সময়ের ফের



নববাবু বিচলিত হলেন। ইস, হারমোনিয়ামটার সারা গায়ে তো ঘামাচি হয়ে গেছে। নির্ঘাত কেউ পাকামো করে রোদে দিয়েছিল?

হারমোনিয়াম যে রোদে দেওয়া উচিত নয় বিজলীদিকে সকালেই সে বাবদে জ্ঞানদান করেছি। তবু লাফিয়ে পড়ে ক্রেডিট নিতে পারলাম না। নববাবুর উপমাটা আমার ক্রেডিটের ধক তলানি করে দিল। রোদ্দুর লেগে পালিশ চটে গিয়ে সারা গায়ে জন্মানো ফ্যাকাশে ফুটকিগুলোকে হারমোনিয়ামের ঘামাচি বলে চালাতে বাংলাদেশের খুব বেশি কবিসাহিত্যিকের কুলোবে না।

নববাবুকে এমারজেন্সি কল দিয়েছে বাবা। আগেরদিন সকালে ২০৪৮ খেলতে খেলতে আঙুল অবশ করে ফেলছিলাম, এমন সময় বিজলীদি কথা নেই বার্তা নেই দমাস করে এনে হারমোনিয়ামটাকে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল। এই নাও সোনা।

আরে এটা কে! বলে ২০৪৮ ফেলে লাফিয়ে উঠে বেলো খুলতে না খুলতে, রিডে আঙুল ছোঁয়ানোর আগেই একটা কনস্ট্যান্ট প্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ। আঙুল ছোঁয়াতে কোমল ধা, কোমল নি আর ওপরের সা-এর রিড খুলে এদিকওদিক ছিটকে পড়ল।

মায়ের হারমোনিয়ামটা পঁচাত্তর সালের। চাকরি পেয়ে নিজেই গানের মাস্টারমশাই ঠিক করে, নিজেই হারমোনিয়াম কিনে এনেছিলেন মা। সেই হারমোনিয়াম ছোটমামা মায়ের শ্বশুরবাড়ি আসার ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিলেন। নিজের গান মাথায় উঠল, অ্যাজ ইফ একটুও দুঃখ হচ্ছে না ভঙ্গিতে মা আমাকে হারমোনিয়ামে বসিয়ে দিলেন। সারেগামা শুরু হল। লায়েক হয়ে হারমোনিয়াম ফেলে চম্পট দেওয়ার পরে শুনেছি মা নিয়মিত ওটা বাজিয়ে গান গাইতেন। পাড়ার পিসি, কাকি, জেঠিদের নিয়ে গানের আসর বসত বাড়িতে।

নববাবু বললেন, একটা অক্টেভে ক'টা স্বর থাকে জানো?

নববাবুর হাইট আমার সমান, প্রস্থও অনুরূপ। তফাৎ শুধু আমি জীবনভরের ছাত্র (ফেল করা) আর নববাবুর দিকে একবার চোখ ফেললে যে কেউ বলে দেবে ভদ্রলোক জাত মাস্টারমশাই।

বললাম, বারো।

নববাবু ভুরু কোঁচকালেন। কী রকম শুনি?

কর গুনতে শুরু করলাম। সা, রে, রে, গা, গা, মা, মা, পা, ধা, ধা…

হয়েছে হয়েছে। হাত তুললেন নববাবু। বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, সা আর পা, এই দুটি বাদ দিয়ে সবক’টি স্বরের দুটি রূপ, কোমল আর কড়ি। বাবা মাথা নাড়লেন।

নববাবু আমার দিকে ফিরলেন। আচ্ছা, এমন একটা রাগ বল দেখি যাতে পা নেই?

