নতুন চশমা



অর্চিষ্মান যেদিন চেয়ারের পেছন দিয়ে পাস করতে করতে আমার স্ক্রিনের ছত্রিশ ফন্টের দিকে চোখ ফেলে, “বস্‌স্‌স্‌স্‌…” বলে উঠল বুঝলাম আর দেরি করা যাবে না। বিকেলেই দয়াল অপটিকস। গটগটিয়ে ঢুকে গেলাম। কোনদিকে যাব, কার সঙ্গে কথা বলব ইত্যাদি নার্ভাসনেস দেখালাম না। চেনা দোকান। চেনা মুখ। করণীয় কাজের পারম্পর্য জানা। প্রথমে যেতে হবে দোকানের অন্যপ্রান্তে স্বচ্ছদেওয়াল কিউবিকলে, যার ভেতর একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিবিধ যন্ত্রপাতি সাজিয়ে বসে আছেন।

ট্রে মতো একটা জিনিসে চিবুক রাখলাম। উত্তলমতো একটা জিনিস কপালে সেঁটে গেল। সবুজ মাঠ, নীল আকাশ, সবুজ ট্রাক। ঝাপসা হল,স্পষ্ট হল। যন্ত্র সরিয়ে, চশমার কংকাল নাকে বসিয়ে, গোল কাচ ঢুকিয়ে, ঘুরিয়ে, বার করিয়ে দূরের বোর্ডের বর্ণমালা পড়ানো হল। সেই সাড়ে পাঁচ থেকে পড়ে আসছি। সাড়ে পাঁচে ওই ট্রাকের ফোকাসের ব্যাপারটা হত না। বদলে ডাক্তারবাবু একটা হলুদ আলোর বিন্দু নিয়ে আমার চোখের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।

চশমা হওয়ার গল্পটা আগে বলেছি, আবার শুনুন। কেজি টু শেষ আর ক্লাস ওয়ান শুরুর মাঝখানে আমার চশমা হয়। হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু আমি তো বুঝিনি যে আমি কম দেখি। আমি ভেবেছি আমি যেমন দেখি, ঝাপসা ঝাপসা, কাঁপা কাঁপা, সবাই ও রকমই দেখে। বাকিরাও বোঝেনি। পড়তে লিখতে শুরু করার পর বোঝা উচিত ছিল। স্কুলে যেতে শুরু করার পর অ্যাট লিস্ট। যায়নি কারণ তখন আমি যেতাম পাড়ার কিন্ডারগার্টেনে। বসার জায়গা থাকলে ফার্স্ট বেঞ্চেই বসতে শিখিয়েছিলেন মা। এখন যেচে পেছনের বেঞ্চে সিট খুঁজি, তখন বাধ্য মেয়ের মতো ফার্স্ট বেঞ্চেই বসতাম। পাড়ার গলির স্কুল। ব্ল্যাকবোর্ড ফার্স্ট বেঞ্চের নাকের ডগায়। চোখ সরুটরু করে ম্যানেজ হয়ে যেত।

বাড়িতেও ধরা না পড়াটা বরং বেশি আশ্চর্যের। কারণ ততদিনে নিয়মিত বই পড়া শুরু হয়েছে। শুরু করেই বুঝেছি মচৎকার জিনিস। খেলাধুলোর পরিশ্রম, লৌকিকতার বোরডম থেকে জীবনভরের সস্তা, পুষ্টিকর ও টেঁকসই মুক্তি। বইয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছি। প্রেমের চোটে, ভেবেছে সবাই।

যতদিন না মা চুল কাটতে বসলেন। জীবনের প্রথম কয়েকবছর বারোমাস ন্যাড়া থাকতাম। চুল চিমটি দিয়ে ধরা যায় অবস্থায় এলে আবার ন্যাড়া করিয়ে দেওয়া হত। গরম কম লাগবে, চুল ভালো হবে। আসলে সরল স্যাডিজম। স্কুলে যাওয়ার সম্ভাবনায় বাড়ির লোকদের বিরল বিবেক জাগ্রত হল। ন্যাড়ামাথায় স্কুলে পাঠানোটা বাড়াবাড়ি, হেয়ারস্টাইল বদলানো হোক।

বদলটাও বলার মতো ইমপ্রুভমেন্ট নয়। এ কানের লতি থেকে শুরু করে কাঁচি চালাতে চালাতে ও কানের লতিতে গিয়ে ঠেকা। তারপর তেল মাখিয়ে চুলকে করোটির সঙ্গে যতখানি পারা যায় মিশিয়ে, বাঁদিকে সিঁথি কেটে ডানদিকে কালো কিরিকিরি ক্লিপ এঁটে দেওয়া। পাছে কালবৈশাখী এসে দুটো চুল মুক্ত করে দিলে “উড়নচণ্ডী” না লাগে।

ন্যাড়া করাতে ক্ষুরটুর চালাতে জানতে হয় তাই স্টেশনের সেলুনে পাঠানো হত। বাবার সাইকেলের সামনের রডে একটা ছোট সিট পার্মানেন্টলি আঁটা ছিল এই সব যাতায়াতের জন্য। লতি টু লতি স্টাইলের জন্য মা কাফি। শোওয়ার ঘরের ফ্যান বন্ধ হল। মেঝেতে পেপার পাতা হল। মায়ের রংজ্বলা শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে, দক্ষিণের বাগানের পেয়ারা, নিম, কাঁঠাল আর অশোককাকুদের রান্নাঘরের চালের অ্যাসবেস্টসের ঢেউ চোখে নিয়ে বসলাম। কাঁচি চলতে শুরু করল। এমনিতে আমি মারাত্মক লক্ষ্মী, স্টেশনের সেলুনের চেয়ারে কাঠ হয়ে বসে থাকি। লক্ষ্মীপনায় যত না, তার থেকে বেশি যার হাতে খোলা ক্ষুর তাকে না চটানোর পরিণামদর্শিতায়। মায়ের সঙ্গে সে পরিণামদর্শিতা প্র্যাকটিসের প্রয়োজন নেই। উশখুশ করি, আঙুল দিয়ে মেঝেতে ছবি আঁকি, গলা বাড়িয়ে দেখি অশোককাকুদের টিনের চালে কোন হুলোটা হাঁটছে। মা গল্পের বই এনে মেঝেতে পাতলেন। আইডিয়াটা হচ্ছে আমি ঘাড় অল্প বেঁকিয়ে বইয়ের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকব আর মা বিনাবাধায় কাঁচি চালিয়ে দেবেন।

