানালার পাশে চুপ করে দাঁড়াতে দেখিনি। একটা লোকের নিজস্ব পেন না থাকা নাকি কখনও মন খারাপ না হওয়া কোনটা বেশি ভয়ের?

আমার ঘন ঘন মনখারাপ হয়। নড়তেচড়তে পারি না। শ্বাস নিতে ভুলে যাই। কীসের মনখারাপ? ভুরু কুঁচকে জানতে চেয়েছ অনেকবার। রমরমা প্র্যাকটিস, সুন্দরী বউ, বছরে দুটো ডোমেস্টিক, একটা ইন্টারন্যাশনাল ট্রিপ, সপ্তাহান্তে নিভু আলোয় আড্ডা, প্রগতিশীলতার গর্ব, শিক্ষার দেমাক, আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পুঁজির ওম। তবু মনখারাপটা কীসের?

এ যেন শ্বাসকষ্টের রোগীকে জিজ্ঞাসা করা, চারদিকে এত অক্সিজেন তবু আপনি শ্বাস নিতে পারছেন না কেন?

তাড়াতাড়ি কাটতে হবে, চৈতীর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। শনিবার সন্ধেয় রেস্টোর‍্যান্টের অ্যাশট্রেতে সিগারেট দুমড়ে দ্বৈপায়ন বলেছিল। লাউডন স্ট্রিটের ওদিকটায় এ সময় ফাটিয়ে জ্যাম।

কী হয়েছে?

ডিপ্রেশন। তোমার দিকে মুচকি হেসে দ্বৈপায়ন বলেছিল, আমাদের মতো মাথাব্যথা আর আমাশা নয়। চৈতীকে একা ফেলব না বলেই বলেছিলাম, শরীরের অসুখ হলে শরীরের ডাক্তার, মনের অসুখ হলে মনের ডাক্তার দেখানোই তো যুক্তিসংগত। ন্যাপকিনটা টেবিলে ফেলে বাথরুমে গিয়েছিল দ্বৈপায়ন। তিরিশ সেকেন্ড পর তুমিও গেলে। চৈতী আর আমি চুপ করে বসে রইলাম ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্লেটের দিকে তাকিয়ে।

গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলেছিলে, শোনো, রিয়েল, খেটেখুটেখাওয়া মানুষদের ডিপ্রেশনফিপ্রেশন হয় না। ওসব হয় পটের বিবিদের। সারাদিন খাচ্ছে শুচ্ছে বরের পয়সায় ফুর্তি করছে, ডিপ্রেশন কীসের? একেকটা সেশনের ভিজিট জানো? এসি ঘরে শুয়ে শুয়ে পুরুষ ডাক্তারের কাছে মনের কথা বলার দাম একঘণ্টায় সাড়ে সতেরোশো।

দ্বৈপায়নের টাকা বাজে খরচ হওয়া নিয়ে তোমার মাথাব্যথা দেখে আন্দাজ করা উচিত ছিল।

আমিও অবশ্য করেছি বাজে খরচ। লাউডন স্ট্রিট সাইকায়াট্রিস্ট সার্চ করে ডক্টর চৌধুরীর নাম পেতে তিরিশ সেকেন্ড। প্রতি বৃহস্পতিবার ক্লাবে যাই বলেছিলাম, আসলে চেম্বার থেকে বেরিয়ে ডক্টর চৌধুরীর চেম্বারের রিক্লাইনিং চেয়ারে আধশোয়া হয়ে দুঃখের কথা বলতাম। ঘণ্টাপ্রতি সাড়ে সতেরোশো টাকা গচ্চা দিয়ে। প্রথমটা সংকোচ হত। তারপর আড় ভেঙে গেল। দুঃখের কথা, আনন্দের কথা, ভবিষ্যৎসংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কথা, মায়ের বুকে ছুরি বসানোর স্বপ্নের ঘুরে ফিরে আসা, সব বলেছি। বলেছি, তুমি কী অসম্ভব সুন্দর। অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্টস লিখে দিয়েছেন ডক্টর চৌধুরী। কয়েকমাস ধরে পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ কিনে পাশের পাড়ার দোকান থেকে আবার ওই একই ওষুধ কিনেছি প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে। বাড়তি ওষুধগুলো এই ড্রয়ারে রাখা।