লাক বলতে হবে, আজ সব প্রশ্ন কমন পড়ছে।

বললাম, মালকোষ।

নববাবু খুশি হলেন কি না বুঝতে পারলাম না। আমার কনফিডেন্স ডেফিনিটলি বেড়েছে। বললাম, বুঝতেই পারছেন, জিনিসটার কাহিল অবস্থা। চার বছর হাত পড়েনি। আপনি যা যা সারানোর খুঁজেপেতে সব সারিয়ে দিন।

দেখি কতটা কী করা যায়। ব্যথিত মুখে নববাবু বাঁ হাতে বেলো খুললেন, ডান হাতের মনোযোগী তর্জনী সন্তর্পণে রাখলেন বি ফ্ল্যাটের সা-তে। চেনা আওয়াজ আমাদের বারান্দা থেকে শুরু করে সারা বাড়ি, রান্নাঘর, কুয়োতলা, ছাদ, নিম নারকেল কাঁঠালগাছের মাথা হয়ে কচি কুমড়োলতার আকর্ষ বেয়ে আকাশেবাতাসে মিশে গেল। আর আমি টের পেলাম, আবার সেই টাইমের গোলমালটা ঘটতে শুরু করেছে।

বাড়িতে গেলে এই গোলমালটা হয়। একটা সমসাময়িক সময়ে অন্য একটা সময় কিছু কিছু দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ ভর করে দুমদাম ঢুকে পড়ে। যেমন ধরা যাক, বাড়ির ছাদটা। বছর পঞ্চান্ন বয়স হল, কয়েকবছর ধরে নীল ঢেউখেলানো ঢাকনা পরানো হয়েছে। পাড়ার অনেক বাড়িতেই হয়েছে। রোদে জলে ছাদ চোট খায় না, বৃষ্টির মধ্যে দিব্যি জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া যায়। সকলেই নিঃসংশয়, ব্যবস্থা মচৎকার।

বাড়ি গেলে জাগরণের সিংহভাগ ছাদে কাটাই। সকালে উঠেই একবার ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করি, দশটা নাগাদা আরেকবার। খেয়ে উঠে একবার, সন্ধে নামার সময় আরেকবার, রাতে খাওয়া সেরে লাস্ট ভিজিট। কানে গান গুঁজে ছাদের কোণাকুণি হাঁটি। ওদিকে পৌঁছে দেখি একই নিমগাছের ডালে ডালে পুরোনো নতুন পাতায় কত রকম সবুজ, এদিকে এসে দেখি আমগাছে আম নেই, এ বছর প্রচুর আম হয়েছিল, বাবা হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়ে পাঠিয়ে লোভ দেখিয়ে ব্যর্থ হয়ে সে সব আম দিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে রেখেছিলেন, তারা আমার সুটকেস করে দিল্লিতে এসেছে। অর্গ্যানিক, নো অ্যাডেড সুগার। আমরা সেগুলোতে লেবু চিপে, চাটমশলা ছড়িয়ে টকাস টকাস খাচ্ছি। কাঁঠালগাছও ফাঁকা। পাতা বিক্রি হয়ে গেছে, সুপুরি আর নারকেলের মতো। বেলগাছের ডালে ডালে বেল। গাছটা যে রেটে বাজখাঁই হয়েছে, আশায় আছি পরেরবার গিয়ে অমাবস্যার রাতে ব্রহ্মদৈত্যও দেখতে পাব।

ঢাকনাওয়ালা ছাদে আমার সুবিধেই হল। বাড়িতে থাকাকালীন যে রেটে বৃষ্টি হল, সে বৃষ্টি নিজস্ব পোস্ট ডিজার্ভ করে। তাতে বেশ না ভিজে হাঁটাহুঁটি করা গেল। ঝামেলাটা হচ্ছে, যতক্ষণ ছিলাম মাঝে মাঝেই একটা ঢাকনাহীন ছাদ কেবলই ঢাকনা ফুঁড়ে নেমে আসছিল আমার চোখের সামনে। লোডশেডিং-এর রাত। মাদুর পেতে পাশাপাশি শুয়ে মামেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। মা যথারীতি হাতপাখা নেড়ে, গান গেয়ে, মশা তাড়িয়ে মাল্টিটাস্কিং-এর মিসাল সেট করছেন, আমি খালি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, গোটা জিনিসটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লে কী হবে।