মায়ের এত বুদ্ধি খরচ বৃথা গেল। আমি বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। মা যত কাঁধ টেনে সোজা করেন, আমি তত ঝুঁকে পড়ি। মা ভুরু কুঁচকে আমার স্কুলে যাওয়ার টিনের সুটকেসটা, যার এক কোণায় তেরছা ক্যালিগ্রাফিতে পাশের বাড়ির দিদি 'কুন্তলা' লিখে দিয়েছিল, যা দেখে মা বলেছিলেন, দিদি খুব ভালো ভেবেই নিশ্চয় লিখেছে কাজেই দিদিকে কিছু বলার দরকার নেই কিন্তু নিজের যাবতীয় সম্পত্তির ওপর নিজের মালিকানা ঘোষণা করে রাখাটা বাহুল্য। যার যার কিনে আনা ডিমে রুমমেটরা তার তার আদ্যক্ষর ছেপে রাখে শুনলে মা কী বলতেন জানি না।

মা ভুরু কুঁচকে আমার নাম লেখা সুটকেস এনে তার ওপর বই চড়িয়ে কাঁচিতে হাত গলালেন। আবার হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কী ব্যাপারটা কী সোনা? মা গলা মোটা করলেন। আমি মিহি গলা ছাড়লাম। এত ওপর থেকে মানুষে অত খুদি খুদি লেখা পড়ে কী করে? চুল অর্ধেক কাটা অবস্থায় তুলে নিয়ে ঠাকুমার ঘরের দরজায় দাঁড় করানো হল। ওই প্রান্তের দেওয়ালে মাকালীর পায়ের কাছে তিনটি জবাফুলে মা সারদা, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ ফুটে আছেন। নট নড়ন চড়ন। ফ্যানের হাওয়ায় খসখস গোলযোগ পাকান বলে ঠাকুমা ক্যালেন্ডারের দুই কোণে কাপড় শুকোনোর দুটো ক্লিপ এঁটে জব্দ করেছেন।

ক্যালেন্ডারের মাথায় কী লেখা আছে পড় তো দেখি? পড়ে ফেললাম। ঘোষ এন্টারপ্রাইজ। উত্তরটা দরকারের থেকে দ্রুত হয়ে গিয়েছিল, পিসি বলল, রাজুর দোকানের নাম ও জানে তো। ঠিকই। গত অক্ষয়তৃতীয়ায় বাবার সঙ্গে গিয়ে ক্যালেন্ডারটা আমিই নিয়ে এসেছি। চুরি ধরা পড়ে গেল। পরীক্ষা ফুরোল না। নাম থাক, ঠিকানা পড়। ঘোষ এন্টারপ্রাইজের নিচের লাইনে খুদেতর অক্ষরে যা ছাপা আছে। যে ঠিকানা আমার জানা নেই। জানার কোনও কারণও নেই। গুলিবাগানের মোড়, রিকশাস্ট্যান্ডের উল্টোদিকে, মুন্নাদিদের বাড়ির পাশে - যে ঠিকানাগুলো বললে রাজুদার এন্টারপ্রাইজে লোকে অ্যাকচুয়ালি পৌঁছতে পারবে ক্যালেন্ডারে তো সে ঠিকানা ছাপা নেই। ছাপা আছে সেই সব ঠিকানা, স্ট্রং পাসওয়ার্ডের শর্ত মেনে বর্ণ, সংখ্যা এবং অবলিক জাতীয় স্পেশাল ক্যারেকটার সংবলিত, যা দিয়ে ছ'মাস ধরে খুঁজলেও রাজুদার এন্টারপ্রাইজে কেউ পৌঁছতে পারবে না। বললাম, হাত ছেড়ে দাও, কাছে গিয়ে পড়ে দিচ্ছি। পরের শনিরবি কলকাতার ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল। বোর্ডের সবথেকে ওপরের, সবথেকে বড় E-টাই পড়তে পারলাম না।

চশমার অর্ডার নিয়ে দোকানদার বলেছিলেন, ডাণ্ডায় দড়ি বেঁধে দেব বৌদি, বাচ্চা মেয়ে ভেঙেটেঙে ফেলবে? মা অবাক হলেন। বাচ্চা তো কী, একটা চশমা সামলাতে পারবে না? তাছাড়া ক্লাস ওয়ান হতে চলল, এ তো প্রায় অ্যাডাল্ট। দড়িওয়ালা চশমার গোপন শখ গোপনই রয়ে গেল। অনেক বছর পর আত্মীয়বন্ধুর বাচ্চাদের উপহারের জন্য কিনতে গিয়ে বর্ণপরিচয়ের বিশালবপু, রংচঙে, মোমঘষা পাতার নবকলেবরের প্রতি হতাশামিশ্রিত কৌতূহল এবং ফিনফিনে গোলাপি মলাটওয়ালা পুঁচকে বর্ণপরিচয়ের প্রতি মা নস্ট্যালজিয়া প্রকাশ করায় বিক্রেতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। আসলে কী বলুন তো বৌদি, বাচ্চারা পাতা ছিঁড়ে ফেলে তো, তাই টেঁকসই করার জন্য আরকি। মা সত্যিসত্যি অবাক হয়েছিলেন। ছেঁড়ার জিনিস নয় বুঝিয়ে বললেও ছিঁড়ে ফেলবে? ভদ্রলোক কিছু বলার আগে আমিই, কত ধানে কত চাল তো টের পাওনি জীবনে, বলে, টাকা দিয়ে, বই নিয়ে, মায়ের হাত ধরে দৌড়ে দু'শো উনিশ ধরেছিলাম।

চশমা হওয়ার মাসতিনেকের মধ্যে তিন স্টেশন দূরের নামকরা স্কুলের অ্যাডমিশন টেস্টের, যা আমি দিতে গিয়েছিলাম খালি চোখে, রেজাল্ট বেরোল। উতরে গেছি। ক্লাস ওয়ান। এ সেকশন। উচ্চতার বেসিসে বসার সিট নির্ধারিত হল লাস্ট বেঞ্চে। শুরুতে ভালোই পিক আপ নিয়েছিলাম। পাঁচ দুইয়ে দৌড় শেষ হবে, লম্বা বাবার জিনকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেঁটে মায়ের জিন জিতে যাবে, কেউ ভাবেনি। চশমাটা মোক্ষম সময়ে হয়েছিল বটে। ও ছাড়া লাস্ট বেঞ্চে বসলে বোর্ডের কিসুই দেখতে পেতাম না।

পরীক্ষা শেষ করে ভদ্রলোক হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন। বয়স কত?