আজই হয়তো সারা সন্ধে ফিশ ওরলি আর মাটন টিক্কা খেয়ে রাতে তোমার অসুখ হবে। রিয়েল অসুখ। খেটেখাওয়া মানুষের অসুখ। অম্বল, বুকজ্বালা। বড় এক গ্লাস জলে গুলে হাতে তুলে দেব। বলব, খেয়ে নাও। সকালে তোমার ঘুম ভাঙবে না। গালের পাশে হাত মুঠো করে শান্ত শুয়ে থাকবে। হোপফুলি ঠোঁটের কষে গ্যাঁজলাট্যাজলা লেগে থাকবে না। তোমার সৌন্দর্য অটুট থাকবে। ওষুধের ফয়েলগুলো শোওয়ার ঘরের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে আসব। কেউ বলবে কই কিচ্ছু বোঝা যায়নি তো? কেউ বলবে, এ জিনিস বোঝা যায় না। ডিপ্রেশন ইজ আ সাইলেন্ট কিলার।

সুইসাইড নোট? ওটা মিথ। অধিকাংশ লোক কিছু না লিখে মরে যায়। তাছাড়া তুমি নোট লিখবেই বা কী করে, তোমার তো পেন নেই। ওয়াটারম্যানটা ছ'মাস বাদে ভগবতীর মা ঝাঁট দিয়ে খাটের তলা থেকে বার করেছিল।


জামা পেয়েছ?

দরজা ঠেলে তুমি ঢুকে এসেছ। অন্য কারও দরজায় নক কর কি না জানি না, আমার দরজায় কখনও করোনি। তুমি মনে কর না দুজন লোক আগে প্রাপ্তবয়স্ক, তারপর স্বামীস্ত্রী।

আমি করি। একবার নক শুনে দরজা খুলে ভগবতীর মা ভেবে আমাকে দেখে হাঁ করেছিলে। আরেকবার তোমার থাকার আঁচ না পেয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে ফোন হাতে বিছানায় উপুড়রত তোমাকে আবিষ্কার করে মুখ থেকে সরি বেরিয়ে গিয়েছিল। দ্বৈপায়ন কখনও সরি বলে না। চৈতী বলেছে। কবে বলেছে, কোথায় বলেছে মনে নেই। হয়তো রেস্টোর‍্যান্টে তোমাদের দুজনের বাথরুম ব্রেকের সমাপতনের অবসরে। কিংবা ওদের বাড়িতে নেমন্তন্নে।

কষানোটাই আসল। কড়াইভর্তি লাল মাংস নাড়াচাড়া করতে করতে দ্বৈপায়নের জিভে জল চলে আসে। মাংস দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে নিতে নিতে চোখ বুজে গুঙিয়ে ওঠে যখন তুমি চকচকে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাক। কয়েকমাস ধরে মাংস খেতে বসে দ্বৈপায়নের গোঙানি আর তোমার দৃষ্টি মনে পড়ে। খেতে পারি না। দ্বৈপায়ন বলে, ফুড চেনটা এভাবে মাটি করিস না। তুই পাঁঠাকে না খেলে পাঁঠা তোকে খাবে। তুমি ভেঙেচুরে হাস।

দ্বৈপায়ন কথায় কথায় খেঁকিয়ে ওঠে আজকাল। আনমনা থাকে। চতুর্থ গ্লাসে পৌঁছে চৈতী বলে। নীরব থাকি। ইশ, খুবই খারাপ করে-ও যেমন বলি না, স্বামীস্ত্রীর মধ্যে ওসব হয় মানিয়ে নাও তাও না। আসলে আমি বিশ্বাস করি স্বামীস্ত্রী একটা ইউনিট যার অন্দরের ডায়নামিক্স, পাওয়ার প্লে বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। একে অপরের প্রতি যাবতীয় অভিযোগ আগে নিজেদের কাছে মিটিয়ে নেওয়া উচিত। জানি না তুমিও সেই মতে বিশ্বাসী কি না। দ্বৈপায়ন বা শুভজ্যোতি, সতেরো মিনিটের বেশি তোমার সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্যওয়ালা পুরুষেরা আজকাল আমার দিকে তাকিয়ে হাসলে নার্ভাস লাগে।

জলপাই রঙের সিল্কটা পরেছ। আজ তোমাকে অন্যদিনের থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে। তোমার চলাফেরায়, চাউনিতে দশ বছরে এই প্রথম একটা ভয়, সংশয়। আমার চোখে চোখ রাখছ না। দৃষ্টি টেবিলের ওপর ঘুরছে।

পেয়েছি। আসছি এক্ষুনি। আশ্বাসের হাসি হাসি। প্রত্যুত্তরে হাসো। দরজা টেনে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দৃষ্টি টেবিলের ওপরের ব্রাউন খামটা আরেকবার ছুঁয়ে যায়।