ওই মশামণ্ডিত, লোডশেডিংলাঞ্ছিত, আকাশ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাসম্ভূত ছাদটা ঘাই মেরে মেরে ছাদের নতুন ঢাকনার মহিমা কেবলই মাটি করতে লাগল।

একই ঝামেলা ছাদের নিচেও। এখনকার বাড়িটার সবথেকে বড় লক্ষণ, লোকের অভাব। সকলেই একে একে ফ্রেমবদ্ধ হয়ে হাসি হাসি মুখে দেওয়ালে চড়েছেন। আমি আর বাবা ঘাড় তুলে দেখছি। প্রত্যেকবারই বাড়ি গিয়ে দেখি ঠাকুরের আসন, বুককেস লোকেশন চেঞ্জ করেছে। রান্নাঘরে মাইক্রোওয়েভ, গ্যাস, ইনডাকশন, তিন রকম পদ্ধতিতে রান্না হচ্ছে। বাবাকে মাঝে মাঝে ছবিতে দেখলে চমকে উঠি। একজন বয়স্ক মানুষ। আমি বদলেছি। আকারে আয়তনে বেড়েছি। কিন্তু আমার প্রতি বাড়ির লোকের ব্যবহারে সে বৃদ্ধির কোনও ছাপ পড়েনি।

শুনতে যতই উন্মাদের মতো লাগুক, এই বাড়িটায় আমি শেষ (একমাত্রও) শিশু, বালিকা, কিশোরী এবং ধেড়ে। সামহাউ, বাড়িটা আমার শিশু আর বালিকার মাঝখানের একটা সময়ের স্ক্রিনশট সেভ করে রেখেছে। বাড়িতে যারা নিয়মিত আসাযাওয়া করে তারা এস এস-টা দেখে দেখে আমার ওই বয়সটায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। সকালসকাল মীরামাসি  খাটের রেলিং-এ কনুই রেখে দাঁড়ায়। কী খাবে বল। তেত্রিশবার চা করে দেয় অম্লানবদনে। একবার 'বিজলীদি' বলে ডাকলেই, ডাকের স্থানকালপরিস্থিতি বুঝে, হয় চশমা, নয় গামছা, নয় ইয়ারফোন নিয়ে বিজলীদি মধুসূদনদাদার রূপে আবির্ভূত হয়। শ্যামলী মশারি টাঙিয়ে, গুঁজে, জলের বোতল বিছানার ভেতর পুরে জিজ্ঞাসা করে, সোনা, ছোট লাইটটা জ্বালিয়ে রাখি? অন্ধকারে যদি ভয় করে? ট্রেন থেকে আমার জন্য লালুভুলু নিয়ে আসে ব্যাগে পুরে।