বললাম। সোয়া বেয়াল্লিশ।

তব তো আপকো পতা হি হোগা প্রবলেম কেয়া হ্যায়। লেকিন বেটা, এক ইস্যু হ্যায়। সেরেছে। কম দেখি পর্যন্ত ঠিক আছে। উপরি ঝামেলা হলেই গেছি। ভদ্রলোক বললেন, তোমার ডান চোখের পর্দা একটু বেশি কমজোরি। বললাম, সেই রকমটাই আগের ডাক্তারবাবুরা বলেছেন। ভদ্রলোক গলা ঝাড়লেন। এতই কমজোরি যে লেসিক করা রিস্কি হতে পারে। কাজেই তোমার মনে যদি এই সুযোগে চশমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সুপ্ত বাসনা থাকে, ভদ্রলোক দুঃখী মুখ করলেন, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড দ্যাট উডন'ট বি অ্যাডভাইসেবল।

অত বয়স্ক লোকের কাঁধ তো চাপড়ানো যায় না, নিজের হাঁটু চাপড়েই হাসতে হল। আমার সুপ্ত বাসনার সাত মাইল লিস্টের সাতশো মাইলের মধ্যে চশমা থেকে অব্যাহতি পাওয়া নেই। চশমা কি শুধু দেখার জন্য পরি? চশমা খুললে কানকে পান শুনি, ফুচকা বিস্বাদ লাগে, শীতকালে গরম আর গরমকালে ঠাণ্ডা লাগে। ছ’ছখানা ইন্দ্রিয়েই গ্লিচ লেগে যায় ওই একটি ইন্দ্রিয়সহায়ক না থাকলে। আর যার হাত থেকেই থাকুক, চশমার হাত থেকে নিষ্কৃতির ইচ্ছে আমার নেই।

তাছাড়াও একটা ব্যাপার আছে। অনেক বছর আগে একজন বলেছিল যে চশমা পরা আমাকে চশমা না-পরা আমির থেকে বেটার লাগে। তার পর থেকে আমি কনট্যাক্ট লেন্সের আইডিয়াও মনে স্থান দিইনি। বিয়ের দিন ব্যতীত। সেটারও ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় ঘাড় না পাতার স্বাধীনতার মুখ চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘাড় পাতার স্ট্র্যাটেজি। প্রসঙ্গতঃ, এই যে পালে পালে লোক দাবি করেন যে সিগারেট তাঁরা ছাড়তেই পারছেন না, নব্বই শতাংশ (অ্যাকচুয়ালি, একশো) কেসে জীবনের কোনও না কোনও পয়েন্টে, কেউ না কেউ তাঁদের বলেছিল যে সিগারেট খেলে তাঁদের দারুণ কুল দেখতে লাগে। কাজেই লোকজনের প্রতি আমার অনুরোধ। হরমোনের গুঁতোয় হাবিজাবি যা কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার দিন, একে অপরকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুচিত্রা সেন যা খুশি বলুন, সিগারেট খেলে হট কিংবা কুল দেখতে লাগে সেইটা বাদে। প্রেমে পড়ে/ফেলেই যথেষ্ট ড্যামেজ করেছেন, এইটা আর করবেন না।

ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত এবং খুশি হলেন। একজন কর্মী মহিলাকে ডেকে বলে দিলেন আমাকে যেন এক্সট্রা কেয়ার নিয়ে চশমা করিয়ে দেওয়া হয়।

মহিলা মানে বাচ্চা মেয়ে। তিনি যারপরনাই কেয়ারের সঙ্গে আমাকে কাউন্টারে নিয়ে গেলেন। খাটো স্ট্যান্ডে ডিম্বাকৃতি আয়না। কাউন্টারে দুই কনুই রেখে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে আমার চোখে চোখ রেখে সেই প্রশ্নটা করলেন, যেটার প্রত্যাশায় কাঁটা হয়ে ছিলাম।

বাইফোকাল দিখাউঁ ইয়া প্রোগ্রেসিভ?

বাইফোকাল হল যে চশমার কাচের মধ্য দিয়ে একটা লাইন চলে যায়। সরলরেখা হতে পারে বা সেমিসার্কল। আর প্রোগ্রেসিভ হল যে কাচ নিদাগ, মসৃণ। বোঝাই যাবে না (অন্তত শুধু চশমা দিয়ে) যে আপনাকে চালশে ধরেছে। একই লেন্সে মালটিপল ভিশন, যেদিকে যখন তাকাবেন যেমনটি দরকার তেমন দেখতে পাবেন।

গলা যথাসম্ভব নামিয়ে বললাম, প্রোগ্রেসিভ।

গলা নামালাম কারণ রিসার্চ করে যাইনি,প্রোগ্রেসিভ লেন্স কার্যকারিতায় বাইফোকালের থেকে এগিয়ে কি না জানি না। বাইফোকালের বদলে প্রোগ্রেসিভকে পক্ষপাত দর্শানোর কারণ কার্যকারিতা নয়, বিশুদ্ধ ভ্যানিটি।

আমার ধারণা, ভ্যানিটি ব্যাপারটা আমার মধ্যে গড়পড়তার থেকে কম। ভ্যানিটি বলতে বহিরঙ্গের দর্শনজনিত ভ্যানিটি। ভ্যানিটি কম হওয়ার পুরো কৃতিত্ব আমার নয়, এমন দুজনের ক্রোমোজোম দিয়ে আমি তৈরি, বহিরঙ্গ নিয়ে মাথাব্যথা যাদের গড়পড়তার থেকে কম। তবে সবটা তো নেচার হয় না। নারচারের অংশটুকুর পঁয়ত্রিশ পার সেন্ট নিজে প্র্যাকটিস করেছি। নীতিশিক্ষার বইতে ভ্যানিটি পরিত্যাজ্য লেখা ছিল বলে। যেমন ভাবে সামাজিক মইয়ে নিচে থাকা লোকজনকে তুই বলিনি, সেইভাবেই চামড়ার ঔজ্জ্বল্যকে প্রায়োরিটিতে পেছনে রেখেছি।

পনেরো পার সেন্টের দায় নিয়েছে চরিত্রের এমন একটা দিক যাকে আবার নীতিশিক্ষার বইতে দূরছাই করা হয়েছে। এখনও আছে অল্পস্বল্প, কিন্তু এককালে, বিশেষ করে যখন সাজগোজের দিকে মন যেতে শুরু করে, বাঁধভাঙা ছিল। লো সেলফ এসটিম। সাজলে কি আরও আন্ডারলাইন করে দেখানো হবে না আমি সত্যিই কতটা খারাপ দেখতে?