মাঝে মাঝে মনে হয় চাই না শান্তি, চাই না নির্ঝঞ্ঝাট। আগুপিছু ভাবব না, বুকের ভেতর একশো পাগলা হাতি দাপাবে, রান্নাঘরের সবথেকে বড় ছুরিটা নিয়ে তিনটে করে সিঁড়ি টপকে ধাক্কিয়ে দরজা খুলব, ড্রেসিং টেবিলের সামনে তোমার মগ্নতা খানখান, ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মূর্তি দেখে চেঁচিয়ে ওঠার আগেই লাফ মেরে পৌঁছে যাব তোমার ওপর, বাঁ হাতে পেঁচিয়ে ধরব কোমর, অনুমতির তোয়াক্কা না করে আট ইঞ্চির ফলা গেঁথে দেব তোমার শরীরে। তোমার চোখ বিস্ফারিত হবে, নিঃশব্দ আর্তনাদে নিখুঁত ও-তে বিন্যস্ত হবে গোলাপি ঠোঁট, সমস্তটুকু অসহায়তা নিয়ে তুমি অবশেষে, অবশেষে আমাকেই খামচে ধরবে।

তোমার ছিন্নভিন্ন কিন্তু তখনও সুন্দর শরীরটা কোলে নিয়ে, তোমার রক্ত গায়ে মেখে বসে থাকব, পুলিশ আসবে। খবরের কাগজে বেরোবে আমাদের বাড়ির নাম, পৃথিবীর কদর্য কৌতূহলে মা জর্জরিত হবে, ফোন ধরতে পারবে না, রাস্তায় বেরোতে পারবে না।

নাঃ। লোভ দেখাব না নিজেকে। জেল নোংরা, খাবারদাবার খারাপ। তাছাড়া জেলে ওরা দুর্বলের গন্ধ পায়। পা রাখার তিনমিনিটের মধ্যে শিকার হয়ে যাব। রেপ করবে সকালবিকেল। ওঃ, সে আমি সহ্য করতে পারব না, মিতুল। মায়ের জন্য তো না-ই, তোমার জন্যও না।


তার থেকে আউটসোর্সিং ভালো। কোথাও একটা কনফারেন্স জোগাড় করে চলে যাব, প্রতি বৃহস্পতিবার মা মন্দিরে যায়, ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে সুপারি কিলার তোমাকে মেরে রেখে যাবে। কিছু গয়নাগাঁটি, ক্যাশ নিয়ে যেতে বলে দেব। ঝুঁকি থাকবে। সোজা পুলিসের কাছে চলে গেল। বা ধরা পড়ে সব স্বীকার করে ফেলল। সেই আবার থানাপুলিস।

তার থেকেও বড় একটা ঝুঁকি আছে। বন্ধ বাথরুমের সামনে বন্দুক তুলে সেফটি অফ করে দাঁড়াল লোকটা, তুমি তোয়ালে দিয়ে মাথা ঘষতে ঘষতে বেরোলে, ট্রিগার টানার আগের মুহূর্তে লোকটা ভাবল পৃথিবীতে এত সুন্দর সৃষ্টি কেউ ধ্বংস করে কী করে?

জীবনের শেষ মুহূর্তটা তুমি তোমার একজন প্রেমিকের সঙ্গে কাটাবে, সহ্য করতে পারব না।


সম্ভবত একটা রাস্তাই বাকি। খাদঘেঁষা, সর্পিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে সতেরো হাজার ফুট ওপরে বরফের মরুভূমি চেরা। সিমলা নারকান্ডা হয়ে, চিতকুল, নাক, টাবো, কাজা ছুঁয়ে মানালি হয়ে ফেরা। ওয়ান্ডারলাস্টের মৃগাঙ্কদা প্ল্যান করে দিয়েছে। তুমিও গিয়েছিলে একবার মৃগাঙ্কদার অফিসে, মনে আছে? রিসেপশনিস্ট ছেলেটি, মৃগাঙ্কদার প্রতি পুষে রাখা রাগ মেটাতেই হয়তো বলেছিল, ঢুকে যান, ম্যাম। স্যার ভেতরেই আছেন।

সেক্রেটারি মেয়েটি মৃগাঙ্কদার কোলে বসে ছিল। সামলে নিতে ওদের থেকে বেশি সময় লেগেছিল আমার। আগের সপ্তাহেই পার্টি ছিল মৃগাঙ্কদার বাড়িতে। বৌদি কত যত্ন করে খাওয়ালেন।