শ্যামলী আমার থেকে একবছরের বড়।

পাড়াতেও এক কেস। বুচিদিদিদের ডিসপিউটেড জমিটা অবশেষে বিক্রি হয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। ভাবা যায়, ফ্ল্যাট? পাড়ার মধ্যে? এতদিন একটা জমিতে একটাই বাড়ি, বাড়িতে একটাই পরিবার। এখন একটা জমিতে পাঁচতলা বাড়ি, পনেরোটা পরিবার। একটা মিনি পাড়া। সে পাড়ায় সবাই নতুন। তারা কি কোনওদিন আমার প্রতিবেশী হবে? যে সেন্সে টুকাইদা, বুচিদিদি, রত্নাকাকিমা, রাজুদা, অশোককাকু আমার প্রতিবেশী? একই অক্ষাংশদ্রাঘিমাংশে, একই গুগল ম্যাপের ঠিকানায়, আসলে অনেকগুলো পাড়া তৈরি হয়ে গেছে। ওদের পাড়ার স্কাইলাইনে একটা বিরাট জলের ট্যাংক, আমার পাড়ায় ওই ট্যাংকের জায়গায় নীল আকাশ, ট্যাংকের নিচে ফাঁকা জমিতে টিমটিমে সুকান্ত উদ্যানে একটা স্লিপ, একটা ঢেঁকি, একটা নাগরদোলা। আমার পাড়ায় পুকুরপাড়ে একটা গিঁটপাকানো ঝুরিওয়ালা বটগাছ, ওদের পাড়ায় সেখানে বাঁধানো, পার্মানেন্ট সংস্কৃতিমঞ্চ।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, কোনও পাড়াই স্থবির নয়। সবক'টা নিজেদের মতো, নিজেদের গতিতে বদলাচ্ছে। এই যেমন সেদিন বেলেঘাটা থেকে উবার নিয়ে নেমেছি পুকুরপাড়ে, অনুপমদার দোকানের মোড়ে। উবার কী কল করে রেখেছে, বাড়ির সামনে ডেসটিনেশন সেট করলে দিল্লি রোড দিয়ে ঘুরিয়ে সাড়ে সাতশো টাকা চার্জ করে, আর পাড়ার "পন্ড”-এ ডেস্টিনেশন সেট করলে জিটি রোডের সোজা কিন্তু জ্যামজর্জর রাস্তা দেখিয়ে বলে, ছশো দিয়ে দেবেন, বউদি। পন্ড থেকে আমার বাড়ির গেট দেড়শো পা। পা প্রতি এক টাকা ভাড়া দেওয়ার মতো দামি পদক্ষেপ আমার হয়নি এখনও তাই আমি দেড়শো পা দূরেই নামি।

নেমে হেঁটে হেঁটে আসছি, সাইকেলে শ্যামলকাকু। শ্যামলকাকু ডেফিনিটলি আমার পাড়ার অংশ। এমনকি আমার আগের পাড়ারও, যখন বাবা কাকু জেঠু পিসি টগবগে যুবক এবং কলকাতা থেকে সদ্য মফঃস্বলে মুভ করেছেন।

ডাকলাম।

পাড়ায় গেলে ডাকাডাকির নিয়মটা মেন্টেন করি। পাড়ার বাইরে বেশিরভাগ জায়গাতেই করি না। পরিষ্কার একে অপরকে দেখছি, চিনতেও পারছি, কিন্তু ও ডাকল না বলে আমিও ডাকলাম না, আমি ডাকলাম না বলে ও-ও ডাকল না করে যে যার পথে চলে যাই। এইসব ধ্যাষ্টামো পাড়াতে চালাই না। প্রধান কারণ, ডাকতে, কথা বলতে ইচ্ছে করে। গৌণ কারণ, রেপুটেশন রক্ষা। পাড়ায় ফিরলে (চাঁদ থেকে নাকি শেওড়াফুলি থেকে ম্যাটার করে না) এবং চেনা লোককে দেখেও না দেখার ভান করলে সবাই ধরে নেয় যে উক্ত ব্যক্তির “গ্র্যাভিটি” মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সে ব্যক্তি যত হনুই হোন, গ্র্যাভিটি বাড়লে তিনি মহাপাতকী। আমি হনুও নই, রেপুটেশনকেও গুরুত্ব দিই। প্রায় কুড়ি বছর ধরে বাড়িতে ফিরছি। চেনা, আধচেনা, চেনা চেনা সন্দেহভাজন লোক দেখলেই ডেকে ডেকে কথা বলি। বুচিদিদি ফিরছে ছাতা মাথায় ছেলেকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিয়ে, টিউশন সেরে, ডাকি। ঠাকুরকাকু নাতির স্কুলবাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, ডাকি। টুকাইদা বাইকে উঠছিল, ডাকলাম। টুকাইদা, কেমন আছ, কোথায় যাচ্ছ? ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার এক্তিয়ারবর্জিত, কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধনীতি নিয়ে আলোচনা করার থেকে অনেক বেশি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে টুকাইদার পার্সোনাল স্পেসের তোয়াক্কা না করা। টুকাইদা ছাদের দিকে মুখ তুলে বলল, আরে সোনা যে, কবে এলি, কদিন থাকবি, এই তো পোস্টাপিস যাচ্ছি, এসে রান্না বসাব। তখন ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করতেই হল, কী রাঁধবে? টুকাইদা বলল, সিম্পল। এদিকে ভাত বসিয়ে দেব, ওদিকে মাছের ঝোল। একজনের জন্য আর কী লাগে।