কিন্তু নীতিশিক্ষা জীবনধারণের দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজি হতে পারে না। তার জন্য লাগে ব্যবহারিক সুবিধে। যে নীতিগুলো মেনে চললে রোজকার বাঁচা মসৃণ হয়, বা অমসৃণ হওয়া এড়ানো যায়, সেই নীতিগুলোই ফাইন্যালি মেনে চলা যায়। যেমন ফস্‌ করে তুই বললাম, তিনিও আমাকে উল্টে 'তুই' বলে উত্তর দিলে যেহেতু ভালো লাগবে না, সে হেতু কাউকে তুই বলব না। বসের ঘরে গিয়ে হাত কচলাতে চাই না বলে অধস্তনকেও হাত কচলাতে বাধ্য করব না। চুরি করব না অন্যের দ্রব্যে না বলিয়া হাত দেওয়া পাপ বলে নয়, সিমপ্লি এই জেনে যে ধরা পড়ে গেলে পুলিশ ডাণ্ডাপেটা করবে।

কাজেই কেবল নীতিশিক্ষা বা নীতিশিক্ষার অভাব দিয়ে ভ্যানিটিকে আমি বাগে রাখিনি। একটা অত্যন্ত রক্তমাংসের, প্র্যাকটিকাল কারণ আছে। কারণটার একটা চমৎকার উদাহরণ আছে। বা ছিল আমাদের পাশের বাড়িতে।

সে বাড়িতে দুই ভাই ছিল। বড় ভাই সব মাসিক, ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হত। ছোট ভাই মাসিক, ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক সবেতেই উতরে যেত। বুদ্ধি কম বলে নয়। দাদার থেকে চৌখস বরং কিছু বেশিই। এমনও নয় যে বংশের বড় বাতির প্রতি বাবামা বাড়তি যত্ন নিতেন। ছোটটিও কিছু কম চোখের মণি ছিল না।

সকলেই অবাক হত। বলত, কেন রে? দাদাকে দেখে হিংসে হয় না? নিদেনপক্ষে ইচ্ছে? দাদার মতো পড়াশোনা করে টপাটপ ফার্স্ট হওয়ার? হাততালি পাওয়ার? ছোট ভাই, তার তখন কত, ক্লাস ফোরটোর হবে, বলত, একটুও না। আমি তো বরং পরিশ্রম করে কম নম্বর পাই যাতে ফার্স্ট না হয়ে যাই। না হলে আর ফার্স্ট হতে কী? সবাই পারে। সবাই বলত, কেন রে? ভাই বলত, কারণ একবার ফার্স্ট হলে প্রতিবার ফার্স্ট হতে হয়। পরীক্ষার আগে মা ঘুমোতে দেয় না, বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসে, দাদার কানে ঘন ঘন প্যাঁচ মারে। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে রিকশায় বসে মা রিভিশন দেওয়ায়। পরীক্ষা থেকে ফিরে প্রশ্নপত্র সল্ভ করে দেখাতে হয়। আমি নাচতে নাচতে পরীক্ষা দিতে যাই, দিয়ে এসে খেলতে ছুটি। দাদার নম্বর নিয়ে চুল চিরে চিরে বাবামায়ের নাওয়াখাওয়া ডকে ওঠে, আমার রেজাল্ট ভালো করে পড়েই দেখে না কেউ।

বড় হয়ে কোন ভাই বেশি শাইন করেছে বলে দেওয়ার দরকার নেই আশা করি।

আমি এমন কিছুতে ঢুকতেই চাইনি, চাই না, যেটা একবার শুরু করলে আর থামা যায় না। অধিকাংশ ভ্যানিটির পথই তাই। এই শিক্ষা আমার মাকে দেখে হয়েছিল। মা আত্মবলিদান দিয়ে আমার চক্ষুরুন্মীলন ঘটিয়ে গেছেন। মায়ের চুল পেকেছিল ছোট বয়সেই। সবাই বলেছিল, কী সাংঘাতিক, এই বয়সে চুল পেকে গেল? শিগগিরি রং করে ফেলো। তাঁদের দোষ নেই। নীলের গামলায় পড়ে যাওয়া শেয়ালরা বাকি শেয়ালদের নীলের গামলায় পড়তে উদ্বুদ্ধ করবেই। মা রং করা শুরু করলেন। বিউটি পার্লারে যাওয়ার অপশনটাও মায়ের মাথায় আসেনি আমি শিওর। এলেও যেতে পারতেন কি? তিরিশ বছর আগে রিষড়ায় পার্লার ছিল? খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। রবিবার সকাল থেকে শুরু হত। প্রথমে শ্যাম্পু। তারপর কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল শুকোনো। তারপর রং লাগানো। শুকোনো। তারপর আবার শ্যাম্পু। সকাল সাতটা থেকে শুরু করে হেসেখেলে বেলা তিনটে। আর এই গোটা সময়টা তো মা ফ্যানের তলায় চিৎপাত হয়ে রবিবাসরীয় পড়তেন না। সারা সপ্তাহের জমানো কাপড় কাচতেন। ইস্ত্রি করতেন। জলখাবারে চাউমিন বানিয়ে চাউমিনের থালা টিভির সামনে মুগ্ধদৃষ্টিতে বসে থাকা দর্শকদের সামনে পৌঁছে দিয়ে আবার কুড়িয়েবাড়িয়ে আনতেন। শুক্তো থেকে মাটন হয়ে চাটনি রাঁধতেন। বাগান ইত্যাদি পরিষ্কারের লোক এলে তাঁদের তদারকি করতেন। আমাকে পড়তে বসাতেন। টিভি থেকে টেনে টেনে রাখতেন।

বলতাম, কেন কর, মা? ওপরের কাজগুলো মাকে করতেই হবে বুঝে গেছিলাম তদ্দিনে, আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল চুলের রং। ওটা বাদ দিলে তো একটা যন্ত্রণা কমে। মা বলতেন, শুরু করে ফেলেছি, এখন থামালে খুব অদ্ভুত লাগবে সোনা। জোর আমি কাউকে করি না, মাকেও করিনি। মা বলতেন, রিটায়ার করার পর আর করব না, দেখিস সোনা। সত্যিটা জানতাম, বলিনি। বলা বাহুল্য, রিটায়ার করার পরেও মা থামতে পারেননি।

তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ইলেভেনটুয়েলভে সায়েন্স নিয়ে নেব, সম্বন্ধ করে বিয়ে করে ফেলব, তবু চুল পাকলে কলপ করব না। ভুরু প্লাক করব না। কোভিডে টেঁসে যাওয়ার টেনশনের ওপর, এতদিন ভুরু না ছেঁটে গোরিলার মতো দেখানোর টেনশন করতে পারব না। তার থেকে ঢের ভালো আগাগোড়া গোরিলা হয়ে থাকা। তার ওপর যেচে ওই ব্যথা? বাপরে বাপরে বাপ। ওই খরচ? ও দিয়ে তিনদিন রান্না না করে বাইরে খাওয়া হয়ে যাবে।

তবে এ সব ছেঁদো কারণ। ওই রাস্তায় না হাঁটার একটা এক কোটি গুণ বেশি ভয়ের কারণ ছিল। বারংবার ডুব দিতে দিতে, একদিন নীলের গামলা থেকে ডুব দিয়ে উঠে,  ডুব না দেওয়া শেয়ালদের দেখে অস্বস্তি হওয়ার ভয়। নীলটাই যে আমার এবং পৃথিবীর বাকি শেয়ালদের স্বাভাবিক রং, সেই প্রত্যয়টা বুকের ভেতর গেঁথে যাওয়ার ভয়। মা যে মা, তাঁরও হয়েছিল। মা বলেই পুরো নিন্দে করতে পারছি না। ডিসক্লেমার দিচ্ছি। পৃথিবীর অন্য কোনও মানুষের চেহারা নিয়ে একটি মন্তব্যও মায়ের দাঁতের ফাঁক দিয়ে কোনও দিন বেরোয়নি। কিন্তু আমার বেলা মা সে সৌজন্য রক্ষা করতে পারেননি।  মা ভয় পেয়েছিলেন। একে আমি অর্চিষ্মানের থেকে বড়, তারপর পাকাচুল নিয়ে ঘুরলে পাছে শ্বশুরবাড়িতে হতাশার কারণ ঘটে (এবং সে হতাশা আমার প্রতি কোনওরকম বীতরাগ হয়ে ফোটে) সেই ভয়ে মা কাঁটা হয়ে থাকতেন। মা একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমার পেছনে লেগে ছিলেন, নরমেগরমে, চুলে রং করার জন্য।

করিনি। ঠিকই করেছি।

মা এতই বিচলিত ছিলেন বিষয়টা নিয়ে যে দুয়েকজন আত্মীয়স্বজনের কাছে হতাশা প্রকাশও করে ফেলেছিলেন। মায়ের মৃত্যুর তিনদিনও যায়নি, শোওয়ার ঘরে মায়ের খাটের ওপর ঠাসাঠাসি করে বসে একগাদা সান্ত্বনাবাক্যের পর গলা ঝেড়ে তাঁরা বলেছিলেন, মা থাকতে থাকতে মায়ের ইচ্ছে পূরণ করনি,  এইবার অন্তত মায়ের স্মৃতির সম্মানে চুলটা কালো করে ফেলো সোনা। রাগ করিনি। কারণ ওঁরা নিরুপায়। ওঁদের সবার কানের পেছন, হাতের তেলো, নাকের ডগা নীল হয়ে গেছে। দুই কান ছুঁচলো হয়ে উঠেছে আর একটা করে ল্যাজ গজিয়েছে। ওঁদের দোষ নেই।

উপরোক্ত শৃগালদের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে অত শিওর হবেন না। কোনওপক্ষই কম যান না।

তাছাড়া এর তো শেষ নেই। এই যে মা ঘাড় পেতে, ওই বিষম সময়, এনার্জি খরচ করে, সপ্তাহের একটি দিনের কয়েকটি ঘণ্টার অবসর গোল্লায় দিয়ে পাকাচুল লুকিয়ে ফেললেন, তারপর কী হল বলে আপনার ধারণা? সবাই বলল, উফ বৌদিকে কী লাগছে? মণি এবার নীলবর্ণ শৃগাল সমিতির সদস্যপদের সমস্ত ক্লজ ফুলফিল করেছে, এবার ওকে মহাসমারোহে বরণ করে তোল? দাঁড়ান দাঁড়ান। মা যে এত রোগা, সেটার কী হবে? মায়ের চামড়াটাও তো যথেষ্ট চকচকে নয়? চোখের নিচের ক্লান্তি? 

রিটায়ারমেন্টের বছর পাঁচেক পর, মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে, মা চুল রং করা ছেড়েছিলেন। বাড়ি গেছি। মায়ের সঙ্গে বাজারে ঘুরছি, ফুলঝাড়ু, বাঁধাকপি, পেয়ারা কিনছি, এমন সময়, আরে অর্চনাদি! পুরোনো চেনা। সেই যবে থেকে নতুন চশমা এঁটে নতুন স্কুলে যেতে শুরু করলাম, তখন থেকে আমাদের সঙ্গে ইনিও ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতেন। আমাকে দেখে কী বললেন সেটা আমার মনেও নেই কিন্তু বলেছিলেন শিওর, মনের কথা  কি আর মনে চেপে রেখেছিলেন? মাকে দেখে যে আঁতকে উঠেছিলেন সেটা মনে আছে। একী অর্চনাদি, এত চুল পেকে গেছে আপনার? মা বোধহয়, পেকেছে অনেকদিন এখন দেখা যাচ্ছে ইত্যাদি গোছের কিছু বলে হাসার চেষ্টা করেছিলেন, সে হাসি শেষ করার সুযোগও না দিয়ে  চেনা লোক চোখেমুখে অসামান্য কারুণ্য ফুটিয়ে বলেছিলেন, আসলে এভাবে আপনাকে দেখে অভ্যেস নেই তো, খুব খারাপ লাগছে।

ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল চোখ না বুজেও দেখতে পাই। ডানদিকে শনিমন্দির, বাঁ দিকে দীনেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, দশহাত দূরে লেভেলক্রসিং। বন্ধ। অপেক্ষারত সাইকেল, রিকশা, স্কুলভ্যান, টেম্পো, পাঞ্জাব লরি, মারুতি অল্টো, মানুষ মিলিয়ে মারকাটার। মনে আছে সব ছাপিয়ে একটা হিংস্র ইচ্ছেের মগজ ছেয়ে ফেলা। কনসিকোয়েন্সের বোধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে না বইলে সে ইচ্ছে সেদিন আমি পুরণ করে ফেলতাম।

দুঃখের বিষয়, এত জেনেশুনেবুঝেও কোথাও না কোথাও রক্তবীজ থেকেই যায়। লজ্জিত ভঙ্গিতে হলেও, বাইফোকালের বদলে প্রোগ্রেসিভ লেন্স বাছিয়ে নেয়। চশমার দাগ লুকিয়ে বয়স লুকোনোর চেষ্টা করিয়ে নেয়। যদি নিজের প্রতি নরমও হই। হয়ে ভাবি, হয়তো পুরো ইচ্ছেটা বয়স লুকোনোরও নয়, হয়তো খানিকটা তাগিদ ওই চশমা পরে ফুচকা খেতে গিয়ে চেনা লোকদের সামনে পড়লে তারা আমার চশমা ও চালশে নিয়ে যে অবধারিত ডিসকোর্সে ঢুকবে তার থেকে প্রাণ বাঁচানোর, তাহলেও সান্ত্বনা মেলে না। সেই সব মতামতের থেকে নিজেকে যতটা ইমিউনড মনে করি ততটা নই তার মানে।

গ্লানি আরও বাড়াল বাইফোকাল আর প্রোগ্রেসিভের দামের তফাৎ। ভ্যানিটি কস্টলি বটে। প্রোগ্রেসিভের আবার গ্রেডেশন আছে। প্রোগ্রেসিভ লেন্সে, বেসিক্যালি, কাচের মাঝখানটা কাজের, চারপাশের অংশটুকু ডিসটর্টেড। নর্ম্যাল প্রোগ্রেসিভ লেন্সে ডিসটর্শন বেশ বেশি, বা লোককে দামি অপশনগুলোর দিকে ধাবিত করার জন্য বাড়িয়ে বাড়িয়ে এঁকে রেখেছে। প্রিমিয়াম প্রোগ্রেসিভে ডিসটর্শন কম, ডায়মন্ড গ্রেড প্রোগ্রেসিভে অগ্রাহ্য করার মতো। আড়চোখে দেখার প্রিভিলেজ এখনই ছাড়তে চাই না বলে ডায়মন্ডেই ঘাড় পাতলাম। তার ওপর আমার হাই ইনডেক্স কাচ লাগে, ভ্যানিটির জন্য নয়, ভারের চোটে নাক খসে পড়া এড়াতে। তাহলে ডায়মন্ড + ইন্ডেক্সটাই ফাইন্যাল করুন বলে হাঁফ ছাড়তে যাব, মহিলা জানতে চাইলেন, ল্যাপটপের হেভি ইউজ হয় কি না। বলে কী? ল্যাপটপ কর্তৃক আমি হেভিলি ইউজড। তব তো ব্লু লাইট প্রোটেকশন ভি চাহিয়ে। বলে বার করলেন একটা টর্চ, যার হাইড্রা-র মতো মালটিপল মাথা থেকে নীল রং বিচ্ছুরিত হয়। একফালি 'ব্লু লাইট প্রোটেকশন' সমৃদ্ধ কাচ সেই নীল আলোদের সামনে ধরে দেখিয়ে দিলেন, স্বচ্ছ কাচ ফুঁড়ে এক বিন্দু নীলও যেতে পারেনি। পুরো ম্যাজিক।

শুধু দাম বাড়বে বলে নয়, ঘাড় পাতারও তো একটা সীমা আছে। বললাম, বুঝেছি খুবই কাজের জিনিস, কিন্তু এটা নেব না, সরি। দোকান থেকে বেরিয়ে যেই না অর্চিষ্মানকে বলেছি, ব্লু লাইট প্রোটেকশনটা গিলিয়ে দিতে পারত, অর্চিষ্মান আমার বাক্য সম্পূর্ণ করল, যদি ওই ম্যাজিকটা না দেখাত। হাই ফাইভ দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে আগরওয়াল সুইটসের পানিপুরির দিকে হাঁটলাম।

নির্ধারিত দিনে ডেলিভারি নিতে গেলাম। নতুন চশমা পরে ডাইনেবাঁয়ে ওপরনিচে ঘাড় ঘুরিয়ে, দোকানের সবার অভিনন্দন নিয়ে বেরিয়ে আসছি, মনে পড়ল। দৌড়ে গেলাম। আমার ঝাপসা, আঁচড়ময়, ডাণ্ডাবেঁকা চশমাটা? জীবনের শেষ নন-চালশে চশমাটা? ব্যাগ মে ডাল দিয়া, ম্যাম। থ্যাংক ইউ। বাড়ি ফিরে সেটাকে খাপে ঢুকিয়ে রাখলাম। আরেকজন চলে গেল জীবন থেকে চিরদিনের মতো। গায়ে হাত বুলিয়ে থ্যাংক ইউ বললাম। এই চরম অদূরদর্শিতা সম্বল করে কত সূর্যোদয় দেখলাম, কত সূর্যাস্ত।  প্রেমিকের চোখ দেখলাম, বন্ধুর হাসি। বই পড়লাম, সিনেমা দেখলাম। হোপফুলি, নিজেকেও দেখলাম অল্পস্বল্প, উল্টেপাল্টে। তুমি ছিলে বলে।

বাবাকে ফোন করলাম। বাবা পুরীর বিচে বসে বডিবিল্ডিং কম্পিটিশন দেখছিলেন। চালশে চশমার খবর দিলাম। বাবা প্রথমটা বুঝতেই পারছিলেন না। তারপর গলায় হাসি ফুটল। তাও তো বটে। হওয়ারই তো কথা। কল্পনা করতে চাইলাম, বাবা কী দেখছেন। অফিস থেকে ফিরে আমাকে বিছানা থেকে তুলে সিলিং-এর দিকে ছুঁড়ছেন? কাঁধে চাপিয়ে গড়ের মাঠে হাঁটছেন? ক্লাস নাইনের জন্মদিনে শাড়ি কিনে নিয়ে আসছেন? নাকি দেখছেন আঠাশ বছরের ছ'ফুট ছুঁইছুঁই কালো ফ্রেমের চশমাপরা সেই তীব্র যুবকটিকে, বালি নার্সিংহোমের সিঁড়ি টপকে টপকে যে উঠছে, নার্সিংহোমের বাইরের বাজার থেকে কেনা ঝুমঝুমির গোল মুন্ডুখানা শার্টের বুকপকেট থেকে বেরিয়ে আছে।