এসব পাতি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে বেরিয়ে এসো। দুনিয়া বদলেছে। ফেরার পথে বলেছিলে তুমি।

শালকিয়ার ফ্ল্যাটের মেয়েটার মধ্যে এত উচ্চবিত্ত মূল্যবোধ এল কোথা থেকে? কবে থেকে? তোমার কঠিন চোয়াল, বেঁকানো ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আবারও কূল ছাপানো প্রেম এসেছিল। সেই প্রেম নিয়েই গাটা লুপের একুশটা হেয়ারপিন বেন্ডের বরফের চাঙর বিছিয়ে থাকা রাস্তায় গাড়ি চালাব। জানালার বাইরে তাকিয়ে কার কথা ভাবছ আন্দাজ করার চেষ্টা করতে করতে উইন্ডস্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তোমার মুখে স্থাপন করব এই জানা নিয়ে যে শেষবারের মতো তোমাকে দেখছি।


ডিভোর্সও দেওয়া যায়। রক্ত না, গ্যাঁজলা না, থানাপুলিস না, স্ক্যান্ডাল না, পাড়াপড়শির উল্লাস না, তোমার মায়ের বুকচাপড়ানি না, আমার মায়ের আতংক না। লাহিড়ীবাড়িতে কেউ ডিভোর্স করেনি আগে। বাকি সব পরীক্ষায় মতো এটাতেও ফার্স্ট হব। আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শির কাছে মায়ের সিংহাসন অটুট থাকবে।

ডিভোর্স পেতে অসুবিধে হবে না। দুপুরেই এসে পৌঁছেছে বাদামী খামটা। আমার নামঠিকানা প্রিন্ট করা। টেবিলে পড়ে আছে। হয়তো তুমিই লেটারবক্স থেকে নিয়ে এসে রেখেছ। হালকা, হাত বুলোলে ছোট, শক্ত কোণাওয়ালা একটা কিছুর আভাস।

পেন ড্রাইভ।

তুমি তোমার জীবনে ভেসে যাবে। আমি আমার জীবনে। আবারও প্রমাণ হয়ে যাবে, সবাই সবাইকে ছাড়া বাঁচতে পারে। ম্যাট্রেসের মেমোরি ফোম তোমার শরীরের স্মৃতি ঠেলে স্বস্থানে ফিরে আসবে, চিরুনিতে লেগে থাকা চুল উড়ে যাবে, আয়নায় টিপের আঠা উঠে যাবে। আমিও হয়তো নতুন বাড়িতে উঠে যাব। নতুন বাড়ি, নতুন আয়না, আয়নায় আমার মুখের পাশে নতুন মুখ। সে মুখ তোমার মুখের মতো সুন্দর হবে না হয়তো। হয়তো কেন, নিশ্চিত হবে না। কিন্তু রক্তমাংসের হবে। কোমর বেঁধে রান্না করবে কিংবা সকালবিকেল জোম্যাটোসুইগির লাইন লাগাবে বাড়িতে। দুপুরবেলা ফোন করে ভাতঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞাসা করব খেয়েছ? কিংবা সটান হানা দেব অফিসে, কাজের দোহাইয়ে কান না দিয়ে লাঞ্চে নিয়ে যাব। গল্প করব, বেড়াতে যাব। সে আমার দিকে কফি ভর্তি কাপ ছুঁড়বে, আমি রাতে বাইরে খেয়ে ফিরব। কখনও আমি গিয়ে তাকে জড়াব, কখনও সে এসে বুকে মাথা রাখবে।

ভালোবাসে কি না সে নিয়ে একচিলতে সংশয় থাকবে না।


কোলাহল কান ফাটাচ্ছে। মামণিরা শুদ্ধু আশিজনই এসে গেছে বোধহয়।

পেন ড্রাইভটা ফয়েলের গোছার ওপর রেখে ড্রয়ার বন্ধ করি। ওয়ান্ডারলাস্টের লোগো আঁকা খামটা ছিঁড়ে প্লেনের টিকিটদুটো কুচিকুচি করে বিনে ফেলে দিই।

হলভর্তি ভিড়। পারফিউম আর কাবাবের সুবাস। হ্যাপি অ্যানিভার্সারি লেখা তিনতলা কেকের পাশে রান্নাঘরের বড় ছুরিটা। কেক কাটা হয়ে গেলেই সরিয়ে রাখতে হবে। কার লেগেটেগে যাবে কখন।