একা আমিই ডাকি না, আমাকেও অনেকে ডাকে। এ বারেই যেমন ফিরতি পথে দেড়শো পা হেঁটে দেড়শো টাকা বাঁচিয়ে উবারে উঠছি, বাজখাঁই বাইক এসে দাঁড়াল। কেমন আছিস? পরের পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডে আমার নামধাম, বরের নাম, বরের চাকরি সরকারি কি না, বাবাকে কবে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব ইত্যাদি খবরাখবর নিয়ে আবার ভটভটিয়ে পগারপার হল। আমার কোনও আইডিয়া নেই কাকে অতগুলো পার্সোনাল ইনফরমেশন দিলাম। তবে চিন্তা নেই, ইনি নির্ঘাত আমার পাড়ার অংশ। না হলে এই স্মার্টনেসে এত অনধিকার চর্চা করতে পারতেন না।

শ্যামলকাকু সাইকেল কাত করে এক পা মাটিতে ছোঁয়াল। আরে সোনামণি যে। কবে এলি?

বললাম। তুমি কোথায় যাচ্ছ?

এই তো ক্লাসে।

কীসের ক্লাস গো?

আকুপাংচার।

কী চার?

এমন নয় যে আমি কথাটা শুনতে পাইনি। বা কথাটা আমার অজানা। কিন্তু চেনাটেনা নির্ভর করে কন্টেক্সটের ওপর। এই যদি শ্যামলকাকু বলত যে সোনা, আঁকা শেখার ক্লাসের তদারকি করতে যাচ্ছি কিংবা লাফিং ক্লাবের, টপ করে গোটা বিষয়টা বুঝে ফেলতে পারতাম। আমাদের পাড়াতেও যে আকুপাংচার ক্লিনিক বসেছে, বসতে পারে, আমার মাথাতেই আসেনি।

কাকু বলল, আসিস একবার সময় হলে। ভালো জিনিস। অনেক কিছু সারিয়ে দেয়। বললাম, সুযোগ হলে সত্যি যাব।

অর্চিষ্মান চোখ গোল করল। যাবে নাকি সত্যি সত্যি?

বললাম, না রে বাবা না।

যা করবে ভেবে কোর। তাছাড়া ছুঁচ কে ফোটাবেন, তোমার শ্যামলকাকু নিজেই নাকি? বলে দন্তবিকশিত ইমোজি পাঠাল।

প্রথম কথা, হাসতে হলে পাটুলির লোককে নিয়ে হাসোগে, দ্বিতীয় কথা, শ্যামলকাকু আকুপাংচারের কোর্সটোর্স করেছে কি না জানে ও? চেনেই তো না।

কে বলল চিনি না। কাকিমার সময় দেখা হল তো।

তা বটে। মায়ের মৃত্যুর পর শ্যামলকাকু, পাড়ার অন্য আরও কাকু, জেঠু, কাকিমা, জেঠিমা, দাদা, পিসিদের সঙ্গে এসেছিল। দৌড়োদৌড়ি করে গাড়ি আনা থেকে মালাটালা আরও যা যা, শ্মশানে যাওয়া, আমাকে বসিয়ে সব ফর্মটর্ম ফিলআপ - শ্যামলকাকু করেছিল। কাকুর অর্চিষ্মানকে মনে না থাকলেও, অর্চিষ্মানের কাকুকে ভোলার কথা নয়। দিল্লি এসে খবর পেয়েছিলাম, লাইব্রেরিতে ক্লাবের পক্ষ থেকে মায়ের স্মরণসভার নেমন্তন্নটা বাবাকে শ্যামলকাকুই করতে এসেছিল।

নববাবু হারমোনিয়াম সারিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। চানটান করে এসে আবার ২০৪৮ খুলেছি, বিজলীদি বলল, একটু গাইবে না সোনা?