চশমাটা বানিয়েছে ভালো। ফন্ট আবার বারোতে নেমে এসেছে। ডিসটর্শনের ব্যাপারটা না জানা থাকলে ধরতে পারতাম না। আগের মতোই দেখছি সব। খালি দামটা, সত্যি বলছি, ভুলতে পারছি না। বা দামটা আসলে কীসের চোকালাম, সেই কটু সত্যিটা। এক্সট্রা যত্নে রেখেছি। দু'বেলা দোকান থেকে যে সলিউশনটা দিয়েছে সেটা দিয়ে, নির্দিষ্ট মোছার রুমালটা দিয়ে মুছছি। সেদিন রাতে ক্যান্ডি ক্রাশের লাইফ শেষ করে চশমাটা খুলে অর্চিষ্মানকে ওর দিকের টেবিলে রাখতে দিলাম, ও মা, ফটাস করে ডাঁটি ভাঁজ করতে লেগেছে। ছাদের সমান লাফ দিয়ে উঠে ছিনিয়ে নিয়ে, ডাঁটি আবার মেলে, ফুঁ দিয়ে অর্চিষ্মানের মুহূর্তের অযত্ন যথাসম্ভব উড়িয়ে,  চশমাটাকে আমার দিকের টেবিলে রাজার মতো বসিয়ে রাখলাম। অর্চিষ্মান এত জোরে এতক্ষণ ধরে এত পেট চেপে ধরে হাসল যে প্রসেনজিৎ পরদিন এসে জিজ্ঞাসা করেছিল কিছু হয়েছিল কি না।

অর্চিষ্মান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে একদিন নাকি আমি চেয়ারের ওপর চশমাটা পেতে তার ওপর বসব। এবং সে দিন আসবে অচিরেই। ম্যাক্স দু'মাস। মিলিয়ে নিয়ো। হাঁটু নাচিয়েছে।

হয়তো আসবে। আসলে আসবে। টুডে ইজ নট দ্যাট ডে।

Comments

  1. amar ek cousin jibone prothom choshma chokhe die bolechilo "brishtir fota dekha jae?". Apnar choshma ar shajshojjar golpo pore sob barer motoi bhishon bhalo laglo. Koto golpo je mone pore galo. Amar ma shottor-urdho jiboneo chul kalo kore jachhen.....ar tar chele, meye, jamai sobai sada chul nie ghure berachhi. Ma o ghorei koren chuler rong. Khub mojar scene hoe jokhon dekhi baba bose jan ma'r chule rong laagate. Edike baba'r chul kintu shada bohu din.......aar ekta natoker dialogue mone pore galo "Public er mukh to apni bondho korte parben na".....ei kotha ta hare hare ter pai. ...Notun bochorer shuvechha roilo......Moutushi

    ReplyDelete
    Replies
    1. কাজিন তো মারাত্মক কাব্যিক , মৌটুসি। ভারি ভালো লাগল বৃষ্টির ফোঁটা দেখার চাওয়াটা জেনে। নববর্ষের অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা আপনাকেও। ১৪৩০ মারকাটারি কাটুক।

      Delete
  2. আমার সিগারেটের অভ্যেস আছে, তবে আমায় তো কেউই কোনোদিন বললো না যে আমাকে সিগারেট খেলে কুল লাগে। বললে তাও একটা কুল লাগার উপায় তো পেয়ে যেতাম।
    আমি অবশ্য "ছাড়তে পারছি না" বা এরম কিছুর ক্লেম করি না।

    সাদা চুলে তো বেশ একটা "classy look" আসে। শুধু শুধু কালো করতে যাবো কেন!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেকী, কেউ কুল লাগে বলেনি তা সত্ত্বেও এখনও খেয়ে যাচ্ছেন? সিগারেটের প্রতি আপনার ভালোবাসা খাঁটি, মেনে নিলাম।

      Delete
  3. নববর্ষের শুভেচ্ছা কুন্তলাদি। লেখাটা ভারী ভালো লেগেছে। অবশ্য তোমার বেশীরভাগ লেখাতেই একই কমেন্ট করি, কিন্তু ভালো লাগাটা অনেক রকম হলেও শব্দ ভান্ডারে তো ভালো লাগাই আছে, তাই..
    চশমা আমার হয়েছিল, ক্লাস ফাইভে, সে সামান্য পাওয়ার শখে পরতাম। আসল চশমা হল, আপিস শুরু হবার পর৷ ব্লু লাইট না কী বলল, ওইটে অবশ্য আমি ঘাড় পেতে নিই।
    প্রোগ্রেসিভটা নিয়ে ভালোই করেছ মনে হিয়, আর কিছু না ওই আড়চোখে দেখাটা বাদ যায় কেন।
    পুরোনোদিনের কথা এত বিশদে অনেকদিন পরে লিখলে, ভালো লেগেছে বড়।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. আড়চোখে দেখা দীর্ঘজীবী হোক, প্রদীপ্ত। ব্লু লাইটে কাজ দেয় বলছ?

      Delete
  4. daarun laglo lekhata.. onek onek identify korlam..

    aamaro progressive chasma. ekta chosma bhul kore boRo size er lens kinechilam, se aar use e korte parlam na.. soru chosma ta cholche bhalo.. aar oi bibhinno dhoroner add on diye bhoyonkor daam baaRte thakata ekta sanghatik byapar chosmar dokane.. jetei tension hoy.. ei sob chalser aage aabaar aamaar bhai er chilo photochromatic lens, taateo almsot eirokomi dhape dhape daam baaRto.. blue light protection ekbar bodh hoy niyechilam.. tarpor normal kapoR diye chosma muche siggiri chosmar lens er rong sada kore phelechilam.. tobuo ebaaro bodh hoy blue light protection aache..

    aamaar maa o chul rong korten.. protyek soptahe noy, tobe bhaloi tamjham chilo.. aamio chul rong kori.. tobe knuRemi kore majhe emon gap diye pheli je puro kalo theke puro sada ekta odbhut cycle e ghurte thaki.. tobuo ekhono clientder chomke na deyar jonne rong kore jacchi.. parlour e giye rong korte osojjho lage, tobu chul ekhon "boys cut" tai rokkhe.. mostly sara jibon amakeo ei ghani taante hobe.. aamaar kintu tobuo mone hoy je aamaar vanity o besh kom.. hoy toh noy

    khub bhalo thakben.. shubho noboborsho..