তুমি ঘুরছ, কথা বলছ, হাসছ। কামনায়, ঈর্ষায়, বিস্ময়ে, বন্দনায় তোমার আনখশির সাঁটা আশিজোড়া চোখ।

চৈতী সুন্দর সেজেছে। দ্বৈপায়নের হাসিটা আজ তোমারই মতো জোর করে আনা। তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। এই প্রথম নিজেকে হীন মনে হয় না। দশ বছর পর অবশেষে আমি তুমি সমানে সমান। মুখ উঁচু করে তাকাও আমার দিকে। পেন ড্রাইভের ভিডিওটার চোখদুটো মনে পড়ে। ডি এন এ - র মতো পেঁচানো দুটো শরীর। বেলুগা তিমির পেটের মতো নির্লোম, মাংসল পিঠের বাঁদিকে লাল জড়ুল। গরম লাগছে বলে অবলীলায় জামা খুলে ফেলত যখন দ্বৈপায়ন,চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগেই যেটায় চোখ পড়ে গেছে অনেকবার। পেডিকিওর পায়ের পাতায় কোমর জড়িয়ে ওর কাঁধের পাশ দিয়ে তুলে রাখা মুখে রভসের অভিনয় ফুটিয়ে তুলতে তুলতে তুমি আবারও কন্ট্রোল হারালে মিতুল, মিলিসেকেন্ডের জন্য ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ফেললে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি করে ফেললে। কামনার্তের কাঁচা অভিনয় পেরিয়ে তোমার আসল প্রার্থনাটা স্পষ্ট হয়ে গেল আমার কাছে।

মুক্তি দাও। মুক্তি দাও। মুক্তি দাও।

তোমরা আমাকে ঠিকই চিনেছ। চোটপাট করতে পারব না। লোকজানাজানির ভয়ে সিঁটিয়ে থাকব। রাগে, ঘৃণায় পুড়তে পুড়তে, টুঁ শব্দটি না করে তোমাকে বিসর্জন দেওয়াই আমার ক্ষমতায় কুলোবে।

কিন্তু ততটাও চেনোনি। আমার হার মেনে নেওয়ার ক্ষমতাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছ। গলা নিচু করে, আবার এত নিচুও না যে একটিও শব্দের দ্যোতনা তোমার অগম্য রয়ে যায়, কানে কানে বলি, মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে, মিতুল।

কাঁদে না মিতুল। মন খারাপ করে না। আমারও তো তোমার মতোই কষ্ট, বল? আমিও তো বাঁধা পড়ে আছি একই পাকে, তোমার মতোই। এসো আমরা দুজনে মিলে দাম্পত্য নরকে ঝাঁপ দিই। আমরণ।

Comments

  1. Replies
    1. এত খারাপ? না এত ভালো? দ্বিতীয়টা ধরে নিয়ে খুশি হচ্ছি।

      Delete
  2. আপনার লেখনীকে শতকোটি প্রণাম - উপালি

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, উপালি।

      Delete
  3. দারুণ লিখেছ কুন্তলাদি৷ দারুণ।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত। সত্যি ভালো লাগল।

      Delete
  4. Dampotto norok. :-)
    Khub bhalo lekha Kuntala.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বন্ধুদের প্রশংসা সর্বদা কনফিডেন্স বাড়ায়। থ্যাংক ইউ, শর্মিলা।

      Delete
  5. খুব ধারালো লেখা কুন্তলা! যদিও শেষটা pretend করবোনা, বুঝতে পারিনি ভালো| পাঠক যেমন ইন্টারপ্রেট করবে তেমনই চাও? Keep your friends close, keep your enemies closer?

    ReplyDelete
    Replies
    1. শেষটার জন্য অনেকগুলো প্রবাদ খাটে, অমিতা, এই মুহূর্তে সবথেকে লাগসই মনে হচ্ছে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ।

      Delete
    2. বুঝতে পারলাম| লেখাটা অসাধারণ! দিনে দিনে আরো ভালো হচ্ছে তোমার লেখনী|

      Delete
    3. থ্যাংক ইউ, অমিতা।

      Delete
  6. Replies
    1. বিপাশা, প্রথমবার আপনার নামটা চোখের ওপর রেখেও ভুল লিখেছিলাম কেন কে জানে। একান্তভাবে মার্জনাপ্রার্থী। মুছে আবার লিখছি।

      অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল।

      Delete
  7. Last ta dhakka dilo.

    ReplyDelete
  8. Web e idik sidik ghurte ghurte ei rotnoti pelam. Bhalo hoeche. Darun hoeche!

    ReplyDelete

Post a Comment