প্রথমটা লজ্জা লজ্জাই করছিল। এই বয়সে প্যাঁ প্যাঁ করে গলা ছাড়লে পাড়ার লোকে ভাববে সোনার আর্লি ভীমরতি সেট ইন করেছে। তার মধ্যে ভরদুপুর। বারোটা বাজতে যায়। ভেবে ভেবে একখানা লক্ষণগীত মনে পড়ল।

জাতি ওড়ব সম্পূরণ কহত, ধৈবত গান্ধার বাদী সমবাদী হোত।
তব কহত বুধ রাগ সুমধুর জন,করকে শুনাওয়ত দ্বিতীয় প্রহর দিন।

লজ্জাটজ্জা ভুলে গলা ছেড়ে গাইতে লাগলাম। হারমোনিয়াম বাজানোও সাইকেল চালানো আর সাঁতার কাটার মতো। কড়ি কোমল গোলাল না, আঙুলে আঙুল গিঁট পড়ল না।

সন্ধেবেলায় ছাদে উঠেছি, দেখি জেঠি বাগানের কলে বাটি টাইপের কী একটা ধুচ্ছে। ডাকলাম। জেঠি মুখ তুলল। গান গাইছিলি সোনা?

বেগুনি হলাম। ইস, জানালাটা বন্ধ করা উচিত ছিল। সব শোনা যাচ্ছিল গো? ভেরি সরি।

সরি কীসের? সকালে তুই যখন গাইছিলি, আমি কাজ করছিলাম। বুচি বলল, এত এনার্জি আজ? তখন মনে পড়ল। অন্যদিনের থেকে বেশি কাজ করে ফেলেছি। অথচ হাঁটুটাও টনটনাচ্ছে না। ভাবছি হল কী? তারপর বুঝে ফেললাম। অনেক বছর আগে এই জিনিসটা ঘটত বটে, সোনা গাইছে, আমি কাজ করছি। আজ দুপুরে তুইও গাইছিস, আমিও কাজ করছি দেখেটেখে সেই সময়টার হাঁটুটাও এসে উপস্থিত হয়েছে। নো টনটনানি।

বললাম, চা বসাচ্ছ? আসছি।

আয়। কাল আছিস তো?

আছি।

কালও গান করিস, আর জানালা খবরদার বন্ধ করিস না। বাটি ঝাড়তে ঝাড়তে ভেতরে চলে গেল জেঠি।

Comments

  1. কিছুদিন আগে বাড়ি গেছিলাম। সব পাড়ার একই গল্প, ফ্ল্যাট হয়ে হয়ে খালি জমি জমা সব ভরে গেছে, আমাদের ঠিক সামনের জেঠিমাদের একতলা বাড়ি, কুয়ো, সুপুরিগাছ সব বদলে গিয়ে একটা তিনতলা বাড়ি।
    অনেক নতুন লোকজন এসে গেছেন, যাদের সাথে পরিচিতি হয়নি। হলে হয়তো একই রকম পারিবারিক একটা আমেজ আসতে পারতো, কিন্তু সে সুযোগ নেই..কদিনের জন্যই তো যাই.