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভ্যানিটি কম হলেই যে দারুণ ব্যাপার হবে তাও তো না। অন্য দোষ হয়তো এমন বেশি আছে যে ভ্যানিটি কম দিয়েও সামলানো যাচ্ছে না। কাজেই এই সব কমবেশি থাকা না থাকা উনিশবিশ বলেই আমার বিশ্বাস, ইন্দ্রাণী। কোনওটাই যাতে হাতের বাইরে না যায় সেটা দেখেশুনে রাখাই আমাদের রোজকার কাজ।

      Delete
  5. Amaro choshma r bhari shokh chhilo. Besh kalo mota frame er choshma ....
    To sei ukg ba class 1 nagad prothom sujog holo. Matha dhore bole chokher dr er kachhe niye gelo. Tini bollen ..oi line gulo poro to.
    Ami gorgoriye shesh line obdhi pore dilam.
    Bhari bake dr chhilo, choshma dilo na!
    To abar bpchhor 2/3 pore ek e complain niye abar ek dr. Ebar amio 2/3 bochhor beshi buddhiman.
    Besi risk na niye ami second ba 3rd line ei hochot khelam.
    Dr ti genuine baje chhilen. Bhuru kuchke onekshan ki sab bhebe abar eye drop top diye chhere dilen.
    Er por abar bochhor khanel er mathay abar...ebar fortunatrly onyo dr. Ini choshma nnite bollen.
    Ami to mohanonde dokan a giye straight select kore fellam...amar dadu ar dokandar onek bojhalo erokom kalo mota frame ekdom bhalo lagchhe na ..etc. kintu ami amar pochhonde onor.
    To se anondo o dekha gelo oti kshanosthayee. choshma pore school a jaoa matro sabai eto hoi hullor korlo....se 2/3 din por chhere dilam
    Er por arekbar colege jeeban a. Sebar ekta sundar kalche lal frame rr choshma. Kintu demha gelo choshma pore motei football khela jay na. On hindsight, football khelar samay porat darkar o chhilo na bpdhhoy...but tokhon matha y ase ni. Bar duyek bhenge jabar por bollam thak apatoto.
    Er por finally 42-43 pouchhe abar holo. Tarpor koyek bochhore ebar relationship ta jomechhe. Mone hovhche baki jeeban ta katbe. Oti sundar kalo frame er choshma
    ...ektu patla r opor.
    Ei lekha ta pore eiisab mone pote gelo..ar mone hlo Bahu din oparer ek balok er jhapsa mukhe muchki hasi ....
    Sundar lekha...bhalo laglo.

    ReplyDelete
  6. Ar oporer lekha ta choshma chhara. Proti ta typo amar ar ebarer choshma r somporko dirgho korar proman hobe

    ReplyDelete
    Replies
    1. শিবেন্দু, কেমন করে বললেন, বহুদিন ওপারের এক বালকের ঝাপসা মুখে মুচকি হাসি, মনটা কেমন খারাপ-ভালো হয়ে গেল।

      টাইপো তো তেমন দেখলাম না কিছু? তবে সে জন্য চশমার সঙ্গে সম্পর্ক ঢিলে করবেন না।আপনার সঙ্গে চশমার এই হতে হতেও না হওয়া না হওয়া এবং অবশেষে হওয়া সম্পর্কের গল্পটা পড়ে যারপরনাই ভালো লাগল। থ্যাংক ইউ। ভালো থাকুন চশমা পরে।

      Delete
  7. এখনকার জীবনে দুর্লভ হাসিটা তুমি এমন ভাবে ছড়িয়ে দাও যে, শুধু কি ভাল বললে মন ভরে না। গাল বাড়িয়ে দাও, একটা চুমু দেই।
    তোমার মা-র সংগে ভাগ্যিস দেখা হয়নি, শুধু গল্প পড়েই আমি বেজায় হীনমন্যতায় ভুগতে থাকি। দেখা হলে মরেই যেতাম। সারা সংসারের কাজ সামলানো, চাকরি করা, মেয়েকে এভাবে মানুষ করা - এরকম দশভুজারা গল্প ও কল্পনাতেই বিধৃত থাকেন, আমারও আছেন। আমি হতে পারিনি।
    চুল রঙ করা নিয়ে আমার ধারণা তোমার সঙ্গে একদম মিলে গেল। একবার বিশেষ প্রয়োজনে চুলে রঙ ব্যবহার করতে হয়েছিল। খানিক পর মনে হতে লাগল, আমি খুব শক্ত একটা টুপি পরেছি । সেটা এক টান মেরে খুলে ফেলতে পারলে আরাম লাগবে। কিন্তু সেতো আর হবার নয়, তাই রঙ ওঠা পর্যন্ত প্রচণ্ড শারীরিক আর মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হল। আর পাকা চুলের কি মহিমা ! মুখোমুখি আড্ডা না হলে বলা যাবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। পোস্ট ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল। চুল রং করে টুপির ফিলিংটা ভালো বর্ণনা করেছেন, ব্যাপারটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠলে টুপি-টুপিই মনে হওয়ার চান্স বেশি। আর মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রসঙ্গে বলি, মা একেবারেই ইন্টিমিডেটিং ছিলেন না, একেবারেই সোজাসাপটা হাসিখুশি টাইপ ছিলেন, কাজেই আলাপ হলে ও রকম কোনও শক্ত শক্ত অনুভূতি জাগত না, শিওর। ভালোই লাগত।

      Delete
  8. Ek bandhobi er thelai pore apnar lekha porte suru korechilam,aj hotat ei lekha ta porlam,mon ta valo hoe gelo...amar chokhe high power choto theke,chosma jinista ekkere pochondo noi choto theke tai boro hoe lens ke apon korechi r Lasik ke apon korbo bhebeo duchhai bole pichie esechi...kal amar 6 bochorer meye er chokh e minus power dhora porlo,mon ta khub kharap chilo,ei lekha ta pore khub khub bhalo laglo...
    Dhonyobad...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আমার আপনাকে দেওয়ার। অবান্তর পড়ার জন্য, ভালোলাগা জানানোর জন্য। আপনার কন্যার চশমাজীবন নিরাপদ ও নিশ্চিন্তির হোক।

      Delete

Post a Comment