    আমাদের বাড়িতেও শুনলাম ঢেউ খেলানো নীল ঢাকনা বসবে। মনে আছে প্রথম যখন এই বাড়িতে এসেছিলাম, ছাদে যাবার সিঁড়িও ছিলোনা, তারপর সিঁড়ি হয়ে ছাদ যখন যাবার মতো হলো, লোডশেডিং, উল্কাবৃষ্টি এগুলো গোটা পাড়া ছাদেই কাটাতাম।

    অদ্ভুত ব্যাপারটা হচ্ছে, আকারের সাথে সাথে যেন মনে হলো আয়তনেরও বদল হয়ে গেছে। কেন যেন মনে হচ্ছিলো পাড়াটা ছোট হয়ে গেছে। খালি জায়গা একটু কমে গেছে ঠিকই। কিন্তু পুজো প্যান্ডেলের মোড়টা আরেকটু বড়ো ছিল, রাস্তাগুলো আরো চওড়া ছিল, এসব মনে হচ্ছিলো।
    তারপর বুঝতে পারলাম, আমিই ছোট ছিলাম, তাই সব বড়ো বড়ো লাগতো, এখন আমি বড়ো হয়ে গেছি। একটু।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী জানি, ফ্ল্যাটওয়ালা পাড়াগুলোও হয়তো পাড়া। আমার অভ্যেস নেই বলে কেমন কেমন লাগছে। আয়তনের অসুবিধেটা সত্যি। সবথেকে বেশি হয় স্কুলের নিরিখে। পুরোনো স্কুলে পারতপক্ষে যাই না, কিন্তু ছবি দেখেই বুঝতে পারি, কী ছোট ছোট সবকিছু। তখন কী রকম গ্র্যান্ড লাগত।

      Delete
  2. tomaar lekha ta amaa kachhe ekta alternate universe-er chhobi dekhay. duto parar modhye difference ta bodhoy distance-e mapa jaabe na. tar opor ami kono kaaleo karor shonge khub ekta jeche bakyo binimoy korini.

    kintu tao lekha ta pore mone holo ki jeno ekta phuriye gelo, jeta aar pawa jaabe na

    ReplyDelete
    Replies
    1. ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে, অর্পণ। বুঝে গেছি, আর কিছু শুরু হবে না কোনওদিন। এবার শুধু ফুরোনোর পালা। সেই ডক্টর সুস-এর কোটেশন আওড়াচ্ছি বসে বসে। ডোন্ট ক্রাই বিকজ ইটস ওভার, স্মাইল বিকজ ইট হ্যাপেনড।

      যা জড়ো হল, সেগুলোকে যত্ন করে বাকিটুকু কাটিয়ে দেব, ঠিক করেছি।

      Delete
  3. কি সুন্দর লিখেছ। পড়ে গলার কাছ টা কিরম ব্যথা ব্যথা করে উঠল। পুরনো লীলা মজুমদার পড়লে যেরম হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিম্ববতী, তোমার আমার প্রতি নির্ঘাত পার্শিয়ালিটি আছে। তাতে আমি খুশিই হচ্ছি। আর খুব বেশি লোকের নেই কি না। থ্যাংক ইউ। তোমার লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে সত্যি খুশি হলাম। এগুলো তো বানিয়ে লেখা না, সত্যি কথা। কাউকে স্পর্শ করলে তার উষ্ণতা লেখা পেরিয়ে আমাকেই ছোঁয়।

      Delete
  4. লেখা ভালো লেগেছে।

    ReplyDelete
  5. মন ভালো হল বলবো, না খারাপ হলো বলবো? জানিনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাড়ি গেলে আমারও এই ধোঁয়াশাটাই হয়, ঈপ্সিতা।

      Delete
  6. ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো লাগল। শেষকালে একটু গলা ব্যাথা চোখে জল এলো। আপনার পাড়া যুগ যুগ জিয়ো।

    গান দিল্লিতে গান না? গাইতে পারেন তো? কাল ভাইঝি গানের স্কুলের function দেখে এতো ভালো লাগলো! ভাইঝি এবার রিয়াজ কর শুনে শুনে পাগল হবে। যাই হোক , গান গাইতে পারাটা যে কতবড় blessing সেটা hopefully একটু বড় হলে বুঝবে।

    খুব ভালো থাকবেন। 2048 খেলে আঙ্গুল ব্যাথা করানোয় হাই-ফাইভ!

    ইন্দ্রানী

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আমার পাড়া আপনার অমরত্বের আশীর্বাদ পেয়ে খুবই খুশি হবে, ইন্দ্রাণী।

      দিল্লিতে গাই। একটা বিটকেল যন্ত্র আছে যাতে তানপুরা তবলা দুটো একসঙ্গে বাজে, তাতে। এ জিনিসের বিভিন্ন ভার্শান গত কুড়ি বছর ধরে আমি যেখানে যাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। এবার হারমোনিয়ামটা নিয়ে আসব। যত না গান করার সুবিধের জন্য, তার থেকে বেশি যন্ত্রটা কাছে রাখার জন্য। ওটার ভূমিকা আমার জীবনে অপরিসীম।

      ২০৪৮ যুগ যুগ জিয়ো।

      Delete
  7. কী যে ভালো লাগলো কুন্তলাদি লেখাটা। মানে ন্যাতানো ফতুয়া পরা টাইপ ভালো লাগা। তোমার অন্য ডাইমেনশনের পাড়া বেঁচে থাক। আর তোমার হারমোনিয়াম আর একা একা না থাকুক।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেরি করে উত্তর দিচ্ছি, প্রদীপ্ত। লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  8. তোমাদের পাড়াটা খুব ভাল , অনেকদিন ই লেখা পড়ে মনে হয়েছে। আমার অন্য অনেকের পাড়া পছন্দ ছিল, নিজের কোনোদিন পাড়া পছন্দমত হয়নি , হয় বাজে, নাহলে ঠিক আছে, খারাপ নয় ধরণের।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, সে আমাদের পাড়াতেও গোলমাল আছে, ঊর্মি। আমি এতদিন পর পর যাই, তাই শুধু ভালোটাই দেখার চেষ্টা করি। আমরা সবাই, আমাদের সবার পাড়াই উনিশবিশ।

      Delete
  9. হে বিস্মৃত পথযাত্রী,
    ভাবো অচেনা এ পথ কার
    হারানো আস্বাসের খোঁজে
    করো দিগন্ত পারাপার।

    হারায়নি, চেয়ে দেখো,
    আছে সে তোমারি অন্তর
    কালের হাত ধরে
    হয়তো সে রূপান্তর।

    সেদিনের মায়াময় ছবি
    সাদা কালো ক্যামেরায় তোলা
    স্নেহার্দ্র স্মৃতির তুলিতে
    আজ সে রঙিন চিত্রকলা।

    (লেখাটা পরে যে ফিলিংস আসছিলো, সেটাকে আরেকটু বাড়িয়ে চড়িয়ে, একটু কল্পনা লাগিয়ে, এইটা বানালাম। যেদিন পোস্টটা পড়ে এটা লেখা শুরু করেছিলাম, সেদিন একদুটো লাইন কিছুতেই ঠিক হচ্ছিলো না, আজ হয়ে গেলো।)

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক দেরি করে আপনার এত সুন্দর মন্তব্যের উত্তর দিচ্ছি, রাজর্ষি। কিছু মনে করবেন না। বাইরে বাইরে ছিলাম। আপনি আমার একটা ব্যথার জায়গা পাড়িয়ে দিলেন, কবিতা আমাকে চাবুক মারলেও বেরোবে না। কিন্তু দিস ইজ নট অ্যাবাউট মি। আমার পোস্ট পড়ে যে আপনার এমন সুন্দর একটা জিনিস লিখতে ইচ্ছে করেছে এবং পরিশ্রম করে সেটা লিখেছেন আবার অবান্তরে এসে সেটা আমাকে পড়িয়েছেন এ জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। সত্যি মন ভালো হল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. অরে, কবিতা আমিও প্রচুর বিফল চেষ্টা করেছি।
      এখন মনে হচ্ছে, শুরুতেই শেষের কবিতা লিখে ফেলার চেষ্টা করতাম বলে হয়তো হত না। তার থেকে এরম একটু শব্দ মেলানোর সহজ অনুশীলন হোক বরং আগে।

      Delete

Post a Comment